বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল পাতলা হয়। বাড়তে থাকে চুল কমে যাওয়ার হার। আছে বংশগতিরও প্রভাব। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরেও রোগবালাই ও অপুষ্টির কারণে নারী–পুরুষ উভয়েরই চুল পড়তে পারে যেকোনো বয়সে।
মানুষের মাথার প্রতিটি চুলের আছে নিজস্ব আয়ু। আয়ু শেষে প্রতিটি চুল ঝরে যায় আর তার গোড়ায় বা ফলিকলে জন্ম নেয় নতুন চুল। এই ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকে। চুলের এই জীবনচক্রের কয়েকটা পর্যায় আছে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চুল পাতলা হয় আর চুল কমে যাওয়ার হার বাড়তে থাকে। বংশগতিরও একটা প্রভাব আছে এতে। এ কারণে বয়স্ক পুরুষদের মাথায় টাক পড়তে শুরু করে, যাকে বলা হয় অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া। এতে চুলের জীবনচক্রের প্রথম ধাপ, যা অ্যানাজেন স্টেজ (চুল জন্মানো ও বৃদ্ধির দীর্ঘতম পর্যায়) নামে পরিচিত, সে ধাপটি ছোট হয়ে আসে আর টেলোজেন বা রেস্টিং স্টেজ (চুলের জীবনচক্রের চূড়ান্ত ধাপ) হয়ে পড়ে দীর্ঘ। ফলে চুল পাতলা ও ছোট ছোট দেখায়, কিছু ফলিকল বা গোড়া খালি বা শূন্যই হয়ে যেতে পারে। এটি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। নারীদেরও কিছু না কিছু এই পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন বয়স ও হরমোনজনিত।
কোনো কোনো রোগবালাই ও অপুষ্টির কারণে চুল পড়ার হার হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। যেমন আমিষস্বল্পতা, ভিটামিন ডি, আয়রনের অভাব। ক্যানসারের কারণে যে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়, তারপরও ব্যাপক হারে চুল পড়তে পারে। নানা ধরনের সংক্রমণের (টাইফয়েড, যক্ষ্মা, এমনকি কোভিড-১৯) পরও চুল পড়তে দেখা যায়। হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের মতো হরমোনজাতীয় রোগে চুল পড়ে। চুলের গোড়ায় খুশকি ও ছত্রাকের সংক্রমণে চুল পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত কারণটির চিকিৎসা করলে অনেক সময় চুল পড়া বন্ধ হয়।
চুল পড়া বন্ধ ও নতুন চুল গজানোর ফলপ্রসূ চিকিৎসা নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক। বর্তমানে চুল পড়া রোধের নানা আধুনিক চিকিৎসা করা হয়ে থাকে বাংলাদেশেও। তবে সব চিকিৎসা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সব ধরনের চিকিৎসায় সবার চুল গজানোর শতভাগ নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবে না। যেহেতু এ ধরনের চিকিৎসা ব্যয়সাধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি, তাই শুরু করার আগে এর ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেওয়া জরুরি।
ঘাটতি পূরণ, কার্যকারণ দূর
চুল পড়ার চিকিৎসা শুরু করার আগে জানা দরকার ভিটামিন বা খনিজের ঘাটতি আছে কি না। অনেকে কষ্টকর বা ক্রাশ ডায়েট করেন, তারপর চুল পড়তে শুরু করে। স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য সঠিক পুষ্টি দরকার। প্রয়োজন হলে রক্তের আয়রন, ভিটামিন ডি প্রভৃতি পরীক্ষা করে নেওয়া যায়। ঘাটতি থাকলে চিকিৎসক সাপ্লিমেন্ট দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করতে পারেন। চুল পড়ার অন্তর্নিহিত কারণ আছে কি না, সে ইতিহাস জানা জরুরি। কারণটি দূর করার চেষ্টা করতে হবে আগে। যেমন থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে তার সমাধান করা জরুরি। কোনো গুরুতর সংক্রমণের পর হয়ে থাকলে বা কেমো বা রেডিওথেরাপি দেওয়া হলে অপেক্ষা করাই বাঞ্ছনীয়। খুশকি বা ছত্রাকের সংক্রমণ থাকলে তার চিকিৎসা নিন আগে।
চুল বাঁচাতে ওষুধ
বয়সের কারণে চুল পড়ে যাওয়া বা টাক পড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার নাম মিনোক্সিডিল। এটি ক্রিম, ফোম বা স্প্রে আকারে পাওয়া যায়। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে চুল পড়ার হার কমায়, নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে। নারী-পুরুষ সবাই ব্যবহার করতে পারেন।
আরেকটি ওষুধ আছে যার নাম ফিনেস্টেরাইড। এটি কাজ করে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের ক্রিয়াকলাপের ওপর। টেস্টোস্টেরন থেকে এর বাই প্রোডাক্ট ডিএইচটি হতে বাধা দেয় এ ওষুধ। এটি কেবল পুরুষেরাই ব্যবহার করতে পারবেন। আবার এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে।
যে ওষুধই ব্যবহার করুন না কেন, তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যবহার করতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই, তা ছাড়া এগুলো তখনই ব্যবহার করতে হবে, যখন হেয়ার ফলিকল বা চুলের গোড়ায় চুল গজানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। আর চুল গজানোর জন্য সঠিক পরিবেশ (পুষ্টি, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, সংক্রমণহীনতা, হরমোনের ভারসাম্য প্রভৃতি) যখন তৈরি হয়।
পিআরপি
প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা বা পিআরপি একটি সহযোগী পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি চুল পড়ার নির্দিষ্ট বা একমাত্র চিকিৎসা নয়, বরং অন্য চিকিৎসাপদ্ধতিগুলোকে সাহায্য করে। পিআরপি করলেই চুল পড়া সম্পূর্ণ বন্ধ হবে, এমন কথা নেই।
প্রতিস্থাপন
যখন হেয়ার ফলিকল বা গোড়া নষ্ট হয়ে যায় বা বৃহৎ টাক পড়ে যায়, সে ক্ষেত্রে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা চুল প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনো গতি নেই। প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে মাথার পেছনের অংশের চুল ব্যবহার করা হয়। কতখানি চুল অক্ষত আছে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে ফলিকুলার ইউনিট ট্রান্সপ্লান্ট ও ফলিকুলার ইউনিট এক্সট্র্যাকশন—এ দু ধরনের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
চুল পড়ার চিকিৎসা যখন শুরু করবেন, তখন প্রথমে চুল পড়ার কারণ, ধরন, অন্যান্য রোগ আছে কি না সে বিষয়ে সঠিক ধারণা নিতে হবে। চুল শরীরের বাইরের কোনো জিনিস নয়, তাই শারীরিক যেকোনো রোগে এর স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়। কারণ দূর না করা হলে ওষুধ বা পদ্ধতিজনিত চিকিৎসায় আশাপ্রদ ফল লাভ হবে না। তা ছাড়া টোটকা বা কবিরাজি চিকিৎসার পেছনে না ছুটে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিতে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেওয়া জরুরি।