গল্প: বাটি চালান [সত্য ঘটনা অবলম্বনে]
[FA]pen[/FA] লেখা: মিস্ক আল মারুফ
[HR=3][/HR]
শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতেই আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই কারণ শ্বশুরের পুরো উঠোন জুড়ে মানুষের সমাগম এবং একজন জটাধারী লোক উঠোনের মাঝে বসে কিসব যেন মন্ত্রটন্ত্র পড়ছে। অন্যদিকে আমার শ্বশুর এবং শাশুরী দুজনই সেই জটাধারী বাবাকে অনেকটা হন্তদন্ত হয়েই একটু পর পর কিছু জিনিস এনে দিচ্ছেন। আমি বেশ অবাক হয়ে আমার স্ত্রী রাইসাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ব্যপার কি? হঠাৎ তোমাদের বাড়িতে এতো হট্টগোল কিসের? আর ঐ পাগলটা ওখানে বসে বসে কি করছে?
-আরে আর বলো না। বাবা যখন শুনলেন তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে ঠিক তখনি তিনি মানিব্যাগে পাঁচহাজার টাকা নিয়ে বাজার করার জন্য রওয়ানা দিচ্ছিলেন। কিন্তু চৌকাঠ পেড়োনোর সাথে সাথে তাঁর মনে হলো ব্যাগ একটাতে হবে না তাই তিনি আরো একটি ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য মানিব্যাগটা আমাদের বসার রুমে রেখে গিয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ব্যাগ নিয়ে এসে যখন বসার রুম থেকে মানিব্যাগটা নিতে যাবেন তখনই দেখেন সেখানে আর সেটা নেই। তুমিতো জানোই আমাদের বসার রুমটা কত খোলামেলা। যে কেউ এসেই হুটহাট করে বসে পরে তাই এই কবিরাজকে নিয়ে এসেছেন বাটি চালান দেওয়ার জন্য।
আমি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-বাটি চালান দিলে কি সত্যি সত্যি আসল চোর বেড়িয়ে যাবে?
-আরে বলো কি? এই কবিরাজ আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের দশগ্রামে অনেক বিখ্যাত। উনি এই পর্যন্ত যেই কয়টা বাটি চালান দিয়েছেন একটাও ব্যর্থ হয়নি বরং প্রত্যেকবারই আসল চোর ধরা পরেছে।
রাইসার কথাশুনে আমার কৌতুহল আরো কিছুটা বাড়লো। কারণ ছোটবেলা থেকেই এইসব বাটি চালান, আয়না পড়া, চাউল পড়া ইত্যাদি অনেক কিছুরই নাম শুনে এসেছি কিন্তু এসব নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আদৌ আমার হয়নি। তাই আজ যে সরাসরি নিজের চোখে বাটি চালান দেখার সুযোগ পাবো তা ভাবতেই মনে এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে।
.
কবিরাজ নামক জটাধারী লোকটি মন্ত্রটন্ত্র শেষ করে মুহূর্তেই সকলের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
-এই সবাই শুনে রাখ, এখনো সময় আছে কেউ চুরি করে থাকলে যার মাল তাকে দিয়ে দে নয়তো আমি যদি বাটিতে একবার হাত দেই তাইলে ভস্ব হয়ে যাবি।
কবিরাজের এমন কথা শুনে আগত সবাই বেশ ভয় পেয়ে একে অপরকে বলাবলি করছে,
-ভাই কেউ নিয়া থাকলে মানিব্যাগ দিয়া দে।
কিন্তু এটুকু বলা পর্যন্তই সবাই ক্ষান্ত হলো আর সামনে এগোলো না। কবিরাজ মশাই যখন দেখতে পেলেন কেউ আর সাড়াশব্দ করছে না তখন তিনি কাপড়ের পোটলা থেকে একটি তাবিজ জাতীয় কিছু বের করেই ডান হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিলেন। পরক্ষণেই সে রাইসাদের বসার রুমে বাটিটা রেখে তার উপর নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটি সেট করে এবং নিতম্বটি উঁচু করে চড়কির মতো ঘুরতে শুরু করলেন। আমি এমন কান্ড দেখে রাইসাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ব্যপার কি? উনি এভাবে ঘুরছে কেন? এভাবে ঘুরতে থাকলেতো মাথা চক্কর দিয়ে মেঝেতে পরে যাবে।
-ধুর তুমি এসব বুঝবানা। এখনি দেখো কি হয়? চোরটি যেই পথে চুরি করে পালিয়েছে বাটিটাও সেই পথেই যাবে।
রাইসার কথা শেষ হতে না হতেই কবিরাজটি বাটিটি মাটিতে ঘষতে ঘষতে বসার রুম থেকে বাহিরে বেড়িয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বাটিসহ কবিরাজ মশাই আমার শ্বশুরের বাড়িতে ঢোকার পথ পেড়িয়ে ডানদিকে মোড় নিলো। উৎসুক জনতা কবিরাজের পিছনে পিছনেই দৌড়ে যাচ্ছে এবং আসল চোরকে জানার জন্য যে তাঁদের মন উদগ্রীব হয়ে রয়েছে সেটা তাঁদের উৎফুল্লতা দেখেই অবলোকন করতে পারলাম।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বাটিটি থেমেছে আমার শ্বশুরের কর্মচারী কুদ্দুসের বাড়িতে। কারো আর একমুহূর্ত বুঝতে বাকি রইলো না যে মানিব্যাগটি আর কেউ নেয়নি স্বয়ং কুদ্দুসই নিয়েছে।
.
কুদ্দুসকে চোরের দায়ে আমার শ্বশুরসহ আরো কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু ওকে বারবার বেত্রাঘাত করার পরও ও কোনোভাবেই স্বীকার পাচ্ছে না যে মানিব্যাগটি ও নিজেই নিয়েছে। আমার শ্বশুর এবার মোটা একটি বাঁশ নিয়ে যেই কুদ্দুসের শরীরে আঘাত করতে যাবেন ঠিক তখনই কুদ্দুসের স্ত্রী দৌড়ে এসে আমার শ্বশুরের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বেশ আকুতিভরা কন্ঠেই বলে উঠলো,
-চাচাজান! মাফ কইরা দেন ওরে। আপনার বাড়িতে এতো বছর ধইরা কাম করে কোনোদিন কি দেখছেন ওরে একটা পয়সাও চুরি করতে? আপনে ঐ ভুয়া কবিরাজের কথা বিশ্বাস কইরা আমার স্বামীরে আর মাইরেন না।
কিন্তু কুদ্দুসের স্ত্রীর আকুতিতে আমার শ্বশুরের মন বিন্দুমাত্রও নমনীয় হলোনা উল্টো তিনি অনেকটা লাথি দিয়েই তাকে সরিয়ে দিলেন। শ্বশুর মশাইয়ের এমন ব্যবহার আমার নিকট বেশ দৃষ্টিকটু মনে হওয়াতে আর চুপ থাকতে পারলাম না বরং তাঁর সামনে গিয়ে তাঁর হাত থেকে বাঁশটি কেড়ে নিয়ে বেশ আক্রোশ কন্ঠেই বলে উঠলাম,
-আচ্ছা বুঝলাম কুদ্দুস চুরি করেছে তাই বলে ওকে এভাবে মারার কি আছে? আপনিতো পাঁচ হাজার টাকা চুরি করার অপরাধে ওকে অলরেডি দশহাজার টাকার মাইর দিয়ে দিয়েছেন।
-জামাই বাবা! তুমি এসবে নাক গলাইয়ো না, ওদের মতো ফকিরনির বাচ্চাগুলারে যদি এভাবে না মারি তাইলে ওদের শিক্ষা হইবোনা বরং আবারও চুরি করবো।
এবার আমি বেশ রাগান্বিত স্বরেই বললাম,
-ওর শরীরে যদি আর একটি আঘাতও করেন তাহলে শুনে রাখুন আপনাদের মেয়ে জামাই আপনার বাড়িতে আর কোনোদিনই আসবে না।
আমার কথা শুনে শ্বশুরের কিছুটা চেতনা ফিরলো বোধহয়। অতঃপর শত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি কুদ্দুসকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।
.
শ্বশুর আব্বার মানিব্যাগ চুরি হওয়ার ঠিক দুইদিন পর হঠাৎই আমার বিশ হাজার টাকা সমমূল্যের মোবাইলটি সেই বসার রুম থেকেই আবারো চুরি হয়। আমার মোবাইল চুরি হওয়াতে আমি যতটা চিন্তিত ছিলাম তাঁর থেকেও বহুগুণ চিন্তিত ছিলো আমার স্ত্রীসহ শ্বশুর বাড়ির সকলেই। এবার আমার শ্বশুর আব্বা আমার কাছে এসে বেশ গম্ভীর গলাতেই বলে উঠলেন,
-সেদিনতো তুমি বেশ বড় গলাতেই কুদ্দুসকে ছাড়িয়ে নিলা এখন দেখো নিজের মোবাইলটাও গেলো। এই কারণেই আমি বলি চোরকে ভালোমতো না পিটাইলে সে চুরি জীবনেও ছাড়বো না বরং সারাজীবন করতেই থাকবো।
আমি আজ তাঁর এই কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলার সাহস করলাম না। পাশ থেকে আমার শ্যালক রাতুল বলে উঠলো,
-আব্বু! তুমি আবার কবিরাজকে খবর দেও। আজকে যদি ভাইয়ার মোবাইল চোরকে ধরতে পারি তাইলে এক পা ভাইঙ্গা উঠোনে ঝুলিয়ে রাখবো।
.
কবিরাজ মশাই পূর্বের ন্যায় আবারো বাটি চালান দেওয়ার জন্য রেডি হয়ে রয়েছেন। আমার মনে বেশ উৎকন্ঠা এবং উদ্বেগ কাজ করছে কারণ আমি কি আদৌ আমার ফোনটি ফিরে পাবো?
বাটি নিয়ে অজস্র ঘোরাঘুরির পর এবার কবিরাজ মশাইয়ের বাটিটা পৌঁছে গেলো আমার শ্বশুরের আরেক কর্মচারী কাঞ্চন মিয়ার বাড়িতে। কাঞ্চন মিয়া দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ আমার শ্বশুরের গরু ছাগল এর দেখাদেখি করছেন। তাঁর মতো এমন বুজুর্গ মানুষের বাড়িতে বাটি চলে যাওয়াতে পুরো গ্রামবাসীই বেশ অবাক হয়ে যায় কারণ গ্রামে যদি পাঁচওয়াক্ত নামাজী কোনো মানুষদের লিষ্ট করা হয় তবে কাঞ্চন মিয়ার নামই সবার উপরে থাকবে। কিন্তু তাঁর এতসব সম্মান থাকা সত্ত্বেও কবিরাজের বাটি তাঁর বাড়িতে চলে যাওয়াতে এলাকার মানুষ ছি ছি করতে শুরু করলো। আমার শ্বশুর বেশ ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে কাঞ্চন মিয়াকে বলে উঠলেন,
-কিরে ফ*রনির বা*! দামী মোবাইল দেইখা আর হুঁশ আছিলো না, তাইনাহ?
-ভাইজান! বিশ্বাস করেন আল্লাহর কছম কইরা কইতাছি আমি মোবাইল নেইনাই। এইগুলা সব ভুয়া।
-ভুয়া নাহ? তোরে দেখাইতাছি কোনটা ভুয়া আর কোনটা আসল! ঐ কে আছিস ওরে খুঁটির সাথে বান! আইজকা ওর হাত পা ভাঙ্গমু।
পরক্ষণেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাতুলসহ ওর কিছু বন্ধুরা কাঞ্চন মিয়াকে না বেঁধে সেই জটাধারী কবিরাজকে জাপটে ধরে মুহূর্তেই খুঁটির সাথে বেঁধে ফেললো। ওদের এমন কান্ডে আমার শ্বশুরসহ আগত সবাই হতভম্ব হয়ে স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই আমার শ্বশুর আব্বা তেজদীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
-কিরে তোদের মাথার তার কি দুই একটা ছিড়ছে? কারে রেখে কারে বানলি?
আমি তাঁর কথা শুনে কবিরাজের সামনে এগিয়ে গিয়েই পকেট থেকে মোবাইলটি বের করলাম। পরমুহূর্তেই সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,
-আমার মোবাইল কোনো চোরে নেয়নি। আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম এই কবিরাজ কি আসলেই সত্যিকারের চোরকে ধরিয়ে দেয় নাকি এভাবে ধোঁকা দিয়ে অসহায় মানুষকে চুরির অপবাদে মার খাওয়ায়? আজ তাহলে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ অন্তর আমি শ্বশুর আব্বার কাছে এসে বলি,
-আপনারা সমাজের টাকা পয়সাওয়ালা লোক বলে গরীবদের বিচার করেন এখন আপনি যে গরীবদের গায়ে যুক্তিপ্রমাণ ছাড়াই হাত তুললেন তাহলে তাঁর বিচার করবে কে?
আমার কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর আমি কবিরাজের কাছে গিয়ে যখন শক্ত করে ওর চুলগুলো ধরে একটি টান দিলাম তখনই ওর মাথা থেকে আলগা চুলগুলো বেড়িয়ে এলো। তারমানে এই ব্যাটা আর কেউ নয় বরং ছদ্মবেশী এক ভুয়া কবিরাজ যে এভাবেই মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এতোদিন টাকা ইনকাম করেছে?
এরপর এই কবিরাজের সাথে কি ঘটবে সেটা আপনারা নিশ্চই জানেন। হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন, গণধোলাই!
সমাপ্ত
[FA]pen[/FA] লেখা: মিস্ক আল মারুফ
[HR=3][/HR]
শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতেই আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই কারণ শ্বশুরের পুরো উঠোন জুড়ে মানুষের সমাগম এবং একজন জটাধারী লোক উঠোনের মাঝে বসে কিসব যেন মন্ত্রটন্ত্র পড়ছে। অন্যদিকে আমার শ্বশুর এবং শাশুরী দুজনই সেই জটাধারী বাবাকে অনেকটা হন্তদন্ত হয়েই একটু পর পর কিছু জিনিস এনে দিচ্ছেন। আমি বেশ অবাক হয়ে আমার স্ত্রী রাইসাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ব্যপার কি? হঠাৎ তোমাদের বাড়িতে এতো হট্টগোল কিসের? আর ঐ পাগলটা ওখানে বসে বসে কি করছে?
-আরে আর বলো না। বাবা যখন শুনলেন তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে ঠিক তখনি তিনি মানিব্যাগে পাঁচহাজার টাকা নিয়ে বাজার করার জন্য রওয়ানা দিচ্ছিলেন। কিন্তু চৌকাঠ পেড়োনোর সাথে সাথে তাঁর মনে হলো ব্যাগ একটাতে হবে না তাই তিনি আরো একটি ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য মানিব্যাগটা আমাদের বসার রুমে রেখে গিয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ব্যাগ নিয়ে এসে যখন বসার রুম থেকে মানিব্যাগটা নিতে যাবেন তখনই দেখেন সেখানে আর সেটা নেই। তুমিতো জানোই আমাদের বসার রুমটা কত খোলামেলা। যে কেউ এসেই হুটহাট করে বসে পরে তাই এই কবিরাজকে নিয়ে এসেছেন বাটি চালান দেওয়ার জন্য।
আমি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-বাটি চালান দিলে কি সত্যি সত্যি আসল চোর বেড়িয়ে যাবে?
-আরে বলো কি? এই কবিরাজ আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের দশগ্রামে অনেক বিখ্যাত। উনি এই পর্যন্ত যেই কয়টা বাটি চালান দিয়েছেন একটাও ব্যর্থ হয়নি বরং প্রত্যেকবারই আসল চোর ধরা পরেছে।
রাইসার কথাশুনে আমার কৌতুহল আরো কিছুটা বাড়লো। কারণ ছোটবেলা থেকেই এইসব বাটি চালান, আয়না পড়া, চাউল পড়া ইত্যাদি অনেক কিছুরই নাম শুনে এসেছি কিন্তু এসব নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আদৌ আমার হয়নি। তাই আজ যে সরাসরি নিজের চোখে বাটি চালান দেখার সুযোগ পাবো তা ভাবতেই মনে এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে।
.
কবিরাজ নামক জটাধারী লোকটি মন্ত্রটন্ত্র শেষ করে মুহূর্তেই সকলের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
-এই সবাই শুনে রাখ, এখনো সময় আছে কেউ চুরি করে থাকলে যার মাল তাকে দিয়ে দে নয়তো আমি যদি বাটিতে একবার হাত দেই তাইলে ভস্ব হয়ে যাবি।
কবিরাজের এমন কথা শুনে আগত সবাই বেশ ভয় পেয়ে একে অপরকে বলাবলি করছে,
-ভাই কেউ নিয়া থাকলে মানিব্যাগ দিয়া দে।
কিন্তু এটুকু বলা পর্যন্তই সবাই ক্ষান্ত হলো আর সামনে এগোলো না। কবিরাজ মশাই যখন দেখতে পেলেন কেউ আর সাড়াশব্দ করছে না তখন তিনি কাপড়ের পোটলা থেকে একটি তাবিজ জাতীয় কিছু বের করেই ডান হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিলেন। পরক্ষণেই সে রাইসাদের বসার রুমে বাটিটা রেখে তার উপর নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটি সেট করে এবং নিতম্বটি উঁচু করে চড়কির মতো ঘুরতে শুরু করলেন। আমি এমন কান্ড দেখে রাইসাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ব্যপার কি? উনি এভাবে ঘুরছে কেন? এভাবে ঘুরতে থাকলেতো মাথা চক্কর দিয়ে মেঝেতে পরে যাবে।
-ধুর তুমি এসব বুঝবানা। এখনি দেখো কি হয়? চোরটি যেই পথে চুরি করে পালিয়েছে বাটিটাও সেই পথেই যাবে।
রাইসার কথা শেষ হতে না হতেই কবিরাজটি বাটিটি মাটিতে ঘষতে ঘষতে বসার রুম থেকে বাহিরে বেড়িয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বাটিসহ কবিরাজ মশাই আমার শ্বশুরের বাড়িতে ঢোকার পথ পেড়িয়ে ডানদিকে মোড় নিলো। উৎসুক জনতা কবিরাজের পিছনে পিছনেই দৌড়ে যাচ্ছে এবং আসল চোরকে জানার জন্য যে তাঁদের মন উদগ্রীব হয়ে রয়েছে সেটা তাঁদের উৎফুল্লতা দেখেই অবলোকন করতে পারলাম।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বাটিটি থেমেছে আমার শ্বশুরের কর্মচারী কুদ্দুসের বাড়িতে। কারো আর একমুহূর্ত বুঝতে বাকি রইলো না যে মানিব্যাগটি আর কেউ নেয়নি স্বয়ং কুদ্দুসই নিয়েছে।
.
কুদ্দুসকে চোরের দায়ে আমার শ্বশুরসহ আরো কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু ওকে বারবার বেত্রাঘাত করার পরও ও কোনোভাবেই স্বীকার পাচ্ছে না যে মানিব্যাগটি ও নিজেই নিয়েছে। আমার শ্বশুর এবার মোটা একটি বাঁশ নিয়ে যেই কুদ্দুসের শরীরে আঘাত করতে যাবেন ঠিক তখনই কুদ্দুসের স্ত্রী দৌড়ে এসে আমার শ্বশুরের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বেশ আকুতিভরা কন্ঠেই বলে উঠলো,
-চাচাজান! মাফ কইরা দেন ওরে। আপনার বাড়িতে এতো বছর ধইরা কাম করে কোনোদিন কি দেখছেন ওরে একটা পয়সাও চুরি করতে? আপনে ঐ ভুয়া কবিরাজের কথা বিশ্বাস কইরা আমার স্বামীরে আর মাইরেন না।
কিন্তু কুদ্দুসের স্ত্রীর আকুতিতে আমার শ্বশুরের মন বিন্দুমাত্রও নমনীয় হলোনা উল্টো তিনি অনেকটা লাথি দিয়েই তাকে সরিয়ে দিলেন। শ্বশুর মশাইয়ের এমন ব্যবহার আমার নিকট বেশ দৃষ্টিকটু মনে হওয়াতে আর চুপ থাকতে পারলাম না বরং তাঁর সামনে গিয়ে তাঁর হাত থেকে বাঁশটি কেড়ে নিয়ে বেশ আক্রোশ কন্ঠেই বলে উঠলাম,
-আচ্ছা বুঝলাম কুদ্দুস চুরি করেছে তাই বলে ওকে এভাবে মারার কি আছে? আপনিতো পাঁচ হাজার টাকা চুরি করার অপরাধে ওকে অলরেডি দশহাজার টাকার মাইর দিয়ে দিয়েছেন।
-জামাই বাবা! তুমি এসবে নাক গলাইয়ো না, ওদের মতো ফকিরনির বাচ্চাগুলারে যদি এভাবে না মারি তাইলে ওদের শিক্ষা হইবোনা বরং আবারও চুরি করবো।
এবার আমি বেশ রাগান্বিত স্বরেই বললাম,
-ওর শরীরে যদি আর একটি আঘাতও করেন তাহলে শুনে রাখুন আপনাদের মেয়ে জামাই আপনার বাড়িতে আর কোনোদিনই আসবে না।
আমার কথা শুনে শ্বশুরের কিছুটা চেতনা ফিরলো বোধহয়। অতঃপর শত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি কুদ্দুসকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।
.
শ্বশুর আব্বার মানিব্যাগ চুরি হওয়ার ঠিক দুইদিন পর হঠাৎই আমার বিশ হাজার টাকা সমমূল্যের মোবাইলটি সেই বসার রুম থেকেই আবারো চুরি হয়। আমার মোবাইল চুরি হওয়াতে আমি যতটা চিন্তিত ছিলাম তাঁর থেকেও বহুগুণ চিন্তিত ছিলো আমার স্ত্রীসহ শ্বশুর বাড়ির সকলেই। এবার আমার শ্বশুর আব্বা আমার কাছে এসে বেশ গম্ভীর গলাতেই বলে উঠলেন,
-সেদিনতো তুমি বেশ বড় গলাতেই কুদ্দুসকে ছাড়িয়ে নিলা এখন দেখো নিজের মোবাইলটাও গেলো। এই কারণেই আমি বলি চোরকে ভালোমতো না পিটাইলে সে চুরি জীবনেও ছাড়বো না বরং সারাজীবন করতেই থাকবো।
আমি আজ তাঁর এই কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলার সাহস করলাম না। পাশ থেকে আমার শ্যালক রাতুল বলে উঠলো,
-আব্বু! তুমি আবার কবিরাজকে খবর দেও। আজকে যদি ভাইয়ার মোবাইল চোরকে ধরতে পারি তাইলে এক পা ভাইঙ্গা উঠোনে ঝুলিয়ে রাখবো।
.
কবিরাজ মশাই পূর্বের ন্যায় আবারো বাটি চালান দেওয়ার জন্য রেডি হয়ে রয়েছেন। আমার মনে বেশ উৎকন্ঠা এবং উদ্বেগ কাজ করছে কারণ আমি কি আদৌ আমার ফোনটি ফিরে পাবো?
বাটি নিয়ে অজস্র ঘোরাঘুরির পর এবার কবিরাজ মশাইয়ের বাটিটা পৌঁছে গেলো আমার শ্বশুরের আরেক কর্মচারী কাঞ্চন মিয়ার বাড়িতে। কাঞ্চন মিয়া দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ আমার শ্বশুরের গরু ছাগল এর দেখাদেখি করছেন। তাঁর মতো এমন বুজুর্গ মানুষের বাড়িতে বাটি চলে যাওয়াতে পুরো গ্রামবাসীই বেশ অবাক হয়ে যায় কারণ গ্রামে যদি পাঁচওয়াক্ত নামাজী কোনো মানুষদের লিষ্ট করা হয় তবে কাঞ্চন মিয়ার নামই সবার উপরে থাকবে। কিন্তু তাঁর এতসব সম্মান থাকা সত্ত্বেও কবিরাজের বাটি তাঁর বাড়িতে চলে যাওয়াতে এলাকার মানুষ ছি ছি করতে শুরু করলো। আমার শ্বশুর বেশ ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে কাঞ্চন মিয়াকে বলে উঠলেন,
-কিরে ফ*রনির বা*! দামী মোবাইল দেইখা আর হুঁশ আছিলো না, তাইনাহ?
-ভাইজান! বিশ্বাস করেন আল্লাহর কছম কইরা কইতাছি আমি মোবাইল নেইনাই। এইগুলা সব ভুয়া।
-ভুয়া নাহ? তোরে দেখাইতাছি কোনটা ভুয়া আর কোনটা আসল! ঐ কে আছিস ওরে খুঁটির সাথে বান! আইজকা ওর হাত পা ভাঙ্গমু।
পরক্ষণেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাতুলসহ ওর কিছু বন্ধুরা কাঞ্চন মিয়াকে না বেঁধে সেই জটাধারী কবিরাজকে জাপটে ধরে মুহূর্তেই খুঁটির সাথে বেঁধে ফেললো। ওদের এমন কান্ডে আমার শ্বশুরসহ আগত সবাই হতভম্ব হয়ে স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই আমার শ্বশুর আব্বা তেজদীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
-কিরে তোদের মাথার তার কি দুই একটা ছিড়ছে? কারে রেখে কারে বানলি?
আমি তাঁর কথা শুনে কবিরাজের সামনে এগিয়ে গিয়েই পকেট থেকে মোবাইলটি বের করলাম। পরমুহূর্তেই সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,
-আমার মোবাইল কোনো চোরে নেয়নি। আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম এই কবিরাজ কি আসলেই সত্যিকারের চোরকে ধরিয়ে দেয় নাকি এভাবে ধোঁকা দিয়ে অসহায় মানুষকে চুরির অপবাদে মার খাওয়ায়? আজ তাহলে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ অন্তর আমি শ্বশুর আব্বার কাছে এসে বলি,
-আপনারা সমাজের টাকা পয়সাওয়ালা লোক বলে গরীবদের বিচার করেন এখন আপনি যে গরীবদের গায়ে যুক্তিপ্রমাণ ছাড়াই হাত তুললেন তাহলে তাঁর বিচার করবে কে?
আমার কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর আমি কবিরাজের কাছে গিয়ে যখন শক্ত করে ওর চুলগুলো ধরে একটি টান দিলাম তখনই ওর মাথা থেকে আলগা চুলগুলো বেড়িয়ে এলো। তারমানে এই ব্যাটা আর কেউ নয় বরং ছদ্মবেশী এক ভুয়া কবিরাজ যে এভাবেই মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এতোদিন টাকা ইনকাম করেছে?
এরপর এই কবিরাজের সাথে কি ঘটবে সেটা আপনারা নিশ্চই জানেন। হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন, গণধোলাই!
সমাপ্ত