সালাউদ্দিন লাভলুকে প্রথম দেখি নব্বই দশকে ইমদাদুল হক মিলন রচিত ‘কোন কাননের ফুল’ ধারাবাহিক নাটকে। পাক্ষিকভাবে মঙ্গলবার রাত আটটার সংবাদের পর দেখাতো নাটকটি। সেখানে লাভলু আশ্রিত দুষ্টু আত্মীয়ের চরিত্রে অভিনয় করে। যে প্লেটে খেত সেই প্লেট ফুটো করতো। সেই নাটকে লাভলুর একটি সংলাপ জনপ্রিয়তা পায়।
জুলাই অথবা আগস্ট ১৯৯৪। আমি লাভলুকে সরাসরি দেখেছিলাম। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। সম্ভবত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নামে একটি সংগঠনের সভায়।
আমি তখন কুয়েত, সময়কাল ২০০৬। সুখজুম্মায় ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ ছায়াছবির ডিভিডি দেখে কিনে নিলাম। লাভলু যখন পরিচালক নিশ্চয়ই চমক আছে।
রাত দশটায় ডিভিডি প্লেয়ারে অন করলাম। কী দেখলাম?
দুশো বিঘা জমির মালিক এবাদত গাজী। অহংকারী, মারাত্মকভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন একরোখা। কথায় কথায় ধর্ম নিয়ে আসে। ভুল, মিথ্যা ও জাল হাদিস প্রচার করে। যা নিজে বুঝে তাই সব। নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। তাবিজ-কবচে প্রবল বিশ্বাস। বাড়ীর নাম মোল্লা বাড়ী।
জোয়ান গাজী তার একমাত্র সন্তান। এবাদত গাজীর চাপিয়ে দেওয়া ভুল মতবাদের চাপে সে অনেকটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। নিজস্বতা বলতে জোয়ানের কিছু নাই। যেন নাচের পুতুল। নাচায় এবাদত গাজী।
এবাদত চরিত্রে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, তার ছেলে হয়েছেন রিয়াজ।
মৌসুমী। রিয়াজের স্ত্রী, এটিএম-র পুত্রবধূ। সহজসরল নরম মনের মানুষ। পাখির গান শুনতে ভালোবাসে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে। জোসনা রাতে স্বামীর সাথে চাঁদ দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু রিয়াজ স্ত্রী মৌসুমীর আবেগ-ভালোবাসার কোনো মূল্য দেয় না। মূলত সে এইসব বুঝেই না।
বাবা এটিএমের ভুল মতবাদের চাপে চাপে রিয়াজের বোধশক্তি শূন্য। তাই মৌসুমী মূলত নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে। স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে।
শ্বশুরের শাসনের নামে অপশাসনে বিরক্ত ছিল। কিন্তু এই বিরক্ত প্রকাশ করারও অবকাশ ছিলো না মৌসুমীর। মৌসুমী আগে মৃত সন্তান প্রসব করে, এবারও করে। শ্বশুর বিশ্বাস করে মৃত বাচ্চা হওয়ার কারণ- মৌসুমীর প্রতি জ্বীনের আসর আছে। জ্বীন প্রতিবার বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তাই ওঝা ডেকে আনা হলো। ওঝা মৌসুমীর জ্বীন তাড়ানোর আসর বসালো। জ্বীন তাড়ানোর নামে চলে ভয়াবহ অত্যাচার।
মৌসুমীর ওপর ওঝার অত্যাচার শেষে রিয়াজকে আরেকটি বিয়ে করায় বাবা। দ্বিতীয় স্ত্রী শাবনূর কিন্তু মৌসুমী থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। শাবনূর প্রথমদিন থেকে লক্ষ্য করে- মৌসুমী অত্যাচারিত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শ্বশুরের অপশাসন আর স্বামীর অবহেলা ও অমনোযোগিতায় সে জর্জরিত।
শাবনূর গরম কড়াইতে পানি না ঢেলে তেল ঢাললেন। মানে শ্বশুরের তালে তাল মিলালেন। যাতে শ্বশুরের অহংকারের পতন হয়। যাতে শ্বশুর সংসারে যে কুসংস্কারের আতংক সৃষ্টি করেছেন। সেই আতংক দূর হয়। রিয়াজ যে স্ত্রীর প্রতি অমনোযোগী তারও বিহিত করার চেষ্টা চালালেন। শ্বশুর তো খুশি পুত্রবধূ শাবনূরের আনুগত্য দেখে।
শ্বশুর একবার বিশেষ সফরে বাহিরে গেলেন। তখন শাবনূর জোর করে রিয়াজ থেকে ভালোবাসায় আদায় করলেন। আসলে রিয়াজকে ভালোবাসা শিখালেন। রিয়াজ-কে জোসনা রাতে পুকুর পাড়ে নিয়ে গেলেন রোমাঞ্চ করতে। যার জন্য মৌসুমী একসময় ছটফট করতেন।
রিয়াজকে আগাগোড়া বদলে দিলেন শাবনূর। মন-মানসিকায় এবং আচার- আচরণে। এটিএম এসে রিয়াজের এই পরিবর্তন দেখে আকাশ থেকে পড়লেন। জানতে চাইলেন কারণ। শাবনূর জানালো রিয়াজকে জ্বীনে ধরেছে। রিয়াজ জ্বীনে ধরার অভিনয় করলো।
রিয়াজ এটিএমের নাগালের বাহিরে চলে গেলো। শাবনূর-রিয়াজ মোল্লা বাড়ীতে জ্বীনের নাটকের সফল মঞ্চায়ন করলো। অবশেষে নাটকের জ্বীন এটিএমকে ধরলো। শাবমূরের সাথে রিয়াজ তালে তালে তাল মিলিয়ে বাবাকে জ্বীনে ধরছে প্রচার করতে থাকে। সেই ওঝা এলো। যে ওঝা মৌসুমীর জ্বীন তাড়ানোর নামে শাররীক নির্যাতন করলো।
ওঝা একই নির্যাতন করলো এটিএমের প্রতি। যে আতংক সৃষ্টি করে এটিএম সংসারের স্বৈরশাসন করতো। সেই আতংকের শিকার এটিএম নিজেই হলো।
এবাদত গাজী চরিত্রটি আমাদের সমাজের বাস্তবরূপ। এমন মতো চরিত্র আমাদের সমাজে আছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে আছে। যারা সমাজে আতংক সৃষ্টি করে রাখে। যারা সংসারে আতংক সৃষ্টি করে রাখে।
যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে। মিথ্যা হাদিস, জাল হাদিস বলে অপরকে দমিয়ে রাখে। এইসব ইবাদত গাজি-দের হাতিয়ার জাল হাদিস। ধর্মের অপব্যাখ্যা। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সমাজে-সংসারে স্বৈরশাসন চালায়।
কুসংস্কার হাতিয়ার করে এবাদত গাজীরা সমাজ-সংসারে আতংক সৃষ্টি করে। এদের জন্য যারা ইসলাম পছন্দ করে না, তারা ইসলামের প্রতি আঙ্গুল তুলে সমালোচনা করতে পারে।
সমাজের এইসব এবাদত গাজীরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। পুত্র জোয়ান গাজীকে দুটি বিয়ে করায় দুর্বল দেখে। যাতে নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে পারে। ইচ্ছে মতো অপশাসন-স্বৈরশাসন করতে পারে। আর অত্যাচারিতরা যেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে না পারে।
মৌসুমী ছিলেন মাতৃহীন আর পিতা নিরুদ্দেশ। ফুফুর কাছে লালনপালন হয়। মৌসুমী নীরবে সব অত্যাচার সহে যায়। কারণ মৌসুমীর পক্ষে প্রতিবাদ করবে, এমন কেউ ছিলো না। শাবনূরও পিতামাতাহীন। একটি বাড়ীর কাজের মেয়ে। এবাদত গাজী বুঝতে পারেনি শাবনূর এতটা প্রতিবাদী-প্রতিরোধী হবে।
আমাদের সমাজ সংসারেও এইসব তথাকথিত এবাদত গাজীরা সমাজপতি হয়। সবচেয়ে শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, এবাদত গাজি যে আতংক সৃষ্টি করেছিলো, সেই আতংকে নিজেই কুপোকাত হয়েছে। এককথায় ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ আমাদের সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
পরিচালক: সালাউদ্দিন লাভলু, প্রযোজক: আব্বাস উল্লাহ শিকদার, পরিবেশক: ছায়াছন্দ চলচ্চিত্র, রচয়িতা: এ টি এম শামসুজ্জামান, সুরকার: ইমন সাহা, মুক্তি: ২ সেপ্টেম্বর ২০০৫, শ্রেষ্ঠাংশে: মৌসুমী, রিয়াজ, শাবনূর, এটিএম শামসুজ্জামান, প্রাণ রায়, চিত্রলেখা গুহ, কেরামত মাওলা, খায়রুল আলম সবুজ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি ও মাসুদ আলী খান।
* লিখেছেন: আকবর খসরু | চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা | ২৫ রামাদান, ১৯ মে ২০২০