What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected অনন্ত অম্বরে (আত্ম জিবনী) (1 Viewer)

ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি




ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি পেয়েছি। হাতের লেখা যেমন চমৎকার, ইংরেজিও খুব সুন্দর। চিঠির শেষে নাম নেই, শুরুতেই তার জন্যে পত্র লেখিকা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন–আমি মোটামুটি সম্মানজনক একটি চাকরি করছি। আমার বয়স ৪০। আমার আদি নিবাস বিহার প্রদেশে। মোহাজের হয়ে বাবা-মা-ভাইবোন সহ ১৯৫০ সনে তদানীন্তন পাকিস্তানের সৈয়দপুরে চলে আসি।

একটি দীর্ঘ চিঠি। ভদ্রমহিলা জানাচ্ছেন, তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার এক সাক্ষাৎকারে পড়েছেন যে, আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা নিয়েছি। তিনি চাচ্ছেন যেন সেই উপন্যাস একপেশে না হয়। যেন বিহারী মোহাজেরদের কথা লেখা হয়–যারা একটি দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশে এসেছিল, সেই দেশও তাদের রইল না। পাকিস্তানও তাদের দেশ নয়। এখন তারা এমন এক মানবগোষ্ঠী যাদের কোন দেশ নেই।

এই পত্ৰলেখিকা জেনেভা ক্যাম্পে তিন মাস ছিলেন। তিনি সেই তিন মাসের অভিজ্ঞতা এবং জেনেভা ক্যাম্পে আসার আগের অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অভিজ্ঞতা খোলাখুলি বর্ণনা করেছেন। যেই অভিজ্ঞতার কিছু কিছু অংশ ভয়াবহ। বর্ণনাতীত।

চিঠির শেষ পর্যায়ে তিনি লিখছেন–প্রিয় লেখক, আমি কিছুই আপনার কাছে গোপন করি নি। সব লিখলাম এই আশায়, যখন আপনি লিখবেন তখন আমাদের কথাও মনে রাখবেন। আপনারা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছেন–আমরা কি পেলাম?

চিঠিতে কোন ঠিকানা নেই বলে আমি চিঠির জবাব দিতে পারি নি। এই লেখায় জবাব দিচ্ছি। জানি না তিনি পড়বেন কি-না। না পড়লেও আমার মনের শান্তির জন্যে চিঠিটার জবাব দেয়া দরকার।

আমি ভদ্রমহিলাকে জানাচ্ছি যে, তাঁর চিঠি আমি গভীর মমতা এবং গভীর বেদনার সঙ্গে পড়েছি। যে অন্যায় তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবারের উপর করা হয়েছে। তার জন্যে আমি এদেশের মানুষের হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

সেই সঙ্গে তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, সমগ্র জাতির উপর যখন পাকিস্তানী মিলিটারী নির্মম অত্যাচার শুরু করেছে তখন মোহাজের বিহারীদের আমরা পাশে পাই নি। তারা যোগ দিয়েছেন হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। অথচ তাঁরা বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় বড় হচ্ছেন। মাটি আমাদের মা। তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মায়ের সঙ্গে। এই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তো পেতেই হবে। ভয়াবহ দুঃসময়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। একজনের অপরাধে দশজন নিরপরাধী শাস্তি পায়। আমরা বাঙালিরা কোন অপরাধ না করেই কঠিন শাস্তি পেলাম। তাঁরাও খানিকটা পেয়েছেন। আমাদের চরম দুঃসময়ের কথা মনে করে তাঁরা তাদের পুরানো ব্যথা ভোলার চেষ্টা করবেন–এই কামনাই করছি।

দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হল। পদ্মা, মেঘনায় অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে–১৯৭১-এর স্মৃতি সেই বিপুল জলরাশি মুছে ফেলতে পারে নি। পত্রলেখিকা তাঁর জীবনের ভয়ংকর কিছু সময়ের কথা লিখেছেন–আমিও খানিকটা লিখলাম। এই লেখাটায় ঈশপের গল্পের মত শেষের দিকে একটু চমক আছে। আশা করি পত্র–লেখিকা সেই চমকটি ধরতে পারবেন এবং আমার দুঃখের তীব্রতা খানিকটা হলেও বুঝবেন–

জায়গাটার নাম গোয়ারেখা।

পিরোজপুর শহর থেকে পনেরো-ষোল মাইল দূরের অজ পাড়া গাঁ। নদীর পাশে ছোট্ট গ্রাম। নদীর নাম মনে নেই–বলেশ্বর বা রূপসা হতে পারে। নদী যেমন সুন্দর গ্রামটা তার চেয়েও সুন্দর। নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে অতি যত্নে কেউ যেন এই গ্রাম সাজিয়ে দিয়েছে। ভরা বর্ষা–থৈ থৈ করছে নদী। জ্যোৎস্না রাতে আলোর ফুল ঝরে ঝরে পড়ে। কিছু ফুল আটকে যায় গাছের পাতায়। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নদৃশ্যের মত। এই স্বপ্নদৃশ্যে আমি আমার মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে বাস করছি। আমাদের মধ্যে কোন স্বপ্ন নেই।

মা ক্রমাগত কাঁদছেন। কারণ খবর পাওয়া গেছে, পাক মিলিটারী আমার বাবাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই জাফর ইকবালকে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুজনই রাইফেল নিয়ে প্রচুর ছোটাছুটি করেছি। ভেবেছি, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলে মিলিটারীদের আটকে দেয়া যাবে। বাস্তবে তা হয় নি। পাক আর্মির গানবোট বিনাবাধায় পিরোজপুরের হুলারহাটে ভিড়েছে। তাদের একটি দল মার্চ করে ঢুকেছে পিরোজপুর শহরে। শুরু হয়েছে ধ্বংস এবং হত্যার উৎসব।

আমরা তখন পলাতক। প্রথমে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিপদজনক মানুষ হিসেবে আমাদের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় দিলেন গোয়ারেখার জনৈক মৌলানা। তিনি সর্ষিনার পীর সাহেবের ভক্ত খাদেম। মনেপ্রাণে পাকিস্তানী। পাকিস্তান যাতে টিকে যায় সেই দোয়া তিনি প্রতি নামাজেই করছেন। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন–জোর গলায় বলছেন, কোন ভয় নাই। মিলিটারী আপনার ছেলেদের ধরতে পারবে না। উপরে আছেন আল্লাহ পাক, নিচে আমি। আমাকে গুলি না করে তারা আপনার ছেলেদের গুলি করতে পারবে না।

মা তাঁর কথায় খুব ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ আশেপাশে মিলিটারী অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এইসব হত্যাকাণ্ডের খবর আবার মৌলানা সাহেব নিজেই নিয়ে আসছেন এবং আমাদের সবাইকে একত্র করে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন।

আজ কাউখালিতে বিশটা মানুষ লাইন করে দাঁড়া করেছে। ব্রাশ ফায়ার। সব শেষ।

আজ দুইটা মানুষরে খেজুর গাছে তুলে বলল–জয় বাংলা বোল। তার পরেই ডিম ডিম গুলি।

আজ কুড়াল দিয়ে এক কোপ দিয়ে হিন্দু কম্পাউন্ডারের কল্লা আলাদা করে ফেলেছে।

হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সময় মৌলানা সাহেবের মুখে এক ধরনের আনন্দময় আভাও দেখতে পাই। আমি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না। ভদ্রলোক নিতান্তই ভালমানুষ। তিনি শুধু যে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন তাই না, কয়েকজন হিন্দু যুবককেও আশ্রয় দিয়েছেন।

হিন্দুদের জন্যে তখন সব পথ বন্ধ। হিন্দু জানলেই দ্বিতীয় কোন কথা বলার সুযোগ নেই–গুলি। হিন্দু পরিবারগুলি বাড়ি-ঘর ছেড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। বর্ষাকালের সাপ-খোপ ভর্তি জঙ্গল। দিন-রাত বৃষ্টি পড়ছে। বর্ণনার অতীত সব দৃশ্য। এরা পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতেও পারছে। যেতে হবে সুন্দরবন হয়ে। নদীতে ঘুরছে মিলিটারী গানবোট। সাহায্য করবার জন্য মুক্তিবাহিনী তখনো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি।

আমরা আমার নিজের দেশের অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রামে আটকা পড়ে গেছি। পালিয়ে যেতে চাচ্ছি অন্য একটি দেশে। চারপাশে মৃত্যু ঘোরাফেরা করছে। তীব্র আতংকে কাটছে আমাদের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী।

এই রকম সময়ে গোয়ারেখার মৌলানা সাহেব চিন্তিত মুখে মাকে বললেন, আপনার ছেলে দুটাকে সরিয়ে দেয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না।

মা চমকে উঠে বললেন, কেন?

অবস্থা ভাল দেখতেছি না।

ভাল দেখতেছেন না কেন?

জোয়ান ছেলেপুলে সব ধরে ধরে মেরে ফেলতেছে।

ওদের কোথায় সরিয়ে দিতে চান?

এমন জায়গায় সরাব যে মিলিটারী কোন সন্ধান পাবে না।

এমন জায়গা কি আছে?

অবশ্যই আছে। ওদের রেখে আসব সর্ষিনা পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। ওরা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকবে। দরকার হলে ওদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেব–

জামাতে ছওম ক্লাসে।

মা বললেন, আপনার হাতে আমি ছেলে দুটাকে তুলে দিলাম। আপনি যা ভাল মনে করেন …।

আমরা দুভাই লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরলাম। মাথায় দিলাম গোল বেতের টুপি। রওনা হলাম সর্ষিনা। যেতে হবে নৌকায়। পথ মোটেই নিরাপদ না। মিলিটারীর গানবোট চলাচল করছে। আতংকে অস্থির হয়ে যাত্রা। এই নৌকা ভ্রমণ মনে হচ্ছে। কোনদিন শেষ হবে না। ইঞ্জিনের বিজবিজ শব্দ হতেই অতি দ্রুত নৌকা কোন খাড়িতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে মৌলানা সাহেব বলেন, বাবারা ডাইনে তাকাবা না। আমরা ডাইনে তাকাই না, কারণ তখন ডানে গলিত মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।

সর্ষিনার পীর সাহেবের আস্তানা চমৎকার। জায়গাটা নদীর তীরে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মাদ্রাসার ছাত্রদের থাকার জন্যে বিশাল হোস্টেল। পাড়া গা মত জায়গায় বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর হবে নাই বা কেন। পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রপ্রধানই এখানে এসেছেন। কিছু সময় কাটিয়েছেন।

আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সর্ষিনা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপাগপ করে খেলাম। তাদেরকে যে মিলিটারীরা কিছুই বলছে না এ জন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে সর্ষিনার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দুভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্রকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করলাম না।

সঙ্গের মৌলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হল না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশির ভাগ কথার জবাব দিচ্ছেন উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কি কথা যেন বলা হল। পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।

মৌলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ংকর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?

মৌলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কি কথাবার্তা তাঁর হয়েছে তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারীরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। ভোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল–দেহেন দেহেন। তাকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। এমন কোন দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে ঝিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ শার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়ত পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।

এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশের সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্রসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।

১৯৮০ সনে, মুক্তিযুদ্ধের ন বছর পর মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে–সর্ষিনার পীর মৌলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।

হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?
 
বিয়ের ঘটকালী



বাঙালি মাত্রই প্রবল উৎসাহের সঙ্গে একটি কাজ করে–বিয়ের ঘটকালী। যে মানুষটির কোন কাজে উৎসাহ নেই, সাপ্তাহিক বাজারে যান না, ঈদের জামা কেনার জন্যে বাচ্চাদের হাত ধরে বের হন না, তিনিও বিয়ের ঘটকালীতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন। সম্ভবত ঘটকালী করতে গিয়ে নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে, প্রথম জীবনের সুখস্মৃতিতে নস্টালজিক হবার সুযোগ ঘটে বলেই এত উৎসাহ।

আমি নিজে খুব আগ্রহ করে এ-রকম একটি বিয়ে দেই। গ্রামের একটি কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়ে একটি রূপবতী তরুণীকে আমার খুব পছন্দ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক তখন পিএইচ.ডি. করতে কেমব্রীজ যাচ্ছে। বউ সঙ্গে নিয়ে যাবার সুযোগ আছে। সে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে ডেকে বললাম, একটা ভাল মেয়ে দেখেছি। ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি মেয়েটিকে দেখে এসো।

সে অবাক হয়ে বলল, আপনি যেখানে ভাল বলছেন সেখানে আমার দেখার কি দরকার? আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি যাকে বিয়ে করতে বলবেন আমি তাকেই বিয়ে করব।

আমার প্রতি তার আস্থা দেখে শংকিত বোধ করলাম। চিঠি লিখলাম মেয়ের বাবাকে। মেয়ের বাবা রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠির জবাব পাঠালেন। চিঠির ভাষা

এরকম–

পরম পূজনীয় স্যার,

ভগবানের আশীর্বাদস্বরূপ আপনার পত্র পাইয়াছি। আপনি আমার জ্যেষ্ঠা কন্যার জন্য পাত্র দেখিয়াছেন–আপনার পছন্দের পাত্রকে আমার দেখার কোনই কারণ নেই। আপনি যদি রাস্তার কোন অন্ধ ভিক্ষুককে আমার কন্যার জন্য স্থির করেন–ভগবানের শপথ, আমি তাহার হাতেই কন্যা তুলিয়া দিব। আমার কন্যাও তাহাতে কোন অমত করিবে না।

শুধু শ্রীচরণে একটি অনুরোধ–বিবাহ অনুষ্ঠানে আপনাকে উপস্থিত থাকিতে হইবে এবং কন্যা আপনাকে সম্প্রদান করিতে হইবে।

এ কি সমস্যায় পড়া গেল! কেউ কাউকে দেখল না–এক চিঠিতে বিয়ে? তারপর যদি দেখা যায় তেলে-জলে মিশ খাচ্ছে না তখন কি হবে? স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির দায়ভাগের সবটাই কি আমাকে নিতে হবে না?

বিবাহ অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। অনেক দূরের পথ–লঞ্চে করে যেতে হয়। আমি তিন কন্যা এবং কন্যাদের মাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম। নিজে বিয়ে দিচ্ছি সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকব না তা হয় না। তাছাড়া হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়। বাচ্চারা দেখে আনন্দ পাবে। আগে কখনো দেখেনি–।

শেষরাতের দিকে লগ্ন।

লগ্ন পর্যন্ত পৌঁছার আগেই ভয়াবহ সব ঝামেলা হতে শুরু করল। ঝামেলার প্রকৃতি ঠিক স্পষ্ট হল না।–রাত বারোটার সময় বর এসে আমাকে কানে কানে বলল, স্যার, বিয়ে করব না।

সেকি?

পালিয়ে যাব। বন্ধু বান্ধবরা তা-ই বুদ্ধি দিচ্ছে। এরা অবশ্যি পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। ধরতে পারলে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে।

সত্যি পালাবে না-কি?

না পালিয়ে উপায় নেই। আপনি ভাবী এবং বাচ্চাদের প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় পাঠিয়ে দিন। ওদের প্রটেকশনে তারা থাকুক। চলুন, আমরা পালিয়ে যাই। পরে পুলিশ দিয়ে ভাবী এবং বাচ্চাদের উদ্ধার করব।

বলছ কি তুমি?

সত্যি কথা বলছি। দুটার সময় লগ্ন। হাতে সময় বেশি নেই। পালিয়ে যেতে হবে একটার দিকে। এদের কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। তবে আমার মনে হয় আঁচ করে ফেলেছে–লাঠি-সোটা নিয়ে তাগড়া তাগড়া ছেলেপুলে ঘুরঘুর করছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখুন।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই তাই। আমার গা হিম হয়ে গেল। এ কি যন্ত্রণা! কে আমাকে বলেছিল বিয়ের ঘটকালীতে যেতে?

গুলতেকিন হতাশ গলায় বলল, জুতা খুলে ফেল। খালি পায়ে ভাল দৌড়াতে পারবে। অকারণে কি ভয়ংকর সব যন্ত্রণা যে তুমি তৈরি কর। মাঝে মাঝে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে।

বর যে সত্যি সত্যি পালিয়ে যেতে চাচ্ছে তা তখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি। বরের বাবা অতি বৃদ্ধ এক স্কুল শিক্ষক যখন আমাকে বললেন, বাবা আমার ছেলে যে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে এই কাজটা কি ঠিক হবে? হিন্দুমতে লগ্ন পেরিয়ে গেলে দুপড়া হয়ে যায়। সেই মেয়ের তো আর বিয়ে হবে না।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথায় আমার কাল ঘাম বের হয়ে গেল। হায় হায় আমি তো একশ হাত পানির নিচে! বৃদ্ধকে বললাম, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।

রাত দুটার লগ্ন পার হয়ে গেল। ভোর সাড়ে তিনটায় শেষ লগ্ন। বিয়ে হলে ঐ লগ্নে হবে, নয়তো না। মেয়ের বাবা এসে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন–আমি এই ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিব না। আমার মেয়ের কপালে ভগবান যা রেখেছেন তাই হবে। এই বলেই তিনি শার্ট গায়ে বের হয়ে গেলেন। আমরা খবর পেলাম, মেয়েটি বিয়ের কারণে সারাদিন উপোস ছিল। এই খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। তার জ্ঞান আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা সব চিৎকার করে কাঁদছে।

ইউনুস নবী মাছের পেটে যখন চলে যান তখন সেই মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে একমনে একটা দোয়া পড়েন, যে দোয়ার নাম দোয়ায়ে ইউনুস। আমি অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে সেই দোয়া পড়ছি–লা-ইলাহা ইল্লা আতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজুয়ালেমিন। এমন ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন আগে হই নি। এই বিপদ থেকে বের হবার কোন পথও আমি জানি না। আমার পাশে আছে একদল বাজনাদার। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। হিন্দু বিয়ে বাজনা ছাড়া হয় না। খানিকক্ষণ মন্ত্রপাঠের পরপর বাজনা বাজাতে হয়। এই বাজনাদারের ক্ষুদ্র দল বাজনা বাজানোর কোন সুযোগ পায় নি। মনে হচ্ছে পাবেও না। পুরো দলটি অসম্ভব বিষণ্ণ। মাথা নিচু করে বসে আছে।

শুধু পুরোহিত তাঁর পোশাক-আশাক পরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত মুখে বিয়ের আসরে বসে আছেন। তাঁর সামনে পেতলের নানান ধরনের কাশি-কুশি। তিনিও ঐ জায়গায় সন্ধ্যা থেকে বসে আছেন। নড়েন নি। লগ্ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত হয়ত নড়বেন না। আমি ঐ ভদ্রলোকের অসীম ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। ভদ্রলোক যেন মানুষ নন। পাথরের মূর্তি।

লগ্ন শেষ হবার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে বর বলল, আচ্ছা ঠিক আছে বিয়ে করব। টোপর কোথায়?

মেয়ের বাবা বললেন–না। অসম্ভব! আমি ঐ বদ ছেলের হাতে আমার আদরের মেয়েকে দেব না। মেয়ে কেটে রূপশা নদীতে ভাসিয়ে দেব।

লোকজন ধরাধরি করে মেয়ের বাবাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল–মাঠের দিকে। সেখান থেকেই ভদ্রলোক চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।

তাঁর কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল বাজনায়।

বাজনাদাররা বাজনা বাজাতে শুরু করেছেন।

ক্রমাগত উলু পড়ছে।

বাজনার শব্দ, উলুর শব্দ, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা কন্যার বাবার কান্নার শব্দ–সব মিলিয়ে পরিবেশ কেমন যেন হয়ে গেল।

খোলা উঠোনে বিয়ে হচ্ছে। আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হ্যাজাক লাইট। আমি দূর থেকে দেখছি। কনেকে এনে বসিয়ে দেয়া হল বরের সামনে। মেয়েটিকে আজ আর মানবী বলে ভ্রম হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হল ঈশ্বর তাঁর ভাণ্ডারের সমস্ত রূপ অন্তত আজ রাতের জন্যে হলেও মেয়েটির সারা শরীরে ঢেলে দিয়েছেন। হোমের আগুনের পাশে মেয়েটি যেন পদ্মফুল হয়ে ফুটে আছে। শুভ দৃষ্টির আগে স্বামীর দিকে তাকানোর নিয়ম নেই–তবু সে একবার চোখ বড় বড় করে তাকালো স্বামীর দিকে–সেই দৃষ্টিতে ছিল গভীর বেদনা, অনুযোগ এবং তার সতেরো বছরের জীবনের অভিমান!

মেয়ের বাবাকে হাত ধরে ছেলের বাবা নিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। গাঢ় স্বরে বললেন, স্যার, আমি দরিদ্র মানুষ। আজ আপনার জন্যে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পেয়েছি। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। বলেই এই বৃদ্ধ মানুষ নিচু হলেন আমার পা স্পর্শ করার জন্যে–আমি তাঁকে ধরে ফেললাম। কোমল গলায় বললাম–যান, মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন।

সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন–আচ্ছা, এই বাজনাদারগুলি কোত্থেকে জোগাড় করেছে?–এরা এখনো বাজনা বাজাচ্ছে। মন্ত্রপাঠের সময় থামবে না? এরা কি নিয়ম-কানুন কিছু জানে না?

তাকিয়ে দেখি, বাজনাদারের পুরো দলটির যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নেচে নেচে বাজাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচে বয়স্ক মানুষটির হাতে করতাল। সে রীতিমত লাফাচ্ছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না তারা এই জীবনে বাজনা থামাবে।

আমি এই জীবনে অনেক মধুর সংগীত শুনেছি। কর্নেগী হলে শুনেছি পৃথিবী-শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞের কনসার্ট–মোজার্টের ফিফথ সিম্পোনী। লাসভেগাসে লেবোরেটরীর পিয়ানো শুনেছি বিথোভেন–কিন্তু সেদিনের কিছু অখ্যাত গ্রাম্য বাজনাদারদের বাজনার মত মধুর সংগীত এখনো শুনি নি–আর যে শুনব সে আশাও কম।
 
পশু-প্রেমিক



আমার এক বন্ধু আছেন–পশু-প্রেমিক। রাস্তায় কুকুর কাঁদছে কুঁ-কুঁ করে, তিনি হয়ত যাচ্ছেন রিকশায়; রিকশা থামিয়ে ছুটে যাবেন। চোখ কপালে তুলে বলবেন, হল কি তোর? এই আয়, তু তু তু। তাঁর পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা বিড়ালের গায়ে গরম মাড় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি সেই বিড়াল নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গেলেন। ইন্টার্নী ডাক্তার বললেন, এখানে কেন এনেছেন? পশু হাসপাতালে নিয়ে যান।

তিনি বললেন, পশু হাসপাতাল কোথায় আমি চিনি না। প্লীজ ফার্স্ট এইড দিন, আমি পরে পশু হাসপাতাল খুঁজে বের করব।

ডাক্তার ফার্স্ট এইড দিতে রাজি নন।

আমার বন্ধু ফার্স্ট এইড না নিয়ে যাবেন না। চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈচৈ। চারদিকে লোক জমে গেল। আমার বন্ধু শার্টের হাতা গুটিয়ে ডাক্তারকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি অবস্থা।

মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি আমার এই বন্ধু চরম উদাসীন। একবার এক পকেটমার ধরা পড়েছে। কিল-ঘুসি-লাথি মেরে তার অবস্থা এমন যে এখন যায় তখন যায় অবস্থা। সে ক্ষীণ স্বরে বলছে–আমারে একটু পানি দেন। এক ফোঁটা পানি।

আমার বন্ধু কঠিন গলায় বললেন, হারামজাদার মুখে কেউ প্রস্রাব করে দিন তো।

তার বাসায় ভিক্ষা চাইতে এসে ভিখিরি প্রচণ্ড লাথি খেয়েছিল। তার ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল। এটা জানার পর তিনি মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। আধ ঘণ্টা পর মেয়ে যখন কাঁদতে কাঁদতে বের হল তখন দেখা গেল তার মাথার সব চুল কেটে ফেলা হয়েছে। অল্প কিছু চুল কোট ব্রাশের মত খাড়া হয়ে আছে। আমার এই বন্ধুর ভালবাসা পশু সমাজের জন্য।

আমি আমার বন্ধুর মত নই। কুকুরের প্রভুভক্তির অসংখ্য গল্প জানা থাকা সত্ত্বেও কুকুর দেখলে ভয় ছাড়া অন্য কোন মানবিক আবেগ আমি বোধ করি না। বিড়াল প্রাণী হিসেবে খুব সুন্দর। সেই বিড়ালকে একবার দেখলাম রক্তাক্ত ইঁদুর মুখে নিয়ে ঘুরছে। বিড়ালের ধবধবে শাদা মুখে লাল রক্তের ধারা। আমি সেই থেকে বিড়াল পছন্দ করি না।

আমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে বিড়ালের কোন মাথাব্যথা থাকার কথা না। তারা যখন-তখন আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় আসে। খাবার টেবিল থেকে মাছ নিয়ে পালিয়ে যায়। আদর্শ বিড়ালের মত মাছের কাটায় তারা সন্তুষ্ট নয়। আমি বিড়াল দেখলেই দূর-দূর করি। ওরা নানান ভাবে আমার সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করে। হয়ত বই পড়ছি–চুপি চুপি এসে পায়ের সঙ্গে গা ঘসে গেল। লাথি মারবার আগেই পালিয়ে গেল।

স্ত্রীরা স্বামীদের অধিকাংশ অভ্যাস গ্রহণ করে ফেলে (যদিও তারা কখনো তা স্বীকার করে না)। গুলতেকিনও সেই ফমূলায় বিড়াল অপছন্দ করে। আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিড়ালের জন্য এই বাড়ি মোটামুটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এরা তবু আশা ছাড়ে না। মাঝে-মধ্যে আসে। দুঃখিত চোখে আমাদের দেখে চলে যায়।

এক রাতের ঘটনা। বসে বসে লিখছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়ায় শীত শীত লাগছে। আমি গুলতেকিনকে বললাম একটা চাদর দিতে। সে চাদরের জন্যে কাবার্ড খুলে চেঁচিয়ে উঠল। এক অতি রুগণ বিড়াল কাবার্ডের ভেতর বাচ্চা দিয়ে বসে আছে। এতটুকু টুকুন চার বাচ্চা কুঁ কুঁ শব্দ করছে। কাবার্ডের সমস্ত কাপড় নোংরা। বিশ্রী অবস্থা!

গুলতেকিন বলল, এখন কি করব? আমি বললাম, রাতটা কাটুক। ভোরে ফেলে দেয়া যাবে। খুব পাষাণহৃদয় মানুষের পক্ষেও বাচ্চাসহ একটা বিড়াল ফেলে দেয়া কঠিন। আমাদের এই অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হল না।

আমার ছোট মেয়ের বান্ধবী পাশের ফ্ল্যাটের জেনিফার ভোর বেলাতেই একটা জুতার বাক্স নিয়ে উপস্থিত। সে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, চাচা, আমাদের বিড়ালটা না-কি আপনাদের বাসায় বাচ্চা দিয়েছে?

একটা বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে জানি। তোমাদের বিড়াল কি-না তাতো জানি না। তোমাদের বিড়াল চেনার উপায় কি?

ওর নাম লুসিয়া।

নামে তো মা ঠিক চিনতে পারছি না।

ওর খুব স্লীম ফিগার।

স্লীম ফিগার হলে তোমাদেরই বিড়াল। তুমি পরীক্ষা করে দেখ। কাবার্ডের ভেতর আছে।

কাবার্ড খোলা হল। লুসিয়াকে পাওয়া গেল না। বাচ্চা চারটা আছে। এখনো চোখ ফুটে নি।

জেনিফার বলল, চাচা, আমি এদের আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।

আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই নিয়ে যাবে মা, অবশ্যই নিয়ে যাবে। তোমাদের বিড়াল অন্যের বাসায় বাচ্চা মানুষ করবে এটা কোন কাজের কথা না। সম্মান হানি হবার মত কথা।

জেনিফার জুতার বাক্সে বিড়ালের বাচ্চা তুলে নিয়ে গেল। আমি নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, বাঁচা গেল।

সে রাতের ঘটনা। বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি। অনেক খাতা জমে আছে। প্রতিজ্ঞা করে বসেছি ত্রিশটা খাতা না দেখে ঘুমুতে যাব না। খাতাগুলি দেখতে খুব সময় লাগছে। রাত একটার মত বেজে গেল। পুরো বাড়ি ঘুমে অচেতন। আমি জেগে আছি। ফ্লাক্স ভর্তি চা আমার সামনে রেখে দেয়া।

হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে লুসিয়া লাফিয়ে আমার টেবিলে উঠে এল। আমার দিকে তাকিয়ে রাগী ভঙ্গিতে ম্যাঁ ম্যাঁ করে কিসব বলল। বিড়ালের ভাষা আমার বোঝার কোনই কারণ নেই। তবু তার ভঙ্গি, তার চিৎকার শুনে মনে হল, সে বলতে চাচ্ছে–আমি আমার অবোধ শিশুগুলিকে তোমাদের ঘরে রেখে খাবারের সন্ধানে গিয়েছিলাম। তোমরা এদের সরিয়ে দিয়েছ। যে কাজটা করেছ, তা অন্যায়। আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দাবী করছি। তোমাকে জবাবদিহি করতেই হবে।

আমার কি যে হল–বিড়ালকে বললাম, যা, তুই তোর বাচ্চাগুলিকে নিয়ে আয়। আমি আর কিছু বলব না। বিড়াল খানিকক্ষণ চুপ থেকে নরম স্বরে বলল,

ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও (সত্যি কি আনতে বলছেন?)

হ্যাঁ।

ম্যায়াও মি ম্যায়াও (আনলে তাড়িয়ে দেবেন না তো?)

না।

বিড়াল নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বাচ্চা মুখে নিয়ে টেবিলের উপর লাফিয়ে উঠল। সে যে আমার কথা বুঝে এই কাণ্ড করেছে এটা মনে করার কোনই কারণ নেই। তবু আমার কেন জানি মনে হল বিড়াল বাচ্চাটা মুখে করে এনে লাফিয়ে আমার টেবিলে উঠেছে একটি কারণে। আমার চূড়ান্ত অনুমতি চাচ্ছে।

ম্যাঁও ম্যাঁও। (কি, রাখব আমার সোনামণিদের?]

হ্যাঁ, রাখ।

ম্যাঁয়াও ম্যাঁয়াও [তোমার স্ত্রী আবার আপত্তি করবে না তো?]

না। তাকে আমি বুঝিয়ে বলব।

ম্যাঁয়াও ধন্যবাদ স্যার।]

বিড়াল বাচ্চা নিয়ে কাবার্ডের ভেতর ঢুকে গেল। অন্য বাচ্চাগুলিকেও একে একে নিয়ে এল। আমি তাকে বললাম, একটা শর্ত মনে রাখবে। এরা একটু বড় হলেই তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে। আমি বিড়াল পছন্দ করি না।

ম্যাঁয়াও (আচ্ছা।)।

ভোরবেলা আমি গুলতেকিনকে ঘটনাটা বললাম। তার ধারণা হল পুরো ব্যাপারটি আমার বানানো। ধারণা করাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার সতুর ভাগই থাকে বানানো। আমি খুব গুছিয়ে সত্যের মত করে মিথ্যা বলতে পারি।

আমি গুলতেকিনকে বললাম, বিড়ালটা কথা দিয়েছে তার বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।

তোমাকে সে কথা দিয়েছে?

হ্যাঁ। মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না কিন্তু পশুরা একবার কথা দিলে কথা রাখে।

তুমি তো মনে হচ্ছে অবতারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছ। পশুদের ভাষা বুঝতে পার।

তোমার সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি–বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।

বেশ যাও, হাজার টাকা বাজি।

গুলতেকিন বিড়ালটার জন্য দৈনিক এক পোয়া দুধ বরাদ্দ করে দিল। উচ্ছিষ্ট মাছ মাংস তাকে প্লেটে করে দেয়া হতে লাগল। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। যে রাজকীয় হালে তাকে রাখা হচ্ছে সে তো আর এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না। আমাকে বাজিতে হারতে হবে

কিম আশ্চর্যম! বাচ্চা চারটি একটু বড় হতেই বিড়াল এদের নিয়ে চলে গেল।

আমি অবশ্যি বাজির টাকা পেলাম না। কারণ গুলতেকিন তখন যুক্তি দেখাল, তোমাকে কথা দিয়েছে বলে তো আর সে যায় নি। বাচ্চারা বড় হয়েছে–পৃথিবীতে বাস করার ট্রেনিং দেবার জন্যে সে এদের নিয়ে চলে গেছে। তার কথা যে সত্যি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এর পর মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। আশেপাশের যত বিড়াল আছে তারা গর্ভবতী হলেই আমাদের বাসায় চলে আসে। বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলি একটু বড় হলে এদের নিয়ে চলে যায়। কালো বিড়াল, ধলা বিড়াল, হলুদ বিড়াল। এর মধ্যে একটা ছিল ডাকাতের মত দেখতে।

আমার ধারণা লুসিয়া সমস্ত বিড়াল সমাজের কাছে প্রচার করেছে–হুমায়ূন স্যারের বাসা মেটারনিটি ক্লিনিক হিসেবে অতি উত্তম। এরা যত্ন-আত্তি করে। দুধ খেতে দেয়। শুধু একটা শর্ত, বাচ্চারা বড় হলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।

আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। একবার তিনটা বিড়াল এক সঙ্গে বাচ্চা দিল। বাচ্চা দিয়েই এরা চুপ করে থাকে না। প্রতিদিন বাচ্চাগুলিকে জায়গা বদল করায়। এই দেখলাম খাটের নিচে, খানিকক্ষণ পরই ট্রংকের কোণায়। ক্ষিধে পেলে এরা গুলতেকিনের শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে টেনে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আমি পশু-প্রেমিক নই বলেই একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। দেড় হাজার টাকায় নেট কিনে মিস্ত্রি লাগিয়ে দরজা-জানালা, ফাঁক-ফোকর সব নেট দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘ ছ বছর পর প্রথম বিড়াল মুক্ত দিবস পালন করলাম।

আমার নিয়ম হচ্ছে গভীর রাতে যখন হলের ছেলেরা বেশির ভাগ ঘুমিয়ে পড়ে তখন গুলতেকিনকে নিয়ে হলের সামনের মাঠে হাঁটাহাঁটি করা। সে রাতেও তাকে নিয়ে বের হয়েছি। চাদনি পহর রাত। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে অপূর্ব লাগছে। সাধারণত হাঁটাহাঁটির সময় আমি প্রচুর বকবক করি। সে রাতে কেন জানি চুপ করে আছি–গুলতেকিন বলল, তুমি চুপ করে আছ কেন? ঘর নেট দিয়ে বন্ধ করে দেয়ায় তোমার কি মন খারাপ লাগছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, লাগছে।

নেট খুলে দিতে চাও?

না।

না কেন?

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি পশু-প্রেমিক নই গুলতেকিন। সামান্য মন খারাপকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না।

মন খারাপটা অবশ্য খুব সামান্য ছিল না। সে রাতে কিছুতেই আমার ঘুম এল না।

রাত তিনটা পর্যন্ত চুপচাপ জেগে রইলাম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ঘুম এল ফজরের আজানের পর। ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। বিছানা থেকে নেমে দেখি সব নেট খুলে ফেলা হয়েছে। কে খুলল, কার নির্দেশে খুলে ফেলা হল কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। আমি এবং গুলতেকিন দুজনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন এই প্রসঙ্গ আলোচনার যোগ্য কোন প্রসঙ্গ না। রাতে টিভি দেখছি। আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আব্বু গেস্ট রুমে আরেকটা বিড়াল এসে বাচ্চা দিয়েছে। এইবারের বাচ্চাগুলি কালো রঙের। কুচকুচে কালো।

আমি মহা বিরক্ত হয়ে বললাম, এ তো বড় যন্ত্রণা হল! এরা পেয়েছেটা কি? অসহ্য। এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি গুলতেকিন জানালা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছে।

———– * আমাদের এই বিড়াল পরিবার নিয়ে আমি বিপদ নামে একটি উপন্যাস লিখেছি। উদ্ভট জাতীয় গল্প যারা ভালবাসেন তারা অন্যের কাছ থেকে বই ধার করে পড়ে দেখতে পারেন।
 
আত্মকাহিনীমূলক রচনা



আজকালকার ছেলেমেয়েরা আত্মকাহিনীমূলক রচনা শেখে কি-না জানি না তবে আমাদের সময় এ জাতীয় রচনা প্রচুর শিখতে হত। নদীর আত্মকাহিনী, একটি বটগাছের আত্মকাহিনী, চোরের আত্মকাহিনী ইত্যাদি। একের ভেতর তিন নামক একটি গ্রন্থ থেকে আমি বেশ কয়েকটি আত্মকাহিনী মুখস্থ করে ফেলি। এর মধ্যে একটি চোরের আত্মকাহিনীটি খুব করুণ করে লেখা। চোর বলছে, সবাই তাকে মারছে। লোকজন ভিড় করে আছে। সে হঠাৎ শুনল একটি বাচ্চা মেয়ে বলছে, বাবা আমি চোর দেখব। তাকে চোর দেখানো হল। মেয়েটি বলল, আরে এ চোর কোথায়? এ তো মানুষ! এই শুনে চোর আত্মগ্লানিতে জরজর।

এই রচনার মোর্যাল হচ্ছে–চোরও মানুষ। অন্য দশজনের থেকে আলাদা কিছু নয়। এই তথ্য জানার পরও চোর শুনলেই আমাদের গলা বাড়িয়ে দেখার আগ্রহ হয়। আমরা কি দেখতে চাই? আগ্রহের কারণটা কি? আমরা কি দেখতে চাই–লোকটা কোন-না-কোন ভাবে একটু আলাদা কি-না?

বরিশাল থেকে স্টীমারে ঢাকা আসছি। হঠাৎ শুনলাম এই স্টীমারে করেই একজন ভয়ংকর খুনীকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভয়ংকর খুনী দেখতে একজন ভাল মানুষের চেয়ে খুব একটা আলাদা হবে না জেনেও দেখতে গেলাম। ২১/২২ বছরের একটি যুবক। তিনজন পুলিশ তাকে ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে। যুবকটির কোমরে দড়ি বাঁধা, লুঙ্গি পরা, সবুজ রঙের শার্ট। হাসিমুখে চা খাচ্ছে।

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে যুবকটিকে দেখছি। কোন রকম অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে আছে কি-না তা ধরার চেষ্টা। সে শব্দ করে হাসছে। পা নাচাচ্ছে। পুলিশ তিনজনের সঙ্গে রসিকতা করছে–তার চরিত্রে বা চেহারায় কোন রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম না। এই মানুষটা চারটা খুন কিভাবে করল সেও এক রহস্য। খুন করতে মানসিক শক্তি যেমন প্রয়োজন শারীরিক শক্তিও প্রয়োজন। এই যুবকটি নিতান্তই দুবলা পাতলা।

সে এখন সিগারেট ধরিয়ে টানছে। পুলিশ তিনজন তার সঙ্গে সিগারেট টানছে। সে হাসিমুখে বলল, ওস্তাদজী একটু হাঁটব। পায়ে ঝিঝি ধরছে। পুলিশ কোনরকম আপত্তি করল না। একজন তার কোমরের দড়ি ধরে পেছনে পেছনে যাচ্ছে। অন্য দুজন বসে আছে উদাসদৃষ্টিতে।

পুলিশ তিনজনের সঙ্গে যুবকটির মনে হচ্ছে বেশ সুসম্পর্ক। সে যা বলছে, পুলিশ তাই করছে।

আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত যুবকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছি। সে কোথাও বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছে না। সারা স্টীমার ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে বলল, ওস্তাদজী সিগারেট।

বসে-থাকা পুলিশ তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট দিল, এবং নিজেই ধরিয়ে দিল। চমৎকৃত হবার মত দৃশ্য। পরে বুঝলাম, এই দামী সিগারেট যুবকটিরই কেনা। পুলিশ তার সিগারেটের জিম্মাদার।

আমি যুবকটির চোখ দেখতে চাচ্ছি। সরাসরি তাকাতে চাচ্ছি তার চোখের দিকে। একজন মানুষের ভেতরটা নাকি চোখের মাধ্যমেই দেখা যায়। একটা মানুষ ভাল কি মন্দ, সৎ-অসৎ, তা নাকি তার চোখ বলে দেয়। কিও যুবকটির চোখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তার দৃষ্টি কোথাও স্থির হয়ে পড়ছে না। এক সময় সে তাকাল আমার দিকে। আমার মনে হল তার চোখে অন্য এক ধরনের আলো। সাপের দৃষ্টির মত দৃষ্টি। পরক্ষণেই এই ধারণা মন থেকে মুছে ফেললাম। লোকটি খুনী, আগেভাগে তা জানি বলেই আমি তার চোখের দৃষ্টি সাপের দৃষ্টি বলে ভাবছি। সাপের দৃষ্টি কেমন তাও তো জানি না। সাপের চোখের দিকে তো আমি কখনো তাকাই নি।

খুনীদের সম্পর্কে আমার খানিকটা কৌতূহল আছে। এই কৌতূহলের কারণ হল, খুব ছোটবেলায় আমাদের বাসায় একজন জ্যোতিষী এসেছিলেন। তিনি আমার সব ভাইবোনের হাত দেখে অনেক ভাল ভাল কথা বললেন। আমার হাত দেখে বললেন, এই ছেলে তিনটি বিবাহ করবে। আমার মার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি অবশ্যি যথেষ্ট পুলক অনুভব করলাম। অতঃপর জ্যোতিষী বললেন, চন্দ্রের ক্ষেত্রে যব চিহ্ন–এই ছেলে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারবে। আমার মা নিশ্চিত হলেন যে জ্যোতিষী কিছুই জানে না। সে যদি বলতো। আমি দেশের রাজা হব। মা ধরে নিতেন ঐ জ্যোতিষী খুবই বড় জ্যোতিষী। শৈশবে জ্যোতিষীর কথা আমাকে খানিকটা হলেও পীড়িত করেছে। আমি মানুষ খুন করব–এই ধারণা আমার কাছে খুব রুচিকর মনে হয় নি। এক সময় নিজেই এ জাতীয় আদিভৌতিক বইপত্র পড়তে শুরু করলাম। আমার উৎসাহ ছিল খুনীদের লক্ষণ বিচারে। একটা বই-এ দেখলাম, খুনীদে, বৃদ্ধাঙ্গুল হবে

খাটো এবং মোটা। এর পর থেকে কারো সঙ্গে দেখা হলেই তার বুড়ো আঙ্গুলের দিকে তাকাতাম। কারো আঙ্গুল একটু মোটা দেখলেই মনে মনে ভাবতাম, পাওয়া গেছে। এইবার ধরেছি। ব্যাটা খুনী।

লক্ষণ বিচারে মারাত্মক খুনী যাকে পাওয়া গেল সে আমাদের বাসায় কাঠের কাজ করতে এসেছিল। মানুষটা এতই মধুর স্বভাবের যে তাকে খুনী ভাবতেও খারাপ লাগে। উপায় নেই। খুনী তো বটেই। এই মোটা বুড়ো আঙ্গুল।

মেট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাস সময় পাওয়া যায়। এই তিন মাস রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই–আমি তিন মাস নষ্ট করলাম জ্যোতিষী এবং এস্ট্রনমির বই পড়ে পড়ে। বাসায় এ-জাতীয় বই-এর কোন অভাব ছিল না। এক সময় হাত দেখাও শুরু হল–হাত দেখা, সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনা করা। দ্বিতীয়টি বেশ কঠিন। কিছুদিন চেষ্টা করে বাদ দিয়ে দিলাম। হাত দেখা বজায় রইল। অল্পদিনেই বুঝে গেলাম–বড় পামিস্ট হিসেবে নাম করা অত্যন্ত সহজ কাজ। হাত দেখাতে যে আসে সে নিজের সম্পর্কে কিছু কিছু জিনিস শুনতে চায়। কি শুনতে চায় তা নিজের অজান্তেই প্রকাশ করে ফেলে। যে সব জিনিস শুনতে চায় সে সব শুনিয়ে দিলেই সে পামিস্ট সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

মহসিন হলে থাকাকালীন সময়ে আমার হাত দেখা বিদ্যার (!!) পূর্ণ বিকাশ ঘটল। দূর-দূর থেকে অচেনা মানুষজনও আসতেন এবং বিনীত গলায় বলতেন, আপনার নাম শুনে এসেছি–একটু যদি কাইন্ডলি। এঁদের কঠিন মুখে ফিরিয়ে দিতাম। তাই নিয়ম। কয়েকবার ফিরিয়ে দিতে হবে। তারপরেও আসবে তখন একদিন হাত দেখা হবে। যে সব কথা ভদ্রলোক শুনতে চাচ্ছেন তার সবই আমি তাকে শুনিয়ে দেই এবং অভিভূত করে বিদায় দেই, কাজটা খুব কঠিন না। নমুনা দিচ্ছি–

আমি : আপনাকে সবাই ভুল বুঝে। আপনি আসলে কি কেউ জানে না।

ভদ্রলোক : ঠিক বলেছেন। সবাই ভুল বুঝে (উদাস হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে খুশি। সব মানুষই চায়–তার মধ্যে রহস্য থাকুক।]

আমি : সবচে বেশি ভুল বুঝে আপনার অতি প্রিয়জনরা।

ভদ্রলোক : খুব কারেক্ট অবজারভেশন। [আরো উদাস, এবং দুঃখি। তবে এই দুঃখে কিছুটা আনন্দ মেশানো।]

আমি : আপনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত উদার যদিও ভাব করেন যে আপনি উদার নন।

ভদ্রলোক : এটা ভাই আপনি দারুণ সত্যি কথা বললেন। ভেতরের কথা বলে ফেলেছেন।

[দারুণ খুশি, সবাই চায় নিজেকে উদার ভাবতে।]

আমি ও মানুষের প্রতি আপনার মমতা অপরিসীম। শুধু মানুষ না পশু পাখি এদের প্রতিও আপনার অসীম মমতা।

ভদ্রলোক : এটা যখন বললেনই তখন আপনাকে একটা গল্প বলি। বৎসর খানিক আগের কথা। নিউ মাকের্টে গিয়েছি…

[lম্বা গল্প ফেঁদে বসলেন যেখানে পশুপ্রেমের ব্যাপার আছে।]

আমি : আপনার ভেতর অনুশোচনার ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রবল। কোন একটা অন্যায় করবার পর তীব্র অনুশোচনায় আপনি আক্রান্ত হন। এমনও হয়েছে যে অতি সামান্য অন্যায় কিন্তু সারারাত আপনার ঘুম হল না।

ভদ্রলোক : [ অভিভূত। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ধরা গলায় বললেন–] আমার ফ্যামিলি লাইফ সম্পর্কে বলুন।

বলার ভঙ্গি থেকে ধরতে হবে লোকটি পারিবারিক জীবনে সুখী কি সুখী নয়। শতকরা আশি ভাগ সম্ভাবনা–অসুখী। সুখী মানুষ জ্যোতিষী খুঁজে বেড়ায় না। অসুখী হলে অসুখের কারণটা অর্থনৈতিক কি-না তা লোকটির কাপড়-চোপড় দেখে ধরতে হবে। যদি দেখা যায় কারণ অর্থনৈতিক নয় তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা অন্য জায়গায়।

আমি : ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার হাত দেখে মনে হচ্ছে। পারিবারিক জীবনে আপনি অত্যন্ত অসুখী, যদিও বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। কেন অসুখী তাও আপনার হাতে আছে। বেশ পরিষ্কার ভাবেই আছে, কিন্তু স্যরি। আমি বলতে চাচ্ছি না। এই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। দয়া করে আমাকে জোর করবেন না।

আমাকে তখন আর কিছু বলতে হয় না। ভদ্রলোক নিজেই তখন হড়বড় করে তার জীবন ইতিহাস বলতে থাকেন। এই ব্যাপার আমি একবার না, অসংখ্যবার লক্ষ্য করেছি। মানুষগুলি জেনেশুনে প্রতারিত হবার জন্যে আসে। প্রতারিত হয় এবং হাসিমুখে ফিরে যায়। তার জন্যে আমি তেমন কোন গ্ৰানিবোধ করি না। তার প্রধান কারণ, এর মধ্যে কোন অর্থ জড়িত নয়। হাত দেখার জন্যে আমি কোন টাকা নেই না। এতটা নামা আমার পক্ষে সম্ভব না। দ্বিতীয় কারণ, পুরো ব্যাপারটায় আমি খুব মজা পাই। মানব চরিত্রের বিচিত্র সব দিক ধরা পড়ে।

অনেকেই হয়ত বলবেন–আপনি হাত দেখতে জানেন না বলেই আজেবাজে কথা বলে মানুষকে ধোকা দেন। যারা জানে তারা দেয় না। হাতে যা আছে তাই বলে। তাঁদের জন্যে আমার একটা গল্প আছে–বছর ছয়েক আগের কথা। সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার অফিসে গিয়েছি। গল্প করছি। রোববার পত্রিকার সম্পাদক কবি রফিক আজাদের সঙ্গে। তখন বাংলাদেশের একজন নামী হস্তরেখাবিশারদ পত্রিকা অফিসে ঢুকলেন। তাঁর নাম করছি না। তাতে তাঁর রমরমা ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে।

রফিক আজাদ আমাকে দেখিয়ে বললেন, উনার হাতটা দেখুন তো।।

হস্তরেখাবিশারদ আমাকে চিনলেন না। চেনার কথাও না। তখন পত্র পত্রিকায় আমার কোন ছবি ছাপা হত না। তিনি গভীর মনোযোগে হাত দেখলেন–এবং বললেন,

আপনি লেখালেখি করেন।

সবাই চমৎকৃত হল। আমি হলাম না। পত্রিকার অফিসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। সঙ্গত কারণেই ধরে নেয়া যায় আমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। আমি তাঁকে কনফিউজ করবার জন্যে খুব শংকিত গলায় বললাম–আমার পড়াশোনা কতদূর হবে একটু দেখুন।

হস্তরেখাবিশারদ আমার টোপ গিললেন এবং আমার করুণভাবে বলার ভঙ্গি থেকে ধরে নিলেন–পড়াশোনার অবস্থা শোচনীয়।

আপনার রবির ক্ষেত্র বেশ দুর্বল। তাছাড়া বৃহস্পতির ক্ষেত্রও তেমন ডেভেলপড নয়। ব্রেক অব স্টাডি আছে।

তখন আমি সদ্য পি-এইচ.ডি করে দেশে ফিরেছি। কিন্তু এমন ভাব করলাম যেন তাঁর কথায় অভিভূত হয়ে গেছি। আমার আশেপাশে যারা ছিল তারা আমার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। আমি গলার স্বর আরো করুণ করে বললাম,

পড়াশোনা বাদ দিন। যা হবার হয়েছে। এর বেশি কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। চাকরি-বাকরি দেখুন।

ভদ্রলোক আবার আমার টোপ গিললেন এবং বললেন–এখন চাকরির কোন যোগ দেখছি না। তবে বছর দুএকের মাথায় বড় ধরনের একটা সুযোগ আছে। সেই সুযোগ গ্রহণ করলে ভাল হবে।

তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি। আমি ভদ্রলোকের কথায় এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগলাম যে তিনি চলে এলেন পুরো আমার হাতের মুঠোয়! আমি বললাম, আমার খুব দেশ-বিদেশ দেখার শখ। দেখুন না বিদেশযাত্রা আছে কি-না।

শেষ বয়সে সম্ভাবনা আছে।

এই হচ্ছে পামিস্ট্রি। এই হচ্ছে দেশবিখ্যাত (!!!) হস্তরেখাবিশারদের নমুনা। বিজ্ঞান সম্বন্ধে পড়াশোনা জানা মানুষদেরও আমি দেখেছি এই সব ব্যাপারে অটল ভক্তি। কেউ কেউ পামিস্ট্রি বিশ্বাস করেন না কিন্তু এস্ট্রনমি বিশ্বাস করেন। তাঁদের ধারণা এস্ট্রনমি নাকি সায়েন্স! বৃশ্চিক রাশির সব জাতকের স্বভাব চরিত্র না-কি এক রকম হবে। আমি এবং আমার দুই ভাইবোন বৃশ্চিক রাশির। আমাদের কারোর সঙ্গে কারো স্বভাবের কোন মিল নেই। তার চেয়েও বড় কথা, এইসব রাশির ব্যাপারগুলি হাজার বছর আগের আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখে ঠিক করা। হাজার বছরে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। আজ যদি কষ্টি তৈরি করা হয় এবং কষ্ঠি বিচার করে লেখা হয়–

জাতক জন্মলগ্নে বৃশ্চিক রাশি

তখন উচ্চস্বরে হাসা ছাড়া পথ নেই। হাজার বছর আগে জন্মালে এই জাতক বৃশ্চিক রাশি হত। আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলি যোগ করলে বৃশ্চিকের মত হয়ত দেখাতো। আজ দেখাবে না। নক্ষত্ররা সরে গেছে।

বাংলাদেশে হস্তরেখাবিশারদের মত অনেক এস্ট্রলজারও আছেন। তাদের সমিতি-টমিতি আছে। তাঁরা মহা সম্মেলন করেন। গ্রহ-নক্ষত্র বিচারে দেশের ভবিষ্যৎ কি তা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দেন। পত্রিকাওয়ালারা সেই সব বিবৃতি খুব আগ্রহ করে ছাপেন। বিস্মিত হয়ে ভাবি, কোন যুগে বাস করছি? জাদুটোনার যুগে না চন্দ্র জয়ের যুগে?

এস্ট্রলজারদের মহা সম্মেলনে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটি আমি আগেও এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আবারো করছি। যে মহা সম্মেলনটির কথা বলছি সেই মহা সম্মেলনে এরশাদ সাহেবের এক মন্ত্রী ছিলেন প্রধান অতিথি। তিনি তাঁর বক্তৃতায়–মহা সম্মেলনের সাফল্য কামনা করলেন। এস্ট্রলজাররা গ্রহ-নক্ষত্র গুণে দেশ ও জাতির জন্যে যে মঙ্গল করে যাচ্ছেন তার ভূয়সি প্রশংসা করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে এস্ট্রলজির একটি বিভাগ খোলা উচিত সেই সম্পর্কেও বললেন। ঘন ঘন হাততালি পড়তে লাগল।

তখন তিনি একটি মোক্ষম কথা বললেন। তিনি বললেন, এস্ট্রলজারদের জন্যে তিনি একটি মানমন্দির স্থাপনের ব্যবস্থা করবেন।

এস্ট্রলজাররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এ কি সমস্যায় পড়া গেল! মানমন্দির দিয়ে তাঁরা কি করবেন? কোন্ গ্রহ ভাল কোন্ গ্রহ মন্দ এটা তো মানমন্দির দিয়ে বোঝা যাবে না। মানমন্দির হচ্ছে এস্ট্রানমারদের জন্যে, এস্ট্রো

ফিজিসিস্টদের জন্যে। তাঁদের প্রয়োজন হাজার বছরের পুরানো পুঁথি–এবং একদল বোকা পাঁঠা জনগুষ্ঠী।

ভাল কথা, শৈশবে যে জ্যোতিষী আমার হাত দেখে বলেছিলেন আমি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারব, তাঁর গণনা কিন্তু এক অর্থে মিলে গেছে। এইসব দিনরাত্রি নামক ধারাবাহিক নাটকে আমি টুনীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছি। শুধু টুনী না–আমার উপন্যাসের অনেক চরিত্রকেও অকালে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। আমি কি করব? আমার হাতে লেখা।
 
রাত একটার পর



রাত একটার পর আমি সাধারণত ঘড়ির দিকে তাকাই না। ঘড়ির দিকে তাকালেই এক ধরনের অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। ঘুমুতে যাওয়া উচিত–যাচ্ছি না। দুষ্ট ছেলের মত জেগে আছি। একে একে ঘরের সব বাতি নিভে যাচ্ছে। রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে কাজের মেয়েটি ঘুমুতে গেল। চারদিক চুপচাপ। এর আগের রাতও জেগে কাটিয়েছি। আরো কয়েক রাত এমন করে কাটলে পুরোপুরি অনিদ্রায় ধরবে। শরীরের নিজস্ব ঘড়ি যাবে উল্টে। দিনে ঘুমুব, রাতে জেগে থাকব।

গত রাত জেগে কাটিয়েছি বিশেষ কারণে। মন বিক্ষিপ্ত ছিল। তুচ্ছ কারণে মন বিগড়ে গেল। অতি তুচ্ছ বিষয় যা তৎক্ষণাৎ মন থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত ছিল, অথচ ঝাড়তে পারি না। বড় বড় ব্যাপারগুলি সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায় কিন্তু তুচ্ছ ব্যাপারগুলি চোরকাঁটার মত। কিছুতেই তাড়ানো যায় না। ঘটনাটা বলি–ছোট্ট একটা ইলেকট্রিক্যাল পার্টস কিনতে গিয়েছি। একটা মাল্টি প্ল্যাগ টিভির পেছনে লাগানো থাকবে। একসঙ্গে এন্টেনা এবং ভিসিআর-এর ইনপুট আসবে। দোকানে ঢোকামাত্র দোকানি আনন্দে হেসে ফেলে বলল, আরে আপনি! কি সৌভাগ্য!

আমি বললাম, আপনি কি আমাকে চেনেন?

দোকানি চোখ কপালে তুলে বলল, আপনাকে চিনব না? আপনার বন্ত্রীহি

আমি যথেষ্টই আনন্দিত হলাম। জিনিসটা কিনলাম। দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানি বলল, পৃথিবীর সব মানুষের কাছ থেকে লাভ করা যায়, আপনার কাছ থেকে করা যায় না। আপনার সঙ্গে ব্যবসা করলে অধর্ম হয়। আমি যে দামে কিনেছি সেই দাম দিন। একটা পাই পয়সা বেশি রাখব না। একশ চল্লিশ টাকা।

আমি একশ চল্লিশ টাকা দিলাম।

স্যার চা খান।

না, চা খাব না।

আপনি আমার দোকান থেকে চা না খেয়ে যাবেন, তা তো হয় না।

চা এল। আমি চা খেয়ে খুশি মনে রওনা হলাম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। যে সবাইকে বিশ্বাস করে সে কখনো ঠকে না।

আমার কি যে হল–অবিশ্বাসের সামান্য কণা মনে জন্মাল। অন্য একটা দোকানে এই জিনিসটির দাম জানতে চাইলাম। তারা বলল, একশ টাকা। আরো একটা দোকানে গেলাম। তারাও বলল, একশ। আমি হতভম্ব। তখন মনে হল–লোকটাকে অবিশ্বাস করেছি বলে ঠকেছি। অন্য কোথাও দাম জিজ্ঞে: না করলে তো কৈতাম না। চল্লিশ টাকা এমন বড় কিছু নয়।

একবার ভাবলাম, প্রথম দোকানে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি–ভাই, এই কাজটা আপনি কেন করলেন? সামান্য চল্লিশটা টাকার জন্যে করলেন, নাকি আমাকে বোকা বানানোর জন্যে করলেন?

আমি লোকটির কাছে গেলাম না। প্রচণ্ড রাগ বুকে পুষে ঘরে ফিরে এলাম। রাতে বিছানায় ঘুমুতে গিয়ে মনে হল, ঐ লোক তার স্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয় হাসতে হাসতে গল্প করছে–আজ আমাদের দোকানে এসেছিল এক বোকা লেখক। ব্যাটাকে মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছি। হা-হা-হা।

যে মানুষ ঈশ্বরের অংশ তার ভেতর এত ক্ষুদ্রতা কেন? আমি আরো অনেকের মত মানুষকে নিখুঁত প্রাণী হিসেবে ভাবতে ভালবাসি। যদিও খুব ভাল করেই জানি আমার ভেতর অসংখ্য খুঁত আছে। রাগ, লোভ, ঘৃণা, অহংকার সব শুধু যে আছে তাই না–অনেক বেশি পরিমাণে আছে, তবু কেন অন্যের ভেতর এইসব দেখলে এত কষ্ট পাই?

লেখালেখির সময়ও একই ব্যাপার–যে সব চরিত্র তৈরি করি তাদের মানবিক গুণই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের চরিত্রের অন্ধকার অংশের কথা ভাবতে বা লিখতে ভাল লাগে না। লিখতে গেলে মনের উপর চাপ পড়ে।

মানুষকে বড় করে দেখার এই প্রবণতা কি দোষণীয়?

যে যেমন তাকে ঠিক তেমন করেই কি দেখা উচিত নয়? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় মানব চরিত্রে এমন সব বড় দিক আছে যার স্পর্শে তার যাবতীয় দোষ, যাবতীয় ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়।

প্রাণী হিসেবে মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, সে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন করবে না। সে তার জীবনের মূল্য জানে। এই জীবনকে সে রক্ষা করবে। অথচ কি মজার ব্যাপার, অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকাণ্ড সব বোকামি করে। দাউদাউ করে একটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বাড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট একটা শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ শিশুর কান্না শুনে দৌড়ে আগুনের ভেতর ঢুকে পড়বে। ভয়াবহ বোকামি করে প্রমাণ করবে যে মানুষ শ্রেষ্ঠতম প্রাণী।

আমাদের নানার বাড়িতে নসু বলে একটা লোককে ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তার সমস্ত শরীর ঝলসানো। সে আগুনে আটকা পড়া একটা বিড়াল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। সবাই তাকে ডাকতো বোকা নসু। কিন্তু সেই বোকা ডাকের সঙ্গে কি গভীর মমতাই না মেশানো থাকতো!

ছোটবেলায় আমি ভেবেছিলাম, নসু মামা বোধ করি খুব বিড়াল পছন্দ করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দাঁত-মুখ কুঁচকে বললেন, দূর ভাইগনা। বিলাই আমার দুই চউক্ষের বিষ।

আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুচোখের বিষের বাচ্চা বাঁচানোর জন্যেও আগুনে ঝাপিয়ে পড়া যায়। মানুষ বলেই সে পারে। মানুষকে চেষ্টা করে মহৎ হতে হয় না, মহত্ত্ব নিয়েই সে জন্মেছে।

আমার মন যখন বিক্ষিপ্ত থাকে তখন কিছু কিছু লেখকের রচনা পাঠ করি যা আমাকে শান্ত হতে সাহায্য করে। মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টেইনবেক তেমনি একজন লেখক। মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতি তাঁর আস্থা, মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন মমতা আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে।

১৯৫২ সনে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে জন স্টেইনবেক যে ভাষণ দিয়েছিলেন আমার কাছে সে ভাষণ দৈববাণীর মত মনে হয়। স্টেইনবেক বলছেন–আমি মনে করি যে লেখক মানুষের নিখুঁত ও ত্রুটিহীন হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় আস্থা স্থাপন করেন না–সাহিত্যের প্রতি তাঁর কোন আনুগত্য নেই। সাহিত্য সদস্য হবার কোন যোগ্যতা তাঁর নেই।

এই মহান লেখক মানুষের ত্রুটিগুলি এত মমতায় এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। মনে হয়, বিশ্বাস হারানোর সময় এখনো আসে নি। কখনো আসবেও না।।

আমার যখন রাতজাগা রোগ হয় তখন এই লেখকের দুটি বই খুব আগ্রহ করে পড়ি–একটি হল ক্যানারী রো। কয়েকজন ভবঘুরে অলস যুবকের গল্প। অন্যটি টরটিলা ফ্ল্যাট। বড়ই মজার, বড়ই রহস্যময় উপন্যাস। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, যে গ্রন্থের জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পান–গ্রেপস অব র্যাথ তা আমার পড়তে একেবারেই ভাল লাগে নি। একবার শুধু পড়েছি। তাও কষ্ট করে।

এই মহান লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে খুব মজা করে একটা ঘটনা লিখেছেন। হাতের কাছে বইটি নেই। কাজেই হুবহু অনুবাদ করতে পারছি না–ঘটনাটা বলি। যুবক বয়সে স্টেইনবেকের খুব ইচ্ছে হল আমেরিকার এক মাথা থেকে পায়ে হেঁটে অন্য মাথায় যাবেন। কাঁধে হেভার স্যাক নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় যাত্রা শুরু করলেন। সারাদিন হাঁটেন। রাতে কোন না কোন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। গৃহকর্তা জিজ্ঞেস করেন, তোমার উদ্দেশ্য কি? যাচ্ছ কোথায়?

আমি পায়ে হেঁটে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছি।

কেন?

এমি, কোন কারণে না।

না, তোমার মতলব সুবিধার মনে হচ্ছে না। থাকতে দেয়া হবে না। অন্য কোথাও যাও।

অন্য বাড়িতে গিয়েও দেখেন একই অবস্থা। একটা যুবক ছেলে শুধুমাত্র শখের কারণে ছহাজার মাইল পায়ে হাঁটবে–এটা কেউ বিশ্বাস করছে না। স্টেইনবেক বলছেন, আমি যখন দেখলাম, মানুষ সত্যটাকে গ্রহণ করতে পারছে না তখন মিথ্যার আশ্রয় নিলাম–আমি বলা শুরু করলাম, বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরেছি। পায়ে হেঁটে আমেরিকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাব। তখন সবাই যে শুধু আমার কথা বিশ্বাস করল তাই না, আমাকে নানানভাবে উৎসাহও দিল যাতে আমি বাজি জিততে পারি। স্টেইনবেক বলছেন, মানব চরিত্রের একটি মজার দিক হচ্ছে মানুষ সত্যের চেয়ে মিথ্যাকে সহজে গ্রহণ করে।

প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। প্রসঙ্গে ফিরে যাই–নিশি যাপন বিষয়ে বলছিলাম। আজ রাত জেগে আছি মন খারাপের জন্যে ঘুম আসছে না বলে। কিন্তু আমার মন যখন বেশ ভাল থাকে তখনো আমি মাঝে মাঝে নিশি যাপন করি।

এই পৃথিবীতে সবচে মহৎ এবং সবচে ভয়ংকর পরিকল্পনাগুলি নাকি রাতে করা হয়। সাধুরা ঈশ্বর চিন্তা করেন রাতে। কুৎসিততম অপরাধগুলি করতে অপরাধীরা রাতে বের হয়। সাধারণ মানুষদের জন্যে রাত হচ্ছে বিশ্রামের কাল। আর যারা অসাধারণ, রাত তাদের জেগে থাকার সময়। আমি খুবই সাধারণ তবু মাঝে মাঝে অসাধারণ হতে ইচ্ছা করে। রাত জাগতে ভাল লাগে। আমার এই রাতজাগা অভ্যেস ধরিয়ে দেন আনিস সাবেত। মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া তুখোড় ছাত্র। মহসিন হলে আমার পাশের ঘরে থাকতেন। পদার্থবিদ্যার ছাত্র। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা একটাই–ছবি বানাবেন। পাঠ্যবই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছবি বানানোর কিছু কোর্স নিলেন। কোন এক ক্যামেরাম্যানের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে ক্যামেরার কাজ শিখতে লাগলেন। তাঁর ছিল রাতজাগা নেশা। এই নেশা তিনি আমাকে ধরিয়ে দিলেন। বাতি-টাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি। ভোর আটটা থেকে ক্লাস–সকালে উঠতে হবে। আনিস ভাই এসে দরজায় টোকা দিলেন, এই ঘুমুচ্ছ না-কি?

আমি মটকা মেরে পড়ে থাকি, জবাব দেই না।

আনিস ভাই আরো কয়েকবার দরজায় টোকা দিয়ে শেষটায় বলেন–এখন কিন্তু দরজা ভাঙব। ওয়ান-টু-থ্রী

আমি কাতর গলায় বলি, আমার ভোর বেলায় ক্লাস আনিস ভাই।

ভোরবেলায় তো আমারো ক্লাস। হু কেয়ার্স?

যাবেন কোথায় এত রাতে?

প্রথমে নীলখেতে গিয়ে চা খাব, তারপর শহরে হাঁটব।

শার্ট গায়ে দিয়ে বের হই। নীলখেতে চা খাই তারপর হাঁটতে শুরু করি। সেই সময় রাতের ঢাকা ছিল অসম্ভব নিরাপদ। শহর কখনো ঘুমুতো না। রাস্তা-ঘাটে কিছু না কিছু মানুষ থাকতোই। এমনও হয়েছে আমরা সারারাত হেঁটে ভোরবেলা হলে উপস্থিত হয়েছি। চা-নাশতা খেয়ে চলে গিয়েছি ক্লাসে।

দেশের প্রতি প্রচণ্ড মমতা ছিল আনিস ভাইয়ের। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জন্যে কি করা যায়–কি করে এ দেশের শিল্প-সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়া যায়–রাতদিন এই পরিকল্পনা। আহমেদ ছফার সঙ্গে যোগ দিয়ে তখন পত্রিকা বের করছেন। দারুণ উৎসাহ। ছবির একটা স্ক্রীপ্ট লিখে ফিললেন। যখন টাকা হবে এই ছবি বানানো হবে। দেশে বিদেশে ছবি যাবে সবাই মুগ্ধ হয়ে বলবে–বাংলাদেশের ছবি। যে দেশের প্রতি এত মমতা সেই দেশের উপর প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে তিনি ১৯৭৫ সনে চিরদিনের জন্যে চলে গেলেন কানাডা। আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখলেন না। চিঠি লিখি, জবাব দেন না।

আমেরিকা গিয়ে অনেক চেষ্টা করে টেলিফোনে তাঁকে পেলাম। মনে হল, কথা বলায় কোন আগ্রহ বোধ করছেন না। রাগ করে টেলিফোন রেখে দিলাম। সেও অনেক কাল আগের কথা।

তার পরের ঘটনা ভয়ংকর ধরনের। গভীর রাতে টেলিফোন এসেছে। লং ডিসটেন্স কল। আনিস ভাই আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আমাকে খুঁজে বের করেছেন। টেলিফোন করেছেন রাত তিনটায়। রাগ ভুলে গিয়ে আমি হাসিমুখে বললাম, আপনার পুরানো অভ্যাস এখনো যায় নি। টেলিফোন করেছেন, রাত তিনটায়।

আনিস ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ইচ্ছে করে করেছি। তোমার ঘুম নষ্ট করবার জন্যে করেছি। কেমন আছ?

ভাল। আপনি কেমন?

আমি কেমন আছি বলছি, তবে শান্ত হয়ে শুনবে, মন খারাপ করবে না। আমার ক্যানসার হয়েছে। থ্রোট ক্যানসার। কাউকেই বলি নি। তোমাকে বললাম। সময় হাতে বেশি নেই। দুমাস।

আমি টেলিফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।

শেষ দুমাসে আনিস ভাই প্রতি সপ্তাহে টেলিফোন করতেন। রাত দুটা বা তিনটায় টেলিফোন বেজে উঠতো। কথা বলতে তখন তাঁর কষ্ট হত। সব কথা বোঝাও যেত না।

হুমায়ুন, তোমার কি মনে আছে আমরা কেমন সারারাত শহরে হাঁটতাম?

মনে আছে।

তুমি কি এখনো হাঁট?

না।

মৃত্যুর আগে আর একবার শুধু ঢাকা শহরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। আমাদের দেশটাকে আল্লাহ এত সুন্দর করে কেন বানালেন বলতো? খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

চলে আসুন।

চলে আসা সম্ভব নয়। আমার শেষ অবস্থা। তুমি কি কাঁদছ নাকি?

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, না। আপনি দয়া করে আর আমাকে টেলিফোন করবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।

আনিস ভাই আমাকে টেলিফোন করেন নি। তাঁর নির্দেশমত হাসপাতাল থেকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে দেয়া হয়।

আমি এখনো নিশিযাপন করি। মাঝে মাঝে কেমন জানি লাগে। মনে হয় হারিয়ে যাওয়া মানুষরা যেন হারিয়ে যায় নি–আছে, আমার পাশেই আছে। এই তো ভালবাসা এবং মমতায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এমন অনুভূতি কখনো দিনে হবার নয়–তার জন্যে প্রয়োজন চিররহস্যময়ী–রাত্রি। অনন্ত অম্বর।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top