তিনি হতে চেয়েছিলেন সাধারণ এক ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে খেতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সব টাকা খুইয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। সিনেমা দেখার পয়সা নেই, তাই হতে চেয়েছিলেন সিনেমা হলের দারোয়ান। চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরিতে নাকি পিয়নকে স্যার ডাকতে হয়। সেটা তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল। তাই শেষমেশ তিনি হলেন অভিনেতা। কেননা, এই একটা কাজই তিনি পারতেন।
আজ ‘নিজের ইচ্ছার রাজা’ সেই জিনিয়াস অভিনেতার জন্মদিন উদযাপন করছেন ভক্তরা। বাংলাদেশের যে অল্প কয়েকজন অভিনেতা দেশের মানুষের অঢেল ভালোবাসা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সোনার অক্ষরে জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে যে নাম, সেটি হুমায়ুন ফরীদির। বেঁচে থাকলে খেয়ালি ও মেধাবী এই অভিনেতা আজ বয়সের ক্যালেন্ডারে ছুঁয়ে ফেলতেন ৬৯।
১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর। হুমায়ুন ফরীদিরা তখন ছিলেন চাঁদপুরে। সেদিন ফরীদির মা সবুজ একটা শাড়ি কেটে তার ওপর একটা লাল কাপড় আর সোনালি বাংলাদেশের ম্যাপ জুড়ে বানিয়েছিলেন একটা পতাকা। হুমায়ুন ফরীদি সেই পতাকা টাঙালেন তাঁদের দোতলা বাড়িতে। চাঁদপুরে তাঁর এক বন্ধু ছিলেন মনসুর। তিনি সেদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরলেন। হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে দেখা করে বললেন, ডিসেম্বরে তো প্রচণ্ড শীত, তাই তিনি একজোড়া জুতা কিনবেন।
দুই বন্ধু গেলেন জুতা কিনতে। জুতার দোকানদার দোকান বন্ধ করে ভেতরেই ছিলেন। ধাক্কাধাক্কিতে তিনি সন্দেহ নিয়ে দোকান খুলে বললেন, ‘ভাই, দেশ কি স্বাধীন হইছে?’ তখন ফরীদির সঙ্গে থাকা মনসুর বললেন, ‘হ্যাঁ, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা চাঁদপুর স্বাধীন করে ফেলেছি।’ তখন দোকানদার উচ্ছ্বসিত হয়ে তড়িঘড়ি করে বললেন, ‘কোন জুতা নেবেন নেন, পছন্দ করে নেন।’ এটিই হুমায়ুন ফরীদির জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।
টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদি। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২৯ মে ফরীদির জন্ম। তাঁর প্রথম স্মৃতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে তাঁর বাবা এক লোকের সঙ্গে মগ্ন হয়ে দাবা খেলছেন। সেই লোকটা আবার কানে কম শোনেন। সেই বাড়িতে থাকতেই এক রাতে উঠেছিল প্রচণ্ড ঝড়। দুই ভাই আর তিন বোনের ভেতরে সবচেয়ে দুরন্ত ছিলেন ফরীদি। তাই বাবার হাতের মারও ভাগে বেশিই পড়েছে তাঁর কপালে। তাঁর বাবার ছিল বদলির চাকরি। ফরীদির ছেলেবেলা কেটেছে বিভিন্ন শহরে। প্রতিটি শহরের আলাদা গন্ধ পেতেন তিনি। বড় হয়ে যখন সেসব শহরে গেছেন, তাঁর নাকে ঢুকেছে সেই ঘ্রাণ। মাঝরাতে হইরই করে হামলে পড়া ডাকাতের মতো পুরোনো পরিচিত সেই ঘ্রাণের সঙ্গে আছড়ে পড়েছে তাঁর ছেলেবেলা। সেই ঘ্রাণ আর নস্টালজিয়ায় একাকার হয়ে তিনি ভাবেন, মৃত্যু বুঝি প্রচণ্ড রঙিন, অনেক সুন্দর সবুজ, অনেক সুন্দর নীল, অনেক সুন্দর বেগুনি রঙের একটা জায়গা।
মুক্তিযুদ্ধের পরের চার বছর বোহেমিয়ান ভ্যাগাবন্ড একটা জীবন কাটিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। চার বছর পর তিনি তাঁর বাবার কাছে ফিরে বলেছেন, ‘বাবা আমি লেখাপড়া করব।’ তখন তাঁর বাবা বলেছেন, ‘করো।’ মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈবরসায়নে ভর্তি হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর গেলেন জাহাঙ্গীরনগরে। পাঁচ বছরের ব্রেক অব স্টাডিজ দেখে চেয়ারম্যান বললেন, ‘ইমপসিবল। তুমি কীভাবে ভর্তি হবে? এ হয় না।’ ফরীদির বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধবেরা তখন থার্ড ইয়ার-ফোর্থ ইয়ারে পড়েন। তাঁরা গিয়ে সবাই অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান মালিক হোসেন চৌধুরীকে অনুরোধ করে বললেন, ‘ও খুব ভালো ক্রিকেট খেলে, স্যার।’ তখন ভূগোল বিভাগের কাছে অর্থনীতি বিভাগ নিয়মিত হারত। তাই নিয়ে মনে খুব দুঃখ ছিল চেয়ারম্যানের। ভালো ক্রিকেট খেলে শুনে তাঁর মন নরম হলো। হঠাৎ তিনি আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার হায়েস্ট স্কোর কত?’ ফরীদি বললেন, ‘সিক্সটি ফোর।’ ব্যস, ভর্তি হয়ে গেলেন ফরীদি!
হুমায়ুর ফরীদি ও সুবর্ণা। ছবি: সংগৃহীত
ফরীদি আর আফজাল হোসেন তখন চট্টগ্রামে ‘শকুন্তলা’র শো করতে গিয়েছিলেন। সেই রাতে হঠাৎ ফরীদি বলেছিলেন, ‘আমাকে টেলিভিশন স্টার হতে হবে।’ শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে আফজাল হোসেন বললেন, ‘তোকে তো সব সময় বলি, তুই টেলিভিশন কর, টেলিভিশন কর। তুই-ই তো বলিস যে না, ওটা ইডিয়ট বক্স, এখানে অ্যাক্টিংয়ের পিওরিটি নেই।’
তারপর আফজাল ঢাকায় ফিরে তিন-চারটা নাটক লিখলেন, সেখানে ফরীদি অভিনয় করলেন। তখন ফরীদি খুব রোগা, চোয়াল ভাঙা, লম্বা চুল, নাক বোঁচা। দর্শক ফরীদিকে নায়ক হিসেবে মানতে পারলেন না। আর ফরীদি ঠিক করলেন, তিনি নায়ক নন, অভিনেতা হতে মনোযোগী হবেন।
হুমায়ুন ফরীদি ও আফজাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
ছোট আর বড় সব পর্দায় দারুণ সব চরিত্রে ব্যস্ত হয়ে ওঠা ফরীদি একসময় ভয়ে, লজ্জায় সিনেমা ছাড়লেন। কারণের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘যেভাবে অশ্লীলতা শুরু হলো, মনে হলো, দরকার নেই আমার। কারণ, নিজের কাছে তো জবাবদিহি করতে হবে! অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে, আমি যখন নিজের মুখোমুখি হই, নিজেকে কী জবাব দেব?’ জীবনে কোনো দিন কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেননি হুমায়ুন ফরীদি। কারণও জানিয়েছেন। ভীতু মানুষ নাকি আপস করে। ফরীদি আর যা-ই হন, ভীতু নন।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দুজন মানুষের দুটো উপদেশ সব সময় সঙ্গী হয়ে ছিল ফরীদির। তাঁদের একজন এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি একদিন ফরীদির সেটে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘জামাই, আপনি তো এখন স্টার। আপনার আশপাশে চামচা থাকবে। এরা আপনার কানে নানা কথা দেবে। আমাদের ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করবে। আপনি সেসব বিশ্বাস করবেন না। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, সোজা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন।’ আর অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘টাকাপয়সা বুঝে নিবা।’
ব্যক্তিজীবনে দুবার বিয়ে করেছিলেন ফরীদি। দুবারই পেয়েছেন বিচ্ছেদপত্র। সেসব সম্পর্ক নিয়ে অকপটে বলেছেন, ‘আমি দুটো বিয়ে করেছি। কোনোটাই টিকেনি। একটা টিকেছিল চার বছর, আরেকটা বাইশ বছর। আমার প্রথম স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীও আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। দে মাস্ট হ্যাভ দেয়ার রিজনস।’
হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে কাজ করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। ছবি: সংগৃহীত
মানুষকে একবুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসতে বলেছেন ফরীদি। কারণ ছাড়াই তুমুল প্রেমে পড়তে বলেছেন। বলেছেন, ‘মানুষকে ভালোবাসতে হয়। কোনো কারণ ছাড়াই তুমুল প্রেমে পড়া জানতে হয়। মনে হবে, কেন যে প্রেমে পড়লাম, কেন যে ভালোবাসলাম! এর আসলে কোনো উত্তর হয় না। প্রেম অন্ধকার ঘরের ওই কালো বিড়ালের মতো, যাকে আমরা খুঁজে মরি, কিন্তু সে আসলে কখনো ওই ঘরে ছিলই না।’ জীবন কেমন? এই প্রশ্নেরও উত্তর আছে ফরীদির কাছে। বলেছেন, জীবন একটা অদ্ভুত ব্যাপার, যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া হয়, সে ছেড়ে চলে যায়। তবু জীবন উপভোগ্য। জীবন সুন্দর।
হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্মৃতির গলি ঘুরে লিখেছিলেন, ‘ফরীদির তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। বিটিভির অভিনয়রাজ্য দখল করে আছেন। একদিনের কথা, বেইলি রোডে কী কারণে যেন গিয়েছি, হঠাৎ দেখি ফুটপাতে বসে কে যেন আয়েশ করে চা খাচ্ছে। তাকে ঘিরে রাজ্যের ভিড়। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখানোর সময় তাদের ঘিরে এ রকম ভিড় হয়। কৌতূহলী হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ভিড় ঠেলে উঁকি দিলাম, দেখি হুমায়ুন ফরীদি- চা খাচ্ছেন, সিগারেট টানছেন। রাজ্যের মানুষ চোখ বড় বড় করে দৃশ্য দেখছে, যেন তাদের জীবন ধন্য। হঠাৎ আমার ওপর চোখ পড়ল ফরীদির। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, “আপনি এখানে কী করেন?” আমি বললাম, আপনার চা খাওয়া দেখি।’ হুমায়ূন আহমেদের লেখার এই অংশটুকু আজ ফেসবুকের দেয়ালে পোস্ট করে ফরীদিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ।
সিনেমার খলচরিত্রে অন্যরকম এক আবেদন সৃষ্টি করেছিলেন ফরীদি। ছবি: সংগৃহীত
এক জীবনকে পুরোটা উজাড় করে দিয়ে যাপন করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। সেখানে দুঃখগুলো সুনিপুণ বাসা বেঁধেছিল সুখের দালানের এক কোণে। সেই দুঃখগুলো সযত্ন লালন করে ফরীদি বলেছেন, ‘এই তো আছি বেশ।’ বারবার প্রেমে পড়েছেন। সেসব প্রেম ছেড়েও গেছে। কিন্তু অভিনয়ের প্রেমে একবারই পড়েছেন। আর সেই প্রেমকেই সঙ্গী করে ৯ বছর হলো অন্য ভুবনে তিনি। তবু বছর ঘুরে জন্মদিন আসে। আর আমরা মহা উৎসাহে উদযাপন করি—আমাদের একজন আক্ষেপহীন, আপসহীন হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন।