সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের হনশু দ্বীপের বিখ্যাত ফুজি পাহাড়ের পাদদেশে চিরসবুজ গাছপালায় ঘেরা এক বন আছে। এই বনের নাম আওকিগাহারা। এই বনে গাছপালা এতোতাই ঘন আর সংখ্যায় এত বেশি যে এই বনটিকে অনেকেই বৃক্ষ-সাগর বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবার অনেকেই এই বনকে বলেন শয়তানের বন। তবে আত্মহত্যার বন হিসেবেই এটি অধিক পরিচিতি লাভ করেছে।
কেন একে বলা হয় আত্মহত্যার বন?
অনেকেই হয়ত অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে- একটা বনকে কেন আত্মহত্যার বন বলা হবে? উত্তরটা পেয়ে যাবেন যদি কখনও এই বনে পা রাখার সুযোগ পান! আওকিগাহারা বনের সব যায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মানুশের লাশ। অবাক হওয়ার ব্যাপার হলেও এটা সত্যি যে এই বনে প্রতি বছর প্রায় ৫০টির অধিক লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। এসব লাশের প্রায় সবই এই বনে এসে আত্মহত্যা করেছে বলে ধারনা করা হয়।
এই বনে এসে আত্মহত্যা করার কারন কি?
যে কেউ নিঃসন্দেহে চমকে যাবেন যদি শোনেন এই বনে ঘটা আত্মহত্যার সব কাহিনী। প্রতি বছর আত্মহত্যা প্রবণ লোকেরা কোন এক অদ্ভুত কারনে এই বনকে বেছে নেয়। তাই বনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল, তাদের ব্যবহৃত জামা-কাপড়, ব্যাগ, ঘড়ি আর প্রবেশপথে পড়ে আছে অসংখ্য পরিত্যক্ত গাড়ি। এরা বনে ঘুরতে আসার নাম করে আর ফিরে যাননি! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মানুষজন কেন আত্মহত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেয় এই বনকে? অন্য কোথাও নয় কেন? আসুন সে প্রসঙ্গে যাই এবার…
আত্মহত্যার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কারনঃ
লোকমুখে এই বনটির আত্মহত্যার বন হিসেবে নাম করার পেছনের বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যে কাহিনী তা হলো, ১৯৬০ সালে সেইচো মাতসুমোতোর নামে এক জাপানি লেখকের ‘কুরোয় কাইজু’ নামের একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। রোম্যান্টিক ধারার এই উপন্যাসটি পাঠকের কাছে ব্যপকভাবে সমাদৃত হয়। বইয়ের শেষ দৃশ্যে দেখা যায় দুই প্রেমিক-প্রেমিকা আওকিগাহারা বনে এসে আত্মহত্যা করে। অনেকে মনে করেন, বিখ্যাত এই উপন্যাসটি পাঠকের মনে গভীর অনুভূতি ও আবেগ সৃষ্টি করে, যা তাদের আওকিগাহারা বনে গিয়ে আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করে। আর এই কারনেই হতাশা গ্রস্ত ব্যক্তি বা আত্মহত্যা প্রবণ লোকেরা নিজেদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার জন্য ছুটে আসতে শুরু করে আওকিগাহারা বনে। এ কারনে পরবর্তিতে জাপানে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।
এরপর ১৯৯৩ সালে আরেক জাপানি লেখক ওয়াতারু তসুরুমুইয়ের ‘দ্য কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল’ বইটি প্রকাশিত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল- তিনি এই বইটিতে আত্মহত্যার জন্য সঠিক স্থান হিসেবে আওকিগাহারা বনকে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে বনটিতে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তেই থাকে। গা শিউরে ওঠা বিষয় হলো- বনে পড়ে থাকা বেশ কয়েকটি মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল ওয়াতারুর লেখা এই এ বইটি!
বনের গা শিউরে ওঠা পরিবেশঃ
আগেই বলেছি আওকিগাহারা বন খুব ঘন গাছপালায় ঘেরা। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই বনে বন্যপ্রাণীদের বসবাস নেই বললেই চলে। তাই এ বনটি পরিবেশটা যেন একটু বেশিই নির্জন। বনের ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই গা শিউরে ওঠে। বনের নির্জনতা ও পাথুরে পথে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই এই বনের ধারে কাছে আসতে চায় না। তাই বহুকাল থেকে এই বনের রহস্য বেড়েই চলেছে।
স্থানীয়রা আওকিগাহারা বনকে ভূতের রাজ্য বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তাদের মতে, এই বনে গেলে কেউ আর ফিরে আসতে পারে না। অতৃপ্ত আত্মারা তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের হত্যা করে আসে। লোকমুখে এমন আরও অনেক কাহিনী প্রচলিত থাকলেও কেউই আজ পর্যন্ত আওকিগাহারা বনের এই আত্মহত্যার ঘটনার পেছনের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
আত্মহত্যার সংখ্যাঃ
১৯৭০ সাল থেকে প্রতি বছরে একবার করে আওকিগাহারা বনে মৃতদেহের সন্ধান করা হয়। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও অনেক সাংবাদিকরা এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ২০০২ সালে এই বনে মৃতদেহ পাওয়া যায় ৭৮টি, ২০০৩ সালে ১০০টি এবং ২০০৪ সালে ১০৮টি। তবে ২০১০ সালে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৪৭ জন মানুষ এই বনে এসে আত্মহত্যা করেন।
আরও বিস্তারিত তথ্য পাবেন এই ওয়েবসাইটেঃ
২০১৬ সালে এসে জাপানের সরকার এই মৃতের কমিয়ে আনার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এতেও কি এই বনের রহস্যের সমাধান হবে? আমরা অপেক্ষায় থাকবো। ধন্যবাদ আমাদের সাথে থাকার জন্য।