সমগ্র বিশ্বে চলচ্চিত্র শিল্পের সবচাইতে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার বা একাডেমি এ্যাওয়ার্ড। একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সাইন্সের আয়োজনে ১৯২৯ সাল থেকে প্রতি বছর সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্যকার সহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ জানুয়ারি একাডেমি পুরস্কারে মনোনীতদের নাম প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অসামান্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ যেমন বহু যোগ্য ব্যক্তির নাম এসেছে তালিকায় তেমনি বিতর্কের জন্মও দিয়েছে প্রচুর।
জোকারের জয়কার
জোকারের জয়রথ যেন থামছেই না। টড ফিলিপসের ‘জোকার’ শুধু দর্শকের মনোরঞ্জনই করেনি, অস্কারেও সর্বোচ্চ ১১ টি মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছে। সেরা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সেরা অভিনেতা বিভাগে ওয়াকিন ফিনিক্স, সেরা পরিচালক বিভাগে টড ফিলিপস, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা পোশাক ডিজাইন, সেরা মৌলিক সঙ্গীত আয়োজন, সেরা সুর মিশ্রণ, সেরা সম্পাদনা ও সেরা মেকআপ বিভাগে মনোনীত হয়েছে এটি। ধারণা করা হচ্ছে, গোল্ডেন গ্লোবের মতো অস্কারও উঠবে ওয়াকিন ফিনিক্সের হাতেই ।
‘জোকার’ বন্দনায় অস্কার কমিটিও
চমকে দেয়া পরজীবী
‘অনুবাদের এক ইঞ্চি দেয়ালটা পার হলেই দুনিয়ার অসামান্য সব চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় ঘটবে আপনার।‘
পরিচালক বং জুন হোর গোল্ডেন গ্লোবে দেয়া বক্তব্য আরও একবার বিশ্বের তাবৎ সিনেমাপ্রেমিকে ভাবতে শিখিয়েছে। হলিউডেই যে শুধু মানসম্মত ছবি তৈরি হয়, সেই ভোঁতা ধারণাকে ভদ্রভাবেই ধাক্কা দিয়েছেন ‘প্যারাসাইট’ নির্মাতা। কান, গোল্ডেন গ্লোব জয়ের পর বং জুনের ‘প্যারাসাইট’ অস্কারের মঞ্চেও দৃঢ় প্রতিদ্বন্দ্বিতার জানান দিয়েছে। তবে চমকপ্রদ বিষয় হলো, কোরিয়ান ভাষায় নির্মিত এমনকি মূল কাহিনি কোরিয়ান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে নির্দেশ করলেও সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে জায়গা পেয়েছে এটি। এছাড়াও সেরা পরিচালক, বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য বিভাগে , সেরা প্রোডাকশন ডিজাইন বিভাগ ও সেরা সম্পাদনা বিভাগে স্থান লাভ করেছে ছবিটি। তবে সমালোচনার মুখে পড়েছে সেরা অভিনেতা বিভাগে সং কাং হোর মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়টি। সেরা সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগেরও দাবিদার ছিল তুখোড় এই সামাজিক–থ্রিলারটি।
‘প্যারাসাইট’এর সাফল্য অবাক করেছে তাবৎ সিনেমাপ্রেমিদের
নারী নির্মাতারা চক্ষুশূল?
গোল্ডেন গ্লোবের মঞ্চে এবার সঞ্চালক রিকি জেরভেইস ঠাট্টাচ্ছলে বলেই ফেলেছিলেন, ‘ আমাদের সেই সময়ে ফিরে যেতে হবে যখন কোন নারীই ছবি নির্মাণ করতে পারতেননা।‘ ২০১৯ সাল ছিল নারী নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, সম্পাদকদের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ততম বছর। অথচ গোল্ডেন গ্লোব তাতে নাক গলানো হাস্যকরই ভেবেছিল। গ্রেটা গারউইগ, ফিবি ওয়েলার ব্রিজের মতো নারী পরিচালকদের আমলেই নেয়নি তারা। ঠিক একই কাজ করলো ৯২ তম অস্কার বোর্ডও। নারী নির্মাতাদের কাজ নানান বিভাগে মনোনীত হলেও পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যেন এখনও নারাজ একাডেমি। তালিকার নাম ঘোষণার সময় অভিনেত্রী ইসা রে তো বলেই বসলেন , Congratulations to those men.’
২০১৮ সালে গ্রেটা গারউইগ ‘লেডি বার্ড’ এর জন্য সেরা পরিচালক বিভাগে মনোনীত হয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে অস্কারের ৯২ তম আসর পর্যন্ত মাত্র ৫ জন নারী নির্মাতা পেয়েছেন এই মনোনয়ন। ২০১০ সালে ক্যাথেরিন বিগেলো ‘দ্য হার্ট লকার’ এর জন্য অস্কারও পেয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৭৭ এ লিনা ওয়েরট্মুলার ‘সেভেন বিউটিস’ এর জন্য, ১৯৯৪ সালে ‘দ্য পিয়ানো’র জন্য জেন ক্যামপিওন এবং ২০০৪ সালে ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশনে’ র জন্য সোফিয়া কোপোলা তালিকায় এসেছিলেন মাত্র।
গ্রেটা গারউইগকে মনোনয়ন না দেওয়ায় সমালোচিত অস্কার কমিটি
২০১৯ সালে গ্রেটা গারউইগ নির্মিত ‘লিটল উইমেন’ তুমুল করতালি পেলেও অস্কারের সেরা পরিচালকের লিস্টে তাঁর নাম ওঠেনি। ৬ টি বিভাগে মনোনীত হলেও ছবির কাণ্ডারির প্রতি উদাসীন ছিল একাডেমির কর্তারা। এছাড়াও তালিকার জোর দাবিদার ছিলেন ‘হাস্টলারস’ পরিচালক লরেন স্কারফিয়া, ‘দ্য ফেয়ারওয়েল’ এর লুলু ওয়াং, ‘আ বিউটিফুল ডে ইন নেবারহুড’ নির্মাতা মারিয়েল হেলার, ‘হানি বয়’এর আলমা হারল, ‘বুকস্মার্ট’ এর অলিভিয়া ওয়াইল্ড এবং ‘আটলান্টিক’ এর মাতি ডিওপ।
অস্কার কমিটি নিজেদের পক্ষে অবশ্য বলেছেন সর্বমোট ৬২ জন নারীকে তারা মনোনীত করেছে। ফিচার লেংথ ফিল্ম বিভাগে ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’, ‘দ্য এজ অফ ডেমোক্রেসি’ , ‘ফর সামা’ , ‘হানিল্যান্ড’, ‘ দ্য কেভ’ সবগুলোতেই নারী নির্মাতা বা বিষয়ের দিকে গুরুত্ব দিয়েছে তারা। অন্যদিকে ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’ কে মনোনয়নের কারণ হিসেবে অনেকেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাকে দলে ভেড়াবার তাল খুঁজে পাচ্ছেন। মিশেল ওবামার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ পার্টিসিপেন্ট মিডিয়া’ ও নেটফ্লিক্স একত্রে অর্থায়ন করেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে।
মেট্রোর প্রধান চলচ্চিত্র সমালোচক লারুস্কা ইভান–জাদেহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ ২০১৯ সালে অনেক বেশি নারী নির্মাতা কাজ করেছেন এবং তাঁরা প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিভাবান। কিন্তু তালিকায় নাম না আসাটাকে আমি বিস্ময়জনক মানছি এবং আশা করি নারী নির্মাতারা আশাহত হবেন না। আপনারা কাজ করতে থাকুন।‘
বর্ণবাদের অভিযোগ
রাজনৈতিকভাবে সুক্ষ্ম ও সঠিক হওয়ার তাগাদা এখন সবক্ষেত্রেই। কিন্তু খোদ আমেরিকাই যেন সেপথে হাঁটতে রাজি নয়। এর প্রকট দৃশ্য আছে অস্কার তালিকাতেও। অভিনয়ের জন্য চার বিভাগের মাত্র একটিতে কৃষ্ণাঙ্গ কোন অভিনেতার নাম এসেছে। হ্যারিয়েট টাবম্যানের চরিত্রে ‘হ্যারিয়েট’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সিন্থিয়া এরিভোকে সেরা অভিনেত্রী বিভাগে রেখেছে কমিটি। অন্যদিকে তুলসা গোত্রের আলফ্রে উডার্ড ‘ক্লিমেন্সি’র জন্য, ‘হাস্টলারস’ এর জন্য জেনিফার লোপেজ, ‘ডলেমাইট ইস মাই নেম’ অনবদ্য অভিনয়ের জন্য এডি মারফি, ‘আস’ এ দুই চরিত্রের জন্য লুপিতা নিওং, ‘জাস্ট মারসি’ এর জন্য জেমি ফক্স, ‘প্যারাসাইটে’র সং কাং হো, ‘দ্য ফেয়ারওয়েল’ এর আকোয়াফিনা প্রমুখের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ মেলেনি। এদিকে নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক ছবি ‘লায়নহার্ট’ কে সেরা ছবির তালিকায় স্থান দেয়নি কমিটি। তাদের যুক্তি মতে, এটি ভিন্ন ভাষার ছবি। অথচ ‘প্যারাসাইট’ সেই লিস্টে ঠিকই আছে! এর আগেও ‘দ্য হ্যান্ডমেইডেন’, ‘দ্য লেডি অন দ্য ফায়ার’ এর মতো প্রশংসিত আন্তর্জাতিক ছবিকে একই যুক্তিতে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল একাডেমি।
সিন্থিয়া এরিভো ছাড়া অশ্বেতাঙ্গ কোন অভিনেতাকে গোনায় ধরেনি অস্কার; Photo: Hollywood Reporter
নেটফ্লিক্সের বিনিয়োগ সাফল্য
বাণিজ্যিক ভাবে নেটফ্লিক্স বর্তমানে অধিকাংশ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চাইতে বেশি সফল। অস্কার মনোনয়নের দিক দিয়েও এর জয় অব্যাহত। সর্বোচ্চ ২৪ টি মনোনয়ন পেয়েছে স্ট্রিমিং সাইট থেকে বনেদি প্রযোজক বনে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি। এই সাইটে মুক্তি পাওয়া মার্টিন স্করসেসির ‘দ্য আইরিশম্যান’ পেয়েছে ১০ টি নমিনেশন, ‘ম্যারিজ স্টোরি’ পেয়েছে ৬ টি, ‘টু পোপস’ ৩ টি বিভাগে মনোনয়ন। ‘দ্য আইরিশম্যান’ এর জন্য সেরা পার্শ্ব চরিত্রে জো পেসি ও আল পাচিনো মনোনীত হলেও মূল আইরিশম্যান ডি নিরোকে আমলেই নেয়নি অস্কার কমিটি। এছাড়াও ‘আমেরিকান ফ্যাক্টরি’ ফিচার লেংথ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
‘ দ্য টু পোপস’ নেটফ্লিক্সের অন্যতম সফল প্রোজেক্ট
জোড়া মনোনয়নে স্কারলেট
মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ভক্তরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন ‘ব্ল্যাক উইডো’ ছাড়াও ভিন্ন পরিচয় আছে স্কারলেট জোহানসেনের। নাতাশা রোমানফের মৃত্যু হলেও ‘ম্যারিজ স্টোরি’র নিকোল আর ‘জোজো র্যাবিট’এর রোজি ঠিকই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অস্কার তালিকায়। গোল্ডেন গ্লোব হাতছাড়া হলেও অনেকেরই আশা অস্কারে সেরা অভিনেত্রীর সোনালি পুরস্কারটা শোভা পাবে তাঁর হাতেই। অস্কার ইতিহাসে তিনি ১২তম অভিনেত্রী যে একই আসরে সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী দুই বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছেন।
স্কারলেটের অস্কার ভাগ্য কেমন হবে এবার?
গত আসরের মতো এই আসরেও সঞ্চালক বিহীনভাবেই পরিচালিত হবে অস্কার অনুষ্ঠান। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হবে এর বিজয়ীদের নাম। তবে পরিসংখ্যানে বলছে বিগত চার বছর ধরেই এই পুরস্কারের প্রতি আস্থা কমে এসেছে দর্শকদের এবং টেলিভিশনে প্রচারের ব্যাপারেও আগ্রহি নন তারা। এর উপর নতুন বিতর্কের পালে হাওয়া দিয়েছে এবারের মনোনয়ন তালিকা।