তিনি জামে'আ সালাফিয়ার রেক্টরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি 'ইদারাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়্যাহ ওয়াদ দাওয়াহ ওয়াল ইফতা' বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ড. আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ বলেন,
وبجانب نشاطه فى مجال التدريس والصحافة ساهم فى مجالات أخرى فى الجامعة السلفية، منها المطبعة، وإدارة البحوث الإسلامية، وأشرف على المؤسستين من وقت إنشائها، بل يعتبر هو من مؤسسيها.
'শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি জামে'আ সালাফিয়ার অন্যান্য ক্ষেত্র সমূহেও অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে জামে'আর প্রেস ও ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান অন্যতম। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি এ দু'টি সংস্থার তত্ত্বাবধান করে এসেছেন; বরং তিনি সেগুলোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে'। (জুহূদ মুখলিছাহ, পৃঃ ২৭৪।)
আরবী, উর্দূ, হিন্দী ও ইংরেজী ভাষায় অসংখ্য পুস্তক এখান থেকে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিছ ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী রচিত মিশকাতুল মাছাবীহ-এর আরবী ভাষ্য 'মির'আতুল মাফাতীহ' অন্যতম।
তিনি এখান থেকে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর ভূমিকা লিখতেন। যেমন 'মির'আতুল মাফাতীহ' গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন,
والحق أن هذا الشرح رفع مكانة علماء الهند بين علماء الحديث فى العالم وفتح أمامهم طريقا نافعا ومنهجا متميزا لدراسة الحديث النبوى الشريف وللاستنباط منه، زاد الله هذا الشرح قبولا ونفعا، وأسكن مؤلفه جنة الفردوس.
'বস্ত্তত এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি বিশ্বের মুহাদ্দিছদের মাঝে ভারতীয় আলেমদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে এবং তাদের সামনে হাদীছে নববী অধ্যয়ন-পর্যালোচনা ও তা থেকে মাসআলা ইস্তিম্বাতের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ পথ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পদ্ধতির দ্বার উন্মোচন করেছে। আল্লাহ এই ব্যাখ্যাগ্রন্থটির গ্রহণযোগ্যতা ও উপকারিতা বৃদ্ধি করুন এবং এর রচয়িতাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন'।(ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী, মির'আতুল মাফাতীহ (বেনারস : জামে'আ সালাফিয়া, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৯৮), ১ম খন্ড, ভূমিকা দ্র.।)
অনুরূপভাবে উক্ত বিভাগ থেকে প্রকাশিত 'হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ'মালুহু' (حياة المحدث شمس الحق وأعماله) শিরোনামে প্রকাশিত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন,
فهذه دراسة تتناول ترجمة علم من أعلام السلفيين فى الهند، أنه قد وقف حياته وكرس جهوده لخدمة الحديث النبوى، واختار لذلك منهجا علميا نزيها يمتاز بالدقة والوضوح، ويخلو من التعصب المذهبى والتأويل البعيد والتعسف الردئ.
'এটি এমন একজন ভারতীয় আহলেহাদীছ বিদ্বানের জীবন ও কর্মের পর্যালোচনা, যিনি হাদীছে নববীর খিদমতের জন্য নিজের জীবন ও প্রচেষ্টাকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এজন্য সূক্ষ্মতা ও স্পষ্টতার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এবং মাযহাবী গোঁড়ামী, দূরবর্তী ব্যাখ্যা ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত পরিচ্ছন্ন গবেষণা পদ্ধতি নির্বাচন করেছিলেন'।(মুহাম্মাদ উযাইর সালাফী, হায়াতুল মুহাদ্দিছ শামসুল হক ওয়া আ'মালুহু (বেনারস : জামে'আ সালাফিয়া, ১৯৭৯), পৃঃ الف। )
তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করে জামে'আ সালাফিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৮ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে 'কাদিয়ানী মতবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ' শিরোনামে এবং ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠিত সীরাতুন্নবী সম্মেলনে যোগদান করে 'শরী'আতের দ্বিতীয় উৎস হাদীছ' (السنة مصدر ثان للتشريع) বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাছাড়া সঊদী আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশের সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খন্ড, পৃ. ২৩০।)
২৯ ও ৩০ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে বেনারসের 'জামে'আ সালাফিয়া'য় দু'দিনব্যাপী 'নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান হুসাইনী বুখারী (রহঃ) : হায়াত ওয়া খিদমাত' (নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান হুসাইনী বুখারী : জীবন ও অবদান) শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনারে বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসরবৃন্দ অংশগ্রহণ করে নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে ২৯টি তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ পাঠ করেন। উক্ত সেমিনারে ড. আযহারী সেমিনারের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেন। (আস-সিরাজ, মে ২০০৬, পৃঃ ৩-৯; আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃঃ ১৭, মনীষী চরিত : নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ) দ্র.।) উক্ত সেমিনারে অংশগ্রহণকারী 'আস-সিরাজ' পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শামীম আহমাদ নাদভী এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, 'জামে'আ সালাফিয়ার হল রুমে সেমিনার শুরু হ'লে তিনি তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রমাণ করেন এবং পরিচ্ছন্ন ভাষায় প্রোগ্রামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্ক আলোকপাত করার সাথে সাথে নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খানের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং ইলমী খিদমতের উপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন এবং নিজের প্রবন্ধের উদ্ধৃতিসমূহ পেশ করেন। এর মাধ্যমে তার অধ্যয়নের গভীরতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর মনীষা সম্পর্কে অবগত হই'। (আস-সিরাজ, ডিসেম্বর ২০০৯, পৃঃ ২৫।)
২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে 'মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ' এর উদ্যোগে দিল্লীতে একটি ঐতিহাসিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতেও তিনি উদ্বোধনী বক্তব্য পেশ করেন। (ঐ, পৃঃ ২৫-২৬।)
এছাড়া ১৯৮০ সালে জামে'আ সালাফিয়ায় দাওয়াত ও শিক্ষা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনারে দেশ-বিদেশের ওলামায়ে কেরাম অংশগ্রহণ করেন। এ সেমিনারকে সফল করার জন্যও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে এ সেমিনার নিয়ে 'মাজাল্লাতুল জামে'আ সালাফিয়া'র (বর্তমানে 'ছাওতুল উম্মাহ') একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয়, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩৮।
আরবী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ড. আযহারীর দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। জামে'আ সালাফিয়াতে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী সাহিত্যে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। 'তারীখে আদাবে আরবী' শিরোনামে দু'খন্ডে উর্দূতে আরবী সাহিত্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন, যেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক প্রফেসর, প্রবীণ কলামিষ্ট ড. মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান অনুবাদ করেন। অনূদিত ১ম খন্ড প্রথমবার প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ এর জুলাই মাসে এবং দ্বিতীয় বার প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ এর জুনে।
তিনি প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক- প্রাবন্ধিক আববাস মাহমূদ আল-আক্কাদ বিরচিত আত্মজীবনী 'আনা' (আমি)-এর উর্দূ অনুবাদও করেন, যা জামে'আ সালাফিয়া থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। 'মানছূরুল ফাকিহী : হায়াতুহু ওয়া শি'রুহু' শিরোনামে আলীগড় ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত 'মাজাল্লাতুল মাজমা আল-ইলমী আল-হিন্দী' (مجلة المجمع العلمي الهندى) তে তিনি আরবীতে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেন। তাছাড়া আধুনিক আরবী কবিতার পথিকৃত মাহমূদ সামী আল-বারূদী (মাসিক বুরহান, দিল্লী, মে ১৯৬৭), শাওকী ও তাঁর কবিতা (মা'আরিফ, আযমগড়, মার্চ-জুন ১৯৭০), হাফিয ইবরাহীম একজন জাতীয়তাবাদী মিসরীয় কবি (বুরহান, দিল্লী, অক্টোবর ১৯৭৯), ইবনু কুতায়বার জীবনী এবং অবদান (অর্ধ সাপ্তাহিক দাওয়াত, দিল্লী), উমাইয়া যুগের গীতিকাব্য চর্চা (ছাওতুল জামে'আ, বেনারস) প্রভৃতি বিষয়ে উর্দূতে প্রবন্ধ লিখে আরবী সাহিত্যে অবদান রাখেন। (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খন্ড, পৃঃ ২২৮-৩০। ) রচনাবলী :
মৌলিক গ্রন্থ রচনা ছাড়াও ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী অনেক মূল্যবান গ্রন্থ উর্দূ ও ফার্সী থেকে আরবীতে এবং আরবী থেকে উর্দূতে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। নিম্নে তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থগুলোর তালিকা পেশ করা হ'ল-
মৌলিক রচনা : ১. খাতূনে ইসলাম (উর্দূ, প্রকাশিত)।
২. তাখরীজু আহাদীছে বাহজাতুল মাজালিস। (জুহূদ মুখলিছাহ, পৃঃ ২৭৫-৭৭।) ইন্তিকাল :
ইলমী জগতের এই প্রতিভা ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। (আস-সিরাজ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩।)
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, ড. আযহারী আমৃত্যু নিজেকে ইলমের ময়দানে ব্যাপৃত রেখেছিলেন নানামুখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে। বিশেষত জামে'আ সালাফিয়ার উন্নতি-অগ্রগতি সাধনে এবং ভারত ও বহির্বিশ্বে উহার পরিচিতি বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কলমী জিহাদেও তাঁর অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন! আমীন!!