সুইজারল্যান্ডে নিশানা ভেদে মগ্ন দিয়া সিদ্দিকী, ছবি ওয়ার্ল্ড আর্চারির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
মেয়ে দিয়া সিদ্দিকী চিকিৎসক হবে, সেই স্বপ্ন দেখতেন বাবা নূর আলম সিদ্দিকী। কিন্তু কে জানত দিয়া এভাবে খেলার মাঠে আলো ছড়াবেন?
আন্তর্জাতিক আর্চারিতে বাংলাদেশের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে দিয়া সিদ্দিকী জিতেছেন বিশ্বকাপে রুপার পদক। গত ২৩ মে সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ আর্চারির স্টেজ–টুয়ে রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সোনা জেতা হয়নি দিয়ার। তবে রোমানকে সঙ্গী করে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে বিরল এক কীর্তিই গড়েছেন নীলফামারীর তরুণী। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে কালেভদ্রেই যে ওঠেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা!
নীলফামারী জেলা সদরে দিয়াদের বাড়ি। তাঁর বাবা নূর আলম সিদ্দিকী একটি বেসরকারি টেলিভিশনের নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি। মেয়েকে আদর করে ‘বাবা’ বলে ডাকেন নূর আলম। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় বলে ছোটবেলা থেকেই একটু বাড়তি আদর পেয়ে এসেছেন মা–বাবার। কিন্তু মেয়ে হয়ে খেলাধুলা করুক, তা তাঁর বাবা ছাড়া পরিবারের কেউই চাইতেন না। দিয়া বলেন, ‘বাবা আমাকে সমর্থন না দিলে হয়তো আর্চারি খেলাই হতো না।’
দিয়া সিদ্দিকী
দিয়া বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন। নীলফামারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় শরীরচর্চা শিক্ষক খাইরুল ইসলাম দিয়ার উচ্চতা (৫ ফুট ৪ ইঞ্চি) দেখে তাঁকে নিয়ে আসেন আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণের ক্যাম্পে।
ঢাকা থেকে নীলফামারী যাওয়া আর্চারি ফেডারেশনের ওই বিশেষ ক্যাম্পে দিয়ার ডাক পাওয়ার ঘটনাটা ছিল মজার। সেদিনের ঘটনাটা স্মৃতি হাতড়ে দিয়া বলছিলেন, ‘ক্যাম্পে অন্যরা ধনুক হাতে নিলেও আমাকে সেই সুযোগটা একদমই দিচ্ছিলেন না স্যার। আমাকে ট্রায়ালের সুযোগ না দিয়েই স্যার বললেন, “তুমি ক্যাম্পে নেই।” আমি বললাম, কেন স্যার? আমাকে সুযোগ না দিয়েই বাদ দিলেন কেন? আমার কথা শুনে স্যার শেষ পর্যন্ত আমাকে সুযোগ দিয়েছিলেন। আমি ক্যাম্পে বাছাইয়ে টিকে গেলাম।’
এরপর দিয়া টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে আসেন। সেখান থেকে বিকেএসপিতে ট্রায়াল দেন। এরপর বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলে ২০১৬ সালে।
কিন্তু নীলফামারী থেকে বিকেএসপিতে গিয়ে পড়াশোনা করবে মেয়ে, সেটা পরিবারের কেউ মানতে চাননি। এবারও এগিয়ে আসেন বাবা নূর আলম। মেয়ের ওপর কখনো আস্থা হারাননি তিনি। বলছিলেন, ‘আমি জানি, মেয়ে যেখানেই যাবে, পড়াশোনাটা ঠিকমতো করবে। বিকেএসপিতেও ঠিকই খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাটা চালিয়ে নিয়েছে ও।’ অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন দিয়া।
প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের অভিষেকে বাজিমাত করেন দিয়া। টঙ্গীতে ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের অভিষেকে জেতে রিকার্ভের মেয়েদের এককের সোনা। এরপর বিশ্বকাপে রুপা।
এত দূর আসার পেছনে কোচদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই দিয়ার, ‘জাতীয় দলের কোচ মার্টিন স্যার (মার্টিন ফ্রেডরিখ), বিকেএসপির কোচ নূর আলম, জিয়া স্যার (সহকারী কোচ জিয়াউল হক) সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
বিশ্বকাপে দিয়ার পারফরম্যান্স দেখে বিদেশি তিরন্দাজসহ অনেকের মুখে ঝরেছে প্রশংসার ফোয়ারা, ‘সেখানে আমি অনেকের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমাদের আগের কোচ রিচার্ড স্যার (যুক্তরাজ্যের কোচ ও জাতীয় দলের সাবেক কোচ রিচার্ড প্রিয়েস্টমান) বলছিলেন, “আমি শুরু থেকেই খেয়াল করেছি তুমি খুব ভালো খেলেছ।” এমনকি আশপাশের স্বেচ্ছাসেবকেরাও আমার খেলা দেখে বলছিল, বেস্ট অব লাক।’
২১-২৭ জুন ফ্রান্সে হবে বিশ্বকাপ আর্চারির স্টেজ থ্রি। একই সঙ্গে যেটি অলিম্পিকের বাছাইপর্ব। দিয়া স্বপ্ন দেখছেন অলিম্পিকে খেলার, ‘যেকোনো অ্যাথলেটের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন অলিম্পিক। আমিও সেই স্বপ্ন দেখি। রোমান ভাই অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। আমি তাঁর খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হই সব সময়। তাঁর মতো আমিও অলিম্পিকে খেলতে চাই।’
বিশ্বকাপে রুপা জিতে যে স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছেন দিয়া, সেই পথচলা থামাতে চান না। দিয়ার তির-ধনুকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশও।