স্নিগ্ধতা একা আসবে বলেছিল, ও নিয়ে এসেছে সাথে এক বান্ধবীকে। সেমিস্টার ব্রেক চলছে, কেউ ঘুরতে গেছে বান্দরবন , কেউ সিলেট, কেউ খুলনা- আমরা অভাগা কয়েকজন ঢাকাতেই বসে আছি, কুত্তার মত ঘুরছি চারুকলা থেকে মুক্তি ও গণতন্ত্র। পকেটে টাকা পয়সা নেই, মনকে বলেছি, "এসব খুলনাটুলনায় তো ট্যুর দেয় গরিবেরা, আমি শালা টাকা কামিয়ে প্যারিস বন হেগ ট্যুর দেব!"
স্নিগ্ধতার বান্ধবীরাও সবাই কোথাও না কোথাও গেছে ঘুরতে, ওর বাবার টাকার অভাব নেই কিন্তু বাড়ি থেকে পার্মিশন মেলেনি। সেও আমার মত সকালে ক্যাম্পাসে এসে ফ্যাফ্যা করে ঘুরছে।
স্নিগ্ধতা এসেই বলল, "এ আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড প্রজ্ঞা। আর এ আমার খুব ভাল বন্ধু দ্রোহ!"
প্রজ্ঞা আমার সাথে হ্যান্ডশেক করল। স্নিগ্ধতা বলল, "বলাকায় ন'ডরাই দেখাচ্ছে, দেখতে যাবি?"
বললাম, "রাতে খেতে পাবো কিনা সেটা বাল জানি না আর তুই বলছিস সিনেমা দেখতে! তাও আবার আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা!"
প্রজ্ঞা বলল, "কেন?"
"যে ছেলেটাকে পড়াতাম, তার বাবার চাকরি চলে গেছে! সাফ জানিয়ে দিয়েছে, টাকা দিতে পারবে না! টাকা দিলে কি আর এখানে পড়ে থাকতাম। ঘুরতে যেতাম সুন্দরবন!"
প্রজ্ঞা বলল, "তাহলে ধার নাও আমার কাছে!"
আমি প্রজ্ঞার দিকে তাকালাম এবারে। পিচ্চি একটা মেয়ে, লম্বায় বড় জোর পাঁচ ফুট হবে। মাথার ঘন কাল রাত্রির মতো, চুলের মাঝে শুভ্র মুখটা ফুটে আছে সূর্যমুখীর মত। চেনা চেনা লাগছে, যেন কোথাও দেখেছি। সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই আমার চেনাচেনা লাগে ইদানীং।
বললাম, "যদি ধার নিয়ে ফেরত না দেই? তুমি তো ভালোভাবে চেনো না আমাকে!"
প্রজ্ঞা ফিক করে হেসে বলল, "ফেরত না দিলে স্নিগ্ধতার কাছ থেকে নেব!"
স্নিগ্ধতা বলল, "আচ্ছা, তোর টিকেটের টাকা আমি দিচ্ছি। তুই চল।"
অগত্যা চললাম বলাকা অভিমুখে। যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া হয় না, পেরুতে হয় নীলক্ষেতে ঠ্যালাঠ্যেলি। ফ্লাইওভারের নিচে এমন অবস্থা হলো যে সামনে আর এগুনো যায় না। দেশের জনসংখ্যা যে আসলেই বিশ কোটি ছাড়িয়েছে, বোঝা যায় নিউমার্কেটে এলে। পিঁপড়ার মত পিলপিল করছে মানুষ- লক্ষ্য জামাকাপড় কসমেটিক্স; হকার দখল করে নিয়েছে ফুটপাত। একটু এদিক ওদিক তাকালেই ধাক্কা খাও সামনে থেকে ষাঁড়ের মত তেড়ে আসা জনস্রোতের সাথে!
+
স্নিগ্ধতাকে বললাম, "এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। বাংলাদেশে জন্মেছিস, ভিড় ঠেলাটা শিখতে হবে!"
প্রজ্ঞা বলল, "আমার ন'ডরাই দেখার ইচ্ছা নাই, ভাই। আমি ঐ ভিড়ের মধ্যে যেতে পারব না!"
বড়লোকের খুকী দুটি! নেইলপলিশ থেকে ব্রা পর্যন্ত কিনেছে মল থেকে। নিউমার্কেটে লোকের সাথে ধাক্কাধাক্কি করার অভ্যাস তো আর নেই।
[HIDE]
বললাম, "পক্ষিকূলে জন্ম নিয়েও উড়াল শিখলো না !"
প্রজ্ঞা আমার দিকে উত্তপ্ত মুখে তাকিয়ে বলল, "আমি যাব। এ আর এমন কিছু ভিড় হলো! এত লোক পারছে, আমি পারব না"
যেন আমাকে দেখাতেই হনহন করে হাঁটতে লাগল প্রজ্ঞা। ঠ্যালাঠেলি করে পৌঁছেও গেল ওপারে, পিছনে আমি আর স্নিগ্ধতা।
ঠিক বলাকার সামনে থেমে বলল, "আমিও পারি বুঝলে। আমি এখন আর কচি খুকী নই!"
সামান্য এই ধাক্কাধাক্কিতেই ঘেমে গেছে প্রজ্ঞা। পরিপক্ব আমের মত ঈষৎ লাল হয়ে গেছে মুখটা। ওর এমন নিষ্পাপ মুখটার সাথে রাগী ভাবটা ঠিক যায় না। হাসি পেল আমার।
বললাম, "আমি কি বলেছি নাকি তুমি কচি খুকী! এমন ভাব করছো যেন ভিড় না বরফ ঠেলে জয় করেছো এভারেস্ট!"
এতকিছুর পরও আমাদের ইমপ্রেস করতে না পেরে বোধহয় হতাশ হলো প্রজ্ঞা। কিছু না বলে ঢুকে পড়ল সিনেমা হলে।
টিকেট তিনটা স্নিগ্ধতাই কাটল। বলল, "ন'ডরাই দেখার ইচ্ছা যেহেতু আমার, তাই আমিই টাকা দিচ্ছি!"
স্নিগ্ধতা এক্কেবারে ফার্স্টক্লাসের টিকিট কেটেছে। এসিতে। এসি আমার সহ্য হয় না। এমনটা নয় যে, এসিতে থাকতে অস্বস্তিকর লাগে। কিন্তু এসিতে সিগারেট টানা যায় না! সিগারেট নিষিদ্ধ এমন যেকোনো জায়গাতেই আমার অস্বস্তি লাগে। মনে হয়, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এসব জায়গায় কোন ক্রিয়েটিভ মানুষ থাকতে পারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা?
ফার্স্টক্লাস পুরো ফাঁকা, আমরাই তিনজন শুধু সুতরাং যা ইচ্ছে করতে পারি। আমি একটা চেয়ার টেনে পা তার উপরে উঠিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, "জমিদারের মত লাগছে রে! যেন স্পেশাল স্ক্রিনিং হচ্ছে!"
প্রজ্ঞা কিছু বলল না। সিগারেটের ধোঁয়ায় ওর কুচকে গেছে নাক।
"আমার টাকায় জমিদারি ফলাচ্ছিস কেন? শালা পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা সরা!", হাসিমুখে বলল স্নিগ্ধতা। নামটাই শুধু স্নিগ্ধতা ওর, মুখে তার ছিটেফোঁটাও নেই। প্রজ্ঞা হাসতে লাগল।
সিনেমাটা দেখার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। বুঝলাম না কিছুই। পুরো সিনেমা চট্টগ্রামের আঞ্চলিকে- মনে হচ্ছে ম্যান্ডারিন দেখছি। সিনেমাটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে খুব। বুঝছতেই পারছি না, আলোচনায় অংশ নেব কী!
+
স্নিগ্ধতা আর প্রজ্ঞা কী আর জিনিস নিয়ে হাসাহাসি করছে। ওরা বসেছে খানিকটা দূরে, পাশাপাশি। হঠাৎ কেউ এলে, বুঝতে পারবে না, একসাথে এসেছি আমরা।
"হাসছিস কেন রে?", প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার প্রশ্নে হাসি বেড়ে গেল ওদের। যেন আমার কিছু দেখেই ওরা হাসছে, প্যান্টের চেনটেন খোলা নেই তো! দুটো মেয়ে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে, আপনি জানেন না ওরা আপনাকে নিয়ে হাসছে কিনা, এর চেয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
শেষে বাধ্য হয়ে আশপাশে উপরে নিচে তাকালাম। দেখলাম আবছা-আবছা- হল তো অন্ধকার, নিচের পিছনের সারিতে একটা কপোল চুম্মাচাটি করছে, ছেলেটা সুযোগ পেয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে মেয়েটির থ্রি-পিছের ভেতর। এতোটাই উত্তেজিত ওরা যেন এখানেই শুরু করে ফেলবে, কাউকে পরোয়া না করে!
এদিকে এরা হাসতে হাসতে খিল। বললাম, "এটাতে এত হাসার কী আছে? যেন তোরা রিক্সায় টেপাটেপি করিসই না! তোদের বয়-ফ্রেন্ড তোদের ওয়াজ শোনায় ফাঁকা রুমে!"
আমার কথায় ওরা- প্রজ্ঞা আর স্নিগ্ধতা আরও জোরে হাসতে লাগল। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দুই তরুণীর হাসি সিনেমাহলের দেয়ালে দেয়ালে। হাসির শব্দেই কিনা জানি না, ছেলেটা টুক করে হাত বের করে ফেলল মেয়েটার ওড়নার ভেতর থেকে!
স্নিগ্ধতা হাসি সামলিয়ে বলল, "এই চুপ। ছেলেটা হস্তশিল্প বন্ধ করেছে। ডিস্টার্ব করে ফেললাম বোধহয়! না হলে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, ওরা এখানেই লাগাতো!"
বলেই আবার হাসিতে ফেটে পড়ল প্রজ্ঞা। তবে এবার মুখে হাত দিয়ে শব্দ না করে।
+
স্নিগ্ধতা বলল, "আমি বাবা কোনদিন এমন ওপেন জায়গায় এসব পারব না!"
বললাম, "বদ্ধ জায়গায় তো পারবি? এদের হোটেলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, এখানেই মেকাউট করছে!"
প্রজ্ঞা এবার ফুঁসে উঠে বলল, "হে লিসেন, আমরা হোটেলেও যাই না! এসব লেকচার অন্য কাউকে দিও! সবাই তোমার মত চরিত্রহীন নয়!"
[/HIDE]