পাবনা শহর থেকে সকাল সকাল রওনা হয়েছিলাম চাটমোহরের এক নিভৃত গ্রামের উদ্দেশে। যে গ্রামে ছায়াঘেরা কয়েকটি বাঁশবাগানের সন্ধান আগেই পেয়েছিলাম। সফরসঙ্গী ছিলেন পাবনার বন্য প্রাণিবিষয়ক সংগঠন ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন কমিউনিটির সভাপতি এহসান আলী বিশ্বাস।
১৯ জুন ছবি তুলতে গেলেও প্রস্তুতিটা ছিল আরও আগের। জেনেছি দুধরাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। এটা যেকোনো প্রাণীর ছবি তোলার ক্ষেত্রেই হয়। প্রাণীর ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্য কেমন, তা ছবি তুলতে যাওয়ার আগে অবশ্যই জানা জরুরি। তাই আমরা ক্যামো পোশাকের সঙ্গে নিজেদের প্রকৃতিতে লুকানোর জন্য ‘হাইড কাপড়’ ব্যবহার করলাম। যেন কোনোভাবেই পাখিরা আমাদের উপস্থিতি বুঝে ভয় না পায়।
লম্বা লেজের পাখি দুধরাজ
গ্রামটিতে গিয়ে কয়েকটি দুধরাজ পাখির বাসার সন্ধান পেলাম। একটি বাঁশবাগানে আমরা হাজির। পাশে দেবদারুগাছে একটি বাসা ছিল। বাসা থেকে দূরে স্থান নির্বাচন করলাম। এরপর লুকিয়ে অপেক্ষার পালা। হঠাৎ দেখি, খাবার নিয়ে উড়ে এল মা পাখিটি। এরপর আবার কোনো এক সময় বাবা পাখিটি এল। কিন্তু দুঃসাহসী এই পুরুষ পাখিরা বাসার চারপাশ কড়া পাহারায় রাখে। বাসার আশপাশে মানুষ, বেজি, কুকুর-বিড়াল, সাপসহ শিকারি পাখিরা এলেই কর্কশ চিৎকার করে আক্রমণ করে। আক্রমণের গতি ও আকস্মিকতায় শত্রুরা ভড়কে যায়।
ঠিক এমনই পারিবারিক একটা ছবির অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু প্রথম দিন ব্যর্থ হলাম। পরদিন ভোরে আবার সেখানে হাজির হই। দেখি, বাসার পাশে মাত্র একটি ছানা। বাকি তিনটিকে বিভিন্ন ডালে উড়তে শেখাচ্ছে বাবা পাখিটি। মাঝেমধ্যে খাবার দিচ্ছে। বাসার বাইরে ডালে বসে থাকা একটি ছানাসহ মা-বাবাকে পাওয়া গেল। শিকার ধরে এনে ছানার মুখে তুলে দিচ্ছে মা পাখিটি। আর চিৎকার করে বাসা পাহারা দিচ্ছে বাবা দুধরাজ। বাবা দিবসের কথা ভেবে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। বাবা দিবসে এর চেয়ে ভালো ছবি আর কী হতে পারে! আমিও আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম!
ছানার জন্য খাবার এনেছে বাবা দুধরাজ
দুধরাজ মূলত পুরুষ পাখি। আবার মেয়েদের ডাকা হয় দুধরানি বলে। মেয়ে পাখি সারা জীবনই লালচে-বাদামি রঙের থাকে। তার লেজ ছোট অর্থাৎ কোনো ফিতা পালক থাকে না। কিন্তু পুরুষ পাখির লম্বা লেজ থাকে। সুদৃশ্য লম্বা লেজ এদের শরীরের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ বড়। বাতাসে এই সুদৃশ্য লম্বা লেজ যখন দোলে, তখন নান্দনিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক এই পুরুষ পাখিরা প্রায় তিন বছর ধরে পালকের লাল রং বদলে দুধের মতো সাদা হয়ে যায় বলে তাদের এই নামকরণ। তবে অঞ্চলভেদে সাহেব বুলবুলি, শাহ বুলবুল, সুলতান বুলবুল, লেজ ঝোলা, নন্দন পাখি প্রভৃতি নামেও এরা পরিচিত। লম্বা লেজের পাখিটির স্বর্গীয় রূপ থেকেই হয়তো এর ইংরেজি নাম হয়েছে ‘এশিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার’।