যাইহোক সপ্তাহখানেক কেটে যায়। আয়েশা মালিক নিজেকে হরিরামপুরের গ্রাম্য পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
দিনভর ডিউটীর পর বিকেলে অবসর পেলেই গ্রামটা ঘুরে দেখে ও। বেশ সুন্দর, ছিমছাম ও পরিপাটি গ্রাম। দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, মিঠে হাওয়ায় যখন ধান বা গমের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় তখন হৃদয়েও প্রশান্তি সুবাতাস বয়ে যায়। দূরে নীল পাহাড় দেখে নিজের জন্মভূমি ভূস্বর্গ পাশ্মীরের জন্য মন টানে আয়েশার।
একটা জিনিস অবশ্য বেশ অদ্ভূত লাগলো আয়েশার। হিন্দু অধ্যুষিৎ হরিরামপুরের রাস্তাঘাটে মুসলিমা আওরতদের সাথে দেখা হয়ে যায় ওর। পরিচয় না থাকলেও বুরখা, হিজাব বা অন্ততঃ মাথায় ওড়নার পর্দা দেখে আয়েশা চিনতে পারে মুসলিমাদের। একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ে ওর। রাস্তাঘাটে দেখা পাওয়া প্রায় প্রত্যেক মুসলিমা আওরতই গর্ভবতী। বুরখাওয়ালী বা হিজাবী মুসলিমা ঢাউস ভরা পেট নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বা রিকশায় বসে খানাখন্দকে ভরা সড়কে থরথর করে কাঁপতে থাকা গাভীন পেট আঁকড়ে ধরে আছে এমনটাই চোখে পড়ে আয়েশার। মুসলিমা বহেনরা গাভীন হচ্ছে, মাযহাবের সংখ্যাবৃদ্ধি করছে দেখে ভালই লাগে আয়েশার। আর মাশাল্লা! যা ঢাউস সাইযী গাভীন পেট হরিরামপুরের মাযহাবী বহেনদের! দেখলেই বোঝা যায় তাগড়া লড়কা পেটে নিয়ে ঘুরছে গর্ভবতী মুসলিমারা। মুসলমান সম্প্রদায়ের এমন দুঃসময়ে মাযহাবী বিবিদের পেট ভরে তাগড়া লড়কা বাচ্চা পয়দা হওয়াটা অবশ্য সৌভাগ্যের লক্ষণ... আয়েশার সরল বিশ্বাসে তাই মনে হয়। ও তো আর ভেতরের ঘটনাবলী জানে না।
তবে মালাউন হিন্দুতে ভরা হরিরামপুরের একটা ব্যাপার বেশ মনে ধরে আয়েশার। এখানে কি সুন্দর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে মুসলমান নারীদের প্রতি অপরিচিত পুরুষের সম্মান ও যত্ন নেয়াটা চোখে পড়ার মতো। কোনও পোয়াতী মুসলিমা সওয়ারী পেলে হাত ধরে খুব যত্ন করে মুসলিমা মাকে নিজের বাহনে চড়ায় হিন্দু রিকশাওয়ালা। পেটওয়ালী মুসলিমা খদ্দের পেলে হিন্দু সব্জীওয়ালা খুব কম মূল্যে ডাবল পরিমাণ সব্জী, আনাজ দিয়ে দেয়, যাতে গর্ভের সন্তান পুষ্টিকর খাবার পেয়ে তড়তড় করে বেড়ে ওঠে। এমনকী হিন্দু ছোকরারা নিজ উদ্যোগে বাজারের থলে পোয়াতী মুসলিমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় যাতে বেচারীর অযথা পরিশ্রম না হয়। হিন্দু অধ্যুষিৎ হওয়ায় গাঁয়ের সব কোণায় একটা করে মন্দির তো আছেই। আর সব মন্দিরের পুরুত মশাইরা নিজ নিজ মহল্লার বাড়ী বাড়ী গিয়ে গাভীন মুসলিমাদের খোঁজখবর নিয়ে আসে। আসলে, পুরো গাঁয়ের হিন্দু মরদরা হরিরামপুরের মুসলিমা পোয়াতীদের যে যত্ন আর খাতিরের আদরে মুড়ে রেখেছে তা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়ে সরলমতী ডাক্তার আয়েশা মালিক।
গাঁয়ে নতুন মুসলিমা ডাক্তার এসেছে চাউর হবার পরে মুসলিমা গর্ভবতী মায়েরা ভিড় করে আয়েশার হাসপাতালে, মাতৃত্বকালীন রূটিন চেকআপের জন্য। আয়েশা খেয়াল করে, হরিরামপুরের এসব গাভীন মুসলিমারা কখনোই তাদের শোওহরকে সাথে নিয়ে আসে না। বরং ও প্রায়শঃই খেয়াল করতে থাকে সগর্ভা মুসলমান মায়েদের ব্যাপারে হিন্দুরাই অধিক যত্নশীল। কখনো হিন্দু পুরোহিতরা তাদের মহল্লার পোয়াতী মুসলমান আওরতকে সঙ্গে নিয়ে আসে। অথবা হিন্দু বয়স্ক প্রতিবেশী তার পড়শীবাড়ীর অল্পবয়স্কা গাভীন মুসলিমাকে সঙ্গদান করে নিয়ে আসে। অথবা কোনও হিন্দু নেতা একাধিক অন্তঃসত্বা মুসলমান রমণীকে দল বেঁধে জীপ গাড়ীতে চড়িয়ে নিয়ে আসে গর্ভকালীন পরীক্ষার জন্য।
ওর হাসপাতালে পেটওয়ালী মুসলিমা মায়েদের দায়িত্ববান হিন্দু মরদরা নিয়ে আসছে আর ঘরে দিয়ে আসছে, রাস্তাঘাটে গাভীন মুসলমান নারীদের যেভাবে যত্নআত্তি করছে - এসব দেখে আয়েশার মনে হতেই থাকে হরিরামপুর গ্রামটি আসলে যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বেহেশত।
একদিন রোজকার এর মতো আউটডোর বন্ধ করে সবে উঠতে যাবে, এমন সময় দলবল নিয়ে রঘু এসে হাজির। দু’হাতে নমঃস্কার করে রঘু বলে, “নমস্তে ম্যাডাম! ভালোই আছেন দেখছি। আপনাকে আমাদের সাথে একবার যেতে হবে। নেতাজী একবার ডেকেছেন আপনাকে, শরীর খারাপ, চলুন শম্ভূলাল পণ্ডিতজীর বাড়ী।”
আয়েশা শান্ত স্বরেই বলে, “দেখুন, আমি সরকারী ডাক্তার, আমার ডিউটী এখানে। কারোর বাড়ি যেতে পারবো না। শরীর খারাপ হলে ওনাকে নিয়ে আসুন এখানে।”
রঘু কিছুক্ষন সরু চোখে দেখে। তারপর বলে, “দেখুন, ম্যাডাম আপনি না গেলে কিন্তু নেতাজী এখানে আসবেন। আর এখানে এলে কিন্তু তার পরিণাম আপনার জন্য ভালো হবে না। তাই বলছি, স্বেচ্ছায় চলুন। অনেক ফায়দা হবে আপনার।”
আয়েশা বলে, “মাফ করুন, আমি পারবো না। আপনি আসতে পারেন।”
বলে কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যায় আয়েশা।