করোনায় আক্রান্ত হয়ে আজ রাত ১২টা ২০ মিনিটে মারা গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ও সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি এক বিরল নক্ষত্রের নাম। ‘সুতরাং’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অথবা ‘সারেং বৌ’। ইতিহাস সৃষ্টি করা বহু ছবিতে অভিনয় তাঁকে নিয়ে গেছে ঈর্ষণীয় এক উচ্চতায়। গুণী এই অভিনেত্রী ২০১৬ সালে পেয়েছিলেন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। কবরীকে নিয়ে সে সময় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো...
‘আপা, এমন কিছু দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই, যা পাঠকেরা জানেন না। বলেন না তেমন কিছু!’
প্রশ্ন শুনে চোখ দুটি বড় বড় করে তাকালেন কবরী। এবং হাসলেন। সেই হাসি, যে হাসির কারণে তিনি ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে দর্শকের মন অধিকার করে রেখেছেন।
‘কী নিয়ে বলব?’
‘প্রেম নিয়ে কিছু বলা যায় না?’
‘একটা মিষ্টি ঘটনা শুনবে?’
মিষ্টি একটি গল্প
শোনো তবে। ২০০৭ সালে একটা উৎসবে গেছি জার্মানির হামবুর্গে। ছেলে শাকের ছিল সঙ্গে। পথের ক্লান্তিতে শাকের ঘুমিয়ে পড়েছে রুমে গিয়ে। আমি লবিতে। ২৭-২৮ বছর বয়সী একটা জার্মান ছেলে দেখি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। ওকে দেখে আমার মনও কেমন যেন করে উঠল। ছেলেটা একটু পর আমার কাছে এসে ইংরেজিতে বলল, ‘আমি এই হোটেলের মালিকের ছেলে। তুমি কি টাকা চেঞ্জ করতে চাও? একটু ঘুরতে চাও?’
কবরী তখন। ছবি: ‘কবরীর চার দশকের একক প্রদর্শনী’ থেকে সংগৃহীত
আমার কিন্তু ভালো লেগে গেল ছেলেটাকে। ওর সঙ্গে গিয়ে ডলার ভাঙিয়ে এলাম। একটু ঘুরলামও। ঘরে এলে ছেলে অবাক হয়ে বলল, ‘মা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ ওকে বললাম ঘটনাটা। আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, জার্মান ছেলেটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
পরদিন ছেলেটা বলল, ‘তোমাকে নিয়ে ডিনারে যেতে চাই।’
বললাম, ‘যেতে পারি, কিন্তু আমার ছেলেকেও নিয়ে যাব।’
ছেলেটা বুঝি একটু দমে গেল। কিন্তু রাজি হলো। বলল, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আসবে আমাদের নিতে। আমি খুব সেজেগুজে বসে থাকলাম। সাড়ে সাতটা, আটটা, নটা, দশটা বেজে গেল, কিন্তু সে আর এল না। আমার ছেলেও কোথায় চলে গেল কে জানে। রাগ করে আমি পোশাক পাল্টে ঘুমুতে গেলাম। পরদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, শাকের আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তো জার্মান ছেলেটার গুষ্টি উদ্ধার করার জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু শাকের বলল, ছেলেটা নাকি সাড়ে সাতটাতেই এসেছিল। শাকের ওকে বলেছে, ‘মা ঘুমাচ্ছে। চলো, আমরা দুজন ডিনার করে আসি।’
এটুকু বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন কবরী। বললেন, ছেলেটা কিন্তু আমাকে ভালো বেসে ফেলেছিল। ওদের দেশে তো অসমবয়সী প্রেম হয়!
তারপর যেন আপনমনেই বললেন, ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু একসময় আবিষ্কার করেছি, এদের অনেকেই হীনম্মন্যতায় ভুগছে, উদার নয়। আমি কিন্তু গলা পর্যন্ত নেমেছি, তারা হাঁটুজলেও নামেনি। ভালোবাসার তো কত রূপ। তবে এটা বলি তোমাকে, ট্রাডিশনাল প্রেম বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছু আমার জীবনে ঘটেনি।
২০১৩ সালে জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত ‘কবরীর চার দশকের একক প্রদর্শনী’তে
সেই মেয়েটা
মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায় হাসিতে। টেলিভিশন যে ঘরটিতে, সেই ঘরে অনেকগুলো ছবির মধ্যে একটি ছবি যেন তাঁর ‘মিষ্টি মেয়ে’ পরিচিতির সিলমোহর। এখনো ঘিয়ে রঙা শাড়িতে তো সেই মেয়েটাকেই দেখছি, যিনি কিনা ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে অনায়াসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সরল চেহারা, সেই সরল হাসিই তাঁকে আলাদা করেছে অন্যদের থেকে।
প্রথম নায়ক সুভাষ দত্তকে ভয় পেতেন। যদিও সুতরাং ছবির নায়িকা এই ছোট্ট মেয়েটাকে খুব আদর করতেন সুভাষ দত্ত, কিন্তু শাসনও কম করতেন না। ঠিক উচ্চারণে সংলাপ বলা শেখাতেন তিনি।
আর জহির রায়হান? হ্যাঁ, জহির রায়হানের বাহানা নামের ছবিতেই শুধু কাজ করেছেন কবরী। কিন্তু যোগাযোগ ছিল। জহির বলতেন, ‘বিবিসি দেখো, ইংরেজি বই পড়ো।’ আর খান আতা যেন হাতে ধরে শিখিয়েছেন সব কাজ। ধমক দিতেন যেমন, আদরও করতেন তেমনি। চলচ্চিত্রের অনেক খুঁটিনাটি খান আতার কাছ থেকেই শেখা।
সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্তের সঙ্গে, রাজ্জাক ও কবরী,, জাফর ইকবালের সঙ্গে, সারেং বউ ছবিতে ফারুকের সঙ্গে, তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে, দেবদাস ছবিতে বুলবুল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন (মাঝে) ও কবরী
নানা রকম রান্না
‘কোন ছবিটি মনে গেঁথে আছে? কোন চরিত্র?’
একটু সময় নিলেন ভাবার জন্য। তারপর বললেন, ‘আসলে এখানে যে ছবিগুলো হয়, তা তো একটা ঘরানার। প্রায় সব ছবি তৈরি হয় একই ধরনে। মানে ধরো, আমাদের এদিকের যে রান্নাবান্না, তাতে হয়তো কেউ মসলা একটু কম দেয়, কেউ একটু বেশি। কিন্তু যা-ই রাঁধো না কেন, তাতে হলুদ, মরিচ, আদা—এ ধরনের মসলা থাকবেই। আবার হলিউডের ছবিগুলো কিন্তু ভিন্ন মসলায় রান্না হয়। সেটা আবার অন্য ঘরানার। বৈচিত্র্য লেগেছিল ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে কাজ করতে গিয়ে। এই এক পরিচালক, যাঁকে মনে হয়েছিল এক অজানা ঘরানার কেউ। তাঁর সেটে আমি যেন অন্য মানুষ।’
কবরীর নায়কেরা
রাজ্জাক-কবরী জুটি গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এ জুটির নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি, দর্পচূর্ণ, স্মৃতিটুকু থাক, রংবাজ, বেঈমান, কাঁচকাটা হীরেসহ অসংখ্য ছবি আছে, যা দর্শক-মন ছুঁয়েছে। একটি দারুণ ব্যাপার হলো নায়ক উজ্জ্বল, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক ও জাফর ইকবালের প্রথম ছবির নায়িকাও কবরী। ফারুকের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুজন সখী ও সারেং বৌ ছবি দুটো করেও নাম কুড়িয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় ছবিটির জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। কবরী অভিনীত আরও কয়েকটি মনে রাখার মতো ছবি হলো সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, মতিমহল, বিনিময়, দেবদাস।
কবরী: যখন শুরুর সময়। সংগৃহীত
টুকরো প্রশ্ন, টুকরো উত্তর
রাজনীতি করলেন। সাংসদ হলেন। এখন কি খুব ব্যস্ত?
‘না। এখন তো আর সংসদ সদস্য নই। কিন্তু মানসিকভাবে ব্যস্ত। আত্মজীবনী লিখছি। গল্পের আকারে। কখনো শুটিংয়ের কথা, কখনো ব্যক্তিজীবনের কথা, কখনো সামাজিক অনুষঙ্গ...’
‘ছেলেরা কেমন আছে?’
‘ওরা পাঁচজনই ভালো আছে। বড় ছেলে অঞ্জন যুক্তরাষ্ট্রে। মেজো ছেলে রেজওয়ান দুবাইতে। সেজো ছেলে শাকের আছে ইংল্যান্ডে, এর পরেরটা জয়নাল চিশতী কানাডায়। ছোটটা, মানে শানও কানাডায় ছিল, এখন ঢাকায়।’
‘রান্নাবান্না করেন?’
‘বাঙালি রান্না করি। ছেলেরা বলে, “মা, তোমার হাতে জাদু আছে”।’
‘বই পড়েন?’
‘বই পড়ি মানে? সুতরাং-এ অভিনয় করার আগেই কড়ি দিয়ে কিনলাম পড়েছি। বিমল করের ওই মোটা বইটা। কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি। আশুতোষ, শীর্ষেন্দু, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা দেবী, কত বই পড়েছি। বই পড়তে আমার ভালো লাগে।’
বসার ঘরে সত্যজিৎ রায়ের ওপর একটি আর জয়নুল আবেদিনের ওপর একটি বই রাখা আছে। সুযোগ পেলেই সেই বই দুটো পড়ছেন এখন।
‘গান ভালো লাগে?’
‘রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাসনের গান তো ভালো লাগেই। টম জোনসের গানের পাগল আমি। কিছুদিন আগে জ্যাজ শুনলাম, খুব ভালো লাগল।’
‘সিনেমার গানের মধ্যে পছন্দের কিছু আছে?’
‘‘‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়”, “প্রেমের নাম বেদনা”। আর “ওরে নীল দরিয়া” গানটা আমার খুব পছন্দ।’
মনে করেন, এখনো আপনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। নায়ক হিসেবে কাকে বেছে নেবেন?
‘গ্রেগরি পেক।’
‘কোন চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছে হয়?’
‘শওকত ওসমানের “জননী” করতে চেয়েছি। সে এক অসাধারণ জটিল চরিত্র। বিধবা নারীটি গর্ভবতী হয়। নিজের সন্তানদের বাঁচানোর জন্যই সে এটা করেছে।’
এমন মিষ্টি মেয়ের দেখা খুব কমই পেয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা
প্রেম
বালিকাবেলায় কবরীর প্রেমে পড়েছিলেন চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক। খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কবরীকে ভুলতে পারেননি কখনো। ২০১১ বা ’১২ সালে কবরী একবার চট্টগ্রামে গেছেন কোনো এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এক তরুণ এসে বললেন, ‘আপনি কি আমাদের বাড়িতে একবার আসবেন? আমার বাবা আপনাকে যেতে বলেছেন।’ গেলেন কবরী। সেই বাড়ির সবাই কবরীতে মুগ্ধ। সেই ভদ্রলোকের ছেলেবউ এসে বললেন, ‘শ্বশুরমশাই তো শুধু আপনার কথাই বলেন সব সময়।’ এই সেই ভদ্রলোক, যিনি প্রায়-শিশু কবরীর প্রেমে পড়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় ভদ্রলোক কবরীর ফোন নম্বর রেখে দিলেন। গাড়িতেই ফোন। মেজাজ খারাপ হলো কবরীর। এরপর তিন দিন বাদেই আবার ফোন। একবার নয়। বারবার। ধরলেন না কবরী। দিন সাতেক পর আবার ফোন। বারবার। এবার বেশ মেজাজ খারাপ করেই কবরী ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো, বলুন!’
‘আন্টি, এটা আমি। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন দিন পরই বাবা মারা গেছেন। আপনাকে ফোন করেছিলাম তখন!’ খবরটা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি হারিয়ে গেলাম ছোটবেলার স্মৃতিতে।
এ রকম অনেক ঘটনা আছে মিষ্টি মেয়ে কবরীর। চলচ্চিত্রের মতোই এ রকম অনেক আনন্দ-বেদনার গল্প নিয়েই তিনি কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন। আমরা অপেক্ষায় আছি, কবে বের হবে তাঁর আত্মজীবনী। অপেক্ষায় আছি, কবে আমরা চলচ্চিত্রের গল্পের চেয়েও মনকাড়া একটি গল্প পড়তে পারব।
‘আপা, এমন কিছু দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই, যা পাঠকেরা জানেন না। বলেন না তেমন কিছু!’
প্রশ্ন শুনে চোখ দুটি বড় বড় করে তাকালেন কবরী। এবং হাসলেন। সেই হাসি, যে হাসির কারণে তিনি ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে দর্শকের মন অধিকার করে রেখেছেন।
‘কী নিয়ে বলব?’
‘প্রেম নিয়ে কিছু বলা যায় না?’
‘একটা মিষ্টি ঘটনা শুনবে?’
মিষ্টি একটি গল্প
শোনো তবে। ২০০৭ সালে একটা উৎসবে গেছি জার্মানির হামবুর্গে। ছেলে শাকের ছিল সঙ্গে। পথের ক্লান্তিতে শাকের ঘুমিয়ে পড়েছে রুমে গিয়ে। আমি লবিতে। ২৭-২৮ বছর বয়সী একটা জার্মান ছেলে দেখি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। ওকে দেখে আমার মনও কেমন যেন করে উঠল। ছেলেটা একটু পর আমার কাছে এসে ইংরেজিতে বলল, ‘আমি এই হোটেলের মালিকের ছেলে। তুমি কি টাকা চেঞ্জ করতে চাও? একটু ঘুরতে চাও?’
কবরী তখন। ছবি: ‘কবরীর চার দশকের একক প্রদর্শনী’ থেকে সংগৃহীত
আমার কিন্তু ভালো লেগে গেল ছেলেটাকে। ওর সঙ্গে গিয়ে ডলার ভাঙিয়ে এলাম। একটু ঘুরলামও। ঘরে এলে ছেলে অবাক হয়ে বলল, ‘মা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ ওকে বললাম ঘটনাটা। আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, জার্মান ছেলেটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
পরদিন ছেলেটা বলল, ‘তোমাকে নিয়ে ডিনারে যেতে চাই।’
বললাম, ‘যেতে পারি, কিন্তু আমার ছেলেকেও নিয়ে যাব।’
ছেলেটা বুঝি একটু দমে গেল। কিন্তু রাজি হলো। বলল, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আসবে আমাদের নিতে। আমি খুব সেজেগুজে বসে থাকলাম। সাড়ে সাতটা, আটটা, নটা, দশটা বেজে গেল, কিন্তু সে আর এল না। আমার ছেলেও কোথায় চলে গেল কে জানে। রাগ করে আমি পোশাক পাল্টে ঘুমুতে গেলাম। পরদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, শাকের আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তো জার্মান ছেলেটার গুষ্টি উদ্ধার করার জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু শাকের বলল, ছেলেটা নাকি সাড়ে সাতটাতেই এসেছিল। শাকের ওকে বলেছে, ‘মা ঘুমাচ্ছে। চলো, আমরা দুজন ডিনার করে আসি।’
এটুকু বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন কবরী। বললেন, ছেলেটা কিন্তু আমাকে ভালো বেসে ফেলেছিল। ওদের দেশে তো অসমবয়সী প্রেম হয়!
তারপর যেন আপনমনেই বললেন, ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু একসময় আবিষ্কার করেছি, এদের অনেকেই হীনম্মন্যতায় ভুগছে, উদার নয়। আমি কিন্তু গলা পর্যন্ত নেমেছি, তারা হাঁটুজলেও নামেনি। ভালোবাসার তো কত রূপ। তবে এটা বলি তোমাকে, ট্রাডিশনাল প্রেম বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছু আমার জীবনে ঘটেনি।
২০১৩ সালে জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত ‘কবরীর চার দশকের একক প্রদর্শনী’তে
সেই মেয়েটা
মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায় হাসিতে। টেলিভিশন যে ঘরটিতে, সেই ঘরে অনেকগুলো ছবির মধ্যে একটি ছবি যেন তাঁর ‘মিষ্টি মেয়ে’ পরিচিতির সিলমোহর। এখনো ঘিয়ে রঙা শাড়িতে তো সেই মেয়েটাকেই দেখছি, যিনি কিনা ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে অনায়াসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সরল চেহারা, সেই সরল হাসিই তাঁকে আলাদা করেছে অন্যদের থেকে।
প্রথম নায়ক সুভাষ দত্তকে ভয় পেতেন। যদিও সুতরাং ছবির নায়িকা এই ছোট্ট মেয়েটাকে খুব আদর করতেন সুভাষ দত্ত, কিন্তু শাসনও কম করতেন না। ঠিক উচ্চারণে সংলাপ বলা শেখাতেন তিনি।
আর জহির রায়হান? হ্যাঁ, জহির রায়হানের বাহানা নামের ছবিতেই শুধু কাজ করেছেন কবরী। কিন্তু যোগাযোগ ছিল। জহির বলতেন, ‘বিবিসি দেখো, ইংরেজি বই পড়ো।’ আর খান আতা যেন হাতে ধরে শিখিয়েছেন সব কাজ। ধমক দিতেন যেমন, আদরও করতেন তেমনি। চলচ্চিত্রের অনেক খুঁটিনাটি খান আতার কাছ থেকেই শেখা।
সুতরাং ছবিতে সুভাষ দত্তের সঙ্গে, রাজ্জাক ও কবরী,, জাফর ইকবালের সঙ্গে, সারেং বউ ছবিতে ফারুকের সঙ্গে, তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে, দেবদাস ছবিতে বুলবুল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন (মাঝে) ও কবরী
নানা রকম রান্না
‘কোন ছবিটি মনে গেঁথে আছে? কোন চরিত্র?’
একটু সময় নিলেন ভাবার জন্য। তারপর বললেন, ‘আসলে এখানে যে ছবিগুলো হয়, তা তো একটা ঘরানার। প্রায় সব ছবি তৈরি হয় একই ধরনে। মানে ধরো, আমাদের এদিকের যে রান্নাবান্না, তাতে হয়তো কেউ মসলা একটু কম দেয়, কেউ একটু বেশি। কিন্তু যা-ই রাঁধো না কেন, তাতে হলুদ, মরিচ, আদা—এ ধরনের মসলা থাকবেই। আবার হলিউডের ছবিগুলো কিন্তু ভিন্ন মসলায় রান্না হয়। সেটা আবার অন্য ঘরানার। বৈচিত্র্য লেগেছিল ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে কাজ করতে গিয়ে। এই এক পরিচালক, যাঁকে মনে হয়েছিল এক অজানা ঘরানার কেউ। তাঁর সেটে আমি যেন অন্য মানুষ।’
কবরীর নায়কেরা
রাজ্জাক-কবরী জুটি গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এ জুটির নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি, দর্পচূর্ণ, স্মৃতিটুকু থাক, রংবাজ, বেঈমান, কাঁচকাটা হীরেসহ অসংখ্য ছবি আছে, যা দর্শক-মন ছুঁয়েছে। একটি দারুণ ব্যাপার হলো নায়ক উজ্জ্বল, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক ও জাফর ইকবালের প্রথম ছবির নায়িকাও কবরী। ফারুকের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুজন সখী ও সারেং বৌ ছবি দুটো করেও নাম কুড়িয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় ছবিটির জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। কবরী অভিনীত আরও কয়েকটি মনে রাখার মতো ছবি হলো সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, মতিমহল, বিনিময়, দেবদাস।
কবরী: যখন শুরুর সময়। সংগৃহীত
টুকরো প্রশ্ন, টুকরো উত্তর
রাজনীতি করলেন। সাংসদ হলেন। এখন কি খুব ব্যস্ত?
‘না। এখন তো আর সংসদ সদস্য নই। কিন্তু মানসিকভাবে ব্যস্ত। আত্মজীবনী লিখছি। গল্পের আকারে। কখনো শুটিংয়ের কথা, কখনো ব্যক্তিজীবনের কথা, কখনো সামাজিক অনুষঙ্গ...’
‘ছেলেরা কেমন আছে?’
‘ওরা পাঁচজনই ভালো আছে। বড় ছেলে অঞ্জন যুক্তরাষ্ট্রে। মেজো ছেলে রেজওয়ান দুবাইতে। সেজো ছেলে শাকের আছে ইংল্যান্ডে, এর পরেরটা জয়নাল চিশতী কানাডায়। ছোটটা, মানে শানও কানাডায় ছিল, এখন ঢাকায়।’
‘রান্নাবান্না করেন?’
‘বাঙালি রান্না করি। ছেলেরা বলে, “মা, তোমার হাতে জাদু আছে”।’
‘বই পড়েন?’
‘বই পড়ি মানে? সুতরাং-এ অভিনয় করার আগেই কড়ি দিয়ে কিনলাম পড়েছি। বিমল করের ওই মোটা বইটা। কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি। আশুতোষ, শীর্ষেন্দু, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা দেবী, কত বই পড়েছি। বই পড়তে আমার ভালো লাগে।’
বসার ঘরে সত্যজিৎ রায়ের ওপর একটি আর জয়নুল আবেদিনের ওপর একটি বই রাখা আছে। সুযোগ পেলেই সেই বই দুটো পড়ছেন এখন।
‘গান ভালো লাগে?’
‘রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাসনের গান তো ভালো লাগেই। টম জোনসের গানের পাগল আমি। কিছুদিন আগে জ্যাজ শুনলাম, খুব ভালো লাগল।’
‘সিনেমার গানের মধ্যে পছন্দের কিছু আছে?’
‘‘‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়”, “প্রেমের নাম বেদনা”। আর “ওরে নীল দরিয়া” গানটা আমার খুব পছন্দ।’
মনে করেন, এখনো আপনি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। নায়ক হিসেবে কাকে বেছে নেবেন?
‘গ্রেগরি পেক।’
‘কোন চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছে হয়?’
‘শওকত ওসমানের “জননী” করতে চেয়েছি। সে এক অসাধারণ জটিল চরিত্র। বিধবা নারীটি গর্ভবতী হয়। নিজের সন্তানদের বাঁচানোর জন্যই সে এটা করেছে।’
এমন মিষ্টি মেয়ের দেখা খুব কমই পেয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা
প্রেম
বালিকাবেলায় কবরীর প্রেমে পড়েছিলেন চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক। খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কবরীকে ভুলতে পারেননি কখনো। ২০১১ বা ’১২ সালে কবরী একবার চট্টগ্রামে গেছেন কোনো এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এক তরুণ এসে বললেন, ‘আপনি কি আমাদের বাড়িতে একবার আসবেন? আমার বাবা আপনাকে যেতে বলেছেন।’ গেলেন কবরী। সেই বাড়ির সবাই কবরীতে মুগ্ধ। সেই ভদ্রলোকের ছেলেবউ এসে বললেন, ‘শ্বশুরমশাই তো শুধু আপনার কথাই বলেন সব সময়।’ এই সেই ভদ্রলোক, যিনি প্রায়-শিশু কবরীর প্রেমে পড়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় ভদ্রলোক কবরীর ফোন নম্বর রেখে দিলেন। গাড়িতেই ফোন। মেজাজ খারাপ হলো কবরীর। এরপর তিন দিন বাদেই আবার ফোন। একবার নয়। বারবার। ধরলেন না কবরী। দিন সাতেক পর আবার ফোন। বারবার। এবার বেশ মেজাজ খারাপ করেই কবরী ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো, বলুন!’
‘আন্টি, এটা আমি। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন দিন পরই বাবা মারা গেছেন। আপনাকে ফোন করেছিলাম তখন!’ খবরটা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি হারিয়ে গেলাম ছোটবেলার স্মৃতিতে।
এ রকম অনেক ঘটনা আছে মিষ্টি মেয়ে কবরীর। চলচ্চিত্রের মতোই এ রকম অনেক আনন্দ-বেদনার গল্প নিয়েই তিনি কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন। আমরা অপেক্ষায় আছি, কবে বের হবে তাঁর আত্মজীবনী। অপেক্ষায় আছি, কবে আমরা চলচ্চিত্রের গল্পের চেয়েও মনকাড়া একটি গল্প পড়তে পারব।