সারাক্ষণ কানে কোনো শব্দ অনুভব করাটা ভীষণ বিরক্তিকর। সুখের কথা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা হয় ক্ষণস্থায়ী এবং আপনাআপনিই সেরে যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে তা দীর্ঘস্থায়ী, যন্ত্রণাদায়ক ও অস্বস্তিকর হয়। এটি এমন এক কষ্ট, যা ভুক্তভোগী ব্যক্তি অন্য কাউকে ঠিকভাবে বোঝাতেও পারেন না। এই কান শোঁ শোঁ করার সমস্যাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘টিনিটাস’।
যেকোনো শব্দের একটি উৎস থাকে। হোক তা পাখির কুহুতান, বৃষ্টির রিমঝিম বা নদীর স্রোতোধারার শব্দ। কিংবা হাইড্রলিক হর্নের ‘কান ফাটানো’ আওয়াজ। কিন্তু যাঁর ‘টিনিটাস’ রয়েছে, তিনি উৎস থেকে উৎপন্ন শব্দ ছাড়া আরও একটি শব্দ শুনতে পান। অর্থাৎ, পরিবেশের যাবতীয় শব্দের বাইরেও একটি অতিরিক্ত শব্দ তিনি শোনেন। সাধারণত শব্দটি হয় শোঁ শোঁ ধরনের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কানে শব্দ হচ্ছে বলে মনে হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর মনে হয়, শব্দটা হচ্ছে তাঁর মাথার ভেতর।
কানে শোঁ শোঁ করলে...
টিনিটাস কেন হয়
টিনিটাস নিজে কোনো রোগ নয়। কানের অন্য অনেক রোগের এটি উপসর্গ। সাধারণত টিনিটাসের সঙ্গে রোগীর কানে কম শোনার বা শ্রবণজনিত সমস্যা থাকে।
কানে ময়লা বা খৈল জমলে, বহিঃকর্ণে কিছু আটকে গেলে (যেমন: মটরদানা, শিমের বীজ, ধান প্রভৃতি), আঘাতের কারণে কানের পর্দার ক্ষতি হলে, কানের জন্য ক্ষতিকারক ওষুধ প্রয়োগ বা সেবন করলে এ রকম হতে পারে। এ ছাড়া মধ্যকর্ণে পানি বা রক্ত জমা, মধ্যকর্ণের প্রদাহ কিংবা টিউমার, কানের মধ্যকার ক্ষুদ্র অস্থির স্বাভাবিক সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হওয়া, মধ্যকর্ণ ও নাকের সংযোজক নালির কার্যকারিতা কমে যাওয়া, যেকোনো কারণে শ্রবণের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্নায়ুর প্রদাহ কিংবা স্নায়ুর টিউমারও টিনিটাসের কারণ। মিনিয়ারস ডিজিজ নামের এক রোগেও টিনিটাস হয়, যেখানে রোগীর মাথা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বমির সমস্যা দেখা দেয়।
টিনিটাস যেকোনো বয়সেই হতে পারে। বার্ধক্যে অনেকেই এই সমস্যায় ভুগতে পারেন, সঙ্গে কমে যেতে পারে শ্রবণশক্তি। মাইগ্রেন, খিঁচুনি, বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ, রক্তস্বল্পতা, মানসিক অস্থিরতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কিংবা বিষাদে ভুগলে টিনিটাস হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে থাকলেও এ রকম হতে পারে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না।
কী করতে হবে
টিনিটাসে ভুগলে একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী হবে চিকিৎসা। যেমন কানে ময়লা জমলে সেটি পরিষ্কার করতে হবে, কিছু আটকে থাকলে অপসারণ করতে হবে, স্নায়ুর সমস্যা থাকলে চিকিৎসা নিতে হবে, এমনকি শ্রবণযন্ত্রও ব্যবহার করতে হতে পারে। রক্তস্বল্পতা থাকলে সেটির চিকিৎসা করাতে হবে, রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টিউমার কিংবা কানের পর্দায় আঘাত লাগার মতো কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসারও প্রয়োজন পড়ে।
কিছু পরামর্শ
দিনের ব্যস্ত প্রহরে নানান শব্দের গোলমালে রোগী কানের বাড়তি শব্দ অনেক সময় বেশি অনুভব করেন না। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতায় টিনিটাস বেড়ে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাতের নীরবতায় টিনিটাস বাড়ে, ফলে অস্থিরতা বাড়ে, তাতে টিনিটাস আরও বাড়ে।
বিশেষ করে যেসব রোগীর টিনিটাসের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, রাতে তাঁদের জন্য প্রচণ্ড অস্বস্তির সৃষ্টি করে টিনিটাস। রাতে তাঁরা পূর্ণগতিতে পাখা ছেড়ে রাখতে পারেন, পাখার শব্দে নিজের কানের শোঁ শোঁ শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এতে রোগীর অস্থিরতা কমে। তা ছাড়া টিকটিক আওয়াজ করে, এমন টেবিল ঘড়ি বা হাতঘড়ি বালিশের নিচে রেখে দেওয়া যায়।
টিনিটাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক অস্থিরতার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, রোগীর আপনজনদের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তাই যে কারণেই টিনিটাস হোক না কেন, এমনকি কারণ যদি না–ও পাওয়া যায়, সমস্যাটি যে ধীরে ধীরে একসময় সেরে যাবে, রোগীকে এই আশ্বাস দিতে হবে। প্রয়োজনে মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হবে।
মানসিক রোগীও কখনো কখনো টিনিটাসে ভুগতে পারেন, যার কারণে তাঁর অস্থিরতা আরও বাড়ে। এসব রোগীর মানসিক রোগের চিকিৎসা করানো হলেও রোগী সহজে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন না। তাই আপনজনদের অবশ্যই এসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
প্রতিরোধ
- কানে চুলকানি, অস্বস্তি যা–ই হোক, কোনো অবস্থাতেই কান খোঁচানো যাবে না। কটনবাড দিয়েও না। এতে কানের ক্ষতি হয়।
- চিকিৎসকের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কানের কোনো ড্রপ ব্যবহার করবেন না। আগে কখনো চিকিৎসক দিয়েছিলেন বলে নিজে নিজে আবার ব্যবহার শুরু করা যাবে না।
- কিছু ওষুধ সেবনেও কানের ক্ষতি হতে পারে (যেমন অ্যাসপিরিন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কিছু ওষুধ, ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ প্রভৃতি)। তাই কী কী ওষুধ খাচ্ছেন, তা চিকিৎসককে জানান।
- উচ্চশব্দবহুল স্থানে কাজ করতে হলে প্রতিরোধক ব্যবহার করুন। মাঝেমধ্যে কানের বিশ্রাম দরকার।
[FA]pen[/FA] লেখক: অধ্যাপক ডা. এ এফ মহিউদ্দিন খান | সাবেক বিভাগীয় প্রধান, নাক-কান-গলা বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল