এদিকে চৌবেজির থানায় তখন, সেকেন্ড অফিসার রায় তার সামনে চেয়ারে বসা মহিলাটিকে দেখছিল। সে অনেকদিন আছে এই থানায়। বয়স বেশী নয়,কাজে খুব বেশী উৎসাহ দেখায় না, তবে উপরওয়ালা যা নির্দেশ দেয় তা শোনে। তার বাড়ি বেশী দুরে নয়, বাড়ির কাছে পোস্টিং, এতেই সে খুশী। বেশী ভালো কাজ বা খারাপ কাজ কোনোটাই করে সে এখান থেকে অন্য জায়গায় যাবার ব্যবস্থা করতে রাজী নয়। এই মহিলাকে দেখে কেমন চেনা লাগে তবে মনে পড়েনা, চেষ্টাও করেনা মনে করার। মহিলার বয়স হয়েছে প্রায় আশির কাছেই হবে, চেহারায় খুব মোটা না, রং ফরসা টুকটুক করছে, মাথার সাদা চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পরণে ঢোলা মত কামিজ আর রঙিন পাজামা, হাতে একটি ওয়াকিং স্টিক।
ভদ্রমহিলাও চশমার ফাঁক দিয়ে রায়কে জরিপ করছিলেন। রায়ের কথাবার্তা এমনিতে ভদ্র,ব্যবহার সভ্য। সে একটু অপেক্ষা করল ও তরফের মুখ খোলার জন্য। কিন্তু দেখল ইনি এনার বয়সী অন্যান্য মহিলার মত বলিয়ে টাইপের নয়। উনিও যেন রায়েরই শুরু করার অপেক্ষায়।
-"আমাদের ইন চার্জ চৌবে সাহেব এখন একটু কাজে বেরিয়েছেন। আপনার যা বলার আমাকে বলতে পারেন, আমিও এ থানার একজন অফিসার। আপনার পরিচয়টা?"
মহিলাটি এবার একটু সোজা হলেন, তারপর আশপাশ দেখলেন। তাদের আশেপাশে কেউ ছিলনা, শুধু কনস্টেবল মঙ্গল ছাড়া। বাকি কনস্টেবলরা বাইরে গুলতানী করছিল, বড় সাহেব নেই। আরো দু একজন এদিক সেদিক ছিটিয়ে ছিল।
গলা একটু সাফ করে বললেন,
-" আমি বেটা, মিসেস কাপুর, জেনি কাপুর। এখানে ঐ রিটা অ্যাপার্টমেন্টসে থাকি, একশ বারো নম্বরে। আমি একাই থাকি, মেয়ে দিল্লিতে থাকে। যে মেয়েটী নিখোঁজ হয়েছে, চম্পা, ওর মা আমার মেয়ের বন্ধু ছিল। আগে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টই থাকত ওরা, ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি।"
রায় খুব একটা উৎসাহিত হলনা, কেসটা মূলত চৌবেজি নিজে দেখছে। সে এব্যাপারে খুব কিছু জানেটানে না। তবু কিছু না বললে এই ভদ্রমহিলা হয়ত তাকে সারাদিন বসিয়ে ঐ মেয়েটীর ছোটবেলার গল্প শোনাবে। সে বুঝে নিল একা বয়স্ক মহিলা, জীবনে কোনো রকমফের নেই। এসময়ে এরকম একটা ঘটনা যার কুশীলবরা মহিলার একদা পরিচিত। উনি বোধহয় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করে আর ধৈর্য্য ধরতে পারেননি, থানায় ছুটে এসেছেন সব জানার জন্য।
সে মুখটাকে নীরস করে উৎসাহে জল ঢালা গলায় বলল,
-"আপনি কি কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন এ ব্যাপারে? যা বলার একটু চটপট বলুন, আমি নোট করে রেখে দেব, বড় সাহেব এলে তাকে দিয়ে দেব। তারপর তিনি যদি মনে করেন আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবেন। ঠিকানাটা কী যেন?"
মিসেস কাপুর এখানেই স্কুলে পড়াতেন, সারাজীবন অনেক ছাত্রছাত্রী ও তাদের গার্জিয়ানদের চরিয়ে মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অসীম। উনি রায়ের ইঙ্গিতগুলো বুঝতে ভুল করলেন না। মুখটাকে শক্ত করে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে,
-"অফিসার, আপনি যখন এ কেস সম্বন্ধে কিছু জানেন না তখন আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয়না। এক কাজ করুন, আমার বক্তব্যের জায়গায় শুধু আমার নাম জেনি কাপুর ও ঠিকানা একশ বারো রিটা অ্যাপার্টমেন্ট লিখে রেখে দিন। ও আর তার সাথে এও লিখুন যে আমি নিখোঁজ চম্পার পরিবারকে অনেক দিন ধরে ভালোভাবে চিনতাম, তাই তাদের সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এবার আমি আসি।"
উনি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একহাতে স্টিকটাকে শক্ত করে ধরে আর অন্যহাতে কাপড়ের ঝোলাটা নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। রায় এই আকস্মিক ব্যবহারে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। কনেস্টেবল মঙ্গল পুরো ঘটনাটা দেখে বলে ওঠে,
-"এই মেমসাব তো খুব ভালো, অনেককাল এলাকায় আছেন। টীচার ছিলেন, লোকে খুব শ্রদ্ধা করে। কোনো ব্যাপার না হলে এমনি এমনি উনি সময় বরবাদ করতে থানায় আসবেনা।"
রায় এমনিতে সহজে বিচলিত হয়না, পুলিশের চাকরিতে তার উচ্চাশা কিছু নেই, যতটুকু না করলে নয় ততটুকু করে। তবু আজকের এই ব্যাপারটা তার একটু কেমন কেমন লাগল, মুখটায় একটা তেতো ভাব! সে চিন্তা করতে থাকল ঘটনাটা চৌবেজিকে বলা ঠিক হবে কিনা।
চৌবে যখন ফিরল তখন সেকেন্ড অফিসার রায় সকালের ঐ বয়স্ক মহিলার কথা পুরো চেপে যায়।
একটু পরেই থানায় রজতের ফোন আসে চৌবেজির কাছে, রজত একটু ভাবনার স্বরে বলে,
-" আমি কালকে একটু ঐ মন্দির এলাকাটা ঘুরে দেখতে চাই। আপনি আসতে পারবেন?”
-"স্যার, কালকে আমাকে একটু বড় সাহেবের কাছে যেতে হবে, তাই কালকে আমার সময় হবে না। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। এক কাজ করি,আমার থানার কনস্টেবল মঙ্গল, লোকাল ছেলে, সব চেনে জানে ভালো, ওকে বলে দেব ও আপনাকে ঘুরে সব দেখিয়ে দেবে।"
রজতের প্রস্তাবটা ভালো লাগল। ওতো এটাই চাইছিল, ঐ মন্দিরের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে নিজের মত করে, পুলিশ থাকবে না।
কনস্টেবল মঙ্গল সি.আই.ডি অফিসার রজতের জন্যে অপেক্ষা করবে মন্দিরের মুখে, চৌবেজি সেরকমই বলে দিয়েছিল। রজত নিজে গাড়ি চালিয়ে আসেনি, এদিকটা খুব ঘিঞ্জি, কোথায় পার্কিং পাবে না পাবে তাই রেন্টাল থেকে একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে। মন্দিরের কাছে এসে গাড়িটাকে বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে রজত নেমে পড়ে, ড্রাইভারকে বলে মন্দিরের সামনে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করতে। সামনেই একটি লম্বা মত বছর তিরিশের লোক দাঁড়িয়েছিল, লোকটা এগিয়ে এল,
-"স্যার, চৌবে সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।"
রজত হাসল অল্প, লোকটির চেহারাটা পেটানো, টানটান, তবে মুখটা বেশ বাচ্চা বাচ্চা, হাসিখুশি।
-"মঙ্গল? নমস্তে, বুঝতে পেরে গেছেন? চলুন মন্দিরের ভেতরে যাওয়া যাক।"
মন্দিরটা পাঁচিলঘেরা, অনেকটা জায়গা জুড়ে, রাস্তার ধারেই। রাস্তা আর মন্দিরের মাঝের জায়গাটা সিমেন্ট বাঁধানো, একটা কৃষ্ণচূড়া আর দু তিনটে দেবদারু, একটা অমলতাস এরকম কয়েকটা গাছগাছালিতে জায়গাটা বেশ ছায়াঘন চারধার। সকাল নটা থেকে এগারোটা ভোগ নিবেদনের জন্যে সামনের গেট এখন বন্ধ, এখন দশটা বাজে,আবার এগারটায় খুলবে। তবু কিছু মানুষের আনাগোণা দেখা গেল হয়ত কাজে এসেছে, দর্শনার্থী নয়। পাশের জুতো রাখার স্টলটাও বন্ধ। একদিকে একটা আধখোলা সাইড গেট, সেখান দিয়ে অনেকে দরকারে যাতায়াত করে, এছাড়া পেছনের দিকেও গেট আছে আশ্রমিক দের চলাফেরার জন্য। রজত মঙ্গলকে নিয়ে সাইডগেটটা দিয়ে ঢুকে পড়ে, এই মন্দির রজত বাইরে থেকেই দেখেছে, কোনোদিন ভেতরে ঢোকেনি। বাইরের গেট দিয়ে ঢুকলে মূল মন্দিরের পাঁচিল ও বড় কাঠের তৈরী কারুকার্য করা দরজা, সেটা এখন বন্ধ। দুই পাঁচিলের মধ্যিখানের চত্বরে দু চারটে দোকানদানি, সিকিউরিটীর কুঠরি, হাত পা ধোবার জায়গা ও পানীয় জল ইত্যাদির ব্যবস্থা। অনেক গাছপালাও আছে আর একেবারে শেষে একটা ছোট কাঠের দরজা আছে, ভেতরের লোকেদের ব্যবহারের জন্য। একজন গিয়ে সে দরজায় ধাক্কা দিতে দরজা অল্প খুলে তাকে ঢুকিয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল। একটা দোকান খোলা ছিল, সেখানে নানান মূর্তি, ধুপ ও দানী, ঘন্টা প্রদীপ, ধর্মীয় বই সিডি এরকম নানা সামগ্রী রাখা আছে। খদ্দের নেই, দোকানী একজন ফরসা মতন বৃদ্ধ, পরণে ধুতি ও ফতুয়া, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি ডাস্টার নিয়ে জিনিসগুলো মুছে মুছে রাখছে। মঙ্গলের কাছে জানা যায় এই দোকান থেকেই চম্পাদেবি পূজা দেবার সামগ্রি কিনত। রজত গিয়ে দোকানটার সামনে দাঁড়ালো। দু একটা জিনিস হাতে নিয়ে দাম করতে করতে কথাটা পাড়ে,
-"আচ্ছা, এই মন্দিরের বাইরে একটা পাগলি মেয়ে বসে থাকে, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?"
ভদ্রলোক প্রশ্নটা শুনে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনা, চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে অবাক চোখে তাকায়। রজত আবার বলতে, বলেন,
-"পাগল মেয়ে? কোন পাগল মেয়ে?"রজত ঘাবড়ায়, সেরেছে, এই মন্দিরে কখানা পাগলি মেয়ে আছে রে বাবা! সে আবার কিছু বলার আগেই মঙ্গল তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
"ঐ যে, ঐ মেয়েটা যে রোজ বাইরের চাতালে বসে ভিক্ষা করে। ও আসেনি আজকে?"
লোকটি এবার একটু সহজ স্বাভাবিক,
-"ও রানি? ওতো ঠিক পাগল নয়, পাগলামি কিছু করেনা। আসলে ওর বয়স অনুপাতে বুদ্ধি পাকেনি, অনাথ মেয়ে। বাবা মার সঙ্গে ফুটপাথে থাকত, দুজনেই কী একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। সেই শকেই বোধহয় একটু অদ্ভুত হয়ে গেছে। এখানেই মন্দিরের বাইরে থাকে। মন্দির থেকে দুবেলা খেতে দেয়, রাতে এই শেডের নীচে শুয়ে থাকে। তা ওর সঙ্গে কী দরকার?"
রজত ভদ্রলোকের দিকে তাকালো, মনে হল নেহাতই কৌতুহলের প্রশ্ন, কোনো কিছু সন্দেহ করে নয়। লোকটি বোধহয় মঙ্গলকে চেনেনা। রজত মঙ্গলকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে একটু মিথ্যার আশ্রয় নেয়,
-"না, আসলে এর আগে একদিন এসেছিলাম, তখন ও জামা চেয়েছিল। সেদিন সঙ্গে ছিলনা, পয়সা দিয়েছিলাম। আজ এদিকে আসার কথায় তাই ওর জন্যে পুরনো জামা নিয়ে এসেছিলাম। আমার কাজে দেরী হয়ে গেল, মন্দিরেও দর্শন হলনা। অন্তত মেয়েটাকে জামা দিয়ে যাই, নাহলে আবার কবে আসা হয়।"
কথা বলতে বলতে একটা প্রদীপ পছন্দ করে ভদ্রলোকে হাতে দিল, উনিও প্যাক করতে করতেই উত্তর দিলেন,
-"আছে কোথাও, একটু এদিক ওদিক দেখুন। এখন তো মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে, দর্শনার্থী আসবেনা, তাই অন্য কোনোখানে গেছে। দুপুরে প্রসাদ খাওয়ার সময় ঠিক এসে পড়বে।"
কেনা শেষ হয়ে গেলে ওরা বেরিয়ে এল। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, যদি মেয়েটা আসে।
-"স্যার, আপনি কি মন্দিরের ভেতরে যেতে চান। আমি তাহলে বলে দরজা খোলাতে পারি।"
মঙ্গলের প্রশ্নে রজত একটু ভাবে, মন্দিরের ভেতরে গিয়ে কিছু করার নেই। সেদিন ঐ মেয়েটি চম্পাকে দেখেছে মন্দিরের বাইরে। তার ঐ মেয়েটিকে দরকার।
-"না, মঙ্গল, আমি মন্দিরে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। একটু অপেক্ষা করে দেখি, না হলে আর কী করা যাবে।"
-"স্যার, একটা কথা ছিল, আমি চৌবে সাহেবকেই বলতাম, কিন্তু সাবের সঙ্গে কথা বলার সময় একদম ভুলে গিয়েছিলাম।"
রজত রানিকে না পেয়ে খুবই আশাহত হয়েছে, কোনো কিছুই ভালো লাগছিলনা, তবু মঙ্গলের এ কথায় একটু কৌতুহলে তাকায়,কিছু না বলে। মঙ্গল একটু আমতা আমতা করে বলে,
-"না, মানে হয়ত সেরকম কিছু দরকারী নয় তবু। এখানে একজন বুড়ি মেমসাব আছেন, মিসেস কাপুর, আগে ইস্কুলের খুব বড় ম্যাডাম ছিলেন এখন রিটায়ার করে গেছেন অনেক দিন হোলো। তা তিনি একদিন থানায় এসেছিলেন এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েটার ব্যপারে কী যেন বলার ছিল বলে। সেই সময় বড় সাব ছিলেন না, তা ছোটোসাব আমাদের ঐরকমই, একটু গাছাড়া, যেটুকু না করলে নয়। সে তো মেম্সাবকে কী বলতে মেমসাব একেবারে রেগে কিছু কথা না বলেই চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেসলেন পুলিশের কিছু জানার থাকলে যেন তারা ওঁর কাছে যায়, উনি আর থানায় আসবেন না। আসলে স্যার, ছোটসাব হয়ত ভাবছেন, বুড়ি মানুষ মাথার ঠিক নেই, কাজ নেই, তাই থানার সময় নষ্ট করতে চলে এসেছিল। কিন্তু স্যার, ঐ কাপুর মেমসাব ওরকম আর পাঁচটা বয়স্ক মহিলার মত নয়,খুব ব্যক্তিত্বময়ী, এখানে লোকে খুব শ্রদ্ধা করে। উনি যখন এসেছিলেন নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। তা আমি বলি কী আপনি যখন এসেছেন, ওর সঙ্গে দেখা করুন না একবার। কাছেই, সময়ও কেটে যাবে, ততক্ষণে ঐ মেয়েটা এসে যাবে।"
যেহেতু আগে এই বৃত্তান্ত শোনা ছিলনা, রজতের একটু ধন্দ জাগে। কে মিসেস কাপুর, কী বলতে চান! সে মঙ্গলের মত অত উৎসাহী হতে পারেনা, থানার ছোট সাহেবের মত তারও মনে হয় যে মহিলা হয়ত চেনা মেয়ের কেস দেখে বেশী উত্তেজিত হয়ে থানায় ছুটেছিলেন। আজকে তার রানির সঙ্গে দেখা করাটা বেশী জরুরী মনে হয়। তবু মঙ্গলকে নিরাশ করতে চায়না, তাই বলে,
-"বেশ তো, কাছেই যখন একবার যাওয়া যাবে নাহয় মিসেস কাপুরের কাছে। কিন্তু আগে রানি আসুক, ওর সাথে কথা বলি তারপর। নাহলে ও যদি এসে আবার কোথাও চলে যায়।"
মঙ্গল আর কিছু বলেনা। সেও অপেক্ষা করতে থাকে রজতের সঙ্গে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেলে,শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে রজত মিসেস কাপুরের ওখানে যাওয়াই স্থির করে। তাকেও ঘরে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে, অবশ্য মঙ্গলের কথা অনুযায়ী তিনি সচরাচর বাইরে বেরোন না। বেলা হয়ে এসেছে, ওরা উল্টোদিকে রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়ীতে উঠে বসে, মঙ্গল ড্রাইভারের পাশে বসে বুঝিয়ে দেয় কোথায় যেতে হবে। এটা ডাবল রোড,তাদের মন্দিরের দিকের রাস্তা ধরতে হবে। সামনেই সিগন্যাল, সেখান অবধি গিয়ে ইউ টার্ণ নিয়ে আবার গাড়ীটা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, রজত অন্যমনস্কভাবে পথের ধারে চোখ রেখেছে, মনে মনে রানির কথাই ভাবছে, কিভাবে ধরা যায় মেয়েটাকে। মন্দিরটা পেরিয়ে কিছুটা গেলে রাস্তার ধারে একটা নতুন বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে, সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি জমা করা আছে সেখানে কতগুলো রাস্তার ছেলেমেয়ে মলিন পোশাক, রুক্ষ চেহারায়, কাঞ্চা বা গুলি খেলছে। সামনেই তেমাথার সিগন্যাল তাই গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়েছে, রজতের মন ভার,চোখ বন্ধ। গাড়ীটা ডানদিকে সবে ঘুরেছে, কানে এল,"এ রানি, এবার তোর চাল"।
রানি, রানি, নামটা খুব চেনা মনে হচ্ছে, কোথায় শুনল যেন, বিদ্যুতের ঝিলিকের মত মাথায় আসতেই "রোকো রোকো" করে গাড়ীটা থামাতে বলল হুড়মুড় করে। বিরক্তিতে ড্রাইভারের মুখ্চোখ বিকৃত হয়ে এল আর একটা বিকট আওয়াজ করে ব্রেক কষল সে, মঙ্গল অবাক হয়ে পিছনে তাকালো। ভাগ্যিস শনিবারের দুপুরে এ অঞঅলে ট্র্যাফিক তেমন নেই, নাহলে নির্ঘাত পেছনে থেকে অন্য গাড়ি এসে ঠুকে দিত। রজত নেমে পড়ে, সঙ্গে মঙ্গলও।
-"তুই রানি, মন্দিরে থাকিস?" ডাক শুনে উঠে দাঁড়িয়েছে, পরনে একটা ময়লা ঘাঘরার মত স্কার্ট আর একটু কম ময়লা কুর্তা। ঘন ছোট ছোট লালচে কোঁকড়া রুক্ষ চুলে মুখখানা ঘেরা, গড়ন দেখে মনে হয় বয়স তের চোদ্দ বছরের মতো হবে তবে ঠিক বলা যায় না, বেশীও হতে পারে। দৃষ্টিও চুলের মতই, রুক্ষ, চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে এক হাত কোমরে আর অন্য হাতে কাঁচের গুলি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
-"হাঁ, তো কী হল?" সব ব্যাপারেই রজত যতটা সম্ভব সোজাসুজি পরিস্কার কথা বলতে পছন্দ করে সে সামনে যেই হোক না কেন, এখানেও তার অন্যথা হলনা। সে রানিকে জানালো, যে দিদি হারিয়ে গেছে, যার জন্য পুলিশ এসেছিল মন্দিরে, সে ঐ দিদির বন্ধু, দিদিকে খুঁজে বার করতে চায়। প্রথমে বুঝতে একটু সময় নিল মেয়েটা তারপর চোখে মুখে হাল্কা আগ্রহের আভাস। তাই দেখে রজত ওকে একটু সরে অন্য দিকে আসতে বলল, অন্য খেলুড়েরা খেলা থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। রানি আপত্তি করে না, ওরা সরে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রজত একবার মঙ্গলের দিকে দেখে নিল, সে উদাস ভঙ্গীতে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
-"রানি, ঐ দিদি যেদিন হারিয়ে গেছিল সেদিন তুই ওকে মন্দিরের কাছে দেখেছিলি রাত্তিরবেলায়?"
-"তুমি পুলিশ?"
-"না তো। কেন? আমি ঐ দিদির বন্ধু।"
-"আমি তো পুজারিকে বলেছিলাম সব। সেদিন আমি ভেতর থেকে প্রসাদ নিয়ে এখানে এসে দেখি পীপল এর তলায় কে দাঁড়িয়ে আছে। একটু ঠাহর করে দেখে মনে হল দিদি। এমনিতে দিদি মন্দিরে এলেই আমাকে পয়সা প্রসাদ বা কোনো জিনিস দেয় । সেদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আশপাশ কেউ ছিলনা, দিদি বলে ডাকলাম,ঠিক তখনই একটা কালো গাড়ি এল আর দিদি তাতে উঠে চলে গেল।"
রজত দুরে মন্দিরের দিকে দেখল। ওরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে সেখান আর মন্দিরের মাঝামাঝি জায়গায় উল্টোদিকে পার্কের পাঁচিল ঘেঁসে একটা পীপল গাছ। ও হাত বাড়িয়ে রানিকে ঐ গাছটা দেখাল,
-"কোন গাছ? ঐ গাছটার কথা বলছিস?"
-"হ্যাঁ।"কল্পনা করতে চেষ্টা করল রজত, মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ গাছতলায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে সঠিকভাবে চেনা সম্ভব কিনা। বাচ্চা মেয়ে, ওর দৃষ্টিশক্তি ভালোই হবে, তবু মনে হয় হলফ করে বলা যায়না। চম্পার আদলের কাউকেও দেখে থাকতে পারে।
-"তুই কালো গাড়িটা ঠিক দেখেছিলি? কী করে বুঝলি গাড়িটা ঐ দিদিদেরই গাড়ি?"
রানি এখন অনেক সহজ, প্রচুর উৎসাহ নিয়ে বোঝাতে আরম্ভ করল,
-"হাঁ তো, দিদি তো অনেকবার আসত মন্দিরে। আমি ওদের গাড়ি দেখলেই চিনতে পারি।"
-"তাও, একইরকমের গাড়ি অন্য কারুর ও তো হতে পারে, তাছাড়া দিদি হলে তোর কাছে আসবে না কেন? তুই ডেকেছিলি না?" এবার রানি একটু দ্বিধায় পড়েছে মনে হল। তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
-"না মানে আমি ঠিক জোরে ডাকিনি, মন্দিরের ওখান থেকেই "দিদি" "দিদি" বলেছিলাম। মনে হয় দিদি শুনতে পায়নি।"
-"কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল দিদি ওখানে?"
-"সে জানিনা। আমি তো মন্দিরের ভেতরে প্রসাদ নিতে গেছিলাম। বেরিয়ে এসে দেখলাম দিদিকে। যখন দিদি গাড়ির দিকে যাচ্ছে তখন ডাকলাম, তো দিদি শুনল না, গাড়িতে উঠে পড়ল।"
রজত এবার একটু ভাবনায় পড়ল। মেয়েটি সেঅর্থে পাগল নয়, হয়ত অপরিণতমনস্ক হওয়ার দরুন শিশুর মতই কল্পনাপ্রবণ, চম্পার নিরুদ্দেশের খবর শুনে নিজের দেখাকে মিলিয়ে কাহিনী তৈরী করছে! রানির কাছ থেকে এর বেশী কিছু খবর আশা না করেই রজত মানিব্যাগের ভেতর হাতড়াচ্ছিল মেয়েটাকে কিছু দেবে বলে।
-"গাড়ি কে চালাচ্ছিল তুই দেখেছিলি, ড্রাইভারই ছিল না অন্য কেউ?"
-"না, পরিস্কার দেখিনি, তবে ড্রাইভারই হবে?"
রজত এবার খুব জোরেই বলে ওঠে,
-"তুই পুলিশকে বলেছিস তো ঠিক দেখিসনি? এখন আবার বানিয়ে বলছিস? অন্য আর কেউ ছিল গাড়িতে?"
-"পুলিশ তো আমায় শুধু গাড়ি কেমন ছিল পুছেছিল। গাড়িটা খুব জোরে বেরিয়ে গেল, মন্দিরের সামনে অত জোরে কেউ গাড়ি চালায় না, ঐ দিদির ড্রাইভারই প্রত্যেক সময় অমন জোরে গাড়ি ঘোরাত। আর কাউকে তো দেখিনি, গাড়ি পুরো বন্ধ ছিল, কাঁচ তোলা।"
রজত আবার মন্দির থেকে জায়গাটা দেখল যেখানে রানির কথা অনুযায়ী গাড়িটা থেমেছিল। রজতের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট উঠে আসে। মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, দুই হাতে ঘাগরার দুদিকের খুঁট ধরে নাচের ভঙ্গীতে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। কথা শুনে পাগল মনে হয়না আবার যে খুব বুদ্ধিসুদ্ধি তাও বোধহয় না, অপরিণত। খুঁটিয়ে দেখল রজত, বানিয়ে বলছে মনে হচ্ছে না। ও যা বলছে তা ও হয় দেখেছে নয় ও ভাবে ও দেখেছে।
মঙ্গলকে ডেকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। আজ আর মিসেস কাপুরের ওখানে যাওয়া হবেনা, মঙ্গল একটু হতাশ হয় শুনে, রজত ওকে আশ্বস্ত করে কাল আসবে বলে, মঙ্গলকে ফোনে সময় জানিয়ে দেবে, ও মিসেস কাপুরের সাথে কথাও বলে রাখতে পারবে সেই মত। গাড়ি বাড়ির পানে বাঁ দিকের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একবার পিছন ফিরে কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখল রানি আবার ফিরে গেছে ঐ বালির ঢিবির পাশে, ওর ক্ষুদে সঙ্গীদের সাথে খেলায় যোগ দিয়েছে।
ভদ্রমহিলাও চশমার ফাঁক দিয়ে রায়কে জরিপ করছিলেন। রায়ের কথাবার্তা এমনিতে ভদ্র,ব্যবহার সভ্য। সে একটু অপেক্ষা করল ও তরফের মুখ খোলার জন্য। কিন্তু দেখল ইনি এনার বয়সী অন্যান্য মহিলার মত বলিয়ে টাইপের নয়। উনিও যেন রায়েরই শুরু করার অপেক্ষায়।
-"আমাদের ইন চার্জ চৌবে সাহেব এখন একটু কাজে বেরিয়েছেন। আপনার যা বলার আমাকে বলতে পারেন, আমিও এ থানার একজন অফিসার। আপনার পরিচয়টা?"
মহিলাটি এবার একটু সোজা হলেন, তারপর আশপাশ দেখলেন। তাদের আশেপাশে কেউ ছিলনা, শুধু কনস্টেবল মঙ্গল ছাড়া। বাকি কনস্টেবলরা বাইরে গুলতানী করছিল, বড় সাহেব নেই। আরো দু একজন এদিক সেদিক ছিটিয়ে ছিল।
গলা একটু সাফ করে বললেন,
-" আমি বেটা, মিসেস কাপুর, জেনি কাপুর। এখানে ঐ রিটা অ্যাপার্টমেন্টসে থাকি, একশ বারো নম্বরে। আমি একাই থাকি, মেয়ে দিল্লিতে থাকে। যে মেয়েটী নিখোঁজ হয়েছে, চম্পা, ওর মা আমার মেয়ের বন্ধু ছিল। আগে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টই থাকত ওরা, ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি।"
রায় খুব একটা উৎসাহিত হলনা, কেসটা মূলত চৌবেজি নিজে দেখছে। সে এব্যাপারে খুব কিছু জানেটানে না। তবু কিছু না বললে এই ভদ্রমহিলা হয়ত তাকে সারাদিন বসিয়ে ঐ মেয়েটীর ছোটবেলার গল্প শোনাবে। সে বুঝে নিল একা বয়স্ক মহিলা, জীবনে কোনো রকমফের নেই। এসময়ে এরকম একটা ঘটনা যার কুশীলবরা মহিলার একদা পরিচিত। উনি বোধহয় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করে আর ধৈর্য্য ধরতে পারেননি, থানায় ছুটে এসেছেন সব জানার জন্য।
সে মুখটাকে নীরস করে উৎসাহে জল ঢালা গলায় বলল,
-"আপনি কি কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন এ ব্যাপারে? যা বলার একটু চটপট বলুন, আমি নোট করে রেখে দেব, বড় সাহেব এলে তাকে দিয়ে দেব। তারপর তিনি যদি মনে করেন আপনার সঙ্গে কথা বলে নেবেন। ঠিকানাটা কী যেন?"
মিসেস কাপুর এখানেই স্কুলে পড়াতেন, সারাজীবন অনেক ছাত্রছাত্রী ও তাদের গার্জিয়ানদের চরিয়ে মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অসীম। উনি রায়ের ইঙ্গিতগুলো বুঝতে ভুল করলেন না। মুখটাকে শক্ত করে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে,
-"অফিসার, আপনি যখন এ কেস সম্বন্ধে কিছু জানেন না তখন আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয়না। এক কাজ করুন, আমার বক্তব্যের জায়গায় শুধু আমার নাম জেনি কাপুর ও ঠিকানা একশ বারো রিটা অ্যাপার্টমেন্ট লিখে রেখে দিন। ও আর তার সাথে এও লিখুন যে আমি নিখোঁজ চম্পার পরিবারকে অনেক দিন ধরে ভালোভাবে চিনতাম, তাই তাদের সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাস্য থাকলে পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এবার আমি আসি।"
উনি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একহাতে স্টিকটাকে শক্ত করে ধরে আর অন্যহাতে কাপড়ের ঝোলাটা নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। রায় এই আকস্মিক ব্যবহারে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। কনেস্টেবল মঙ্গল পুরো ঘটনাটা দেখে বলে ওঠে,
-"এই মেমসাব তো খুব ভালো, অনেককাল এলাকায় আছেন। টীচার ছিলেন, লোকে খুব শ্রদ্ধা করে। কোনো ব্যাপার না হলে এমনি এমনি উনি সময় বরবাদ করতে থানায় আসবেনা।"
রায় এমনিতে সহজে বিচলিত হয়না, পুলিশের চাকরিতে তার উচ্চাশা কিছু নেই, যতটুকু না করলে নয় ততটুকু করে। তবু আজকের এই ব্যাপারটা তার একটু কেমন কেমন লাগল, মুখটায় একটা তেতো ভাব! সে চিন্তা করতে থাকল ঘটনাটা চৌবেজিকে বলা ঠিক হবে কিনা।
চৌবে যখন ফিরল তখন সেকেন্ড অফিসার রায় সকালের ঐ বয়স্ক মহিলার কথা পুরো চেপে যায়।
একটু পরেই থানায় রজতের ফোন আসে চৌবেজির কাছে, রজত একটু ভাবনার স্বরে বলে,
-" আমি কালকে একটু ঐ মন্দির এলাকাটা ঘুরে দেখতে চাই। আপনি আসতে পারবেন?”
-"স্যার, কালকে আমাকে একটু বড় সাহেবের কাছে যেতে হবে, তাই কালকে আমার সময় হবে না। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। এক কাজ করি,আমার থানার কনস্টেবল মঙ্গল, লোকাল ছেলে, সব চেনে জানে ভালো, ওকে বলে দেব ও আপনাকে ঘুরে সব দেখিয়ে দেবে।"
রজতের প্রস্তাবটা ভালো লাগল। ওতো এটাই চাইছিল, ঐ মন্দিরের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে নিজের মত করে, পুলিশ থাকবে না।
কনস্টেবল মঙ্গল সি.আই.ডি অফিসার রজতের জন্যে অপেক্ষা করবে মন্দিরের মুখে, চৌবেজি সেরকমই বলে দিয়েছিল। রজত নিজে গাড়ি চালিয়ে আসেনি, এদিকটা খুব ঘিঞ্জি, কোথায় পার্কিং পাবে না পাবে তাই রেন্টাল থেকে একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে। মন্দিরের কাছে এসে গাড়িটাকে বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে রজত নেমে পড়ে, ড্রাইভারকে বলে মন্দিরের সামনে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করতে। সামনেই একটি লম্বা মত বছর তিরিশের লোক দাঁড়িয়েছিল, লোকটা এগিয়ে এল,
-"স্যার, চৌবে সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।"
রজত হাসল অল্প, লোকটির চেহারাটা পেটানো, টানটান, তবে মুখটা বেশ বাচ্চা বাচ্চা, হাসিখুশি।
-"মঙ্গল? নমস্তে, বুঝতে পেরে গেছেন? চলুন মন্দিরের ভেতরে যাওয়া যাক।"
মন্দিরটা পাঁচিলঘেরা, অনেকটা জায়গা জুড়ে, রাস্তার ধারেই। রাস্তা আর মন্দিরের মাঝের জায়গাটা সিমেন্ট বাঁধানো, একটা কৃষ্ণচূড়া আর দু তিনটে দেবদারু, একটা অমলতাস এরকম কয়েকটা গাছগাছালিতে জায়গাটা বেশ ছায়াঘন চারধার। সকাল নটা থেকে এগারোটা ভোগ নিবেদনের জন্যে সামনের গেট এখন বন্ধ, এখন দশটা বাজে,আবার এগারটায় খুলবে। তবু কিছু মানুষের আনাগোণা দেখা গেল হয়ত কাজে এসেছে, দর্শনার্থী নয়। পাশের জুতো রাখার স্টলটাও বন্ধ। একদিকে একটা আধখোলা সাইড গেট, সেখান দিয়ে অনেকে দরকারে যাতায়াত করে, এছাড়া পেছনের দিকেও গেট আছে আশ্রমিক দের চলাফেরার জন্য। রজত মঙ্গলকে নিয়ে সাইডগেটটা দিয়ে ঢুকে পড়ে, এই মন্দির রজত বাইরে থেকেই দেখেছে, কোনোদিন ভেতরে ঢোকেনি। বাইরের গেট দিয়ে ঢুকলে মূল মন্দিরের পাঁচিল ও বড় কাঠের তৈরী কারুকার্য করা দরজা, সেটা এখন বন্ধ। দুই পাঁচিলের মধ্যিখানের চত্বরে দু চারটে দোকানদানি, সিকিউরিটীর কুঠরি, হাত পা ধোবার জায়গা ও পানীয় জল ইত্যাদির ব্যবস্থা। অনেক গাছপালাও আছে আর একেবারে শেষে একটা ছোট কাঠের দরজা আছে, ভেতরের লোকেদের ব্যবহারের জন্য। একজন গিয়ে সে দরজায় ধাক্কা দিতে দরজা অল্প খুলে তাকে ঢুকিয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল। একটা দোকান খোলা ছিল, সেখানে নানান মূর্তি, ধুপ ও দানী, ঘন্টা প্রদীপ, ধর্মীয় বই সিডি এরকম নানা সামগ্রী রাখা আছে। খদ্দের নেই, দোকানী একজন ফরসা মতন বৃদ্ধ, পরণে ধুতি ও ফতুয়া, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি ডাস্টার নিয়ে জিনিসগুলো মুছে মুছে রাখছে। মঙ্গলের কাছে জানা যায় এই দোকান থেকেই চম্পাদেবি পূজা দেবার সামগ্রি কিনত। রজত গিয়ে দোকানটার সামনে দাঁড়ালো। দু একটা জিনিস হাতে নিয়ে দাম করতে করতে কথাটা পাড়ে,
-"আচ্ছা, এই মন্দিরের বাইরে একটা পাগলি মেয়ে বসে থাকে, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?"
ভদ্রলোক প্রশ্নটা শুনে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনা, চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে অবাক চোখে তাকায়। রজত আবার বলতে, বলেন,
-"পাগল মেয়ে? কোন পাগল মেয়ে?"রজত ঘাবড়ায়, সেরেছে, এই মন্দিরে কখানা পাগলি মেয়ে আছে রে বাবা! সে আবার কিছু বলার আগেই মঙ্গল তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
"ঐ যে, ঐ মেয়েটা যে রোজ বাইরের চাতালে বসে ভিক্ষা করে। ও আসেনি আজকে?"
লোকটি এবার একটু সহজ স্বাভাবিক,
-"ও রানি? ওতো ঠিক পাগল নয়, পাগলামি কিছু করেনা। আসলে ওর বয়স অনুপাতে বুদ্ধি পাকেনি, অনাথ মেয়ে। বাবা মার সঙ্গে ফুটপাথে থাকত, দুজনেই কী একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। সেই শকেই বোধহয় একটু অদ্ভুত হয়ে গেছে। এখানেই মন্দিরের বাইরে থাকে। মন্দির থেকে দুবেলা খেতে দেয়, রাতে এই শেডের নীচে শুয়ে থাকে। তা ওর সঙ্গে কী দরকার?"
রজত ভদ্রলোকের দিকে তাকালো, মনে হল নেহাতই কৌতুহলের প্রশ্ন, কোনো কিছু সন্দেহ করে নয়। লোকটি বোধহয় মঙ্গলকে চেনেনা। রজত মঙ্গলকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে একটু মিথ্যার আশ্রয় নেয়,
-"না, আসলে এর আগে একদিন এসেছিলাম, তখন ও জামা চেয়েছিল। সেদিন সঙ্গে ছিলনা, পয়সা দিয়েছিলাম। আজ এদিকে আসার কথায় তাই ওর জন্যে পুরনো জামা নিয়ে এসেছিলাম। আমার কাজে দেরী হয়ে গেল, মন্দিরেও দর্শন হলনা। অন্তত মেয়েটাকে জামা দিয়ে যাই, নাহলে আবার কবে আসা হয়।"
কথা বলতে বলতে একটা প্রদীপ পছন্দ করে ভদ্রলোকে হাতে দিল, উনিও প্যাক করতে করতেই উত্তর দিলেন,
-"আছে কোথাও, একটু এদিক ওদিক দেখুন। এখন তো মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে, দর্শনার্থী আসবেনা, তাই অন্য কোনোখানে গেছে। দুপুরে প্রসাদ খাওয়ার সময় ঠিক এসে পড়বে।"
কেনা শেষ হয়ে গেলে ওরা বেরিয়ে এল। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, যদি মেয়েটা আসে।
-"স্যার, আপনি কি মন্দিরের ভেতরে যেতে চান। আমি তাহলে বলে দরজা খোলাতে পারি।"
মঙ্গলের প্রশ্নে রজত একটু ভাবে, মন্দিরের ভেতরে গিয়ে কিছু করার নেই। সেদিন ঐ মেয়েটি চম্পাকে দেখেছে মন্দিরের বাইরে। তার ঐ মেয়েটিকে দরকার।
-"না, মঙ্গল, আমি মন্দিরে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। একটু অপেক্ষা করে দেখি, না হলে আর কী করা যাবে।"
-"স্যার, একটা কথা ছিল, আমি চৌবে সাহেবকেই বলতাম, কিন্তু সাবের সঙ্গে কথা বলার সময় একদম ভুলে গিয়েছিলাম।"
রজত রানিকে না পেয়ে খুবই আশাহত হয়েছে, কোনো কিছুই ভালো লাগছিলনা, তবু মঙ্গলের এ কথায় একটু কৌতুহলে তাকায়,কিছু না বলে। মঙ্গল একটু আমতা আমতা করে বলে,
-"না, মানে হয়ত সেরকম কিছু দরকারী নয় তবু। এখানে একজন বুড়ি মেমসাব আছেন, মিসেস কাপুর, আগে ইস্কুলের খুব বড় ম্যাডাম ছিলেন এখন রিটায়ার করে গেছেন অনেক দিন হোলো। তা তিনি একদিন থানায় এসেছিলেন এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েটার ব্যপারে কী যেন বলার ছিল বলে। সেই সময় বড় সাব ছিলেন না, তা ছোটোসাব আমাদের ঐরকমই, একটু গাছাড়া, যেটুকু না করলে নয়। সে তো মেম্সাবকে কী বলতে মেমসাব একেবারে রেগে কিছু কথা না বলেই চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেসলেন পুলিশের কিছু জানার থাকলে যেন তারা ওঁর কাছে যায়, উনি আর থানায় আসবেন না। আসলে স্যার, ছোটসাব হয়ত ভাবছেন, বুড়ি মানুষ মাথার ঠিক নেই, কাজ নেই, তাই থানার সময় নষ্ট করতে চলে এসেছিল। কিন্তু স্যার, ঐ কাপুর মেমসাব ওরকম আর পাঁচটা বয়স্ক মহিলার মত নয়,খুব ব্যক্তিত্বময়ী, এখানে লোকে খুব শ্রদ্ধা করে। উনি যখন এসেছিলেন নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। তা আমি বলি কী আপনি যখন এসেছেন, ওর সঙ্গে দেখা করুন না একবার। কাছেই, সময়ও কেটে যাবে, ততক্ষণে ঐ মেয়েটা এসে যাবে।"
যেহেতু আগে এই বৃত্তান্ত শোনা ছিলনা, রজতের একটু ধন্দ জাগে। কে মিসেস কাপুর, কী বলতে চান! সে মঙ্গলের মত অত উৎসাহী হতে পারেনা, থানার ছোট সাহেবের মত তারও মনে হয় যে মহিলা হয়ত চেনা মেয়ের কেস দেখে বেশী উত্তেজিত হয়ে থানায় ছুটেছিলেন। আজকে তার রানির সঙ্গে দেখা করাটা বেশী জরুরী মনে হয়। তবু মঙ্গলকে নিরাশ করতে চায়না, তাই বলে,
-"বেশ তো, কাছেই যখন একবার যাওয়া যাবে নাহয় মিসেস কাপুরের কাছে। কিন্তু আগে রানি আসুক, ওর সাথে কথা বলি তারপর। নাহলে ও যদি এসে আবার কোথাও চলে যায়।"
মঙ্গল আর কিছু বলেনা। সেও অপেক্ষা করতে থাকে রজতের সঙ্গে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেলে,শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে রজত মিসেস কাপুরের ওখানে যাওয়াই স্থির করে। তাকেও ঘরে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে, অবশ্য মঙ্গলের কথা অনুযায়ী তিনি সচরাচর বাইরে বেরোন না। বেলা হয়ে এসেছে, ওরা উল্টোদিকে রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়ীতে উঠে বসে, মঙ্গল ড্রাইভারের পাশে বসে বুঝিয়ে দেয় কোথায় যেতে হবে। এটা ডাবল রোড,তাদের মন্দিরের দিকের রাস্তা ধরতে হবে। সামনেই সিগন্যাল, সেখান অবধি গিয়ে ইউ টার্ণ নিয়ে আবার গাড়ীটা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, রজত অন্যমনস্কভাবে পথের ধারে চোখ রেখেছে, মনে মনে রানির কথাই ভাবছে, কিভাবে ধরা যায় মেয়েটাকে। মন্দিরটা পেরিয়ে কিছুটা গেলে রাস্তার ধারে একটা নতুন বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে, সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বালি জমা করা আছে সেখানে কতগুলো রাস্তার ছেলেমেয়ে মলিন পোশাক, রুক্ষ চেহারায়, কাঞ্চা বা গুলি খেলছে। সামনেই তেমাথার সিগন্যাল তাই গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়েছে, রজতের মন ভার,চোখ বন্ধ। গাড়ীটা ডানদিকে সবে ঘুরেছে, কানে এল,"এ রানি, এবার তোর চাল"।
রানি, রানি, নামটা খুব চেনা মনে হচ্ছে, কোথায় শুনল যেন, বিদ্যুতের ঝিলিকের মত মাথায় আসতেই "রোকো রোকো" করে গাড়ীটা থামাতে বলল হুড়মুড় করে। বিরক্তিতে ড্রাইভারের মুখ্চোখ বিকৃত হয়ে এল আর একটা বিকট আওয়াজ করে ব্রেক কষল সে, মঙ্গল অবাক হয়ে পিছনে তাকালো। ভাগ্যিস শনিবারের দুপুরে এ অঞঅলে ট্র্যাফিক তেমন নেই, নাহলে নির্ঘাত পেছনে থেকে অন্য গাড়ি এসে ঠুকে দিত। রজত নেমে পড়ে, সঙ্গে মঙ্গলও।
-"তুই রানি, মন্দিরে থাকিস?" ডাক শুনে উঠে দাঁড়িয়েছে, পরনে একটা ময়লা ঘাঘরার মত স্কার্ট আর একটু কম ময়লা কুর্তা। ঘন ছোট ছোট লালচে কোঁকড়া রুক্ষ চুলে মুখখানা ঘেরা, গড়ন দেখে মনে হয় বয়স তের চোদ্দ বছরের মতো হবে তবে ঠিক বলা যায় না, বেশীও হতে পারে। দৃষ্টিও চুলের মতই, রুক্ষ, চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে এক হাত কোমরে আর অন্য হাতে কাঁচের গুলি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
-"হাঁ, তো কী হল?" সব ব্যাপারেই রজত যতটা সম্ভব সোজাসুজি পরিস্কার কথা বলতে পছন্দ করে সে সামনে যেই হোক না কেন, এখানেও তার অন্যথা হলনা। সে রানিকে জানালো, যে দিদি হারিয়ে গেছে, যার জন্য পুলিশ এসেছিল মন্দিরে, সে ঐ দিদির বন্ধু, দিদিকে খুঁজে বার করতে চায়। প্রথমে বুঝতে একটু সময় নিল মেয়েটা তারপর চোখে মুখে হাল্কা আগ্রহের আভাস। তাই দেখে রজত ওকে একটু সরে অন্য দিকে আসতে বলল, অন্য খেলুড়েরা খেলা থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। রানি আপত্তি করে না, ওরা সরে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রজত একবার মঙ্গলের দিকে দেখে নিল, সে উদাস ভঙ্গীতে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
-"রানি, ঐ দিদি যেদিন হারিয়ে গেছিল সেদিন তুই ওকে মন্দিরের কাছে দেখেছিলি রাত্তিরবেলায়?"
-"তুমি পুলিশ?"
-"না তো। কেন? আমি ঐ দিদির বন্ধু।"
-"আমি তো পুজারিকে বলেছিলাম সব। সেদিন আমি ভেতর থেকে প্রসাদ নিয়ে এখানে এসে দেখি পীপল এর তলায় কে দাঁড়িয়ে আছে। একটু ঠাহর করে দেখে মনে হল দিদি। এমনিতে দিদি মন্দিরে এলেই আমাকে পয়সা প্রসাদ বা কোনো জিনিস দেয় । সেদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আশপাশ কেউ ছিলনা, দিদি বলে ডাকলাম,ঠিক তখনই একটা কালো গাড়ি এল আর দিদি তাতে উঠে চলে গেল।"
রজত দুরে মন্দিরের দিকে দেখল। ওরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে সেখান আর মন্দিরের মাঝামাঝি জায়গায় উল্টোদিকে পার্কের পাঁচিল ঘেঁসে একটা পীপল গাছ। ও হাত বাড়িয়ে রানিকে ঐ গাছটা দেখাল,
-"কোন গাছ? ঐ গাছটার কথা বলছিস?"
-"হ্যাঁ।"কল্পনা করতে চেষ্টা করল রজত, মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ গাছতলায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে সঠিকভাবে চেনা সম্ভব কিনা। বাচ্চা মেয়ে, ওর দৃষ্টিশক্তি ভালোই হবে, তবু মনে হয় হলফ করে বলা যায়না। চম্পার আদলের কাউকেও দেখে থাকতে পারে।
-"তুই কালো গাড়িটা ঠিক দেখেছিলি? কী করে বুঝলি গাড়িটা ঐ দিদিদেরই গাড়ি?"
রানি এখন অনেক সহজ, প্রচুর উৎসাহ নিয়ে বোঝাতে আরম্ভ করল,
-"হাঁ তো, দিদি তো অনেকবার আসত মন্দিরে। আমি ওদের গাড়ি দেখলেই চিনতে পারি।"
-"তাও, একইরকমের গাড়ি অন্য কারুর ও তো হতে পারে, তাছাড়া দিদি হলে তোর কাছে আসবে না কেন? তুই ডেকেছিলি না?" এবার রানি একটু দ্বিধায় পড়েছে মনে হল। তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
-"না মানে আমি ঠিক জোরে ডাকিনি, মন্দিরের ওখান থেকেই "দিদি" "দিদি" বলেছিলাম। মনে হয় দিদি শুনতে পায়নি।"
-"কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল দিদি ওখানে?"
-"সে জানিনা। আমি তো মন্দিরের ভেতরে প্রসাদ নিতে গেছিলাম। বেরিয়ে এসে দেখলাম দিদিকে। যখন দিদি গাড়ির দিকে যাচ্ছে তখন ডাকলাম, তো দিদি শুনল না, গাড়িতে উঠে পড়ল।"
রজত এবার একটু ভাবনায় পড়ল। মেয়েটি সেঅর্থে পাগল নয়, হয়ত অপরিণতমনস্ক হওয়ার দরুন শিশুর মতই কল্পনাপ্রবণ, চম্পার নিরুদ্দেশের খবর শুনে নিজের দেখাকে মিলিয়ে কাহিনী তৈরী করছে! রানির কাছ থেকে এর বেশী কিছু খবর আশা না করেই রজত মানিব্যাগের ভেতর হাতড়াচ্ছিল মেয়েটাকে কিছু দেবে বলে।
-"গাড়ি কে চালাচ্ছিল তুই দেখেছিলি, ড্রাইভারই ছিল না অন্য কেউ?"
-"না, পরিস্কার দেখিনি, তবে ড্রাইভারই হবে?"
রজত এবার খুব জোরেই বলে ওঠে,
-"তুই পুলিশকে বলেছিস তো ঠিক দেখিসনি? এখন আবার বানিয়ে বলছিস? অন্য আর কেউ ছিল গাড়িতে?"
-"পুলিশ তো আমায় শুধু গাড়ি কেমন ছিল পুছেছিল। গাড়িটা খুব জোরে বেরিয়ে গেল, মন্দিরের সামনে অত জোরে কেউ গাড়ি চালায় না, ঐ দিদির ড্রাইভারই প্রত্যেক সময় অমন জোরে গাড়ি ঘোরাত। আর কাউকে তো দেখিনি, গাড়ি পুরো বন্ধ ছিল, কাঁচ তোলা।"
রজত আবার মন্দির থেকে জায়গাটা দেখল যেখানে রানির কথা অনুযায়ী গাড়িটা থেমেছিল। রজতের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট উঠে আসে। মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেনা, দুই হাতে ঘাগরার দুদিকের খুঁট ধরে নাচের ভঙ্গীতে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। কথা শুনে পাগল মনে হয়না আবার যে খুব বুদ্ধিসুদ্ধি তাও বোধহয় না, অপরিণত। খুঁটিয়ে দেখল রজত, বানিয়ে বলছে মনে হচ্ছে না। ও যা বলছে তা ও হয় দেখেছে নয় ও ভাবে ও দেখেছে।
মঙ্গলকে ডেকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। আজ আর মিসেস কাপুরের ওখানে যাওয়া হবেনা, মঙ্গল একটু হতাশ হয় শুনে, রজত ওকে আশ্বস্ত করে কাল আসবে বলে, মঙ্গলকে ফোনে সময় জানিয়ে দেবে, ও মিসেস কাপুরের সাথে কথাও বলে রাখতে পারবে সেই মত। গাড়ি বাড়ির পানে বাঁ দিকের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একবার পিছন ফিরে কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখল রানি আবার ফিরে গেছে ঐ বালির ঢিবির পাশে, ওর ক্ষুদে সঙ্গীদের সাথে খেলায় যোগ দিয়েছে।