বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের গানের বিশাল ভাণ্ডারের ভেতর যে বা যারা ডুব দিবেন তারা আমাদের বাংলা গানের একেকটি অসাধারণ অধ্যায়ের সন্ধান পাবেন। যে ভাণ্ডারের ভেতর রয়েছে এমন কিছু রত্ন যে রত্নগুলোকে অন্য কোন দেশ পেলে সারাজীবন পূজা দিতো, যত্ন করে রত্নগুলোর সৃষ্টিগুলোকে সংরক্ষণ করতো। দুর্ভাগ্যবশত যে উপনিবেশকতা থেকে মুক্তি পেলেও আমাদের স্বভাব চরিত্রে উপনিবেশকতার বিদেশি চাটুকারীতা আমরা ছাড়তে পারিনি। তাই তো নিজেদের রত্নগুলোর খোঁজ না রেখে আমরা আজো বিদেশের শিল্পীদের চাটুকারিতা আর পূজা করে যাই।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে অনেক রত্নের মাঝে আজাদ রহমান নামটি জ্বলজ্বল করা একটি হীরক খণ্ডের নাম। যিনি একজন সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী।
আজাদ রহমান হলেন আমাদের চলচ্চিত্রের গানের অন্যতম ক্লাসিক সুরকার যিনি উচ্চাঙ্গরীতির সাথে বাংলাদেশের সহজ সাবলীল সুরের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যারা নিয়মিত দর্শক তারা আজাদ রহমানকে দেখেছেন অসংখ্যবার। কারণ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়েই আজাদ রহমান নিয়মিত কাজ করছেন। বাংলাদেশি খেয়ালের জনকও তিনি।
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি আজাদ রহমানের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। দেশভাগের পর পুরো পরিবার চলে আসেন ঢাকায়। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেয়ালের উপর স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন। বাংলাদেশের ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন বাবুল চৌধুরীর ‘আগন্তুক’ ছবির মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্বে। প্রথম ছবিতেই একেবারেই নতুন শিল্পী খুরশিদ আলমকে ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ গানটি দিয়ে জনপ্রিয়তা পাইয়ে দেন। এই গানটি দিয়েই খুরশিদ আলম রাজ্জাকের কণ্ঠ মেলানো গানগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে যান। গীতিকার নইম গওরের লিখা ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’ গানটির সুর করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।
স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার হাত ধরে ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এরপর মাসুদ পারভেজের ‘এপার ওপার’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ‘ভালবাসার মূল্য কত’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের মন আরও বেশি জয় করে নেন। অথচ এই গানটি গাওয়ার কথা ছিল আব্দুল জব্বারের। কিন্তু আব্দুল জব্বার গানটির জন্য দুইবার আলাদাভাবে পারিশ্রমিক দাবী করলে সঙ্গীত পরিচালক আজাদ রহমান বেঁকে বসেন। তিনি আব্দুল জব্বারকে এক পারিশ্রমিকেই ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটির রোমান্টিক ও স্যাড দুই ভার্সনের জন্যই গাইতে বলেন। আব্দুল জব্বার রাজী হয়ে শুধু ‘মন সঁপেছি আমি তার মনেরই আঙিনায়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে চলে যান ।
পরবর্তীতে আজাদ রহমান ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটি তুলে শোনালে প্রযোজক ও নায়ক সোহেল রানাকে শোনালে সোহেল রানা তাকেই কণ্ঠ দিতে অনুরোধ করেন। বন্ধু সোহেল রানার অনুরোধে গানটিতে কণ্ঠ দেন এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর আজাদ রহমানের গাওয়া সোহেল রানার ঠোঁটে সিলেটের জাফলং এলাকার কমলা বাগানে চিত্রায়িত ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ গানটি শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে যা আজো শ্রোতাদের প্রিয় গানের তালিকায় আছে। মূলত এই গানটির জনপ্রিয়তার কারণেই পরবর্তীতে সোহেল রানার ‘দস্যু বনহুর’ ও ‘গুনাহগার’ ছবি দুটোর সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’, ‘লোকে আমায় কয় গুনাহগার’ গানগুলোতেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন— এ গানগুলোও শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিতেও ‘মা হলো গর্ভধারিণী/ সব দুঃখ হরণকারিণী’ গানটিতেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এরপর বহুদিন আজাদ রহমানকে চলচ্চিত্রের গান গাইতে শুনিনি। বহুদিন পর ১৯৯৩ সালে কাজী হায়াতের ‘চাঁদাবাজ’ ছবির একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
আজাদ রহমান আগাগোড়াই একজন ক্লাসিক সুরকার। সবসময় সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ধারার সাথে আধুনিকতাকে যুক্ত করেছেন। হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, সেতারের সাথে কিবোর্ড, গিটার, ড্রামকে যুক্ত করেছেন অসাধারণভাবে। এই কারণেই আজাদ রহমানের গানগুলো শুনলেই আলাদাভাবে চেনা যায় খুব সহজেই। বাদী থেকে বেগম, এপার ওপার, পাগলা রাজা, অনন্ত প্রেম, আমার সংসার, মায়ার সংসার, দস্যু বনহুর, ডুমুরের ফুল, মাসুদ রানা, রাতের পর দিনসহ প্রায় সাড়ে তিনশো ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের গানে নান্দনিক আবহ সঙ্গীত ও গানের জন্য পেয়েছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
১৯৭৭ সালে আব্দুল লতিফ বাচ্চুর নির্মিত ‘যাদুর বাঁশি’ ছবির জন্য আজাদ রহমান প্রথম জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে কাজী হায়াতের ‘চাঁদাবাজ’’ ছবির জন্য দ্বিতীয়বার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ‘চাঁদাবাজ’ ছবিতে সোহেল চৌধুরীর ঠোঁটে আজাদ রহমানের গাওয়া একটি গান ছিল— যে গানটির জন্য ‘শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)’ শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন যা শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে একসাথে একইবছর দুই শাখাতেই কারো সর্বপ্রথম জাতীয় পুরস্কার পাওয়া।
আজাদ রহমানের সুর করা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান হলো – বন্ধু ওগো কী করে ভাবলে, বনে বনে যত ফুল আছে, মনেরই রঙে রাঙাবো, ও রানা ও সোনা এই শোনো না, আকাশ বিনা চাঁদ হাসিতে পারে না, ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, যুগে যুগে প্রেম আসে জীবনে, মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারি না, আপায় কইছে আমারে বাল্যশিক্ষা কিইন্না দিবো …অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কিত নির্মিত ‘গোপন কথা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন এই বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান। আজাদ রহমান আমাদের বাংলা গানের পর্দার আড়ালে থাকা এক চিরস্মরণীয় সুরস্রষ্ঠা, যার সৃষ্টিগুলো তাকে চিরকাল শ্রোতাদের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে। বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে আজাদ রহমানের লেখা সংগীতবিষয়ক বই ‘বাংলা খেয়াল’। তিনি সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক সহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।