করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই আমাদের পবিত্র ঈদুল আজহা পালন করতে হচ্ছে। এদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর মৃত্যু। হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। কেবল করোনা নয়, প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তাই ঈদ পালনে এবার সর্বোচ্চ সতর্কতা দরকার। কোনোভাবেই যেন আমাদের ঈদ আনন্দ কারও জন্য বেদনা ডেকে না আনে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রশাসনের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব নয়, যদি না আমরা নিজেরা সতর্ক হই।
করোনাকালে ঈদ
করোনা মোকাবিলায় দেশজুড়ে যে বিধিনিষেধ চলছে, তা ঈদের সময় একটু শিথিল করা হয়েছে। তবে এবারও বলব, যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ উদ্যাপন করতে চেষ্টা করুন। পরিবার নিয়ে বা নিজে অকারণে স্থানান্তর হবেন না। গতবার ঢাকা থেকে সংক্রমণ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ছিল, এবার কিন্তু উল্টো। এবার ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রামেই সংক্রমণ বেশি। তাই পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
ইসলাম ধর্মের মানুষদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। আর ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করার ধর্মীয় নিয়ম রয়েছে। সেটি পালন করবেন, কিন্তু কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখুন। অকারণে বিভিন্ন হাটে ঘোরাঘুরি করবেন না। বেশি যাচাই-বাছাই করার সময় এটা নয়। যতটা সম্ভব দ্রুততম সময়ে পশু কেনার কাজ সারুন। সম্ভব হলে অনলাইনে কেনাকাটা করুন। এই সময়ে অনলাইনে পশু কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দল বেঁধে হাটে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিকে নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক ও সুস্থ যাঁরা, তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে হাটে যাবেন। জ্বর বা উপসর্গ আছে, এমন কেউ কিছুতেই হাটে যাবেন না।
পশু কোরবানি ও কাটাকুটির সময়ও ভিড় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন। অনেকেই আজকাল নির্ধারিত স্থান থেকে কাটার কাজ সারেন। তাতে বাড়িতে ভিড় এড়ানো যায়। আর বাড়িতে কোরবানি করা হলে কসাই ও সাহায্যকারীদের মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করুন। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট ও বাসার নিচে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও সাবানপানি থাকা উচিত। বাইরের লোক যত কম প্রবেশ করবে, তত ভালো।
ঈদের নামাজে যাওয়ার সময় নিজের জায়নামাজ সঙ্গে নিন। বাসা থেকে অজু করে যাবেন। মসজিদে দূরত্ব বজায় রাখবেন। কোলাকুলি বা হাত মেলানো থেকে বিরত থাকুন। মাস্ক পরে নিন।
মাংস ভাগবাঁটোয়ারার সময়ও সব স্বাস্থ্যবিধি মানুন। বাড়ির গেটে ভিড় জমিয়ে মাংস বিতরণ করবেন না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সর্বাধিক মনোযোগ দিন। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মাংস দিতে গেলে যত দূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে কাজ সারুন। অকারণ ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলুন। নিজের বাসায় নিজের পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করুন।
বিধিনিষেধের কারণে অনেক মানুষ চরম দারিদ্র্যের মাঝে দিন কাটাচ্ছে। চাইলে কেউ কোরবানির টাকা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন বা গ্রামে পাঠিয়ে দিতে পারেন, যাঁরা আপনার হয়ে কোরবানি দেবেন।
ডেঙ্গু বিষয়ে সতর্কতা
কোরবানির পর অনেকের বাসার আশপাশে পানি, রক্ত ইত্যাদি জমে থাকে। রাস্তার নর্দমাগুলো উপচে পড়ে। মনে রাখবেন, এই পানিতে ডেঙ্গুর এডিস মশার উৎপত্তি হতে পারে। তাই কোরবানির পর যত দ্রুত সম্ভব ব্লিচিং পাউডার ও পানি দিয়ে এমনভাবে বাসা ও আশপাশ পরিষ্কার করবেন, যাতে পানিটা জমে না থাকে। বর্জ্য যথাস্থানে ফেলুন বা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের জন্য রেখে দিন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য প্রতিবেশী ও পাড়া-মহল্লার সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করুন। কারণ, একজনের বাসার জমা পানিতে মশার বিস্তার হলে পাশের বাসার মানুষটি কিন্তু আক্রান্ত হবেন। তাই একা নয়, সবাইকে সচেতন হতে হবে। যেখানে কোরবানির পশু রাখা হয়, দেখভাল করা হয় আর পরবর্তী সময়ে কাটাকুটি করা হয়, দরকার হলে সেসব জায়গায় আগে থেকেই মশার ওষুধ স্প্রে করুন। ছোটদের ত্বকে মশা নিরোধক মলম লাগাতে পারেন।
নিজের ও পরিবারের সুস্থতা আগে
এই সময় কোভিড ও ডেঙ্গুর কারণে শহরের হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। স্বাস্থ্য খাতে জনবলেরও তীব্র অভাব। তাই ঈদের সময় ও তার পর নিজের ও পরিবারের সুস্থতার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিন।
ঈদে খাবারদাবারের অসংযমের কারণে ডায়রিয়া, বদহজম যেন না হয়। পরিমিত খান, স্বাস্থ্যকর উপায়ে খান। যাঁদের গ্যাস্ট্রিকের বা পিত্তথলি ও যকৃতের সমস্যা আছে, কোলেস্টেরল বেশি এবং যাঁরা হৃদ্রোগী, তাঁরা সাবধান থাকবেন।
কাটাকুটি, রান্নাবান্নার সময় তাড়াহুড়ার কিছু নেই। অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অতিরিক্ত পরিশ্রমে অসুস্থ হতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পানি খাবেন, সবজি ও সালাদ, ফলমূল খাবেন। ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলবেন। কারণ, রক্তে শর্করা বা রক্তচাপ বেড়ে গেলে আপনার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ও জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
অসুস্থ হলে আমলে নিন
যদি ঈদের ছুটিতে বা এ সময় কেউ জ্বর, কাশি বা এমন উপসর্গে আক্রান্ত হন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখুন। প্রচুর পানি, তরল পান করতে দিন। পুষ্টিকর খাবার দিন। যত দ্রুত সম্ভব জ্বরের রোগীর কোভিড ও ডেঙ্গু টেস্ট করে ফেলুন।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ ঈদসহ যেকোনো ছুটিতে খোলা থাকে। তাই শ্বাসকষ্ট হলে বা স্যাচুরেশন কমে গেলে দেরি না করে হাসপাতালে নিন।
দেশে আবার করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। যাঁরা এখনো টিকা নেননি, তাঁরা দ্রুত নিবন্ধন করুন ও টিকা নিন।
* অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ