কান্না হাসির খেলা। (#2)
[HIDE]আমি আলতো করে দু’কাঁধ ছুঁয়ে রাস্তার মাঝে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি, চিবুকে তর্জনী ঠেকিয়ে আলতো করে ওর সুন্দর চেহারা তুলে ধরি। দু’চোখ বন্ধ, চোখের পাতা সুন্দর করে সাজানো লম্বা পালকে, আমি তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টে ঐ সুন্দর মুখপানে। ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে, আসন্ন কিছু আশার আকাঙ্খায়। হাত দুটি ভাঁজ করে বুকের ওপরে রাখা, শাল গায়ের সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে। আমি একটু ঝুঁকে যাই ওর সুন্দর মুখের ওপরে আমাদের ঠোঁট জোড়া খুব কাছে। আমি সারা মুখে ওর উষ্ণ প্রশ্বাস অনুভব করি, এত কাছে দাঁড়িয়ে আমরা, আমি যেন ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পাই। বুকের মাঝে উত্তাল তরঙ্গ বারংবার আছাড় খাচ্ছে যেন, পরীর বক্ষদ্বয় নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে ক্রমাগত ওঠানামা করছে আমার চোখের সামনে। দৃষ্টি থেকে থেকে আটকে যায়, বুকের খাঁজে। আমি মাথা নামিয়ে নিয়ে আলতো করে নাক দিয়ে ওর নাক ছুঁই, দু’জনেই ঘেমে গেছিলাম। ওর নাকের ঘাম আমার নাকে স্পর্শ করে, কেঁপে ওঠে পরী। ঠোঁট দুটি স্পর্শ করার প্রবল কামনা জাগে মনের গভীরে। পরী দাঁড়িয়ে, যেন কিছু শুনতে চায় আমার কাছে কিংবা নিবিড় চুম্বনের অধীর অপেক্ষায়। আমি সাহস যোগাড় করে উঠতে পারিনা সেই চুম্বনটি আঁকার জন্য।
এমন সময় হটাৎ করে পরী চোখ খোলে। দু’নয়নে অশ্রু টলমল করছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, নাকের ডগা লাল। ধরা গলায় বলে ওঠে “না, না। এটা সম্ভব নয় অভি। তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।” মাথা নামিয়ে, চোখে জল নিয়ে আমার সামনে থেকে দৌড়ে চলে যায় পরী।
আমি দাঁড়ায়ে একলা, সেই রাতের অন্ধকারে। বুকে মধ্যে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পরে। নিজেকে খুব একা মনে হয়, যেন এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি যেন অজানা এক গ্রহে হারিয়ে গেছি। একটা সিগারেট ধরাই আমি। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরতে থাকে, “আমি কে? আমি কি? কে এই অভিমন্যু?” বুকের কোন এক কোনা থেকে উত্তর আসে “জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক মানুষ, তুমি” আমার দু’চোখে জল চলে আসে, সেটা কি সিগারেটের ধোঁয়ায় না পরাজয়ের, জানিনা বা জানতে চেষ্টা করিনি আমি। আমার কি অধিকার আছে কারুর সন্মান কারুর ধারনা অথবা অনুভুতিকে যন্ত্রণা দেবার। আমার কোন অধিকার নেই, শুচিস্মিতার কে অসম্মান করার বা তার হৃদয়ে যন্ত্রণা দেবার। আমি হেরে গেছি এই পৃথিবীতে, নিজের কাছে। আমি আমার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ার প্রেমে পড়েছি, সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমাদের সম্পর্ক সমগ্র সভ্যতার চোখে নিষিদ্ধ। আমাদের এই সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় জীবনে, তাকে এড়িয়ে কি করে জীবন কাটানো সম্ভব? কিছুতেই সেটা সম্ভব নয়।
বিধ্বস্ত পরাজিত, বুকের মাঝে এক তোলপাড় নিয়ে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াই। ঠিক সেই সময়ে আমাকে কেউ ডাক দেয়, মাথা উঠিয়ে দেখি, সুব্রতর এক বন্ধু আমাকে ডাকছে। বিয়ের পালা শেষ, বর কনে এবারে খেতে বসবে তাই ডাক পড়েছে আমার।
প্যান্ডালে ঢুকে দেখি, পরী এক কোনায় মাথা নিচু করে এক দৃষ্টিতে নিভে যাওয়া আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। নাকের ডগা লাল চোখের পাতা ভারী, চোখের কোনে জল। মনে হল ফুঁপিয়ে কাঁদছে, থেকে থেকে মৃদু ভাবে পিঠ ওঠানামা করছে। আমি প্রমাদ গুনলাম, আমি কেন এলাম, কেন ওকে কাঁদিয়ে দিলাম। যা ঘটে চলেছে সেটা ঠিক না ভুল জানিনা।
এমন সময়, কনের মা এসে পরী কে জিজ্ঞেস করে “কি হল, একা একা কেন বসে? তোমাকে সবাই খাওয়ার টেবিলে খুঁজছে। তোমার নতুন বউদি তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করে বসে আছে।”
ডাক শুনে, পরী সোজা হয়ে বসে, চোখের জল মুছে মিষ্টি হাসে। কনের মা, ওকে নিয়ে খাবার জায়গায় ঢুকে পরে। আমি ও পেছন পেছন ঢুকে পড়লাম খেতে। ঢুকে দেখি, ও নতুন বউয়ের পাশে বসে বেশ গল্প করছে হাসছে। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল যে সেই পুরানো নারী, যে এইখানে এসেছিল, সে যেন হারিয়ে গেছে। আমি একটা কোনায় বসে চুপ করে খাওয়া সেরে নিলাম। পুরো সময়টাই কেউ কারুর দিকে তাকাই নি।
খাওয়া দাওয়া শেষে, সবাই যে যার নিজের কাজে চলে যায়। বর কনে কে নিয়ে সুব্রতর বন্ধুরা বাসর জাগতে চলে গেল। পরীকে সাথে নিয়ে কনের মা চলে যান।
আমি একা একটা চেয়ার টেনে বিয়ের জায়গায় বসে থাকি। ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা কিন্তু আমার যেরকম মনের অবস্থা, তাতে ঠাণ্ডা বিশেষ লাগেনা। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে, নিভে যাওয়া আগুনের থেকে নির্গত ধোঁয়ার পানে এক ভাবে চেয়ে বসে থাকি। মাথার মধ্যে যেন কিছুই নেই, কোন চিন্তা নেই একদম খালি।
জানিনা রাত কটা বাজে, ঘড়ি থাকলেও সেটা আর দেখা হয়ে ওঠেনা। এমন সময়ে নাকে এসে লাগে জুঁই ফুলের গন্ধ, কাঁধে ওপরে আলতো ছোঁয়া, এসেছে তাহলে আমার কাছে, আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো আর আসবে না। আমি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসার ইশারা করি। পরী চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার সামনে বসে পরে। ভাবলেশহীন চোখে ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকি। ওর লাল ঠোঁটে মিষ্টি একটা বাঁকা হাসি মাখা।
আমায় জিজ্ঞেস করে “ঠাণ্ডা লাগছে?”
অনেক ক্ষণ পরে ওর আওয়াজ শুনে মনে হল যেন কিছু ফিরে পেলাম আমি। মাথা নাড়াই “হ্যাঁ ঠাণ্ডা তো লাগছে।”
“আমি আর একটা শাল এনেছি তোমার জন্য।”
“আমার শাল টা আমাকে দেবে না?”
মাথা নাড়িয়ে চোখে হাসে মাখিয়ে বলে “না, এই শাল আমি দেব না, এটা আমার। চিরদিনের জন্য আমার।”
মৃদু হেসে বলি আমি “ঠিক আছে, আমার রানীর যা ইচ্ছে তাই হোক।”[/HIDE]