আমার এক কাজিন আছে, আমারই সমবয়সী। ১৯৮৬ সালে যখন আমরা ন্যাশনাল পার্কে পিকনিকে গিয়েছিলাম, তখন যে মিনি বাস নিয়ে গিয়েছিলাম সেটার ড্রাইভার ছিলো আমার এক মামা। ঐ গাড়িতে হেলপারের কাজ করতো তখন আমার সেই কাজিন। নির্দ্ধারিত জায়গায় বাস না রেখে বেশ কিছুটা দূরে পার্ক করে মামা হ্যতো বিড়ি ফুঁকতে আশেপাশে কোথাও গেছিলো। রান্না বান্নার কাজ ফেলে রেখে আনন্দে মেতে উঠলে পরে না খেয়ে থাকতে হতে পারে ভেবে আমাদের মাঝেই কেউ একজন প্রস্তাব করলো রান্নার জায়গা পছন্দ করে সেখানে রান্না চড়িয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু যেখানে রান্না করতে চাইছি সেখান থেকে বাস বেশ দূরে থাকায় রান্নার জায়গায় বাস নেয়ার জন্য খোঁজ পড়লো ড্রাইভার মামার। কিন্তু মামার খোঁজ কিছুতেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। যেনো মামা হাওয়ায় উড়ে গেছেন। অগত্যা আমার কাজিনকে ধরলাম আমরা সবাই মিলে। গাড়িটা রান্নার জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু ড্রাইভার মামার ভয়ে সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। তখন আমরা তাকে তাতিয়ে দেয়ার জন্য বলে উঠলাম, তুই আসলে ড্রাইভিং করতে জানিস না। এতে বেশ কাজ হলো। আমাদের সবার অনুরোধ আবদারেই হউক কিংবা ড্রাইভিং যে সে পারে সেটা বুঝানোর জন্যই হউক সে স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসলো। গাড়ির চাবি গাড়িতেই ছিলো বলে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ছোট্ট এই চলার পথে বারবারই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। বেশ কিছুক্ষন কসরতের পর অবশেষে নির্দ্ধারিত জায়গায় গাড়ি নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। এর কিছুক্ষন পর ড্রাইভার মামা এসে কি রাগারাগি ! রাগারাগির এক পর্যায়ে ওনি চাবি রেখে চলেই আসবেন বলে আমাদের জানিয়ে দিলেন। ওনার সাফ কথা যে গাড়ি ওখান থেকে এখানে এনেছে সেই তোদের গাড়ি চালিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে। হ্যান্ড ব্রেক টানা অবস্থায় গাড়িটা ওখান থেকে এখানে নিয়ে এসেছে সে। ব্রেক শ্যূ এর অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে ইত্যাদী ইত্যাদী মন্তব্য। যাক, পরে আমরা সবাই মিলে আমার কাজিনের সব দোষ আমাদের মাথায় তুলে নিয়ে মামার কাছে খুব নরম হয়ে মিনতি করায় শেষ রক্ষা হয়। আমরা সবাই মামার সাথেই বাড়ি ফিরতে পারি।
এর ঠিক বছর খানেকের মাথায়ই আমার সেই কাজিন পুরো ড্রাইভার হয়ে অন্য একটা গাড়ির রেগুলার ড্রাইভার হিসাবে কাজে যোগ দ্যায়। কিন্তু বছর দুয়েক গাড়ি চালানোর পর সে ড্রাইভারী ছেড়ে বিদেশ যাবার জন্য উঠেপড়ে লাগে। অবশেষে নব্বুইয়ের শুরুর দিকে সে মালোয়শিয়া চলে যায়। মাঝে কয়েকবার আসা যাওয়া করে সব শেষ ২০১৫ সনে সে স্থায়ীভাবে দেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনো দেশেই আছে। সেই ১৯৯০ সন থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সে আর কোনদিন গাড়ি চালায়নি। চালানোর সুযোগও ছিলো না। যেহেতু এই সময়টা সে বিদেশে রং আর রডের কাজ করে কাটিয়েছে।
সে স্থায়ীভাবে বাড়ি ফেরার পর একদিন গ্রামের বাড়ি যাবার পর সে আব্দার করলো গাড়িটা দেয়ার জন্য। সে কোথাও যাবে। ঘন্টা কয়েক পর সে আবার গাড়ি ফেরত দিয়ে যাবে। দিলাম, ড্রাইভার সহ। আপত্তি করলো সে, ড্রাইভার লাগবে না বললো। আমি দিতে চাইলাম না। শেষ পর্যন্ত সে ড্রাইভার নিতে রাজি হলো, শর্ত হলো সে গাড়ি চালাবে, ড্রাইভার পাশে বসে থাকবে। অগত্যা রাজি হলাম। গাড়ি নিয়ে বেরোতেও দেখলাম, আবার গাড়ি নিয়ে ফিরতেও দেখলাম। আর শুনলাম, আমার ড্রাইভারের কাছে। তার মতে আমার কাজিন নাকি চমৎকার গাড়ি চালায় ! এমনকি তার চাইতেও নাকি ভালো চালায়... আর আমি তো যা দেখার তা দেখেছিই। সেই আগের মতোই স্মুথ ড্রাইভিং !
ভালো ড্রাইভারদের এই গুন ! মনের মাঝে সেটা গেঁথে নিলে সারা জীবনেও ভুলে যাবার নয় ! যেমন আপনার লেখা, সুন্দর সেই লেখাগুলো তো আপনিই লিখতেন, মামা। এখন শুধু ইচ্ছা করলেই আবার আগের মতো লেখা বেরিয়ে আসবে আপনার ভিতর থেকে। সেক্ষেত্রে অবসর আর আপনার ইচ্ছাটাই যথেষ্ঠ ! সময় পেলেই আবার লিখতে বসে যান, দেখবেন আমার সেই কাজিনের চাইতেও স্মুথ লেখা বেরিয়ে আসবে আপনার হাত ধরে...
অপেক্ষায় রইলাম, মামা !!