ডাঃ আফতাব হোসেন, আমার বেশ কয়েকজন প্রিয় লেখকের মধ্যে একজন। পেশায় উনি একজন ডাক্তার। পেশাগত কারণে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে অবসর সময় কাটাচ্ছেন সে গল্প ও উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে। এপর্যন্ত তাঁর ৩/৪ টি বই প্রকাশ পেয়েছে। সবগুলি বইই ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই উপন্যাসটাও খুব শীঘ্রই বই আকারে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। তাই কৌশলগত কারণেই উনি মোট ২৫ পর্বের (আনুমানিক) মধ্যে ১৭ টি পর্ব ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। আমি আপনাদের মাঝে সেই ১৭ টি পর্বই উপস্থাপন করবো। আশাকরি আপনাদের কাছে খারাপ লাগবেনা। আর যদি ভালো লেগে যায় তবে অবশিষ্ট আট পর্ব পড়তে হলে আপনাকে বইটি কিনে তবে পড়তে হবে। বই প্রকাশ হলে আপনাদের জানিয়ে দিব। আসুন তবে পড়া শুরু করি...
বেশ গর্বের সাথেই বলেছিল কথাটা হাশিম আসকারি। ইরানে স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরিটা নিশ্চিত হয়ে যাবার পর আবার ডেকেছিলাম ছেলেটাকে। ১৯৯০ সাল। মাত্র বছর দুই হয় ইরান ইরাক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটা কী হাল হয়েছে কে জানে ? তার উপর ক’মাস আগেই (জুন ২০, ১৯৯০) এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে ইরানের দু’টি শহর। মাটিতে মিশে গেছে সব ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, পথ-প্রান্তর। প্রাণ হারিয়েছে পঞ্চাশ হাজার মানুষ। আহত লাখ দেড়েক। মনের ভেতর এক ধরণের দ্বিধা। যাওয়া কী ঠিক হবে ? তাই ডেকেছিলাম ওকে। ইরানের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য। ও আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিল,
- ফেকের না কুন দকতোর। চিন্তা করো না ডাক্তার। ইরান অনেক বড় আর সুন্দর দেশ। ইরানিদের কাছে পয়গম্বরের পরেই মেহমানের স্থান। মেহমান হাবীবে খোদা হাস্ত। মেহমান আল্লাহর বন্ধু। আর ডাক্তার হলে তো কথাই নাই। তোমাকে ইরানিরা মাথায় করে রাখবে।
হাশিমের কথা শুনে আফগানিস্তানের আব্দুর রহমানের কথা মনে পড়ে যায়। সেও বলেছিল, “ইন হাস্ত ওয়াতানাম”। এই তো আমার জন্মভূমি। নিজের দেশের প্রতি, নিজের দেশের মানুষের প্রতি, নিজের কৃষ্টি কালচারের প্রতি এই যে ভালোবাসা, এই যে উচ্চ ধারণা, এটাই তো দেশপ্রেম। অথচ আমরা বাঙ্গালিরা, তিন মাস ইউরোপ আমেরিকার বাতাস গায়ে লাগতেই নিজের দেশ সম্পর্কে নাক সিটকে বলি, এহ, ও দেশে মানুষ থাকে ? কাদা-পানি, ধুলো-বালি, মশা-মাছি, ময়লা-আবর্জনায় ভরা ! যারা নিজের দেশকে নিয়ে এমন লজ্জা পায়, আমি নিশ্চিত, তারা নিজের মা বাবার পরিচয় দিতেও লজ্জা পায়। অথচ এই মানুষগুলোর অনেকেই বিদেশে বসে তৃতীয় শ্রেণীর কাজ করে।
না, মিথ্যে বলেনি হাশিম আসকারি। ইরানের মানুষের যে কতটা অতিথিপরায়ণ, পারস্য সভ্যতাকে যে কেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলা হয়, ইরানের মাটিতে পা ছোঁয়াবার আগেই তা টের পেয়েছিলাম। বরিশালে মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিলে শ্বশুর বাড়ি থেকে নৌকা পাঠানো হত নিয়ে আসার জন্য। ইরানি কর্তৃপক্ষ নৌকা কিংবা বিমান না পাঠালেও বিমানের টিকেট কেটে পাঠিয়েছিল। যেখানে অন্যদের বিদেশ যেতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হত, সেখানে আমাদের এক পয়সাও লাগল না। এত রীতিমত জামাই আদর। মনে হল শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি চাকরী করতে !
আমরা একসাথে সাতজন বাংলাদেশি ডাক্তার সেদিন ইরান যাচ্ছিলাম। অন্যদের কথা জানি না, তবে আমার জন্য সেটাই জীবনে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রবেশ। তখন এয়ারপোর্ট এত বড় ছিলনা। তবু তার চাকচিক্যে একটু টাসকি খাইয়া গেলাম। স্বজন ছেড়ে দূর প্রবাসে যাবার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে গেলাম। বাংলাদেশ বিমান প্রথমে নিয়ে যাবে দুবাই। সেখান থেকে ইরান এয়ারে তেহরান।
এর আগে বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা বলতে একবার মাত্র যশোর থেকে ঢাকা ভ্রমণ। ফকার টুয়েন্টি সেভেনে। ত্রিশ মিনিটের উড়ালে বার তিনেক এমন ঝাঁকি খেয়েছিল যে, ভয়ে পরাণ পাখিটা আমার বুকের খাঁচা ছেড়ে আকাশে উড়াল দেয়ার জোগাড় হয়েছিল। আধঘণ্টায় এই অবস্থা, ছয় ঘণ্টার উড়ালে না জানি কী হয় ! ভয়ে ভয়ে বিমানে উঠলাম। বোয়িং সেভেন জিরো সেভেন। ফকারের তুলনায় বিশাল। তেমন কোনো ঝাঁকি-টাকি খেল না। তবে বাঁধ সাধল অন্য খানে। ফকার উড়েছিল মাটি থেকে মাত্র ষোল থেকে আঠেরো হাজার ফুট উপর দিয়ে। আর বোয়িং উড়ছে আটত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে। আমার দু’কানেই তালা লেগে গেল। শুধু কী তালা ? সেই বন্ধ তালায় চাবি দিয়ে কে যেন আজান দিয়ে গুঁতাতে শুরু করল। ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি বের হবার জোগাড়। আমি তালা খোলার জন্য মুখ এদিকে ভেংচাই, ওদিকে ভেংচাই, তালা তো খেলেই না, বরং আরও চেপে বসে। এত টাকা খরচ করে মানুষ প্লেনে ক্যান চড়ে কে জানে ? এর চেয়ে আমাদের পিরোজপুর টু বাগেরহাট মুড়ির টিনই ভালো। ঝাঁকি-টাকি গায়ের উপর দিয়ে যায়, কান ফুটা করে দেয় না।
শুনেছি, এয়ার হোস্টেজরা খুব সুন্দরী হয়। হয় লাস্যময়ী, তরুণী। সে গুড়েও বালি। বাংলাদেশ বিমানে ঢুকে মনে হল, আজ কোনো কারণে বিমান বালারা নয়, তাদের মা খালারা এসেছেন ডিউটি করতে। তবে ব্যবহারটা তাদের মোটেই মা খালাদের মতো নয়, রীতিমত প্রাইমারী স্কুলের অংকের টিচারের মতো ! যেন আমরা হোম ওয়ার্ক না করেই ক্লাসে এসেছি, আর ওনারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন! একে তো কানে ব্যথা, তার উপর তাদের এই রসকষহীন ব্যবহার, আমি মুখটাকে ভুতুম পেঁচা বানিয়ে ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষায় বসে রইলাম। চার ঘণ্টার উড়াল সেদিন আমার কাছে চার বছরের মতো মনে হয়েছিল।
দুবাই এয়ারপোর্ট দেখে তো আমার ভীমরি খাবার জোগাড়। এত বড়ও এয়ারপোর্ট হয় ? বিমানে বসে যাকে একটা বিশাল কাঁচের ডিমের মতো মনে হয়েছিল, ভিতরে ঢুকে তাকে রীতিমত একটা শহরের মতো মনে হল। বুঝলাম, তেল শুধু এ দেশে মাটির নীচে নয়, মাটির উপরেও চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তেল চকচকে বাহারি সব দোকান-পাট। চোখ ধাঁধানো সব জুয়েলারি শপ। সে সব দোকানের কর্মচারী থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টের সুইপার, ঝাড়ুদার পর্যন্ত, সবাই ভিনদেশী। ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, ফিলিপিনো, নেপালি, ইন্দোনেশিয়ান, বাংলাদেশী। তবে ইমিগ্রেশন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দুবাইওয়ালারা নিজেদের হাতেই রেখেছে। এ সব দেখতে দেখতেই ইরান এয়ারের ঘোষণা এসে যায়।
বাংলাদেশ বিমানে বসে কান দুটোয় তালা লেগেছিল, এবার ইরান এয়ারের দরজায় এসে চোখ দুটো হোঁচট খেল। বিমানবালাদের পোশাক যে এমন হতে পারে, সে আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শরীর এক অদ্ভুত সুন্দর কালো কাপড়ে মোড়া, শুধু মুখ আর দুই হাত কবজি পর্যন্ত খোলা। সে মুখ দেখে মনে হল, কালো পটভূমিতে এক থোকা বেলি ফুল ফুটে আছে। ত্বকের আভা বলে দেয়, বয়স ত্রিশের নীচেই। ডাগর কালো চোখে পুরু কাজলের প্রলেপ। গোলাপ পাপড়ি ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। এই জন্যই কি ইরানি মেয়েদের গোলাপ ফুলের সাথে তুলনা করা হয় ? আমি ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ি। পিঠে বন্ধু ইকবালের খোঁচা খেয়ে সম্বিৎ ফেরে আমার। দেখি বিমানের দরজার দুপাশে প্রায় একই রকম দেখতে দুই বিমানবালা দাঁড়িয়ে। হাসছে তারা আমায় দেখে। হাসছে তাদের ঠোঁট, হাসছে তাদের চোখ। চোখাচোখি হতে বলল,
- গুদ আফতারনুন স্যার। ইয়োর তিকেত প্লিজ।
বুঝলাম, ওরা আরবি উচ্চারণে ইংরেজি বলছে। আরবি ভাষায় ট বর্গের বর্ণ নেই। হয়ত ফারসি ভাষাতেও নেই। তাই ড কে দ আর ট কে ত উচ্চারণ করছে। আমি টিকেট দেখাই। টিকেটে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, নাচের মুদ্রায় হাত দুলিয়ে বলল,
- দিস ওয়ে প্লিজ। বেফারমাইন।
“দিস ওয়ে” তো বুঝলাম। কিন্তু বেফারমাইনটা কী জিনিষ ? ফারসি ভাষার ফ ও জানি না। অথচ এসেছি এ দেশে ডাক্তারি করতে। কোথায় পোস্টিং হবে কে জানে। সেখানকার মানুষেরা যদি ইংরেজি না জানে, কিংবা দোভাষী না থাকে, কিসের চিকিৎসায় কী দেব, আল্লাহই মালুম। ফারসি শেখার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে।
ছাত্রজীবন থেকেই যেখানেই যাই, পড়ি বা না পড়ি, বই আমার নিত্য দিনের সঙ্গী। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। বউ সাথে করে না আনতে পারলেও একগাদা বই সাথে করে নিয়ে এসেছি। ওয়েট চার্জ এড়াতে তার অনেকগুলো হ্যান্ড লাগেজে ঢুকিয়েছি। মেডিকেলের বই, পাথরের চেয়েও ভারি। প্রায় আধ মন ওজনের হ্যান্ড লাগেজটা কোনো মতে মাথার উপরে তো তুললাম, কিন্তু ক্যাবিনেটে ঢুকাতে পারছিলাম না। বাংলাদেশ বিমানে বন্ধুরা সাহায্য করেছিল। কিন্তু এবার ওরা অন্য পাশে। এমন সময় পাশ থেকেই মিষ্টি কণ্ঠে কেউ বলে ওঠে,
- লেত মি হেল্প ইউ স্যার।
আমার মাথার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লাগেজটা কেবিনেটে ঠেলে দিল আর এক বিমান বালা। তাকিয়ে দেখি, আমার চেয়েও প্রায় এক হাত বেশি লম্বা। জীবনে এই প্রথম খাটো হওয়ার জন্য খুব খারাপ লাগে আমার। আর দু’ইঞ্চি লম্বা বানালে কী এমন ক্ষতি হত খোদার ? অন্তত এই ইরানি ললনার সামনে লজ্জা পেতে হত না আজ। লজ্জিত কণ্ঠেই বলি,
- থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
- খায়েশ মিকুনাম দকতোর।
আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকি। বলে কী মেয়ে ? দরজায় দেখা মেয়ে দুটির মতোই রূপসী। সমস্ত অঙ্গে তার ফরাসী সৌরভ। আমার অজ্ঞতা সে বুঝতে পারে। দু’চোখে হাসির ঝিলিক তুলে বলে,
- ইউ আর মোশত ওয়েলকাম দকতোর।
সে নাহয় বুঝলাম। ফারসিতে কথা বলেতে অভ্যস্ত মেয়েটি “ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম” কে “ খায়েশ মিকুনাম” বলে ফেলেছে। কিন্তু আমি যে ডাক্তার বুঝল কী করে ? আমার কপালে কি ডাক্তার সাইনবোর্ড লেখা আছে ? আটাশ বছরের মেয়েলী চেহারার ছোটখাটো এই আমাকে এখনও অনেকে কিশোর বলে ভুল করে। আমাকে আর যাই হোক, ডাক্তার বলে ভুল করার কোনো কারণ নেই। আমাকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেই মেয়েটি অন্য যাত্রীদের সেবায় চলে গেল।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এত বড় ফ্লাইটে মাত্র একজন পুরুষ ফ্লাইট এটেন্ড্যান্ট। বাকী সবাই মেয়ে। সমস্ত শরীর কালো কাপড়ে ঢেকে তারা পুরুষের মতোই সব কাজ কেমন সাবলীল ভাবে করে যাচ্ছে। ইরানে ইসলামী শাসন চলছে এগারো বছর। ছাত্রজীবনে যে সব প্রগতিশীল বন্ধুরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরোধিতা করত, তাদের বিরোধিতার অন্যতম কারণ ছিল, ইসলামের অনুশাসন কট্টরপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল। নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, অন্তঃপুরবাসিনী করে রাখে, পর্দায় মুড়ে রাখে। ইরানের মূল ভূখণ্ডের অবস্থা কী, এখনও জানি না। তবে ইরান এয়ারের এই ফ্লাইট দেখে মেয়েদের আর যাই হোক, অন্তঃপুরে বন্দিনী বলে মনে হল না। তবে হ্যাঁ, ইসলামী আইন মতো তারা পর্দা করতে বাধ্য। কিন্তু সে পর্দা তাদের সৌন্দর্য কোনো অংশে কমিয়েছে বলে মনে হল না। যে সব মেয়েরা মনে করে, অঙ্গ প্রদর্শনের মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধন হয়, কিংবা আকর্ষণ বাড়ায়, তাদের একবার এই ইরানি মেয়েদের দেখে যাওয়া উচিৎ।
না, আমাকে কোনো মতেই প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী কিংবা নারী বিদ্বেষী ভাবার কোনো কারণ নেই। না আমি কোনো কপট, বৈড়ালব্রতী কেউ। মনে প্রাণে আমি একজন প্রগতিশীল মানুষ। নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং ব্যক্তিজীবনে তা পালনও করি। আমার স্ত্রী কিংবা বোনদেরকে কখনও পর্দা করতে বাধ্য করিনি। আমি বিশ্বাস করি, শরীরের পর্দার আগে মনের পর্দাটা জরুরী। আর পোশাক হল যার যার ব্যক্তিগত রুচি ও ইচ্ছার ব্যাপার। যে যাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে নিজেকে যেমন সাজাতে পছন্দ করে। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, একজন পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে যখন একজন নারীর দিকে তাকাই, তার প্রকাশিত সৌন্দর্য চাইতে তার অপ্রকাশিত সৌন্দর্যই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে।
ইরানি ললনাদের কাজল কালো আঁখি দেখে আমিও ডুবে গিয়েছিলাম আর এক জোড়া কাজল দিঘি চোখের মাঝে। যে হয়ত হাজার মাইল দূরে বসে এখন ভাবছে আমারই কথা। ভাবছে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ পানে শূন্য দৃষ্টি মেলে। আসতে চেয়েছিল মেয়েটি ঢাকা পর্যন্ত আমাকে বিদায় জানাতে। আমিই রাজী হইনি। বিদায়, হোক সে খুলনায় কিংবা ঢাকায়, কষ্ট তো একই। কী লাভ তাহলে সে কষ্ট ঢাকা পর্যন্ত টেনে এনে ? তাছাড়া চাইলেই তো হবে না, পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় ওঠার মতো কোনো জায়গা আমার ছিল না। ছিল না হোটেলে ওঠার মতো সামর্থ্য। এমন কত চাওয়াই তো অপূর্ণ থেকে গেছে এ জীবনে। তার সাথে আর একটা যোগ হলে এই পৃথিবীর তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। ঢোক গিলে বুকের দীর্ঘশ্বাসটা পেটে চালান করে দেই। এমন সময় পাশের সীটে বসা ইরানি সহযাত্রীর কথায় চমকে উঠি।
নাহয় সবাই ধরেই নিয়েছে আমি ডাক্তার। তাই বলে ফারসিও জানি এটা ধরে নেয়ার কী কোনো কারণ আছে ? আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকাই। কোট প্যান্ট পরা পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক। কাঁচা পাকা দাড়িতে দারুণ সুদর্শন লাগছে তাঁকে। সে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে এবার পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে ওঠে,
- তুমি কি ডাক্তার ?
- হ্যাঁ।
- এবং তুমি ফারসি জানো না।
- ঠিক ধরেছ। আর তোমরা ইংরেজি জানলেও ফারসিতেই কথা বলতে শুরু করো।
- কী করব বলো ? জবানে মা খাইলি শিরীন হাস্ত। অর্থাৎ আমাদের ভাষা খুব মিষ্টি। তাই বলার লোভ সামলাতে পারি না।
বলেই গলা ছেড়ে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক। যেন খুব মজার কোনো জোক বলে ফেলেছেন। আমি যেন তাঁর বহুদিনের পরিচিত একান্ত আপন কেউ। প্রথম দেখায় এমন অমায়িক ব্যবহার আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করে। একটু রসিকতা করার লোভ আমিও সামলাতে পারি না। হেসে বলি,
- তাহলে তো তোমাদের দেশে বেশি দিন থাকা যাবে না। তোমরা দেখতে শিরীন। তোমাদের কথা শিরীন। না জানি তোমাদের খাবারও কত শিরীন। শেষে আমার ডায়াবেটিস না হয়ে যায় !
- তা একেবারে ভুল বলোনি দকতোর। একটু সাবধানে থেকো। দেখতে শিরীন তুমিও কম নও। ডায়াবেটিস না হলেও শিরীনে শিরীনে যে এশক হয়ে যেতে পারে, তাতে সন্দেহ নাই।
ভারি মজার লোক তো ! এদের চেহারা আর ভাষাই শুধু মিষ্টি না। এদের কথা বলার ধরণটাও খুব মিষ্টি। হতেই হবে। যে দেশ ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, হাফিজ, রুমীর মতো কবিদের জন্ম দিয়েছে, যাদের কবিতা হাজার বছর ধরে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে আজও গুঞ্জরিত হয়, তাঁদের সব কিছু যে মিষ্টি আর প্রেমময় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। শুনেছি, এই শিরীনদের আশিকি হয়ে অনেক ডাক্তারই এ দেশে ঘর বেঁধেছেন। ভাগ্যিস, বিয়েটা করে এসেছি, নইলে কী হত বলা যায় না। হেসে বললাম,
- সে সম্ভাবনা নেই জনাব। আমি লেজ কেটেই এসেছি।
- দরজা বন্ধ করলেই কি চুরি ঠেকানো যায় ইয়াং ম্যান? কমবখত ইশক যে সিঁধেল চোর। কখন সিঁধ কেটে মন চুরি করে নিয়ে যাবে টেরও পাবে না। হা হা হা।
আবার সেই দরাজ গলায় অমায়িক হাসি। লোকটার কথায় আমি কেমন সম্মোহিত হয়ে পড়ি। এমন সময় মেশক আম্বরের মৌ মৌ গন্ধে সে সম্মোহন কেটে যায় আমার। মিষ্টি বিমান বালা ট্রে ভর্তি করে ফল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছে। দু’ঘণ্টার ফ্লাইট। তাই কোনো ভারি খাবার নয়। সে খাবার খেতে খেতে আলোচনার মোড় ঘুরে যায়।
কথা যা বলার, তিনিই বলে চলেন। নাম হামেদ জায়েদী। তেহরান ইউনিভার্সিটিতে ফিলসফির প্রফেসর। পৃথিবীর তাবৎ মাষ্টাররা বুঝি একটু বেশিই কথা বলেন। খোরাসানের লোক। ওমর খৈয়ামের জন্মভূমিতে জন্ম বলেই হয়ত তাঁর কথা এমন প্রেমের দর্শন। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের আগে আমেরিকায় ছিলেন। তাঁর ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতার কারণ বোধহয় এটাই। তবে একটা ব্যাপার অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমরা যেখানে একটু সময় পেলেই রাজনৈতিক আলোচনায় মেতে উঠি, তিনি সেখানে ইরানের বিপ্লব, যুদ্ধ কিংবা রাজনীতি নিয়ে কিছুই বললেন না। আমিও উপযাচক হয়ে কিছু জানতে চাইলাম না। বরং বললাম,
- আমি বাংলাদেশী। ডাক্তার হিসাবে চাকরী নিয়ে এই প্রথম তোমাদের দেশে যাচ্ছি। তোমাদের দেশের মানুষেরা কি তোমার মতোই ভালো ইংরেজি বলে ?
- না। উল্টো। ঐ যে বললাম না, আমরা আমাদের ওয়াতান আর জবানের আশিক। তবে চিন্তা করো না। ফারসি খুব সহজ ভাষা। তুমি খুব তাড়াতাড়ি শিখে যাবে।
শুধু ফারসি নয়, ইরান সম্পর্কেও তেমন কোনো ধারনা নেই আমার। ধারনা বলতে উচ্চমাধ্যমিকে পড়া শাহনামা ও মহাকবি ফেরদৌসির উপরে পড়া একটা প্রবন্ধ। জানি না, পোস্টিং আমার ইচ্ছায় হবে না কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় হবে। তবে একটু ধারনা থাকা ভালো। লোকটা যেহেতু ভালো ইংরেজি জানে, তার কাছ থেকেই ধারনা নেয়া যাক। জানতে চাইলে সে জানালো, একত্রিশটা প্রভিন্স নিয়ে ইরান। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রভিন্স বেশ উন্নত, জীবনযাত্রার মান ভালো। যেমন তেহরান, ইস্পাহান, মাজান্দারান, সেমনান, মাশহাদ, সিরাজ, কুম, ইত্যাদি। এ সব প্রদেশে শিক্ষার হারও বেশ ভালো। তবে সব চেয়ে খারাপ হল সিস্তান ও বালুচিস্তান। জানতে চাইলাম,
- খারাপ কেন ?
- কারণ এটা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বর্ডারে। অধিকাংশই বালুচ পাঠান। অশিক্ষিত, বর্বর, স্মাগলার।
- স্মাগলার ?
লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার দিকে একটু ঝুঁকে আসে। যেন গোপন কিছু বলবে। সত্যি সত্য গলা নামিয়ে বলে,
- আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে যত পপির চাষ হয়, মানে যা থেকে হেরোইন তৈরি হয়, তার প্রায় নব্বই ভাগ বালুচিস্তান দিয়ে ইউরোপে যায়।
- বলো কী ? তোমাদের সরকার কিছু বলে না ?
- বলবে কী ? ওরা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। ওদের আছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। এলাকাটা দুর্গম পাহাড়ি, মরুভূমি। কিন্তু ওদের নখদর্পণে। তাই আমাদের আর্মিরা সব সময় ওদের সাথে পেরে ওঠে না। তাছাড়া ট্রাইবাল মারামারি তো আছেই।
শুনে শিউরে উঠি আমি। মনে মনে বলি, খোদা আর যেখানেই হোক, সিস্তান বালুচিস্তানে যেন পোস্টিং না হয়। এর মধ্যেই ফ্লাইট ল্যান্ডিং এর ঘোষণা হয়। আমাদের আলোচনা আর এগোয় না। ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করেই নেমে গেলেন। কেন ? সে কি ড্রাগ স্মাগলিং এর কথা বলে ফেলেছেন বলে ? আমি জানি না। আর কোনদিন দেখা হয়নি। কতকাল কেটে গেছে। বাকপটু সেই প্রফেসরের কথা আমার আজও মনে আছে।
তেহরানের মেহরাবাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামতে নামতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। তখনও তেহরান ইমাম খোমেনি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট তৈরি হয়নি। মেহরাবাদ এয়ারপোর্ট যথেষ্ট বড় হলেও দুবাইয়ের মতো চকচকে ঝকঝকে নয়। আর হবেই বা কেমন করে ? আট বছরের যুদ্ধে ইরানের অর্থনীতি তখন বিপর্যস্ত। তার উপর এই এয়ারপোর্ট বহুবার ইরাকি বিমান বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছে। যদিও সে আক্রমণের কোনো ক্ষত আমি দেখতে পেলাম না।
ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা হল না। ফ্লাইট এটেন্ড্যান্ট সবাই মহিলা হলেও ইমিগ্রেশন অফিসার সবাই পুরুষ। পাসপোর্টের ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে ঠকাস করে সীল মেরে দিল ! পাসপোর্ট ফেরত দিতে দিতে হেসে বলল,
- খোশ আমোদিদ অগাই দকতোর। বেফারমাইন।
এবার আর ডাক্তার শুনে অবাক হলাম না। পাসপোর্টে নামের সামনে ডাক্তার লেখা আছে। তবে ইমিগ্রেশন অফিসারের ইংরেজি না জানার কথা নয়। তবু ফারসিতেই স্বাগত জানাল ! বুঝলাম, আসলেই এরা আপন ভাষার প্রেমিক। আমরা যেখানে ভাষার জন্য জীবন দিয়েও কথার মধ্যে দু’চারটে ইংরেজি বুলি না আওড়ালে জাতে উঠি না, ওরা সেখানে পারতে সাধ্যে ইংরেজিতে কথাই বলে না। ভাষার জন্য জীবন দেয়া এক জিনিষ, আর সে ভাষাকে সর্ব স্তরে চালু করা অন্য জিনিষ। আমরা কবে তা শিখব কে জানে ?
ইমিগ্রেশন শেষে এরাইভাল লাউঞ্জে একে একে জড় হলাম হারাধনের সাতটি ছেলে। আমাদেরকে বলা হয়েছিল, ইরানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে লোক আসবে আমাদের রিসিভ করতে। ভেবেছিলাম প্ল্যাকার্ডে “ডক্টরস ফ্রম বাংলাদেশ” জাতীয় কিছু লিখে একজন কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে লাউঞ্জে। তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। আমাদের কাছে কোনো কন্টাক্ট নম্বর বা নামও নেই যে যোগাযোগ করব। একা হলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতাম। সাতজন একসাথে আছি। এটাই ভরসা। তাছাড়া এ পর্যন্ত ইরানিদের কাজের যে ধরণ আমরা দেখেছি, তাতে এমনটা হওয়ার কথা নয়। হলও না। কেতাদুরস্ত একজন ভদ্রলোক বলে উঠলেন,
- স্যরি দকতোরস। উই আর বিট লেত।
যাক বাবা, বাঁচা গেল ! বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কিন্তু এরপর তিনি যেটা করলেন, সেটার জন্য আমরা ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। টেলিভিশনের খবরে দেখেছি, বিদেশ থেকে কোনো সরকারী মেহমান এলে দেশীয় কর্মকর্তারা সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর কুশল বিনিময় করে। এখানে তিনি আমাদের প্রত্যেকের সাথে হাত মেলালেন আর জানতে চাইলেন, “ হাউ আর ইউ দকতোর”? শুধু তিনিই নয়, তেনার সাথে দু’জন সহকারীও এসেছেন। তারা আরও এক কাঠি বাড়া। শুধু হাতই মেলালেন না। অনেকক্ষণ ধরে হাত ঝাঁকাতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন, “ হালে শুমা খুবে ? খুব হাস্তিদ ? সালেম হাস্তিদ ? খোশ হাল হাস্তিদ ? “
এ কোন জ্বালায় পড়লামরে বাবা ? এ সবের মানে কী ? পাকিস্তানিদের “পহলে আপ, পহলে আপ” এর গল্প শুনেছি। এ কি সে রকমই কিছু ? কিন্তু এ সবের জবাবে কী বলতে হয়, তা জানি না। আমরা এ ওর মুখের দিকে চাই আর যা’ই বলে, জবাবে থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, বলে চালিয়ে দেই। মিনিট দশেক ধরে চলল এই “হালে শুমা” এর পালা। কিন্তু আমাদের অবাক হবার আরও বাকী ছিল। ভদ্রলোক জানালেন, আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। মাল জিনিষ তুলতে যাব, অমনি একদল পোর্টার রে রে করে ছুটে এসে আমাদের লাগেজ কাঁধে তুলে নিলো। দেখে তো আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। অন্যদের কথা জানি না, আমার পকেটে কোনো ইরানি মুদ্রা নেই। বিপদে কাজে লাগবে ভেবে দুশো ডলার সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ভাঙ্গানো হয়নি। এখন ভাঙ্গানোর সময়ও নেই। সবাই গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। যে রাজকীয় অভ্যর্থনা পাচ্ছি, তাতে যদি পোর্টারকে টিপস না দিতে পারি, ইজ্জতের ধুলও থাকবে না।
সাত জনের মধ্যে একজন আমার ক্লাসমেট, ইকবাল হাসান। ছাত্র জীবন থেকেই গম্ভীর, কম কথা বলে। ছাত্র জীবন থেকেই স্বপ্ন দেখে অস্ট্রেলিয়া যাবে। কিন্তু যাচ্ছে ইরান। জানতে চেয়েছিলাম,
- বুঝলাম না। ইরান সরকার কি অস্ট্রেলিয়ার ভিসা দিবো ? শুনছি, ইরানের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক খুব খারাপ ?
- ঠিকই শুনছোস।
- তাইলে ?
- ইরানে বসে যে টাকা কামাই করব সেই টাকা দিয়াই অস্ট্রেলিয়া যাব। তাইলে আর বাপের কাছে হাত পাতা লাগবে না।
তৎকালীন ওয়াপদার চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ডাঃ ইকবাল হাসান। টাকা পয়সা যার কাছে তেজপাতা। অথচ বাপের পয়সায় নয়, নিজের পয়সায় স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। যার জন্য সে তখনও বিয়ে পর্যন্ত করেনি। এমন সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা যার, সে নিশ্চয়ই আমার মতো শূন্য পকেটে ইরান আসেনি ? ফিসফিস করে জানতে চাইলাম,
- দোস্তো, তোর কাছে ইরানি টাকা আছে ? কুলির পয়সা দেওন লাগবো।
সে ভারিক্কী চালে মাথা দোলালে ধরে আমার প্রাণ এলো। যাক বাবা, এবারের মতো বয়াতী বংশের পোলার ইজ্জত রক্ষা পেল।
ডিসেম্বরের শেষ। বাইরে তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। শুনেছি, ইরান ঠাণ্ডার দেশ। তাই হালকা শীতের কাপড় পরে এসেছিলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এয়ারপোর্টে বসে এতক্ষণ টের পাইনি। বাইরে বের হতেই একটা দমকা হিম শীতল বাতাস ধেয়ে এলো। যেন কয়েক হাজার সূচ একযোগে বিঁধে গেল আমার চোখে মুখে। মুহূর্তে শরীরের সমস্ত লোমকূপ চামড়া ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল। এ কোন শীতরে বাবা ? শুধু কি শীত ? সাথে তুষারপাতও হচ্ছে। জীবনে এই প্রথম তুষারপাত দেখা। কিন্তু সে তুষারপাত দেখার মজার নেয়ার অবস্থা নেই আমার। ততোক্ষণে ঠকঠক করে দাঁত দাঁতে বাড়ি খেতে শুরু করেছে।
আমাদের জন্য একটা মিনিবাস অপেক্ষা করছিল। পোর্টাররা তাতেই আমাদের মালপত্র তুলে দিল। আমরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি সেই ভদ্রলোক পোর্টারদের মজুরী মিটিয়ে দিচ্ছেন। আরে করে কী ? করে কী ? এমন ঘটনা যে কল্পনারও অতীত ! আমরা তো শ্বশুর বাড়িতে আসিনি। চাকরী নিয়ে এসেছি। মোটা অংকের মাইনে পাব। এ সব পাতি খরচ তো আমাদেরই করার কথা। ইকবাল ভদ্রতা করে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পয়সা দিতে গেল। অমনি ভদ্রলোক বিনয় বিগলিত কণ্ঠে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
- কোরবানে শুমা বেরাম। খায়েস মিকুনাম দকতোর।
যার অর্থ সেদিন বুঝিনি। পরে জেনেছি, যার অর্থ হল, তোমার জন্য কোরবান হয়ে যাব। এই ইচ্ছাটুকু শুধু পূরণ করতে দাও ডাক্তার। পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় এমন অলঙ্কার ব্যাবহার করে বলে আমার জানা নাই।
মিনিবাসের মধ্যে হিটিং চলছিল। গাড়িতে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। যাত্রীর তুলনার বাসটি বেশ বড়। আমরা সবাই আলাদা আলাদা জানালার পাশে সীটে বসলাম। সেই ভদ্রলোকও উঠলেন। তবে তাঁর সহকারী দুজন উঠলেন না। হয়ত তাদের দায়িত্ব এই পর্যন্তই ছিল।
আমাদের গাড়ি এয়ারপোর্ট ছেড়ে এগিয়ে চলে। দুপাশে যতদূর চোখ যায়, বাড়িঘর, দোকানপাট, গাছপালা, সব তুষারে ঢাকা। সব ধবধবে সাদা। তখনও ঝিরিঝিরি করে পড়ছে তুষার। রাস্তার দুধারে ল্যাম্পপোস্টগুলো একলা দাঁড়িয়ে নিয়ন আলো দিচ্ছে। সে আলো তুষারের গায়ে লেগে রূপালি দ্যুতি ছড়ায়। ধীর গতিতে এগূচ্ছে গাড়ি। ফুটপাথ দিয়ে দু একজন মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কেমন এক নৈসর্গিক পরিবেশ চারিদিক। আমি দুচোখ ভরে সে রূপের সুধা পান করতে থাকি।
মাত্র মাইল সাতেক দূর তেহরান শহর থেকে এয়ারপোর্ট। স্বাভাবিক সময়ে পনেরো মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তুষার ভেজা পিচ্ছিল পথ। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আধঘণ্টা লেগে যায়। ইরানের রূপমুগ্ধ আমার সে সময়টুকু কখন শেষ হয়ে যায়, বুঝতেই পারি না। এক চার তারকা খচিত হোটেলে এসে আমাদের গাড়ি থামে। ততোক্ষণে আমি অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শুধু অপেক্ষায় থাকি, দেখি না ব্যাটারা আর কী কী করে !
সাথের ভদ্রলোক গাড়িতে বসেই জানালেন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা রুম বুক করা আছে। ফর বোথ লজিং এন্ড ফুডিং। যে যার রুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে যেন আধঘণ্টার মধ্যে নীচে লবিতে আসি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সাথে দেখা করতে আসবেন। বলে কী ? আজ রাতেই ? তাও এই তুষার ঝড়ের মধ্যে ? এদের কি খেয়ে দেয়ে আর কোনো কাজ নেই ? কোথায় রুম হিটিং এর ওমে বসে চায়ের কাঁপে চুমুক দেবে আর টিভি দেখবে আর আমরাও বিনে পয়সায় ভূড়িভোজ করে গদি-ওয়ালা বিছানায় ডুবে লম্বা একটা ঘুম দেব, তা না, এই দুর্যোগের রাতেই আসছেন মিটিং করতে ! এতদিন জেনে এসেছি, তেল-ওয়ালা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পুরুষেরা অলস প্রকৃতির হয়, একাধিক বিয়ে করে আর খেয়ে খেয়ে খোদার খাসী হয়। কিন্তু এখানে দেখছি উল্টো ! এরা কি আসলেই এমন নাকি এটা ইসলামী বিপ্লবের ফসল ?
যথাসময়ে আমরা সাত জন লবিতে নেমে এলাম। সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের জন্য লবিতেই অপেক্ষা করছিলেন। তিনিও উঠে এসে সবার সাথে হাত মেলালেন। সবার কুশল আলাদা আলাদা ভাবে জানতে চাইলেন। বুঝলাম এটাই এদের কালচার। এদের সভ্যতা। তারপর একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিলেন। যার সারমর্ম হল, আমাদের এক একজনকে এক এক প্রভিন্সে পাঠানো হবে। প্রভিন্সিয়াল হেড কোয়ার্টার ঠিক করবে, কোন শহরে কাজ করতে হবে। তার হাতে কিছু খাম দেখিয়ে বললেন, এর মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে। আছে দশ হাজার তোমান ( এক লক্ষ ইরানি রিয়াল) প্রাথমিক খরচের জন্য। এই টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাদিয়া স্বরূপ। আমরা গ্রহণ করলে তিনি বাধিত হবেন। আমরা চাইলে দু একদিন এই হোটেলেই সরকারী খরচে মেহমান হিসাবে থাকতে পারি কিংবা কালই যার যার প্রভিন্সে রওনা দিতে পারি। আমাদের যাবার ব্যাপারে ইব্রাহিম খলিলি সব রকম সাহায্য করবে। বলে এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের সাথে আসা ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিলেন।
শুনে সবাই খুব খুশি। এর চাইতে ভালো ব্যবস্থা আর হতে পারে না। যুদ্ধ করতে করতে বোধহয় এদের সব কাজই পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক হয়। মানে আমাদের ভাগ্যে কোন প্রভিন্স পড়বে, তা আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। আমি আবার মনে মনে খোদাকে ডাকতে শুরু করলাম আর ফ্লাইটে বসে প্রফেসর সাহেব, যে সব প্রভিন্সগুলোর নাম বলেছিলেন, তা মনে করার চেষ্টা করলাম। সিস্তান বালুচিস্তান ছাড়া আর কোনোটাই ঠিকমত মনে পড়ছে না। খোদা, এইটা যেন না হয়।
খামগুলো একে একে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হল। সবাই খুলে দেখতে শুরু করল কার কোথায় পোস্টিং হয়েছে। কারও ইস্পাহান, কারো হামাদান, কারও তাবরিজ, কারও খোরাসান। ইকবাল বলল, ওর পড়েছে কেরমান। ভয়ে ভয়ে আমি আমার খামটা খুললাম। ইংরেজিতে লেখা। পড়তেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা সাপ নীচে নেমে গেল !
ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ছে শরীর। চার তারকা হোটেলের মখমল বিছানায় প্রায় ডুবে আছি। অথচ এক ফোঁটা ঘুম নেই দুচোখে। থাকবে কেমন করে ? দু’চোখে যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে এ দেশে এসেছিলাম, পোস্টিং লেটার হাতে পেয়ে এক ফুঁৎকারে তা নিভে গেছে ! শেষ পর্যন্ত ইরানের সব চেয়ে খারাপ জায়গাটায়ই আমার পোস্টিং হল ? এখন মনে হচ্ছে, ফ্লাইটে বসে প্রফেসর সাহেবের সাথে দেখা না হলেই ভালো হত। তাঁর দুই ঘণ্টার বিনে পয়সার লেকচার শুনে সিস্তান বালুচিস্তান সম্পর্কে যে ধারণা আমার জন্মেছে, তাতে সেখানে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা আমার অবশিষ্ট নেই। তা শুধু এ জন্য নয় যে প্রফেসর সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী বালুচরা অশিক্ষিত, বর্বর এবং ড্রাগ স্মাগলার জনগুষ্ঠি। বরং এ জন্যও যে, তারা এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ জাতি। যদিও ততদিনে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী মুজাহেদীনদের হাতে নাকানি চুবানি খেয়ে পালিয়েছে, তারপরেও সেখানে নজিবুল্লাহ সরকারের সাথে মুজাহেদিনদের গণযুদ্ধ চলছে। ইরানে যুদ্ধ থেমে গেলেও সীমান্তের ওপারে চলমান সেই যুদ্ধে আঁচ কতটা এপারে এসে লাগছে, তা কে জানে ?
এই সব চিন্তায় আমার গলা দিয়ে খাবারও নামল না তেমন। অথচ আমার সহযাত্রীদের সে সব দুশ্চিন্তার কোনো বালাই নেই। তারা মহা খুশিতে হোটেলের লঙ্গরখানায় গলা ডুবিয়ে খেল। তার পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো, এখানে বেকার বসে থাকার কোনো মানে নেই, কালই যে যার গন্তব্যে রওনা দেবে। আমাকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে বন্ধু ইকবাল বলল,
- তুই মুখটারে বাংলার পাঁচ বানাইয়া বইয়া রইছস ক্যান ? তর তো সব চাইতে ভালো পোস্টিং হইছে।
- তুই বুঝলি কেমনে ?
মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে অবাক হবার ভান করে জানতে চাইলাম। ইকবাল সবজান্তার ভাব নিয়ে ভারিক্কী চালে বলল,
- ইরানে যে সব প্রভিন্সে সব চেয়ে বেশি বেতন দেয়, সিস্তান বালুচিস্তান তার মধ্যে একটা।
আমি তখনও জানতাম না, ইরানে এক এক প্রভিন্সে ডাক্তারদের বেতন এক এক রকম। শুধু তাই নয়, একই প্রভিন্সে বিভিন্ন শহরে ডাক্তারদের বেতন বিভিন্ন। কিন্তু বেতন বড় না জীবন বড় ? আমার গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে,
- সাধে কী আর দেয় ? সব চেয়ে খারাপ জায়গা বইলাই সব চেয়ে বেশি বেতন দেয়।
- খালি বেশি বেতন না, বালুচরা সব সুন্নি। খুবই ভালো মানুষ।
- আরে ব্যাটা, সুন্নি ধুইয়া আমি কি পানি খামু নাকি সুন্নিগো মাইয়া বিয়া করমু ?
- দোস, চ্যাতোস ক্যান ? আমার কী দোষ ? আমি যা শুনছি, তাই কইলাম।
আমার রাগের কারণ বুঝতে না পেরে ইকবাল থতমত হয়ে বলে। তাই তো, ওর কী দোষ ? বালুচিস্তান সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, ও হয়ত তা শোনেনি। তবে ওকে সে সব কথা বলিও না। কী লাভ বলে ? যা হবার, তা তো হবেই। নিজের দুরবস্থার কথা বলে অন্যের সহানুভূতি অর্জন ভীষণ অপছন্দ আমার। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসি।
জীবনে এই প্রথম টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আমার। বেড সাইড টেবিলে টেলিফোন রেখে ঘুমানোর মতো সৌভাগ্য হয়নি তখনও। কোথায় আমি ? বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। টেলিফোনটা তখনও বিকট শব্দে বেজে চলেছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে হোটেলে কে ফোন করল আমায় ? ফোনটা তুলতেই শুনি,
কবজি উল্টে ঘড়িতে দেখি সকাল নয়টা। কাল রাতে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম। কখন নয়টা বেজে গেছে, টের পাইনি। কাঁচের জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি তুষারপাত নেই। তবে মুখ ভার করে আছে তেহরানের আকাশ। সেই সাথে ভারি হয়ে আছে আমার মন। “আসছি” বলে ফোনটা কেটে দেই। এ কোন দেশে এসে পড়লাম রে বাবা ? কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ন’টায় এসে হাজির ? তাও আবার এই তুষারে মোড়া শীতের সকালে ? বুঝলাম, এ দেশে ন’টার গাড়ি বারোটায় ছাড়ে না। আমি দ্রুত ফ্রেস হয়ে নীচে নামি।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা দেশ ইরান। আছে দুর্গম পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, মরুভূমি। সে হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নতই বলা যায়। প্রতিটা প্রাদেশিক রাজধানীর সাথে রয়েছে তেহরানের বিমান যোগাযোগ। আছে আন্তঃপ্রাদেশিক বাস। তবে প্রাকৃতিক কারণেই অনেক প্রদেশের সাথে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনও। সিস্তান বালুচিস্তান তাদের মধ্যে একটি। আমাকে যেতে হবে হয় বিমানে, নয় বাসে। সব খবর নিয়েই এসেছেন ইব্রাহিম খলিলি। সিস্তান বালুচিস্তানের রাজধানী জাহেদান। তেহরান জাহেদানের বিমানের টিকেট আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত নেই। অন্যান্য রুটেও একই অবস্থা। ভূমি পথ দুর্গম বলে ইরানিরা আকাশ পথে যেতে পছন্দ করে। তাই এই অবস্থা। তবে বাকিদের যাওয়ার উপায় ইতিমধ্যেই ঠিক হয়ে গেছে। সবাই আজই যাচ্ছে। কেউ ট্রেনে, কেউ বাসে। আমিই সবার শেষ নেমেছি। আমাকেও বাসেই যেতে হবে। নইলে এক সপ্তার একাকী অপেক্ষা ! জানতে চাইলাম,
বলে কী ? দেড় হাজার কিলোমিটারের উপরে ? খুলনা থেকে বাসে করে তিনশো কিলোমিটার দূরে ঢাকায় যেতেই আমার হালিস বেরিয়ে যেত, লাগত আট থেকে নয় ঘণ্টা ! এই হাড় কাঁপানো শীতে বাসে করে তার চেয়ে পাঁচগুণ পথ পাড়ি দিতে হবে ? ভাবতেই আমি জমাট বরফ হয়ে গেলাম ! তবু ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম,
- কতক্ষণ লাগবে যেতে ?
- তাকরিবান হাজদাহ ছা’ত। প্রায় আঠেরো ঘণ্টা।
মাত্র ! পাহাড়ি রাস্তা। আঁকাবাঁকা। আছে চড়াই উৎরাই। বাস কি রাস্তা দিয়ে চলবে নাকি আকাশ দিয়ে ? ব্যাটা মিথ্যা বলছে না তো ? নাকি এটাও এক ধরণের “ইন হাস্ত ওয়াতানাম” এর মতো স্বদেশ প্রেম ? হঠাৎ আমার জেদ চেপে যায় ? আমিও দেখতে চাই, আমার তিন আঙ্গুল কপালে কতটা ভোগান্তি লেখা আছে ? আঠেরো ঘণ্টাই লাগুক, আর আঠেরো দিনই লাগুক, আমার আর কিচ্ছু আসে যায় না। বালুচিস্তান জান্নাতই হোক কিংবা জাহান্নামই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এই পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে চাই আমি। জানতে চাইলাম,
- আজ যাওয়া যাবে ?
- হ্যাঁ, যাবে। তোমার জন্য টিকেট বুক করা আছে। দুপুর দু’টোয় ছাড়বে। তৈরি হয়ে নাও।
এতক্ষণে অরিন্দম বুঝিল বিষাদে ! সবই তাহলে আগে থেকে ঠিক করা আছে ? হুদাই আমাগো মতামত চাইতাছে ? আসলে এক রাইতের বেশি হোটেলে রাখবো না। সবারই টিকেট আজ দুপুরের পর। সবাইকেই দুপুর একটার মধ্যে চেক আউট করতে হবে। ওরা কি আগে থেকেই জানত, ফাঁকিবাজ বাঙালি আমরা ? তাই ফাঁকি দেয়ার ফাঁক ফোঁকর আগে থেকেই বন্ধ করে রেখেছে ! বুঝলাম ভালোই গ্যাঁড়াকলে পড়তে যাচ্ছি !
ঢাকার রাস্তায় তখন দু একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ প্রাইভেট কার কদাচিৎ চোখে পড়ত। তখন ধারনা ছিল, ভীষণ বড় কোনো সরকারী আমলা, মন্ত্রী কিংবা অসম্ভব রকমের ধনী মানুষেরা এই গাড়ি ব্যাবহার করে। বাসও যে মার্সিডিজ বেঞ্জ হয়, ইরানে এসে এই প্রথম দেখলাম। সেই বাসে উঠে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া। মনে হল, বোয়িং সেভেন জিরো সেভেনে উঠেছি। মখমল কাপড়ে মোড়া সীট, বিমানের চাইতেও প্রসস্থ আর আরামদায়ক। বাসের মেঝেও কার্পেট দিয়ে মোড়া। বাইরে যেখানে শরীর হিম করা শীত, বাসের ভিতরে সেখানে শরীর জুড়ানো কোমল উষ্ণতা। পথের কষ্টের ভয়ে শরীরে যে আড়ষ্টতা জন্মেছিল, এ সব দেখে মুহূর্তে তা কেটে গেল। এতক্ষণে বুঝলাম, দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কেন আঠেরো ঘণ্টার বেশি লাগবে না।
সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার বাসে উঠে বসলাম। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দুটায় মৃদু গুঞ্জন তুলে বাস চলতে শুরু করে। অবাক হয়ে দেখি, আমার পাশের সীটে কোনো যাত্রী নেই। হয়ত সামনে কোথায়ও থেকে উঠবে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। সকাল থেকে তুষারপাত না হলেও সূর্য ঘুমিয়ে ছিল মেঘের আড়ালে। এতক্ষণে তিনি ঘুম থেকে উঠে মেঘের চাঁদর সরিয়ে উঁকি দিয়েছেন পশ্চিম আকাশে। সূর্য উঠলেও তাপমাত্রা শূন্যের নীচে। বাড়ির ছাদ, ঘরের কার্নিশ, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, গাছের পাতা, সব খানেই জমে আছে থোকা থোকা তুষার। সূর্যের আলো সে তুষারে লেগে এক অপার্থিব রূপালী আভা ছড়ায়। আমি দু’চোখ ভরে প্রকৃতির সেই রূপের সুধা পান করতে থাকি।
ইরান ইরাক সম্মুখ যুদ্ধ মূলত সীমাবদ্ধ ছিল সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে। তবে ইরাকি বোমারু বিমানগুলো বারবার আক্রমণ চালিয়েছিল ইরানের বড় বড় শহরগুলো উপর। বিশেষ করে রাজধানী তেহরানে। কাল রাতে তেমন কিছু চোখে না পড়লেও আজ দিনের আলোয় দেখতে পেলাম তার বিভীষিকা। দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কত ঘর বাড়ি, ইমারত, অট্টালিকা। তেল সমৃদ্ধ দেশ ইরানের শরীর থেকে হয়ত এ ক্ষত একদিন মুছে যাবে, কিন্তু যে সব মায়ের কোল খালি হয়েছে, যে সব শিশু এতিম হয়েছে, যে সব নারী বিধবা হয়েছে, তাঁদের মনের ক্ষত কী কোনদিন মুছবে ? কী এমন প্রয়োজন ছিল এই যুদ্ধের, যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়নি কোনো দেশ, শুধু পরাজিত হয়েছে মানবতা ?
বেশ বড় শহর তেহরান। আমাদের বাস শহর ছেড়ে বের হতে হতে আধ ঘণ্টার বেশি লেগে যায়। অথচ আমার পাশের সীটে কোনো যাত্রী ওঠে না। তেহরান জাহেদান আন্তঃ প্রদেশ বাস। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মতো পথে পথে লোক ওঠাবে না। তার মানে পুরো পথ আমি দুই সীট নিয়ে একাই যাব। বাহ, এই প্রথম আমার তিন আঙ্গুল কপালটাকে সাড়ে তিন আঙ্গুল মনে হয়। আমি পাশে সীটে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে বসি।
বাইরে যতদূর চোখ যায়, দিগন্ত বিস্তৃত তুষার ঢাকা ধবল প্রান্তর। তারই মাঝখান দিয়ে মসৃণ কালো পিচ ঢালা পথ। যেন একটা সাদা কাগজে কেউ কালো কালি দিয়ে একটা লম্বা দাগ টেনে দিয়েছে। সে পথ বেয়ে আমাদের বাস তীব্র গতিতে এগিয়ে চলে। ভেতরে বসে বোঝাই যায় না, গাড়ি রাস্তা দিয়ে চলছে, নাকি আকাশ দিয়ে। দূরে, আরও দূরে, দিগন্তের কোল ঘেঁষে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে, হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে সাড়ি সাড়ি পাহাড়। পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আলোয় পাহাড়গুলোকে সোনার পাহাড় বলে মনে হয়। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ বালুচিস্তান নিয়ে আমার অনাগত দিনগুলির দুশ্চিন্তাকে ভুলিয়ে দেয়।
শীতের বিকেল গড়িয়ে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামে। ডুবে যাবার আগে সূর্য মামা পশ্চিম আকাশে আবির ঢেলে দেয়। গাড়িতে হিটিং চললেও আমার কেমন শীত করে ওঠে। সামনের সীট পকেটে দেখি প্যাকেট করা কম্বল রাখা। তারই একটা খুলে আমি গায়ে জড়িয়ে নেই। আহা ! প্রেয়সীর বুক ছাড়া এমন মোলায়েম ওম পাইনি কোথাও। বাংলাদেশে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। ঘরের পাশে শিউলি গাছের তলে, জোনাকিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে পিদিম। সে জোনাক আলোয় এক জোরা কাজল চোখ কি খুঁজছে আমায় ? জংলী ঝোপের মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার দল গুনগুন করে গাইছে গান। সে গানের সুরে কেঁদে উঠছে কি আমার জোনাক রাণীর প্রাণ ?
হঠাৎ অনেক মানুষের কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। দেশের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। চোখ মেলে দেখি যাত্রীরা কথা বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছে। চলে এসেছি ? এত তাড়াতাড়ি ? নাহ। ঘড়িতে কেবল রাত আটটা বাজে। মাত্র ছয় ঘণ্টা চলেছে গাড়ি। বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা আরও অনেক বাস দাঁড়িয়ে। আছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফলের দোকান, পেট্রোল পাম্প। বুঝলাম, সাময়িক যাত্রা বিরতি। ইরানে আসার পর এই প্রথম খুধাটা বেশ ভালো ভাবে অনুভব করি। হোটেলে ইরানি খাবার তেমন মুখে রোচেনি আমার। নতুন দেশে নতুন ধরণের খাবার। অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। কী খাওয়া যায় ? দেখি সীট পকেটে বেশ বড়সড় একটা প্যাকেট। খুলতেই বেরিয়ে পড়ে না না ধরণের খাবার। সবই ড্রাই ফুড জাতীয়। কেক, বিস্কুট, ক্র্যাকারস, সুইটস, জুস। একজনের জন্য অনেক। বাইরে দোকানে থরে থরে সাজানো বাহারি ফল। কিনছে অনেকেই। আমারও কেনার লোভ হল। তাছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া দশ হাজার তোমানের এক পয়সাও খরচ হয়নি তখনও।
এখন বাংলাদেশের হাটে বাজারে, রাস্তায় ফুটপাতে, অলিতে গলিতেও দেখা যায় প্রচুর ফলের দোকান। মৌসুমি ফল ছাড়াও এখন দোকানে দোকানে আপেল, আনার, আঙ্গুর, কমলা, মালটার ছড়াছড়ি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এমনটা দেখা যেত না। দু একটা অভিজাত ফলের দোকানে পাওয়া যেত আপেল, আঙ্গুর, কমলা। বিবেচিত হত রুগীর পথ্য হিসেবে। বড়লোকেরা সে সব ফল নিয়মিত খেত কিনা জানি না। তবে সিনেমায় দেখতাম, চৌধুরী সাহেবদের ডাইনিং টেবিলে জ্যাম, জেলি, পাউরুটির সাথে এক ফানা সাগর কলা ও আপেল সাজানো থাকত। আর জলসা ঘরে সুন্দরী সাকী সুরার সাথে এক ছড়া আঙ্গুরও রাজা বাদশাহদের ঠোঁটের কাছে তুলে ধরত। গরীবের ঘরে জন্ম নেয়া এই আমার কাছে দূর থেকে দেখা সে আঙ্গুর ফল বরাবরই টক মনে হত।
দশ হাজার তোমান পকেটে নিয়ে নিজেকে অনেকটা রাজা বাদশাহর মতোই মনে হয়। শুনেছি, আঙ্গুর ফল পচিয়ে মদ তৈরি হয়। সে মদ নাকি শরীরে উত্তাপ ছড়ায়। পচা না হোক, তাজা আঙ্গুর খেলে কিছুটা হলেও নিশ্চয়ই শরীরটা গরম হবে। দেশে দেখেছি, আঙ্গুরের ছড়া সুতোয় বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। এখানে দেখলাম, ঝুড়ির মধ্যে স্তূপাকারে ফেলে রেখেছে। আমার ফারসির জ্ঞান তখন পর্যন্ত হালে শুমা খুবে, বেফারমাইন আর খায়েশ মিকুনাম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আঙ্গুরকে ফারসিতে কী বলে তাও জানি না। তাই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, হাউ মাচ ?
দোকানী এক গাল হেসে বলল,
- হালে শুমা খুবে দকতোর ? বেফারমাইন।
এখানেও দকতোর ? আমি এদিক ওদিক তাকাই। নিজেকে ছাড়া আর কোনো ভিনদেশী নজরে এলো না। বুঝলাম, ব্যাটারা বিদেশী দেখলেই ধরে নেয় ডাক্তার। তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু “এই হালে শুমা খুবে” এর জবাবে কী বলব ? থ্যাংক ইউ ? তা নাহয় বললাম। কিন্তু ভাষা না জানলে দরদাম করব কেমন করে ? আমরা বাঙ্গালীরা তো আবার দরদাম না করে কোনো জিনিষ কিনতে পারি না। ব্যাটা বিদেশী পেয়ে শেষ পর্যন্ত কল্লা কাটা দাম না নিয়ে নেয় ! নিলে নিবে। কুছ পরোয়া নেহি। মেরে পাছ বহুত পয়সা হ্যায়। আমি এবার আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুর ছুঁয়ে জানতে চাই,
- হাউ মাচ ?
- দকতোরে জাদিদ হাস্তিদ ? হান্দ্রেদ তোমান কিলো।
যাক, কিছুটা হলেও ইংরেজি জানে। কিন্তু বলে কী ? আঙ্গুরের কিলো একশো তোমান ? হোটেলে বসেই জেনে নিয়েছিলাম, খোলা বাজারে এক তোমান বাংলাদেশের চার আনার সমান। সে হিসাবে কিলো মাত্র পঁচিশ টাকা ! এই টাকায় তো দেশে এক কিলো টক বড়ইও পাওয়া যায় না। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। নিশ্চিত হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করি,
- ওয়ান কিলো ওয়ান হান্ড্রেড তোমান ?
- বালে দকতোর। বেফারমাইন।
বলে উপর নীচ মাথা ঝাঁকায় দোকানী। মুখটা তখনও হাসি হাসি। তখন পর্যন্ত আঙ্গুর কেনার অভিজ্ঞতা বলতে এক ছটাক, দু ছটাক, কিংবা বড়জোর এক পোয়া। তাও দেয়া হত চিনে বাদামের ঠোঙার মতো ছোট ঠোঙায়। আমি বাদশাহ আকবরের মতো মাথা উঁচিয়ে বললাম,
- হাঁফ কিলো।
লোকটা তার তর্জনী সোজা করে জানতে চাইল,
- এক কিলো ?
ব্যাটা কয় কী ? জীবনে এক ছটাক আঙ্গুর এক সাথে খাই নাই। আর এক রাইতে খামু এক কিলো ? নাকি আমারে ধুর ভাবছে ? না বোঝার ভান কইরা আধা কিলোর জায়গায় এক কিলো গছাইতে চায় ? আমিও বয়াতী বংশের পোলা। তর্জনীটাকে ভাঁজ করে অর্ধেক বানিয়ে বললাম,
- নো, হাঁফ কিলো।
লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর আধা কিলো আঙ্গুর মেপে দেয়। ততক্ষণে বেশ কিছু উৎসুক জনতা জমা হয়ে গেছে। আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। সেদিন তাঁদের হাসির অর্থ বুঝতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম, ইরানিরা আঙ্গুর কেনে কিলো হিসেবে কিংবা টুকরি ধরে। আধা কিলো কিংবা পোয়া কিলো নয়।
যাহোক, আমি পকেট থেকে পাঁচশ তোমানের একটা নোট বের করে দোকানীকে দেই। লোকটা দুহাত সামনের দিকে তুলে মাথাটাকে একটু উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
- নেই মিখাম দকতোর।
নেই মিখাম মানে কী ? খুচরা নাই ? আমার কাছেও সব পাঁচশ তোমানের নোট। খুচরা নাই। বললাম।
- আই অলসো ডোন্ট হ্যাভ চেঞ্জ।
- খায়েশ মিকুনাম দকতোর। নেই মিখাম।
আবার নেই মিখাম ? আরে ব্যাটা তুই দোকানদার। তোর কাছে খুচরা নাই, তার আমি কী করুম ? খায়েশ মিকুনাম কইলেই হইল ? আমি মানি ব্যাগ উল্টে দোকানীকে দেখিয়ে বললাম,
- লুক, নো চেঞ্জ।
- কোরবানে শোমা দকতোর। নেই মিখাম।
এ তো মহা জ্বালায় পড়া গেল ! আমি কই কী আর আমার সারিন্দায় কয় কী ? টাকার জন্য কি কোরবানি করে ফেলবে আমাকে ? এবার রেগে মেগে বললাম,
- সো হোয়াট ? গেট চেঞ্জ ফ্রম সামওয়ান।
শুনে সমবেত জনতা এবার শব্দ করেই হেসে ওঠে। যেন আমি এক সার্কাসের জোকার। ভীষণ মজার কিছু করে ফেলেছি। হেসে ওঠে দোকানীও। হাসতে হাসতেই দুহাত মুখের সামনে তুলে এদিক ওদিক নাড়তে নাড়তে বলে,
- দকতোর, পুল নেই মিখাম।
এ কোন বিড়ম্বনায় পড়া গেল ? নে মিখামের সাথে পুলের সম্পর্ক কী ? আমি অসহায় ভঙ্গিতে সাহায্যের আশায় এদিক ওদিক তাকাই। এত মানুষের মধ্যে কি ইংরেজি জানা কেউ নাই ? ফল কিনতে যেয়েই এত বিভ্রাট । চিকিৎসা করতে যেয়ে না জানি কী হাল হয় আমার। এমন সময় যুবক মত একজন এগিয়ে আসল। সম্ভবত কোনো ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল,
- হি দুনত ওয়ান্ত মানি দকতোর।
কয় কী ? দোকানদার ফলের দাম নিবো না ? এমন আজব কথা বাপের জন্মে শুনি নাই। আমি অবিশ্বাসী কণ্ঠে জানতে চাইলাম,
আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারি না। এ কেমন কালচার ? এ কেমন সভ্যতা ? একজন সামান্য ফল বিক্রেতা মেহমানকে সম্মান জানাতে যেয়ে তার ফলের দাম নেবে না ? এমন কালচার পৃথিবীর আর কোনো সভ্যতায় আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি দোকানীকে তার এই অদ্ভুত সভ্যতার জন্য কয়েকবার “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ” বলে দাম না দিয়েই আঙ্গুর নিয়ে চলে আসলাম। অথচ আমি জানতেও পারলাম না, দোকানের কাছে দাঁড়ানো লোকগুলোও অবাক চোখে আমার চলে যাওয়া দেখছে আর মনে মনে বলছে, “এমন অসভ্য লোক বাপের জন্মে দেখি নাই” !
প্লাটিনাম শ্রমিক কলোনিতে এক কামরার বাসায় বড় হওয়া বয়াতী বংশের অষ্টম পুরুষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্সিডিঞ্জ বেঞ্জ বাসের দুই সীট একাই দখল করে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের উপর পা তুলে। তাঁর হাতে টসটসে কালো আঙ্গুরের থোকা। বাইরে বরফ জমা অন্ধকার। ভেতরে হালকা নীলাভ আলোয় রমণীয় উষ্ণতা। বাতাসে ভাসছে কোনো এক নারী কণ্ঠে নেশা ধরানো ফারসি গানের সুর। সে গানের সুরে হালকা হালকা দুলছে তাঁর মস্তক। এই মুহূর্তে বাদশাহ আকবরের সাথে তাঁর তেমন কোনো তফাৎ নেই। তফাৎ শুধু একটাই, শিয়রের কাছে মদের জাম হাতে দাঁড়িয়ে নেই কোনো অপ্সরী সাকী, যে সুরার সাথে সাথে ঠোঁটের কাছে ধরবে তুলে আঙ্গুরের থোকা। বাধ্য হয়ে নিজেই নিজেকে আপ্যায়ন করছেন কল্পনায় ফানুস উড়ানো এক রাতের এই বাদশাহ নামদার।
শুনেছি, মাগনা পেলে বাঙ্গালী আলকাতরাও খায়। আর এ তো রীতিমত বিনে পয়সায় পাওয়া ইরানি আঙ্গুর। কে বলে এই ফল টক ? মুখে দিতেই ভরে যাচ্ছে মিষ্টি মধুর রসে। এত বড় বড় রসালো আঙ্গুর খাওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখিনি কোনো দিন। নিজের সৌভাগ্যকে নিজেরই বিশ্বাস হয় না আমার। জীবনে এই প্রথম বারের মতো হাফ কিলো আঙ্গুরের প্রায় পুরোটাই খেয়ে ফেলি। না, মিথ্যা শুনিনি, দ্রাক্ষারসে চনমন করে ওঠে শরীর। মদিরা নেশায় ভারি আসে চোখের পাতা। বাসের দোলায় দুলতে দুলতে মনে হল, কোনো এক নাম না জানা অষ্টাদশী সুন্দরী কানিজের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি আমি। তার চম্পাকলি আঙ্গুল প্রণয় পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আমার মাথায়, গলায়।
হঠাৎ যেন আগুনের ছাঁকা লাগে আমার মুখে। পুড়ে ওঠে চোখের পাতা। তবে কি কানিজের উষ্ণ কোমল ঠোঁট ছুঁয়ে দিল আমার শুষ্ক শীতল ঠোঁট ? জ্বালিয়ে দিল আমার নাক, চোখ, কপাল ? ঝট করে চোখ খুলি। কোথায় কানিজ ? জানালার কাঁচ ভেদ করা উজ্জ্বল রোদের তপ্ত আলো পড়ছে আমার চোখে, মুখে। ধড়ফড় করে উঠে বসি। তাকিয়ে দেখি বাইরে ঝলমলে সোনাঝড়া রোদ। আকাশে অনেকটা উপরে হাসছে সূর্য কুমার। তুষারের নাম নিশানা নেই কোথাও। ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে প্রকৃতি। এক দিকে ছোট বড় পাথুরে পাহাড়ের সারি। অন্য দিকে দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি। পাহাড়ের গাঁ বেয়েই দুর্বার গতিতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। সেই পাহাড়ের গায়ে, এখানে সেখানে, দাঁড়িয়ে আছে কিছু নাম না জানা পাতাহীন গাছ। সম্ভবত শীতের প্রকোপে ঝড়ে গেছে সব। একই দেশে প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্য দেখিনি আগে।
ঘড়িতে তখন সকাল ন’টা। প্রায় বারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। একবারে এত দীর্ঘ সময় আগে কখনও ঘুমিয়েছি বলে মনে পড়ে না। হয়ত আধা কিলো আঙ্গুরের প্রভাব। সেই সাথে আরও একটা প্রভাব অনুভব করি তলপেটে। বেশ জোরেশোরেই। আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে ? বলেছিল আঠেরো ঘণ্টা। অথচ উনিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমি হাত তুলে সুপারভাইজারকে ডাকলাম। সে কাছে এসে বিনয় বিগলিত কণ্ঠে জানতে চাইল,
- সালামালেক আগাজুন। বেফারমাইন।
এই প্রথম কেউ আমাকে দকতোর না বলে আগাজুন বলল। এই আগাজুনটা আবার কী ? সেটা যাই হোক, তার গবেষণা করার সময় এখন নেই। আমি যতদূর সম্ভব তার বোধগম্য ইংরেজিতে জানতে চাইলাম,
- হাউ লং উইল ইট টেক টু গো টু জাহেদান ?
লোকটা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। বুঝলাম, ব্যাটা ইংরেজির ই ও বোঝে না। আমি আঙ্গুল দিয়ে একবার সামনের দিকে দেখালাম আর একবার হাতের ঘড়ি দেখালাম, মুখে বললাম,
- জাহেদান, হাউ লং ?
চালাক ছেলে, এবার বুঝতে পারল। দাঁত বের করে সেও তার এক আঙ্গুল তুলে মুখে বলল,
- এক সা’ত।
মানে কী ? এক ঘণ্টা ? ততক্ষণ কি অপেক্ষা করতে পারব ? মনে হয় না। যে হারে চাপ বাড়ছে, গাড়ি একটা বড়সড় ঝাঁকি খেলে রীতিমত অঘটন ঘটে যেতে পারে। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম,
- আই নিড টু পি। স্টপ দ্যা বাস।
এবারও সে দাঁত কেলিয়ে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে বলল,
- ইংলিশি বালাদ নিস্ত আগাজুন।
এ তো মহা ফাঁপরে পড় গেল ! আমি যা কই, সে বুঝে না। সে যা কয়, আমি বুঝি না। ব্যাটারে কেমনে বুঝাই, এখনই গাড়ি না থামাইলে বয়াতী বংশের ইজ্জত পানিতে ভাইসা যাইতে পারে। কষ্টে আমার চোখ ফেটে পানি বের হবার জোগাড়। রেগে মেগে খাস বাংলায় বললাম,
- আরে বলদ, পেসাব করমু।
- পেসাব মিকুনি ? বেফারমাইন।
বলে সে আমাকে ওঠার জন্য ঈশারা করে জায়গা করে দিল। আচানক কাণ্ড ! ব্যাটা বাংলা জানে কেমনে ? আর তখনই মনে পড়ল, বাংলা ব্যাকরণে পড়েছিলাম, বাংলা ভাষায় তৎসম ও তৎভব শব্দের সাথে অনেক বিদেশী শব্দও যুক্ত হয়েছে। মুঘল সম্রাট ও সুবে বাংলার নবাবদের ভাষাও ছিল ফারসি। শত শত বছরের শাসনামলে তার অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে। পেসাব সম্ভবত তারই একটি। ভাগ্যিস, নবাবদের ভাষা ফারসি ছিল !
দশ মাসের পোয়াতির মতো আমি খুব সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম। ভেবেছিলাম, লোকটা ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলবে। তা না বলে সে আমাকে আঙ্গুল তুলে বাসে পিছনের দিকে যেতে ঈশারা করল। কয় কী ? বেকুবটা কি আমারে বাসের মধ্যেই আকামটা করতে কইবো ? অবশ্য আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, আমাদের দেশে গাঁও গেরামে খাঁটা পায়খানা বাড়ি থেকে দূরে জঙ্গলে কিংবা বাগানে থাকত। খুব ছোটবেলায় যখন দাদা নানা বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, গভীর রাতে ছোট বেগটা চাপলে চুপি চুপি অন্ধকারে ঘরের বারান্দায় বসে চৌকাঠের নীচ দিয়েই কম্মটি সেরে ফেলতাম। তাই বলে এই বুড়ো বয়সে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এতগুলো লোকের সামনে বাসে বসেই ? আমি অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকাই। অনেকগুলো উৎসুক চোখ তখন দেখছে আমাদের। মুখে তাঁদের মিটিমিটি হাসি। লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। মনে মনে বললাম, ধরণী, দ্বিধা হও। চাকরির খ্যাতা কিলাই। এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে জানলে কোনো দিনই ইরানে আসতাম না। অজান্তেই চিৎকার করে উঠলাম,
- হোয়াট ?
- বেফারমাইন।
বলে লোকটা এক রকম ঠেলেই আমাকে পিছনের দিকে নিয়ে চলল। রাতে খেয়াল করিনি। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, বাসের ইন্টেরিওরোটাই শুধু বিমানের মতো নয়, সুযোগ সুবিধাও বিমানের মতো। একটু এগুতেই দেখি, বাসের একেবারে পিছনে একটা দরজার উপর ইংরেজিতে লেখা “টয়লেট”। আমার সামনে স্বয়ং রেজা শাহ পাহলভীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও বোধহয় এতটা অবাক হতাম না। বাসের মধ্যেও যে ওয়াশরুম থাকতে পারে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
পাখির পালকের মতো হালকা শরীর নিয়ে ঝকঝকে তকতকে টয়লেট থেকে বের হতেই আবার চমকে উঠলাম। দেখি পাশেই আর একটি দরজা থেকে একজন লোক চোখ রগড়াতে রগড়াতে বের হচ্ছে। না, আর একটা টয়লেট নয়, ছোট একটা কামরা, ভেতরে স্লিপিং বেড। বাসের মধ্যে তাহলে ঘুমানোর ব্যবস্থাও আছে ? এত দেখি এলাহি কারবার। পরে জেনেছি, ইরানে লং রুটের বাসগুলোতে দুজন করে ড্রাইভার থাকে, একজন চালায়, অন্যজন ঘুমায়। প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর পালা বদল হয়। যাতে ঘুমের ঝিমুনিতে কিংবা ক্লান্তিতে এক্সিডেন্ট না করে বসে।
পোটলা পুটলি নিয়ে জাহেদান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়য়ের হেড অফিসে যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা। না, চিনতে কোনো অসুবিধা হল না। “মারকাজে বেহদাশত” বলতেই ট্যাক্সি পৌঁছে দিল। শব্দ দুটো ইবরাহিম খলিলি হেফজো করিয়ে দিয়েছিল। জাহেদান ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশের রাজধানী হলেও তেহরানের মতো বড় কিংবা ঝকমকে নয়। এখানকার প্রকৃতির মতোই এই শহরের ঘর বাড়িগুলোও রুক্ষ, ধূলি ধূসর, ম্যাড়ম্যাড়ে। বহুতল ভবন তেমন নজরে পড়ল না। কিছু কিছু বাড়ি ঘরের দেয়াল এই যুগেও মাটি দিয়ে লেপা। মানুষগুলোও তেমন। প্রাগৈতিহাসিক। অধিকাংশের পরনেই লম্বা কুর্তা, কুর্তার উপরে কোট, নীচে খাটো সালোয়ার, মাথায় ইয়া বড় পাগড়ী। এই শীতের সকালেই অনেকে রাস্তা দু’ধারে নানা রকম পসরা সাজিয়ে বসেছে। মনে হল, ইরান ছেড়ে বুঝি আফগানিস্তানের কোনো শহরে ঢুকে পড়েছি।
পরে শুনেছি, এক সময় এই শহরের নাম ছিল নাকি “পানি চোর”! ফারসিতে, দোজদ-আব। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি তাফতানের কাছেই পর্বত ঘেরা এই সমতলে পানি পড়লেই নাকি শুষ্ক বালি মাটি তা গিলে খেতো। তাই নাম হয়েছিল পানি-চোর। কথিত আছে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভী এই শহরে এসে কিছু সাদা কাপড় ও পাগড়ী পরা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ দেখতে পান। যাদেরকে তাঁর কাছে খুব ধার্মিক বলে মনে হয়। ফারসিতে ধার্মিককে জাহেদ বলে। তাঁর খায়েশেই তখন থেকে এই শহরের নাম “পানি-চোর” থেকে “ধার্মিক-গন” বা জাহেদান হয়ে যায়।
যাহোক, ধার্মিকদের এই শহরে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়য়ের প্রাদেশিক অফিসে ঢুকে আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। নিম্নপদস্থ দারোয়ান, আর্দালি আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় সব কর্মচারী নারী। এক অদ্ভুত কায়দায় কালো চাদরে মাথা ও শরীর ঢেকে নিবিষ্ট মনে কাজ করছে। এদেরকে ঠিক রাস্তায় দেখা আলখাল্লা পরা ধার্মিকদের জায়া বা কন্যা বলে মনে হল না। পরে জেনেছি, সিস্তান বালুচিস্তান প্রদেশটি মূলত সিস্তান ও বালুচিস্তান এলাকা নিয়ে গঠিত। সিস্তান, যার প্রধান শহর জাবুল, এর জনগণ প্রধানত শিয়া সম্প্রদায়ের। যাদেরকে কথ্য ভাষায় জাবুলিও বলা হয়। আর বালুচিস্তানের জনগণ বালুচ, পাশতুন ও পাঠান উপজাতির লোক, যারা সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমান। শিক্ষা দীক্ষায় শিয়ারা সুন্নিদের চাইতে অনেক এগিয়ে। মন মানসিকতায় অনেক আধুনিক। অফিসে কাজ করা এই সব নারীদের অধিকাংশই হয় জাবুলি কিংবা অন্য প্রদেশ থেকে আসা শিয়া সম্প্রদায়ের।
আমাকে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ এই অফিসের প্রধান বা রইসে বেহদারীর রুমে নিয়ে যাওয়া হল। রইস সাহেব আমাকে সাদরে গ্রহণ করে বসতে দিলেন। এখানে ভাষার কোনো সমস্যা হল না। ভদ্রলোক চমৎকার ইংরেজি বলেন। জানতে চাইলেন, পথে কোনো তকলীফ হয়েছে কিনা, শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা, খানা পিনা করেছি কিনা, এখন কিছু খেতে চাই কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন আমি শ্বশুর বাড়িতে এসেছি, আর তিনি জামাই আদর করছেন ! সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসে দেয়া শুকনো খাবার খেয়েছিলাম। তাছাড়া আঙ্গুর খেয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, এই মুহূর্তে নতুন করে কিছু খাওয়ার চিন্তা মাথায় নেই আর। চিন্তা শুধু, কোথায় পোস্টিং হবে, সেটা বর্ডারের কতটা কাছে বা দূরে, কেমন সেখানকার মানুষ, পোস্টিং প্লেসে যাবার আগে কতদিন থাকতে হবে জাহেদানে, এই সব। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে তেহরান থেকে দেয়া পোস্টিং লেটারটা দিলাম। তিনি একটু চোখ বুলিয়ে নিয়েই বললেন,
- দকতোর, ইউ আর গোইং টু খাশ।
তার মানে এখানেও আমার নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে আছে ? কিচ্ছু বলার বা করার নেই। আমার অবস্থা অনেকটা, “পড়েছি মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে” এর মতো। রইস আর্দালিকে ডেকে ফারসিতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই চা পরিবেশন করলেন। দেখলাম, রুমের এক কোনেই টেবিলের উপর অদ্ভুত আকৃতির একটা লম্বা জগের মতো পাত্র। যার নীচে হালকা আঁচে জ্বলছে আগুন আর জগের মুখে বসানো একটা টি-পট। চা গরম রাখার জন্য। সেই পট থেকে পরিষ্কার কাঁচের কাপে চা ঢাললেন। লাল চা। সাথে আর একটা বাটিতে অনেকগুলো চিনির কিউব। কিন্তু কোনো চামচ দিলেন না। তাহলে চিনি কিংবা চিনির কিউব গোলাব কী দিয়ে। আমি আবার চিনি ছাড়া চা খেতে পারি না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন রইস। বললেন, ওনারা চিনি গুলিয়ে চা খান না। কান্দ দিয়ে চা খান। চিনির ঐ কিউবগুলোকে ফারসিতে কান্দ বলে। উনি দেখিয়েও দিলেন কী ভাবে কান্দ দিয়ে চা খেতে হয়। কান্দের এক টুকরা আগে মুখে নিয়ে তারপর চায়ে চুমুক দিতে হয়। চা মুখ বেয়ে গলা পর্যন্ত যেতে যেতে কান্দকে গলিয়ে মিষ্টি হয়ে যায়। বড় অদ্ভুত কায়দা ! এত কসরত না করে চায়ের কাপে কান্দ গুলিয়ে নিলেই হয় ! কী আর করা ? যে দেশে যেই রীতি। হোয়েন ইউ আর ইন রোম, ইউ গট টু বি রোমান। আমিও ইরানি হইয়া বেকুবের মতো কান্দ দিয়া চা খাইতে যাইয়া জিভ পোড়াইয়া ফুলাইয়া ফালাইলাম ! সেই ফোলা জিভ মুখের মধ্যে নিয়ে চা ঠাণ্ডা হবার জন্য অপেক্ষা করছি আর ভাবছি, আর কত ভোগান্তি আছে কপালে কে জানে ?
তেহরান থেকে গন্তব্যে রওনা দিতে এক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এখানে এক ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হল না। পোড়া মুখে চা খেতে খেতেই এক লাস্যময়ী রমণী আমার পোস্টিং অর্ডার টাইপ করে নিয়ে এলো। সম্ভবত রইসের প্রাইভেট সেক্রেটারি। এমন উর্বশীর সাহচর্যে ক্লান্তি স্পর্শ করার কথা নয়। রইস চিঠিটায় খস খস করে সাইন করে একটা খামে ভরে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
আমি জানতাম, অনেক বাংলাদেশী ডাক্তার ইরানে চাকরী করে। তাই বলে সিস্তান বালুচিস্তানের মতো দুর্গম এলাকায় স্বদেশী ডাক্তারদের দেখা পাব, এমনটা আশা করিনি। মনটা খুশিতে ভরে গেল। দু’দিনও হয়নি ইরানে এসেছি। অথচ মনে হচ্ছে কতো কাল প্রবাসে আছি। কত কাল বাঙ্গালী দেখি না, বাংলায় কথা বলি না। আজই যদি যাওয়া যেত ! কত দূর এখান থেকে খাশ ? একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলাম,
এখনই ? এরা কি ঘোড়ার পিঠে জিন পরিয়েই রাখে ? মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসেছি ! এখনই আবার ছুটতে হবে ? যদিও বিশ ঘণ্টা জার্নি করেও তেমন টায়ার্ড লাগছে না। লাগবে কেমন করে ? বারো ঘণ্টাই তো আঙ্গুরের নেশায় ঘোড়া বেঁচে ঘুমিয়েছি। তবে এখানে আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। বিশেষ করে যখন শুনেছি খাশে দেশী ভাইয়েরা আছেন। আমি রাজী হয়ে গেলাম। অবশ্য রাজী না হলেও বোধহয় যেতেই হত। কারণ ইতোমধ্যেই আমার লাগেজ গাড়িতে ওঠানো হয়ে গেছে। আমি রইসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আর্দালির সাথে বাইরে এলাম।
গাড়ি কোথায় ? এ তো দেখছি এম্বুলেন্স ! এম্বুলেন্সে করে আমাকে নেয়া হবে খাশে ? তাও আবার মার্সিডিজ বেঞ্জ কোম্পানির তৈরি জীবন রক্ষাকারী সকল সরঞ্জাম সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক এম্বুলেন্সে ? এতদিন মরণাপন্ন রুগী নেয়ার জন্য এম্বুলেন্স আসতে দেখেছি। জীবনে এই প্রথম সুস্থ্য সবল ডাক্তারকে নেয়ার জন্য এম্বুলেন্স আসতে দেখলাম। পরে শুনলাম, ঠিক আমাকে নেয়ার জন্য নয়, এই এম্বুলেন্স খাশ থেকে মরণাপন্ন রুগী নিয়ে এসেছিল জাহেদানের বড় হাসপাতালে। ফেরার পথে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। বাহ, সরকারী ব্যবস্থাপনার কী সুন্দর সদ্ব্যবহার !
বছর তিরিশেক বয়স ড্রাইভারের। দেখে মনে হল বালুচ। আমাকে সসম্মানে তার পাশের সীটে বসতে দিল। পিছনে পেসেন্ট বেডের পাশের সীটে বসল তার সাথী। সম্ভবত হেলথ কেয়ার এসিস্ট্যান্ট। মুমূর্ষু রুগী বহন করতে হলে এম্বুলেন্স ক্রু দুজন থাকতে হয় এবং তাদের জরুরী স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার কৌশল জানতে হয়। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমি ধরেই নিলাম, ড্রাইভার ইংরেজি জানে না। আর আমিও ফারসি জানি না। সুতরাং রাস্তায় কোনো বাৎচিত হবে না। আমি মুখে কুলুপ এঁটে রাস্তার দুপাশে ঘর বাড়ি দেখতে থাকলাম।
- কেইছে হায় দকতোর ছাব ?
চমকে উঠলাম। বালুচ ড্রাইভারের মুখে হিন্দি বোল ? আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারি না। হিন্দি আমিও মোটামুটি বলতে পারি। হিন্দিতেই জানতে চাইলাম,
এরপর যা বলল, তা শুনে আমি রীতিমত তাজ্জব বনে গেলাম। হিন্দি সিনেমা তার খুব পছন্দ। অমিতাভ বচ্চন তার প্রিয় নায়ক। তার হেন কোনো মুভি নেই, যা সে একাধিক বার না দেখেছে। দিওয়ার, শোলে, সিলসিলা থেকে শুরু করে শক্তি, কুলি, মর্দ, শাহানশাহ পর্যন্ত সব নাম গড়গড় করে বলে গেল। অমিতাভ বচন ছাড়াও সে ধর্মেন্দ্র, ঋষি কাপুর, অনিল কাপুরদের ছবিও দেখে। আর নায়িকাদের মধ্যে শ্রীদেবী তার খুব প্রিয়। আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনছিলাম। শ্রীদেবীর নাম নেয়ার সময় বুঝি তার চেহারা খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কট্টর শরিয়াপন্থী ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হয়ে এত হিন্দি ছবি সে কিভাবে দেখে ? কোথায় দেখে ? এ দেশের সিনেমা হলে নিশ্চয়ই হিন্দি ছবি মুক্তি পায় না ? জানতে চাইলাম,
- কোথায় দেখো এত হিন্দি ছবি ?
- ভি সি আর এ।
- কোথায় পাও ?
সে জানালো, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ছবি দেখা এ দেশে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তবে পাকিস্তান বর্ডার দিয়ে চোরাই পথে হিন্দি ছবির ক্যাসেট ইরানে ঢোকে। নতুন ছবি মুক্তি পাবার দু তিন মাসের মধ্যেই তার পাইরেটেড কপি এখানে চলে আসে। শুনেছি, পাকিস্তানেও হিন্দি ছবির অনেক কদর। বড় বিচিত্র মানুষের মানসিকতা। যে পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের দু’চোখে দেখতে পারে না, তারাই আবার ভারতীয় ছবি দু’চোখ ভরে দেখে !
জানতে চাইলাম,
- পুলিশ চেক করে না ? কিছু বলে না ?
- বলবে কী দকতোর? তারা তো জানে। সুযোগ পেলে তারাও চুপিচুপি দেখে।
বলে গলা ছেড়ে হাসে জোয়ান ড্রাইভার। বড় অদ্ভুত শক্তি এই সেলুলয়েড মিডিয়ার। মানুষকে আফিমের মতো নেশায় বুঁদ করে রাখে। একজন ড্রাইভার হয়ে কতই বা বেতন পায় বেচারা ? কালোবাজারে ক্যাসেট কিনতে যেয়ে নিশ্চয়ই তার অনেকটা খরচ হয়ে যায় ? জিজ্ঞেস করলাম,
- ছেলে মেয়ে কয় জন ?
- ছেলে মেয়ে কোথায় পাব দকতোর ? বিয়েই তো করিনি।
যতদূর জানি, মুসলমানরা, বিশেষ করে এমন অনুন্নত এলাকার গোঁড়া মুসলমানরা খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলে। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
- বলো কী ? এখনও বিয়ে করোনি ? তুমি তো দেখতে অমিতাভ বচ্চনের মতোই দারুণ হ্যান্ডসাম।
শুনে লাজুক হাসে সিনেমা পাগল ড্রাইভার। বলে,
- হ্যান্ডসাম হলেই তো হবে না দকতোর। বিয়ে করতে টাকা লাগে। মেয়ের বাপকে অনেক টাকা পণ দিতে হয়। যে যত বেশি টাকা দিতে পারে, মেয়ে তার। টাকা পেলে বুড়ো বরের হাতেও মেয়ে তুলে দিতে আপত্তি নেই বাপের। অল্প বেতন পাই। ঘরে আমার বুড়ো মা বাপ আছে। টাকা জমাতে পারি না, বিয়েও করা হয় না।
শেষের দিকে তার কথাগুলো বড় করুণ শোনায়। ছেলেটার জন্য খুব মায়া লাগে আমার। পৃথিবীতে এমন জায়গাও আছে, যেখানে এখনও মেয়ের বাপ পনের নামে মেয়েকে বিক্রি করে দেয় ? অথচ আমাদের দেশে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে রীতিমত যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হয় ! কবে বন্ধ হবে এ সব অনাচার ? কবে বিক্রি হবে মানুষ শুধু ভালোবাসার দামে ?
আমি কিছুটা আনমনা হয়ে যাই। ছেলেটাও আর কোনো কথা বলে না। সাপের গায়ের মতো মসৃণ রাস্তা বেয়ে গাড়ি উল্কার বেগে ছুটে চলে। এক পাশে তাফতান পর্বতমালা। অন্য পাশে পাথুরে উপত্যকা। শক্ত পাথুরে ভূমি বলেই এ দেশের রাস্তা সহজে দেবে যায় না। পরে শুনেছি, ঐ পর্বতমালার মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে কয়েকটা আগ্নেয়গিরি। শেষবার একটু জেগে উঠেছিল সম্ভবত বিশ বছর আগে। দূরে দেখা যায় দু একটা লোকালয়। কিছু সবুজ গাছপালা। হঠাৎ গাড়ির স্পিডোমিটারে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি। কাঁটা দুশোর ঘর ছুঁই ছুঁই ! এক পাহাড়ি রাস্তা, তাঁর উপর এত স্পিড, এক্সিডেন্ট হলে শরীরের কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি চিৎকার করে উঠি,
- আরে করো কী ? করো কী ? আস্তে চালাও।
- মাজরাত মিখাম অগাই দকতোর। ক্ষমা চাই দকতোর। তবে ভয় নেই। আমার অভ্যাস আছে। রুগী নিয়ে দুশো কিলোমিটার রাস্তা আমাকে দেড় ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হয়।
বুঝতে পারি, যথেষ্ট দক্ষ ড্রাইভার সে। দ্রুততম সময়ে তাঁকে রুগী হাসপাতালে পৌঁছাতে হয়। বলি,
- কিন্তু এখন তো গাড়িতে রুগী নেই। তুমি আস্তে চালাও।
- ওক্কে দকতোর।
বলে সে গাড়ির স্পিড স্লো করে দেয়। দেখে আমার ধরে প্রাণ আসে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে,
- আচ্ছা দকতোর, তুমি সিনেমা দেখো না ?
- দেখি তো। খুব দেখি। আমারও প্রিয় নায়ক অমিতাভ বচ্চন।
ধীরে চালাতে বলেছিলাম। তবুও দুই ঘণ্টায় দুশো কিলোমিটার পথ প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এলো সিনেমা পাগল ইরানি ড্রাইভার। দুপুর দুটো নাগাদ নামিয়ে দিল খাশ জেনারেল হাসপাতালে। এক লাখ আশি হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশাল আয়তনের প্রদেশ সিস্তান বালুচিস্তান। যার অধিকাংশই পাহাড়, পর্বত আর মরুভূমি। এই প্রদেশে উনিশটি বিভাগীয় শহর। ওরা বলে শহরেস্তান। নামে বিভাগীয় শহর হলেও দেখতে অনেকটা আমাদের উপজেলা শহরের মতো। তারই একটা ছোট্ট শহরেস্তান, খাশ। শহরের প্রায় সব বাড়ি ঘরই একতলা। প্রকৃতি জাহেদানের চাইতেও রুক্ষ। গাছপালা বলতে রাস্তার পাশে লাগানো কিছু ঝাউ গাছ, তাও ধুলি ধূসর। যুদ্ধের কোনো ক্ষত চোখে পড়ল না কোথাও। ইরাক সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, পাহাড় ঘেরা এই ছোট্ট শহরটা, সম্ভবত সামরিক দিক দিয়ে কোনো গুরুত্বই বহন করেনি ইরাকিদের কাছে। মানুষজন যা কিছু চোখে পড়ল, প্রায় সবাই বালুচ, বেশ ভূষায় আরও গরীব। কথায় বলে না, “আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে” ? বিশ্বের অন্যতম এক গরীব দেশের এক গরীব ডাক্তারের পোস্টিং হল শেষ পর্যন্ত আরও গরীব এক শহরে !
হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্টেই দেখা হয়ে গেল ডাঃ জাহিদ ভাইয়ের সাথে। বরিশাল মেডিকেলের। আমার চেয়ে ছয় বছরের সিনিয়র। ডিউটি শেষ করে বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার পরিচয় পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ। যেন বহুকাল পর তার হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাইটিকে ফিরে পেয়েছেন। স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, রুক্ষ কঠিন এই জনপদে, এমন মমতার ছোঁয়া আমার চোখ ভিজিয়ে দিল।
জাহিদ ভাই আমাকে রইসে বিমারিস্তান বা হাসপাতালের প্রধান কর্মকর্তার রুমে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক ডাক্তার। বেশ ভূষায় বালুচ বলে মনে হল না। তবে আমার চোখ আঁটকে গেল তাঁর পাশের চেয়ারে বসা আর একজন ভদ্রলোকের প্রতি। অপূর্ব সুন্দর চেহারা। মুখে হালকা চাপ দাড়ি। জোড়া ভুরূর নীচে উজ্জ্বল দুই চোখ। পরনে সালোয়ার, কুর্তার উপরে ইংলিশ কোট। বুঝলাম, ইনি বালুচ। দুজনেই দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। পরিচয় পর্ব শেষে জানতে পারলাম, ইনিই স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, রইসে বেহদারি। নাম হাজী কুগান। এই প্রথম কোনো বালুচকে এত উচ্চ পদে দেখলাম।
ইরানে আসার পর থেকে দেখছি, এখানে আনুষ্ঠানিক কাজগুলো অনানুষ্ঠানিক ভাবেই খুব দ্রুত শেষ হয়। আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হাসপাতাল ডরমিটরিতেই হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হল, আপাতত আমি এই হাসপাতালেই রুগী দেখব। জাহিদ ভাইয়ের সাথে বসে। তাতে এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথেও পরিচয় হয়ে যাবে, আর হাতে কলমে ভাষাটাও শেখা হয়ে যাবে। যে ভাষার অজ্ঞতা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম, তার এমন সুন্দর সমাধান হয়ে যাবে, চিন্তাও করতে পারিনি।
ইমার্জেন্সীতে ফিরে আসতেই আরও দুজন ডাক্তারের সাথে দেখা হয়ে গেল। চিটাগাং মেডিকেলের নজরুল ভাই আর পাকিস্তানের ডাঃ হোসেন। আমার পরিচয় পেয়ে ডাঃ হোসেন বললেন,
আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। পার্টি ? তাও আবার আমার অনারে ? আমি যে আসব, জানল কেমন করে ? পরোক্ষণেই বুঝলাম, দুষ্টুমি করছেন। আসলে আজ দুপুরে কেরালার ডাঃ ভার্মার বাসায় সব বিদেশী ডাক্তারদের দাওয়াত। দাওয়াতের কথা শুনেই পেটের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা ক্ষুধার অজগরটা আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠল। খাওয়া বলতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় আধা কিলো আঙ্গুর আর এক কাপ লাল চা ! ডাঃ হোসেন গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। আমার মালপত্র সেই গাড়িতেই তোলা হল। আগে খাওয়া, তারপর থাকা ! অনাহুত না হলেও অনেকটা রবাহূতের মতোই আমি চললাম সবার সাথে দাওয়াত খেতে।
খুব একটা দূরে নয় ডাঃ ভার্মার বাসা। খাশ হাসপাতালের এনেস্থেসিওলোজিস্ট। ওনার স্ত্রী, ডাঃ কৃষ্ণা, এই হাসপাতালেরই গাইনিকোলোজিষ্ট। বাহ, মন্দ নয়। একজন অজ্ঞান করেন, অন্য জন পেট কাটেন ! দুজনেই খুব হাস্যোজ্জ্বল, মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ। সাদরে বরণ করলেন আমাকে। মনেই হল না, আমি ভিন দেশের ভিন ধর্মের একজন মানুষ। শুধু কী তাই ? পাকিস্তানী ডাক্তার হোসেনের সাথে ইন্ডিয়ান ডাক্তার ভার্মার খাতিরটা একটু বেশিই মনে হল। ধর্ম, ভাষা, রাজনীতি, কাঁটাতার, কোনো কিছুই বন্ধুত্বের পথে বাঁধা হতে পারেনি।
দাওয়াতের কথা শুনে ভেবেছিলাম কোরমা পোলাও কিংবা বিরিয়ানি না হোক, অন্তত মাছ, ভাত, ডাল তো পাবই। ভেতো বাঙ্গালি আমি। তিন দিন বাংলা খাবার না খেয়ে প্রাণটা আমার ভাতের জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। কিন্তু ভাত কোথায় ? খাবার বলতে বাটি ভর্তি সবজি মেশানো ডালের মতো এক প্রকার তরল পদার্থ। সাথে বড় বড় পাটিসাপটা আর ছোট ছোট ভাপা পিঠা ! ডাল দিয়ে পিঠা খাওয়া ? বাপের জন্মে শুনিনি। পরে শুনলাম, এগুলোকে যথাক্রমে সাম্বার, ধোসা ও ইডলী বলে। ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ ভারতীয় খাবার। খাওয়া তো দূরের কথা, নামও শুনিনি জীবনে। তবে খেতে খারাপ লাগল না। সাম্বার মূলত ডাল দিয়ে রান্না হলেও অন্যান্য সবজি ও বিশেষ মশলার গুনে খেতে অন্য রকম লাগল। ধোসাও পাটিসাপটার মতো নরম নয়, খুব পাতলা আর মচমচে। আর ইডলী তো নারিকেল আর গুড় বিহীন ভাপা পিঠাই। ভাতের তৃপ্তি না পেলেও পেট পুরে সাম্বার ধোসা খেলাম।
খাওয়া দাওয়ার পর কতক্ষণ জম্পেশ আড্ডা হল। ভার্মা দম্পতী একাই সবাইকে মাতিয়ে রাখলেন। কে বলবে, তিন বৈরী দেশের নাগরিক এরা ? দেখে মনে হয় যেন এক যৌথ পরিবারের সদস্য সবাই। এমন আন্তরিকতায়, আপ্যায়নে আর বিনোদনে মনটা আমার নিমেষেই ভালো হয়ে গেল। তবে ডাঃ ভার্মার বাসায় কোনো বাচ্চা কাচ্চা দেখতে পেলাম না। বছর চল্লিশেক বয়স। দুজনেই চাকরী করেন। ভাবলাম হয়ত সে কারণেই ছেলে মেয়েদের দেশে রেখে এসেছেন। আত্মীয় স্বজনের জিম্মায়। নিতান্ত কৌতূহল বশতই জিজ্ঞেস করলাম,
- তোমাদের ছেলে মেয়েদের দেখছি না। ওদের কি ইন্ডিয়ায় রেখে এসেছ ?
যার হাত ধরে হাজারও সন্তান এই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেছে, তাঁর নিজের জীবনটাই সন্তানহীন, অন্ধকার, ভাবতেই মনটা কেমন করে উঠল। এ কেমন বিচার বিধাতার ? যে নারী হাজারও নারীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, তাঁর নিজের হাসিতেই লুকিয়ে আছে এক পৃথিবী কান্না ? মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার অহেতুক কৌতূহল ভার্মা দম্পতিকে বুঝি অস্বস্তিতে ফেলে দিল ! ম্লান স্বরে বললাম,
- আয়াম স্যরি ডক্টর।
- ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু। ইটস নান অব আওয়ার ফল্টস।
বলে হাসার চেষ্টা করলেন ডাঃ কৃষ্ণা। হেসে আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইলেও নিজের হতাশাটাকে পুরাপুরি লুকাতে পারলেন না। এরপর আর আড্ডাটা তেমন জমল না। বুকের ভেতর একটা অপরাধ বোধের কাঁটা নিয়ে আমি ডাঃ হোসেনের গাড়িতে উঠলাম। সাথে জাহিদ ভাইও।
ততোক্ষণে বাইরে শীতের সূর্য ঝিমিয়ে পড়েছে। ম্লান হয়ে এসেছে দিনের আলো। বইছে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। তেহরানের মতো বরফ জমা না হলেও আমার হাড় কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখি তাফতান পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে জমছে ধূসর কালো মেঘ। অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলাম,
- এখানে শীতকালে বৃষ্টি হয় নাকি ?
- বৃষ্টি যা কিছু হয়, তা তো শীতকালেই। তয় এই মেঘে বৃষ্টি হইব না, তুষার পড়বো।
জবাব দিলেন জাহিদ ভাই।
- বলেন কী ? এখানে তুষারপাতও হয় ? তবে যে শুনলাম, খুব গরম এখানে ?
- ঠিকই শুনছো। গরমকালে গায়ে ফোসকা পড়া গরম। এয়ার কুলার ছাড়া থাকোন যায় না। আবার শীতকালে খুব ঠাণ্ডা। রুম হিটার ছাড়া থাকোন যায় না। আসছ যখন, সবই টের পাইবা।
কথা বলতে বলতেই জাহিদ ভাইয়ের বাসা এসে যায়। হাসপাতালের কাছেই বাসা। হাঁটা দূরত্বে। নেমে যেতে যেতে জাহিদ ভাই বললেন,
- রাইতে বাসায় আইসো। আইজ রাইতে আমার বাসায়ই খাইবা। আরও অনেক ডাক্তারের লগে দ্যাখা হইবো।
- রাতে আপনার বাসায়ও পার্টি নাকি জাহিদ ভাই ? কোনো উপলক্ষ ?
- আইলেই বুঝবার পারবা মিয়াঁ। তাড়াতাড়ি চইলা আইসো।
বলে নেমে গেলেন জাহিদ ভাই। খুবই দিল খোলা টাইপের মানুষ। অল্প সময়েই আপন করে নেন। অধিকার নিয়ে কথা বলেন। দূর প্রবাসে এসে এমন পিতৃ সুলভ বড় ভাই পাব, ভাবতেও পারিনি। তাছাড়া আমার অবস্থা এখন যেখানেই রাত, সেখানেই পাত, সেখানেই কাত। না বলার প্রশ্ন ওঠে না। বললাম, আসব জাহিদ ভাই।
একটু পরে আমাকেও হসপিটাল ডরমেটরিতে নামিয়ে দিয়ে ডাঃ হোসেন চলেন গেলেন আপন গন্তব্যে। ডরমেটরির কেয়ারটেকার আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এক মধ্য বয়সী বালুচ। নাম বলল, খোদাদাদ রিগী। আমাকে কিছু বলতে হল না। নিজ থেকেই আমার মালপত্র বয়ে ডরমেটরিতে নিয়ে এলো। একতলা বিল্ডিং। টানা বারান্দা। পরপর রুম। আমার রুমটা সুন্দর সাজানো গোছানো। এক বেডের কামরা। পড়ার টেবিল, চেয়ার। একটা ছোট আলমারি। অনেকটা সিঙ্গেল বেডের হস্টেলের রুমের মতো। রুমে ঢুকতেই হলকার মতো গরম হাওয়া মুখে ঝাঁপটা দিল। তাকিয়ে দেখি দুই দুইটা রুম হিটার জ্বলছে। ইলেক্ট্রিক হিটার। গনগনে লাল হয়ে আছে। বুঝলাম, আমি আসব জেনেই রুমটা গরম করে রেখেছে কেয়ারটেকার। তাই বলে এত গরম ? আমি কি তন্দুরি মুরগী ? একটা হিটার বন্ধ করে দিলাম।
যাবার আগে খোদাদাদ গড়গড় করে ফারসিতে অনেক কিছু বলে গেল যার মাথা মুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত “ তুমি কোনো চিন্তা করো না ডাক্তার, আমি তো আছি। যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে বলো, হয়ে যাবে” জাতীয় কিছু। কিছু না বুঝেই আমি “খাইলি মামনুন, খাইলি মামনুন”বলে গেলাম। এই তিন দিনে ধন্যবাদ জানাতে যে “খাইলি মামনুন”বলতে হয়, এইটুকু অন্তত শিখে গেছি”। তবে লোকটাকে কোনো বখশিশ টকশিস দিতে পারলাম না। পকেটে দশ হাজার তোমান তেমনই আস্ত পড়ে আছে। কোথাও খরচ হয়নি বলে খুচরা করা হয়নি। কী ভাবল লোকটা কে জানে।
দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ছে শরীর। উষ্ণ, নরম বিছানা ডাকছে আমায়। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পিঠ ছোয়াইনি বিছানায়। একবার ছোঁয়ালে আর হুঁশ থাকবে না। অথচ রাতে জাহিদ ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে। এত করে বলেছেন, না গেলে খারাপ দেখায়। তাছাড়া উপরি পাওনা হিসাবে আরও কিছু ডাক্তারের সাথে পরিচয়ও হবে। রেস্ট নেয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে জিনিষ পত্র গুছিয়ে রেখে ফ্রেস হয়ে নিলাম। এ পর্যন্ত গাড়িতে গাড়িতেই পথ চলেছি। এবার হেঁটে যেতে হবে। যদিও জাহিদ ভাইয়ের বাসা বেশি দূরে নয়। বড়জোর মিনিট দশেক লাগবে। তবুও সব রকম শীতের কাপড় গায়ে তুলে নিলাম। কান টুপি, মাফলার থেকে শুরু করে হাত মোজা পর্যন্ত। দেয়ালের গায়ে লাগানো আয়নায় নিজেকে দেখে একটা ছোটোখাটো ভাল্লুকের মতো মনে হল। হোক না, আমি তো আর কনে দেখতে যাচ্ছি না !
বাইরে তখন গাঢ় সন্ধ্যা নেমেছে। টিমটিম করে জ্বলছে ল্যাম্পপোস্টের বাতি। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। ছোট শহর বলে গাড়ি ঘোড়ও কম। ঠাণ্ডাটা আরও জাঁকিয়ে বসেছে। ওভারকোটের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে আমি ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। মিনিট পাঁচেক হাটতেই হাতের ডানে হাসপাতাল। সামনেই কিছু ফলের দোকান। দুপুরে ডাঃ ভার্মার বাসায় খালি হাতে গিয়েছিলাম। অবশ্য আমি একা নই, সবাই খালি হাতেই গিয়েছিলেন। এখানে বোধহয় কোনো বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে হাতে কিছু নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ নাই। কিন্তু আমি বাংলাদেশের ছেলে। যাচ্ছি আর এক বাংলাদেশির বাসায়। খালি হাতে গেলে কেমন দেখায় ? তাছাড়া আমার টাকাও ভাঙ্গানো দরকার। আমি একটা ফলের দোকানে ঢুকলাম।
একলা দোকানী বসে আছে পসরা সাজিয়ে। কোনো খরিদ্দার নেই। আমি এগিয়ে যেতেই একগাল হেসে বলল,
আরে বাপরে ! এক সঙ্গে এত প্রশ্ন ? বেফারমাইন ছাড়া তো বুঝলামই না কিছু, উত্তর দিমু কী ? আমি আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুর দেখিয়ে বললাম, ওয়ান কিলো আর আপেল দেখিয়ে বললাম টু কিলো। লোকটা ঝটপট এক কিলো আঙ্গুর ও দুই কিলো আপেল মেপে ঠোঙ্গায় ভরে দিল। টাকা দিতে গেলেই হা হা করে উঠল,
- খাইলি মামনুন দকতোর, নেই মিখাম।
আচানক কাণ্ড ! এখানেও সেই নেই মিখাম ? মানে টাকা চায় না ? ঘটনা কী ? ঘোড়া ঘাসের সাথে দোস্তি করলে বাঁচবে কেমন করে ? নাকি এই ঘোড়া বিদেশী ঘাস খায় না ? মানে বিদেশী মানুষের কাছ থেকে পয়সা নেয় না। এটাও কি ইরানিদের মেহমান নওয়াজীর একটা ধরণ ? নাকি ডাক্তার বলে এই বাড়তি খাতির, যাতে রোগ শোক হলে একটু বাড়তি সেবা পাওয়া যায় ? তাই বলে এতগুলো ফল মাগনা দিয়ে দেবে ? ভাষাটাও জানি না যে ভাল করে শুনব বা কেন নেবে না জানতে চাইব। আমি রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আবারও টাকা দিতে চাইলাম। বললাম, প্লিজ টেক মানি, টেক।
এ তো মহা জ্বালায় পড়া গেল ! কত দাম কে জানে ? গরীব দোকানী এতগুলো টাকা গচ্চা দেবে ? একবার ভাবলাম, ফলগুলো ফেরত দিয়ে দেই। আবার ভাবলাম, তাহলে তো জাহিদ ভাইয়ের বাসায় খালি হাতে যেতে হয়। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। হয়ত এটাই এখানকার রীতি। ফল ফেরত দিলে হয়ত অপমানিত বোধ করবে। জাহিদ ভাইয়ের কাছে শুনতে হবে, এর মোজেজাটা কী ? বুকের ভেতর একটা অস্বস্তির কাঁটা নিয়ে দুহাতে ফল ঝুলিয়ে আমি জাহিদ ভাইয়ের বাসার পথ ধরলাম। অথচ জানতেও পারলাম না, অবাক চোখে দোকানী আমার টাকা না দিয়ে চলে যাওয়া দেখছে আর মনে মনে বলছে, এমন অভদ্র উজবুক মানুষ ডাক্তার হল কেমন করে ?
বেল টিপতেই জাহিদ ভাই দরজা খুলে দিলেন। ফলগুলো তাঁকে দিতে গেলেই বললেন,
- এই সব কী আনছো ?
- তেমন কিছু না জাহিদ ভাই। কিছু ফল।
- ফলের দ্যাশে ফল খাইতে খাইতে মুখ তিতা হইয়া গেছে। পোলাপাইনে খাইতে চায় না। ফল ঘরে পইড়া থাকতে থাকতে পইচা যায়। তাছাড়া তুমি নতুন আইছো, হুদাহুদি খরচ করতে গেলা ক্যান ?
- অসুবিধা নাই জাহিদ ভাই। পয়সা লাগে নাই।
- ক্যান ? পয়সা লাগে নাই ক্যান ?
- দোকানদার তো আমার কাছ থেকে পয়সা নিলো না জাহিদ ভাই।
- কও কী ? তোমার কাছ থেইকা পয়সা নিলো না ? আমাগো কাছ থেইকা তো গলা কাটা দাম নেয় ! ঝাইড়া কাশো দেখি মিয়াঁ ।
শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কয় কী ? অন্যদের কাছ থেকে গলা কাটা দাম নেয় আর আমারে মাগনা দেয় ? তাইলে কি আমি বিশেষ কিসিমের কেউ ? যাহ, এমন ভাবনা স্বপ্নেও আসে না। আমি হইলাম গিয়া কল্পনায় নবাব সিরাজ উদ্দৌলা, বাস্তবে গোলাম হোসেন। জাহিদ ভাইকে সব খুলে বললাম। এমনকি তেহরান থেকে আসার পথের ঘটনাও। শুনে জাহিদ ভাই চোখ কপালে তুলে বললেন,
- আয় হায় মিয়াঁ, করছো কী ?
বুঝলাম, কোথাও বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছি। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম,
- কেন ? কী করছি ?
- আসো, কইতাছি। তাঁর আগে সবার লগে পরিচয় করাইয়া দেই।
ফলগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে জাহিদ ভাই আমাকে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। নাম বসার ঘর না হয়ে জলসা ঘর হওয়াই উচিৎ ছিল। কারণ আধুনিক বসার ঘরের আসবাবপত্র, যেমন সোফা, ডিভান, টেবিল, চেয়ার, মোড়া, এ সব কিছুই নেই। বেশ বড় ঘরটা পুরু কার্পেটে মোড়া। সেই কার্পেটের উপর দেয়াল ঘেঁষে মোটা মোটা তোষক পাতা। তাঁর উপর বালিশ, তাকিয়া। সেই তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গীতে শুয়ে বসে আছেন কয়েকজন। শুধু সুরা আর সাকীর অভাব!
আমাদের দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। জাহিদ ভাই একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বরিশাল মেডিকেলের কাজী ভাই ও তুষার ভাই, রাজশাহী মেডিকেলের জহির ভাই, ময়মনসিং মেডিকেলের সোবহান ভাই। সবাই আমার থেকে বেশ সিনিয়র। শহর থেকে দূরে, দুর্গম অঞ্চলে, বিভিন্ন ক্লিনিকে কাজ করেন। ফারসিতে দারমাঙ্গা বলে। অনেকটা আমাদের পল্লী ক্লিনিকের মতো। সেখানেই ডাক্তারদের থাকার ব্যবস্থা। সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনেকেই শহরে (খাশে) চলে আসেন সদায়পাতি করার জন্য। জাহিদ ভাইয়ের বাসাতেই ওঠেন। শুক্রবারটা থেকে শনিবার যে যার জায়গায় চলে যান। বুঝলাম, জলসা ঘর না বললেও জাহিদ ভাইয়ের বাসাটাকে নির্দ্বিধায় সরাইখানা বলা যায়। মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
জাহিদ ভাই এবার আমাকে দেখিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই হইল গিয়া আমাগো পেছার দকতোর।
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
- পেছার দকতোর মানে কী জাহিদ ভাই ?
- পেছার মাইনে হইল গিয়া পোলা বা ছেলে। তোমারে দেখলে তো আর ডাক্তার মনে হয় না, ডাক্তারের পোলা মনে হয়। ইরানিরা তোমারে দেখলে পেছার দকতোর কইয়াই ডাকবো।
একেবারে মিথ্যা বলেননি জাহিদ ভাই। দু বছর আগে ডাক্তারি পাশ করলেও এখনও অনেকে এ ভুল করে বসে। কিন্তু ইরানিরা তো আমাকে ঠিকই চিনেছে। সবাই তো দকতোর বলেই ডাকলো। বুঝলাম, রসিক মানুষ জাহিদ ভাই। আমাকে নিয়ে রসিকতা করছেন। আমিও একটা মিচকেল হাসি হেসে চুপ করে থাকলাম।
জাহিদ ভাই আবার বলতে শুরু করলেন,
- এইবার শুনো মিয়াঁরা, আমাগো পেছার দকতোরে কী করছে। সে ফল কিইনা দাম না দিয়াই চইলা আইছে।
শুনে সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। বলেন কী জাহিদ ভাই ? কেন ? কী ভাবে ?
আমি রেগে মেগে বললাম,
- মোটেই তা নয় জাহিদ ভাই। আমি তো দাম দিতেই চাইছিলাম, ওই ব্যাটারাই তো নিলো না। আমার কী দোষ ?
জাহিদ ভাই একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে মজলিশী মেজাজে আমার কাছ থেকে শোনা ঘটনা সবাইকে নতুন করে শোনালেন। শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসি চলতেই থাকল কিছুক্ষণ। এত হাসির কী হল বুঝতে না পেরে আমি ভ্যাবলার মতো বসে রইলাম। হাসির রোল একটু থামতেই সোবহান ভাই বললেন,
- আপনি তো ভাই ডাক্তারদের ইজ্জত ডুবাইছেন। কোনো কিছুর দাম হোক, গাড়ির ভাড়া হোক, কিংবা পাওনা টাকা হোক, ইরানিরা কমপক্ষে তিনবার নিতে অস্বীকার করবে। কিন্তু আপনাকে “খায়েশ মিকুনাম, খায়েশ মিকুনাম”বলে জোর করে দিতে চাইতে হবে। তখন ওরা “এত করে যখন দিতে চাইছ, না নিলে কেমন দেখায়” এমন ভাব দেখিয়ে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে টাকাটা নেবে। এটাই ওদের কথা বলার রীতি। এটাই ওদের কাছে ভদ্রতা। আপনি তো মহা অভদ্রের মতো কাজ করে ফেলছেন। আপনারে ওরা পেছার ডাক্তার না, ছ্যাঁচড়া ডাক্তার ভাবছে।
শুনে আর একবার হাসির রোল ওঠে। ছি ! আমার বোঝা উচিৎ ছিল। এমন বেকুবের মতো কাজ কী ভাবে করলাম ? তেহরান থেকে আসার পথে দোকানীর কথা নাহয় বাদই দিলাম, এই শহরের দোকানীর সাথে তো আমার আবার দেখা হবে। মুখ দেখাব কেমন করে ? লজ্জায়, অপমানে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইল। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।
জাহিদ ভাই ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
- তোমার খোঁচা দিয়া কথা বলার অভ্যাসটা গেল না সোবহান। ও নতুন মানুষ, ইরানি কালচার বুঝবো কেমনে ?
তার পর আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
- চিন্তা কইরো না আফতাব। অরা বুঝবো, তুমি নয়া আইছো। অগো কালচার অহনো বুইঝা উঠবার পারো নাই। পরে এক সময় টাকাটা দিয়া আইসো।
মনে মনে বললাম, পরে টরে নয়, আজ, এখুনি যেয়ে টাকাটা দিয়ে আসব।
- সালামালেক দকতোর। হালে শুমা খুবে ? মেওয়া চিতুর বুদ ? মুশকিল কি না দাশত ?
আগের মতোই হাসি মুখে অনেকগুলো প্রশ্ন করল বৃদ্ধ ফল বিক্রেতা। একটু আগেই তার ফলের দাম না দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। অথচ রাগ কিংবা বিরক্তির চিহ্ন নেই চোখে মুখে। তবে ফারসিতে কী বলল বুঝতে না পেরে আমি জহির ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
রংপুরের ছেলে জহিরুল ইসলাম। কথায় আঞ্চলিকতার টান। আমার চেয়ে দুই বছর আগে রাজশাহী মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন। এখনও বিয়ে করেননি। এই জন্যই বোধহয় নারী মহলে তাঁর প্রচুর কদর। জাহিদ ভাইয়ের বাসায় বসে দেখলাম, অন্দর মহল থেকে প্রায় তাঁর ডাক আসছে, এটা সেটা করে দেয়ার জন্য। জহির ভাইও হাসি মুখে অতি উৎসাহের সাথে ভাবীদের সব ফরমায়েশ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আমার ভেতর তখন ফলের দাম পরিশোধ করার তাড়া। একজন দোভাষী দরকার। নইলে ফলওয়ালার সাথে কথা বলব কেমন করে ? ইতস্তত করছিলাম, জহির ভাইকে সঙ্গে যেতে বলব কিনা। অনেক পুরুষই আছেন, বিয়ের আগে নারীদের কিংবা বিয়ের পরে অন্য নারীদের যতটা উপকারে আসেন, পুরুষদের উপকারে ততটা আসেন না। একটু দ্বিধা নিয়ে বলেই ফেললাম সাথে যাবার জন্য। আমাকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। হাসিখুশি পরোপকারী এই মানুষটাকে আমার খুব ভালো লেগে গেল।
আসতে আসতে জহির ভাই বলছিলেন,
- ইরানিদের বিশ্বাস কইরবেন না। ব্যাটারা আসলে বদের বদ, পাজির পা ঝাড়া।
- বলেন কী ? আমার কাছে তো এ পর্যন্ত সবাইকে ভালো মানুষ বলেই মনে হল।
- কেবল আইসলেন তো। কিছু দিন যাক, টের পাইবেন। ওদের মুখে এক, অন্তরে আর এক। মুখে বইলবে টাকা দিয়া লাইগবে না। অথচ টাকা নিয়ার লাইগে মুখাইয়া থাইকবে ।
- হুম, তাই তো বলল সবাই ? নিজেরে এখন চোর চোর মনে হচ্ছে জহির ভাই।
- কুনো চিন্তা নাই আফতাব ভাই। দেইখবেন, কেমন ছোঁ মাইরে টাকা নিয়া নেয়। শুধু নিবে না, দেইখবেন, ইচ্ছা মতো দাম রাইখবে।
যেতে যেতে নিজের ভেতরই নিজে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। এমন ফাঁপরে জীবনে এই দ্বিতীয়বার পড়লাম। প্রথম বার পড়েছিলাম পঞ্চাশ বছর আগে। বয়স তখন নয় কি দশ। দেশ কেবল স্বাধীন হয়েছে। চারিদিকে অভাব, অনটন, দুর্ভিক্ষ। ডাস্টবিনে মানুষ আর কুকুর এক সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করে খায়। হাড্ডিসার মানুষগুলো ছালার চট গায়ে পেঁচিয়ে ফুটপাতে ঘুমায়। এখন যে বয়সে ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়, একা একা দোতালা থেকে নিচেও নামে না, সেই বয়সে আমি একা একাই স্কুলে যেতাম, সারাদিন বন্ধুদের সাথে টোটো করে ঘুরে বেড়াতাম, ডাংগুলি খেলতাম, মার্বেল খেলতাম, এমনকি মাঝে মাঝে একা একা বাজারেও যেতাম। একদিন মা আমাকে এক টাকা দিয়ে কাঁচা বাজার করতে পাঠাল। সাথে দু আনার পানও আনতে বলল। বাজারে ঢোকার মুখেই ছিল একটা পানের দোকান। বাজার করে ফেরার পথে সেই দোকান থেকে দু আনার পান কিনলাম। আমার ভেতর তখন স্কুলে যাবার তাড়া। বাসায় ফিরেই দেখি পকেটে চকচকে দু’আনিটা পড়ে আছে। তাড়াহুড়ায় পানের দাম দিতে ভুলে গেছি। তখন আর ফিরে গিয়ে সে দাম দেয়ার সময় নাই।
তখন দু’আনায় কমপক্ষে চার চারটে লাঠি লজেন্স পাওয়া যেত। শিশু মন লোভ সামলাতে পারল না। স্কুলে যেয়ে পয়সাটা খরচ করে ফেললাম। কয়েকদিন পর মা আবার আমাকে বাজারে যেতে বলল। আমি তো মহা ফাঁপরে পড়ে গেলাম। সেই দোকানের সামনে দিয়েই বাজারে ঢুকতে হবে। ব্যাটা আমাকে নির্ঘাত চিনে ফেলবে এবং পানের দাম চাইবে। এখন যদি মাকে বলি, পানের দাম না দিয়ে সে পয়সা দিয়ে লাঠি লজেন্স খেয়ে ফেলেছি, তাহলে লাঠি দিয়ে পেদিয়ে মা আমার অন্য পথ দিয়ে সেই লজেন্সের রস বের করে ফেলবে। আর আব্বা জানলে তো কথাই নেই। বয়াতীর বেটা পানি ছাড়াই আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। আবার পানওয়ালার পয়সা না দিতে পারলে হয় বেঁধে রাখবে, নয়ত মেরে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবে। অভাবের সংসার। বাজার করার জন্য মা গুনে গুনে পয়সা দেয় । সেখান থেকে যে দু’আনা চুরি করব, তারও উপাই নাই। আমার তখন জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ অবস্থা। ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার জোগাড়। কায়মনোবাক্যে খোদাকে ডেকে বললাম, খোদা, রহম করো, এই বারের মতো পার করে দাও, জীবনে আর কখনও কোনো দোকানদারের পয়সা ফাঁকি দেব না।
কিন্তু চোর মন খোদার রহমের উপর তেমন ভরসা করতে পারল না। ভেবেচিন্তে একটা টেকনিক বের করলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন, সেই দোকানে সামনে দিয়ে যাবার সময়, মুখটা ভেঙ্গচি কাটার মতো বাঁকা করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দ্রুত পার হয়ে গিয়েছিলাম, যাতে আমাকে চিনতে না পারে। টেকনিকটা কাজে লেগেছিল। দোকানদার আসলেই আমাকে চিনতে পারল না। কেউ আমাকে পিছু ডাকল না! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। হাটুরে মারের হাত থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম ! হয়ত দোকানদারও পানের দাম নিতে ভুলে গিয়েছিল। হয়ত আমার চেহারা তার মনেই ছিল না। কিন্তু আমার তো আর তা জানার কথা নয়। আমি আর কোনদিন সেই দোকানে পান কিনতে যাইনি। এরপর যতবার সেই দোকানে সামনে দিয়ে গিয়েছি, বহুদিন পর্যন্ত আমি মুখ বাঁকা করে অন্য দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে দ্রুত হেঁটে পার হয়েছি।
একই ভুল আবার করে ফেললাম ! আগের বার পয়সা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, আর এবার বুঝতে ভুল করে ফেললাম। অপরিণত বয়সের সেই টেকনিক এই পরিণত বয়সে আর কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। মুখে ভেঙ্গচি কেটে পার পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। তাছাড়া এবার লাঠি লজেন্স খেয়ে সে পয়সা খরচও করে ফেলিনি। তাই তো জহির ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি, যাতে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফলের দামটা দিয়ে দিতে পারি।
তখনও জানি না, লোকটা ফার্সিতে কী বলেছে। তার চেহারা দেখে বুঝতেও পারছি না, সে আমাকে আদৌ চিনতে পেরেছে কিনা ? এক ঘণ্টাও হয়নি, টাকা না দিয়ে চলে গিয়েছি। আমি মুখ বাঁকা করেও নেই। চিনতে না পারার তো কথা নয়। কী বলল সে ফার্সিতে ?
জহির ভাই আমাকে তর্জমা করে দিলেন, দোকানী আমাকে সালাম দিয়েছে। জানতে চাইছে, আমি কেমন আছি, ফল কেমন ছিল, কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা, এই সব। তাজ্জব ব্যাপার ! এত কিছু জানতে চাইল, অথচ চিনতে পেরেও দাম কেন দিলাম না, তা জানতে চাইল না ? হয়ত দোকানী আমাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে না। জহির ভাই দোকানীর প্রশ্নের জবাব দিলেন,
- সালাম আগাজুন। মেওয়া খাইলি খুব বুঁদ, শিরিন বুঁদ, হিচ মুশকিল না দাশত।
আমার দিকে ফিরে জহির ভাই তর্জমা করলেন, বললাম, সালাম জনাব। ফল খুব ভালো ছিল, মিষ্টি ছিল, কোনো অসুবিধাই ছিল না।
আমি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে ফল নিয়ে গিয়েছিলাম, জহির ভাই খাওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখেননি। অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলাম,
- এই রকম ডাহা মিথ্যা বললেন জহির ভাই ?
- এইটে মিথ্যা না আফতাব ভাই। এইটে হইল অন্যকে খুশি করা। খুশি করার জইন্যে এই রকম অনেক মিথ্যা কথা এখানে সবাই বলে।
আসলেও তাই। দোকানীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, ফলের প্রশংসায় সে খুব খুশি হয়েছে। দোকানীর সাথে পরবর্তী কথোপকথন ফার্সিতে হলেও যথাসম্ভব বাংলা তর্জমা দিলাম। দোকানী গদগদ কণ্ঠে বলল,
- খায়েশ মিকুনাম দকতোর। বলো, আর কী খেদমত করতে পারি ? আরও ফল লাগবে ?
- না না, আর ফল লাগবে না। এই ডাক্তার সাহেব আজই বাংলাদেশ থেকে নতুন এসেছে। ভুল করে ফলের দাম না দিয়ে চলে গিয়েছিল। তার জন্য সে খুব লজ্জিত। এখন যদি তুমি দয়া করে দামটা নিতে, তাহলে ডাক্তার খুব খুশি হত।
বলে আমার কাছ থেকে একটা পাঁচশ তোমানের নোট নিয়ে দোকানীকে দিতে গেল। শুনে হাত জোর হা হা করে বলে উঠল দোকানী,
- কেন আমাকে শরমিন্দা করছ ? আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই ডাক্তার নতুন এসেছে। আমি তো সব ডাক্তারকে চিনি। ও আমাদের নতুন মেহমান। নিজ দেশ ছেড়ে আমাদের খেদমত করতে এসেছে। তাঁর একটু খেদমতে আসতে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার। দাম দেয়া লাগবে না। নেই মিখাম দকতোর।
- খায়েশ মিকুনাম আগাজুন। বেফারমাইন।
বলে আবারও টাকাটা দিতে গেলেন জহির ভাই। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, কথায় কথায় খায়েশ মিকুনাম বলা এ দেশের রেওয়াজ। এবার দোকানী দুহাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গীতে বলল,
- ও আল্লাহে, হারাম। নেই মিখাম। ডাক্তার সাহেব খুবই ভালো মানুষ। তাই তো এই শীতের রাতে এত কষ্ট করে টাকা দিতে এসেছে। আমার পক্ষ থেকে এটা সামান্য হাদিয়া। গ্রহণ করলে ধন্য হব।
এবার জহির ভাই আমার দিকে চেয়ে বললেন,
- আর নিবে না আফতাব ভাই।
- কেন ? সোবহান ভাই তো বলল, কমপক্ষে তিনবার ওরা “নেই মিখাম” বলবে। ও তো মাত্র দুই বার বলেছে । আপনি আবার দিতে চান।
- লাভ নাই আফতাব ভাই। একবার যদি আল্লাহর নাম নিয়া হারাম বইলে ফেলে, তাহলি আর দিয়া যাবি না। আপনাকে হাদিয়া দিয়েছে।
- আমার হাদিয়া লাগবে না। আপনি জোর করে টাকাটা দিয়ে দেন। বেচারা গরীব মানুষ।
জহির ভাই কিছু বলার আগেই দোকানী রাগী রাগী কণ্ঠে বলে উঠল,
- মা গরীব হাস্তাম, দুরস্ত। ওয়ালি এনকাদ গরীব নিস্তাম কি মেহমানরা নেই মিতুনাম হাদিয়া বেদাম।
চমকে উঠে আমি তর্জমার জন্য জহির ভাইয়ের দিকে তাকালাম। জহির ভাই একটু ইতস্তত করে বললেন, ও বইলছে, আমরা গরীব ঠিক আছে, কিন্তু এতটা গরীব না যে মেহমানকে হাদিয়া দিতে পারব না।
শুনে আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে গেল। আমরা তো বাংলায় কথা বলছিলাম। ও বুঝল কেমন করে ? তখনই মনে হল, গরীব ফার্সি শব্দ। বাকিটা ধারণা করে নিয়েছে। আর তাতেই পাঠানের অহমে আঘাত লেগেছে। আমি ভালো করে লোকটাকে দেখি। রোদে পোড়া তামাটে মুখ। সে মুখে কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে জীবন যুদ্ধের ছাপ। কাঁচা পাকা দাড়ি। কত বয়স ? ষাট ? পঁয়ষট্টি ? বোঝা দায়। বড় পাগড়ীর নীচে ম্লান দুই চোখে অভিমান। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। নিজেকে খুব ছোট মনে হল। জহির ভাইকে বললাম,
- ওকে বলুন, গরীব বলার জন্য আমি খুব লজ্জিত। মনের দিক দিয়ে ও আমার চাইতে অনেক বড়। ওর হাদিয়া আমি কবুল করলাম। সারা জীবন এই হাদিয়ার কথা আমি মনে রাখব।
জহির ভাই তর্জমা করলেন। শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বৃদ্ধের দুই চোখ। দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
- কোরবানে শোমা বেরাম দকতোর ( তোমার জন্য কোরবান হয়ে যাব ডাক্তার)। তোমার হাত দুটি দাও, একটু মোসহাফা করি। এই সামান্য হাদিয়া কবুল করে আজ এই গরীবের ইজ্জত অনেক বাড়িয়ে দিলে। আমিও তোমাকে সারা জীবন মনে রাখব।
লোকটা হয়ত অশিক্ষিত, কিন্তু কথায় কী অমৃত ! ভাষায় কী অপূর্ব বাক্যালংকার ! একটা দেশের সভ্যতা তার ইমারতে নয়, সে দেশের মানুষের কথায়, আচরণে, ব্যাবহারে প্রকাশ পায়। সুন্দর আচরণের জন্য পুঁথিগত বিদ্যা নয়, সুন্দর মন থাকা চাই। লোকটা তার কড়ে পড়া শক্ত হাতে আমার দুহাত নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁকাতে থাকল আর বিড়বিড় করে বলতে থাকল, সালেম বাশে, খোশহাল বাশে, দুরস্ত বাশে। বুঝলাম, এই হাতে সে শুধু ফলই বিক্রি করে না, বালুচিস্তানের রুক্ষ, ঊষার পাথুরে ভূমিতে ফলও ফলায়।
একটু আগেই আসতে আসতে জহির ভাই এই ইরানিদের নিয়ে কী সব বাজে মন্তব্য করছিলেন। আমি তাঁর দিকে তাকাই। দেখি তাঁর চোখে মুখেও লজ্জা। হয়ত সেও বুঝতে পারছে, এ ভাবে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। সব মানুষ এক নয়। বিচিত্র এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র ধরণের মানুষ। কত বিচিত্র তাঁদের মন। আমরা দূর থেকে তাদের ক’জনকেই বা চিনতে পারি ? বাইরে থেকে সে মন কতটুকুই বা বুঝতে পারি ?
পরবর্তীতে এই ফলওয়ালার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। নাম ইয়ার মোহাম্মদ। যতটা গরীব তাকে ভেবেছিলাম, ততটা গরীব সে নয়। নিজেরই আপেল ও আঙ্গুরের বাগান আছে। নিজেই তার পরিচর্যা করে। নিজের ফল নিজেই বিক্রি করে। প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ঘর করছে। প্রথম স্ত্রীর ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। বিয়ে শাদী করে যে যার ঘর করছে। যুবতী দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে ছোট ছোট দুই সন্তান। তাই তাকে বাড়তি খাটুনী করতে হয়। প্রথম স্ত্রীর ছেলেরা তাকে তেমন কোনো সাহায্য করে না। তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। তাকে কখনও অসুখী দেখিনি। সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। “পুরুষের পৌরুষ শুধু বিছানায় নয়, ক্ষেতে খামারেও দেখাতে হয়” বলে গলা ছেড়ে হাসত ইয়ার মোহাম্মদ।
যতদিন খাশে ছিলাম, তার দোকান থেকেই ফল কিনতাম। দাম সে নিতে চাইত না কিছুতেই। কিন্তু ততদিনে আমিও বালুচি কায়দা শিখে গেছি। বলতাম, দাম না নিলে আমি আর কোনো দিনই তোমার দোকানে আসব না, তোমার কাছ থেকে ফল নেব না। শুনে নিজের দু’চোখ ছুঁয়ে বলে উঠত ইয়ার মোহাম্মদ।
এমন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায় ? আমিও মানুষটাকে ভালো বেসে ফেলেছিলাম। সময় পেলে প্রায়ই ওর দোকানে যেয়ে বসতাম। নানা রকম গল্প করত ইয়ার মোহাম্মদ। শহর থেকে মাইল দশেক দূরে এক পাহাড়ের কোলে তার বাড়ি, ফলের বাগান। বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান ছাড়াও তার আছে কিছু গুছফান্দ (ভেড়া)। স্ত্রী গুলবাহার সেই গুছফান্দের দেখাশুনা করে। দুধ থেকে মাখন তৈরি করে। নিজ হাতে রুটি বানায়। রাতে দোকান বন্ধ করে এক পুরনো মটর সাইকেল ভটভটিয়ে সে বাড়ি ফেরে। স্ত্রী সন্তানদের সাথে রুটি মাখন খায়। নিজের বাগানের ফল খায়। বলতে বলতে তার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তখন তাকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হত।
বহুবার সে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মাখন, রুটির সাথে কচি গুছফান্দের কাবাব খাওয়াতে চেয়েছিল। বলত, গুলবাহারের হাতের রান্না খেলে নাকি আমি তার প্রেমে পড়ে যাব। আমি হেসে বলতাম,
- সে নাহয় পড়লাম। আমি যুবক মানুষ, তোমার যুবতী বউও যদি আমার প্রেমে পড়ে যায়, তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখেছ ?
- বন্ধুর জন্য এই অধমের জান কোরবান, বউ কোন ছার ? আমি ঠিক আর একটা জুটিয়ে নেব।
বলে হোহো করে হেসে উঠত ইয়ার মোহাম্মদ। একটা স্বপ্নের কথা সে প্রায়ই বলত আমাকে। টাকা জমাচ্ছে। হজ্ব করতে যাবে। আল্লাহর ঘর তওয়াফ করবে। রাসুল (সঃ) এর রওজা যিয়ারত করবে। নইলে রোজ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন কেন ? নইলে রাসুল (সঃ) তার জন্য সুপারিশ করবেন কেন ? তার খুব শখ, মৃত্যুর আগে সবাই তাকে হাজী ইয়ার মোহাম্মদ বলে ডাকুক। ইরানে, বিশেষ করে বালুচিস্তানে হাজী শব্দটা খুব সম্মানের সাথে উচ্চারণ করা হয়।
সেই ইয়ার মোহাম্মদ হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল। কোথায় গেছে কেউ জানে না। কেউ বলল, দুই স্মাগলার গ্রুপের গ্যাং ফাইটের মধ্যে পড়ে মারা গেছে। এমন কানাঘুষাও শোনা গেল, ইয়ার মোহাম্মদ নিষিদ্ধ বামপন্থী মুজাহেদিন খালকের সদস্য ছিল, পাসদারান (ইরানি রিভোলিউশনারি গার্ড) ধরে নিয়ে গুম করে ফেলেছে। বিপ্লবোত্তর ইরানে এই সব ব্যাপারে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করে না। আমিও আর তেমন কিছু জানতে পারি না।
ইয়ার মোহাম্মদের রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল আমি জানি না। সে কোনো স্মাগলার গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিল কিনা, আমি জানি না। মৃত্যুর আগে ইয়ার মোহাম্মদ হাজী ইয়ার মোহাম্মদ হতে পারেনি বলে তার খোদা তাকে ক্ষমা করবেন কিনা, আমি জানি না। রাসুল (সঃ) এর রওজা জিয়ারত করতে পারেনি বলে আল্লাহর নবী তার জন্য সুপারিশ করবেন কিনা, আমি তাও জানি না। শুধু জানি, ইয়ার মোহাম্মদ আমাকে তার কচি ভার্যার হাতে তৈরি রুটি, মাখন আর কচি গুছফান্দের কাবাব খাওয়াতে চেয়েছিল, পারেনি। শুধু জানি, ভিনদেশী এক তরুণ ডাক্তার যাতে মনে কষ্ট না পায়, সেই জন্য তার প্রতিটি কথা চোখের পাতায় করে রাখত। ইয়ার মোহাম্মদ হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমার স্মৃতিতে বেঁচে আছে একজন বন্ধু বৎসল মানুষ হিসেবে। যার কাছ থেকে আমি মানুষকে সম্মান করতে শিখেছি, মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখেছি। যে কোনো অবস্থায় সুখী হতে শিখেছি।
আজ এত বছর পরও যখন কোনো ফলের দোকানে যাই, আমার ইয়ার মোহাম্মদের কথা মনে পড়ে যায়। আমার প্রথম বালুচি বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়। দু’টাকা দাম কমানোর জন্য দর কষাকষি না করে দোকানীকে বলি, আমি তো ফল চিনি না। তুমি ভালোটা বেছে বেছে দাও। দাম যা চাও পাবে। দোকানী আমার দিকে একটু অবাক চোখে চায়। তার পর বেছে বেছে ফল দেয়। বাসায় এলে সে ফল প্রায়ই পচা কিংবা খারাপ বের হয়। গিন্নী ভর্তসনা করে বলেন,
আমি কোনো প্রতিবাদ করি না। আনমনে হাসি আর মনে মনে বলি, মানুষকে বিশ্বাস করে নাহয় একটু বেকুবই হলাম, ক্ষতি কী ? সব মানুষ তো সমান না। কে জানে, এদের মধ্যেই হয়ত একজন ইয়ার মোহাম্মদ আছে…
রাত মাত্র দশটা। অথচ বাইরে বের হতেই মনে হল গভীর রাত। দোকানপাট সব বন্ধ। রাস্তায় জনমানবের কোনো চিহ্ন নেই। নেই মানুষের কোলাহল। নেই গাড়ি ঘোড়ার শব্দ। পুরু কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে পুরা মহল্লা। বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে নীরবতা। অথচ বলা যায়, এই সময়ে বাংলাদেশে কেবল সন্ধ্যা হয়। দোকানপাট সব খোলা থাকে। চায়ের দোকানে জম্পেশ আড্ডা চলে। রাস্তায় গাড়ির মতোই ফুটপাতে থাকে মানুষের ভিড়। তখন কে জানত, রাত দশটা বাজার আগেই এ দেশের মানুষগুলো সব লেপের তলে চলে যাবে ?
জাহিদ ভাই অবশ্য খুব করে বলেছিলেন আজ রাতটা তাঁর বাসায় থেকে যেতে। ইচ্ছে যে আমারও করেনি তা নয়। বসার যে ঘরটায় সব পুরুষদের ঘুমনোর কথা, দেখলাম খাওয়া দাওয়ার পর সবাই সেই ঘরেই গোল হয়ে বসে গেল তাস খেলতে। রামি। তাও আবার পয়সা দিয়ে। রামি খেলিনি জীবনে। আর পয়সা দিয়ে খেলার তো প্রশ্নই ওঠে না। হোস্টেলে ছুটির দিনে বন্ধুদের দেখতাম চার আনা, আট আনা দিয়ে থ্রি কার্ডস, ব্লাক জ্যাক খেলতে। আমি পাশে বসে বসে দেখতাম। ঐ চার আনা, আট আনা করে খেলতে খেলতেই কেউ কেউ চার পাঁচশ টাকা হেরে যেতে। চার পাঁচশ তো দূরের কথা, চার পাঁচ টাকা হারলেও মাসের শেষে গোনা পয়সায় আমার টান পড়ে যাবে। তাই লোভ হলেও ও পথ মাড়ানোর সাহস হয়নি কোনদিন।
একমাত্র দাবা আর গলফ ছাড়া বোধহয় সব খেলাতেই চিৎকার চেঁচামেচি হয়। আর তাস খেলায় তো আরও বেশি হয়। এই চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে কুম্ভকর্ণও ভালো করে ঘুমাতে পারবে না, আমি কোন ছার ? বিশেষ করে যখন শুনলাম, এ খেলা সারা রাত ধরে চলবে। ভাবলাম, তার চেয়ে বরং ডরমিটরিতে যেয়ে হাত পা ছড়িয়ে লম্বা একটা ঘুম দেই। কাল আবার আসা যাবে। শুনে জহির ভাই বলেছিলেন।
- চলেন, আপনারে আগাইয়া দিয়া আসি।
- না না, লাগবে না। এইটুকু পথ আমি একাই যেতে পারব। তয় পথে ভয় ডর কিছু নাই তো ?
- কিসের ভয় আফতাব ভাই ?
- এই চোর ডাকাত, গুণ্ডা বদমাশ।
- মাথা খারাপ ? হাত কাইটে দেবে না ? দরজা, জানালা খুইলে ঘুমাইলেও এইখানে কোনো চুরি ডাকাতি হয় না।
শুনে অজান্তেই আমার বাম হাতটা ডান হাতের কব্জিতে চলে যায়। শুনেছি, ইসলামী আইনে চোরের ডান হাত কব্জির নীচে থেকে কেটে ফেলা হয়। ফল কিনে দাম না দিয়ে চলে আসাটা নিশ্চয়ই চুরির পর্যায়ে পড়ে ? ভাগ্যিস, ইয়ার মোহাম্মদ ফলগুলো হাদিয়া দিয়েছিল ! নইলে আর ডাক্তারি করে খেতে হত না !
পরে অবশ্য জেনেছি, ঠিক কব্জির নীচ থেকে নয়, প্রথম বার চুরির অপরাধে ইরানে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল বাদ দিয়ে বাকি চারটা আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। কব্জির নীচ থেকেই হোক, আর চার আঙ্গুলই হোক, এটা লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেয়ার মতো হয়ে গেল না ? কোরআনের বিধান, মুসলমান হয়ে সংশয় প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। প্রকাশ না করলেও আমার উদার মনে প্রশ্নটা মাঝে মাঝে উঁকি দিত। পরবর্তীতে হাজী আঃ সাত্তার নামে একজন ইসলামী চিন্তাবিদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
- এই যে ইসলামে চোরের হাত কাটার বিধান, এটা একটু বাড়াবাড়ি, একটু অমানবিক হয়ে গেল না ?
- না, মানে, কত কারণেই তো মানুষ চুরি চামারি করে। অভাবে পড়ে, লোভে পড়ে কিংবা ভুল করে। সামান্য চুরির জন্য সারা জীবনের জন্য তার ডান হাত কাটা যাবে ? তাকে শোধরানর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না ?
- অবশ্যই শোধরানর সুযোগ দেয়া হবে। তাছাড়া সব চুরির ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য নয়। এই শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু বাধ্য বাধকতা কিংবা শর্ত আছে।
- যেমন…
- প্রথমত, ইসলামী শরিয়াহর ভিত্তিতে নিয়োগ-কৃত কাজীই একমাত্র এই বিধান দিতে পারবে। অর্থাৎ যে দেশে ইসলামী শরিয়াহ আইন আছে, সেই দেশের কাজী ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারবে না। চোরকে অবশ্যই সাবালক এবং সুস্থ্য মস্তিষ্কের হতে হবে। চুরিটি নিছক চুরির উদ্দেশ্যেই হতে হবে, বাধ্য হয়ে, দায় পড়ে, অভাবের তাড়নায় কিংবা দুর্ভিক্ষের কারণে নয়।
- তার মানে অভাবের তাড়নায় চুরি চুরি নয় ?
- অবশ্যই চুরি। অন্যের জিনিষ না বলে নেয়াটাই চুরি। তোমাকে মনে রাখতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষ যাতে অভুক্ত না থাকে, সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। সে দায়িত্ব সরকার পালন করতে না পারলে মানুষ যদি বাঁচার জন্য চুরি করে, সে ক্ষেত্রে চোরের বিচার করার আগে কাজী সরকারের বিচার করতে পারে। তবে কাজী সাহেব চোরকে সতর্ক ও অবস্থা বিবেচনায় লঘু শাস্তির বিধান দিতে পারে।
- বলেন কী ?
- শুধু তাই নয়। চুরি-কৃত দ্রব্যের মূল্য এক গ্রাম স্বর্ণ মূল্যের অধিক হতে হবে। যে জিনিষটি চুরি হয়েছে, তা নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত স্থানে থাকতে হবে, যেমন ঘরের মধ্যে কিংবা মালিকের বাড়ির সীমানার মধ্যে কিংবা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে। অর্থাৎ, খোলা জায়গায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকলে হবে না।
- তার মানে খোলা জায়গায় পড়ে থাকা জিনিষ চুরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় ?
- আরে পাগল, না। অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে চুরি করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে অন্যের বাড়িতে ঢুকে চুরি করা আর শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে খোলা অরক্ষিত জায়গার জিনিষ চুরি করা সমান অপরাধ নয়। তাই তার শাস্তিও সমান নয়।
- হুম। ব্যবধানটা অনেকটা বিনা অনুমতিতে অন্যের গাছে উঠে ফল পেড়ে খাওয়া আর তলায় পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে নেয়ার মতো। দুটোই চুরি, তবে দুই রকম।
- ঠিক ধরেছ। শোনো, আরও আছে। হাত কাটার শাস্তি দেয়ার আগে মালিককে অবশ্যই কাজীর দরবারে নালিশ করতে হবে এবং দু’জন চাক্ষুষ সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে কিংবা চোর নিজে দুই বার কাজীর সামনে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করবে। চুরি করার পর চোর যদি চুরি-কৃত জিনিষ ফেরত দেয় কিংবা তার মূল্য মালিককে পরিশোধ করে দেয় এবং নিজ অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়, তাহলে এ শাস্তি দেয়া যাবে না। আবার কাজীর দরবারে চুরি প্রমাণিত হবার আগে যদি বাদী তার নালিশ তুলে নেয় কিংবা মাফ করে দেয়, তাহলেও এ শাস্তি দেয়া যাবে না।
- এত শর্ত মানতে গেলে তো অনেক চোরই পার পেয়ে যাবে।
- না, পার পাবে না। বরং বলতে পার, হাত কাটার শাস্তি থেকে পার পাবে। তবে তোমরা যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, মানবিকতার দোহাই তুলে ইসলামের অনুশাসনের বিরোধিতা কর, তাদের বুঝতে হবে, সব চোরের হাত কাটলে দেশের অর্ধেক মানুষের হাত থাকত না। বরং বলা যায়, এই বিধান থাকার কারণে মানুষ ভয়েই চুরির কথা চিন্তা করবে না।
ইসলামের এই অনুশাসনের এমন সহজ ব্যাখ্যা এর আগে কেউ আমাকে দেয়নি। কোরআনের বিধান নিয়ে এমন প্রশ্ন করলে আমাদের দেশের তথাকথিত মোল্লারা হয়ত আমাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে দিত। অথচ হাজী সাহেব এতটুকু রুষ্ট না হয়ে কত সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। না, ভুল বলেননি হাজী আঃ সাত্তার। বালুচিস্তানে তিন বছর থাকাকালীন সময়ে আমি কোনো আঙ্গুল কাটা মানুষ দেখিনি। আবার গরমের সময় দরজা জানালা খুলে রেখে ঘুমালেও আমার একটা সুতাও চুরি হয়নি।
যে কথা বলছিলাম, রাস্তায় চোর চোট্টার ভয় নেই জেনে তো একা একাই বেরিয়ে পড়লাম, তখন কে জানত, এই কুমারী রাতে নৈশব্দ আমাকে এভাবে জাপটে ধরবে ? নির্জনতাকে বরাবরই ভয় আমার। আমার কেবলই মনে হয়, নির্জনতার মাঝেও আছে কেউ। তারা আমার সাথে সাথে পথ চলে, নিঃশব্দে কথা কয়। ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। হঠাৎ করেই যেন রাতের তাপমাত্রা অনেকটা নীচে নেমে গেল। হয়ত শূন্যের কাছাকাছি। বুঝি তুষারপাত শুরু হবে। জাহিদ ভাইয়ের বাসা থেকে বের হলেই এক লম্বা গলি। গলির বাতিগুলি ঘিরে ঝুলে আছে থোক থোক কুয়াশা। ঘন কুয়াশা গলির ভেতর। খালি চোখে খুব কাছের জিনিষও কেমন ঝাপসা দেখায়। এক আধিভৌতিক পরিবেশ চারিদিক। একবার ভাবি ফিরে যাই। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ভয় পেয়ে ফিরে গেছি জানলে সোবহান ভাই খুঁচিয়ে আমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমি দ্রুত পা চালাই। কয়েক মিনিটের গলি পথ আমার কাছে কয়েক বছরের বলে মনে হয়।
হঠাৎ মনে হল, পিছু পিছু আসছে কেউ। আমি ঝট করে ঘুরে দাঁড়াই। কেউ নেই ! কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করি। কোনো শব্দ নেই। তবে একটু পরে মনে হল, কুয়াশার ঝালর সরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে আসছে কেউ। মানুষের আকৃতি নয়। চারপেয়ে। শুনেছি, শীতের দেশে শ্বেত ভল্লূক থাকে। ভল্লূক টল্লূক নয় তো ? নাকি অন্য কোনো জন্তু জানোয়ার ? কাছেই তো পাহাড়। এবার আমি রীতিমত ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। পা দুটো জমে বরফ হয়ে গেঁথে যায় মাটির সাথে। আমি নড়তেও ভুলে যাই। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় ছায়ামূর্তি। একটা বিশালকায় কুকুর ! ছোটবেলায় একবার কুকুর কামড়েছিল পায়ে। সেই থেকে বাঘ ভাল্লুকের চেয়েও কুকুরকে বেশি ভয়। দৌড়ে পালাব, সে উপায়ও নাই। দৌড় দিলে যদি লুব্ধক সাহেব আমাকে চোর মনে করে বসে ? তাহলে আর রক্ষা নাই। কামড়ে আমার কাপড় খুলে নেবে। আমি বিবশ চোখে তাকিয়ে থাকি। দুলকি চালে হেলে দুলে সে এগিয়ে আসে আমার দিকে । কাছে এসে জুলুজুলু চোখে আমাকে দেখে। সে চোখ ভরা সন্দেহ। সে চোখের ভাষা আমি যেন ঠিক পড়তে পারি,
হায় হায় ! শেষ পর্যন্ত ইরানি কুত্তায়ও আমারে ছোটকু ডাকা শুরু করল ? বয়াতী বংশের পোলার ইজ্জতের এমন ফালুদা হইবো জানলে কে আসত এই দ্যাশে ? আল্লায় যে ক্যান আমারে এত ছোটখাটো বানাইল ? নিজের মাকুন্দ মার্কা চেহারার জন্য রাগ এবং লজ্জা দুটোই হয়। বলি,
- ঠিকই ধরছেন। আপনেগো দ্যাশে আইজই নয়া আইছি। আমি একজন ডাক্তার।
- আমিও ইরানের বাদশাহ। নাম রেজা শাহ।
কয় কী ? একলা রাইতে গলির মইধ্যে পাইয়া কুত্তাও আমার লগে মশকরা করে ? ইরানের বাদশাহ ? নাম রেজা শাহ ? পরোক্ষণেই মনে পড়ল, জহির ভাইয়ের সাথে পথের বিপদ নিয়ে কথা বলার সময় সোবহান ভাই টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, চিন্তা নাই, ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ সঙ্গে থাকবেন। খোঁচা মেরে কথা বলেন বলে প্রথম থেকেই লোকটাকে অপছন্দ আমার। তাই তার কথায় পাত্তা দেইনি। তাস খেলায় মশগুল ছিল বলে অন্যরাও কিছু বলেনি। তখন কে জানত, কুত্তার নাম রেজা শাহ ? কুকুরে কি আর নিজের নাম নিজে রাখতে পারে ?, নিশ্চয়ই মানুষেই রেখেছে। তাই বলে দেশের প্রয়াত বাদশাহের নামে নাম ?
রেজা শাহ পাহলভি, ইরানের পাহলভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, যাকে আধুনিক ইরানের স্থপতিও বলা হয়। কাজার রাজবংশের অধীনে সেনাবাহিনীতে কর্ম জীবন শুরু করলেও ১৯২৫ সালে সেই কাজার বংশের শেষ সম্রাট আহম্মদ শাহ কাজার কে ব্রিটিশদের সহায়তায় উৎখাত করে নিজেই সম্রাট হয়ে বসেন। তার সময়েই ইরানে পশ্চিমা ধাঁচে আধুনিকায়ন শুরু হয়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে। শাসক হিসেবে তিনি গণতন্ত্রে নয়, বরং ওয়ান ম্যান রুল বা একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। ফলে সেনাবাহিনী, তল্পিবাহক আমলা ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় ছাড়া অন্যদের কাছে তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না।
ইরানের মানুষ অধিকাংশই ধর্মভীরু। রেজা শাহের কয়েকটি সিদ্ধান্ত, যেমন পুরুষদের বাধ্যতামূলক ভাবে পশ্চিমা পোশাক পরা বিশেষ করে মাথায় হ্যাট পরা, তাতে মুসলমানদের সেজদা দেয়ার সময় কপাল মাটি স্পর্শ করতে পারত না, মহিলাদের হিজাব পরতে নিরুৎসাহিত করা, এমনকি স্কুলের মহিলা শিক্ষকদের মাথা ঢেকে না আসতে বাধ্য করা, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সিনেমা, হোটেল, রেস্টুরেন্টের দরজা নারীদের জন্য অবারিত করে দেয়া, এমনকি দেশের সব নাগরিককে সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক যোগ দিতে বলা যেখানে স্ত্রীরা গায়ে “চাঁদর” কিংবা মাথা হিজাব পরতে পারবে না। এই সব আদেশ নিষেধ ধর্মপ্রাণ ইরানিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রচণ্ড আঘাত হানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪১ সালে ইঙো-সোভিয়েট বাহিনী ইরান দখল করে নেয় এবং রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠায়। তার স্থলে যুবরাজ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভিকে ক্ষমতায় বসায়। তাকেও দেশের মানুষ রেজা শাহ বলেই ডাকত। তিনিও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আধুনিকায়ন ও পশ্চিমীকরণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। তবে পিতার চাইতেও আরও বেশি একনায়ক, আরও বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। শ্বেত বিপ্লব বা হোয়াইট রেভোলুশন এর মাধ্যমে এক সময় তিনি ইরানকে এক উন্নত, আধুনিক, সেকিউলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। যত দ্রুত তিনি দেশের সংস্কার সাধন করছিলেন, তত দ্রুত তিনি দেশের মানুষের মানসিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হন। তার অতি পশ্চিমীকরণ নীতি ইরানের ধর্মপ্রাণ মানুষকে, বিশেষ করে ধর্মগুরু বা উলামা সম্প্রদায়কে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি সোভিয়েত মদদ-পুষ্ট বামপন্থী মার্ক্সিস্ট দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ও রাষ্ট্র-যন্ত্র কাজে লাগিয়ে তাদের উপর চরম নিপীড়ন চালান। শুধু তাই নয়, তার স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্য উদারমনা মধ্যপন্থী ইসলামী দলগুলোর সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম গোঁড়া মৌলবাদী, কট্টর বামপন্থী ও উদার মধ্যপন্থীরা এক যোগে রেজা শাহকে উৎখাতের আন্দোলনে নামে।
শ্বেত বিপ্লবের এক অন্যতম বিষয় ছিল ভূমি সংস্কার। অর্থাৎ, প্রচুর ভূমির মালিক বা ল্যান্ডলর্ডদের কাছ থেকে সরকার জমি কিনে নিয়ে কম দামে ভূমিহীন কৃষকদের কাছে বিক্রি করত বা ইজারা দিত। কাগজে কলমে একে একটা মহৎ উদ্যোগ মনে হলেও এর সুবিধা মূলত রাজ পরিবার ভোগ করে এবং দেশের অর্ধের বেশি কৃষক এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে ভূমি হারিয়ে জমিদার শ্রেণী এবং জমি না পেয়ে কৃষক শ্রেণী যুগপৎ ভাবে রেজা শাহের উপর রুষ্ট হয়। উপরন্তু তার ভুল বাণিজ্য-নীতি, রাষ্ট্রে-যন্ত্রের অবাধ দুর্নীতি, দেশের অভিজাত শ্রেণীর প্রতি অগাধ স্বজনপ্রীতির কারণে দেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ, তরুণ ছাত্র সমাজ এবং ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম অসন্তোষ দানা বাঁধে।
ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ সালে প্রায় বিনা রক্তপাতে পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়। আড়াই হাজার বছরের পারস্য সম্রাজ্যের শেষ সম্রাট, মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি সপরিবারে বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, সে সময় রেজা শাহ দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে ভুগছিলেন। অথচ তাঁর এক সময়ের হিতাকাঙ্ক্ষী, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি তাকে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করে। কয়েক দেশে ঠোক্কর খেয়ে অবশেষে আশ্রয় মেলে তাঁর দূর সম্পর্কের শ্বশুর বাড়ি মিশরে। সেখানেই এক হোটেল কক্ষে এক বছর পর তাঁর অসহায় মৃত্যু হয়।
দেশের এত উন্নতি করা স্বত্বেও শুধুমাত্র জন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে, দেশের মানুষের বিশ্বাস ও মতামতের তোয়াক্কা না করার কারণে, রেজা শাহকে এই করুন পরিণতি ভোগ করতে হল। একজন স্বৈরশাসক, জোর করে দেশের সিংহাসন দখল করে রাখতে পারে, কিন্তু মানুষের মনের সিংহাসনে যে স্থান হয় না, রেজা শাহ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, কতটা ঘৃণিত হলে দেশের মানুষ তার নামে কুত্তার নাম রাখে !
আমি অবাক চোখে রেজা শাহের দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনও সে রাগী চোখে মাপছে আমাকে। বুঝতে পারছি না, আধুনিক ইরানের রূপকারের নামে নাম বলে তাকে সম্ভ্রম দেখাব নাকি একজন ঘৃণিত স্বৈরশাসকের নামে নাম বলে করুণা করব ? বুঝি আমার মনের ভাব বুঝতে পারে রেজা শাহ। গলার ভেতর গড়গড় শব্দ তুলে বলে,
- তোরা মানুষগুলা এত খারাপ ক্যান ? যত সব কুলাঙ্গার, নাফারমানগো নামে কুত্তার নাম রাখবি। আমাগো কি মান ইজ্জত বইলা কিছু নাই ?
শুনে তো আমার ভিমড়ি খাবার জোগাড়। এ দেশের কুত্তায়ও এই নাম চায় না ? ওরে কেমনে বুঝাই, আমরা মানুষেরা ভোল পালটাতে ওস্তাদ। ইতিহাস স্বাক্ষী, আজ যে জাতীয় বেঈমান, পাশার দান উল্টে গেলে সেই একদিন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়ে ওঠে। তবে যে ভাবে রেগে আছে, উলটা সিধা কিছু বললে শেষে অজায়গায় কামড় না দিয়ে বসে ! আমি তোসামোদী সুরে মিনমিন করে বলি,
- তা তো বটেই, তা তো বটেই। কামডা একেবারেই ঠিক হয় নাই। আপনের নাম হওয়া উচিৎ ছিল শাহেনশাহ।
- এ তো দেখি নেতাগো মতো কথা। আসলেই কি তুই ডাক্তার ?
বলে আমাকে ঘিরে বার দুই চক্কর কাটে। ফোঁস ফোঁস করে আমার গা শোঁকে। যেন বুঝতে চেষ্টা করছে, আসলেই আমি ডাক্তার কিনা ? আমার গায়ে ওষুধ, আয়োডিনের গন্ধ আছে কিনা ? দেখে ভয়ে আমার কাপড় ভিজিয়ে ফেলার জোগাড়। মনে মনে ভাবি, যে দেশের মানুষ এত অতিথিপরায়ণ, সে দেশের কুত্তা এত বেরহম ক্যান ?
নিজের দেশের সম্মান রক্ষার্থেই হোক কিংবা আমাকে চিনতে পেরেই হোক, দয়া হয় রেজা শাহের । হঠাৎ সে লেজ নাড়তে শুরু করে। যেন বলতে চাইছে,
- না তারস দকতোর কুচলু। তু রা গজ নেই মিগিরাম। ( ভয় পাইস না ছোটকু ডাক্তার। তরে কামড়ামু না)
- শুকরান। আপনে মেহেরবান।
- বিয়া, বাহাম বেরাম। (চল, এক সাথে যাই)।
- খায়েশ মিকুনাম আগাজুন। আপনের তকলীফ উঠান লাগবো না। আমি একাই যাইতে পারমু।
- কস কী ব্যাটা ? ভূতের ভয়ে তো কাপড় ভিজাইয়া ফালাইছোস। আমি লগে থাকলে ভূতের বাপেও কাছে আইবো না। কুত্তা হইলেও আমাগো একটা নীতি আছে। জবান দিলে জান দিয়া দেই।
এই কথাটা মিথ্যা না। শুনেছি, শরীরী কেউ পাশে থাকলে অশরীরী আত্মা কাছে ঘেঁষে না। হোক সে মানুষ কিংবা কুকুর। আমার কাছে তখন অদৃশ্য শত্রুর চাইতে এই দৃশ্যমান শত্রু অনেক ভালো। তাছাড়া পাঠান কুত্তায় জবান যখন দিছে, নিশ্চয়ই বরখেলাপ করবে না। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। পাশে পাশে পাহারা দিয়ে চলে গলির রাজা, রেজা শাহ।
বড় রাস্তায় পড়তেই আমার ভয় অনেকটা কেটে যায়। গলির চাইতে এখানে অনেক আলো। তবে রাস্তা জনশূন্য। ফাঁকা পেয়ে রেজা শাহ শাহেনশাহের মতো রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ একটা এম্বুলেন্স ওর গাঁ ঘেঁষে হুস করে চলে যায়। “কেঁউ” শব্দ করে রেজা শাহ তিন হাত দূরে লাফ দিয়ে পড়ে। পরোক্ষণেই গাঁ ঝাড়া দিয়ে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, শালা কুত্তার বাচ্চা, দেইখা চালাইতে পারোস না ?
ও কি মানুষকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিল ? নাকি আমি ভুল শুনলাম ? কেন যে মানুষও মানুষকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয় ? আমার তো মাঝে মাঝে কুকুরকেও মানুষের চেয়ে ভালো মনে হয়। অন্তত যারটা খায়, তাকে কামড় দেয় না।
বাকি রাস্তাটা দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। ভূত প্রেতের কথা মনেও আসে না। দেখি, ডরমিটরির মেইন গেট খোলা। কেয়ারটেকারকে কোথাও দেখা যায় না। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি রুমগুলোর বাতিও নেভানো। হয়ত তারাও ঘুমিয়ে। বুঝলাম, শীতের দেশে মানুষেরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। পিছন ফিরে দেখি, আমার স্বল্প সময়ের সহযাত্রী গেটের বাইরে দু’পা ভাঁজ করে কুক্কুরাসনে বসে আছে। ততক্ষণে কুকুরের প্রতি আমার সব ভয় বেমালুম কেটে গেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই ওকে আমার পরম বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। হেসে বললাম,
- যাই রে শাহেনশাহ। এখন থেকে আমি এইখানে থাকব। ক্ষুধা টুধা লাগলে চলে আসিস।
এত বকর বকর করা হিতৈষী বন্ধু আমার কোনো কথা বলল না। একদৃষ্টে চেয়ে রইল। আমিই আবার বললাম,
- তুইও বাড়ি যা। রাত অনেক হইছে। তুষার পড়তে পারে।
তাও কিছু বলল না শাহেনশাহ। আমি মাথা নেড়ে রুমে দিকে হাঁটা দেই। যেতে যেতে আর একবার পিছন ফিরে তাকাই। সেভাবেই ঠায় বসে আছে। ঝাপসা আলোয় ওর চোখ দুটো কি ভেজা দেখলাম ? নাকি সবই আমার মনের ভুল?