অন্ধকারের গান
রাখাল হাকিম
রাখাল হাকিম
হঠাৎ করেই তানিয়াকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। ছোট্ট মেয়ে, চেহারাটা ভারী মিষ্টি। কথা বার্তা খুবই শিশু সুলভ। বয়সও খুব বেশী হয়েছে বলে মনে হলোনা।
প্রথম দেখার ভালোবাসাগুলো এমনই। কোন শক্তির বাঁধই মানে না। অপর একটি মেয়ে অহনাকেই তখন মনে প্রাণে ভালোবাসতাম। হঠাৎই কেমন যেনো ফাটল সৃষ্টি হলো দুজনের মাঝে। আমাকে খুব একটা পাত্তা দিতে চাইছিলো না।
অহনার অনেক বোন। আর এক ভাই। বোধ হয় বড় ভাইটার জন্যেই এত কিছু। সে চায় তার অন্য সব তুলনামূলকভাবে চেহারা খারাপ বোনদের কারো সাথেই প্রেম করি। অহনাদের বাড়ীতে গেলেও, বলে অহনা আছে, তবে এখন ব্যাস্ত। তুমি বসো। সময় হলে আসবে।
অহনার ব্যাস্ততা আমি বুঝি। খুব বেশী সুন্দরী বলে, অনেক ছেলেদেরই মধ্যমণি সে। হয়তো বা আমার চাইতে পছন্দের অন্য কোন ছেলেকে পেয়ে গেছে, অথবা, তার বড় ভাই এর চালাকীতেই আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চাইছে।
সেদিন অহনার সাথে এক প্রকার ঝগড়া বিবাদ করেই তাদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। বিধ্বস্ত মনে উন্মাদের মতোই পথ চলছিলাম। ঠিক তখনই পথে তানিয়াকে দেখেছিলাম। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। আর প্রেম নয়, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবই দিয়েছিলাম।
তানিয়ার বাবা নেই। মা টাও খুব সহজ সরল। আমার প্রস্তাব শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে বললো, বলো কি বাবা? তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? বেশ তো? কবে?
পান থেকে চুন খসতে বোধ হয় সময়ই লাগে। আমি সময় নিতে চাইলাম না। তানিয়ার মতো মিষ্টি চেহারার এই মেয়েটাকে আমি কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইলাম না। হউক বয়স আমার চাইতে অনেক অনেক কম। প্রেম ভালোবাসা জীবনে কতই করেছি। শেষ পর্য্যন্ত কাউকেই নিজের করে পাইনি। এবার বিয়ে, নিজস্ব সম্পদ করেই নেবো তানিয়াকে। আমি বললাম, খুব ঘটা করে বিয়ে আমি করতে চাইনা। তানিয়া যদি রাজী থাকে, তাহলে আপনি যখন বলবেন তখনই।
তানিয়ার মা বললো, তানিয়ার আর রাজী অরাজী কি? বয়সই আর কতটুকু হয়েছে? আমার কথা ছাড়া এক পাও নড়ে না। তুমি দিন তারিখ ঠিক করো। কাকে কাকে জানাতে হবে বলো। তুমি ঘটা করতে না চাইলেও, আমি ঘটা করবো। তানিয়ার বাবা না থাকলেও, আত্মীয় স্বজন আমাদের অনেক।
আমি বললাম, প্লীজ, এত ঘটা করার দরকার নেই। আপনি আপনার আত্বীয় স্বজনদের জানাতে চাইলে জানান। আমি কাউকেই জানাতে চাইছি না। তানিয়াকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। দিন তারিখ অন্যদিন এসে জানিয়ে যাবো।
এই বলে তানিয়াদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসছিলাম। উঠানে আবারো দেখলাম তানিয়াকে। ছোট গাছটার দীর্ঘ চিরল পাতার ডালটা ধরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে কেমন এক বিস্ময় দৃষ্টি নিয়েই তাঁকিয়ে রইলো। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কেমন আছো তানিয়া?
তানিয়া কিছুই বললো না। হতবাক দৃষ্টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁকিয়ে রইলো শুধু।
সেদিন বিয়ের দিন তারিখটা জানানোর জন্যেই তানিয়াদের বাড়ী গিয়েছিলাম। তাদের বাড়ীর উঠানে পা দিতেই দেখলাম, তানিয়া ভীত এক চেহারা করে, দেয়ালের আঁড়ালেই লুকুতে চাইলো। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কি তানিয়া, আমাকে তোমার অপছন্দ?
তানিয়া কিছু বললো না। দেয়ালটা দু হাতে চেপে ধরে, আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলো। চেহারায় এক ধরনের অজানা ভয়। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে ভয় করছো?
তানিয়া কিছু বললো না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁকিয়ে রইলো। আমার হঠাৎই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। তানিয়া বোবা টোবা নয় তো? মেয়ের কোন খুত না থাকলে, তার মাও এমন ছোট্ট একটা মেয়েকে এত সহজেই আমার হাতে তুলে দিতে চাইছে কেনো? আমি বিড় বিড় করেই বললাম, তাহলে কি মেয়েটি বোবা?
তানিয়া না বোধক মাথা নাড়লো।
আমি বললাম, তাহলে কথা বলছো না কেনো? আমাকে কি তোমার অপছন্দ?
তানিয়া আবারো না বোধক মাথা নাড়লো।
আমি বললাম, তোমার সাথে যে আমার বিয়ের কথা বার্তা চলছে, তা তুমি জানো?
তানিয়া এবার হ্যা বোধক মাথা নাড়লো।
আমি বললাম, এই বিয়েতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?
তানিয়া আবারো না বোধক মাথা নাড়লো।
তানিয়ার ব্যাপারটা আমি বুঝলাম। আসলে, বয়সের একটা ব্যাবধান আর তানিয়ার বর্তমান বয়সটাই তাকে ভীত করে রেখেছে। আর তার এই ভীত চেহারাটাই আমার কাছে এত ভাল লাগছিলো যে, কিছু একটা উপহার তাকে এই মুহুর্তেই করতে ইচ্ছে করছিলো। পকেটে বিদেশী টাকার একটা নোট ছিলো, যা দেশে কোন কাজেই লাগবে না। আমি ব্যাক পকেট থেকে মাণি ব্যাগটা বেড় করে, সেটাই তানিয়ার দিকে বাড়িয়ে বললাম, এটা তোমাকে উপহার করতে চাইছি, নেবে?
তানিয়া খুব খুশী হয়েই হাত বাড়ালো। হাতে নিয়ে বললো, এটা কি টাকা?
তানিয়ার খুশী দেখে, আমার মনটাও আনন্দে ভরে উঠলো। আমি বললাম, হুম টাকা, তবে বিদেশী টাকা।
তানিয়া বললো, তাহলে কি ডলার?
আমি বললাম, হুম ডলার, তবে ইউ এস ডলার নয়, তাইওয়ান ডলার। সেবার তাইওয়ান গিয়েছিলাম। তখন কিছু টাকা বদলাতে হয়েছিলো। এটা খরচ হয়নি। তাই পকেটে ছিলো।
তানিয়া তাইওয়ান ডলারটা হাতে নিয়ে, খুশীতে নাচতে নাচতে বাড়ীর ভেতর ঢুকে গেলো।