কোথাও ঘুরতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হলে মনখারাপ হয়ে যায়। তবে এটা ঠিক, বিশ্বের সব দেশেই এটা ঘটে চলেছে। তাই ঘুরতে গিয়ে কোনোমতেই স্পিরিট নষ্ট না করে ভালো করে ঘোরা উচিত। ভালো মানুষের দেখাও মেলে।
সুলতান সুলেমানের দেশ তুরস্ক। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী এ দেশে প্রতিবছর লক্ষ-কোটি পর্যটক আসেন। আমরাও গিয়েছিলাম একবার এপ্রিলের শেষের দিকে। কোথাও ঘুরতে গেলে আমরা সচরাচর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করি। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় কিছুটা বেশি লাগলেও খরচ পড়ে কম। সেবার ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে নেমে ভাবছিলাম, কীভাবে হোটেলে যাওয়া যায়। হাতের লাগেজ নিয়ে পাবলিক বাসগুলোতে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। ধারণা করলাম, এখানকার ট্যাক্সি ভাড়া তো আর ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো চড়া হবে না। কিছুদূর এগিয়ে এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, ড্রাইভাররা গলা হাঁকিয়ে যাত্রী খুঁজছেন। দেশ থেকে এত দূরে একদম দেশি কাণ্ড দেখে কিছুটা অবাক হলাম।
এর মধ্যে একজন প্রায় টেনে আমাদেরকে তাঁর ট্যাক্সির দিকে নিতে চাইলেন। যেহেতু ট্যাক্সিতে মিটার থাকেই আর আমার মোবাইলে গুগল ম্যাপ চালু আছে, তাই খুব একটা না ভেবে উঠে পড়লাম তাঁর ট্যাক্সিতে। আমাদের হোটেল ছিল তাকসিম স্কয়ারে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বেশ হাসিখুশি ও মিশুক মনে হলো, যাত্রা শুরুর পর থেকেই তিনি বেশ খোশগল্প করছিলেন। ইস্তাম্বুল কেমন লাগছে, এটাই আমাদের প্রথম ভ্রমণ কি না, এটা–সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ট্যাক্সিতে সচরাচর যে মিটারগুলো থাকে, এটাতে সেটা নেই।
ইস্তাম্বুল শহর ও হলুদ ট্যাক্সি
তার বদলে আলাদা কী একটা পেজার সদৃশ মিটার অন করা। জিজ্ঞেস করায় বললেন যে রেগুলার মিটারটা নষ্ট, এটাতেও নাকি একই রিডিং দেখাবে। ড্রাইভারের কথায় ঠিক আশ্বস্ত হতে পারলাম না। সন্দেহের চোখে হাতের ফোনে গুগল ম্যাপে তাকালাম, দেখতে পেলাম তিনি ভুল পথের দিকে ট্যাক্সি ঘুরালেন। অমনি তাঁকে আমি ট্যাক্সি থামাতে বাধ্য করলাম। তিনি যে আমাদের ভুল পথে নিচ্ছিলেন এবং সেটা যে আমরা বুঝতে পেরেছি, তাকে গুগল ম্যাপে দেখালাম। তিনি বাহানা দিলেন, এই শহর তাঁর চেনা, গুগলের দেখানো পথে অনেক জ্যাম পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরাও বললাম, গুগলের দেখানো পথে নিয়ে যেতে, অন্যথা আমাদের নামিয়ে দিতে। অগত্যা তিনি রাজি হলেন এবং তেমন কোনো জ্যাম ছাড়াই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম।
এখন ভাড়া দেওয়ার পালা, যদিও এতক্ষণে বুঝে গেছি যে তাঁদের ওই পেজার আকৃতির মিটারে ভাড়া একটু বেশিই দেখাবে, তারপরও এই অচেনা শহরে আমরা আর উচ্চবাচ্য করলাম না, ভাড়া যা দেখাচ্ছে তা–ই দিয়ে দিলাম। নোটগুলো হাতে নিয়ে তিনি একটা নোট ফেরত দিয়ে বললেন, আমি তাঁকে ৫০ লিরার বদলে ভুলে ৫ লিরার নোট দিয়েছি। আমি এবারও আর ঘাঁটালাম না, ভাবলাম নতুন দেশের নতুন নোট ভুল হতেই পারে। তাই আরেকটা ৫০ লিরার নোট দিয়ে আপদ বিদেয় করলাম। কিন্তু এটাও যে ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারের প্রতারণার কৌশল ছিল, সেটা বুঝলাম যখন আমাদের আরও দুই বন্ধু সাইয়িদ ও ফ্রান্সেসকা, যারা সেদিনই জার্মানি থেকে এসেছিল, তাদের সঙ্গেও নাকি এই ভুল নোট লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এরপর আমরা সেই ট্রিপে আর ট্যাক্সি ব্যবহার করিনি।
তাকসিম স্কয়ারে বাস ও ট্যাক্সি স্টপেজ।
পরে শুনলাম, এই প্রতারণার ঘটনা ইস্তাম্বুলে অহরহই ঘটে। তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে ইস্তাম্বুলের সব ট্যাক্সিই এ ধরনের স্ক্যামের অংশ। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার শিকার হতে না চাইলে, আপনাকে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে সহজ সমাধান, পাবলিক বাস-ট্রাম ব্যবহার করা, যেটা আমরা পরবর্তী সময়ে করেছিলাম। এ ছাড়া প্রতারনা থেকে রক্ষা পাওয়ার আরও কিছু সম্ভাব্য উপায় আছে।
১। হোটেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ট্যাক্সি বুক করা।
২। স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নেওয়া।
৩। মিটার সচল আছে কি না, নিশ্চিত হয়ে ট্যাক্সিতে ওঠা।
৪। ট্যাক্সির নম্বর প্লেটের ছবি তুলে রাখা।
৫। অনেকে মনে করেন, আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে ট্যাক্সিতে উঠা উচিত।
বসফরাস প্রণালী
ইস্তাম্বুল অনেক সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় একটা শহর। প্রতারিত হওয়ার ভয়ে এই শহরের সৌন্দর্য উপভোগে কোনো কমতি রাখা যাবে না। তা ছাড়া টুকটাক স্ক্যাম তো বিশ্বের প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটেই হয়ে থাকে, সতর্ক থাকলে যার বেশির ভাগ সহজেই এড়ানো সম্ভব।