পরিচালকঃ ধ্রব বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়: আবীর চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা, অর্জুন চক্রবর্তী
রহস্য শব্দটা বাঙালি জীবন থেকে প্রায় হারাতে বসেছে। হারাতে বসেছে দুর্গাপুজোর অপেক্ষাও। তবু সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এখনও হঠাৎ ভেসে ওঠে কোনও মিম। তাতে লেখা, ‘পুজোর আর ১৪০ দিন।’ নেচে ওঠে মন আনন্দে। খুশিতে। নাকে গন্ধ ভেসে ওঠে পুজোবার্ষিকীর। তাতে ছেলেবেলার কত দাদা উঁকি মেরে যান। ফেলুদা-ঘনাদা-টেনিদা।
তেমনই এক দাদা সোনাদা। তার যদিও সাগরেদরা অভিনব। ঝিনুক ও আবীর। এর আগে তাদের আমরা দেখেছিলাম ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ ছবিতে। ভোটের বাজারে যখন মগজ ঘেঁটে আছে গরমে ও হযবরল-তে, তখন ফের এই জুটিকে দেখে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে, ভোট চালচিত্র পেরিয়ে যখন পুজোর বেড়ানোয় বেরিয়ে পড়া যায় তাদের সঙ্গে।
বাংলা সিনেমা বা সাহিত্যে পুজো ফিরে ফিরে এসেছে আজন্ম। বাঙালি জীবনের অনিবার্য এই দুর্গাপ্রতিমা উঁকি দিয়েছেন সাম্প্রতিকতার যে কোনও সমস্যায়। তা সে কখনও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ, তো কখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়। ঋতুপর্ণ ঘোষের নামও এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের সমস্যা সমাধানে বার বারই ফিরে এসেছেন মা দুর্গা এ সব ছবিতে। স্বমহিমায়। বাতলে দিয়েছেন মুশকিল আসানের চাবিকাঠি।
দুর্গেশগড়ের রহস্যতেও যেন-বা একই আবহ। পুজোর প্রেক্ষাপটে গ্রামে এসেছেন মা দুর্গা। তাতে দেবরায় বংশের খুব হইচই। সোনাদাও তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে তার ছাত্রের পরিচিত এই পরিবারে হাজির। আর তাদের সঙ্গেই হাজির রহস্যও। মনে পড়ছিল বার বার, ফেলুদার কথা। রহস্যের গুণমানের কারণে না, আবহের কারণে। ফেলুদার গোঁসাইপুর সরগরম যেন-বা এমনই। সেই গ্রাম। সেই যৌথপরিবার। সেই সম্পত্তিজনিত সমস্যা। আর সেই রহস্য।
ছবির দৃশ্যে অর্জুন এবং আবীর।
যদিও ফেলুদার চেয়ে বেশ আলাদা সোনাদা। সব দিকেই। তোপসেকে নিয়ে আপামর বাঙালির বিবাহজনিত যে চিন্তা, সোনাদার দুই সঙ্গীর তা নেই। আবীর ও ঝিনুক প্রেমিক-প্রেমিকা। সোনাদার অভিযানের সাথী এই কাপল। বেশ অভিনব লাগে এই রসায়ন। রহস্যের গা ছমছমে প্রেক্ষাপটে কোথাও একটু হালকাও লাগে তাই। লাগে সাম্প্রতিকও।
সাম্প্রতিক লাগে, দেবরায় বংশের মেজছেলেকেও। কৌশিক সেন অভিনীত এই চরিত্র এনআরআই। বিদেশি হালচালে সব কিছু দেশীয়ই খারাপ তার কাছে। বার বার তাই বাকি পরিবারের নৈতিকতার সামনে সব কিছু তার অবান্তর লাগে। নিজেকে তিনি বলেন, পরিবারের মরা ছেলে। অন্য দিকে, পারিবারিক ভারসাম্য বজায় রাখেন বাড়ির বড়ছেলে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। ভারী যত্নে এ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য।
আরও পড়ুন, ‘বাবাকে মুখ বন্ধ রাখতে বল, না হলে…’, অনুরাগের মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি!
আর এ সব কিছুর নেপথ্যে খেলে যায় ইতিহাস। ফিরে ফিরে আসে কিছু নাম। সিরাজদ্দৌল্লা, জগৎ শেঠ। দু’শো বছর আগের সঞ্চিত রত্নভাণ্ডার নিয়ে আজও পারিবারিক বচসা জারি থাকে। স্থানীয় পারিবারিক ঘনিষ্ঠ খরাজ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় কৌশিকের। সংলাপে শোনা যায়, ‘‘চারপাশের পরিবারগুলি যদি ভাঙে, মূর্তির চালচিত্র কী ভাবে জোড়া থাকে!’’
এই সব ভাঙন ও চিরচেনা বাঙালি পারিবারিক কোন্দলের সামনেই বাজতে থাকে ঢাক। চলে পুজো। জমে ওঠে আবহ। আর খসে খসে পড়ে এক এক জনের মুখোশ। পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই মেখেছেন আবহ। জমজমাট লাগে থ্রিলার। শেষে মাটির তলা থেকে গুপ্তধন আবিষ্কার সেই জমজমাটেরই রেশ টেনে নিয়ে যায়।
বাঙালি ক্লিশে রহস্যের গল্পে এই পটভূমি খুব চেনা। তাই ভাল লাগলেও প্রত্যাশা তৈরি হয়। নেটফ্লিক্সে হালফিল রহস্যের যে সিরিজ দেখছি, সেই সব প্রযুক্তির অভিনব চিহ্নের সামনে একটু একঘেয়ে লাগে এ ছবি মাঝেমাঝে। যেমন, জলের নীচে আবীরের গুপ্তধন খোঁজা বা গুহার ভেতর পশুর অবির্ভাব। অ্যাভেঞ্জার্স দেখা শিশুদের চোখ কি এ সব মুহূর্ত বিশ্বাস করবে? প্রশ্ন থেকে যায়। আর একটু কি ভাবা যেত না!
তবু এ ছবি ভাল লাগে। কারণ, ছেলেবেলার নস্টালজিয়ার মতোই, ‘পায়ে ধরে সাধা/রা নাহি দেন রাধা’ বা ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’ গুপ্তধনের সংকেত দেখে মাথা খাটাতে ইচ্ছে করে। সোনাদা হিসেবে আবীর যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। যদিও ব্যোমকেশ বা ফেলুদা হিসেবে তাঁকে দেখে দেখে, মাঝেমধ্যে টাইপ মনেও হয়। এত গোয়েন্দা কেন! এমনও মনে হতে পারে আপনার। তবু ভোটের গুলি-বোমার থেকে যে খানিক সরে যায় মন পুজোর কলকাতায়, তার জন্য পরিচালকে ধন্যবাদ দিতেও ইচ্ছে করে শেষে।