ইরানি দাস্তান
পর্ব – ৮
পর্ব – ৮
খাশ শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে, পাহাড় ঘেরা এক দুর্গম জনপদ। নাম, গোহার কুহ। বাংলায় যার অর্থ, রত্নের পাহাড় কিংবা রত্নময় পর্বতমালা। না, কোনো সোনা রূপা, হীরে জহরত কিংবা মণি মাণিক্য পাওয়া যায় না এই পাহাড়ে। নিরেট পাথরে গড়া কালচে ধূসর পর্বতমালা। শুষ্ক মরুর এই প্রদেশে পানি জীবনের মতোই দামী। যেখানেই একটু পানির উৎস, সেখানেই জীবন, সেখানেই মানুষ, সেখানেই গড়ে উঠে মানুষের বসতি। পাথুরে এই পাহাড়ের গা বেয়েও নেমে এসেছে কিছু পানির নহর। সেই পানিকে ঘিরেই এই জনপদ। পাহাড়গুলো তাই এই জনপদের মানুষের কাছে গোহার কিংবা রত্নের মতোই দামী।
মানুষের যে কয়টি মৌলিক চাহিদা আছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তাদের মধ্যে অন্যতম। যত দূরেই হোক, যত দুর্গমই হোক, যেখানেই মানুষের বসতি, ইরান সরকার সেখানেই পৌঁছে দিয়েছে শিক্ষার আলো। সেখানেই ওষুধপত্র নিয়ে পৌঁছে যায় ডাক্তার। বিনামূল্যে ! খাশের অধীনে যে কয়টি পল্লী ক্লিনিক বা দারমাঙ্গা আছে, গোহার কুহ তাদের মধ্যে সব চেয়ে দূরে, সব চেয়ে দুর্গম, সব চেয়ে অনুন্নত। পড়বি তো পড়, আমার ভাগ্যেই পড়ল সব চেয়ে খারাপ দারমাঙ্গা, গোহার কুহ। খাশ হাসপাতালে তিন মাস কাজ করার পর গোহার কুহতে পোস্টিং হল। শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য আমার তিন আঙ্গুল কপালে ভালো কিছু যে জুটবে না, সে আমি আগে থেকেই জানতাম।
ততদিনে বউ বাচ্চা চলে এসেছে। নিঃসঙ্গতা অনেকটাই কেটে গেছে। ভাষাটাও মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছি। মনে পড়ে, প্রথম যেদিন খাশ হাসপাতালে ডিউটি করতে গেলাম, ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। হালে শুমা, খাইলি মামনুন, আর খায়েশ মিকুনাম ছাড়া তো কিছুই জানি না। রুগীর সাথে কথা বলব কেমন করে ? উল্টা সিধা ওষুধ লিখে শেষে রুগীর বারোটা না বাজিয়ে ফেলি ! জাহিদ ভাইকে বলতেই হেসে আশ্বস্ত করলেন,
- চিন্তা কইরো না মিয়াঁ। ব্যাটাগো রোগ বলতে সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটে ব্যথা, গায়ে ব্যথা, মাথায় ব্যথা। এই গুলা খেয়াল রাখলেই হইব।
- তা তো বুঝলাম জাহিদ ভাই। কিন্তু কোথায় ব্যথা বুঝব কী ভাবে ? গায়ে ব্যথার ওষুধ পেটে ব্যথায় দিলে দিলে তো কম্ম সাবাড়। পেট ফুটা হইয়া যাইবে।
- আরে না না। বালুচগো প্যাট ট্যাবলেট তো দূরের কথা, বুলেটও ফুটা করতে পারে না।
- তারপরও যদি কিছু কমন শব্দ শিখাইয়া দিতেন।
- আচ্ছা শুনো। পরথমেই জিগাইবা চী শুদে ? মাইনে, কী হইছে ? যা’ই কউক, তারপর জিগাইবা দারদ দারি (ব্যথা আছে) ? কুজা দারদ দারি (কোথায় ব্যথা ) ? তাব দারি (জ্বর আছে) ? ছোরফে দারি (কাশি আছে) ? ব্যাস, দেখবা, রোগ ধইরা ফালাইছ। তাছাড়া আমি তো আছিই।
আল্লাহ নাম নিয়ে ইমার্জেন্সীতে জাহিদ ভাইয়ের পাশের টেবিলে বসে রুগী দেখা শুরু করলাম। অবাক কাণ্ড ! যারে যা’ই জিগাই, মাথা নাড়াইয়া কয় “বালে”। তাব দারি ? কয় বালে। ছোরফে দারি? কয় বালে। দারদ দারি ? কয় বালে। মর জ্বালা, সব কিছুতেই বালে ? অর্থাৎ, হ্যাঁ। রাইগা মাইগা জিগাইলাম, কুজা দারদ দারি ? আয় হায়, এ দেখি হাত, পা, মাথা, পেট সবই দেখাইয়া দেয়। এ তো “সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেব কোথা” অবস্থা। অথচ কপালে হাত রাইখা দেখি জ্বর জ্বারি কিছুই নাই। তাগড়া পাঠান শরীর। ব্যথার ব ও আছে বইলা মনে হয় না। অসহায় চোখে জাহিদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পাশের টেবিলে বসে উনি আমাকেই দেখছিলেন। হেসে বললেন,
- শুনো। এরা গরীব মানুষ। শহর থাইকা দূরে থাকে। ক্ষেত খামারি করে। ছাগল, ভেড়া পালে। মাসে এক দুইবার শহরে আসে বাজার ঘাট করার লাইগা। সেই সাথে ডাক্তারও দেখাইয়া যায়। শীতের দেশ। প্রায়ই ওদের সর্দি, কাশি হয়। গায়ে ব্যথা, পেটে ব্যথা হয়। তাই আগাম ওষুধ নিয়া রাখে। তুমি আপাতত এক কোর্স, এন্টিবায়োটিক, কাশির সিরাপ, গায়ে ব্যথা আর পেটে ব্যথার ওষুধ দিয়া দাও। ফার্মাসিস্ট বুঝাইয়া দিবো কখন আর কেমনে খাইতে হইব।
কয় কী ? ওষুধ কি চাইল ডাইল যে দুর্দিনের জন্য আগাম মজুদ কইরা রাখব ? তাও আবার এন্টিবায়োটিক ? এই ভাবে আন্দাজে এন্টিবায়োটিক খাইলে সব রেজিস্ট্যান্স হইয়া যাইব। কী আর করা ? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। যেই দেশে যেই রীতি। তাই বলে তো নিজের পেশার প্রতি পুরাপুরি অবিচারও করতে পারি না। এন্টিবায়োটিক বাদ দিয়ে শুধু ব্যথার ট্যাবলেট ও কাশির সিরাপ দিয়ে দিলাম।
ঠিকই বলেছিলেন জাহিদ ভাই। প্রায় সবারই একই অবস্থা। একই সমস্যা। একই সমাধান। এরই মধ্যে একজন তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এক পোমাদ লোফত কুন দকতোর। মধ্য বয়সী মানুষটার কড়ে পড়া হাতটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। কোনো চর্ম রোগ জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না। ফার্সিতে কী বলল, তাও বুঝলাম না। আবার জাহিদ ভাইয়ের দ্বারস্থ হলাম। জাহিদ ভাই বললেন,
- মলম চাইতাছে।
- কীসের মলম জাহিদ ভাই ?
- বেটনোভেট।
- কন কী ? এইটা তো স্টেরয়েড। ওর তো খুজলি পাঁচড়া কিছু নাই।
- দেখতাছো না, কাম করতে করতে ওর হাতে কড়া পইড়া গেছে। বেটনোভেট লাগাইলে হাত নরম হয়। ওরা এইটা জানে। দিয়া দাও।
হায় হায়, এত বছর ধরে কী পড়লাম, কী শিখলাম, আর এখন কী করতে হচ্ছে ? আমি কী ডাক্তারি করমু ? রুগীরাই দেখি ওষুধ চাইয়া চাইয়া নেয়। আর চাইবেই বা না ক্যান ? ওষুধ তো আর পয়সা দিয়া কিনতে হয় না। এ দেশে ওষুধ, চিকিৎসা সব ফ্রি। শুধু দশ তোমান (বাংলাদেশি টাকায় আড়াই টাকা) দিয়ে একটা টিকেট কাটতে হয়। সেই টাকা উশুল করতেই মুদী বাজারের ফর্দের মতো ওষুধের ফর্দ নিয়ে আসে। সেই ফর্দে আরও কত রকম ফরমায়েশ আছে কে জানে ? বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। লোলচর্ম সর্বস্ব এক বুড়ো। সত্তরের উপরে বয়স। এসে বলল,
- অগাই দকতোর, বিতামিন মিখাম।
বুঝলাম, বিতামিন, অর্থাৎ, ভিটামিন চাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষের মতো এদেরও কী ধারণা ভিটামিন খেলে শরীরে শক্তি বাড়ে ? ওকে কেমন করে বুঝাই, শক্তি ভিটামিনে নয়, শক্তি আছে ভাত রুটি, মাছ মাংস, ডিম, দুধ, মাখনে। হাত নেড়ে ইশারায় জানতে চাইলাম, কেন ? অবাক হয়ে দেখি কিশোরী মেয়ের মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেল বৃদ্ধ। পাগড়ীর লেজটা টেনে দাড়ি, মুখ ঢেকে, এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
- জানে জওয়ান দারাম দকতোরজুন।
মানে কী ? বুইড়া কী জওয়ান হইতে চায় ? চাইতেই পারে। আমরা সবাই জওয়ান থাকতে চাই কিংবা হইতে চাই। এতে এত লজ্জা পাওনের কী আছে ? জাহিদ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখি, রুগী দেখা বাদ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন,
- বুইড়া নয়া শাদী করছে। জোয়ান বউরে সামলাইতে পারতাছে না। শক্তি বাড়াইতে ভিটামিন চায়।
শুনে আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারি না। কুসংস্কার মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে ? ব্যাটা বুইড়া ভাম, নিজেই ঠিক মতো দুই পায়ে খাড়াইতে পারে না, যুবতী বউয়ের সামনে খাড়াইব কেমনে ? অথচ নিশ্চয়ই শুধু টাকার জোরে আর ধর্মীয় বিধানের দোহাই দিয়ে বিয়ে করেছে তার নাতির বয়সী কোনো এক মেয়েকে ! অদেখা সেই মেয়েটির জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার। আহা, না জানি কত স্বপ্ন ছিল তার। স্বপ্নের রাজ কুমার আসবে তার ঘোড়ায় চড়ে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাকে সুখের সাগরে। এই শুষ্ক বুড়োর কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কোথায় খুঁজে পাবে সে সেই স্বর্গীয় সুখের নির্জাস ? এমনিতেই মেজাজটা তেঁতে ছিল। এবার তাতে আগুন ধরে গেল। বললাম,
- জাহিদ ভাই, ওরে বলেন, যতই ভিটামিন খাক, বুড়ো খচ্চর হয়ে কখনও তেজী ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পারবে না।
- মাথা গরম কইরো না মিয়াঁ। পরথম পরথম আমারও খুব রাগ হইত। পরে দেখলাম, লাভ নাই। কুসংস্কার এদের রক্তের মধ্যে মিইশা আছে। ভালো মন্দ মিলাইয়াই মানুষ। আমাগো কাম ডাক্তারি করা, সমাজ সংস্কার করা না। একটা মাল্টি-ভিটামিন দিয়া বিদায় করো।
পরে দেখেছি, এমন অসম বয়সী বিয়ে মূলত বালুচিস্তানে সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। না, এ জন্য নয় যে ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমোদন আছে। বরং এ জন্য যে, শিক্ষার আলো বালুচিস্তানে, বিশেষ করে বালুচ নারীদের কাছে তেমন পৌঁছায়নি। বালুচ মেয়েরা অধিকাংশই অশিক্ষিত কিংবা খুবই স্বল্প শিক্ষিত। এরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন নয়। এরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল, পুরুষের হাতের পুতুল। এরা ভাত কাপড়ের বিনিময়ে পুরুষের জন্য রুটি বানায়, রাতে বিছানায় শরীর দেয়। বছর বছর সন্তান ধারণ করে, তাদের লালন পালন করে। অথচ ইরানের উন্নত প্রদেশগুলোয় শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে এমন অসম বয়সী বিয়ে কিংবা বহু বিবাহের আধিক্য তেমন দেখা যায় না। কারণ, সেখানে মেয়েরা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে। চাকরী বাকরি করে স্বাবলম্বী হয়। নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। চাইলেই সেই সব মেয়েদের নিয়ে পুরুষরা পুতুল খেলা খেলতে পারে না। এই ব্যবধানটা শিয়া সুন্নির মাজহাবের জন্য নয়। ব্যবধানটা মূলত শিক্ষা ও অশিক্ষার, সুশিক্ষা ও কুশিক্ষার ।
এই তিন মাসে শুধু ফার্সি ভাষাটাই রপ্ত করিনি, বালুচদের চিন্তা চেতনা, ধ্যান ধারণা, রোগ শোক সম্বন্ধেও সম্যক ধারণা নিয়েছি। আমি জানতাম, আমার পোস্টিং পল্লী ক্লিনিক বা দারমাঙ্গায় হবে। সেখানে আমাকে একা একাই সব সামলাতে হবে। তাই এই তিন মাসে যতদূর সম্ভব, সব জেনে নিয়েছি। দারমাঙ্গায় ডাক্তারদের ফ্রি একোমোডেশন দেয়া হয়। ফুল ফার্নিশড। তাই কোনো আসবাব পত্রও কিনিনি। বউ বাচ্চা নিয়ে, ইরানের এক দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, এক নতুন জীবন শুরু করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে থাকলাম।
বালুচিস্তানে শীত খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে খুব গরম পড়ে। লু হাওয়া বয়। ধূলি ঝড় হয়। শীতের শেষে খুব অল্প সময়ের জন্য বসন্ত আসে। ওরা বলে ফাছলে বাহার। মৃদুমন্দ বাতাস বয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। পাহাড়ের গায়ে, খাঁজে খাঁজে নাম না জানা জংলি ফুল ফোটে। মরুভূমিতে ক্যাকটাসগুলোও সবুজ হয়ে ওঠে। এখানে সেখানে ফুটে থাকে থোকা থোকা মরু ফুল। এমনই এক বসন্তের সকালে, আমার বাসার সামনে ঢাউস এক ল্যন্ডক্রুজার হাজির। গোহার কুহ থেকে এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ড্রাইভারের নাম দাদ মোহাম্মদ। বালুচ। তবে সাধারণ বালুচদের তুলনায় বেশ ছোটখাটো। পেটানো শরীর। বছর চল্লিশেক বয়স। আমার মালপত্র সেই গাড়িতে ওঠাল। তারপর ড্রাইভারের পাশে সামনের সীটের দরজা খুলে আমাকে ওঠার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। আমাদের দেশে বড় সাহেবরা গাড়ির পিছনের সীটে হাত পা এলিয়ে বসেন। ড্রাইভারের পাশের সীটে বসলে বোধহয় তাদের সম্মানের হানি হয়। অথচ ইরানে দেখেছি, গাড়ির সামনের সীটে বসাটাই সম্মানজনক। ড্রাইভারের পাশে বসলে তাদের মান যায় না। আগে শুনেছি, এক দেশের গালি, আর এক দেশের বুলি। এখন দেখছি মান সম্মানের মাপকাঠিটাও এক এক দেশে এক এক রকম।
পিচ-ঢালা সমান রাস্তাই হোক, আর এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ি রাস্তাই হোক, এরা বোধহয় আস্তে গাড়ি চালাতে জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি পিচ-ঢালা হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় পড়ল। রাস্তা বলতে মানুষের তৈরি কোনো গতানুগতিক রাস্তা নয়। বরং বলা যায় গাড়ির ট্রেইল। অর্থাৎ, যে পথ দিয়ে গাড়ি চলতে চলতে চাকার গভীর ছাপ পড়ে গেছে। “আগের হাল যেদিকে যায়, পিছের হালও সেদিকে যায়” এর মতো সব গাড়ি সেই ছাপে চাকা ফেলে দূর্বার গতিতে ছুটে চলে। অনেকটা রেল লাইন ধরে রেলগাড়ি চলার মতো। এখানকার মাটি বলতে পাথরের নুড়ি আর বালি। তাই চাকা কখনও দেবে যায় না। তবে গাড়ির পিছনে ধুলোর ঝড় ওঠে। সেই ধুলোর কুণ্ডলী দেখে অনেক দূর থেকেই বোঝা যায়, কোনো গাড়ি আসছে। তাই মুখোমুখি সংঘর্ষের তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
যতদূর চোখ যায়, মাইলের পর মাইল ছোট ছোট পাহাড়, উপত্যকা আর মরুভূমি। এ রাস্তায় কোনো গণ-পরিবহণ চলে না। দাদ মোহাম্মদ জানাল, মানুষের বাহন বলতে প্রধানত মটর সাইকেল। আমাদের দেশের মতো একশ কিংবা দেড়শ সিসির মটর সাইকেল নয়, রীতিমত আড়াইশো, তিনশ সিসির ডাবল ইঞ্জিন মটর সাইকেল। এক সময় হয়ত ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চলাচল করত মানুষ। এখন প্রায় প্রত্যেক ঘরেই এক বা একাধিক মটর সাইকেল আছে। মানুষ ঘোড়ার মতোই মটর সাইকেলের যত্ন করে। রঙিন কাপড় দিয়ে সীট, তেলের ট্যাংক মুড়ে রাখে। মজার ব্যাপার হল, এরা মটর সাইকেলের সাইলেন্সরও খুলে রাখে। সাইলেন্সর বিহীন মটর সাইকেল যখন এই রাস্তায় ছুটে চলে, তিনশ সিসির ইঞ্জিনের বিকট শব্দে পাহাড়, উপত্যকা কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়। কোনো পথিক হাত তুললেই সীট খালি থাকলে নির্দ্বিধায় তাকে পিছে তুলে নেয়। তেমনই কিছু সাইকেল আরোহীর সাথে পথে দেখা হয়ে গেল। সাইকেল আরোহীরা ধূলা বালির হাত থেকে বাঁচার জন্য মাথা, মুখ পাগড়ী দিয়ে ঢেকে রাখে। দেখলে অনেকটা হিন্দি সিনেমার ডাকুদের মতো মনে হয়। দাদ মোহাম্মদ আগে থেকে না জানালে তো ভয়ে আমার পিলে চমকে যেত। শুনেছি, গোহার কুহের কাছ দিয়েই ট্রান্স এশিয়ান ড্রাগ ট্রাফিকিং ট্রেইল বা আন্তঃএশিয় মাদক চোরাচালানের পথ চলে গেছে। সে পথে মাঝে মাঝে বন্দুক যুদ্ধও হয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, এই যে মানুষগুলো ডাকাতের মতো আপাদমস্তক ঢেকে চলাচল করছে, ওদের মধ্যে কেউ স্মাগলার আছে কিনা ? ওদের কাছেও পিস্তল বন্দুক আছে কিনা ? প্রথম দেখায় আমার অধীনস্থ একজন ড্রাইভারকে এ প্রশ্ন করা যায় না। আমি চুপ করে থাকলাম। অথচ দেখলাম, পথে দেখা হলেই চালকরা একে অন্যকে হেড লাইট জ্বালিয়ে, হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছে। যেন বলতে চাইছে, আমি আছি, কোনো ভয় নেই নির্জন রাস্তায়। পথে দু একটা পিক আপ জাতীয় গাড়িও চোখে পড়ল। যাদের একটু পয়সা কড়ি আছে, তারা কেনে। এতে মালামাল ও যাত্রী, দুটোই বহন করা যায়।
দৃষ্টিনন্দন পথ হলে তা দেখতে দেখতেই কেটে যায়। অথচ ধূসর মরু পথে সে সুযোগ নেই। বৈচিত্রহীন এই পথ যেন শেষই হতে চায় না। সূর্যদেব ততোক্ষণে নির্দয় হাতে আগুন ছড়াতে শুরু করেছেন মাথার উপরে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির মধ্যে বসে সে আগুন টের না পেলেও সামনের মরীচিকা বলে দেয়, কতটা রেগে আছেন তিনি। বসন্তেই এই অবস্থা, গ্রীষ্মে না জানি কী হাল হবে। শুনেছি গোহার কুহতে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। জেনারেটরের মাধ্যমে দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু রাতের বেলা ? গরমে তো আলু ভর্তা হয়ে যাব ! গাড়ি যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, দুশ্চিন্তায় ততই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। দাদ মোহাম্মদ গোহার কুহের ছেলে। যদিও যেতে যেতে সে গোহার কুহের ভূয়সী প্রশংসা করছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। আমার কাছে তা আব্দুর রহমানের “ইন হাস্ত ওয়াতানাম” এর মতো মনে হচ্ছিল। এমন সময় ছোট এক পাহাড়ের উপর থেকে গোহার কুহকে দেখা গেল। এ কী দেখছি আমি ? এমনটা দেখার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।