সন্তানের আগমন একটি পরিবারে খুশির বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু এই সন্তান ধারণ ও জন্মদানের পুরো সময়টায় যে ত্যাগ ও কষ্টের ভেতর দিয়ে যান একজন মা, তার খবর কয়জন জানেন? কজন ভাবেন মায়ের সুবিধা-অসুবিধার কথা? এসব অসুবিধার কিছু শারীরিক, কিছু মানসিক। যেসব শারীরিক অসুবিধা আমাদের নজরে আসে, সেগুলো সমাধানে হয়তো আমরা সচেষ্টও হই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক দিকটা আমরা খেয়ালই করি না। অথচ সঠিক ব্যবস্থা না নিলে কারও কারও মানসিক সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। আজ সেগুলো নিয়েই আমরা কথা বলব।
হরেক ভাবনা মায়ের মনে
গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে অনেক মায়ের মধ্যে দেখা দিতে পারে মন খারাপ ভাব বা মৃদু বিষণ্ণতা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. লুবনা জাহান বলেন, ‘মাতৃত্ব নারীর জীবনে এক বিরাট বড় পরিবর্তন। গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে অনেকেই বিষণ্ণতায় ভোগেন। বিশেষ করে প্রথম সন্তান জন্মের সময় অনেকেই মানসিক সমস্যায় পড়েন। আমি কি ভালো মা হতে পারব—কেউ কেউ এই আশঙ্কায় ভোগেন। কম বা একটু বেশি বয়সে মা হলে কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে থাকলেও এ রকম হতে পারে।’ আগের সন্তান ছোট থাকা অবস্থায় আবার গর্ভধারণ করলেও মানসিক চাপ বোধ করতে পারেন মা। প্রসব-পরবর্তী ১-২ শতাংশ মায়ের মধ্যে এমন ধারণাও হতে পারে যে এই শিশুই তাঁর সব শারীরিক পরিবর্তন এবং কষ্টের জন্য দায়ী। এই ভাবনা থেকে অন্তঃসত্ত্বা বা প্রসূতি মায়ের নিজের ওপর রাগ–বিরক্তি, ক্ষোভ–অভিমান বাড়তে থাকে।
হঠাৎ শরীর ও মনের পরিবর্তনে দিশেহারা অন্তঃসত্ত্বা মাকে সময় দিতে হবে পরিবারের বাকি সদস্যদের। মডেল: মার্শিয়া
কেন হয়?
এসব সমস্যার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই তবে বেশ কিছু প্রভাবক আছে। মাতৃত্বকালীন স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনে হরমোনের তারতম্য ঘটে। স্নায়ুর ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী কিছু উপাদানেরও তারতম্য ঘটে। এসবের ফলেই মায়ের আবেগীয় পরিবর্তন হয়। এ ছাড়া পুষ্টি, বিশ্রাম, পারিবারিক নিরাপত্তা এবং স্বস্তিদায়ক পরিবেশ—এগুলোর যেকোনোটির অভাব মায়ের মানসিক অবস্থার ওপর ফেলতে পারে নেতিবাচক প্রভাব। কোনো কোনো মায়ের আগে থেকেই দুশ্চিন্তাজনিত মানসিক সমস্যা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবারে মানসিক সমস্যার ইতিহাস থাকে।
লক্ষণগুলো জানা থাক
গর্ভাবস্থায় কিংবা প্রসব-পরবর্তী সময়ে খিটখিটে হয়ে যেতে পারে মায়ের মেজাজ। অল্পতেই মন খারাপ হয়ে যেতে পারে বা সব সময় মনমরা থাকতে পারেন। ‘মুড সুইং’ অর্থাৎ মনের আকাশে এই মেঘ, আবার এই রোদ্দুর—এমনটাও দেখা যায়। অকারণ চিৎকার করতে পারেন, কাঁদতে পারেন। কেউ বেশি খান, কারও অরুচি দেখা দেয়। কেউ কম ঘুমান, কেউ বেশি ঘুমান। মনোযোগের অভাবও হয়।
গুরুতর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে, রোগী নিজেকে অসহায় মনে করেন, নিজের যত্ন নিতে অবহেলা করেন। মারাত্মক পরিস্থিতিতে রোগী নিজের ক্ষতিও করেন।
এ ছাড়া প্রসব-পরবর্তী সময়ে কারও কারও সাইকোসিস (গুরুতর মানসিক সমস্যা) হতে পারে, যেখানে রোগীর মধ্যে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস জন্মে। তিনি অলীক কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে পারেন। এমনকি নিজের সদ্যজাত শিশুটিকেও তিনি শত্রু মনে করতে পারেন এবং তাঁর ক্ষতি করতে উদ্যত হতে পারেন।
করণীয়
মৃদু বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে রোগীকে ভরসা দেওয়াটাই মূল চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সহানুভূতি এবং আশ্বাসই টনিকের কাজ করে। এই বিষণ্ণতা খুবই স্বাভাবিক, কিছুদিন পরই যা কেটে যায়। যেকোনো পরিস্থিতিতে পরিবার তাঁর পাশে রয়েছে, মায়ের মনে এমন বিশ্বাস বুনে দিতে হবে। মানসিক সমর্থন পেলে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়।
অন্যান্য মানসিক সমস্যার তুলনায় এ ধরনের সমস্যা দ্রুত সেরে যায়। প্রতীকী এই ছবিতে মডেল হয়েছেন মার্শিয়া
গুরুতর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা আবশ্যক। সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসা নিতে হবে অতিসত্বর। এ ক্ষেত্রে মা ও শিশু দুজনেরই আলাদা যত্ন নিতে হবে। এমনকি মা শিশুটিকে খাওয়ানোর সময়ও যাতে একজন নিকটাত্মীয়ার তত্ত্বাবধানে থাকেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তিও রাখতে হতে পারে।
প্রসব-পরবর্তী সময়ে মা যদি হঠাৎ চুপ হয়ে যান, শিশুর যত্ন নিতে অনাগ্রহী হন, কিংবা শিশুর ওপর রেগে যান, তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আশার কথা হচ্ছে, অন্যান্য মানসিক সমস্যার তুলনায় এ ধরনের সমস্যা দ্রুত সেরে যায়। চিকিৎসা করালে বেশির ভাগ রোগী চার-ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করেন। তবে পরবর্তীকালে সন্তান ধারণ করলে এমন সমস্যার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে। তাই পরবর্তী সময়ে গর্ভধারণ করলে তাঁর বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
প্রতিরোধ
গর্ভধারণের পরিকল্পনার সময় থেকেই প্রতিটি হবু মা এবং পরিবারকে গর্ভধারণ সম্পর্কে জানতে হবে, মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। মাকে সময় দেওয়া, তাঁর যত্ন নেওয়া, তাঁকে সব বিষয়ে আশ্বস্ত করা এবং তাঁকে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করা পরিবারেরই দায়িত্ব। এ সময় হবু মা এবং প্রসূতি মায়ের প্রতি পরিবারের সমর্থন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কাজের চাপে মা যাতে পিষ্ট না হন, নিজের যত্ন নেওয়ার ফুরসত যাতে তিনি পান, সেদিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক। তাঁর প্রিয় মানুষটি যদি দূরে থাকেন, তিনি যেখানে থাকবেন, সেখান থেকেই সমর্থন দেবেন, বাকিদেরও তাঁর শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করতে হবে। মায়ের পুষ্টি ও বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক চাপমুক্ত নিরুদ্বেগ, প্রশান্ত, নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের মন ভালো রাখতে হবে। অনেক মানসিক সমস্যা এভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
* জানালেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক রোগ (সাইকিয়াট্রি) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া।