What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ইরানি দাস্তান (অসমাপ্ত) (1 Viewer)

ইরানি দাস্তান

পর্ব – ৮









খাশ শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে, পাহাড় ঘেরা এক দুর্গম জনপদ। নাম, গোহার কুহ। বাংলায় যার অর্থ, রত্নের পাহাড় কিংবা রত্নময় পর্বতমালা। না, কোনো সোনা রূপা, হীরে জহরত কিংবা মণি মাণিক্য পাওয়া যায় না এই পাহাড়ে। নিরেট পাথরে গড়া কালচে ধূসর পর্বতমালা। শুষ্ক মরুর এই প্রদেশে পানি জীবনের মতোই দামী। যেখানেই একটু পানির উৎস, সেখানেই জীবন, সেখানেই মানুষ, সেখানেই গড়ে উঠে মানুষের বসতি। পাথুরে এই পাহাড়ের গা বেয়েও নেমে এসেছে কিছু পানির নহর। সেই পানিকে ঘিরেই এই জনপদ। পাহাড়গুলো তাই এই জনপদের মানুষের কাছে গোহার কিংবা রত্নের মতোই দামী।

মানুষের যে কয়টি মৌলিক চাহিদা আছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তাদের মধ্যে অন্যতম। যত দূরেই হোক, যত দুর্গমই হোক, যেখানেই মানুষের বসতি, ইরান সরকার সেখানেই পৌঁছে দিয়েছে শিক্ষার আলো। সেখানেই ওষুধপত্র নিয়ে পৌঁছে যায় ডাক্তার। বিনামূল্যে ! খাশের অধীনে যে কয়টি পল্লী ক্লিনিক বা দারমাঙ্গা আছে, গোহার কুহ তাদের মধ্যে সব চেয়ে দূরে, সব চেয়ে দুর্গম, সব চেয়ে অনুন্নত। পড়বি তো পড়, আমার ভাগ্যেই পড়ল সব চেয়ে খারাপ দারমাঙ্গা, গোহার কুহ। খাশ হাসপাতালে তিন মাস কাজ করার পর গোহার কুহতে পোস্টিং হল। শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য আমার তিন আঙ্গুল কপালে ভালো কিছু যে জুটবে না, সে আমি আগে থেকেই জানতাম।

ততদিনে বউ বাচ্চা চলে এসেছে। নিঃসঙ্গতা অনেকটাই কেটে গেছে। ভাষাটাও মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছি। মনে পড়ে, প্রথম যেদিন খাশ হাসপাতালে ডিউটি করতে গেলাম, ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। হালে শুমা, খাইলি মামনুন, আর খায়েশ মিকুনাম ছাড়া তো কিছুই জানি না। রুগীর সাথে কথা বলব কেমন করে ? উল্টা সিধা ওষুধ লিখে শেষে রুগীর বারোটা না বাজিয়ে ফেলি ! জাহিদ ভাইকে বলতেই হেসে আশ্বস্ত করলেন,

- চিন্তা কইরো না মিয়াঁ। ব্যাটাগো রোগ বলতে সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটে ব্যথা, গায়ে ব্যথা, মাথায় ব্যথা। এই গুলা খেয়াল রাখলেই হইব।

- তা তো বুঝলাম জাহিদ ভাই। কিন্তু কোথায় ব্যথা বুঝব কী ভাবে ? গায়ে ব্যথার ওষুধ পেটে ব্যথায় দিলে দিলে তো কম্ম সাবাড়। পেট ফুটা হইয়া যাইবে।

- আরে না না। বালুচগো প্যাট ট্যাবলেট তো দূরের কথা, বুলেটও ফুটা করতে পারে না।

- তারপরও যদি কিছু কমন শব্দ শিখাইয়া দিতেন।

- আচ্ছা শুনো। পরথমেই জিগাইবা চী শুদে ? মাইনে, কী হইছে ? যা’ই কউক, তারপর জিগাইবা দারদ দারি (ব্যথা আছে) ? কুজা দারদ দারি (কোথায় ব্যথা ) ? তাব দারি (জ্বর আছে) ? ছোরফে দারি (কাশি আছে) ? ব্যাস, দেখবা, রোগ ধইরা ফালাইছ। তাছাড়া আমি তো আছিই।

আল্লাহ নাম নিয়ে ইমার্জেন্সীতে জাহিদ ভাইয়ের পাশের টেবিলে বসে রুগী দেখা শুরু করলাম। অবাক কাণ্ড ! যারে যা’ই জিগাই, মাথা নাড়াইয়া কয় “বালে”। তাব দারি ? কয় বালে। ছোরফে দারি? কয় বালে। দারদ দারি ? কয় বালে। মর জ্বালা, সব কিছুতেই বালে ? অর্থাৎ, হ্যাঁ। রাইগা মাইগা জিগাইলাম, কুজা দারদ দারি ? আয় হায়, এ দেখি হাত, পা, মাথা, পেট সবই দেখাইয়া দেয়। এ তো “সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেব কোথা” অবস্থা। অথচ কপালে হাত রাইখা দেখি জ্বর জ্বারি কিছুই নাই। তাগড়া পাঠান শরীর। ব্যথার ব ও আছে বইলা মনে হয় না। অসহায় চোখে জাহিদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পাশের টেবিলে বসে উনি আমাকেই দেখছিলেন। হেসে বললেন,

- শুনো। এরা গরীব মানুষ। শহর থাইকা দূরে থাকে। ক্ষেত খামারি করে। ছাগল, ভেড়া পালে। মাসে এক দুইবার শহরে আসে বাজার ঘাট করার লাইগা। সেই সাথে ডাক্তারও দেখাইয়া যায়। শীতের দেশ। প্রায়ই ওদের সর্দি, কাশি হয়। গায়ে ব্যথা, পেটে ব্যথা হয়। তাই আগাম ওষুধ নিয়া রাখে। তুমি আপাতত এক কোর্স, এন্টিবায়োটিক, কাশির সিরাপ, গায়ে ব্যথা আর পেটে ব্যথার ওষুধ দিয়া দাও। ফার্মাসিস্ট বুঝাইয়া দিবো কখন আর কেমনে খাইতে হইব।

কয় কী ? ওষুধ কি চাইল ডাইল যে দুর্দিনের জন্য আগাম মজুদ কইরা রাখব ? তাও আবার এন্টিবায়োটিক ? এই ভাবে আন্দাজে এন্টিবায়োটিক খাইলে সব রেজিস্ট্যান্স হইয়া যাইব। কী আর করা ? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। যেই দেশে যেই রীতি। তাই বলে তো নিজের পেশার প্রতি পুরাপুরি অবিচারও করতে পারি না। এন্টিবায়োটিক বাদ দিয়ে শুধু ব্যথার ট্যাবলেট ও কাশির সিরাপ দিয়ে দিলাম।

ঠিকই বলেছিলেন জাহিদ ভাই। প্রায় সবারই একই অবস্থা। একই সমস্যা। একই সমাধান। এরই মধ্যে একজন তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এক পোমাদ লোফত কুন দকতোর। মধ্য বয়সী মানুষটার কড়ে পড়া হাতটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। কোনো চর্ম রোগ জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না। ফার্সিতে কী বলল, তাও বুঝলাম না। আবার জাহিদ ভাইয়ের দ্বারস্থ হলাম। জাহিদ ভাই বললেন,

- মলম চাইতাছে।

- কীসের মলম জাহিদ ভাই ?

- বেটনোভেট।

- কন কী ? এইটা তো স্টেরয়েড। ওর তো খুজলি পাঁচড়া কিছু নাই।

- দেখতাছো না, কাম করতে করতে ওর হাতে কড়া পইড়া গেছে। বেটনোভেট লাগাইলে হাত নরম হয়। ওরা এইটা জানে। দিয়া দাও।

হায় হায়, এত বছর ধরে কী পড়লাম, কী শিখলাম, আর এখন কী করতে হচ্ছে ? আমি কী ডাক্তারি করমু ? রুগীরাই দেখি ওষুধ চাইয়া চাইয়া নেয়। আর চাইবেই বা না ক্যান ? ওষুধ তো আর পয়সা দিয়া কিনতে হয় না। এ দেশে ওষুধ, চিকিৎসা সব ফ্রি। শুধু দশ তোমান (বাংলাদেশি টাকায় আড়াই টাকা) দিয়ে একটা টিকেট কাটতে হয়। সেই টাকা উশুল করতেই মুদী বাজারের ফর্দের মতো ওষুধের ফর্দ নিয়ে আসে। সেই ফর্দে আরও কত রকম ফরমায়েশ আছে কে জানে ? বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। লোলচর্ম সর্বস্ব এক বুড়ো। সত্তরের উপরে বয়স। এসে বলল,

- অগাই দকতোর, বিতামিন মিখাম।

বুঝলাম, বিতামিন, অর্থাৎ, ভিটামিন চাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষের মতো এদেরও কী ধারণা ভিটামিন খেলে শরীরে শক্তি বাড়ে ? ওকে কেমন করে বুঝাই, শক্তি ভিটামিনে নয়, শক্তি আছে ভাত রুটি, মাছ মাংস, ডিম, দুধ, মাখনে। হাত নেড়ে ইশারায় জানতে চাইলাম, কেন ? অবাক হয়ে দেখি কিশোরী মেয়ের মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেল বৃদ্ধ। পাগড়ীর লেজটা টেনে দাড়ি, মুখ ঢেকে, এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

- জানে জওয়ান দারাম দকতোরজুন।

মানে কী ? বুইড়া কী জওয়ান হইতে চায় ? চাইতেই পারে। আমরা সবাই জওয়ান থাকতে চাই কিংবা হইতে চাই। এতে এত লজ্জা পাওনের কী আছে ? জাহিদ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখি, রুগী দেখা বাদ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন,

- বুইড়া নয়া শাদী করছে। জোয়ান বউরে সামলাইতে পারতাছে না। শক্তি বাড়াইতে ভিটামিন চায়।

শুনে আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারি না। কুসংস্কার মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে ? ব্যাটা বুইড়া ভাম, নিজেই ঠিক মতো দুই পায়ে খাড়াইতে পারে না, যুবতী বউয়ের সামনে খাড়াইব কেমনে ? অথচ নিশ্চয়ই শুধু টাকার জোরে আর ধর্মীয় বিধানের দোহাই দিয়ে বিয়ে করেছে তার নাতির বয়সী কোনো এক মেয়েকে ! অদেখা সেই মেয়েটির জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার। আহা, না জানি কত স্বপ্ন ছিল তার। স্বপ্নের রাজ কুমার আসবে তার ঘোড়ায় চড়ে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাকে সুখের সাগরে। এই শুষ্ক বুড়োর কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কোথায় খুঁজে পাবে সে সেই স্বর্গীয় সুখের নির্জাস ? এমনিতেই মেজাজটা তেঁতে ছিল। এবার তাতে আগুন ধরে গেল। বললাম,

- জাহিদ ভাই, ওরে বলেন, যতই ভিটামিন খাক, বুড়ো খচ্চর হয়ে কখনও তেজী ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পারবে না।

- মাথা গরম কইরো না মিয়াঁ। পরথম পরথম আমারও খুব রাগ হইত। পরে দেখলাম, লাভ নাই। কুসংস্কার এদের রক্তের মধ্যে মিইশা আছে। ভালো মন্দ মিলাইয়াই মানুষ। আমাগো কাম ডাক্তারি করা, সমাজ সংস্কার করা না। একটা মাল্টি-ভিটামিন দিয়া বিদায় করো।

পরে দেখেছি, এমন অসম বয়সী বিয়ে মূলত বালুচিস্তানে সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। না, এ জন্য নয় যে ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমোদন আছে। বরং এ জন্য যে, শিক্ষার আলো বালুচিস্তানে, বিশেষ করে বালুচ নারীদের কাছে তেমন পৌঁছায়নি। বালুচ মেয়েরা অধিকাংশই অশিক্ষিত কিংবা খুবই স্বল্প শিক্ষিত। এরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন নয়। এরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল, পুরুষের হাতের পুতুল। এরা ভাত কাপড়ের বিনিময়ে পুরুষের জন্য রুটি বানায়, রাতে বিছানায় শরীর দেয়। বছর বছর সন্তান ধারণ করে, তাদের লালন পালন করে। অথচ ইরানের উন্নত প্রদেশগুলোয় শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যে এমন অসম বয়সী বিয়ে কিংবা বহু বিবাহের আধিক্য তেমন দেখা যায় না। কারণ, সেখানে মেয়েরা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে। চাকরী বাকরি করে স্বাবলম্বী হয়। নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। চাইলেই সেই সব মেয়েদের নিয়ে পুরুষরা পুতুল খেলা খেলতে পারে না। এই ব্যবধানটা শিয়া সুন্নির মাজহাবের জন্য নয়। ব্যবধানটা মূলত শিক্ষা ও অশিক্ষার, সুশিক্ষা ও কুশিক্ষার ।

এই তিন মাসে শুধু ফার্সি ভাষাটাই রপ্ত করিনি, বালুচদের চিন্তা চেতনা, ধ্যান ধারণা, রোগ শোক সম্বন্ধেও সম্যক ধারণা নিয়েছি। আমি জানতাম, আমার পোস্টিং পল্লী ক্লিনিক বা দারমাঙ্গায় হবে। সেখানে আমাকে একা একাই সব সামলাতে হবে। তাই এই তিন মাসে যতদূর সম্ভব, সব জেনে নিয়েছি। দারমাঙ্গায় ডাক্তারদের ফ্রি একোমোডেশন দেয়া হয়। ফুল ফার্নিশড। তাই কোনো আসবাব পত্রও কিনিনি। বউ বাচ্চা নিয়ে, ইরানের এক দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, এক নতুন জীবন শুরু করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে থাকলাম।

বালুচিস্তানে শীত খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে খুব গরম পড়ে। লু হাওয়া বয়। ধূলি ঝড় হয়। শীতের শেষে খুব অল্প সময়ের জন্য বসন্ত আসে। ওরা বলে ফাছলে বাহার। মৃদুমন্দ বাতাস বয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। পাহাড়ের গায়ে, খাঁজে খাঁজে নাম না জানা জংলি ফুল ফোটে। মরুভূমিতে ক্যাকটাসগুলোও সবুজ হয়ে ওঠে। এখানে সেখানে ফুটে থাকে থোকা থোকা মরু ফুল। এমনই এক বসন্তের সকালে, আমার বাসার সামনে ঢাউস এক ল্যন্ডক্রুজার হাজির। গোহার কুহ থেকে এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ড্রাইভারের নাম দাদ মোহাম্মদ। বালুচ। তবে সাধারণ বালুচদের তুলনায় বেশ ছোটখাটো। পেটানো শরীর। বছর চল্লিশেক বয়স। আমার মালপত্র সেই গাড়িতে ওঠাল। তারপর ড্রাইভারের পাশে সামনের সীটের দরজা খুলে আমাকে ওঠার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। আমাদের দেশে বড় সাহেবরা গাড়ির পিছনের সীটে হাত পা এলিয়ে বসেন। ড্রাইভারের পাশের সীটে বসলে বোধহয় তাদের সম্মানের হানি হয়। অথচ ইরানে দেখেছি, গাড়ির সামনের সীটে বসাটাই সম্মানজনক। ড্রাইভারের পাশে বসলে তাদের মান যায় না। আগে শুনেছি, এক দেশের গালি, আর এক দেশের বুলি। এখন দেখছি মান সম্মানের মাপকাঠিটাও এক এক দেশে এক এক রকম।

পিচ-ঢালা সমান রাস্তাই হোক, আর এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ি রাস্তাই হোক, এরা বোধহয় আস্তে গাড়ি চালাতে জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি পিচ-ঢালা হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় পড়ল। রাস্তা বলতে মানুষের তৈরি কোনো গতানুগতিক রাস্তা নয়। বরং বলা যায় গাড়ির ট্রেইল। অর্থাৎ, যে পথ দিয়ে গাড়ি চলতে চলতে চাকার গভীর ছাপ পড়ে গেছে। “আগের হাল যেদিকে যায়, পিছের হালও সেদিকে যায়” এর মতো সব গাড়ি সেই ছাপে চাকা ফেলে দূর্বার গতিতে ছুটে চলে। অনেকটা রেল লাইন ধরে রেলগাড়ি চলার মতো। এখানকার মাটি বলতে পাথরের নুড়ি আর বালি। তাই চাকা কখনও দেবে যায় না। তবে গাড়ির পিছনে ধুলোর ঝড় ওঠে। সেই ধুলোর কুণ্ডলী দেখে অনেক দূর থেকেই বোঝা যায়, কোনো গাড়ি আসছে। তাই মুখোমুখি সংঘর্ষের তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

যতদূর চোখ যায়, মাইলের পর মাইল ছোট ছোট পাহাড়, উপত্যকা আর মরুভূমি। এ রাস্তায় কোনো গণ-পরিবহণ চলে না। দাদ মোহাম্মদ জানাল, মানুষের বাহন বলতে প্রধানত মটর সাইকেল। আমাদের দেশের মতো একশ কিংবা দেড়শ সিসির মটর সাইকেল নয়, রীতিমত আড়াইশো, তিনশ সিসির ডাবল ইঞ্জিন মটর সাইকেল। এক সময় হয়ত ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চলাচল করত মানুষ। এখন প্রায় প্রত্যেক ঘরেই এক বা একাধিক মটর সাইকেল আছে। মানুষ ঘোড়ার মতোই মটর সাইকেলের যত্ন করে। রঙিন কাপড় দিয়ে সীট, তেলের ট্যাংক মুড়ে রাখে। মজার ব্যাপার হল, এরা মটর সাইকেলের সাইলেন্সরও খুলে রাখে। সাইলেন্সর বিহীন মটর সাইকেল যখন এই রাস্তায় ছুটে চলে, তিনশ সিসির ইঞ্জিনের বিকট শব্দে পাহাড়, উপত্যকা কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়। কোনো পথিক হাত তুললেই সীট খালি থাকলে নির্দ্বিধায় তাকে পিছে তুলে নেয়। তেমনই কিছু সাইকেল আরোহীর সাথে পথে দেখা হয়ে গেল। সাইকেল আরোহীরা ধূলা বালির হাত থেকে বাঁচার জন্য মাথা, মুখ পাগড়ী দিয়ে ঢেকে রাখে। দেখলে অনেকটা হিন্দি সিনেমার ডাকুদের মতো মনে হয়। দাদ মোহাম্মদ আগে থেকে না জানালে তো ভয়ে আমার পিলে চমকে যেত। শুনেছি, গোহার কুহের কাছ দিয়েই ট্রান্স এশিয়ান ড্রাগ ট্রাফিকিং ট্রেইল বা আন্তঃএশিয় মাদক চোরাচালানের পথ চলে গেছে। সে পথে মাঝে মাঝে বন্দুক যুদ্ধও হয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, এই যে মানুষগুলো ডাকাতের মতো আপাদমস্তক ঢেকে চলাচল করছে, ওদের মধ্যে কেউ স্মাগলার আছে কিনা ? ওদের কাছেও পিস্তল বন্দুক আছে কিনা ? প্রথম দেখায় আমার অধীনস্থ একজন ড্রাইভারকে এ প্রশ্ন করা যায় না। আমি চুপ করে থাকলাম। অথচ দেখলাম, পথে দেখা হলেই চালকরা একে অন্যকে হেড লাইট জ্বালিয়ে, হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছে। যেন বলতে চাইছে, আমি আছি, কোনো ভয় নেই নির্জন রাস্তায়। পথে দু একটা পিক আপ জাতীয় গাড়িও চোখে পড়ল। যাদের একটু পয়সা কড়ি আছে, তারা কেনে। এতে মালামাল ও যাত্রী, দুটোই বহন করা যায়।

দৃষ্টিনন্দন পথ হলে তা দেখতে দেখতেই কেটে যায়। অথচ ধূসর মরু পথে সে সুযোগ নেই। বৈচিত্রহীন এই পথ যেন শেষই হতে চায় না। সূর্যদেব ততোক্ষণে নির্দয় হাতে আগুন ছড়াতে শুরু করেছেন মাথার উপরে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির মধ্যে বসে সে আগুন টের না পেলেও সামনের মরীচিকা বলে দেয়, কতটা রেগে আছেন তিনি। বসন্তেই এই অবস্থা, গ্রীষ্মে না জানি কী হাল হবে। শুনেছি গোহার কুহতে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। জেনারেটরের মাধ্যমে দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু রাতের বেলা ? গরমে তো আলু ভর্তা হয়ে যাব ! গাড়ি যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, দুশ্চিন্তায় ততই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। দাদ মোহাম্মদ গোহার কুহের ছেলে। যদিও যেতে যেতে সে গোহার কুহের ভূয়সী প্রশংসা করছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। আমার কাছে তা আব্দুর রহমানের “ইন হাস্ত ওয়াতানাম” এর মতো মনে হচ্ছিল। এমন সময় ছোট এক পাহাড়ের উপর থেকে গোহার কুহকে দেখা গেল। এ কী দেখছি আমি ? এমনটা দেখার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
 
ইরানি দাস্তান
পর্ব – ৯






ছোট, বড়, মাঝারি, হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা আকৃতির পাহাড়। সবই রুক্ষ, ধূসর, কালো। সেই সব পাথুরে পাহাড়ে গাছপালা নেই বললেই চলে। অথচ তারই মাঝখানে সবুজে মোড়া কয়েক মাইল ব্যাপী বিস্তীর্ণ সমতল। যেন বিশাল এক মোলায়েম সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ। ইরানে আসার পর এমন গাঢ় সবুজ প্রকৃতি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিস্ময়ে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। অবাক চোখে দাদ মোহাম্মদের দিকে তাকাতেই এক গাল হেসে সে বলল,

- বলেছিলাম না দকতোর ? গোহার কুহ বেহেশত দার জমিন হাস্ত !

না, ভুল বলেনি দাদ মোহাম্মদ। আসলেই গোহার কুহকে দূর থেকে জমিনের বুকে এক টুকরা বেহেশত বলেই মনে হচ্ছে। জানতে চাইলাম,

- এমন রুক্ষ মাটিতে এত গাঢ় সবুজ কী করে সম্ভব ?

- গোহার কুহের মাটির পেস্তা বাদামের জন্য খুব ভালো। এখানে অনেক বড় বড় পেস্তা বাগান আছে। সেই বাগানের জন্য মাটির অনেক গভীর থেকে মটরের সাহায্যে পানি তোলা হয়। তাই এলাকাটা এত সবুজ।

পেস্তা বাদাম। বাদাম জাতীয় ফলের মধ্যে সব চেয়ে সুস্বাদু। সব চেয়ে দামী। মাত্র যে কয়টি হাতে গোনা দেশে পেস্তার চাষ হয়, ইরান তাদের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর মোট পেস্তার প্রায় অর্ধেকটাই উৎপন্ন হয় ইরানে। বড় অদ্ভুত প্রজাতির উদ্ভিদ এই পেস্তা গাছ। স্বভাবে মরু-বৃক্ষ হলেও সব মরুতে জন্মায় না। এদের জন্য দরকার ফোস্কা পড়া গরম, হাড় কাঁপানো শীত আর সার্বক্ষণিক পানির প্রবাহ। এই তিনের সমন্বয় খুব কম এলাকায়ই পাওয়া যায়। এরা আটচল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে শুরু করে শূন্যের দশ ডিগ্রী নীচ পর্যন্ত তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। চরম আবহাওয়ায় জন্মায় বলেই হয়ত পেস্তা গাছ একবার জন্মালে প্রায় তিনশ বছর বেঁচে থাকে। এরা ইউনিসেক্স বা একলিঙ্গ জাতীয় উদ্ভিদ। একটা পুরুষ গাছ গড়ে দশটা স্ত্রী গাছের জন্য পুং রেণু ছড়াতে পারে। আর তাতেই এক একটা স্ত্রী গাছ বছর বছর প্রায় মন খানেক পেস্তা বাদামের জন্ম দেয়।

পথে যেতে যেতেই পড়ল কয়েকটা বিশাল পেস্তা বাগান। রাশি রাশি পেস্তা গাছ এক এক লাইনে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। দেখতে অনেকটা আমদের দেশের পেয়ারা গাছের মত। ফল আসতে শুরু করেছে। সবুজ পেস্তার গায়ে হালকা গোলাপি, বেগুনি আভা ছড়ানো। ঝুলে আছে থোকায় থোকায়। দেখে চোখ ফেরানো দায়। দুই সারি গাছের মাঝখানে ফুট তিনেক চওড়া নালার মতো। এখনও ভেজা। এই নালা দিয়েই সকাল বিকাল বয়ে যায় পাতাল থেকে তোলা পানি। দেখতে দেখতে গোহার কুহ এসে গেলাম। এখানে রাস্তার দু'ধারে যত্ন করে লাগানো সারি সারি ঝাউ গাছ। এই গাছের জন্যই গ্রামটা দূর থেকে এত সবুজ দেখাচ্ছিল। এই চামড়া পোড়া রোদেও গাছগুলোর গোরা ভেজা ভেজা। বুঝলাম, শুধু কুলীন পেস্তা নয়, সাধারণ ঝাউ গাছও সমান ভাবে পানি পায়।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, গোহার কুহ গ্রাম হলেও অনেক নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে এখানে। যেতে যেতে চোখে পড়ল, নিত্য প্রয়োজনীয় মুদি মনোহারি দোকান, রুটির দোকান, স্কুল, থানা, মসজিদ, টেলিফোন অফিস। কাঁটাতারে ঘেরা একটা এলাকা দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল দাদ মোহাম্মদ, “আরতেশ গাহ”। মানে আর্মিদের ক্যাম্প বা সেনানিবাস। বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে। গোহার কুহের মতো ছোট্ট এক গ্রামে কেন যে এত বড় এক আর্মি ক্যাম্প, দাদ মোহাম্মদ সেটা ব্যাখ্যা না করে বললেও আমার বুঝতে অসুবিধা হল না। গোহার কুহের শ্যামলিমা দেখে যতটুকু সবুজ হয়েছিল মন, এত বড় আরতেশ গাহ দেখে ততটাই ধূসর হয়ে গেল !

ইরানের নিয়মিত আর্মিকে ওরা বলে আরতেশ। পাঁচ লক্ষ সদস্যের এই শক্তিশালী আরতেশের প্রধান কাজ হল আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা ও বহিঃ কিংবা আভ্যন্তরীণ আক্রমণ থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখা। এ ছাড়াও আছে রিভোলিউশনারি গার্ড বা সেপাহ। ইসলামী বিপ্লবের পর, আয়াতুল্লাহ খোমেনির আহবানে ১৯৭৯ সালে গঠিত হয়েছিল। আড়াই লক্ষ সদস্যের সেপাহর দায়িত্ব হল দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা। স্বাভাবিক কারণেই রাজনৈতিক ভাবে সেপাহ আরতেশের চাইতে বেশি ক্ষমতাধর। ফলে একই দেশে দুই সমান্তরাল সামরিক বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের শীতল যুদ্ধ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগে থাকত।

দারমাঙ্গা কম্পাউন্ডে ঢুকতেই ষণ্ডা মার্কা একটা লোক দৌড়ে এসে আমার গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। লম্বায় ছয় ফুটের উপরে। মজবুত শরীর। অন্যান্য বালুচদের মতোই মাথায় বিশাল এক পাগড়ি। তবে দাড়ি নেই। মুখের অর্ধেকটা জুড়ে আছে ইয়া বড় একজোড়া পাকানো গোঁফ। চোখ দুটো বাজ পাখীর মতো তীক্ষ্ণ। দেখে তো আমার পিলে চমকে যাবার জোগাড়। যেন দক্ষিণ ভারতের দুর্ধর্ষ ডাকু বিরাপ্পানের হাতে পড়েছি। দাদ মোহাম্মদ পরিচয় করিয়ে দিল, কেফাতুল্লাহ, আমার সুরাইদার, অর্থাৎ নিরাপত্তা প্রহরী। শুনে ধরে প্রাণ আসে। আর যাই হোক, এই গোঁফ-ওয়ালা কাছে থাকলে কোনো চোর বদমাশ যে কাছে ঘেঁষবে না, এ কথা হলফ করে বলা যায়।

গাড়ি থেকে নামতেই তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ ! রীতিমত রাজকীয় ব্যবস্থা ! উঁচু দেয়াল ঘেরা অনেকখানি জায়গা জুড়ে দারমাঙ্গা কমপ্লেক্স। গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে সুরাইদার কেফাতুল্লাহর বাসা। সামনে ক্লিনিক ভবন। ক্লিনিকের পিছনেই কম্পাউন্ডারের বাসা। ক্লিনিক ভবন ছেড়ে কংক্রিটের রাস্তা ধরে একটু হেঁটে গেলেই বাংলো টাইপের ডাক্তারের বাসস্থান। সে রাস্তার দু'ধারে আঙ্গুরের বাগান। থোকা থোকা কাঁচা পাকা আঙ্গুর ঝুলে আছে লতানো ডালে । জীবনে এই প্রথম আঙ্গুর গাছ দেখলাম। শুনেছি, বেহেশতে আঙ্গুর খেতে মন চাইলে হুর পরিরা আঙ্গুরের থোকা মুখের কাছে ধরবে আর যত খুশি খাওয়া যাবে। এই দারমাঙ্গায় কোনো ইরানি পরি আমার মুখের কাছে আঙ্গুরের থোকা তুলে ধরবে কিনা জানিনা। তবে মন চাইলে যে আমি যখন খুশি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে পারব, তাতে সন্দেহ নেই। অন্তত আর আঙ্গুর কেনার বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। শুধু তাই নয়,আমাকে বয়ে আনা ল্যান্ডক্রুজাটা ছাড়াও গ্যারেজে পার্ক করা আছে একটা ল্যান্ড রোভার জীপ। আমার মতো ছাদনা তলার ডাক্তার, যার বাহন বলতে এতকাল ছিল তিন চাকার রিক্সা কিংবা স্কুটার, তার জন্য দুই দুইটা বিলাসবহুল গাড়ি অপেক্ষা করবে, তাও এই অজ পাড়াগাঁয়ে, এমন নবাবী আয়োজন কল্পনাও করতে পারিনি। এই প্রথম বারের মতো আমার তিন আঙ্গুল কপালকে পুরা চার আঙ্গুল চওড়া মনে হল।

দুই বেডরুমের হলেও ডাক্তারের বাংলোটা বেশ বড়সড়, খোলামেলা। সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো। আমার যুবতী স্ত্রী, যার বাসর রাত দু’বছর আগে শুরু হয়েছিল দম বন্ধ করা এক ছোট্ট ঘরে, এমন বিশাল পরিসরের বাড়ি পেয়ে সে প্রজাপতির মতো এ ঘর থেকে ও ঘরে উড়ে বেড়াতে লাগল। সাজানো গোছানো ঘর আবার নতুন করে সাজাতে শুরু করে দিল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেছে। খিধেয় পেট আমার চোঁচোঁ করছে। কিছু একটা রাঁধতে বলব, ওর এই খুশি দেখে তাও বলতে মন চাইছে না। আমি শুকনো কিছু খাবারের খোঁজে টোপলা টাপলি খুলতে শুরু করে দিলাম। এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে উঠল।

দরজা খুলতেই দেখি বিরাপ্পান কেফাতুল্লাহ হেঁট হয়ে দাঁড়িয়ে। অবশ্য পাঁচফুটী এই আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে তার হেঁট হওয়া ছাড়া উপায়ও নাই। পিছনে দুটি যুবতী মেয়ে। প্রায় সমবয়সী। সম্ভবত পিঠাপিঠি দুই বোন। কেফাতুল্লাহর মেয়ে ? দুজনের হাতেই বড়সড় ডালার মতো দুটি পাত্র। দুটোই রঙিন কাপড় দিয়ে ঢাকা। যেভাবে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে আসে মেয়েরা। কারা এরা ? কী নিয়ে এসেছে কাপড়ে ঢেকে ? আমি অবাক চোখে কেফাতুল্লার দিকে তাকালাম। সে তার বিশাল হাতদুটো কচলাতে কচলাতে বলল,

- ইয়েক কম গাজা বোরদাম দকতোরজুন। লুতফান কবুল কুনিদ। ( একটুখানি খাবার নিয়ে এসেছি ডাক্তার সাব। দয়া করে কবুল করো)।

দুই ডালা খাবাররে কয় একটুখানি ? ব্যাটা বিনয়ের অবতার ! আমিও তাড়াতাড়ি “বেফারমাইন”, “বেফারমাইন” বলে ওদের ভেতরে আসতে বললাম। মেয়ে দুটি ডাইনিং টেবিলে ডালা রেখে কাপড় সরিয়ে দিল। অমনি নানা সাইজের থালা, বাটি ভর্তি খাবার দেখে আমার দুচোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কোরমা, পোলাউ, রুটি, মাখন, গোসত, নানা রকম ফল, কী নেই ? ক্ষুধার রাজ্যে এমনিতেই পৃথিবী গদ্যময়। এক সঙ্গে এত খাবার, ঝলসানো রুটি নয়, যেন মেঘ না চাইতেই মুষল ধারায় বৃষ্টি ! কেফাতুল্লাহ তেমনই হাত কচলাতে কচলাতে বলল,

- আমি গরীব মানুষ। বেশি কিছু জোগাড় করতে পারিনি। কোনোমতে কষ্ট করে দুপুরটা খেয়ে নাও। রাতে কচি গুছফান্দের কাবাব করে আনব।

ব্যাটা কয় কী ? আমি মানুষ না হাতী ? যে খাবার এনেছে, আমরা দুজনে দুপুর তো দূরের কথা, দু’দিনেও খেয়ে শেষ করতে পারব না। তার উপর রাতে যদি সে সত্যি সত্যি কচি গুছফান্দের কাবাব নিয়ে হাজির হবে, তাহলে কম্ম সাবাড়। পাঠানদের মেহমানদারী যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। সুরাইদার মানুষ। কতই বা বেতন পায় ? এই খাবার তৈরি করতেই নিশ্চয়ই তার অনেক খরচ হয়ে গেছে। লোকটা ধনে গরীব হলেও মনে যে গরীব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অহেতুক আরও খরচ করুক, কোনমতেই চাই না আমি। হা হা করে উঠলাম,

- রক্ষা করো কেফাতুল্লাহ ? রাতে আর কিছু লাগবে না। যে খাবার এনেছ, আমাদের দুই দিন চলে যাবে।

- ও ! খাবার বুঝি তোমার পছন্দ হয় নাই ? নইলে আমি তো একাই এক বেলায় এর চেয়ে বেশি খাই।

মুখটা মলিন করে বলল কেফাতুল্লাহ। লোকটার শরীরটা ডাকাতের মতো হলেও মনটা অভিমানী বালকের মতো। এই পাগল পাঠানকে কেমন করে বোঝাই, তাল গাছের সাথে কলা গাছের তুলনা চলে না। তার শরীরের সাইজ দিয়ে তো আমার পেটের ক্ষুধা মাপলে হবে না। এ সব কথা তাকে বলা যায় না। প্রথম পরিচয়েই সুরাইদার কিসিমের লোকের সাথে হয়ত এ ধরনের মশকরা শোভা পায় না। যদিও এর আগে আমি কখনও বালুচি খাবার খাইনি, তবুও ওকে খুশি করার জন্য বললাম,

- না না, কী যে বলো তুমি ? গাজায়ে বালুচি খাইলি খোশমজ্জে হাস্ত। বালুচি খাবার ভীষণ মজাদার। খুব খুশবু ছড়াচ্ছে। আমার তো এখনই খেতে ইচ্ছে করছে।

শুনে শিশুসুলভ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কেফাতুল্লাহর মুখ। এক হাতে পাকানো গোঁফে তা দিয়ে অন্য হাত তুলে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বলল,

- ও রেঁধেছে।

- বাহ, তোমার মেয়ের তো অনেক গুণ।

শুনে মেয়ে দুটি মুখে চাঁদর চাপা দিয়ে হেসে কুটিপাটি হয়। সে হাসি দেখে আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। জানি, মেয়েরা রান্নার প্রশংসা শুনলে খুশি হয়। কিন্তু এ হাসি সে খুশির হাসি নয়। এ অন্য কিছু। কেফাতুল্লাহর দিকে তাকাতে দেখি সেও মিটিমিটি হাসছে। এবার সে দুই হাতে দুই গোঁফে মোচড় দিয়ে বলল,

- মেয়ে না দকতোর। বিবি।

- বলো কী ? দুই জনই ?

- না না। একজন বিবি, অন্যজন মেয়ে।

শুনে আমার বিস্ময়য়ের সীমা থাকে না। মুহূর্তে কেফাতুল্লাহর প্রতি আমার ধারণা বদলে যায় ? কত বয়স হবে তার ? পঁয়তাল্লিশ ? পঞ্চাশ ? নিজের মেয়ের বয়সী বিবি ? অথচ এ নিয়ে কোনো বিকার নেই। বরং এক ধরণের গর্বিত ভাব। যেন একাধিক গাড়ি থাকার মতো একাধিক স্ত্রী থাকাও গর্বের জিনিষ। আমি আবার মেয়ে দুটির দিকে তাকাই। এখনও দুজনে মুখ ঢেকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। ওদের মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে ডাগর কালো চোখের তারায় এখনও হাসির ঝিলিক। যেন বলতে চাইছে, এ কেমন বোকা ডাক্তার, মা মেয়ের তফাৎ বোঝে না ?

আসলেই ভীষণ বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সমাজ ব্যবস্থা কি মানুষের মানসিকতাও বদলে দেয় ? নইলে পিতার বয়সী পতি পেয়েও মেয়েটির চোখে দুঃখের কোনো ছায়া নেই কেন ? নাকি অবস্থা মানুষকে এভাবেই নিয়তিকে মেনে নিতে শেখায় ? নাকি এই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে কোনো বোবা কান্না ? আমার কেমন বিভ্রান্ত লাগে। কেফাতুল্লাহর আনা খাবার দেখে যে খুশির দোলা লেগেছিল মনে, কোথায় যেন তা হারিয়ে গেছে। খিধেটা হঠাৎ করেই মরে গেছে। কেফাতুল্লাহকে আমার এখন সত্যি সত্যি ডাকু বিরাপ্পান বলেই মনে হচ্ছে যে হয়ত খুশি মনেই খুন করেছে একটি কিশোরী মনের সব কুমারী স্বপ্ন ! আমার খুব ইচ্ছে করছিল বলি, কেফাতুল্লাহ, খাবারগুলো নিয়ে যাও। কুসংস্কারের বলি ওই নিরুপায় মেয়েটির হাত পুড়িয়ে রান্না করা খাবার আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না। চাইলেও সে কথা আমি বলতে পারি না। সব কথা বলা যায় না। আমিও নিরুপায় হয়ে একটা মেকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে ওদের বিদায় করে দিলাম।
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব – ১০




বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গে আমার। এক গভীর শান্তির ঘুম। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। গুহারকুর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এখনও ন্যাশনাল গ্রিডের সাথে যুক্ত হয়নি। স্থানীয় ভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেয়া হয়। এই গাঁও গেরামে এয়ার কন্ডিশনার নাই। তবে ঘর ঠাণ্ডা রাখার জন্য আছে এক অদ্ভুত কিসিমের ব্যবস্থা। এক গজ বাই এক গজ সাইজের চৌকা এক লোহার খাঁচা। তার চারিদিকে খুব সূক্ষ্ম খড়/ছন জাতীয় আঁশের পুরু স্তর। সরু রাবারের নলের সাহায্যে পানি প্রবাহিত করে আঁশের সে স্তর সব সময় ভিজিয়ে রাখা হয়। খাঁচার মাঝখানে থাকে এক শক্তিশালী ফ্যান। অনেকটা আমাদের টেবিল ফ্যানের সাইজ। একজস্ট ফ্যান ঘুরলে যেমন ভেতরের বাতাস বাইরে যায়, এই ফ্যান ঘুরলে তেমন বাইরের বাতাস ভেতরে আসে। বাইরের গরম বাতাস সেই ভেজা আঁশের স্তর ভেদ করে আসার সময় বেশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ঘরকে ভালোই শীতল করে দেয়। নাম দিয়েছে এয়ার কুলার ! অল্প খরচে ঘর ঠাণ্ডা রাখার এ অপূর্ব কৌশল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু ভয় পেয়ে গেলাম কেফাতুল্লার কথায়,

- সন্ধ্যার পরই খানাপিনা সেরে নিও দকতোর। রাত দশটার পর কারেন্ট থাকে না।

- বলো কী কেফাতুল্লাহ ? কারেন্ট না থাকলে তো কুলারও চলবে না। গরমে তো কচি গুছফান্দের মতো কাবাব হয়ে যাব !

- ফেকের না কুন দকতোর। দার শব হাওয়া ছার্দ মিশে ( চিন্তা করো না দকতোর। রাতে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে যায়)।

- কিন্তু সে তো বাইরের বাতাস। ঘরের বাতাস ঠাণ্ডা হবে কী করে ?

- কেন ? জানালা খুলে রাখবে।

আমি আড় চোখে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকাই। দেখি, দশাসই জানালা আছে ঠিকই, কিন্তু কোনো গরাদ বা গ্রিল নাই। সে জানালা দিয়ে চোর ডাকাত তো বটেই, চাইলে পাহাড়ি গরিলাও এসে আমাকে অনায়াসে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

- চোর টোর আসবে না তো !

- কী যে বলো দকতোর। গাঁও গেরামে চোর আসবে কোথা থেকে ?

মানে কী ? সব চোর ছ্যাঁচোর কি শহরেই থাকে ? অবশ্য, কেফাতুল্লার অদ্ভুত ভঙ্গীতে গোঁফে তা দিতে দেখে মনে হল, চিন্তা কী দকতোর ? যেখানে আমি আছি, সেখানে চোরের বাপেরও সাধ্য নেই কাছে ঘেঁষার ! ডাকু সর্দার ভিরাপ্পনের জিম্মায় একবার এসে যখন পড়েছি, চোর ডাকাতের ভয় যে নেই, সে ভরসা আমি আগেই পেয়েছিলাম। এবার আরও আশ্বস্ত হলাম।

সে রাতে কারেন্ট চলে গেলে আমরা জানালা খুলেই ঘুমিয়েছিলাম। না, ভুল বলেনি কেফাতুল্লাহ। বড় অদ্ভুত খেয়াল এই প্রকৃতির। যেখানে দিনের বেলা ডিম সেদ্ধ করা গরম, সেখানেই রাতে বইছিল মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া। শুনেছি, তপ্ত মরুভূমিতেও রাতের বেলা ঝট করেই ঠাণ্ডা নামে। এভাবেই হয়ত প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করে।

দারমাঙ্গায় প্রথম কর্ম দিবস। তাই দেরি না করে সকাল ন’টার মধ্যেই অফিসে হাজির হলাম। হায় আল্লাহ। এ কী দেখছি আমি। অফিস চত্বর লোকে লোকারণ্য। ছোট্ট একটা গ্রাম গুহারকুহ। কতই বা লোকসংখ্যা ? সবাই কি ঘর বাড়ি, কাম কাজ ছেড়ে চলে এসেছে দারমাঙ্গায় ? ভাবলাম, এরা বুঝি সবাই নতুন ডাক্তারকে এক নজর দেখতে এসেছে। যে চেহারা আর সাইজ আমার, এই পাঠানরা ডাক্তার হিসেবে আমার উপর কতটা ভরসা করবে, খোদাই জানে !

অফিসে ঢুকে দেখি দাদ মোহাম্মদ, কেফাতুল্লার সাথে আরও একজন যুবক দাঁড়িয়ে। বছর পঁচিশেক বয়স। তবে গায়ের রঙ পাঠানদের মতো তামাটে নয়। ধবধবে ফর্সা। পোশাক আশাকও আলাদা। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে হাত মেলাল। বলল,

- আমি বেহজাদ খারকুই। তোমার কম্পাউন্ডার। কাল একটু শহরে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল! তাই আর তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি। খাইলি শরমিন্দা হাস্তাম ( অনেক লজ্জিত)।

শুধু চেহারা নয়, ওর কথা বলার ধরণও আলাদা। বালুচদের মতো আন্তরিক নয়। মুখে শরমিন্দেগীর কথা বললেও চেহারায় তার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। পাশ থেকে দাদ মোহাম্মদ টিপ্পনী কাটার সুরে বলে উঠল, “উ জাবুলি হাস্ত (ও জাবুলি)”। জাবুল, সিস্তান বালুচিস্তানের একমাত্র শিয়া অধ্যুষিত জেলা। এমনিতেই শিয়াদের সুন্নি মুসলমানরা দু’চোখে দেখতে পারে না। তার উপর বালুচরা জাবুলিদের আরও দেখতে পারে না। অফিস আদালতের বড় বড় পদগুলো প্রায় সবই জাবুলি শিয়াদের দখলে। খাশে বসেই ওদের অনেক দুর্নাম শুনেছি। ভূ-প্রাকৃতিক কারণেই একই দেশের মধ্যেও এক এক অঞ্চলের মানুষের স্বভাব চরিত্র এক এক রকম হয়। আমাদের দেশে যেমন রংপুর, রাজশাহীর মানুষ খুব সহজ সরল হয়, বরিশাল, ফরিদপুরের মানুষ প্রচণ্ড চাপাবাজ, কুমিল্লার মানুষ জটিল আর নোয়াখালীর মানুষ তো খাওয়া হলেই রওনা দেয় ! জাবুলের মানুষরাও তেমনই হিংসুটে, স্বার্থপর আর কুটিল বলে পরিচিত। তাই বোধহয় দাদ মোহাম্মদের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। অথচ ডাক্তারকে তো সব সময় কম্পাউন্ডারের সাথেই কাজ করতে হবে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কারও চক্রান্তের শিকার হতে চাই না। তাছাড়া খাশে বসে বাংলাদেশী ডাক্তাররাও পইপই করে বলে দিয়েছে, জাবুলিদের সাথে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে। তবে আমিও ডেল কার্নেগীর চেলা। মানুষ পটাতে ওস্তাদ। হেসে বললাম,

- মাছালে নিস্ত অগাই খারকুই (কোনো ব্যাপার না খারকুই সাহেব)। তুমি তো দেখতে দারুণ হ্যান্ডসাম।

- কোরবানে শোমা বেরাম দকতোর ( তোমার জন্য কোরবান হয়ে যাব ডাক্তার)

- খাইলি মামনুন। তা, বিয়ে শাদী করেছ ?

- হ্যাঁ। আমার বউ জাবুল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।

- তাড়াতাড়ি বউ এখানে নিয়ে আসো। নইলে বালুচি মেয়েরা তোমার প্রেমে পাগল হয়ে যাবে।

বলে আমি হেসে উঠলাম। দেখি খারকুইয়ের ফর্সা গাল লালে লাল। বুঝলাম, ওষুধ কাজ করছে। প্রশংসায় খুশি হয় না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। সে গদগদ গলায় বলল,

- কী যে বলো দকতোর ! বালুচি মেয়েরা শিয়াদের পছন্দ করে না। তবে তোমার জন্য এই খারকুইয়ের জান সব সময় হাজির থাকবে।

শুনে মনে মনে বলি, তর জান ধুইয়া আমি কি পানি খামু ? ব্যাটা বদের বদ, যতই মিঠা কথা কইস, তরে আমি বিশ্বাস করি না। আমিও মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলি,

- মেহেরবানে শোমা (তোমার দয়া)। জানটা আপাতত তোমার জিম্মায়ই থাকুক। এখন বলো, বাইরে এত লোক কেন ?

- ওরা সবাই রুগী।

- বল কী ? এত রুগী ? সে কি আমি নতুন ডাক্তার বলে ?

- না না, তোমার জন্য না। ওরা তো জানেই না, তুমি এসেছ। তোমার আগে দকতোর জহির এখানে ছিল। সবাই খুব পছন্দ করত। তাঁকে দেখাতেই এত লোক আসে।

শুনে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। হুদাহুদিই মনে মনে কলা খাইতে ছিলাম। বুঝলাম, ছয় আঙ্গুল কপাল নিয়ে জন্মেছেন জহির ভাই। শুধু মেয়ে মহলেই নয়, রুগীদের কাছেও ভীষণ জনপ্রিয়তা তার। এত রুগী দেখতে গেলে তো সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবে ! আমি তো সারা জীবন ইরানে থাকতে আসিনি। বউয়ের সাথে একগাদা বইও নিয়ে এসেছি। এম আর সি পি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুত হলেই সটকে পড়ব। আমার এত সস্তা জনপ্রিয়তার দরকার নাই। মনে মনে আমার কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলি। কেফাতুল্লাহকে ডেকে বলি, একজন একজন করে ঢুকাতে।

খাশে বসেই বালুচদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মেছিল। রোগ থাক বা না থাক, ওষুধ নিয়ে জমা করে রাখতে খুব পছন্দ করে। এরাও তার ব্যতিক্রম নয়। শহরে তাও নাহয় একটা অজুহাত ছিল। দূর দূরান্ত থেকে আসে। প্রয়োজনে যদি ডাক্তার কাছে না পায় ? কিন্তু আমি তো টুয়েন্টি-ফোর সেভেন এখানেই থাকব। প্রয়োজন হলেই আমাকে দেখাতে পারবে। বিনা প্রয়োজনে এখন ওষুধ নিয়ে জমা করার তো কোনো দরকার নাই ।

তবে গুহারকুর বালুচরা আর এক কাঠি বাড়া। এসেই বলে, ইয়েক শরবত হাম বেদে (একটা শরবতও দিও)। মর জ্বালা। বুঝলাম, তগো দেশে অনেক গরম। তাই বইলা আমি কি দারমাঙ্গায় শরবতের দোকান খুইলা বইছি ? যে চাইলেই এক গ্লাস লেবু চিনির শরবত কিংবা বরফ পানির সাথে রুহে আফজা মিলায়ে দেব ? পরোক্ষণেই মনে পড়ল, তরল ঔষধ বা সিরাপকে শরবত বলে। দাঁত দেখলে তো মনে হয়, ঘোড়ার মতো শুকনো চানাও চিবিয়ে গুড়া করে ফেলতে পারবে। অথচ ওষুধের বেলায় জোয়ান হোক, বুড়ো হোক, শরবত সবার চাই। আমিও বরিশাইল্যা পোলা। ঘাড়টা আমার এমনিতেই ত্যাড়া। এই বেকুব পাঠানদের অকারণ ঔষধ প্রীতি সে ঘাড়কে আরও ত্যাড়া করে দিল। তাছাড়া দারমাঙ্গায় আমিই প্রধান। আমার উপর কথা বলার কেউ নাই। সুতরাং কোনো রোগ শোক নাই, তাদের আমি শুধু ছয়টা ন্যাংটা প্যারাসিটামল বড়ির প্রেসক্রিপশন দিতে শুরু করলাম।

ঘণ্টা দুই পর খারকুই হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল,

- হায় হায় দকতোর, করছ কী ?

- কী করছি ?

- কেমন দকতোর তুমি ? মাত্র ছয়টা প্যারাসিটামল লিখছ ? রুগীরা তো সবাই ক্ষেপে যাচ্ছে।

- ক্ষেপলে আমি কী করব ? রোগ না থাকলে শুধু শুধু ওষুধ লিখব কেন ?

- কিন্তু দকতোর জহির তো সবাইকে পৃষ্ঠা ভরে ওষুধ লিখত !

- আমি ডাক্তার জহির নই খারকুই। না আমার কোনো পাঠান সর্দারের মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা আছে, না আমি গুহারকুতে ভোটে দাঁড়াব। যার প্রয়োজন নেই, তাকে আমি ওষুধ দেব না।

- তুমি কিন্তু ভুল করছ দকতোর। এ জন্য তোমার নামে উপরে কমপ্লেইন হতে পারে।

এমনিতেই মেজাজ গরম হয়ে ছিল। এবার ধপ করে মাথার ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। আমি ওর চোখে চোখ রেখে কেটে কেটে বললাম,

- শোনো বেহজাদ খারকুই। আমি ডাক্তার আর তুমি কম্পাউন্ডার। আমার কাজ রুগী দেখে প্রেসক্রিপশন লেখা, আর তোমার কাজ হল, সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রুগীকে ওষুধ দেয়া। আমাকে আর কখনও ডাক্তারি শেখাতে আসবে না। কমপ্লেইন হলে সেটা আমি সামলাব। তুমি এখন যেতে পার। আর যাবার সময় কেফাতুল্লাহকে বলবে, আমি পনের মিনিট রেস্ট নেব। যেন কোনো রুগী না পাঠায়।

আমার মতো এমন ভোলা-ভালা চেহারার মানুষের কাছ থেকে এমন কড়া কথা শুনবে, খারকুই বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। তার অবস্থা অনেকটা জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো। আর একটা কথাও না বলে মাথা নিচু করে রুম ছেড়ে চলে যায় খারকুই। আমি চেয়ার পিঠ এলিয়ে দুচোখ বন্ধ করি। কী ভেবে দিন শুরু করেছিলাম, আর কী হয়ে গেল ! আমি জানি, কমপ্লেইন করলে সবার আগে খারকুই করবে। এই ব্যাটা জাবুলির সাথে বোধহয় শান্তিপূর্ণ সহবস্থান আর সম্ভব হবে না ! এখন আর কিচ্ছু করার নেই। ধনুক থেকে তীর ছুটে গেছে। পেশার সাথে, নীতি সাথে আপোষ করতে শিখিনি। এই আপোষ করতে পারব না বলেই দেশ ছেড়েছি। বিদেশে এসেও যদি সেই আপোষই করতে হয়, তাহলে দেশ ছেড়ে কী লাভ হল ? সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি আমার নীতিতে অটল থাকব। যা হবে, দেখা যাবে।

- সালামালেক দকতোর। হালে শোমা খুবে ? খাস্তে না বাশে। (সালাম ডাক্তার। ভালো আছ ? ক্লান্ত হয়ো না)।

মেয়ে কণ্ঠ। পনেরো মিনিট রুগী না পাঠাতে বলেছিলাম। অথচ পাঁচ মিনিটও হয়নি ! কেফাতুল্লাহ আবার রুগী পাঠিয়েছে ? মেজাজের গোঁড়ায় এমনিতেই বারুদ পোরা ছিল। এবার তাতেও আগুন লেগে গেল ! সে আগুনে ব্যাটা ভিরাপ্পনের গোঁফ বুঝি আজ পুড়ে ছাই হয়ে যায় ! তার উপর রুগীও এমন, যে কিনা উল্টো ডাক্তারকেই তার হাল জিজ্ঞেস করে ? দুই ঘণ্টা এক নাগারে রুগী দেখার পরও বলে, খাস্তে না বাশে ? এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা ? এরা কী শান্তিতে একটু নিঃশ্বাসও নিতে দেবে না ? মগজের সব আগুন দু’চোখে নেমে এলো। সে আগুনে মেয়েটিকে ভস্ম করে দেয়ার জন্য আস্তে আস্তে চোখ খুলি।

এ কাকে দেখছি আমি ? কোন উপমায় প্রকাশ করব আমার অনুভূতি ? এ কি তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি ? নাকি ঝিম ধরা চৈত্রের দুপুরে এক দমকা শীতল হাওয়া ? আমার সামনে যে বসে আছে, সে আর যাই হোক, কোনো রুগী হতে পারে না। এ যেন আকাশের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা স্বর্গের এক পরী ! এ যেন বিধাতা শিল্পীর অনেক যত্নে আঁকা এক অনুপম ছবি। ওড়নায় জড়ানো মাথা ও গলা। তার ফাঁক গলে ঢেউ খেলে নেমে এসেছে থোকা থোকা রেশমি কালো চুল কপালে। তারই নীচে ঘন পাপড়ির ছায়ায় মায়া ভরা ডাগর দুই চোখ। সে চোখে যেন থৈথৈ করছে কষ্টের লোনা জল। মুহূর্তে আমার কাজল দিঘি চোখের রেণুবুর কথা মনে পড়ে যায়। মুহূর্তে আমার পাখির বাসার মতো চোখের বনলতার কথা মনে পড়ে যায়। মুখ তো নয়, যেন ফুটে আছে সোনা রঙা এক সূর্যমুখী ফুল। সে মুখে গোলাপ পাপড়ির মতো পাতলা দুই ঠোঁট। যে ঠোটে ঝুলে আছে এক টুকরা মোনালিসা হাসি। সে হাসিতে মাখনের মতো গালে যেন উঠেছে জলের ঘূর্ণি ! সে ঘূর্ণিতে সাঁতার না জানা বালকের মতো অসহায় আমি ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকি। আমার মুখে কোনো কথা সরে না!
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব -১১







- স্যরি টু বদার ইউ ডক্টর। আয়াম আফসানেহ রিগী। ইয়োর হেলথ-কেয়ার এসিস্ট্যান্ট।

বালুচিস্তান তো দূরের কথা, তেহরানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় বড় হর্তাকর্তাদের মুখেও এমন নিখুঁত উচ্চারণে ইংরেজি শুনিনি। গুহারকুর মতো প্রত্যন্ত এক গ্রামের দারমাঙ্গায় হেলথ-কেয়ার এসিস্ট্যান্টের মুখে এমন ইংরেজি শুনে আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা সাধারণত ট বর্গের অক্ষর উচ্চারণ করতে পারে না। আমি অপলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকি। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,

- এক্সিলেন্ট !

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, মেয়েটি ত্রস্তে তার মাথার ওড়না টেনে দিল। চোখের পাতা নেমে এলো নীচে। যেন ঝালর দুলানো দুটি পর্দা ঢেকে দিল আকাশের নীল। গোধূলির আবীর এসে জমা হল সূর্যমুখী গালে। আমি জানি, সুন্দরী মেয়েরা প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত। সম্ভবত আরও অভ্যস্ত সে প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হতে। ও হয়ত ভেবেছে, এই ভিনদেশী ডাক্তার তার রূপের ঝলকে বিহ্বল হয়ে গেছে। ওর ভুল ভাঙ্গাতে আমিও তাড়াতাড়ি ইংরেজিতেই বলে উঠলাম,

- আই মেন্ট, ইয়োর ইংলিশ ইজ এক্সিলেন্ট। কী করে এত সুন্দর উচ্চারণ শিখলে ?

এবার গোধূলির লাল সরে যেয়ে ওর মুখে হেসে ওঠে শেষ বিকেলের সূর্য। ঝিকমিক করে ওঠে চোখের তাঁরা। ঠোঁট টিপে হাসতে যেয়ে আবারও দু’গালে জলের ঘূর্ণি তোলে। কোলে ফেলে রাখা ঢাউস ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট রেডিও বের করে বলল,

- এটা দিয়ে। আমি সময় পেলেই বিবিসি শুনি। শুনতে শুনতে শিখে গেছি।

রূপবতী মেয়েরা সাধারণত একটু বোকা কিসিমের হয়। অথচ স্বর্গের এই অপ্সরীটিকে আমার বেশ বুদ্ধিমতীই মনে হল। আমিও হেসে বললাম,

- বাহ, তোমার তো দারুণ বুদ্ধি ! এখন থেকে আমার সাথেও ইংরেজিতেই কথা বলো। তাহলে আরও ভালো বলতে পারবে।

- উল্টোও তো হতে পারে ডাক্তার। আমার সাথে ফার্সি বললে তোমার ফার্সি আরও ভালো হবে।

বলেই কিশোরী মেয়ের মতো খিলখিল করে হেসে উঠল। এই প্রথম শব্দ করে হাসল মেয়েটি। মনে হল, মালা ছিঁড়ে অনেকগুলো মুক্তোর দানা ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। লক্ষ্য করলাম, মেয়েটি শুধু বুদ্ধিমতীই নয়, বেশ সপ্রতিভও বটে। আমি কিছু না বলে বসে বসে ওর এই প্রগলভতা উপভোগ করি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে ওঠে,

- নারাজ না বাশে দকতোর। ইয়েক কম সুখী করদাম। (রাগ করো না ডাক্তার। একটু দুষ্টুমি করলাম)।

- আমি রাগ করিনি।

- আমি একটু বেশি কথা বলি। তুমি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছ। যাই। তুমি বিশ্রাম নাও।

খারকুইয়ের সাথে কথা বলে মেজাজটা যত খারাপ হয়েছিল, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই মেয়েটির সাথে কথা বলে মেজাজটা আমার ততই ভালো হয়ে যায়। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা একাই দশ প্রাণ হয়ে বদলে সব দেয়। তৈরি করে এক অনাবিল সুখের আবেশ। এই মেয়েটিও তেমনই। ওর কথা শুনে, ওর হাসি দেখে মনটা আমার এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায়। কেন জানি আজ আমারও একটু প্রগলভ হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, মেয়েটির সাথে আরও কিছুক্ষণ গল্প করি। এমনই কোনো সর্বনাশা সুন্দরীকে দেখে কিংবা কল্পনা করেই কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”।

এমন সময় মাথার ভেতর ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যায় বিবেক। একজন ডাক্তার হয়ে তার অধস্তন সহকর্মী, বিশেষ করে নারী সহকর্মীদের সাথে পেশাদারি সম্পর্ক বজায় রাখাই বাঞ্ছনীয়, কোনো আবেগী সম্পর্ক নয়। সুন্দরী মেয়েরা খুব আত্ম-সচেতন হয়। প্রথম পরিচয়েই আমার একটু প্রগলভতা মেয়েটির কাছে কোনো বিভ্রান্তিকর বার্তা পৌঁছে দিক, চাই না। আমি আমার চারিদিকে একটা লক্ষণ রেখা টেনে দিই। লক্ষ করি, “যাই” বললেও তখনও বসে আছে আফসানেহ। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বললাম,

- বেশ। এসো তাহলে।

গল্পে এভাবে হঠাৎ যতি পড়বে, হয়ত প্রত্যাশা করেনি মেয়েটি। থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

- হ্যাঁ, যাই। ভালো কথা, সকালে তোমায় বাসায় গিয়েছিলাম। খানম দকতোর (ডাক্তার গিন্নী) এর সাথে দেখা হল। খানমে শোমা খাইলি যিবা হাস্ত ( তোমার বউ ভীষণ সুন্দরী)!

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিতম্বে ঝড় তুলে দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে যায় আফসানেহ। আমি নীরবে বসে বসে ওর চলে যাওয়া দেখি। না, ভুল কিছু বলে যায়নি আফসানেহ। অসম্ভব রূপবতী বউটিকে ঘরে তুলতে আমাকে চণ্ডীদাসের মতো দীর্ঘ আট বছর বড়শি বাইতে হয়েছে।

আফসানের কথায় কি একটু ঈর্ষার আঁচ পেলাম ? সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে এক ধরণের নীরব প্রতিযোগিতা চলে। এই জন্যই বোধহয় সিনেমায় নায়িকার বান্ধবীরা একটু মোটা, কালো কিংবা খাটো হয়। বান্ধবহীন এই দূর প্রবাসে আফসানের মতো বান্ধবী পেলে বউটির অলস সময় ভালোই কাটত। কিন্তু সে বুঝি আর হবার নয় ! বড় বিচিত্র এই নারীর মন। দেবতা চেনেনি যারে, আমি কী চিনিব তারে ? আসলেই মেয়েটিকে সেদিন আমি চিনতে পারিনি। আফসানেহ অর্থ মহাকাব্য। মেয়েটি নিজেই যে একটি জীবন্ত মহাকাব্য, সেদিন বুঝতে পারিনি। তখন কে জানত, ত্রিশ বছর পর সেই মহাকাব্যই একদিন আমি লিখতে বসব ?

আফসানেহ চলে যেতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে দুচোখ বন্ধ করি। কাল আবার “সাইয়ারি” তে যেতে হবে। সম্ভবত “সওয়ার” থেকে “সাইয়ারি” শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ, গাড়িতে সওয়ার হয়ে, ওষুধপত্র নিয়ে আমাকে যেতে হবে আরও অনেক দূরের জনপদে। রুক্ষ প্রকৃতির এই প্রদেশে পানির খুব অভাব। তাই যেখানেই একটু পানির উৎস, সেখানেই গড়ে উঠেছে ছোট ছোট জনপদ। সেই সব দুর্গম জনপদের নারী ও শিশুদের পক্ষে দারমাঙ্গায় এসে ডাক্তার দেখানো খুব কষ্টকর। তাই ডাক্তারকেই যেতে হয় তাদের কাছে, চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে। সেই সাইয়ারির জন্যই বোধহয় গ্যারেজে পার্ক করা দেখেছিলাম ইংল্যান্ডের তৈরি অধিক শক্তিশালী ল্যান্ড রোভার জীপ, যা যে কোনো দুর্গম পথে চলতে পারে। সপ্তায় তিন দিন রুগী দেখতে হয় দারমাঙ্গায়, আর তিন দিন সাইয়ারিতে। দারমাঙ্গায় প্রথম দিনের রুগী দেখার অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর নয়। না জানি সাইয়ারিতে আমার জন্য কোন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে !

সাইয়ারির কথা মনে হতেই একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। বলেছিলেন, ডাঃ কাজী ভাই। ভীষণ রসিক মানুষ এই কাজী আব্দুর রশিদ। সবাই ডাকে কাজী ভাই। শুধু চিকিৎসা নয়, দেশের প্রতিটি প্রান্তে যাতে শিক্ষার আলো পৌঁছে যায়, তার ব্যবস্থাও করেছে ইরান সরকার। প্রায় প্রতিটি জনপদের জন্যই রয়েছে স্কুল। ওরা বলে মাদ্রাসা। সেই মাদরাসায় পড়ানোর জন্য নিয়োজিত আছেন শিক্ষক। ওদের ভাষায় মোয়াল্লেম। আগে আমাদের দেশে যেমন গ্রামের পাঠশালায় কিছু পণ্ডিত মশাই ছিলেন। যারা সুযোগ পেলেই ফাঁকি দিতেন কিংবা টেবিলে মাথা রেখে একটু ঘুমিয়ে নিতেন। এই বালুচিস্তানেও তেমন এক প্রত্যন্ত গ্রামের মাদরাসায় এক মোয়াল্লেম ছিলেন, যিনি সুযোগ পেলেই একটু ফাঁকি দিতেন বা ঘুমিয়ে নিতেন। ছাত্র ছাত্রী কম বলে তিনি একাই মোয়াল্লেম ছিলেন সেই মাদরাসার। তো, সেই গ্রামে সাইয়ারিতে যেতেন আমাদের ডাঃ কাজী ভাই। ডাক্তার সাহেব সাইয়ারিতে এসেছেন শুনলেই সেই মোয়াল্লেম বাবাজী স্কুলের সব ছাত্র ছাত্রীদের পাঠিয়ে দিতেন ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য। গাঁও গেরামের দুরন্ত সব ছেলে মেয়ে। অবসরে যারা পাহাড়ে মরুতে ভেড়া চড়ায় কিংবা ঘুরে বেড়ায়। তাদের কিই বা এমন রোগ শোক থাকতে পারে যে প্রতি সপ্তায় চেকাআপ লাগবে? গ্রামে বড় হয়েছেন কাজী ভাই। ছোটবেলায় তিনিও কম পাজী ছিলেন না। বুঝে গেলেন, হেলথ চেকআপ নয়, ব্যাটা মোয়াল্লেমের এটা একটু দিবানিদ্রা দেয়ার অজুহাত। অথচ ছেলেমেয়েরা দেখাতে আসলে না দেখেও পারেন না। আবার মোয়াল্লেমকে কিছু বলতেও পারেন না। যদিও ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবুও কাহাতক আর এই উপদ্রব আর সহ্য করা যায় ? একদিন তিনি সব ছাত্র ছাত্রীদের ছয়টা করে মেবেনডাজল ট্যাবলেট ( গুড়া কৃমির ওষুধ) দিলেন। সাথে ছয়টা বড়ি মোয়াল্লেমের জন্যও পাঠালেন। মোয়াল্লেম বাবাজী তো ট্যাবলেট দেখে হতবাক। তার তো কোনো রোগ শোক নাই। ডাক্তারের কাছেও যান নাই। তবু কেন ওষুধ দিলেন ? আবার ছাত্র ছাত্রীদের যেই ঔষধ, ওনাকেও সেই ঔষধ ? কিসের ঔষধ ? ঘটনা কী ? মোয়াল্লেম বাবাজীর মাথা তো পুরাই আউলাইয়া যাওয়ার জোগাড়। ডাক্তার সাহেবের কাছে শুনবেন, তারও উপায় নাই। কারণ কাজী ভাই ততোক্ষণে সাইয়ারি সেরে চলে এসেছেন। আবার যাবেন এক সপ্তাহ পর। কৌতূহল মেটাতে উনি বড়িগুলো এক ফার্মাসিস্টকে দেখালেন। কৃমির ঔষধ ? শুনে তো মোয়াল্লেমের চান্দি গরম হইয়া গেল। ডাক্তার যে তাঁকে অপমান করার জন্য এই কাজ করেছে, তার বুঝতে বাকি রইল না। ভিনদেশী এক ডাক্তারের এত বড় সাহস ? সে সোজা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানাল। যথা সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একজন ইরানি ডাক্তারকে পাঠাল তদন্ত করার জন্য। ডাক্তার সাহেব কাজী ভাইকে প্রশ্ন করলেন,

- তুমি কেন সব ছাত্র ছাত্রীকে কৃমির ওষুধ দিলে ?

কাজী ভাই গোবেচারা মুখ করে বললেন,

- দেখো, প্রতি সপ্তায়ই মোয়াল্লেম সাহেব সব ছাত্র ছাত্রীকে আমার কাছে চিকিৎসার জন্য পাঠান। আমি তো কোনো রোগ খুঁজে পাই না। ভাবলাম, গ্রামে তো খোলা আকাশের নীচেই প্রাকৃতিক কাজ কাম হয়। আবার ওরা খালি পায়ে ঘুরেও বেড়ায়। নিশ্চয়ই ওদের গুড়া কৃমি হয়েছে। সেই জন্য ক্লাসে চুপচাপ বসে পড়া করতে পারে না। হয়ত খালি মোড়ামুড়ি করে। নইলে মোয়াল্লেম সাহেব শুধু শুধু আমার কাছে পাঠাবেন কেন ?

অভিজ্ঞ মানুষ ডাক্তার সাহেব। কোনো মতে হাসি চেপে জানতে চাইলেন,

- তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু মোয়াল্লেম সাহেবকে কৃমির বড়ি দিলে কেন ? সে তো আর খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায় না ?

- দেখো, তুমি নিজেও একজন ডাক্তার। নিশ্চয়ই জানো, গুড়া কৃমি ছোঁয়াচে রোগ। এর ওষুধ সব ক্লোজ কন্টাক্টদের এক সাথে খেতে হয়। যেহেতু মোয়াল্লেম সাহেব দিনের অধিকাংশ সময় বাচ্চাগুলার সাথে থাকে, নিশ্চয়ই তারও গুড়া কৃমি আছে। তাই তাকেও দিলাম। আমি কি কোনো ভুল করেছি ?

তদন্তকারী ডাক্তার সাহেব আর থাকতে না পেরে এবার হোহো করে হেসে উঠলেন। কাজী ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, তোমার মতো এমন চালাক ডাক্তার আমি জীবনে দেখিনি।

ডাক্তার সাহেব তদন্তের রিপোর্ট কী দিয়েছিলেন, জানেন না কাজী ভাই। তবে এর পর মোয়াল্লেম বাবাজী আর ছাত্র ছাত্রীদের চেকআপের জন্য পাঠায়নি। ঘটনাটা মনে পড়তে আমিও আপন মনে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতেই হাঁক ছাড়লাম, কেফাতুল্লাহ, রুগী পাঠাও।

সে রাতেও কারেন্ট চলে গেলে জানালা খুলে দিয়েছিলাম। অথচ বাইরে বাতাস নেই । ঝিম ধরে আছে প্রকৃতি। জানালার পাশে কিশোর ঝাউ গাছটা ডালপালা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে। তারই চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল শুক্লা-দশমীর চাঁদ। ঘরের ভেতর জোছনা ছায়ার লুকোচুরি খেলা। স্পর্শহীন দূরত্বে চিত হয়ে শুয়ে আছি দু’জনে। গরমে ঘুম আসছিল না কারোই। ভাবছিলাম ঘটনাবহুল দিনটার কথা। রুগী দেখতে দেখতে সেদিন আসলেই সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। যতই গোস্বা হও আর অভিমান করো, রোগ নাই, তো ওষুধ নাই। খারকুইও আর কিছু বলতে আসার সাহস দেখায়নি। সারা দিনে আফসানেরও দেখা মেলেনি। অবশ্য হেলথ-কেয়ার এসিস্ট্যান্টদের কাজ দারমাঙ্গার চাইতে বাইরেই বেশি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাচ্চাদের টিকা দেয়া, মায়েদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে জ্ঞান দেয়া, এই সব।

- তোমার অফিসে আফসানেহ নামে একটা মেয়ে আছে। দেখা হইছে ?

নীরবতা ভেঙ্গে হঠাৎ প্রশ্ন করে বউ। শুনেছি, মেয়েদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় খুব প্রখর। তাই বলে এতই প্রখর যে মনের ভাবনা বুঝতে পারে? মনের কথা শুনতে পারে ? নইলে যে মুহূর্তে আমি আফসানের কথা ভাবছিলাম, সেই মুহূর্তেই সে আফসানের কথা শুনতে চাইবে কেন ? এমনিতে বউও কখনো অফিসের কথা শুনতে চায় না। আর আমিও বলা পছন্দ করি না। আজ হঠাৎ করেই জানতে চাইল। এ কি শুধুই মেয়েলী কৌতূহল, নাকি খানিকটা ঈর্ষা ? এটা কোনো ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত নয়ত ? লঘুচাপটি কি নিম্নচাপে রূপ নিতে যাচ্ছে ? আমি সতর্ক হয়ে যাই। ছোট্ট করে জবাব দিই,

- হুম।

- কেমন দেখলা ?

- ভালো।

- কেমন ভালো ?

এ তো দেখি রীতিমত জেরা শুরু করেছে ? আমি ওর দিকে ফিরে শুই। এক ফালি রূপালী চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর চাঁদ মুখে। সে আলোয় ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছি না। ওর মনে কী চলছে, তাও বুঝতে পারছি না। তবে মুখটা হাসি হাসি। আরও সুন্দর, আরও মায়াবী লাগছে। এক নারীর সামনে আর এক নারীর প্রশংসা করা কোনো বুদ্ধিমান পুরুষের কাজ না। আমি নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিই,

- মোটামুটি ভালো।

- ডাক্তার সাহেব, মোটা মোটা বই পড়তে পড়তে আপনের চোখ দুইটা কি একেবারেই গেছে নাকি বউয়ের সামনে সুন্দরী কলিগের প্রশংসা করতে ভয় পাইতাছেন ?

হাতেনাতে ধরা পড়ে আমি মিনমিনে গলায় বলি,

- কী যে বলো, ভয় পাবো কেন ?

- ভয় না পাইলে ঐ মাইয়ারে কেউ মোটামুটি কয় ?

- যাহ। সে তোমার চাইতে মোটেই বেশি সুন্দরী নয়।

শুনে বউ আমার শোয়া থেকে উঠে বসে। তার মুখটা ঝুঁকে আসে আমার মুখের উপর। যেন খুব কাছ থেকে আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে। আমার মুখের রেখা দেখতে পারে। নাকি আমার বুকের ভেতরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে চাইছে, সেখানে অন্য কোনো নারীর প্রবেশ ঘটল কিনা ? অকারণ ভুল বুঝে বউ আমার এতটুকু কষ্ট পাক, কোনো মতেই চাই না আমি। আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠে বউ। হাসতেই থাকে কিছুক্ষণ দুলে দুলে। ওকে আমার তখন এই পৃথিবীর সব চেয়ে রহস্যময়ী নারী বলে মনে হয়। কী বলব বা আমার কী বলা উচিৎ, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। হাসতে হাসতেই সে বলে,

- আসলেই দেখি তুমি খুব ভয় পাইছ। বোকা ডাক্তার, তোমার ভয় পাওনের কোনো কারণ নাই। তোমার সুন্দরী কলিগ থাকতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নাই। দোষ হইল সেটা গোপন করায়। মেয়েটা শুধু সুন্দরী না, ভয়ঙ্কর সুন্দরী। আর সেই সাথে ভীষণ ভালো স্বভাবের।

বাইশ বছরের বউটা যেন হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে যায়। কত বড় একটা কথা বলে ফেলল ! আসলেই তো, পাপ সত্য প্রকাশে নয়, পাপ সত্য গোপনে। সেই সাথে লক্ষ্য করলাম, ওর কথায় সন্দেহ বা ঈর্ষার লেশ মাত্র নাই। আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। ভয় কেটে যায়। আমিও হাসতে হাসতে জানতে চাইলাম,

- কেমনে বুঝলা মেয়েটা ভালো স্বভাবের ?

- মেয়েরাই মেয়েদের ভালো চিনতে পারে। মেয়েরাই মেয়েদের মন ভালো পড়তে পারে। তোমরা পুরুষেরা মেয়েদের শরীর যতটা পড়তে পারো, মন ততোটা পারো না।

শুনে আমি চমকে উঠি। কী হয়েছে ওর আজ ? বোকাসোকা মেয়েটা কেমন দার্শনিকের মতো কথা বলছে ! কথাটা পুরুষ জাতির জন্য যতই অপমানজনক হোক না কেন, এটাই নির্মম সত্য, এটাই রূঢ় বাস্তব। কোন পুরুষ কবে কোন নারীর মনের তল খুঁজে পেয়েছে ? আমি অবাক চোখে মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকি। আমার মুখে কোনো কথা সরে না !
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব ১২


তিন হাজার সিসির ল্যান্ড রোভার জীপটা গোঁগোঁ করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে। গন্তব্য আব্বাসাবাদ। জীবনে প্রথম সাইয়ারি। ঘণ্টা খানেক ধরে চলছি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। যতই চলছি, ততোই আরও বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। হয়ে উঠছে আরও রুক্ষ, আরও ধূসর, আরও দুর্গম। পাহাড় পেরুলেই আব্বাসাবাদ। আরও আধ ঘণ্টার মতো পথ। যেতে যেতে ভাবি, আহা, কত কষ্টে কাটে এদের জীবন। সে তুলনায় তো আমরা স্বর্গের কাছাকাছি আছি। কত সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা দেশ আমার। ঠিকই লিখেছিলেন কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, “ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…”।

এই গাড়িটা অনেকটা আর্মিদের জীপ স্টাইলের। ল্যান্ড ক্রুজারের মতো বিলাসবহুল আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। তাই জানালার গ্লাস নামানো। ইতোমধ্যেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছে সূর্য। তেঁতে উঠতে শুরু করেছে পাথুরে পাহাড়। তারই হলকা এসে লাগছে চোখে মুখে। ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছি। পিছনে কম্পাউন্ডার খারকুই তার ওষুধপত্র নিয়ে। কাল থেকেই কথা কম বলছে ছেলেটা। খুব কড়া কথা বলা হয়ে গেছে ! সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা দরকার।

পাহাড় থেকে নামতেই ভোজবাজীর মতো বদলে গেল প্রকৃতি। এ পাশে পাহাড়ের গায়ে, খাঁজে খাঁজে বেশ কিছু গাছপালা, ছোট ছোট ক্ষেত খামারি। এ যেন ধূসর ক্যানভাসে তুলির আচরে আঁকা থোক থোক সবুজের মেলা। তারই মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। মাটির দেয়াল। ছনের ছাউনি। নীচেই ছোট্ট এক উপত্যকা। তিন দিকে পাহাড়ের দেয়াল। এক দিকে যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। সেই উপত্যকায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি নানা সাইজের তাঁবু। শুনেছি, আরব বেদুঈনরা তাবুতে থাকতেই পছন্দ করে। জোর করেও তাদের ইট পাথরের অট্টালিকায় রাখা যায় না। খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেয়া যাদের অভ্যাস, তাদের নাকি বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফিও নাকি অধিকাংশ সময় তাবুতে কাটাতেন। ইরানেও কি বেদুঈন জাতী আছে ?

আমাদের গাড়ি যেয়ে দাঁড়াল সেই তাঁবু ঘেরা জায়গায়। ড্রাইভার দাদ মোহাম্মদ তাড়াতাড়ি নেমে আমার দরজা খুলে ধরে বলল,

- দকতোরজুন, বেফারমাইন।

আমি নেমে চারিদিকে চোখ বুলাই। গোটা বিশেক তাঁবু একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে খাটানো। ঘর গেরস্থালীর সব কিছুই আছে। কেউ রান্না করছে, কেউ বড় গামলার মধ্যে কাপড় ধুচ্ছে। কয়েকটা মুরগী বাচ্চাদের নিয়ে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে খাবার খুঁজছে। এক মহিলা দু’হাঁটুর মাঝে গামলা ধরে ছাগলের দুধ দোয়াচ্ছে। আমাদের আসতে দেখে সবাই একবার চোখ তুলে তাকিয়ে যে যার কাজে লেগে গেল। বছর দুয়েকের একটা বাচ্চা গাড়ি দেখে তারস্বরে কান্না জুড়ে দেয়। মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে তাঁবুর ভেতর থেকে মা এসে ছোঁ মেরে বাচ্চাটাকে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে যায়। কোনো কিশোর কিংবা পুরুষ নজরে এলো না। আমরা কি কোনো নারী-স্থানে এসে পড়লাম ? শুধু এক বৃদ্ধ খাটিয়ায় বসে গড়াগড়া টানছিল। আমাদের দেখে উঠে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো।

ভেবেছিলাম, গুহারকুর মতো এখানেও শ’খানেক মানুষ রিলিফের চাল নেয়ার মতো ওষুধ নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। তেমন কাউকে না দেখে বেশ অবাক হলাম। ওরা কি জানে না, আজ ডাক্তার আসবে ? দেখি, খারকুই গাড়ির পিছন থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙ্গছে। গাড়ির পিছনে বসে ঝাঁকি খেতে খেতে নিশ্চয়ই বেচারার কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। একটু ভাব জমাতেই বললাম,

- খাস্তে না বাশে অগাই খারকুই। মারিজহা কুজা হাস্ত ? ( ক্লান্ত হয়ো না খারকুই সাহেব। রুগীরা কোথায় ?

- কোরবানে শোমা বেরাম দকতোরজুন ( তোমার জন্য উৎসর্গ হয়ে যাব প্রিয় ডাক্তার)। রুগীর অভাব হবে না। চলে আসবে।

- কিন্তু জানবে কী ভাবে, আমরা এসেছি ?

- পাহাড়ে অনেক দূর থেকে গাড়ির শব্দ শোনা যায়। চিন্তা করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই এসে যাবে।

চিন্তা করছি না। একটু বিরক্ত হচ্ছি। কোথায় রুগীরা সব লাইন দিয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করবে। তা না, ডাক্তারকেই এখন রুগীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ! ঘড়িতে সকাল এগারোটা পেরিয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তার জন্যই কিনা জানি না, আসতে আসতে ইতোমধ্যেই পেটে খিধের ভাব। রুগী দেখে ফিরতে ফিরতে তো দুপুর গড়িয়ে যাবে ! খাব কখন ? খাবার কথা মনে হতেই আমার ইয়ার মোহাম্মদের কথা মনে পড়ে যায়। তার বাড়িও হয়ত ছিল এমনই কোনো এক পাহাড়ি গ্রামে । ঐ দূরের পাহাড়ের খাঁজে বাড়ি ঘরগুলোর মতোই হয়ত ছিল তার বাড়িঘর। যেখানে তার যুবতী স্ত্রী মুরগী পুষত, মেষ চরাত, সবজি ফলাত। আর রান্না করে ইয়ার মোহাম্মদের জন্য অপেক্ষা করত। ইয়ার মোহাম্মদ আর কোনদিনই সে রান্না খেতে ফিরে আসবে না। আমারও কোনদিন তার স্ত্রীর হাতে তৈরি কচি গুছফান্দের কাবাব খাওয়া হবে না। কাবাবের কথা মনে হতেই এবার খিধেটা চনমনিয়ে ওঠে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে কোনো দোকানপাটও নেই যে বিস্কুট জাতীয় কিছু কিনে খাব। এর পর থেকে সাথে কিছু শুকনো খাবার ও পানি নিয়ে আসতে হবে।

- সালামালেক দকতোর।

চমকে তাকিয়ে দেখি সেই বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে আছে। গোঁফ, দাঁড়ি সব পাকা। হালকা পাতলা শরীর। পাহাড়ি মানুষেরা বোধহয় কখনোই মোটা হয় না। একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে। গোঁফের আড়ালে মুখটা হাসিহাসি। তবে বয়সটা কোথায় যেয়ে ঠেকেছে, বোঝা দায়। আমি “আলেকুম সালাম” বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই দুহাতে আমার হাতটা ধরে জোরে চাপ দিলেন। বৃদ্ধের হাতের জোর দেখে আমার পিলে চমকে গেল। এর পর হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলতে লাগল সাদর সম্ভাষণের বাণ, হালে শুমা খুবে ? খুব হাস্তিদ ? সালেম হাস্তিদ ? খোশহাল হাস্তিদ ? খাস্তে কি না শুদিদ ? ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আমিও খাইলি মামনুন, কোরবানে শোমা, ইত্যাদি বলে জবাব দিতে থাকলাম। সম্ভাষণ পর্ব শেষ হলে বৃদ্ধ সবচেয়ে বড় তাঁবুটা দেখিয়ে আরও ঝুঁকে বলল,

- লুতফান তাশরিফ বিয়ান অগাই দকতোর (দয়া করে তোমার তাশরিফ নিয়ে চলো ডাক্তার)

যদিও তাশরিফ শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্মান, ইজ্জত, মর্যাদা, ইত্যাদি। ফারসি ও উর্দু ভাষায় সম্মানীয় কাউকে আসতে কিংবা বসতে বললে তাশরিফ আনা বলা হয়। রুগীরা এখনও আসা শুরু করেনি। তাই এখানে দাঁড়িয়ে থাকারও কোনো মানে হয় না। আমি “শুকরান” বলে আমি তাঁকে অনুসরণ করি। পিছে পিছে দাদ মোহাম্মদ, খারকুই।

তাঁবুর ভেতর ঢুকে তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ! ইতিহাস ভিত্তিক সিনেমায় দেখেছি, যুদ্ধের ময়দানে রাজা বাদশাহদের তাঁবুর ভেতরটা অসম্ভব সুন্দর সজ্জায় সজ্জিত থাকত। বাস্তবেও যে তাঁবুর ভেতরটা এত সুন্দর হতে পারে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি। পুরা মেঝে পুরু নরম কার্পেটে মোড়া। তাঁবুর দেয়ালে লাগানো মেয়েদের নিপুণ হাতে আঁকা নকশী কাঁথা। ছাদে রঙিন শামীয়ানা। এক পাশে চাঁদর বিছানো বসার যায়গা। হেলান দিয়ে বসার জন্য মোটা মোটা তাকিয়া পাতা। তাঁবুর মাঝ বরাবর পর্দা টানা। তার পিছনে হয়ত শোবার জায়গা কিংবা গৃহস্থলী জিনিষপত্র রাখা। আমরা সবাই জুতো খুলে আসন গ্রহণ করলাম।

বাইরে বাতাস গরম থাকলেও তাঁবুর ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়। চোখে মুখে এসে লাগে শীতল হাওয়ার ঝাঁপটা। তাবুতে এয়ার কুলার ? এখানে কারেন্ট থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। তার মানে জেনারেটরের মাধ্যমে চলছে ? বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই তাঁবুর মালিক যথেষ্ট সম্পদশালী ও সৌখিন। আমার মুগ্ধতা দাদ মোহাম্মদের দৃষ্টি এরায় না। সে বলে ওঠে,

- ইন খিমাহ সর্দার হাজী আব্বাস রিগী এ হাস্ত (এই তাঁবু সর্দার হাজী আব্বাস রিগীর)

আগেই শুনেছি, বালুচিস্তানে যতগুলি প্রভাবশালী বংশ আছে, রিগীরা তাদের অন্যতম। শুধু শিক্ষা দীক্ষায় নয়, সম্পদে, ব্যবসায়, স্মাগ্লিং, মারামারি, সবকিছুতেই তাঁরা অন্যতম। আর এক প্রভাবশালী বংশ হাশেমজায়ীদের সাথে তাদের বিবাদ বহুদিনের। তাই বুঝি রিগীদের সর্দার হাজী আব্বাসের আবাস এই পাহাড় ঘেরা সুরক্ষিত স্থানে। তাঁর নাম অনুযায়ী বোধহয় এই আবাসস্থলের নাম আব্বাসাবাদ। তাহলে কি এই বৃদ্ধই রিগীদের সর্দার হাজী আব্বাস ? বুঝি আমার মন পড়তে পারে দাদ মোহাম্মদ। আমার ভুল ভাঙ্গাতে আবার বলে ওঠে,

- ইন পেদারে হাজী আব্বাস হাস্ত। হাজী আহম্মদ রিগী (ইনি হাজী আব্বাসের বাবা। হাজী আহম্মদ রিগী)। হাজী আব্বাস সফরে আছেন।

শুনে মনে মনে ভাবি, কোন সফরে আছেন হাজী আব্বাস ? নামে হাজী হলেও কাজে তো অনেকেই পাজী। কোনো ড্রাগের চালান নিয়ে যান নাই তো ? শুনেছি, এই অঞ্চল দিয়েই আফগানিস্তান থেকে আসা পপির চালান যায় ইউরোপের দিকে। সেই পথের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই কি সর্দারের আস্তানা এখানে? তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরাই বা কোথায় ? ওই পাহাড়ের গায়ে, গাছের আড়ালে বসে একে ফোরটি-সেভেন তাক করে বসে নাই তো ? হয়ত নজর রাখছে সামনের মরুভূমির উপর। যেখানে একটা ছোট্ট কাফেলাও অনেক দূর থেকে দেখা যায়। সর্দারের গানম্যানরা নিশ্চয়ই নজর রাখতে এই উপত্যকায়ও। পাহারা দিচ্ছে সর্দারের পরিবার। আমি মনে মনে সতর্ক হয়ে যাই। এখানে কোনো ঘিরিঙ্গি করা চলবে না। ছয়টা ন্যাংটা প্যারাসিটামল কিংবা কাজী ভাইয়ের মতো ছয়টা কৃমির বড়ি দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। কে জানে, অসন্তুষ্ট হলে হয়ত বেঁধে রাখবে গাছের সাথে! কোনো নালিশ নয়। কোনো তদন্ত নয়। সোজা উঠতে হবে সর্দারের কাঠগড়ায়। ভাবতেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি সিরসির করে নেমে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। গলাটা শুকিয়ে আসে। একটু পানি খেতে পারলে ভালো হত !

এমন সময় ষণ্ডা মার্কা একটা লোক পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। হাতে একটা টোপলা মতো। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই জমে বরফ হয়ে গেলাম! এমন হিম শীতল দৃষ্টি আমি জীবনে দেখিনি। একেই কি সাপের দৃষ্টি বলে ? চোখ দুটো কোটরে ঢোকা। গালের মাংস বুঝি খাবলে নিয়ে গেছে কেউ। চোয়াল দুটো বেঢপ ভাবে ঠেলে উঠে আছে উই পোকার ঢিবির মতো। মোটা দড়ির মতো গোঁফ নেমে এসেছে ঠোঁট থেকে থুতনি পর্যন্ত। তারই আশেপাশে অযত্নে বেড়ে উঠেছে আগাছার মতো থোকা থোকা দাঁড়ি। বোধহয় মাসে দুই মাসে একবার শেভ করে। চওড়া কাঁধ, চল্লিশ ইঞ্চি ছাতি। বুক চিতিয়ে সটান দাঁড়িয়ে স্থির তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এখানে আমিই নতুন। বুঝি বোঝার চেষ্টা করছে এই নতুন ডাক্তারকে কতটুকু ভরসা করা যায়। সে দৃষ্টির সামনে ভয়ে আমি আরও কুঁকড়ে গেলাম। আমার স্থির বিশ্বাস, এই লোক চাইলে নির্দ্বিধায় আমার কল্লাটা ধর থেকে আলাদা করে ফেলতে পারে। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত ! অথচ আমার কাছে কয়েক যুগ বলে মনে হয়। হঠাৎ নরম হয়ে যায় তাঁর দৃষ্টি। কালো গোঁফের নীচে ঝকমক করে ওঠে দুটো সোনা বাঁধানো দাঁত। মাথা ঝুঁকিয়ে বলে ওঠে,

- খোশ আমোদিদ অগাই দকতোর। আমি আহবাব রিগী। হাজী আব্বাসের ভাই।

ধরে প্রাণ আসে আমার। যাক, ব্যাটা বুঝতে পেরেছে, পোলাপাইনের মতো চেহারার এই দকতোর কুচলুকে সন্দেহ করার মতো কিছু নাই। কিন্তু ততক্ষণে আমার গলা শুকিয়ে মরুভূমি। আমিও খাইলি মামনুন বলতে গেলাম। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না। লোকটা কাছে এগিয়ে এসে আমাদের সামনে পোটলাটা খুলে বিছিয়ে দিল। একটা নরম প্লাস্টিকের চাদরের মতো। ওরা বলে ছোফরে। এই ছোফরে বিছিয়েই খানা দানা করে। এর মধ্যেই নান বা রুটি পেঁচিয়ে রাখে যাতে নরম ও তাজা থাকে। এর মধ্যেও রুটি ছিল। তবে পুরনো নয়। তাজা, গরম রুটি। বেশ মোটা। এর আগে বড় চুল্লিতে তৈরি ইরানি রুটি খেয়েছি। দোকানে যা কিনতে পাওয়া যায়। এই প্রথম ঘরে বানানো রুটি দেখলাম। কেমন একটা নেশা ধরানো ঘ্রাণ আসছে। সে ঘ্রাণে পেটের মধ্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠা ছুঁচোগুলো ছোটাছুটি শুরু করে দিলো।

তারপর একে একে আসে বাটি ভর্তি মাখন, পেস্তা, বাদাম, ফালি ফালি করে কাটা মাল্টা, তরমুজ। আসে পানি। আসে চায়ের সরঞ্জাম। গরমের দেশ। অথচ এরা পানির পরিবর্তে সারাক্ষণ চা খায়। বলে গরমে নাকি গরম কাটে। এদের চা বানানোর তরিকাও আলাদা। এর আগে ইরানি চা খাইনি, তা নয়। তবে কোনো ইরানিদের ঘরে বসে নয়।

চা বানানোর পাত্রটিকে এরা সামোভার বলে। সামোভার তিনতলা বিশিষ্ট। সবচেয়ে নীচের তলায় থাকে ছোট একটা স্টোভ। তার উপরে পানির জার বা জগ। সেই জগে সব সময় পানি ফুটতে থাকে। সেই পানিতে মেশানো থাকে না না রকম খুশবুদার মশলা। জগের গায়ে পানির ট্যাপের মতো ট্যাপ লাগানো। আর জগের মুখে বসানো থাকে টি পট। ফুটন্ত পানির বাষ্প গরম রাখে সেই পটে চায়ের লিকার। এরা ছোট ছোট চায়ের কাপে পরিমাণ মতো চা ও পানি মিশয়ে নেয়। চিনির কান্দ মুখে নিয়ে সেই চা টুক টুক করে খায়।

আহবাব হাঁটু গেঁড়ে বসে গ্লাসে পানি ঢেলে সবার সামনে রাখল। হাজী আহম্মদ রিগী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

- বেফারমাইন দকতোর। বিসমিল্লাহ বুকুন।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, রুগী দেখতে নয়, যেন বিয়ে করতে এসেছি। হবু বরের মতো সকল আপ্যায়নের কেন্দ্রবিন্দু আমি। কিন্তু অত কিছু দেখার বা বোঝার অবস্থা নেই আমার। তৃষ্ণায় চৈত্রের মাঠের মতো ছাতি ফেটে চৌচির। কোনোমতে খাইলি মামনুন বলে একটা গ্লাস তুলে ঢক ঢক করে পুরা গ্লাস খালি করে ফেললাম। গ্লাস নামিয়ে রাখতে যেয়ে দেখি, সবাই অবাক চোখে দেখছে আমাকে। দেখি, বৃদ্ধ হাজী আহম্মদ গোঁফের নীচে মিটিমিটি হাসছেন। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিছু কি ভুল করলাম ? এবার হাজী সাহেব তাঁর গ্লাস তুলে সবার সামনে একবার করে ধরলেন আর মুখে বললেন, বেফারমাইন। অর্থাৎ কেউ পানি খাবে কিনা জানতে চাইছেন। সবাই না বলার পরই তিনি পানি মুখে দিলেন। অন্যরাও তাই করল। এতক্ষণে বুঝলাম, বেকুবের মতো কাজ করে ফেলেছি! এটাই এখানকার রীতি। পানির আকাল বলেই বোধহয় আবহমান কাল ধরে অন্যকে অফার না করে নিজে পান করে না। অথচ অভদ্রের মতো কাউকে জিজ্ঞেস না করেই আমি পানি খেয়ে ফেলেছি! লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।

এর পর শুরু হল পানাহার। সবাই যে যার মত, রুটি, মাখন, ফল, চা খেতে লাগল। আমিও আড়ষ্ট ভঙ্গীতে একটুকরা রুটি ছিঁড়ে মাখন লাগিয়ে মুখে দিতেই যেন অমৃতের স্বাদ পেলাম। মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসল, “ ওয়াও, খাইলি খোশমজ্জে হাস্ত” (খুবই সুস্বাদু)। আর পেস্তা তো আমার আগে থেকেই প্রিয়। তালে তালে অনেকটাই খেয়ে ফেললাম। তবে দাদ মোহাম্মদ আর খারকুইয়ের খাওয়া দেখে মনে হল, ওরা সাইয়ারিতে আসবে বলে সকাল থেকেই না খেয়ে আছে !

খাওয়া দাওয়ার পাট শেষ। এবার রুগী দেখার পালা। হাজী আব্বাসের তাঁবুর সামনেই টেবিল চেয়ার পাতা হল। রুগী বলতে নারী, বৃদ্ধ ও শিশু। জোয়ান মরদ নেই বললেই চলে। তবে কেউ শখের রুগী না। কোনো মোয়াল্লেমও মাদ্রাসা ছুটি দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পাঠাল না। আর আমাকেও কঠোর হতে হল না। খুশি মনে অনেককেই তাদের প্রিয় ‘বিতামিন”, “পোমাদ”, “শরবত” দিলাম। সব মিলিয়ে জন তিরিশেক রুগী হবে। যাক, ভালোয় ভালোয় প্রথম সাইয়ারি শেষ হল। সাথে ভূড়িভোজ উপরি পাওনা। সব সাইয়ারিই কি এমন হবে ? কে জানে। এবার যাবার পালা। কিন্তু ড্রাইভার দাদ মোহাম্মদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না আহবাব কিংবা হাজী আহম্মদকেও। শেষে খারকুইকে ডেকে বললাম,

- দাদ মোহাম্মদ কই ?

- দেখো, কারও কাছ থেকে বিড়ি নিয়ে ফুঁকছে!

মানে কী ? বিড়ি খায়, ভালো কথা। তা চেয়ে-চিন্তে কেন ? কিনে খেতে পারে না ? ব্যাটা যে ধান্দাবাজ, প্রথম থেকেই টের পাচ্ছিলাম। একটু টাইট দিতে হবে। ওদিকে যুবতী বউ আমার পথ চেয়ে বসে আছে। অহেতুক অপেক্ষা অসহ্য লাগে আমার। একটু বিরক্তি নিয়ে বললাম,

- যাও, খুঁজে নিয়ে এসো।

- চাশত!

আঙ্গুল দিয়ে নিজের চোখ ছুঁয়ে দাদ মোহাম্মদকে খুঁজতে চলে যায় খারকুই। “চাশত” শব্দটা আজ্ঞাবহ। “হুকমে শোমা বার চেশম হাস্ত” (তোমার আদেশ চোখের উপর) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। অনেকটা বাংলায় “আপনার আদেশ শিরোধার্য” এর মতো। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেল। খারকুই কিংবা দাদ মোহাম্মদ, কারোই দেখা নেই। মেজাজটা আরও খিঁচরে গেল। আমিও একটা সিগারেট ধরালাম।

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে দাদ মোহাম্মদ। বলে,

- মাজরাত মিখাম দকতোর (ক্ষমা চাই ডাক্তার)। আমাকে খুঁজছিলে?

- হ্যাঁ। আর শোনো দাদ মোহাম্মদ, এখন থেকে বিড়ি খেতে হয়, আমার সামনেই খাবে। না থাকলে আমার কাছ থেকে চেয়ে নেবে। আমাকে না বলে হাওয়া হয়ে যাবে না।

- ভুল হয়ে গেছে দকতোরজুন। আর এমন হবে না। কিন্তু আমাকে খুঁজছিলে কেন?

- বাহ, যেতে হবে না? রুগী দেখা তো শেষ।

- যাবে কী? খানা খাবে না?

- খানা খাব মানে? একটু আগে না খেলাম?

- ওহ, সে তো “সোবহানে বুঁদ” (সকালের নাস্তা ছিল)। নাহার (দুপুরের খাবার) খাবে না? তোমার জন্য মুরগী রান্না হচ্ছে।

ব্যাটা কয় কী? রাক্ষস নাকি? দুই ঘণ্টা আগেই না মইষের মতো পেট ভাসাইয়া রুটি, মাখন, চা, ফল খাইলি? এখন আবার নাহার? যে পরিমাণ রুটি খেয়েছি, আমার পেটও তো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। হাহা করে উঠলাম,

- রক্ষে করো দাদ মোহাম্মদ। নাহার তো দূরের কথা, আমার পক্ষে পানি খাওয়াও সম্ভব না। ওদের বলে দাও।

দাদ মোহাম্মদ এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

- আমাকে বলেছ। আর কাউকে বলো না। সর্দার হাজী আব্বাসের বাড়ি এসেছ, আর নাহার খাবে না, এটা আগেও কখনো হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। সর্দার না শুনতে পছন্দ করেন না।

- কিন্তু সর্দার তো আজ বাড়িতে নেই।

- তাতে কী? শোনো দকতোর। তুমি নতুন এসেছ, তাই বলছি। মেহমান হাবিবে খোদা হাস্ত। মেহমান আল্লাহর বন্ধু। তাঁর খেদমত করা বালুচদের জন্য ইবাদত। তুমি না খেয়ে চলে গেছ, শুনলে খুব অপমানিত বোধ করবেন।

এর পরে আর কথা চলে না। ইরানে আসার আগে একই কথা বলেছিল হাশিম আসকারি। আমার অবস্থা “পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে”। তবে একটা কথা পরিষ্কার, সর্দার হাজী আব্বাসকে দাদ মোহাম্মদ বাঘের মতো ভয় করে। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁবুর ভেতর ছোফরে পড়ে। আবারও আসে ফলমূল, চায়ের সামোভার। আর আসে ট্রে ভর্তি ভাত আর বাটি ভর্তি মুরগীর মাংস। আমাদের সাথে আবারও যোগ দেন হাজী আহম্মদ রিগী। যোগ দেয় আহবাব রিগী। এবারও খাবার থেকে ফুরফুর করে আসছে খুশবু। আমি আর না বলার সাহস করি না। যত কষ্টই হোক, কিছু খেতে হবে। প্রয়োজনে রাস্তায় বমি করে দেব। তবুও অদেখা সেই ডাকু সর্দারের বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি নেব না।

পহলে আপ, পহলে আপ, জাতীয় লৌকিকতা সেরে সবাই খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিও এক চামচ ভাত আর এক টুকরা মাংস নিলাম। একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম, গ্রামের বালুচ, অথচ ভাত খায় কাঁটা চামচ দিয়ে। কাঁটা চামচে অভ্যেস নেই আমার। তবুও নিলাম। এক চামচ ভাত মুখে দিতেই মনে হল, এমন ভাত জীবনে খাইনি আমি। ভাত তো দূরের কথা, আমাদের দেশের পোলাউও এর কাছে কিছু না। সরু লম্বা ভাতের দানাগুলো নরমও নয় আবার শক্তও নয়। মুরগী রান্না হয়েছে টমেটোর সস দিয়ে। তাই একটু টক টক স্বাদ। তবে ভীষণ স্বাদ। ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও তেমন খেতে পারি না। অথচ ওরা সবাই গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে। ওদের পাতলা পেটে এত ক্ষুধা কোথায় থাকে কে জানে ? আমি মাথা নিচু করে চামচ দিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকি।

- গাজা খুব না শুদে অগাই দকতোর (খাবার ভালো হয় নাই ডাক্তার)?

চমকে মুখ তুলে তাকাই। অবগুণ্ঠন-ধারী এক নারী দাঁড়িয়ে। ভালো করে মুখ দেখা যাচ্ছে না। অথচ সেই মৌ মৌ মিষ্টি কণ্ঠ ! সেই মাতাল করা ফরাসি সৌরভ! অস্ফুটে উচ্চারণ করি,

- আফসানেহ?
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব ১৩




- চিনতে পেরেছ তাহলে?

ঘোমটাটা মুখ থেকে মাথার উপরে তুলে দেয় আফসানেহ। অমনি যেন চাদরের ফাঁক গলে উঁকি দেয় পূর্ণিমার চাঁদ। মুখে সেই ঠোঁট টেপা মোনালিসা হাসি। দু’গালে তেমনই বুকে ঝড় তোলা জলের ঘূর্ণি। দু’চোখে খুশির ঝিলিক। আজ কাজল পরেছে আফসানেহ। তাতে আরও গভীর, আরও কালো দেখায় ওর কাজল দিঘি চোখ। সেজেছে বালুচি সাজে। পরেছে বালুচি পোশাক। সালোয়ারের উপর চওড়া ঘেরের ফ্রক। বুকে রঙিন সুতোর কারুকাজ। মাথায় ইরানি চাঁদর। অপূর্ব লাগছে দেখতে। কমে গেছে বয়স। এ যেন এক তন্বী বালুচি তরুণী। পাহাড়ের কোল বেয়ে ছুটে আসা এক চঞ্চলা হরিণী ! এক অদ্ভুত ছেলেমানুষি আর সরলতা ওর চলনে ও বলনে। নইলে নতুন ডাক্তারের পরীক্ষা নিতে কেউ ঘোমটায় মুখ ঢেকে আসে ? ওর এই ছেলেমানুষি দেখে ভীষণ হাসি পায় আমার। আবার অবাকও হই খুব। ওকে এভাবে এ সাজে দেখব এখানে, স্বপ্নেও ভাবিনি। অবাক কণ্ঠেই জানতে চাইলাম,

- তুমিও কি সাইয়ারিতে এসেছ?

শুনে বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে কুটিপাটি হয় আফসানেহ। যেন এমন মজার কথা শোনেনি জীবনে। সে হাসিতে দুলে ওঠে ওর লতানো শরীর। যে ভাবে দোল খায় মাধবী লতা বাসন্তী বাতাসে। কিন্তু এত হাসির কী হল বুঝতে পারি না। আমি অবাক চোখে ওকে অপলক দেখতে থাকি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে আফসানেহ বলল,

- তুমি এত বোকা কেন ডাক্তার ? সাইয়ারিতে আসলে তো তোমার সাথেই আসতাম। এটা আমার বাবার বাড়ি।

এখানে বোকামির কী হল আমি বুঝতে পারি না। আব্বাসাবাদের এই দুর্গম উপত্যকায়, বালুচ সর্দারের তাঁবুতে, আমার হেলথ কেয়ার এসিস্ট্যান্ট হঠাৎ বালুচি ড্রেসে উদয় হয়ে বলবে, এটা আমার বাবার বাড়ি, সেটা আগে থেকে কেমন করে জানব আমি ? দেখি, হাসছেন হাজী আহম্মদ রিগী মিটিমিটি। উপভোগ করছেন নাতনীর এই ছেলেমানুষি। যেন বলতে চাইছেন, দেখো দকতোর, কেমন বোকা বানাল তোমাকে! অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, দাদ মোহাম্মদ ও খারকুই মাথা নিচু করে নীরবে খেয়ে চলেছে। আফসানেহ রিগী নামে অসম্ভব রূপবতী একটা মেয়ে যে এখান দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছে, ওরা যেন তা জানেই না। কেন ? ভয়ে ? সর্দার আব্বাস রিগীর মেয়ে বলে ? কতটা ভয়ঙ্কর এই আব্বাস রিগী ? আর তখনই লক্ষ্য করি, আহবাব রিগী খাওয়া থামিয়ে ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে আছে দাদ মোহাম্মদ ও খারকুইয়ের দিকে। সেই জন্যই বোধহয় একই দারমাঙ্গায় কাজ করা স্বত্বেও আফসানের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত করছে না ওরা ? মনে মনে আবার প্রমাদ গুনি। কোনো রকম বালখিল্যতা দেখানো যাবে না এখানে। আমি হাজি আহম্মদ রিগীর দিকে তাকিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলি,

- বেবাকশিদ হাজি আগা (দুঃখিত হাজি সাহেব) ! আমি আসলেই জানতাম না।

- তুমি দুঃখিত হচ্ছ কেন দকতোর ? দোষ তো আফসানের। ও নিশ্চয় তোমাকে আগে থেকে বলেনি?

- বলব কখন দাদাজান ? যা ব্যস্ত মানুষ ডাক্তার। এত কথা শোনার সময় কোথায় তার?

আফসানের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠি। কী আছে সেখানে ? শ্লেষ ? রাগ ? ক্ষোভ ? আমি বুঝতে পারি না। মুখ তুলে আবার ওর দিকে তাকাই। স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে । সে দৃষ্টি আমার কাছে অচেনা মনে হয়। তবে কি কাল ওকে ওভাবে চলে যেতে বলাটা সহজ ভাবে নিতে পারেনি ? আমি জানি, সুন্দরী মেয়েরা অবজ্ঞা সইতে পারে না। এরা তোষামোদে ভুলে যায়। প্রশংসায় খুশি হয়। কঠিন বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। কোথায় যেন এও পড়েছিলাম, মেয়েরা হল সাপের মতো, লেজে পা পড়লেই ফোঁস করে ওঠে। ছোবল দিতে চায়। কিন্তু ওর সাথে তো আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নয়। মাত্র তো এক দিনের পরিচয়! মাথার ভেতর আবার বিপদ সংকেত বেজে ওঠে। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে। কিছু না বলে আমি চোখ নামিয়ে নিই।

কপট রাগত স্বরে আহম্মদ রিগী বলে ওঠেন,

- তুই এখান থেকে যা তো আফসানেহ। দকতোরকে খেতে দে। খালি সবার সাথে ঝগড়া করিস।

আহম্মদ রিগীর গলায় প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়। এবার সত্যি সত্যি আফসানেহ ঝগড়াটে গলায় ঝংকার দিয়ে ওঠে,

- ঝগড়া করছি কোথায় দাদাজান ? ডাক্তার, বললে না তো, রান্না কেমন হয়েছে?

রান্না কি আফসানেহ করেছে ? সেই জন্যই কি জানার এত আগ্রহ তার? দাদা তার নাতনীকে প্রশ্রয় দিতেই পারে। কিন্তু আমার দিলে তো চলবে না। আমি আরও গম্ভীর হয়ে যাই। ওর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিই,

- রান্না খুব ভালো হয়েছে। দাস্তে শোমা দারদ না কুনে ( তোমার হাত যেন ব্যথা না করে)।

স্বভাবে বিনয় আর ভাষায় বাক্যালংকার, পারস্য সভ্যতার এক অন্যতম উপাদান। খেয়ে রান্নার প্রশংসা করা একটা সাধারণ ভদ্রতা। আমরাও করি। কিন্তু ইরানিরা যে কায়দায় করে, সে কায়দায় অন্য কোনো জাতি করে কিনা, আমি জানি না। রান্না ভালো হোক বা না হোক, “খাইলি খোশমজ্জে শুদে” তো বলবেই। সেই সাথে বলবে, দাস্তে শোমা দারদ না কুনে। যার ভাবার্থ হল, এই যে কষ্ট করে রান্না করেছ, তাতে তোমার হাতে যেন ব্যথা না করে। মজার ব্যাপার হল, এর জবাবে “খাইলি মামনুন” তো বলবেই, সেই সাথে বলবে, “মু এ শোমা দারদ না কুনে”, যার ভাবার্থ হল, তুমি যে কষ্ট করে খেয়েছ, তাতে তোমার মুখে যেন ব্যথা না করে। এখানেই শেষ নয়, এর জবাবে অন্যজন বলবে, “ছারে শোমা দারদ না কুনে”। অর্থাৎ, এই যে আমার জন্য চিন্তা করছ, এর জন্য তোমার মাথায় যেন ব্যথা না করে। এই ভাবে একে অন্যের প্রশংসা করতে থাকে। হয়ত অভ্যাস বশেই আফসানেহ জবাব দেয়,

- মুয়ে শোমা দারদ না কুনে অগাই দকতোর। কিন্তু তুমি তো খাচ্ছ না!

- ছারে শোমা দারদ না কুনে খানম রিগী। যথেষ্ট খেয়েছি।

আমরা যেমন পুরুষদের সম্মান জানাতে নাম বা পদবীর আগে মিস্টার কিংবা পরে সাহেব যোগ করি, ওরাও তেমনই আগে “অগাই” কিংবা পরে “আগা” যোগ করে দেয়। আর নারীদের বেলায় “খানম”। তবে বয়সে ছোট বা ঘনিষ্ঠ জনদের শুধু নাম ধরেই ডাকে। আমি ইচ্ছে করেই আফসানেহ না বলে খানম রিগী বলে সম্বোধন করলাম। কথাটা বোধহয় কানে বাজল আফসানের। এর আগে কখনও ওকে খানম রিগী বলে ডাকিনি। শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে আফসানেহ,

- না। তুমি মোটেই যথেষ্ট খাওনি ডাক্তার। আমি অনেকক্ষণ ধরে পর্দার আড়াল থেকে দেখেছি, তুমি শুধু খাবার নাড়াচাড়া করেছ।

হঠাৎ করেই কথা বলার ধরণ বদলে যায় আফসানের। এর আগে কখনও এমন সুরে কথা বলেনি সে। কী বলব একে ? অধিকার ? মায়া ? অভিমান ? কিন্তু কেন ? সদ্য পরিচিত ভিনদেশি এক বিবাহিত ডাক্তারের প্রতি কেন তার তেমন কোনো অনুভূতি হবে ? নাকি এও ওদের মেহমান নওয়াজীর বহিঃপ্রকাশ ? কেমন বিভ্রান্ত লাগে আমার। আবার ওর দিকে তাকাই। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আফসানেহ। পাতলা ঠোঁট দুটো চেপে বসা। কী আছে ঐ মুখের রেখায় ? কী আছে ঐ চোখের তারায় ? আমি পড়তে পারি না। তবে কেন জানি মেয়েটির জন্য খুব মায়া হয় আমার। মোলায়েম স্বরে বলি,

- আসলেই রান্না খুব ভালো হয়েছে আফসানেহ। আমি তো জানতাম না যে “নাহার”ও খেতে হবে। তাহলে রুটি কম খেয়ে পেটে জায়গা রাখতাম। রান্না ভালো হয়েছে না দাদ মোহাম্মদ?

আমি দাদ মোহাম্মদকেও দলে টানতে চেষ্টা করি। শুনে দাদ মোহাম্মদ, খারকুই, দুজনেই এই প্রথম বারের মতো কথা বলে ওঠে,

- অবশ্যই ভালো হয়েছে। খানা অতি সুস্বাদু হয়েছে খানম রিগী। দাস্তে শোমা দারদ না কুনে।

এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ একই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আফসানেহ। তার পর ঝট করে ঘুরে হাঁটা দেয়। আমি অবাক চোখে ওর ছন্দ তোলা শরীরটা পর্দার আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখি। ওর এমন আচরণের কোনো কারণ খুঁজে পাই না আমি। এতক্ষণে আহবাব রিগী বলে ওঠে,

- মাজরাত মিখাম অগাই দকতোর। আফসানের কথায় কিছু মনে করো না। বংশের একমাত্র মেয়ে তো। বড় আদরের। বড় অভিমানী। বড় খামখায়ালি। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।

কঠিন চেহারার এই মানুষটার মনেও যে আফসানের জন্য কী ভীষণ মমতা, তার কথা শুনে বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। সবার এই অতি আদরই যে মেয়েটির মাথা খেয়েছে, খামখেয়ালি করে তুলেছে, তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। শুনেছি, বালুচদের পরিবারে মেয়েদের কোনো গুরুত্ব নেই। মূল্য নেই। অথচ আফসানেকে তো এরা মাথার তাজ করে রেখেছে। তখন কী করে জানব, এই যে সবার অতি আদর, এই যে সকলের মমতার ফল্গুধারা, এই যে সবার মাথার তাজ হয়ে থাকা, আর তাতেই মেয়েটির দিনে দিনে এমন খামখেয়ালি হয়ে ওঠা, এ সব কিছুর পিছনে লুকিয়ে আছে এক নির্মম করুণ ইতিহাস?

আমি হেসে বলি,

- না না, ক্ষমা চাইতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি। কষ্ট করে রান্না করেছে। না খেলে তো খারাপ লাগবেই।

এর পর আর তেমন কথা এগোয় না। ততোক্ষণে অন্যদেরও খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। আহবাব ছোফরে গুটিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। আমরা হাজী আহম্মদ রিগীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসি। আসতে আসতে কেন জানি না, মনের ভেতর দূরে কোথাও যেন ঢেউয়ের গর্জন শুনি। ভাঙ্গনের শব্দ শুনি। ভয়ে শিউড়ে উঠি। মনের বাঁধটা আরও শক্ত, আরও মজবুত করা দরকার। অশোভন কোনো আবেগের ঢেউ এসে মন-নদীর তীর ভেঙ্গে দিক, কোনো মতেই তা চাই না আমি।

বাইরে তখন বেলা পড়ে এসেছে। পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে। মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। ফিরে যাবার তাড়া অনুভব করি। আমরা গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় আফসানে একটা বাস্কেট হাতে নিয়ে ছুটে আসে। আমাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় দাদ মোহাম্মদের দিকে। বলে,

- অগাই দাদ মোহাম্মদ। এটা খানম দকতোরকে দিও।

আজব ! খানম দরতোরকে কিছু দিচ্ছে। অথচ দকতোরকে বলছে না ! বলছে দকতোরের ড্রাইভারকে ? এখনো অভিমান ? আসলেই খুব ছেলেমানুষ মেয়েটা। ওর মান ভাঙ্গাতেই হেসে বলি,

- তা, কী দিচ্ছ আমার বউকে ? আমাকে বলা যাবে না?

দাদ মোহাম্মদের হাতে বাস্কেটটা ধরিয়ে দিয়ে, ধীরে ধীরে হেঁটে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ায় আফসানেহ। এই প্রথম এত কাছে এসে দাঁড়াল সে। এতটাই কাছে যে আমি ওর নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। কোনো কথা না বলে শক্ত মুখে কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন পড়ে নিতে চাইছে আমার চোখের ভাষা। শুনে নিতে চাইছে আমার মনের কথা। হঠাৎ খুব অস্বস্তি লাগে আমার। এক পা পিছিয়ে যাই আমি। এমন সময় দেখি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর দুই চোখ। ঝিকিমিকি করে ওঠে চোখের তারা। শান্ত দিঘির জলে হঠাৎ ঢিল ছুড়ে দিলে যেমন একটা নীরব ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, তেমনই এক নীরব হাসি ছড়িয়ে পড়ে ওর ঠোঁট থেকে গালে, গাল থেকে কপালে, সমস্ত মুখমণ্ডলে। হাসি মুখেই বলে,

- তুমি তো খেয়ে গেলে। কিন্তু একজন যে না খেয়ে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে, সে খেয়াল আছে?

তাই তো ! ঘটনার ডামাডোলে বউটির কথা ভুলেই বসেছিলাম। আসলেই না খেয়ে পথ চেয়ে বসে আছে সে। এ ভাবেই বসে থাকে প্রতিদিন। বিয়ের পর থেকে দেখছি, বাড়িতে থাকলে একদিনও আমার আগে খায়না মেয়েটি। আগে আমাকে নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াবে। তার পর সে খাবে। নইলে নাকি খেয়ে তার তৃপ্তি হয় না। শত নিষেধ করা স্বত্বেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না কোনোদিন। আজও নিশ্চয়ই না খেয়ে বসে আছে ! কিন্তু আফসানেহ জানল কী করে ? অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি,

- তুমি কী করে বুঝলে খানম দকতোর না খেয়ে বসে আছে?

- মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারে ডাক্তার। তোমরা পুরুষেরা যা পারো না।

শুনে আমি ভীষণ ভাবে চমকে উঠি। ঠিক একই রকম কথা বলেছিল বউ কাল রাতে। আসলেই কি আমরা পুরুষেরা অনেক কিছু বুঝতে পারি না ? এই যে একটু আগে যা দেখলাম, যা বুঝলাম, সে সবই কি আমার দেখার ভুল ? সবই কি আমার বোঝার ভুল ? অলিক কল্পনা ? আমি আবার ওর দিকে তাকাই। অবাক হয়ে দেখি, নিষ্পাপ, নির্লিপ্ত দুই চোখ মেলে চেয়ে আছে আফসানেহ। দেখি, নির্মল, স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে আছে মুখ। কোনো রাগ, কোনো ক্ষোভ, কোনো অভিমানের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই সেখানে। কেমন বোকা বোকা লাগে নিজেকে। কত দ্রুত বদলে যায় এদের চোখের ভাষা ! কত দ্রুত বদলে যায় এদের মুখের রঙ ! কে যেন বলেছিল, মেয়েরা হল পানির মতো। যে পাত্রে রাখা হয়, খুব দ্রুত সেই পাত্রের রঙ ধারণ করতে পারে। মনের ভাব বুকে লুকিয়ে রেখে হাসি মুখে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। এই ভালো। ওরা খুব সহজে বদলে যেতে পারে বলেই হয়ত আমাদের আর কষ্ট করে তেমন বদলাতে হয় না। বুঝি এভাবেই ভারসাম্য রক্ষা হয় জগত সংসারে। আর তখনই নিজেকে এই পৃথিবীর অন্যতম নির্বোধ বলে মনে হয়।

দুর্ধর্ষ রিগী বংশের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সর্দার, অঢেল সম্পদের মালিক, হাজী আব্বাস রিগীর একমাত্র মেয়ে, আফসানেহ রিগী। সে নিশ্চয়ই বাবার বাড়ি থেকে এই পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন গুহারকুতে যায় না। নিশ্চয়ই গুহারকুতে তার থাকার জায়গা আছে। আর সেখানে সে নিশ্চয়ই একা থাকে না। এমনিতেই বালুচ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আর আফসানেহ তো শিক্ষা দীক্ষায়, রূপে গুনে অনন্যা। এমন মেয়ের তো পনেরো পেরুবার আগেই বিয়ে হয়ে যাবার কথা। যদিও আফসানের বয়স বোঝা দায়। তবুও বাইশ তেইশ তো হবেই। এতদিনে নিশ্চয়ই একাধিক ছেলেপুলের মা হয়ে গেছে ! গুহারকুতে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে। ওর ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে তো কিছুই জানি না আমি। আজ হয়ত কাকতালীয় ভাবেই আব্বাসাবাদে আমার সাথে দেখা হয়ে গেছে। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়ত একই ভাবে আপ্যায়ন করত। ঠিকমত না খেলে এমনই প্রতিক্রিয়া দেখাত। এটাই হয়ত ওদের আতিথেয়তার ধরণ। তাছাড়া আমিও কোনো আমিতাভ বচ্চন কিংবা রাজেশ খান্না নই যে আমাকে নিয়ে কোনো ফ্যান্টাসি তৈরি হবে। এ সব কথা মনে হতেই শরীরটা আমার পাখীর পালকের মতো হালকা হয়ে যায়। অযথাই দুশ্চিন্তা করছিলাম। অহেতুক শঙ্কিত হচ্ছিলাম। আসলেই বোধহয় আমরা পুরুষরা নারীদের শুধু চোখ দিয়ে দেখি, মন দিয়ে বুঝি না!

- এত কী ভাবছ ডাক্তার ? তুমি যাবে না ? এখনই রওনা না দিলে যে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

ভাবনায় ডুবে ছিলাম বলে আফসানের কণ্ঠের উৎকণ্ঠা আমি টের পেলাম না। আনমনে বলে উঠি,

- ইম। না, কিছু না। আসলেই আমি অনেক কিছু বুঝি না।

- থাক। তোমাকে আর কিছু বুঝতে হবে না ডাক্তার। যাও, বাড়ি যাও। তোমার বউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

অন্যমনস্ক ছিলাম বলে এবারও আফসানের কথার সূক্ষ্ম হুল আমাকে বিদ্ধ করল না। খানম দকতোর না বলে যে “তোমার বউ” বলে আমাকে একটু খোঁচা দিতে চাইল, তাও আমাকে স্পর্শ করল না। আমি অন্যমনস্ক ভাবেই বলি,

- হুম। যাচ্ছি। থ্যাংকস ফর এভরিথিং। খোদা হাফেজ।

আমাদের গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলে। পিছনে উপত্যকায়, নিঃসঙ্গ এক নারী তাঁবুর সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তার মুখে কষ্টের রেখাগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস নিঃশব্দে মিলিয়ে যায় পাহাড়ি বাতাসে। আমি তার কিছুই জানতে পারি না!!
 
ইরানি দাস্তান
পর্ব ১৪






নক করার আগেই খুলে যায় দরজা। দেখি, শুকনা মুখে দাঁড়িয়ে আছে বউ। দু’চোখে তার রাজ্যের উৎকণ্ঠা। দরজায় কান পেতে অপেক্ষা করার কথা শুনেছি। এই মেয়েটা কি মাটিতে কান পেতে অপেক্ষা করছিল ? নইলে আমার পায়ের শব্দেই দরজা খুলে দিল পেল কেমন করে ?

আমাকে দেখেই জানতে চাইল,

- এত দেরি করলা কেন ? কত দূরে গেছিলা ? পথে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো ? সেই সকালে নাস্তা খেয়ে গেছ। সারাদিন তো পেটে দানা পানি কিছু পড়ে নাই। মুখটা কেমন শুকায়ে গেছে ? সাথে খাবার নিয়ে যেতে পারলা না ? আমারে আর কত কষ্ট দিবা ?

- প্রশ্ন করতাছ নাকি মেশিন গানের গুলি ছুড়তাছ ? তা, দরজায় দাঁড় করাইয়াই ঝাঁঝরা কইরা দিবা না ঘরেও ঢুকতে দিবা ?

হেসে জানতে চাইলাম। ত্রস্তে সরে যেয়ে ঘরে ঢোকার রাস্তা করে দেয় বউ। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনি, নিজ মনেই বিড়বিড় করে বলছে,

- কেমনে বুঝবা, ঘরের মানুষটা বাইরে থাকলে মেয়েদের কত রকম দুশ্চিন্তা হয় !

এখানেও সেই পুরুষ হওয়ার অপবাদ ? আমি দুই হাতে ওর দু’বাহু ধরে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে বলি,

- এবার এক এক করে প্রশ্ন করো। দেখো, কোনোটা যেন আবার বাদ না যায়। আজ তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেব।

- থাক, তোমারে আর জবাব দেয়া লাগবে না। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নাও। টেবিলে খাবার লাগাচ্ছি। খিদায় পেট চোঁচোঁ করতেছে।

- তুমি এখনও না খেয়ে বসে আছ ?

- বাহ। আমি কবে তোমার আগে খাইছি ?

- কিন্তু সন্ধ্যা তো হয়ে এলো। এ ভাবে না খেয়ে থাকলে যে অসুস্থ হয়ে পড়বে !

- হইলে তো তুমি আছই। সাধে কী আর বাবায় আমারে ডাক্তারের লগে বিয়া দিছে ?

এই মেয়ের সাথে তর্ক করা বৃথা। সব কথার জবাব তার ঠোঁটের আগায়। আর না পারলে তো চোখের পানি আছেই। কোনদিন জিততে পারি না। সে চেষ্টাও করি না। রণে ভঙ্গ দিয়ে কাপড় চেঞ্জ করতে বেড রুমের দিকে যাব, এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে ওঠে। খুলে দেখি দাদ মোহাম্মদ বাস্কেট হাতে দাঁড়িয়ে। গাড়ি পার্ক করে আফসানের আমানত নিয়ে এসেছে। আমি বাস্কেটটা এনে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখি। বেশ ভারি। এত কী দিয়েছে আফসানেহ ? বাস্কেট দেখেই কলবলিয়ে ওঠে বউ,

- ওমা, কী সুন্দর বাস্কেট। কই পাইলা। কেউ দিছে ? নাকি কিনছ ? এখানে কি মার্কেট আছে ? মধ্যে কিছু আছে মনে হয় ? কী আছে এর মধ্যে ?

এই মেয়েটা মনে হয় একটা দুটো প্রশ্ন করতেই জানে না। মাঝে মাঝে ভাবি, এই মাইয়া স্কুলের মাস্টার হইলে কী হইত আল্লায়ই জানে। প্রশ্নের ঠেলায় পোলাপাইনের বারোটা বাজাইয়া ছাড়ত। এমনিতেও সে প্রচুর কথা বলে । শুধু বলেই না, একেবারে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, কোটেশন সহ বলে। অধিকাংশ সময়ই আমি নীরব শ্রোতা। শুধু মনে খুব কষ্ট পেলে মেয়েটা নীরব হয়ে যায়। তখন ঠোঁট নয়, ওর চোখ কথা বলে। চোখের সে ভাষা আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। ওর মনে কষ্ট দেয়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেসে বলি,

- খুলে দেখো, কী আছে। আমি কাপড় বদলে ফ্রেস হয়ে আসছি।

ডাইনিং রুমে ফিরে আসতেই তো চোখ আমার ছানাবড়া। পুরো টেবিল ভরে গিয়েছে খাবারে। আব্বাস রিগীর তাঁবুতে যত রকম খাবার খেয়েছিলাম, চা ও পানি ছাড়া সবই কিছু কিছু দিয়ে দিয়েছে আফসানেহ। আমাকে দেখেতেই আবার বউয়ের এক ঝাঁক প্রশ্নের বাণ,

- এত খাবার কে দিছে ? দাদ মোহাম্মদ ? বেচারা গরীব মানুষ। এত খাবার দিল কেন ? সবাইরে মানা করে দিবা। এত খাবার যেন কেউ না দেয়।

কেফাতুল্লাহও অনেক খাবার দিয়েছিল। আজ তো আরও বেশি। ভেবেছে, দাদ মোহাম্মদ দিয়েছে। আমি ওর ভুল ভাঙ্গাই,

- আফসানেহ পাঠিয়েছে।

- আফসানেহ ? এত্ত ? বলছিলাম না, মেয়েটা খুব ভালো।

- হুম। একটু বেশিই ভালো।

- ও ভাবে বলতেছ কেন ? প্রথম পরিচয়েই মেয়েটা আমারে বোন ডাকছে। বোনরে ফারসিতে কি কয় জানো ? খাওয়াহার। যাক, বাদ দাও। তুমি খেতে বসো। তোমারে খাওয়াইয়া তারপর আমি খাব। কী সুন্দর ঘ্রাণ আসতেছে। আমার দেরি সহ্য হচ্ছে না।

- তুমি খেয়ে নাও। আমি খেয়ে এসেছি।

- খেয়ে আসছ ? কোথায় খাইলা ?

- আফসানেদের বাড়িতে।

- কও কী ? দাওয়াত দিছিল ? আমারে রেখেই খেয়ে আসলা ? আমারে নিয়া যাইতা। নাকি আমারে দাওয়াত দেয় নাই ? কাল তো আমার কাছে অনেকক্ষণ ছিল। তখন তো কিছুই বলল না !

শেষের দিকের কথাগুলো একটু অভিমানী শোনায়। আমি জোর করে ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেই। নিজেও একটা চেয়ার টেনে ওর সামনে বসি। তারপর বলি,

- আরে পাগলি, দম নেয়ার জন্য হলেও তো একটু থামতে হয়। সেই ফাঁকে অন্তত আমি আমার কথাগুলো বলতে পারি।

- আচ্ছা কও।

ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দেয় বউ। আমি ওকে রেখে খেয়ে এসেছি, বোধহয় মানতে পারছে না সেটা। অথচ একটু আগেই সারাদিন না খেয়ে আছি বলে কতটা উৎকণ্ঠিত ছিল ! শরতের আকাশের মতোই ক্ষণে ক্ষণে বদলায় মেয়েদের মন। একটু অসহায় ভঙ্গিতে বলি,

- শোনো, আজ যে গ্রামে সাইয়ারিতে গিয়েছিলাম, সেই গ্রামের সর্দার আফসানের বাবা। তার তাঁবুতে বসেই রুগী দেখেছি। সেখানেই খেতে হয়েছে। এক বার নয়, দুই দুই বার। এটাই নিয়ম। আসার সময় আফসানেহ খাবারগুলো তোমার জন্য দিয়ে দিল।

- প্রত্যেক সাইয়ারিতেই কি খেয়ে আসতে হবে ?

- তা তো জানিনা রে বউ। মনে হয়। তাই যেদিন আমার সাইয়ারি থাকবে, তুমি সময় মতো খেয়ে নিও।

- তুমি জানো, তোমারে না খাওয়াইলে আমার পেট ভরে না।

- কী করব বলো ? না খেলে যে ওরা অপমানিত বোধ করবে। মনে কষ্ট পাবে। আর কথা নয়। এখন খেয়ে নাও।

- এখন থাক। খিদা মরে গেছে। রাতে খাব।

কথা কম বলছে কেন মেয়েটা ? মনটা কি বেশি খারাপ ? মন খারাপ হলে ওর কথা কমে যায়। সারাদিন আশা করে বসে ছিল বেচারি ! আমি ফিরলে খাবে বলে। খিদে নয়, ওর খাবার ইচ্ছেটাই হয়ত মরে গেছে। বাবার খুব আদরের মেয়েরা বুঝি একটু বেশি অভিমানী হয়। এই মেয়েটি শুধু অভিমানীই নয়, মন খারাপ হলে অবুঝও হয়ে যায়। তখন তাকে স্বামীর মতো নয়, বাবার মতো ভালোবাসতে হয়, স্নেহ করতে হয়। আমি আদর মাখা নরম গলায় বলি,

- শোনো, সব সময় তো তুমি খাবার তুলে দাও। আমি খাই আর তুমি বসে বসে দেখো। আজ আমি খাবার তুলে দিচ্ছি। তুমি খাও। আমি বসে বসে তোমার খাওয়া দেখি।

কোনো কথা না বলে এদিক ওদিক মাথা নাড়ে বউ। চোখের আকাশে জমছে মেঘের ভেলা। যে কোনো সময় নামতে পারে বৃষ্টি। মনটা কেমন করে ওঠে আমার। আহা, মা বাবা, ভাই বোন, বন্ধু স্বজন ফেলে দূর প্রবাসে আমার সাথে পড়ে আছে। এই মন খারাপের দিনে আমি ছাড়া আর কে আছে, যে ওর মাথায় একটু স্নেহের হাত বুলিয়ে দেবে ? আমি আমার চেয়ারটা টেনে ওর পাশে নিয়ে যাই। একটা হাত ওর মাথায় রেখে বলি,

- আচ্ছা, তোমার খেতে হবে না। আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।

ব্যাস, এইটুকুই বোধহয় বাকি ছিল। থিরথির করে কেঁপে ওঠে ওর পাতলা দুই ঠোঁট। কেঁপে ওঠে চোখের পাতা। মেঘ গলে বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়। সে বৃষ্টিতে উপচে ওঠে চক্ষু নদীর জল। ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দেয় বুকের আঁচল। কান্না বড় ছোঁয়াচে জিনিষ। খুব দ্রুতই একজন থেকে অন্যজনে সংক্রামিত হয়। আমার চোখও ভিজে ওঠে। অথচ আমি আমার আবেগ, আমার কষ্ট, আমার কান্না, কখনো কাউকে দেখাতে চাই না। কান্না লুকাতে উঠে ওয়াশ রুমে চলে যাই। নিজেকে সামলে নিয়ে হাত ধুয়ে ফিরে আসি। প্লেটে খাবার নিয়ে নিজ হাতে ওর মুখে তুলে দেই। অশ্রু ভেজা চোখে শিশুদের মতো গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে সে খাবার খায় বউ। দেখে আমার দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা, এই তো জীবন। একটু কান্না, একটু হাসি, একটু অভিমান, একটু ভালো বাসাবাসি। এভাবেই যদি কেটে যেত দিন! সরল, সুন্দর, উপদ্রপহীন। ম্যান পোজেজ, গড ডিসপোজেজ। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। তখন কে জানত, সহজ, সরল জীবনটা আমার এত জটিল হয়ে উঠবে ?

আব্বাসাবাদ ঘটনার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। মোট ছ’টা সাইয়ারি আমার। সপ্তাহে তিনটা। একদিন পর একদিন। দুই সপ্তাহ পর পর এক একটার পালা আসে। বাকি তিন দিন দারমাঙ্গায় রুগী দেখি। কথায় বলে, “বিড়াল মারলে প্রথম রাতেই মারতে হয়”। আমিও গুহারকুতে এসে প্রথম দিনেই বাজী মাত করেছি। আমার ছয়টা ন্যাংটো প্যারাসিটামল তত্ত্ব খুব কাজে লেগেছে। ছোট্ট জায়গা গুহারকুহ। খবরটা রটে গেছে মুখে মুখে। এই পেছার (ছেলে) দকতোর বেশি ওষুধ লেখে না। চাইলেও পোমাদ, বিতামিন, শরবত দেয় না। এর কাছে যেয়ে লাভ নাই। সময় আর পয়সা, দুটোরই অপচয়। দশ তোমান (ইরানি মুদ্রা) দিয়ে টিকেট কেটে যদি এক তোমানেরও ওষুধ না পাওয়া যায়, তাহলে সেই ডাক্তারের কাছে যেয়ে কী লাভ ? তাই আসল রুগী ছাড়া, “যাহা চাই, তাহা পাই” মার্কা রুগী আসা কমে গেছে। আমিও হাফ ছেড়ে বেঁচেছি। আয়েস করে রুগী দেখি। সময় পেলে বাসায় যেয়ে বউয়ের সাথে গল্প করি।

এই এক সপ্তায় আফসানের সাথে একদিনও দেখা হয়নি। কখন আসে, কখন যায়, কিছুই জানি না। আদৌ আসে কিনা তাও জানি না। দারমাঙ্গার প্রশাসনিক প্রধান আমি হলেও আফসানেহ সরাসরি আমার অধীনস্থ নয়। সে পাবলিক হেলথের অধীনে কাজ করে। আমার কাছে নয়, খাশে পাবলিক হেলথ অফিসারের কাছে জবাবদিহি করে। টিকা কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো ক্লিনিক্যাল সমস্যা দেখা না দিলে আমার কাছে আসার প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন নাই বা পড়ল, তাই বলে একবারও সৌজন্য সাক্ষাত করবে না ? ব্যাপারটা ঠিক শোভন লাগছে না। আমার কেন জানি মনে হয়, আফসানেহ আমাকে এড়িয়ে চলছে। কিংবা সেদিনের অস্বাভাবিক আচরণের পর আমার মুখোমুখি হতে লজ্জা পাচ্ছে। কারণ যেটাই হোক, এমন ছেলেমানুষ, খামখেয়ালি মেয়ের সাথে যত কম দেখা হয় ততই মঙ্গল। জীবনে কোনো জটিলতা চাই না আমি।

সেদিনের সেই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী দাদ মোহাম্মদ ও খারকুই। তবে আসার পথে এ নিয়ে আমাদের কোনো কথা হয় নি। হবেই বা কেমন করে ? দুই দুইবার ভুঁড়ি ভোজ করে সারাটা পথ গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘোড়া বেঁচে ঘুমিয়েছি। ভাগ্যিস, সীট বেল্ট বাঁধা ছিল। নইলে পাহাড়ের খাঁদে আমার হাড্ডিও খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু আসার পর থেকে দুজনেই মুখে কুলুপ এঁটে আছে। যেন কিছুই ঘটেনি। নাকি আফসানের এমন আচরণ দেখতে অভ্যস্ত ওরা ? কিংবা বেফাঁস কিছু বলে ফেলে সর্দার আব্বাস রিগীর রোষানলে পড়তে চায় না। আমিও ওদের কাছে আফসানের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা শোভন মনে করি না। কিন্তু জহির ভাই ? তিনি তো আমার আগে এই দারমাঙ্গাতেই ছিলেন। আমার সাথে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। খাশে দেখা হলে অনেক কিছু শেয়ারও করেছেন। কিন্তু আফসানেহ সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। কেন ? একটা অস্বস্তির কাঁটা বুকের ভেতর থেকেই যায়।

সব সাইয়ারিতেই সেই এলাকার প্রধান বা সর্দারের বাড়ি কিংবা তাঁবুতে বসে রুগী দেখতে হয়। সেখানেই খেতে হয়। কিন্তু কেউই আব্বাস রিগীর মতো সম্পদশালী নয়। প্রতাপশালীও নয়। কেউ কেউ তো ভীষণ গরীব। ছেঁড়া তাঁবুর নীচে লোম ওঠা ধূলি ধূসর কার্পেটে বসতে হয়। সম্পদ বলতে এক পাল ভেড়া, কিছু মুরগি, কয়েক খণ্ড ফসলী জমি। আতিথেয়তায় তারা ঝাড়বাতির আলো জ্বালাতে না পারলেও আন্তরিকতার জোনাক পিদিম জ্বেলে দেয়। একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, অতিথি, সে অতি সাধারণ আর যত গরীব হোক, কিংবা অতি গুরুত্বপূর্ণ আর মহা ধনী হোক, তার সামনে কিছু না কিছু খাবার হাজির করবেই। এটাই মেহমানের প্রতি সম্মান। মেহমানও সামনে যা হাজির করা হবে, নিঃশঙ্ক চিত্তে তা গ্রহণ করবে। আর এটাই মেজবানের প্রতি মেহমানের সম্মান। মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান দেখানোর এমন রীতি, আতিথেয়তার এমন আন্তরিকতা, আর কোন দেশে আছে আমি জানি না। এমনও হয়েছে, ছেড়া ছোফরেতে মোড়া কয়েক দিনের পুরনো এক খণ্ড রুটি, একটু বাসি মাখন, কয়েকটা শুকনা খেজুর, এক ঘটি পানি আর চায়ের সামোভার হাজির করেছে। খারকুই আর দাদ মোহাম্মদ সেই বাসী রুটি মাখনই তৃপ্তির সাথে মুখে তুলেছে। তুলেছি আমিও। যদিও মাঝে মাঝে সেই মাখন থেকে ভেড়ার বোটকা গন্ধ পেয়েছি। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করিনি। আমার কোনো অধিকার নেই, রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, প্রচণ্ড কর্মঠ এই মানুষগুলোর আন্তরিকতাকে তাচ্ছিল্য করার, তাদের মনে কোনো কষ্ট দেয়ার।

মাঝে মাঝে আসা যাওয়ার পথে, ছোট ছোট জনপদ চোখে পড়ে। গাড়ির শব্দে ছেলে, বুড়ো, নারী, শিশুরা তাঁবু থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে আমাদের অভিবাদন জানায়। কখনো কখনো হাত তুলে থামতে বলে। দাদ মোহাম্মদ গাড়ির স্পীড স্লো করে জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকায়। যদিও সে সব জায়গায় থামার কোনো বাধ্য বাধোকতা নেই আমার। তবুও থামতে বলি। নেমে ওদের কুশল জিজ্ঞাসা করি। কোনো প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাই। কেউ হয়ত অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে তাঁবুর ভেতর। বাহন নেই বলে দারমাঙ্গা বা সাইয়ারিতে যেতে পারছে না। আমি খুশি মনেই ওদের চিকিৎসা দেই। গাড়ি থেকে ওষুধপত্র দেই। অপ্রত্যাশিত এই অনুগ্রহ পেয়ে ওরাও খুব খুশি হয়। খুশি হয়ে কলাটা, মুলাটার মতো তাদের ক্ষেতে ফলানো তরমুজটা, বাঙ্গিটা দিতে চায়। আমি না না করে উঠলে দাদ মোহাম্মদ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

- না না-কুন দকতোর। ইন হাদিয়া হাস্ত। (না করোনা ডাক্তার। এটা হাদিয়া)। হাদিয়া দেয়া এবং নেয়া, দুটোই নেকির কাজ।

মাগনায় নেকি পাইলে কোন পাগলে ছাড়ে ? আর আমি ছাড়তে চাইলেও দাদ মোহাম্মদ ছাড়বে কেন ? হাদিয়া তো শুধু ডাক্তার একা পাবে না, সাথে তার সঙ্গীরাও পাবে। বাধ্য হয়েই কবুল করতে হয়। তখন কী করে জানব, ডাক্তারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নেকি হাসিল করার অভ্যাস দাদ মোহাম্মদের বহুদিনের ?

একদিন বেশ তাড়াতাড়িই সাইয়ারি শেষ হয়ে যায়। পথে এক লোকালয়ে থামতে হয়। এক বৃদ্ধ বুকে ইনফেকশন বাধিয়ে বসেছেন। তাঁকে চিকিৎসা দিয়ে বাইরে বের হয়েছি। দেখি দাদ মোহাম্মদ একটু দূরে এক মহিলার সাথে কথা বলছে। মহিলা রুটি বানাচ্ছিল। আমাকে দেখেই দাদ মোহাম্মদ ছুটে আসে। পিছে পিছে সেই মহিলা। হাতে বিশাল সাইজের দুই রুটি। তা, আকারে প্রায় লেডিস ছাতার মতো তো হবেই। মাত্র চুল্লি থেকে বের করেছে মনে হয়। রীতিমত ধোঁয়া উড়ছে। আহ, কী তার ঘ্রাণ ! ওরা কি আটার সাথেও খুশবু মেশায় ? নইলে রুটি থেকে এত ঘ্রাণ আসছে কেন ? হাদিয়া হিসাবে ক্ষেতের তরমুজ, বাঙ্গি ঠিক আছে। তাই বলে রুটি ? এটা নিশ্চয়ই ব্যাটা দাদ মোহাম্মদের নেকি হাসিলের ফন্দি ? আমার সামনে রুটি দুটো তুলে ধরে মহিলা বলল,

- বেফারমাইন দকতোরজুন। লুতফান কবুল কুনিদ (দয়া করে গ্রহণ করো)।

- খাইলি মামনুন খানম। কিন্তু আমার তো রুটির দরকার নাই।

- কী যে বলো দকতোর ? রুটির আবার কার দরকার নাই ? রুটি ছাড়া কি জীবন চলে ?

এই বালুচি নারী কেমন করে জানবে, আমি ভেতো বাঙ্গালি। তিন বেলাই ভাত খাই। রুটিতে কোনো রুচি নাই। বিরক্ত মুখে দাদ মোহাম্মদের দিকে তাকাতে দেখি, উল্লুকটা তখন মাটির দিকে তাকিয়ে জুতোর ডগা দিয়ে বালির গভীরতা মাপার চেষ্টা করছে। যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। আমি মহিলাকে ভালো করে দেখি। পড়ন্ত বয়স। মুখের চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে। সে মুখে বলীরেখার আঁকিবুঁকি। পোশাকে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। শুধু চোখ দুটোতে রোদ কিংবা বয়স, কোনোটাই কামড় বসাতে পারেনি। ভাসা ভাসা, মায়া ভরা। কেমন মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে আছে আমার দিকে। সে দৃষ্টিতে নেই কোনো কৃত্রিমতা। আমি কিছু বলার আগেই অমায়িক হেসে বলে,

- তারফ না কুন পেছারজুন ( ভদ্রতা করো না প্রিয় ছেলে)। মায়ের হাতে রুটি, খেয়ে দেখো, অনেক স্বাদ।

এতদিন ইরানিদের মুখে “পেছার দকতোর” ডাক শুনেছি। এই প্রথম কেউ আমাকে পেছারজুন (প্রিয় ছেলে) বলে ডাকল। এই প্রথম কোনো ইরানি নারী আমাকে মায়ের দাবী নিয়ে কিছু দিতে চাইছে। অমনি আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশে এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মা কি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে, উদাস চোখে চেয়ে আছে আকাশে দিকে ? ভাবছে কি তার ছেলের কথা, যে আছে একই আকাশের নীচে দূর কোনো দেশে ? আহা, কতদিন পাই না আমি মায়ের হাতের ছোঁয়া ! পাই না রান্নার স্বাদ ! দু’হাত বাড়িয়ে থাকা এই মাকে আমি না বলি কোন প্রাণে ? রুটি নিয়ে দাদ মোহাম্মদের হাতে দিতে দিতে অজান্তেই বলে ফেলি,

- দাস্তে শোমা দারদ না কুনে মাদারজুন (তোমার হাতে যেন ব্যথা না করে প্রিয় মা)।

একজন অপরিচিত ভিনদেশি ডাক্তারের মুখে “মাদারজুন” ডাক শুনবে, সে হয়ত কল্পনাও করেনি। অবাক দৃষ্টি মেলে সে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। সব মায়েদের দৃষ্টিতেই বুঝি মমতা ঝরে পড়ে। আমি এই নারীর চোখে মমতার সেই ঝর্ণাধারা দেখতে পেলাম। আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ সে আমার মাথায়, মুখে, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

- জিন্দা বাশে, সালেম বাশে, খোশহাল বাশে ( বেঁচে থাকো, সুস্থ থাকো, খুশি থাকো)।

তারপর হঠাৎ করেই ছুটে চুল্লির কাছে চলে যায়। হয়ত তার রুটি পুড়ে যাচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা বিহ্বল হয়ে যাই। আমার চোখে মুখে তার কড়ে পড়া রুক্ষ হাতের ছোঁয়া মাখনের প্রলেপের মতো মনে হয়।

যেতে যেতে আমি দাদ মোহাম্মদকে জিজ্ঞেস করি,

- কী নাম মহিলার ?

- গোলবাহার বেওয়া।

- বেওয়া কেন ? স্বামী নেই ?

- স্বামী অনেক আগেই মারা গেছে। একটা জোয়ান ছেলে ছিল, সেও মারা গেছে।

- কী ভাবে ?

- ইরান ইরাক যুদ্ধে।

শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আহা ! ছেলে হারা মায়ের চোখ, হয়ত আমার মুখে সে তার ছেলের মুখের আদল দেখতে পেয়েছিল। এই জন্যই বোধহয় তার ছোঁয়ায় এত স্নেহের পরশ পেয়েছিলাম। এমন সময় দাদ মোহাম্মদ বলে ওঠে,

- নানে বেওয়া খাইলি খোশমজ্জে হাস্ত (বিধবার রুটি খুব স্বাদের)। একবার খেলে তোমার আবার খেতে ইচ্ছে করবে দকতোর।

ব্যাটা বেকুব কয় কী ? আমি ভাবছি একজন সব হারানো নারীর কষ্টের কথা, আর ও আছে ওর পেটের ধান্দায়। আমি কটমট করে তাকাই। দেখে দাদ মোহাম্মদ ভয়ে চুপ করে যায়। পথে আর কোনো কথা বলে না।

যদিও মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে আছে গোলবাহার বেওয়ার জন্য, তবুও আমি পা টিপে টিপে বাসার দিকে আগাই। আজ বউটাকে চমকে দেব। ও নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি আমাকে আশা করছে না। হয়ত কিচেনে ব্যস্ত। আমি সাইয়ারিতে গেলে ও দেরি করে রান্না করতে যায়। যাতে ফিরে এলে আমাকে ধোঁয়া ওঠা ভাত খেতে দিতে পারে। খিধে না থাকলেও খেতে বসতে হয়। ওর কথা ভেবে কয়েক লোকমা মুখে দিতে হয়। আমি না খেলে যে ওর পেট ভরে না !

নক করার পরও দরজা খোলে না বউ। এখানে তেমন কাউকে চেনে না। একা একা বাইরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। হয়ত ওয়াশ রুমে। আমি অপেক্ষা করি। বেশ কিছুক্ষণ পর আওয়াজ আসে,

- কে ?

- আমি।

অমনি দরজা খুলে যায়। আমার ধারণাই ঠিক। ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে আছে বউ। মুখটা মোছার সময় পর্যন্ত পায়নি। মুক্তো দানার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় জমে আছে জল। আমাকে দেখেই খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে,

- ওমা, কী আশ্চর্য ! এত তাড়াতাড়ি চলে আসছ ? আমি ওয়াশ রুমে ছিলাম। তাই খুলতে একটু দেরি হল। ভালো করছ, তাড়াতাড়ি আসছ। আসো। ভেতরে আসো। আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

মুখে কথার খই ফুটছে । তার মানে মুড আজ খুব ভালো। আমি ওকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকি। ঢুকেই চমকে উঠি। ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার। ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। বউ দৌড়ে এসে একটা একটা করে ঢাকনা উঠায়। মিহিদানা স্টিমড পারসিয়ান রাইস, টমেটো গ্রেভি চিকেন, স্মোকি স্টেক কাবাব, সুইট এন্ড সাওয়ার ব্রিঞ্জেল, স্লাইস করে কাঁটা নান। সব ইরানি ডিশ। আমি অবাক কণ্ঠে জানতে চাই,

- ইরানি খাবার ? কেউ দিয়ে গেছে ?

- না।

- তাহলে কই পাইলা ?

- ঘরে রান্না হইছে।

- তুমি রান্না করছ ?

- না।

- তাহলে ?

- গেজ। আন্দাজ করো।

- আন্দাজ করতে পারছি না। তুমি বলো।

- আফসানেহ।

আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারি না। যে মেয়ে গত এক সপ্তাহ একবারও আমার সাথে দেখা করেনি, সেই মেয়ে আজ আমারই ঘরে বসে রান্না করেছে ? কোথায় বউকে সারপ্রাইজ দেবো বলে আগে ভাগেই চলে আসলাম। উল্টো সে আমাকে এমন সারপ্রাইজ দিল যে আমার মুখের কথাই হারিয়ে গেল। গোলবাহার বেওয়ার দেয়া রুটির কথা বলতেও ভুলে গেলাম।
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব ১৫




- কী ? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম ? তাজ্জব বনে গেছ না ?

বিস্ময়য়ের রেশ তখনও কাটেনি আমার। হজম করতে সময় লাগছে। প্রবাস জীবনে, বিশেষ করে এই প্রত্যান্ত গ্রামে, সহকর্মীদের সাথে, স্থানীয় মানুষদের সাথে, আমাদের অন্তরঙ্গতা বেড়ে উঠুক, একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক, আসা যাওয়া হোক, খাওয়া দাওয়া হোক, এটা আমিও চাই। তাই বলে আমার কলিগ হয়ে আমাকে সযত্নে এড়িয়ে চলবে, আবার আমার বাসায় এসে রান্না বান্না করবে, এ কেমন কথা ? নিজেকে কেমন অপমানিত মনে হয়। সর্দার আব্বাস রিগীর মেয়ে বলে যা খুশি তাই করবে ?

- কী ? তুমি দেখি পুরাই টাসকি খাইয়া গেছ ! হাতে কী ?

এতক্ষণে হাতে ধরা গোলবাহার বেওয়ার রুটির দিকে খেয়াল হয়। একদিকে সন্তান হারা এক বিধবা মায়ের স্নেহের হাতে তৈরি শুকনো রুটি, অন্যদিকে টেবিল ভর্তি আফসানের খেয়ালি হাতে রান্না বাহারি খাবার, দুটো বোধহয় এক সাথে যায় না। আমি রুটি ডাইনিং টেবিলে না রেখে সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বলি,

- রুটি।

অন্যদিন হলে এই রুটিই হয়ত বউয়ের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ বলে মনে হত। হাজার প্রশ্নে কান ঝালাপালা করে দিত। রসনা বিলাসী এত খাবারের সামনে এটা তার কাছে এখন নিছক ঝলসানো রুটি বলেই মনে হয়। কোনো কৌতূহল জাগায় না। তখনও সে টগবগ করে ফুটছে উত্তেজনায়।

- আফসানেহ ঠিকই কইছিল। মিবিনি, দকতোর বিস্তার তাজ্জব মিশে ( দেখে নিও, ডাক্তার খুব অবাক হবে)।

- বাহ, তোমার ফারসির তো বেশ উন্নতি হচ্ছে। তা, কোথায় তোমার সেই আফসানেহ ?

- চলে গেছে।

- মানে ?

- মানে তার বাসায় চলে গেছে।

- তুমি যেতে দিলা ? এত রান্না বান্না করল, খেয়ে যাবে না ?

- অনেক করে বলছিলাম থেকে যেতে। খেয়ে যেতে। কিছুতেই থাকল না। বলল, তোমাকে খুব লজ্জা পায়।

হাহ। লজ্জা পায় আমাকে ? তার লজ্জার বহর তো এক সপ্তাহ আগেই দেখেছি ! মনে মনে বলি। আফসানেহ দিনে দিনে আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। মানসিক বিকারগ্রস্থ নয় তো ? একটি মেয়ের মানসিক সমস্যার কারণে আরেকটি মেয়ের জীবনে ঝড় উঠুক, কোনো মতেই হতে দেয়া যাবে না। আমি সাবধানে প্রশ্ন করি,

- আমাকে লজ্জা পাবার কী আছে ?

- আমিও তো সেই কথাই বলছিলাম, তোমরা এক সাথে কাজ করো, লজ্জা পাবা কেন ?

- কী উত্তর দিল ?

- বলল, সে তোমার সাথে কাজ করে না। একা একা কাজ করে। গত এক সপ্তায় নাকি তোমার সাথে একদিনও দেখা হয়নি ?

দেখা হয়নি নাকি দেখা করেনি ? মনে মনে বলি। মুখে বলি,

- হুম। ওর কাজের ক্ষেত্র আলাদা। তা, আজ হঠাৎ রান্না করতে আসল কেন ?

- হঠাৎ না। আমিই বলছিলাম।

- তুমি ? কেন ?

- না, মানে, সেই রাতে দেখলাম, তুমি ইরানি খাবার খুব তৃপ্তি নিয়া খাচ্ছ। তাই আমি আফসানেহকে বলছিলাম, ডাক্তার তোমার রান্না খুব পছন্দ করছে, আমারেও শিখায়ে দিও।

আব্বাসাবাদ থেকে যে খবার দিয়েছিল, সেই বিকেলে বউকে খাইয়ে দেয়ার পরও অনেক বেঁচে গিয়েছিল। রাতেও দুজনের ভরপুর হয়ে গিয়েছে। খাবার খুব ভালো লাগলেও বউকে তো কিছু বলিনি! আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকাই। সব বউরাই কী এমন ? স্বামীর খুটিনাটি পছন্দ অপছন্দের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে ? নাকি এই মেয়েটিই ব্যতিক্রম ? নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়। কিন্তু কখন বলল সে আফসানেকে ? বউয়ের সাথে কি তার নিয়মিত দেখা হয় ? নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করি,

- কোথায় দেখা হল তার সাথে ?

- কেন ? ও তো প্রায়ই বাসায় আসে।

- প্রায়ই মানে ?

- প্রায়ই মানে, যেদিন যেদিন তুমি সাইয়ারিতে যাও, সেদিন সেদিন। অনেকক্ষণ থাকে আমার কাছে। অনেক গল্প হয় দুজনে। আমার সময়টা ভালো কেটে যায়। কেন ? ও বাসায় আসে তুমি পছন্দ করো না ?

কেমন খটকা লাগে। এই যে এই সহজ সরল মেয়েটি, বাইরে থেকে ফিরলে সারাদিনের সব ঘটনা দাঁড়ি কমা সহ বর্ণনা করে, অথচ আফসানের কথা এত দিন চেপে গেল ? কেন ? জিজ্ঞেস করি,

- কই, আমাকে তো এ কথা আগে বলনি ?

- আরে বোকা, আগে বললে আর সারপ্রাইজ থাকতো কোথায় ? আমরা দুজন মিলেই তো সারপ্রাইজ প্লান করেছি। হয়েছে। আর জেরা করতে হবে না। ফ্রেস হয়ে আসো। খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা এত কষ্ট করে রান্না করেছে !

কথায় বলে, পুরুষ মানুষের রসনা তৃপ্ত হলে মনও শান্ত হয়ে যায়। আসলেই আফসানের রান্নার হাত খুব ভালো। খেতে খেতে আমার মন শান্ত হয়ে যায়। হাসতে হাসতে জানতে চাই,

- সে যে তোমার সাথে এত আড্ডা মারে, তার কাজ কাম নাই ? স্বামী সংসার নাই ?

- ওমা, তুমি জানো না ? আফসানেহ তো বিয়াই করে নাই।

শুইনা এইবার সত্যি সত্যি টাসকি খাইয়া গেলাম। কোথায় ভাইবা বইসা রইছি, এই বালুচি মাইয়া নিশ্চয়ই এত দিনে দুই তিনটা পোলাপাইনের মা হইয়া গেছে, এখন শুনতাছি বিয়াই করে নাই ! বিষম খেতে খেতে কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করি,

- বলো কী ? কেন ?

- আমিও খুব অবাক হইছিলাম। বিয়ের কথা শুনতেও পারে না। পুরুষ মানুষ দেখলেই নাকি ওর গা ঘিনঘিন করে। সেই জন্যই তো লেখা পড়া শিখে চাকরি নিছে, যাতে কোনো পুরুষ মানুষের অধীনে থাকতে না হয়।

এ কথা শুনে কতটা অবাক হয়েছিল বউ, জানি না। তবে আমার বিস্ময় ঘরের ছাঁদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, চাকরী বাকরি করবে, অর্থনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভরশীল হবে, আমিও খুব করে চাই। তাই বলে নারী পুরুষের একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ থাকবে না ? এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। একমাত্র শারীরিক কিংবা মানসিক বৈকল্য ছাড়া এ নিয়মের ব্যত্যয় হবার তো কথা না। যে দুবার আফসানের সাথে আমার দেখা হয়েছে, যতটুকু ওকে দেখেছি, যতটুকু বুঝেছি, শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো বৈকল্য নজরে আসেনি। তার দৃষ্টিতে আর যাই থাক, ঘৃণা যে ছিল না, সে আমি হলফ করে বলতে পারি। এ কেমন কুহেলিকা ? আরও তথ্য নেয়ার জন্য জিজ্ঞেস করি,

- তুমি জানতে চাইলে না, কেন ?

- চাইছিলাম। হঠাৎ খুব রেগে গেল। বলল, খানম দকতোর, বিয়া নিয়া কথা বললে তোমার কাছে আর আসব না। তারপর থেকে আর শুনতে চাই নাই। কী দরকার ? এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তয় মেয়েটার জন্য খুব মায়া হয়। কী মিষ্টি চেহারা। অথচ একা একা থাকে।

- একা একা থাকে ?

- না, ঠিক একা না। সাথে ওর এক খালে (খালা) আর একজন কানিজ (দাসী) থাকে।

একা থাকুক আর দোকাই থাকুক, তাতে আমার কী ? ক'দিনই বা থাকব ? কন্ট্রাক্টের চাকরি। কন্ট্রাক্ট শেষ, চাকরী শেষ। সে তার কাজ করুক, আমি আমার কাজ। আমার অবর্তমানে যদি বাসায় আসে, আমার বউয়ের সাথে গল্প করে, ফারসি শেখায়, রান্না শেখায়, তাতে আমার তো কোনো ক্ষতি নাই। শুধু কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম না দিলেই হয়। আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলি,

- ও! ঠিক আছে। আবার এলে বলো, রান্না খুব ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি।

- আচ্ছা, বলব। রান্নাগুলো আমি শিখে নিছি। এখন থেকে আমিই রেঁধে খাওয়াতে পারব।

সেদিন অনেক রাত অবধি আমার ঘুম আসে না। " গা ঘিনঘিন করে" শব্দ তিনটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কোনো মতেই তাড়াতে পারি না। আফসানের নিটোল মুখটা মনে পড়ে। মনে পড়ে ওর দিঘল কালো চোখ। সে চোখে খুশি দেখেছি, কষ্ট দেখেছি, অভিমান দেখেছি, রাগ দেখেছি। একটু অনুরাগও কি দেখিনি ? হয়ত ! কিন্তু গা ঘিনঘিন করা ঘৃণা ? মনে পড়ে না। নাকি আমি মানুষের চোখের দৃষ্টি চিনতে পারি না ? আমার কেন জানি মনে হয়, আফসানের জীবন ঘিরে একটা রহস্য আছে। এমন কিছু, যেটা সে গোপন করতে চায় ? সেই জন্যই কি সবাই ওর ব্যাপারে মুখ বন্ধ করে রাখে ? কী সেটা ? জানতে পারলে ভালো হত। আর তখনই বিবেক চোখ রাঙ্গায়। ডাক্তার সাহেব, উৎসাহে লাগাম দাও। অতি কৌতূহল ভালো নয়। অন্যের জীবনের রহস্য জেনে তোমার কী লাভ ? ডাক্তারি করতে এসেছ, ডাক্তারি করো। অন্যের চরকায় তেল দিতে যেও না। পরিণাম ভালো নাও হতে পারে। বিবেকের শাসন মেনে নিয়ে শান্ত ছেলে হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। কোনো কাজের তাড়া নেই। তবু কেন জানি না, খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। বাইরে সকালের আলো ফুটেছে। তবে সূর্য মামা এখনও পাহাড়ের আড়াল থেকে বের হননি। বাতাসে একটা হিমহিম ঠাণ্ডা ভাব। বউ তখনও বাচ্চা মানুষের মতো হাত পা কুঁকড়ে ঘুমুচ্ছে। মুখটা নিষ্পাপ, হাসিহাসি। আহা, ঘুমাক বেচারি। এই পৃথিবীতে ঘুমের চাইতে শান্তির আর কী আছে ? একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার আর ঘুম আসে না। ভাবলাম, রোদ তাতার আগে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে মেখে আসি। আমি আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ি।

বাইরে বের হতেই দেখি দরজার সামনে একটা ভেড়ার বাচ্চা বাঁধা। থেকে থেকে ম্যা ম্যা করছে। এই সাত সকালে আমার ঘরের সামনে ভেড়া চরাতে এলো কে ? ব্যাটা ভেড়া চরাবি, চরা, তাই বলে আমার ঘরের সামনে চরাবি ? মেজাজটা বিগড়ে গেল ! কেফাতুল্লার ঘরের কাছে যেয়ে দেখি, দরজা বন্ধ। নিশ্চয়ই কিশোরী বউ নিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। দারমাঙ্গার মেইন গেট হাট করে খোলা। অবশ্য সব সময় খোলাই থাকে। চোর ছ্যাঁচোরের উপদ্রপ নেই এখানে। তাই বলে তুই খেয়াল রাখবি না ? কে এলো, কে গেল, দেখবি না ? তুই না এখানকার সুরাইদার (কেয়ার টেকার) ? আমি কেফাতুল্লাহ, কেফাতুল্লাহ, বলে হাঁক ছাড়ি।

একটু পরে চোখ ডলতে ডলতে বাইরে আসে কেফাতুল্লাহ। এত সকালে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। বলে,

- ছোব বে খায়ের (শুভ সকাল) দকতোর। হালে শোমা খুবে ? কোনো অসুবিধা ?

- অসুবিধাই তো ! তুমি এদিকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছ, ওদিকে কে যেন আমার ঘরের সামনে একটা ভেড়ার বাচ্চা বেঁধে রেখে গেছে। ভেড়ার বাচ্চার মতো আমাকে তুলে নিয়ে গেলেও তো তুমি টের পেতে না।

- কী যে বলো দকতোর। মানুষ রোগে পড়লে আগে আসমানের খোদাকে স্মরণ করে। তারপর জমিনে তোমকে স্মরণ করে। তোমার ক্ষতি করার কথা কেউ স্বপ্নেও চিন্তা করে না।

- থাক। আর তোষামোদ করতে হবে না। দেখো কার ভেড়া। তাকে নিয়ে যেতে বলো। আর কেউ যেন দারমাঙ্গায় ভেড়া না চরায়, সেদিকে খেয়াল রেখো।

- চাশত দকতোর।

ঘণ্টা দুই পরে কেফাতুল্লাহ খবর নিয়ে এলো, আব্বাস রিগী ফিরে এসেছে। এসে শুনেছে, ডাক্তারের আপ্যায়ন ভালো মতো হয়নি। তাই রাতের অন্ধকারে এক চেলাকে দিয়ে কাফফারা হিসাবে ভেড়ার বাচ্চাটা পাঠিয়ে দিয়েছে। শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। এ দেখি আফসানের চাইতেও এক কাঠি বাড়া ! এতো খাইয়েও মন ভরেনি, পাঠিয়েছে কাফফারা ? অবাক কণ্ঠে জানতে চাই,

- কিন্তু রাতের অন্ধকারে কেন ?

- যাতে তোমার মুখোমুখি না হতে হয়।

- আমার মুখোমুখি হলে ক্ষতি কী ?

- যদি তুমি কবুল না করো ! তাই চুপি চুপি রেখে গেছে।

পাঠানদের মেহমান নওয়াজীর অনেক গল্প শুনেছি। ইতোমধ্যেই তার অনেক নজিরও পেয়েছি। কিন্তু এ তো সব ছাড়িয়ে গেল !

এখানে আসার দু'দিন পরের কথা। কে যেন ঘরের সামনে এক কার্টুন আঙ্গুর রেখে গেল! বাংলাদেশে থাকতে বড় জোর আধা পোয়া, এক পোয়া আঙ্গুর কিনেছি। এক সাথে এত আঙ্গুর কেনা তো দূরের কথা, চোখেও দেখিনি। দারমাঙ্গার সবাইকে বিলিয়ে যা ছিল, তার অর্ধেকও দুজন শেষ করতে পারিনি। বউ সে গুলোকে রোদে শুকোতে দিয়েছে। কিসমিস বানাবে। এই তো দু'দিন আগের কথা। বিকেলে রুগী পত্র নেই তেমন। দাদ মোহাম্মদ এসে জানতে চাইল,

- দকতোর, তাফরি মিকুনি (ডাক্তার, ঘুরতে যাবে) ?

- কোথায় ?

- চলো, তোমাকে গ্রাম দেখিয়ে আনি।

- বেশ তো। খানম দকতোরকেও সঙ্গে নিয়ে যাই চলো।

বউ সহ গাড়ি নিয়ে তাফরি করতে বেরুলাম। ঘুরতে ঘুরতে এক বিশাল তরমুজ ক্ষেত পড়ল। বাগানের ফল, ক্ষেতের সবজি, এ সব দেখলে আবার বউয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামতেই সারা ক্ষেতে বাচ্চা মেয়ের মতো ছুটাছুটি শুরু করল। গাছ,পাতা, ফুল, ফল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। বেশ কিছুটা দূরে ক্ষেতের মালিক তরমুজ তুলছিল। আমাদের দেখে দৌড়ে এলো। কুশল বিনিময়ের পর বউয়ের কাছে জানতে চাইল,

- খানম দকতোর, খারবাজে দুস্ত দারি (খানম ডাক্তার, তরমুজ পছন্দ করো) ?

- বালে, খাইলি দুস্ত দারাম (হ্যাঁ, খুব পছন্দ করি)।

- এক কম লুফত মিকুনি ? ( দয়া করে একটু নেবে) ?

- খায়েশ মিকুনাম আগাজুন।

"খায়েশ মিকুনাম" শব্দ দুটা এরা অনেক অর্থেই ব্যবহার করে। এখানে "কী দরকার ছিল ?" জাতীয় বুঝায়। দেখলাম, আফসানের কাছ থেকে ভালোই ফারসি বলতে শিখেছে বউ। গরমের দিনে দু একটা তরমুজ হলে মন্দ কী ? দাম দিতে গেলে তো অপমানিত বোধ করবে। তাই সে চেষ্টা আর করলাম না। দাদ মোহাম্মদ গাড়ি নিয়ে গেল সেই দিকে, যেখানে তরমুজ তুলে জমা করে রাখা হচ্ছিল। আর আমরা দুজন ক্ষেতের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

ল্যান্ড রোভার জীপটা নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়টা তরমুজ জীপে তুলে দিয়েছে, খেয়াল করিনি। দারমাঙ্গায় ফিরে তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। হায় হায়, করেছে কী ? গাড়ির পিছনের অর্ধেকটা তরমুজ দিয়ে ভরে দিয়েছে। গোটা ত্রিশেক তো হবেই। বেচার গরীব মানুষ, এই তরমুজ বেচেই হয়ত সংসার চলে ! সব রাগ যেয়ে পড়ল দাদ মোহাম্মদের উপর।

- দাদ মোহাম্মদ, এত গুলো তরমুজ এনেছ কেন ? এখন কি আমি তরমুজের দোকান খুলে বসব ?

- আমি আনিনি দকতোর। জোর করে তুলে দিল।

- তুমি নিষেধ করতে পারলে না ?

- আমার নিষেধ শুনবে কেন ? বালুচরা যাকে দেয়, এভাবেই দেয়।

একটু গর্বের সাথেই বলল দাদ মোহাম্মদ। এ কথার কী জবাব দেব ? এতদিনে বুঝে গেছি, ওদের ধরে নিয়ে আসতে বললে বেঁধে নিয়ে আসে। শেষে এই তরমুজও সবার মাঝে বিলি করে দিলাম।

ক্ষেতে ফলানো আঙ্গুর, তরমুজ, ডাক্তারকে নজরানা দিয়েছে, ঠিক আছে। তাই বলে ঠিকমত আপ্যায়ন করা হয়নি বলে একটা জ্যান্ত ভেড়া পাঠিয়ে দেবে ? তাও আবার গোপনে ? আগামী সপ্তাহেই তো আব্বাসাবাদ যাব। তখন ভেড়া মেরে খাওয়ালেই তো পারত ! এই আতিথেয়তার কী নাম দেব আমি ? খুব ছোটবেলায় দান নিয়ে একটা কবিতা পড়েছিলাম। নবান্নে নতুন ধান উঠলে বড় ভাই রাতের আঁধারে চার আঁটি ধান গোপনে ছোট ভাইয়ের পালায় রেখে আসল। ছোট ভাইও চার আঁটি ধান একই ভাবে বড় ভাইয়ের পালায় রেখে দিল। কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। হাদিসে পড়েছি, দান এমন ভাবে করতে হয় যেন ডান হাত দিলে বাম হাত টের না পায়। অথচ আমরা দান খয়রাত করতে গেলে আগে ঢাক ঢোল পিটিয়ে তা প্রচার করি। ইসলামের শিক্ষা বোধের অভাবে কী ভাবে বদলে যায় !

কেফাতুল্লাহকে বললাম, ভেড়াটা জবাই করে সবার মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে দাও। আর হ্যাঁ, আফসানেহকেও দিও। শুনে চমকে ওঠে কেফাতুল্লাহ। ওর চেহারায় পরিষ্কার সম্ভ্রমের ভাব ফুটে ওঠে। হাত কচলাতে কচলাতে বলে,

- খানম রিগী তো ছুটিতে ।

ছুটিতে ? সেদিন রান্না করে যাওয়ার পর থেকে আফসানেহ আবশ্য আর বাসায় আসেনি। দারমাঙ্গায় আমার সাথে এমনিতেও দেখা হয় না। তাই বলে ছুটিতে যাবার আগে একবার জানিয়ে যাবে না ? আমাকে না বলুক, তার খাওয়াহার, খানম দকতোরকে তো বলে যেতে পারত ! এটাকে আফসানের অভদ্রতা বলব নাকি অহমিকা বলব, ঠিক বুঝতে পারি না। বিরক্ত কণ্ঠে বলি,

- বেশ তো। তোমার কাছে রেখে দাও। ফিরে এলে দিও।

- কী বলছ দকতোর ? ওর বাবার দেয়া হাদিয়া। এর ভাগ কিছুতেই সে নেবে না।

শুনে তেমন অবাক হই না। এদের কর্মকাণ্ড দেখে দেখে অবাক হতেও যেন ভুলে গেছি !

এমনিতেই দারমাঙ্গায় রুগী আসা কমে গেছে। আজ আরও কম। সাকুল্যে জন পনেরো। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই দেখা শেষ হয়ে যায়। ভাবছি, বাসায় যাব। রুগী এলে কেফাতুল্লাহ খবর দেবে। এমন সময় বাইরে গাড়ির শব্দ। বোধহয় রুগী এসেছে। পাহাড়ি এলাকায় অনেকেরই গাড়ি আছে। অধিকাংশই পিক আপ জাতীয়। সামনে যাত্রী, পিছনে মালামাল বহন করে। আমি রুগীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কয়েক মিনিট পর দরজা দিয়ে যে প্রবেশ করল, তাকে অন্তত এই সময় এখানে আশা করিনি।
 
ইরানি দাস্তান
পর্ব ১৬








শাহ বাখশ আমিরি। বেহদারি খাস (খাসের স্বাস্থ্য বিভাগ) এর ডেপুটি চীফ। জাবুলি ডাক্তার। খুব কড়া আর "খাইশটা" বলে নামডাক তার। লক্ষ লক্ষ তোমান কামাই করে নিয়ে যায় বলে বিদেশী ডাক্তারদের উপর তিনি বড়ই নাখোশ। বিদেশীরাও তারে দু'চোখে দেখতে পারে না। আলু সেদ্ধ করা এই গরমের মধ্যেও কোট প্যান্ট পরে গটগট করে আমার রুমে ঢুকলেন। সাথে আরও দু'জন খয়েরখাঁ। কতক্ষণ "হালে শোমা, হালে শোমা" মার্কা কুশল বিনিময়ের পর যে যার আসন গ্রহণ করলাম। একটু অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

- কী ব্যাপার অগাই আমিরি ? এই অজ পাড়াগাঁয়ে হঠাৎ কী মনে করে ?

- হে হে হে। কী যে বলো দকতোর ! তোমার খোঁজ খবর রাখা আমার দায়িত্ব না ? তুমি হলে আমার দেশের মেহমান। নতুন দারমাঙ্গায় এসেছ। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, মানিয়ে নিতে পারছ কিনা, দেখতে আসব না ?

ভাবে গদগদ কণ্ঠে বলল শাহ বাখশ। যেন ডাক্তারের চিন্তায় তার ঘুম হারাম হবার জোগাড়। আমি চোখ সরু করে তাকাই। ব্যাটার ধান্দাটা কী, বোঝার চেষ্টা করি। সে যে তাফরি করতে এই বিয়াবানে (মরুভূমিতে) আসে নাই, সেটা নিশ্চিত। আমিও দাঁত কেলিয়ে বললাম,

- দারমাঙ্গা কী বলছ শাহ বাখশ ? এটা তো মনে হচ্ছে আমার শ্বশুর বাড়ি। রীতিমত জামাই আদরে আছি। গুহারকুর মানুষেরা আমাকে খুবই ভালোবাসে।

- হে হে হে, বাসতেই হবে, বাসতেই হবে। তুমি যে মানুষটাই এমন। তা রুগী পত্র কেমন ?

ও আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার ? নালিশটা পৌঁছাইয়া গেছে ? পৌঁছাবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে ভাবিনি। আমি তো ভুইলাই গেছিলাম, এখানে তার চামচিকা, কম্পাউন্ডার খারকুই আছে ! আমার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। মনে মনে বলি, হুহু, বাছা, ঘুঘু দেখছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখো নাই। এইবার বুঝবা ঠ্যালা, কারে কয় বরিশাইল্যা পোলা। আমি আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। গোবেচারা ভাব নিয়ে বলি,

- এই যখন যেমন অগাই আমিরি।

- আজ তো দেখি অনেক কম।

- হুম। আজ একটু কম।

- সাধারণত প্রতিদিন কতজন রুগী দেখো দারমাঙ্গায় ?

- এই বিশ ত্রিশ জন।

- বলো কী ? আগের দকতোর তো একশোর উপরে রুগী দেখত !

- আমিও তাই শুনেছি।

- তাহলে তোমার রুগী এত কম কেন ?

আমি একটু চোখ ত্যাড়া করে শাহ বখশকে দেখি। তার চেহারায় রীতিমত বিরক্তি। বিড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে আগে একটু খেলে, তার পর বধ করে, আমিও তেমন শাহ বাখশকে নিয়ে একটু খেলতে চাইলাম,

- আমি আসার পরে রোগশোক মনে হয় সব এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে শাহ বাখশ। মানুষ জন সব সুস্থ্য সবল জীবন যাপন করছে।

- শোমা কী মেছলে সুখী মিকুনি দকতোর ? ( তুমি কি আমার সাথে কৌতুক করছ ডাক্তার?)

গলা চড়ে যায় শাহ বাখশ আমিরির। তার কৃত্রিম আন্তরিকতার মুখোশ খসে পড়তে চায়। দেখে মজা লাগে আমার। তবে মুখের নির্বিকার ভাবটা বজায় রেখে বলি,

- মাথা খারাপ ? তোমার সাথে করব কৌতুক ? এমন সাহস আছে আমার? এসো, বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও।

- কী প্রশ্ন ?

- আমার চিকিৎসায় কারও ক্ষতি হয়েছে কিংবা অসুখ ভালো হয়নি, এমন কোনো রিপোর্ট আছে তোমার কাছে?

- না।

- কোনো রুগী আমার এলাকা থেকে পার্শ্ববর্তী দারমাঙ্গায় যেয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে, এমন কোনো তথ্য আছে ?

- না।

- তোমার কি মনে হয়, গুহারকুর মানুষ এতই ভালো যে অসুস্থ হয়ে ঘরে বসে কাতরাচ্ছে, কিন্তু ডাক্তারের কাছে আসছে না ?

বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে প্রতাপশালী নায়েবে রইসকে ! কোথায় সে ডাক্তারকে জেরা করবে ভেবেছিল, উল্টো তাকেই জেরা করা হচ্ছে ? কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায় ভঙ্গীতে বলে,

- না, তা মনে হয় না।

- গুড। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো ?

- কী ?

- রুগীরা সব ভালো আছে। তান দুরস্ত আছে !

- কিন্তু আমি তো শুনেছি, তুমি মাত্র ছয়টা প্যারাসিটামল লেখো, তাই রুগীরা তোমার কাছে আসে না।

- তাতে তো তোমার আরও খুশি হওয়ার কথা। আমি তো শুনেছি, তুমি নিজেও একজন ডাক্তার। নিশ্চয়ই জানো, বিনা প্রয়োজনে ওষুধ খেলে ক্ষতি হয়। আবার সেই ওষুধ না খেয়ে ঘরে ফেলে রাখলে সরকারের পয়সার অপচয় হয়। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ না লিখে আমি তো তোমার দেশ ও দেশের মানুষের উপকার করছি। তাছাড়া, আমি টুয়েন্টি ফোর সেভেন, এভেইলেবল। যদি কেউ অভিযোগ করে যে ডাক্তার দেখাতে এসে আমাকে পায়নি, আমার উপর ভক্তি হারিয়ে অন্য এলাকায় চিকিৎসা করাতে গেছে, আমার চিকিৎসায় কারও ক্ষতি হয়েছে কিংবা রোগ ভালো হয়নি, সেদিন তদন্ত করতে এসো।

শাহ বাখশ আমিরির মুখটা দেখার মতো হয়। হা হয়ে গেছে ! মনে হচ্ছে একটা চড়ুই পাখি অনায়াসে ফুড়ুৎ করে মুখের ভিতরে ঢুকে ডিম পাড়তে পারবে। দু'চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নতুন ডাক্তারকে এক হাত দেখে নেবে ভেবেছিল, উল্টো দশ হাত খেয়ে গেল ! এমনটা হবে, বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেন নি। খারকুইয়ের দেয়া চা নাস্তা খেয়ে বিদেয় হলেন।

আব্বাসাবাদে যাচ্ছি। বুকের মধ্যে এক কৌতূহলী পাখি ছটফট করছে। আজ হয়ত আব্বাস রিগীর সাথে দেখা হবে। যার দাপটে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়। যার ভয়ে পাহাড়, গাছপালা, মানুষ, পশু কাঁপে থরথরিয়ে। সেই মানুষটাই আবার গোপনে উপঢৌকন পাঠিয়ে আমাকে অশেষ সম্মানে সম্মানিত করে। সেই সাথে একটা অস্বস্তিও কাজ করছে। আফসানেহ নিশ্চয়ই এখন আব্বাসাবাদে। এতদিন সে আমার মুখোমুখি হয়নি। এখন আমারই তার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। যা খামখেয়ালী মেয়ে, না জানি আব্বাস রিগীর সামনেই কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসে !

কিন্তু আব্বাসাবাদে পৌঁছেই মনটা কেমন করে উঠল। যেন ঘুমিয়ে আছে উপত্যকাটা। নেই তেমন প্রাণের সাড়া। মানুষ জন কম। তবে কি আজও সর্দার তাঁর খিমায় (তাঁবুতে) নেই ? তিন দিন আগেই তো গুছফান্দ পাঠালেন ! আজও হাজী আহম্মদ রিগী অভ্যর্থনা জানিয়ে খিমায় বসালেন। আজও আহবাব রিগী যথারীতি সোবহানে নিয়ে এলো। ফলমূল, রুটি মাখন, চা পানি, কমতি নেই কিছুরই।

আমি আহম্মদ রিগীর কাছে জানতে চাইলাম,

- হাজী আগা, শুনেছি, সর্দার ফিরে এসেছেন। খিমায় নেই ?

- না। হঠাৎ করেই একটা বিশেষ কাজে তাকে মাশহাদ যেতে হয়েছে। তাই তোমার খেদমতে হাজির থাকতে পারেনি। আব্বাস খাইলি শরমিন্দা হাস্ত (আব্বাস খুবই লজ্জিত)। দরবারে শোমা বাখশ আর্জ মিকুনাদ (তোমার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে)।

নারী যেমন সুন্দর হয়ে ওঠে, প্রসাধনীতে, গহনায়, আভরণে। কথাও তেমন সুন্দর হয়ে ওঠে বাচন ভঙ্গিতে, বিনয়ে, ভাষার অলঙ্করণে। ইরানিদের কথা আমি যতই শুনি, ততই মুগ্ধ হই।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়, আজ আব্বাস রিগী থাকতে পারবেন না বলেই হয়ত সেদিন গুছফান্দ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তা নিয়ে এখানে একটা কথাও বলল না কেউ। হঠাৎ মনে মনে প্রমাদ গুনি। খিমায় সর্দার নেই। তার মানে আজও আমাকে সর্দার কন্যার মর্জি অধীনেই থাকতে হবে ! আমি কৌশলে সোবহানে কম খাই, যাতে নাহার পেট পুরে খেতে পারি। নইলে আফসানেহ আজ কোন অঘটন ঘটাবে কে জানে ?

আজও পাহাড় থেকে, আশেপাশের লোকালয় হতে, রুগীরা চলে আসে। তবে আগের দিনের মত নয়। অনেক কম। বেশ তাড়াতাড়িই দেখা শেষ হয়ে যায়। দাদ মোহাম্মদ এসে বলে,

- বিয়া, বিরিম দকতোর। (চলো, যাই ডাক্তার)।

মানে কী ? অবাক চোখে দাদ মোহাম্মদের দিকে তাকাই। আজ নাহার নাই ? তার মানে কি আফসানেহ খিমায় নাই ? ছুটি নিয়া তবে গেল কই? এ কথা দাদ মোহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। এমন অহেতুক কৌতূহল আমাকে মানায় না।

সোবহানেও ঠিকমত খাইলাম না। নাহারও পাইলাম না। নিজের পাতা ফান্দে নিজেই ধরা খাইয়া গেলাম ? তয় আফসোস নাই। আফসানের মুখোমুখি যে হইতে হইল না, এইটাই বা কম কিসে ? এক ধরণের স্বস্তি নিয়ে গাড়িতে উঠি।

ফেরার পথেই গোলবাহার বেওয়ার খিমা পড়ে। আমার মুখে, চোখে এখনও তার স্নেহের ছোঁয়া লেগে আছে। এখনও চোখে ভাসছে তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টি । কেন জানি মনে হয়, সন্তান হারা সেই বেওয়াকে একবার দেখে যাই। কে জানে, আমায় দেখে হয়ত অতৃপ্ত মায়ের মন একটু হলেও শান্তি পাবে। সেই সাথে গত সপ্তায় দেখা রুগীটির ফলো আপও হয়ে যাবে। দাদ মোহাম্মদকে গাড়ি সেখানে নিয়ে যেতে বলি।

দেখি, বৃদ্ধ তাঁবুর সামনে খাটিয়ায় বসে বিড়ি ফুঁকছে। তার মানে ওষুধ কাজ করেছে। নিষেধ করে লাভ নেই। এখানে ছেলে বুড়ো প্রায় সবাই সিগারেট খায়। এমনকি মহিলাদেরও দেখেছি, ঠোঁটের নীচে খৈনি গুঁজতে কিংবা ফুকফুক করে বিড়ি ফুঁকতে। গোলবাহার বেওয়ার খোঁজে এদিক ওদিক তাকাই। কোথাও দেখা যায় না। শেষে দাদ মোহাম্মদকে তার তাঁবু দেখিয়ে দিতে বলি। দাদ মোহাম্মদ আঙ্গুল তুলে দূরে একটা তাঁবু দেখিয়ে দেয়। ওদেরকে অপেক্ষা করতে বলে আমি সেদিকে এগিয়ে যাই।

একটা জরাজীর্ণ তাঁবুর সামনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে গোলবাহার বেওয়া। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে দূর পাহাড়ের দিকে। আমার আগমন সে টের পায় না। নিঃশব্দ পায়ে খুব কাছে চলে যাই। মুখটা কষ্ট কাতর। সে মুখে শুকিয়ে আছে পানির দাগ। হয়ত কেঁদেছে একটু আগে। কার কথা ভেবে ? স্বামীর নাকি সন্তানের ? আমি বুঝতে পারি না। নিঃসঙ্গ এই মানুষটার জন্য বুকের ভেতরটা কেমন টনটন করে ওঠে। আস্তে করে বলি,

- সালাম, খানম। হালে শোমা খুবে ?

ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায় গোলবাহার বেওয়া। হঠাৎ আমাকে এই সময় এখানে দেখবে, হয়ত আশা করেনি। অবাক কণ্ঠে বলে,

- আলেকুম সালাম দকতোর। তুমি এখানে ?

- এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাকে একবার দেখে যাই।

- মেহেরবানে শোমা অগাই দকতোর (তোমার দয়া ডাক্তার সাহেব)। বেওয়াদের আর থাকা ! কোনোমতে বয়ে চলা। তাঁর ডাকের অপেক্ষায় আছি।

আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলল গোলবাহার বেওয়া। লক্ষ্য করলাম, আজ সে আমাকে দকতোর বলে সম্বোধন করছে। পেছার বলে ডাকছে না। হয়ত মনটা আজ খুবই খারাপ। হয়ত ভাবছে, এই বিদেশি ডাক্তারকে সন্তান ভেবে আর মায়া বাড়িয়ে কী হবে ? মনটা কেমন করে ওঠে। বলি,

- ইনতুরি না গু মাদারজুন ( মাগো, এ ভাবে বোলো না)।

কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকে বেওয়া। ধীরে ধীরে দু'চোখে জেগে ওঠে মমতা। একটা ম্লান হাসি ফুটে ওঠে শুকনো ঠোঁটে। একটু হতাশ কণ্ঠে বলে,

- কেন মিছেমিছি মায়া বাড়াচ্ছ দকতোর ? বেশি মায়া আমার কপালে সয় না।

- কেন মিছেমিছি আমার দোষ দিচ্ছ বেওয়া ? তুমিই তো আগে পেছার ডাকলে। রুটি ঘুষ দিলে। সেই ঘুষের লোভে ছেলে আবার এসে পড়লে আমাকে দোষ দিতে পারো না।

বলে আমি শব্দ করে হেসে উঠি। সে হাসি সংক্রামিত হয় গোলবাহার বেওয়ার মুখে। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চোখের তারা। খুশি খুশি গলায় জানতে চায়,

- রুটি কেমন ছিল দকতোর ? সত্যি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে ?

হঠাৎ আমার মুখে কথা থেমে যায়। সেদিন আফসানের রকমারি খাবারের ভিড়ে বেওয়ার দেয়া রুটি সাইড টেবিলেই পড়ে ছিল। পরদিন দেখি, শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আর খাওয়া হয়নি। এক পৃথিবী আগ্রহ নিয়ে একজন মা চেয়ে আছে একজন ছেলের দিকে। জানতে চাইছে কেমন ছিল তার মমতা মাখানো রুটি। আমি কেমন করে বলি, মাগো, তোমার স্নেহের দান শুকিয়ে গেছে অবহেলায়। কোনো মতেই এমন সত্য বলে তার বুক ভেঙ্গে দিতে পারব না আমি। অবলীলায় মিথ্যা বলি,

- খাইলি খোশমজ্জে বুঁদ মাদারজুন। দিগের হাস্ত ? ( আরও আছে ?)

মায়ের হাতের রান্না খেয়ে, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ছেলে যখন বলে, মাগো, আর একটু হবে ? মায়ের মুখে তখন যে খুশির বন্যা বয়ে যায়, আমি এই বৃদ্ধ বিধবার মুখে সেই খুশির বন্যা দেখতে পাই। একটু অপ্রস্তুত মুখে বেওয়া বলে,

- আজ তো রুটি বানাইনি বাছা। কাল বানিয়েছিলাম। সপ্তায় দু'দিন বানাই। বাসী রুটি আছে। নেবে ?

এরা যে চুল্লীতে রুটি বানায়, তা গরম করতে অনেক সময় লাগে, অনেক জ্বালানী খরচ হয়। তাই প্রতিদিন রুটি বানায় না। একদিন বানায়, তিন চারদিন খায়। যে রুটি সে নিজের জন্য রেখে দিয়েছে, আমাকে দিতে গেলে তাতে টান পড়ে যাবে। আবার হয়ত চুল্লি ধরাতে হবে। অথচ, না খেয়েও ভালো হয়েছে, এই মিথ্যে বলার গ্লানি তখনও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হঠাৎ করেই বলে ফেলি,

- না, নেব না। আজ তোমার সামনে বসে খাবো। খাওয়াবে আমাকে ?

কথাটা বিশ্বাস করতে একটু সময় লাগে বেওয়ার। পরোক্ষণেই বেশক, বেশক, বলে হাত ইশারায় দূরে গাড়ির কাছে দাঁড়ানো দাদ মোহাম্মদ ও খারকুইকে ডাক দেয়। তারপর ছুটে তাঁবুর ভেতরে চলে যায়। ভেতরে ছোপ ছোপ দৈন্যতার ছাপ। এখানে সেখানে ছিদ্র হয়ে গেছে ছাঁদ। সে ছিদ্র গলে ঢুকে পড়েছে দুপুরের রোদ। দিনের বেলায়ও আলো আধারির খেলা। এক পাশে এক পুরনো ফরাস ফেলা। গোটাকয় ময়লা তাকিয়া পড়ে আছে অবহেলায়। আমি ও খারকুই সেই ফরাসে আসন পাতি। দাদ মোহাম্মদ বেওয়ার কাজে হাত লাগায়। ছোফরে পড়ে। তাতে গোটা তিনেক বাসি রুটি। আসে মাখন, আসে শুকনো খেজুর, একটা গোটা তরমুজ। সামোভারে চায়ের পানি বসে।

বহুদিন পর ছেলে ফিরে এলে মায়ের ভেতর যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়, বেওয়ার ভেতর এখন সেই প্রাণের জোয়ার। কিশোরী মেয়ের মতো সে তাঁবুময় ছোটাছুটি করতে থাকে। খাবার, সে যত সাধারণই হোক না কেন, তাতে যদি মায়ের মমতার ব্যঞ্জন থাকে, সে খাবার অসাধারণ হয়ে ওঠে। মাখনের সাথে বাসি রুটি আমার কাছে অমৃতের মতো লাগে। খেতে খেতে অনেক কথা হয়। আমার আন্তরিকতায় বেওয়া তার মনের অর্গল খুলে দেয়।

হাশেমজায়ী বংশের কন্যা গোলবাহার হাশেমজায়ী। পনেরো বছর বয়েসেই বিয়ে হয়ে যায় আরেক হাশেমজায়ী, দিলওয়ার হাশেমজায়ীর সাথে। বালুচদের সাধারণত নিজ বংশের মধ্যেই বিয়ে শাদী হয়। দিলওয়ার ছিল গোলবাহারের দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই। পাগলের মতো ভালোবাসত গোলবাহারকে। বছর না ঘুরতেই ভালোবাসার ফসল ঘরে আসে, দিল মুরাদ। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখের ভেলায় ভাসতে দশটা বছর কখন কেটে যায়, জানতেও পারে না গোলবাহার। ওদের ঘরে আর কোনো সন্তান আসে না। তাই একমাত্র সন্তান দিল মুরাদই ছিল দুজনের চোখের মণি। হাশেমজায়ীদের সাথে রিগীদের দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। ঝগড়া, বিবাদ, মারামারি, কাটাকাটি লেগেই থাকত। সেই বিবাদে একদিন বিধবা হয়ে গেল গোলবাহার। ছেলে বুকে নিয়ে শোঁকে পাথর হয়ে গেল সে। তখন কত বয়স তার ? বছর পঁচিশ। ভরা যৌবন। অনেকেই সে যৌবনের দখল নিতে চায়। না, অবৈধ ভাবে নয়। বিয়ে করেই। তবে দশ বছরের ছেলের মাকে প্রথম স্ত্রী হিসেবে নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হিসেবে পেতে চায়। দিলওয়ারের জায়গা অন্য কাউকে দেয়ার কথা ভাবতেও পারে না গোলবাহার। স্বামীর রেখে যাওয়া ভেড়ার পাল, ফলের বাগান আর দিল মুরাদকে বুকে ধরে এই তাঁবু আঁকড়ে পড়ে থাকে।

দিনে দিনে বড় হয়ে ওঠে দিল মুরাদ। পাহাড়, মরুতে ভেড়া চরায়, ফলের বাগানের যত্ন নেয়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর কষ্ট ভুলে থাকে গোলবাহার। দিল মুরাদ যখন উনিশের টগবগে যুবক, গোলবাহার স্বপ্ন দেখে ছেলের বিয়ে দেবে, ফুটফুটে একটা বউ ঘরে আনবে, নাতী নাতনীতে ভরে উঠবে তার ছোট্ট খিমা। আর তখনই ইরান ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইমাম খোমেনীর নির্দেশ, সব সমর্থ পুরুষকে যোগ দিতে হবে বাসিজে। বাসিজ ছিল ইসলামী বিপ্লবের পর গঠিত একটা স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাহিনী, যাদেরকে বলা হত দুই কোটির সৈনিক (Army of 20 million). যুদ্ধ বাধলে বারো বছরের বালক থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত এই বাসিজে যোগ দিয়েছিল। দিল মুরাদও বাদ যায় না। খুব সামান্যই সামরিক প্রশিক্ষণ পেত বাসিজ। নিয়মিত বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করত এরা। এই বাসিজকেই যুদ্ধের শেষের দিকে ইরান মানুষের ঢাল বা মানুষের ঢেউ (Human shield or Human wave) হিসাবে সম্মুখ সমরে পাঠিয়েছিল। তারা শত্রু সৈন্যদের সাথে কমব্যাট বা হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হত। সেই ফাঁকে নিয়মিত আর্মি সামনে অগ্রসর হত। ধারণা করা হয়, সেই কমব্যাটেই মারা গেছে দিল মুরাদ। তবে মরদেহ পাওয়া যায়নি। এখনও গোলবাহার পথ চেয়ে বসে থাকে, একদিন হয়ত হঠাৎ করেই হাজির হবে ছেলে। দিল মুরাদ নামের অর্থই যে হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা। গোলবাহার সে আকাঙ্ক্ষাকে মরতে দেয় না ! আমার চেহারা নাকি অনেকটাই দিল মুরাদের মতো। তাই সেদিন চমকে উঠেছিল।

আমি খাওয়া ভুলে তন্ময় হয়ে শুনছিলাম গোলবাহারের করুণ দাস্তান। বলতে বলতে কখন তার বুক ভেসে যায় দুঃখ নদীর জলে, সে তা জানতেও পারে না। শুনেছি, রাজনীতি শব্দটা এসেছে রাজার নীতি থেকে। অথচ এই রাজনীতিতে নীতিরই কোনো বালাই নেই। পাশাপাশি দুটি মুসলিম দেশ ইরান, ইরাক। অথচ বৈরিতা শত বছরের পুরনো। বিরোধের শুরু শাতিল আরব নিয়ে। শাতিল আরব নদী, যার উৎপত্তি ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর সমন্বয়ে। দুইশ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মিশেছে পারস্য উপসাগরে। এই শাতিল আরবের দুই তীরে অবস্থিত দুটি দেশ, ইরান, ইরাক। পারস্য উপসাগরের একমাত্র প্রবেশ পথ, শাতিল আরবের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই শুরু হয় দুই দেশের প্রতিযোগিতা। রেজা শাহের আমলে ইরান ছিল সামরিক দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সব চেয়ে শক্তিশালী দেশ। তার উপরে ছিল আমেরিকার সাথে সখ্যতা। সেই জোরেই শাতিল আরব নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রায়ই ভঙ্গ করত ইরান। চাইলেও কিছু করার সাহস ছিল না ইরাকের।

খোমেনী যখন রেজা শাহকে উৎখাত করে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সাধন করল, তখন পাশার গুঁটি বদলে গেল। বিপ্লবোত্তর ইরানে অরাজকতা, শাহের গঠিত শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অসহযোগিতা, কমিউনিস্ট পার্টি মুজাহেদীন খালকের বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সব মিলিয়ে ইরানে তখন এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। সাদ্দাম হোসেন দেখল এই সুযোগ। সে ১৯৮০ সালে ২২ সেপ্টেম্বর ইরান আক্রমণ করল। এ আক্রমণ শুধু শাতিল আরবের নিয়ন্ত্রণ কিংবা তেল সমৃদ্ধ খুজিস্তান প্রদেশ দখলের জন্য ছিল না। সাদ্দাম হোসেনের ভয় ছিল, ইরানের ইসলামি বিপ্লব আবার ইরাকেও রপ্তানি না হয়ে যায়। তাই শুরুতেই ইসলামী সরকারের কোমর ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু কাজটা সহজ হয় না।

ইমাম খোমেনি ছিলেন খুব দূরদর্শী নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ইরানের নিয়মিত আর্মির উপর পুরা ভরসা করা ঠিক হবে না। তাই, ১৯৭৯ সালেই নিয়মিত আর্মিকে কাউন্টার ব্যাল্যান্স করার জন্য একটা শক্তিশালী ইসলামী বিপ্লবী বাহিনী ( Islamic Revolutionary Guard) গঠন করেন, বাসিজ যার একটি শাখা। যুদ্ধের তিন মাসের মাথায়, বিপ্লবী সরকারের অনুগত নিয়মিত বাহিনী ও ইসলামী বিপ্লবী বাহিনী সাদ্দামের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়। আর পুরা দুই বছর লাগে ইরাকি বাহিনীকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যেতে। পরের ছয় বছর যুদ্ধ মূলত আকাশে ও সীমান্ত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এই যুদ্ধে ইরাক যেমন গণ বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র (Chemical weapon of Mass destruction) ব্যবহার করে অগণিত বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। ইরানও তেমনই বাসিজের হাজার হাজার কিশোর, যুবক, বৃদ্ধকে মানব ঢেউ বানিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এই সময় পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ ইরাককে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। ইরান প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়েই ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত যুদ্ধ বিরতি ইরান মেনে নেয়। দুই দেশই যুদ্ধ পূর্ব অবস্থানে ফিরে যায়।

শুধুমাত্র একটা মানুষের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য, দুটি ভ্রাতৃ প্রতিম দেশের দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধে পরাজিত হয়নি কোনো দেশ। পরাজিত হয়েছে মানবতা। মানুষেরই নৃশংসতায় খালি হয়েছে দুই দেশের পাঁচ লক্ষ মায়ের বুক। যার জ্বলন্ত উদাহরণ, আমার সামনে জীবন্ত লাশ হয়ে বসে থাকা গোলবাহার বেওয়া। কাঁদতে কাঁদতে যার চোখের নদী শুকিয়ে বালুচর। পাথর বুকে রয়ে গেছে শুধু সন্তান হারানোর হাহাকার।

আমার মুখে কোনো কথা আসে না। এমন কোনো ভাষা জানা নেই আমার, যা একজন মাকে তার সন্তান হারানোর কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে। একটা উদ্গত কান্নার ঢেউ আমার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। দু'চোখ শ্রাবণের নদী হতে চায়। আমি কোনোমতে বিদায় নিয়ে পালিয়ে আসি।
 
ইরানি দাস্তান

পর্ব ১৭







"ছেড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা ঠিক না"। কথাটা ছোটবেলায় অনেক শুনেছি। অথচ ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বাবাও ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী মানুষ। প্লাটিনাম কলোনির ষোলো বাই ষোলো এক কামরার বাসায়, ভাঙ্গা খাটে শুয়ে শুয়ে তিনিও স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে একদিন বিলেত যাবে, মস্ত বড় ডাক্তার হবে। যাবার আগে সেই স্বপ্নটা বীজটা আমার বুকেও বপন করে দিয়েছিলেন। বিলেত কোথায় ? টাকার জন্য স্বদেশ, স্বজন ছেড়ে, পাহাড় মরুর বালুচিস্তানে, এক অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি। তবে স্বপ্নটাকে মরতে দিই নি। এখনও স্বপ্ন দেখি, ইরানে চাকরী করে একদিন অনেক টাকা হবে, সেই টাকা দিয়ে বিলেত যাব, বাবার স্বপ্নের মস্ত বড় ডাক্তার হব ! কোনো বাঁধা, কোনো কষ্টই সে স্বপ্ন থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে পারবে না। তাই তো সময় পেলে সুন্দরী বউয়ের চাইতে নীরস ডাক্তারি বইয়ের সাথে বেশি সময় কাটে আমার। এমআরসিপির বই খুলে বসি। সময় হলেই উড়াল দেব স্বপ্নের দেশে।

সেদিন শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েই চলে গিয়েছিলেন বেহদারির ডেপুটি চীফ শাহ বাখশ আমিরি। বৈধতা দিয়ে গিয়েছিলেন আমার ছয় প্যারাসিটামল তত্ত্বকে। সেই থেকে বিন্দাস আছি। সাইয়ারির দিনগুলি ছাড়া বাকি দিনগুলোতে বিস্তর অবসর। সকাল এগারোটার মতো হবে। রুগী দেখা শেষ করে দারমাঙ্গায় কেবিনের দরজা আঁটকে ডুবে গিয়েছিলাম হ্যারিসনের (মেডিসিনের বই) পাতায়। এমন সময় বেশ শব্দ করেই ঝট করে খুলে যায় দরজা। নক না করে কারো ঘরে ঢোকা রীতিমত অভদ্রতা। আর তা যদি আমার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটায়, মোটেই তা বরদাশত করতে পারি না। রেগে মেগে একটা কড়া ধমক দিতে যাব, দেখি, দরজায় দাঁড়িয়ে আফসানেহ রিগী !

প্রায় এক মাস হয়ে গেছে, আফসানের খবর নেই। ছুটি থেকে কবে ফিরেছে, জানি না। জানার প্রয়োজনও মনে করিনি। তবে ওকে আজ এই ভাবে আমার দরজায় দাঁড়ানো দেখব, ভাবিনি। অবিন্যস্ত চুল, এলোমেলো বেশভূষা, চোখ টকটকে লাল। কাজল বিহীন চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। খুব ভয় পেলে যেমন দেখায়। সেই সাথে হাঁপাচ্ছে খুব। দ্রুত লয়ে ওঠা নামা করছে আঁচল সরে যাওয়া বুক। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চিৎকার করে উঠল,

- ডাক্তার, তাড়াতাড়ি এসো। আগরাব খোরদেগি উমাদ ( স্করপিওন বাইট বা বিচ্ছুর কামড়ের রুগী এসেছে)।

আগরাবের নাম শুনেই পিলে চমকে গেল ! পৃথিবীর যত দেশে স্করপিওন বা আগরাবের উৎপাত আছে, ইরান তাদের সেরা। গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় পাহাড়, মরুভূমিতেই এদের বসবাস। খাস হাসপাতালে জয়েন করার পর পরই স্করপিওন বাইট বা আগরাব খোরদেগির উপরে একটা টিউটোরিয়াল দেয়া হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ প্রকারের প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায় ইরানে। এর মধ্যে সাতটি প্রজাতি ভয়ংকর রকমের বিষধর। সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা না দিতে পারলে মৃত্যু অবধারিত। অনেকটা আমাদের দেশে বিষধর সাপে কাটার মতো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই যে ভাবে এসেছিল, সে ভাবেই ঝড়ের বেগে চলে গেল আফসানেহ। আমিও উঠে দ্রুত ইমার্জেন্সী রুমের দিকে ছুটলাম।

বেডে নেতিয়ে পড়ে আছে পনেরো ষোলো বছরের এক নধর কান্তি কিশোর। বেশ ক'জন মানুষ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। খারকুই ইতিমধ্যেই চলে এসেছে। ট্রলিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম সাজাচ্ছে। আমাকে দেখে সবাই জায়গা করে দিল। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে ছেলেটির। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। ঘন হয়ে এসেছে শ্বাস প্রশ্বাস। ঘামছে দরদর করে। আমি দ্রুত ছেলেটির একটা হাত নিয়ে পালস দেখার চেষ্টা করি। ঘামে ভেজা ঠাণ্ডা হাত। নাড়ির গতি খুব দ্রুত । সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, শকে চলে যাচ্ছে ছেলেটি। মুহূর্তে বার বার নেয়া বেসিক লাইফ সাপোর্ট ট্রেনিং এর কথা মনে পড়ে গেল। এবিসি। এয়ার ওয়ে, ব্রিদিং, সার্কুলেশন। আমি খারকুইকে ছেলেটার মুখের ভেতরটা কটন দিয়ে পরিষ্কার করে আম্বো ব্যাগ দিয়ে অক্সিজেন দিতে বললাম। আমাকে সার্কুলেশন ঠিক রাখতে হবে। বমি আর প্রচুর ঘামের জন্য রুগী অনেক সময় ডিহাইড্রেশনে চলে যায়। এখনই স্যালাইন শুরু করতে না পারলে পরে আর শিরা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ট্রলিতে সব রেডি করাই ছিল। অনেক চেষ্টায় আমি হাতে একটা শিরায় বাটার ফ্লাই নিডিল প্রবেশ করাতে পারলাম। যুক্ত করে দিলাম এক ব্যাগ স্যালাইনের সাথে। প্রাথমিক কাজ শেষ।

এবার আমাকে আগরাব সম্পর্কে জানতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম,

- কোথায় কেটেছে।

- এই যে এখানে।

কণ্ঠ শুনে চমকে উঠি। আফসানেহ ! এতক্ষণ খেয়াল করিনি, ছেলেটির বাম পা বেডের সাথে চেপে ধরে বসে আছে আফসানেহ। যাতে পা নাড়াতে না পারে। নড়াচড়া করলে বিষ তাড়াতাড়ি রক্তের সাথে মিশে যায়। গোড়ালির কিছুটা উপরে ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা, যাতে বিষ উপরের দিকে না যেতে পারে। যেই বেঁধেছে, কাজটা খুব বুদ্ধিমানের মতো করেছে। দড়ি কিংবা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধেনি। তাহলে রক্তের প্রবাহ পুরোই বন্ধ হয়ে যেত। আমি ঘুরে বেডের অন্য পাশে আফসেনের কাছে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

- কোথায় কেটেছে, আমাকে দেখাও।

আফসানেহ এবার ছেলেটার পাটা একটু উল্টে গোড়ালি দেখাল। ফুলে আছে গোড়ালিটা। কাটার দাগ স্পষ্ট। সেখান থেকে ক্ষীণ ধারায় চুইয়ে পড়ছে রক্ত। তার মানে, রক্ত জমাট বাধছে না ! মনে মনে শিউরে উঠলাম। ভয়ঙ্করতম স্করপিওন, হেমিস্করপিয়াস লেপটুরাস নয় তো ? ইরানিরা বলে আগরাবে গাদিম। গাদিম অর্থ পুরনো। অতীতে বহু মানুষ এই স্করপিওনের কামড়ে মারা গেছে বলে এর নাম দিয়েছে আগরাবে গাদিম। এই আগরাবের বিষ রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতাই শুধু নষ্ট করে দেয় না। রক্তের কণাও ভেঙ্গে দেয়। খুব তাড়াতাড়ি হার্ট, নার্ভ ও কিডনি আক্রমণ করে। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম,

- কখন কেটেছে ?

- ঘণ্টা দুই। ছেলেটা সকালে পাহাড়ে ভেড়া চরাতে গিয়েছিল।

- বমি করেছে ?

- হু। দুইবার।

সব প্রশ্নের উত্তরই আফসানেহ দিচ্ছে। কে এই রাখাল ছেলে ? অক্সিজেন ও স্যালাইন পেয়ে একটু সতেজ হয়েছে ছেলেটি। আমি ওর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম,

- পেছারজুন, দারদ মিকুনে ? (ছেলে, ব্যথা করছে) ?

এদিকে ওদিক মাথা নাড়ে ছেলেটি। মানে ব্যথা নেই! আমি এবার নিশ্চিত হয়ে গেলাম। আগরাবে গাদিম। এর বিষ নার্ভ আক্রমণ করে বলে ব্যথা বোধ থাকে না। এমন সময় হঠাৎ আফসানেহ উঠে দাঁড়িয়ে আমার বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরে কান্না মেশানো গলায় চিৎকার উঠল,

- ডাক্তার, শুধু কথাই বলবে, না আরও কিছু করবে ?

খুব অবাক হয়ে গেলাম। একজন মেষ পালকের জন্য আফসানের এত উৎকণ্ঠা ? নাকি ছেলেটার আফসানের কোনো আত্মীয় ? এই সব রুগীর দশ জনে একজন মারা যায়। এর আগে বিচ্ছুর কামড় তো দূরের কথা, বল্লার কামড়ের চিকিৎসাও করি নাই। আর এই বিচ্ছু তো সাপের চাইতেও ভয়ঙ্কর। বুকের মধ্যে আমার হৃদপিণ্ডটা খাঁচায় পোরা ব্যাঙের মতো উল্টা সিধা লাফাতে শুরে করল। দু মাস হয়, দারমাঙ্গায় এসেছি, যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়, আর সত্যি সত্যি যদি সে আব্বাস রিগীর আপন কেউ হয়, তাহলে আর ডাক্তারি করে খেতে হবে না। উল্টো আমাকেই বালুচ সর্দার টুকরা টুকরা করে পাহাড়ি নেকড়ে দিয়ে খাওয়াবে ! ভাবতেই মনে হল, আর একটা আগরাব আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে গেল ! বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখার শিক্ষা খুব ছোটবেলায় বাবার কাছে থেকে পেয়েছিলাম। আমি বুক থেকে ওর হাত দুটি সরিয়ে দিয়ে বললাম,

- আফসানেহ, শান্ত হও। যা যা করার দরকার সবই করব। তুমি একটু আম্বো ব্যাগটা ধরো। খারকুই, এন্টি ভেনোম ইনজেকশন বের করো। জলদি !

প্রচুর আগরাবে কাটা রুগী আসে বলে এই অঞ্চলের সব দারমাঙ্গাতেই বিশেষ ফ্রিজে এন্টি ভেনোম মজুদ থাকে। খারকুই আম্বো ব্যাগটা আফসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে গিয়ে এন্টি ভেনোম নিয়ে আসল। আমি এক ডোজ এন্টি ভেনোমের অর্ধেকটা সরাসরি শিরায় চালান করে দিলাম, বাকীটা স্যালাইন ব্যাগে।

স্করপিওন বাইটের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ। এখন ওর হার্ট সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ রাখতে হবে। নিয়মিত কিডনি ফাংশন পরীক্ষা করতে হবে। ক্লোজ ক্লিনিক্যাল অবজারভেশন দরকার। এমন কী আইসিইউ সাপোর্টও লাগতে পারে। অবস্থা বুঝে আরও এন্টি ভেনোম দিতে হতে পারে। এ সব দারমাঙ্গায় বসে করা সম্ভব নয়। ওকে যত দ্রুত সম্ভব, হাসপাতালে নিতে হবে। আমি আবার আফসানেহকেই প্রশ্ন করলাম,

- ওর লিগাল গার্জিয়ান কে ? হাসপাতালে নিতে হবে।

আফসানেহ কিছু বলার আগেই পিছন থেকে একটা শীতল কণ্ঠ বলে উঠল,

- বলতে পারো, আমরাই ওর লিগ্যাল গার্জিয়ান।

চমকে তাকিয়ে দেখি, আহবাব রিগী। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পাশে গুণ্ডা মার্কা আরও দু'জন দাঁড়িয়ে। আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হল না। গার্জিয়ান দিয়া আমার কাম কী ? আমার কাম চিকিৎসা করা। আফসানের দিকে তাকালাম। করুণ চোখে চেয়ে আছে মেয়েটি আমার দিকে। যেন বলতে চাইছে, দোহাই তোমার ডাক্তার, যেমন করে পারো, ছেলেটাকে বাঁচাও। যেন আমার হাতেই ছেলেটার বাঁচা মরা নির্ভর করছে। রাখাল ছেলেই হোক আর আত্মীয়ই হোক, আফসানের মতো ভীষণ রকম খামখেয়ালী ধনীর দুলালীর এত মায়া দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এমন মায়া তো শুধু একজন মাকেই মানায়। অথচ আফসানের তো এখনও বিয়েই হয়নি ! মা হবে কেমন করে ? আর হলেও এত বড় ছেলের মা হওয়া তো একেবারেই সম্ভব নয়। মাতৃত্বের স্বাদ পাক বা না পাক, বিধাতা বোধহয় জন্মের আগে থেকেই সব মেয়ের অন্তরে মাতৃত্বের বীজ বপন করে দেন।

খবর পেয়ে ইতোমধ্যে দাদ মোহাম্মদও চলে এসেছে। রুগী হাসপাতালে পাঠাতে হলে দাদ মোহাম্মদ নিয়ে যায়। সাধারণত খারকুই সাথে যায়। কিন্তু এই রুগী কোনোমতেই একা খারকুইয়ের হাতে ছাড়া যাবে না। পথে যে কোনো সময় অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। এন্টি ভেনোমের প্রতি এলার্জিক রিয়াকশন দেখা দিতে পারে। এমনকি রুগী এনাফাইল্যাকটিক শকেও চলে যেতে পারে। আমাকেই সঙ্গে যেতে হবে। আমি দাদ মোহাম্মদকে এ্যাম্বুলেন্স (ল্যান্ড ক্রুজার) বের করতে বললাম। খারকুইকে বললাম, পেসেন্ট এ্যাম্বুলেন্সে তুলতে। আমি বাসায় গেলাম, বউকে বুঝিয়ে বলতে, যাতে ফিরতে দেরি হলে দুশ্চিন্তা না করে। শুনে বউও ছেলেটিকে দেখতে আসতে চাইল। হয়ত তার মধ্যেও সেই চিরন্তন মাতৃত্বই জেগে উঠেছিল। আমি আর না করলাম না।

ফিরে এসে দেখলাম, রুগী এ্যাম্বুলেন্সে উঠে গেছে। সেই সাথে আফসানেহও এ্যাম্বুলেন্সে উঠে ছেলেটির একটা হাত ধরে বসে আছে। আমি অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলাম,

- তুমিও কি যাবে নাকি ?

- হ্যাঁ।

- তুমি কেন মিছেমিছি কষ্ট করবে খানম রিগী ? আমি তো যাচ্ছিই। সাথে খারকুই আছে। তোমার যাবার তো কোনো দরকার দেখি না!

- আমি যাবই বেহরুযের সাথে।

কণ্ঠে সেই জেদ। ঠোঁট দুটো তেমনই চেপে বসা। থিরথির করে কাঁপছে চোখের পাতা। যেমনটি দেখেছিলাম এক মাস আগে আব্বাসাবাদে। এ্যাম্বুলেন্সের পিছনে রুগী ছাড়া আর দুজন বসা যায়। সার্বক্ষণিক মনিটরিং এর জন্য আমাকেও রুগীর সাথে পিছনেই বসতে হবে। তার মানে আফসানের সাথে পাশাপাশি বসে যেতে হবে। ভাবতেই কেমন অস্বস্তি লাগে আমার। অসহায় দৃষ্টিতে আমি আহবাব রিগীর দিকে তাকালাম। সে তেমনই ঠাণ্ডা গলায় বলল,

- মাছালে নিস্ত দকতোর ( অসুবিধা নাই ডাক্তার)। ও যাক। আমি আসছি পিছে পিছে গাড়ি নিয়ে।

এর পর আর কথা চলে না। আর দেরি করার কোনো মানেও হয় না। আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। খারকুই নীরবে দাদ মোহাম্মদের পাশে সামনের সীটে গিয়ে বসল। এই প্রথম গাড়িতে কোনো সুন্দরী ইরানী ললনার পাশে বসে যাচ্ছি। দেখে বউ কী ভাবছে কে জানে ?

এমনিতে ঘণ্টা দুয়ের পথ খাস। যে উল্কার গতিতে গাড়ি ছোটাচ্ছে দাদ মোহাম্মদ, তাতে দেড় ঘণ্টায়ই পৌঁছে যাব মনে হয়। ছেলেটার একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে আফসানেহ। যেন ভরসা দিতে চাইছে, সাহস দিতে চাইছে। আর গা ছোঁয়া দূরত্ব বাঁচিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি আমি। কেউ কোনো কথা বলছি না। ছেলেটা বোধহয় গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্যালাইন, অক্সিজেন চলছে। একবার পরীক্ষা করা দরকার। আমি "বেবাকশিদ, খানম রিগী" বলে ঝুঁকে ছেলেটার পালস দেখলাম। স্বাভাবিক হয়ে এসেছে নাড়ির গতি। স্টেথো দিয়ে বুকটা পরীক্ষা করলাম। পরিষ্কার। শ্বাস প্রশ্বাসও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তার মানে এন্টি ভেনোম কাজ করছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আমি আগের অবস্থানে ফিরে আসলাম। এ সব করতে যেয়ে আফসানের সাথে বার কয়েক ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল। ওর ভেতর তেমন কোনো বিকার লক্ষ্য করলাম না। অথচ আমি কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। সারা জীবন কো-এডুকেশনে পড়েছি। মেয়েদের সাথে চলতে ফিরতে, কথা বলতে, আড্ডা মারতে, কখনোই কোনো জড়তা ছিল না আমার। অথচ এই মেয়েটির কাছে এলেই কী এক অস্বস্তি ঘিরে ধরে। পালিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। কেন ?

- কেমন দেখলে ডাক্তার ?

আফসানের গলাটা ভাঙ্গা, ফ্যাসফ্যাসে। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলে যেমন হয়। বাইরে উজ্জ্বল রোদ। তার আলো কাঁচের জানালা ভেদ করে এসে পড়েছে আফসানের মুখে। কেমন বিধ্বস্ত দেখায় সে মুখ। যেন বয়স বেড়ে গেছে কয়েক বছর। চোখ দুটি ফোলা ফোলা। ছোট্ট করে জবাব দিলাম,

- ভালো।

- বাঁচবে তো ?

কেঁপে যায় আফসানের গলা। তাকিয়ে দেখি, থিরথির করে কাঁপছে দুই ঠোঁট। দু'চোখে ফুঁসছে এক নদী কষ্টের জল। যে কোনো সময় ডাকতে পারে বাণ। আমি জানি, সাময়িক ভাবে এন্টি ভেনোম কাজ করলেও হঠাৎ করেই অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যেতে পারে। হার্টে অসুবিধা দেখা দিতে পারে। কিডনি ফেইল করতে পারে। এখনই কিছু বলা যাবে না। এমনিতে আমি রুগীর অবস্থা অকপটে বলে দিই। কোনো মিথ্যা সান্ত্বনা দিই না। কিন্তু কেন জানি না, আজ আফসানের সাথে অকপট হতে পারলাম না। শান্ত কণ্ঠে বললাম,

- এত চিন্তা করছ কেন ? সময় মতো সব প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে নিচ্ছি কয়েকদিন অবজারভেশনে রাখার জন্য। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমাকে চমকে দিয়ে আফসানেহ ছেলেটির হাত ছেড়ে হঠাৎ আমার দু'হাত আঁকড়ে ধরল। থরথর করে কাঁপছে। খুব ঠাণ্ডা সে হাত। হয়ত দুশ্চিন্তায়, ভয়ে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল তার। আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। আবার প্রশ্ন জাগল মনে। কে এই ছেলে ? আফসানের ভাই না তো ? তবে যে শুনেছি, আব্বাস রিগীর আর কোনো সন্তান নেই ! তবে কি আব্বাস রিগীর গোপন কোনো স্ত্রীর ছেলে ? নইলে পরিচয় নিয়ে এত হেঁয়ালি করবে কেন ? আমি কিছুই বুঝতে পারি না। ওর কান্নার জল ভিজিয়ে দিতে থাকে আমার দুই হাত। সে হাত আমি সরিয়ে নিতেও ভুলে যাই। থমকে থাকে সময়।

কতক্ষণ ? কয়েক মুহূর্ত ? কয়েক সেকেন্ড ? অথচ আমার কাছে কয়েক যুগ মনে হল। ও'ই প্রথম নিজেকে সামলে নিল। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

- তোমার এই উপকার আমি কোনো দিন ভুলব না ডাক্তার।

- উপকার কেন বলছ খানম রিগী ? এটা তো আমার কর্তব্য।

- কর্তব্য আর আন্তরিকতার পার্থক্য আমি বুঝি ডাক্তার।

- খুব ভালোবাসো ছেলেটিকে ?

- কেন বাসব না ? সেও তো কোনো এক মায়ের সন্তান !

এ কেমন জবাব ? গলাটাও কেমন রূঢ় শোনায়। নাকি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোনো কৌতূহল পছন্দ করে আফসানেহ ? আমার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। মেয়েটিকে আসলেই আমি বুঝতে পারি না। কোন কথায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আগে থেকে কোনোমতেই ধারণা করা যায় না। গম্ভীর গলায় বললাম,

- বেবাকশিদ খানম রিগী। কিছু মিন করে বলিনি।

- কী সেই থেকে খানম রিগী, খানম রিগী করে যাচ্ছ ? আমার কি কোনো নাম নেই ?

- সবাই তো তোমাকে খানম রিগী বলেই ডাকে !

- সবাই আর তুমি কি এক হলে ?

আমি ঝট করে আফসানের দিকে তাকালাম। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে। এবার আর চিনতে ভুল হয় না। এই কণ্ঠ আমি চিনি। এই দৃষ্টি আমি জানি। বুকের ভেতর গুরুগুরু ডেকে উঠল কালবৈশাখী মেঘ। সে মেঘ থেকে ঝড় ওঠার আগেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। ছেলেটিকে চেক করার ছলে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ ধরে পালস দেখলাম। বুক দেখলাম। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শুনলাম। তারপর যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে এক পাশে কুঁকড়ে বসে থাকলাম। আফসানের দিকে আবার তাকাবার সাহস হল না। আফসানেও আর কোনো কথা বলল না।

আমাদের আগেই দলবল নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিল আহবাব রিগী। পৌঁছে দেখলাম, ডাক্তার, নার্স, ট্রলি, সব তৈরি। রুগীকে ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে না নিয়ে সোজা আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হল। বুঝতে পারলাম, আব্বাস রিগীর হাত অনেক লম্বা। আমিও রুগীটিকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সাথে সাথে গেলাম। আইসিইউতে এটেন্ডেন্ট এলাউড না। আফসানেহ ইমার্জেন্সীতেই রয়ে গেল।

রুগী হ্যান্ড ওভার করে নীচে এসে দেখলাম, করিডোরে অপেক্ষা করছে আহবাব রিগী। সাথে আফসানেহ। আমি আহবাব রিগীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

- আলহামদুলিল্লাহ্। ভয়ের কিছু নেই। রুগীর অবস্থা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। চব্বিশ ঘণ্টা আইসিইউতে রাখবে। কোনো জটিলতা দেখা না দিলে জেনারেল ওয়ার্ডে শিফট করে দেবে। সব ঠিক থাকলে তিন চার দিনের মধ্যেই ছাড়া পাবে। আজ আর তোমাদের এখানে না থাকলেও চলবে।

শুনে আহবাব রিগীর পাথর চেহারায় তেমন কোনো পরিবর্তন হল না । হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

- খাইলি মামনুন অগাই দকতোর। দাস্তে শোমা দারদ না কুনে।

মনে মনে বলি, ব্যাটা কথার চাটুকর। শুধুই কি হাতে ব্যথা ? তোর ভাইজির ভয়ে যে সারা পথ গাড়ির মধ্যে কুণ্ডলী পাকাইয়া বইয়া থাকলাম, ফুটবলের মতো ঝাঁকি খাইতে খাইতে যে পুরা শরীর ব্যথা হইয়া গেল, সেইটা নিয়া কিছু বলবি না ? বিরক্তিটা চেপে রেখে আমিও আহবাব রিগীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম,

- খায়েশ মিকুনাম। ছারে শোমা দারদ না কুনে। আমাকে অনুমতি দাও, দারমাঙ্গায় ফিরতে হবে।

- খোদা হাফেজ দকতোর, সাবধানে যেও।

এক কথায় খোদা হাফেজ ? অবাক কাণ্ড ! ওদের রুগী আনতে যেয়ে সারাদিন না খেয়ে আছি, খিধেয় পেট আমার চোঁচোঁ করছে। খাওয়ার ব্যবস্থা করা তো দূরের কথা, শুকনো মুখের কথাটা পর্যন্ত বলল না ? আড় চোখে দেখলাম, শক্ত মুখ করে, নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে আফসানেহ। এখন তার চোখেও বরফ শীতল চাউনি। একটা কথাও বলল না। মানে কী ? এ দেখি পুরোই এক অন্য মানুষ। গাড়ির ভেতর দেখা আফসানের সাথে এর কোনো মিল নেই। ওহ, তাই তো ! রুগী তো হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের হেফাজতে পৌঁছে গেছে। দারমাঙ্গার সাধারণ ডাক্তারকে এখন আর তার কী প্রয়োজন ? ইরানি শুকরিয়ার শাহনামা না হোক, ছোট্ট শায়েরের মতো একটা ভদ্রতা সূচক ধন্যবাদও তো দিতে পারত ! মানুষ এত স্বার্থপর হতে পারে, এত দ্রুত বদলে যেতে পারে, আফসানেহকে না দেখলে হয়ত জানাই হত না ! নিজেকে কেমন অপাংক্তেয় বলে মনে হয়। আমিও খোদা হাফেজ বলে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে বের হয়ে আসলাম।

করিডোরের এক প্রান্তে, দুটি শীতল চোখের বরফ ধীরে ধীরে গলে পানি হয়ে যায়, আমি তা জানতে পারি না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top