১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চীনে কুকুর পালা নিষিদ্ধ ছিল, সংগৃহীত
অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতো চীনের নাগরিকেরাও কুকুর পালেন, কুকুর নিয়ে বেড়াতে বের হন। কিন্তু আজ থেকে ২৮ বছর আগেও এই দৃশ্য কল্পনা করা যেত না। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চীনে কুকুর পালা নিষিদ্ধ ছিল। জলাতঙ্ক রোগে প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ায় চীন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার আগেও কিন্তু চীনে কুকুর পালা নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেটা মাও সে-তুংয়ের শাসনামলে। মাও সরকার মনে করত, কুকুর পালা বুর্জোয়া বিলাসিতা; একে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রশ্রয় দিতে পারে না। মাওয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর পুরো সময়েই (১৯৬৬-৭৬) কুকুর ছিল সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। মাও সে-তুংয়ের আমলে শুধু কুকুরই নয়, নিষিদ্ধ ছিল আরও অনেক কিছু, যা এখন শুনলে অবাক হতে হয়।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর নয়া চীনের প্রতিষ্ঠা করেন মাও সে–তুং, উইকিপিডিয়া
মাও ক্ষমতায় আসেন ১৯৪৯ সালে। ক্ষমতায় এসে যে কটি উদ্যোগ নেন, তার একটি চীনা নববর্ষ উদ্যাপন বন্ধ করা। মাও সরকার ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার অনুষঙ্গের দায়ে নববর্ষ উৎসব উদ্যাপন নিষিদ্ধ করে। নিষিদ্ধ করা হয় গলফ খেলা। এই খেলাকে মাও ধনীদের খেলা বলে মনে করতেন। সমাজতান্ত্রিকতাবিরোধী অভিযোগ তুলে ১৯৬৫ সালে নিষিদ্ধ হয় মার্কিন শিশুসাহিত্যিক ড. সোয়েসের লেখা ‘গ্রিন এগস অ্যান্ড হ্যাম’ বইটি। শুধু কি একটি বই, মাও সরকারের কাছে যেসব দেশি-বিদেশি বই চীনের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হয়েছে, সেগুলোর সবই নিষিদ্ধ হয়েছে।
শিশু–কিশোর পত্রিকায় ‘চার শত্রু নিধনের’ প্রচারণা, সংগৃহীত
ষাটের দশকে চলেছে মাওয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। আর সে সময়ই মাও সরকার নিষিদ্ধ করে বিথোভেন ও মোৎজার্টের মতো কালজয়ী সুরস্রষ্টার সংগীত। মাওয়ের মতে, এসব সংগীত বৈপ্লবিক সময় ও সমাজের আগে সৃষ্ট। কেবল সংগীত নয়, মাও সরকারের কোপানলে পড়েছিল সামান্য চড়ুই পাখিও। মাও সে-তুং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চীনে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেন। মাও বলেন, ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি হলো মানুষের শত্রু। এসব মেরে ফেলতে হবে। মাওয়ের কথায় চীনের সবাই ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি মেরে ফেলতে শুরু করল। সেনাসদস্য থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই অংশ নিল এতে।
মাওয়ের নির্দেশে চীনের সবাই লাখ লাখ চড়ুই নিধন করেছিল, উইকিপিডিয়া
ইঁদুর, মশা আর মাছি মারায় উপকারই হয়েছিল হয়তো। কিন্তু চড়ুই পাখি কেন মারতে হবে? মাও বললেন, চড়ুই পাখি খেতের শস্য খেয়ে ফেলে। তাই চড়ুই পাখিও মেরে ফেলতে হবে। নির্দেশ তামিল হলো; মারা হলো লাখ লাখ চড়ুই। তবে হিতে বিপরীত হলো। ফল পাওয়া গেল পরের বছরই। চড়ুই কমে যাওয়ায় বেড়ে গেল শস্য ধ্বংসকারী কীটের উপদ্রব। দেখা গেল, চড়ুই যতটা শস্য খেত, তার চেয়ে কীটের কারণে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে।
মাও সে-তুং (১৮৯৩–১৯৭৬), উইকিপিডিয়া
১৯৬৫ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সব ধরনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও সংগঠন চীনে নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ধর্ম পালনের অধিকার ফিরে এলেও নিষিদ্ধের রেশ পুরোপুরি যায়নি। এখনো কোনো ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে পারে না। জনপ্রিয় সিদ্ধান্তও কম নেননি মাও। ক্ষমতায় এসেই সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধের ৬০ বছর পর অবশ্য দেশটিতে জুয়া আর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না।
সময়ের সঙ্গে রীতিনীতি বদলায়। চীনেও বদলেছে। মাও সে-তুংয়ের চীন আর এখনকার চীন এক নয়। মাওয়ের অনেক সিদ্ধান্তই এখন আর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এটা তাঁর পরবর্তী সরকারগুলো উপলব্ধি করেছে। তবে অনেকে এ-ও মনে করেন, মাও তাঁর সময়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো সে সময়ের জন্য যথাযথই ছিল।
তথ্যসূত্র: দ্য আইরিশ টাইমস, হিস্ট্রি, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস