কমলা হারিস, মিশেল ওবামা, অপরাহ্ উইনফ্রে, নাওমি ক্যাম্পবেল কিংবা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া—বিশ্বখ্যাত নামগুলো আপন মহিমায় উজ্জ্বল। তাঁদের ত্বকের চাপা রংই যেন সৌন্দর্যে যোগ করে নতুন মাত্রা। এই সময়ে এসে পেশাদার বা অপেশাদার নারীর চলার পথে ত্বকের রং কোনো বাধা সৃস্টি করতে পারে না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে তুলে ধরলেই হলো।
আধুনিক বা ঐতিহ্যবাহী, সব পোশাকেই অনন্য। মডেল: বৃষ্টি ও পল্লবী, সাজ: নুজহাত খান, পোশাক: রুলমেকার শার্টস ও ড্রেসিডেল, স্থান: কৃতজ্ঞতা: ক্যানভাস স্টুডিও
সৌন্দর্য মানে তো ব্যক্তিগত অনুভব। আমার কাছে যা সুন্দর, আপনার কাছে তা না–ও হতে পারে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে সৌন্দর্য বিশ্বজনীনও। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিন দিন বড় হচ্ছে। নতুন সংজ্ঞায়িত সৌন্দর্যে চেহারাটাই সবকিছু নয়। বরং সফলতা, আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্বই আসল। তবে এটাও সত্যি ত্বকের রং চাপা হলে এখনো সেটা অনেকভাবে উল্লেখ করা হয়। গায়ের রং চাপা কিংবা খুলে বললে কালো হওয়া সত্ত্বেও আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন যেসব নারী, তাঁরা প্রশংসিতও হচ্ছেন সর্বত্র। এ বিষয়টি তাঁরা তুলে ধরেছেন নানাভাবে, তবে সেখানে সব সময় প্রকাশ পেয়েছে আত্মবিশ্বাস। হীনম্মন্যতা স্থান পায়নি এখানে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিস, সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, উপস্থাপক ও মিডিয়া মোগল অপরাহ্ উইনফ্রে, মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস বা সংগীতশিল্পী বিয়োনসের মতো নামগুলো চলে আসে সফল নারীদের তালিকায়। শুধু সফলতা নয়, তাঁদের সৌন্দর্যও প্রশংসিত। এঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি মিল তাঁরা ‘ব্ল্যাক (কালো)’।
চাপা রঙের ত্বকে রঙিন পোশাকই ভালো লাগে। পোশাক: আইকনিক ফ্যাশন গ্যারেজ
ভারতীয় অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার একটি সাজের ভিডিও দেখছিলাম। তারকাদের রূপসজ্জাকার প্যাটি ডেব্রফ প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে ডাকেন ব্রাউন বার্বি হিসেবে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও এটিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘আমি পছন্দ করি যে তুমি আমাকে বার্বি বলে ডাকো। আর আমার গায়ের রং তো বাদামি, তো কোনোই অসুবিধা নেই।’
একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় অভিনেত্রী নন্দিতা দাস বলেছেন, গায়ের রং কালো হলে জন্মের পর থেকেই তাকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জাতীয়তাবাদ, ধর্মের মতো গায়ের রংটিও আমাদের একটি পরিচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। কারণ, এটা নিয়েই জন্ম হয়েছে। যেখানে মানুষের ব্যবহার আর কাজটাই তাঁর বড় পরিচয় হওয়া প্রয়োজন।
কাব্য করে কৃষ্ণকলি বলা হলেও সামাজিকভাবে গায়ের রং এখনো একটি বিষয়। ইউরোপ–আমেরিকায় সাদা রঙের অধিকারীরা রোদ উঠলেই সমুদ্রতটে শুয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গায়ের রং একটুখানি ট্যানড বা চাপা করার জন্য। সেখানে আবার জন্মগতভাবে গায়ের রং কালো হয়ে গেলেই যেন সমস্যা।
বাংলাদেশের বিবি রাসেল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বনামধন্য। মডেলিং করেছেন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন সাময়িকী ও ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য। পাশাপাশি ডিজাইনার হিসেবেও পেয়েছেন খ্যাতি। যখন মডেল ছিলেন তখন তাঁর সাহসিকতা এবং সাফল্য অনেকের জন্যই শিক্ষণীয়। বিষয়টি এমন নয়, তাঁদের সাফল্যের কারণে চাপা পড়েছে গায়ের রং। বরং ওটা নিয়েই তাঁরা সফলতা পেয়েছেন।
ভালোবাসুন নিজেকে, ভেতরের স্বত্তাকে
ত্বকের ওপরের রং যেটাই হোক না কেন, সেটি আপনার ভেতরের সত্তাকে যেন চেপে না রাখে, খেয়াল রাখুন সেদিকে। জীবনে কী চাচ্ছেন, কোথায় যেতে চাচ্ছেন—এ ধারণাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার থাকলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা যায়। তখন আশপাশের বিষয়গুলো আর প্রভাব ফেলে না। এটা একটা প্রক্রিয়া। একদিনে হয়তো হবে না। অনেক কম বয়স থেকেই হয়তো আপনাকে এই চলা শুরু করতে হবে। অসুবিধা কোথায় তাতে?
উপস্থাপক, মডেল, কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদ তাঁর চাপা রং নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনেছেন বহুবার। তবে তিনি সেসব পাত্তা দেননি। দুই বছর আগে নকশায় তাঁর এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলেছিলেন এসব কথা। এই দুই বছরে কি সামাজিক এই মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে?
আজরা মাহমুদ বললেন, ‘একদমই না। এখন যেন পাঁচ গুণ বেশি চলছে এ ধারণা। আগে মানুষের হাতে ফরসা হওয়ার তেমন কোনো উপায় ছিল না। এখন উপায় যেহেতু হাতের নাগালে, অনেকে সে পথে যাচ্ছেন। নিরাপত্তার অভাব এর একটি বড় কারণ। আশপাশের মানুষ একটা প্রভাব তৈরি করে। আগে কেউ কিছু বললে কষ্ট লাগত। এখন হাসি পায়। আমি জানি আমি সুন্দর। এটার জন্য আমাকে বাইরের মানুষের সম্মতি লাগবে না। এই আত্মবিশ্বাসটা সবার মধ্যেই থাকা উচিত বলে মনে করি।’
পোশাকের রঙের বিষয়টিও একদম নিজের বহন করার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করেন আজরা। আফ্রিকার নারীরা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরেন। দেখতে সুন্দর লাগে। গায়ের রঙের ওপর নির্ভর করে কাপড় বেছে নিতে হবে। এই ধারণাটি ভুল। নিজের পছন্দের রঙের পোশাক পরলে দেখতে আরও ভালো লাগে। আজরার পছন্দের রং সবুজ। সবুজ পোশাক পরলে ভেতরের আনন্দ যেন প্রকাশ পায় বাইরে। সেদিন যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বলে, সুন্দর লাগছে তোমাকে। এসব কারণে গায়ের রং চাপা বলে যাঁরা রঙিন পোশাক বেছে নিতে অস্বস্তি বোধ করেন, তাঁদের বলছি—নির্দ্বিধায় যেকোনো রঙের পোশাক পরুন। পুরো পোশাকে ম্যাজেন্টার প্রাধান্য আনতে সাহস না পেলে, অল্প করেই আনুন। কুর্তার সঙ্গে স্কার্ফটি হোক ম্যাজেন্টা। একদম সাদা বা কালোও রংটিও ভালো লাগবে।
রং চাপা হলে বেছে নিতে হবে নির্দিষ্ট কিছু সাজপোশাক, চলতি ধারায় সেটি মানার দরকার নেই।
মজার বিষয়, সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্র পারসোনার পরিচালক নুজহাত খান মনে করেন, যাঁদের গায়ের রং চাপা তাঁরা ভাগ্যবান। এ রঙের অধিকারীরা যেকোনোভাবে নিজেদের সাজাতে পারেন। ফরসা ত্বকের সঙ্গে যা অনেক সময় মানায় না। তিনি বলেন, সামাজিকভাবে নিজেকে ফরসা করে তোলার প্রবণতা এখন অনেকের মধ্যেই কম। সাজের সময় অনেকেই তিন থেকে চার টোন বেশি হালকা করার জন্য বলতেন। সেই ধারণাটাও সামনে আরও কমে যাবে। এখন নিজের গায়ের যে রং, সেটি সুন্দরভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন সবাই। বিশ্বজুড়েই এটা এখন চলতি ধারা। নকশার এই প্রতিবেদনের জন্য ছবি তোলার সময় মডেলদের যখন সাজাচ্ছিলেন নুজহাত, তখন তিনি জানালেন চাপা রঙের টোনগুলো সবচেয়ে সুন্দর। সাজের মাধ্যমে বেশ ভিন্নতা তুলে ধরা যায়।
২০১৯ সালের মিস ইউনিভার্স জোজিবিনি টুনজিকে অভিনন্দন জানানোর সময় ২০১১ সালের মিস ইউনিভার্স হিসেবে নির্বাচিত অ্যাঙ্গোলার লেইলা লোপস বলেছিলেন, অবশেষে মহাবিশ্ব (ইউনিভার্স) কালো ত্বককে গুরুত্ব দিচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে জোজিবিনি টুনজি পরে বলেছিলেন, ‘আমি এমন এক পৃথিবীতে বেড়ে উঠেছি যেখানে আমার মতো দেখতে একজন নারীকে কখনো সুন্দর মনে করা হয় না। এখন এসে এই বিষয়টা থেমেছে। আমি চাই বাচ্চারা আমার দিকে তাকিয়ে আমার মুখটি দেখুক।’
শ্যামলা, উজ্জ্বল শ্যামলা কিংবা কালো—ত্বকের রং যেমনই হোক, সেটার পরিচর্যা দরকার নিয়মিত। আপনি নিজের কতটা যত্ন নিচ্ছেন, সৌন্দর্য প্রকাশ পায় সেই ভাবনার মধ্য দিয়েও। রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বলেন, ‘যাঁদের গায়ের রং চাপা, সানস্ক্রিন ব্যবহার করা আবশ্যক। কারণ এই ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। রোদে গেলে ১৫ মিনিট পরই ত্বক রোদে পোড়া শুরু হয়ে যায়। যেহেতু এই রং মিষ্টি, ধরে রাখুন সারা জীবন। ফরসা হওয়ার প্রয়োজনই নেই। পরিবার থেকেও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা দরকার। গায়ের রং জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো বাধা নয়, এই অনুভব প্রথম থেকেই জানাতে হবে।’
সাজের বেলায় যদি স্বস্তিবোধ না করেন তবে কমলা, মেরুন, লাল রঙের লিপস্টিক এড়িয়ে যেতে পারেন। বরং মভ টোন, বাদামি, গাঢ় গোলাপি সাজে ভিন্নতা আনবে। যাঁরা একদমই সাজেন না, শুরু করুন ৩-৪টি জিনিসের মধ্য দিয়ে। কনসিলার দিয়ে দাগগুলো ঢেকে নিন। এরপর কমপ্যাক্ট পাউডার, ব্লাশঅন, ভুরু আঁকা আর লিপস্টিক। ব্যস, এতেই প্রকাশ পাবে আপনার ব্যক্তিত্ব।
ভেতরের এই ব্যক্তিত্বই আপনার শক্তি, এটিই তুলে ধরবে আপনার বাইরের সৌন্দর্য।
ব্যক্তিত্বই আপনার সৌন্দর্য