‘ইতিকাফ’ অর্থ অবস্থান করা, আবদ্ধ করা, আবদ্ধ হওয়া বা আবদ্ধ রাখা। ইসলামের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন, তাঁকে ‘মুতাকিফ’ বলে। জগতের সব আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে, সব মোহ–মায়া ত্যাগ করে, সব বাঁধা–বন্ধন উপেক্ষা করে একান্তভাবে আল্লাহর নৈকট্যে যাওয়ার নাম ইতিকাফ।
হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজীবন রমজান মাসের শেষ দশকগুলো ইতিকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের আগে এবং পরেও তাঁর বিবিগণ (ঘরে) ইতিকাফ করতেন। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৪৬, পৃষ্ঠা: ১২৯)।
ইতিকাফ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। রমজানের শেষ দশক তথা ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০ রমজান পূর্ণ হয়ে ওই দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ। কোনো মসজিদে মহল্লার কয়েকজন বা কোনো একজন আদায় করলে সবাই দায়মুক্ত হবেন। আর কেউই আদায় না করলে সবাই সুন্নাত তরকের জন্য দায়ী থাকবেন। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যাঁরা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তাঁরাই সওয়াবের অধিকারী হবেন। যাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় চাকরি, ব্যবসা ও বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততায় ইতিকাফ করতে পারেন না, করোনাকালীন এই অখণ্ড অবসর তাঁদের জন্য ইতিকাফ করার মহাসুযোগ বৈকি। আসুন, জীবনে একবার হলেও এই সুন্নাত পালন করি।
সাধারণত পুরুষদের মসজিদে ইতিকাফ করতে হয়; মহিলারা নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে ইতিকাফ করবেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত বিশেষ জরুরত ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হবেন না। অজু, ইস্তিঞ্জা বা পাক–পবিত্রতার জন্য বাইরে বের হলে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন না বা সালাম বিনিময় করবেন না। কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেবেন না। তবে দরকার হলে ওই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবেন এবং কেউ ভেতরে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবেন। ইতিকাফ–কক্ষে এমন কেউ অবস্থান করতে পারবেন, যাঁরা ইতিকাফ করছেন না। ইতিকাফ–কক্ষটি যদি শয়নকক্ষে হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যেকোনো কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন; তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। ইতিকাফের সময় ইবাদত–বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ো না, যখন তোমরা ইতিকাফরত থাকবে মসজিদে (বা নির্দিষ্ট স্থানে)।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।
করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে যত দূর সম্ভব নামাজ, রোজাসহ সব ইবাদত সতর্কতার সঙ্গে পালন করবেন এবং ইতিকাফও করবেন। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্য যেসব ইবাদত আমল করা সম্ভব, সেগুলো অধিক পরিমাণে সম্পাদন করবেন। যিনি নিয়মিত যে আমল করেন অথবা কোনো নেক আমলের নিয়ত করেন, বিশেষ কোনো ওজরের কারণে তা করতে না পারলেও তার সওয়াব পাবেন ইনশা আল্লাহ
জামে মসজিদে বা জুমা মসজিদে যেমন ইতিকাফ করা যায়, তেমনি পাঞ্জেগানা মসজিদেও ইতিকাফ করা যায়। এমতাবস্থায় জুমার নামাজ আদায়ের জন্য শুক্রবার জামে মসজিদে যেতে হবে, এতে ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। জুমার আজানের পর যাবেন এবং নামাজের পর চলে আসবেন। এ সময় আসা-যাওয়ার পথে বা জুমা মসজিদে কারও সঙ্গে কথা বলবেন না, প্রয়োজনে ইশারায় বা সংকেতে নির্দেশ ও উত্তর প্রদান করবেন।
পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফকালীন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করবেন। কখনো কোনো কারণে জামাত না হলে, নিজেই আজান–ইকামাত দিয়ে নামাজ আদায় করবেন। ওয়াক্তিয়া নামাজের জামাতের জন্য ইতিকাফ ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া যাবে না। এ জন্যই সম্ভব হলে জামে মসজিদে ইতিকাফ করাই উত্তম।
রোজা এবং ইতিকাফ অবস্থায় তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে। প্রয়োজনে নস্যি, মেনথল ও গরম পানির ভাপ নিলেও রোজা এবং ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। সাবান–সোডাও ব্যবহার করা যায়। ডেটল, স্যাভলন, হেক্সিসল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্নতার উপকরণ ও জীবাণুনাশক বা স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক উপাদানসমূহ ব্যবহার করা যাবে। এতে অজু, নামাজ, রোজা ও ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। ইতিকাফ অবস্থায় মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরা যাবে এবং চেহারাও আবরণে আবৃত রাখা যাবে। এমনকি স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিশেষ পোশাক যেমন, পিপিই ও মস্তকাবরণ ইত্যাদি পরিধানেও কোনো বাধা নেই।
করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে যত দূর সম্ভব নামাজ, রোজাসহ সব ইবাদত সতর্কতার সঙ্গে পালন করবেন এবং ইতিকাফও করবেন। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্য যেসব ইবাদত আমল করা সম্ভব, সেগুলো অধিক পরিমাণে সম্পাদন করবেন। যিনি নিয়মিত যে আমল করেন অথবা কোনো নেক আমলের নিয়ত করেন, বিশেষ কোনো ওজরের কারণে তা করতে না পারলেও তার সওয়াব পাবেন ইনশা আল্লাহ! হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস নং-১)।
* মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম