What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected আমার প্রিয় কবিতাগুলো............ (1 Viewer)

নীরার দুঃখকে ছোঁয়া – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কতটুকু দূরত্ব? সহস্র আলোকবর্ষ চকিতে পার হয়ে
আমি তোমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসি
তোমার নগ্ন কোমরের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলার আগে
অলঙ্কৃত পাড় দিতে ঢাকা অদৃশ্য পায়ের পাতা দুটি
বুকের কাছে এনে
চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে চাই
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বুক কাঁপে
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বাইরের জীবন মিথ্যে হয়ে যায়
বহুকাল পর অশ্রু বিস্মৃত শব্দটি
অসম্ভব মায়াময় মনে হয়
ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে
আমার দুঃখ মিশিয়ে আদর করি
সামাজিক কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে
স্ফুরিত হয় একটি মুহূর্ত
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে তোমার পায়ের কাছে…

বাইরে বড় চ্যাঁচামেচি, আবহাওয়া যখন তখন নিম্নচাপ
ধ্বংস ও সৃষ্টির বীজ ও ফসলে ধারাবাহিক কৌতুক
অজস্র মানুষের মাথা নিজস্ব নিয়মে ঘামে
সেই তো শ্রেষ্ঠ সময় যখন এ-সবকিছুই তুচ্ছ
যখন মানুষ ফিরে আসে তার ব্যক্তিগত স্বর্গের
অতৃপ্ত সিঁড়িতে
যখন শরীরের মধ্যে বন্দী ভ্রমরের মনে পড়ে যায়
এলাচ গন্ধের মতো বাল্যস্মৃতি
তোমার অলোকসামান্য মুখের দিকে আমার স্থির দৃষ্টি
তোমার রেজী অভিমানের কাছে প্রতিহত হয়
দ্যুলোক-সীমানা
প্রতীক্ষা করি ত্রিকাল দুলিয়ে দেওয়া গ্রীবাভঙ্গির
আমার বুক কাঁপে,
কথা বলি না
বুকে বুক রেখে যদি স্পর্শ করা যায় ব্যথাসরিৎসাগর
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে
চোখ শুকনো, তবু পদচুম্বনের আগে
অশ্রুপাতের জন্য মন কেমন করে!
 
নীরার জন্য কবিতার ভুমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা
এ কবিতার মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে

ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের
থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে এক মুহুর্ত ভাববে
কে তোমায় মনে করছে এত রাত্রে — তখন আমার
এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাশ রেফ
ও রয়ের ফুটকি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার
আধো ঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও
বিছানায় আমার নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলো
এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু
তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে

তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি
আমার ভযংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না — আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম,
. শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে — এরা তোমাকে চুম্বন করলে
তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারা রাত শুয়ে থাকবে
এক বিছানায় — তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের
কাছে মরা প্রজাপতির মতো লুটোবে | এদের আত্মা মিশে
থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো

বহুদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্নার জলের মতো
হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে | নীরা, আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো | আমি অন্য কথা
বালার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে-মনে
ঘর ভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে
. নিজস্ব চোখে তাকাবো |
তুমি জানতে পারবে না — তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে |
আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা |
 
তোমাকে মনে পড়ে যায়
মোহন রায়হান

মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট,
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দিবে তুমি

ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে
কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা
প্রতিটি পা ফেলছো কি দৃঢ় প্রত্যয়ে
কি উচ্চকিত তোমার কন্ঠের শ্লোগান
যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে
হাত উঠছে হাত নামছে
মাথা ঝুকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে
ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যরে পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি

মধুর ক্যান্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম, মিছিল সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে র্দুজয় শপথ
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে
শিক্ষাজীবন, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্বশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে
ডাক দেই দেশবাসীকে

তোমারি মত নিরাপত্বাহীনতায়
প্রতিটি ছাত্রের দুর্বিষহ জিন্মীজীবন এখনো এ ক্যাম্পাসে
হলে গেটে গেটে পড়ে থাকে ভয়ংকর বিস্ফোরোন্মুখ তাজা বোমা
প্রতিদিন চর দখলরে মত হল দখলের হিংস্র মহড়া
গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ
এখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ
এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?

মধুর ক্যান্টিনে যাই
প্রতদিনি আমাদের জীবন হাতরে মুঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার

শিক্ষাভবন অভিমুখে সামরিক শাসন ভাঙ্গার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারির কাফেলায় তুমি ছিলে
৪ঠা আগস্ট সশস্ত্র দুবৃর্ত্তদের কবল থেকে
আমাদের পবিত্র মাটি রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোন র্ধমঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল আন্দোলন নেই যে তুমি ছিলে না

সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও
তুমি অস্ত্রধারীদরে দুর্গের দিকে অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে
ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু তুমি পিছু হটনি
তুমি বীর, তুমি সাহসী যোদ্ধা, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্ররেণা
মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়রে কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

কাউন্টারের সামনে কতদিন
তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি
কতদিন তুমি আমাকে চায়ের পয়সা দিতে দাওনি
কতদিন চায়ের সঙ্গে একটি সিঙ্গারা বা কেকের আবদার করেছ
কতদনি তোমার সঙ্গে খোশগল্প হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছি
বসু, আজ সব কথা মনে পড়ে যায়।

রিপার বিয়েতে তুমি বলেছিলে
অ্যাকশনে আপনার আর আগে থাকার দরকার নেই,
আমরা তো আছি
বসু, তুমি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে গেলে
বসু, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি রক্তকরবী বৃক্ষ
মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

তোমার মৃত্যুর সেই নৃশংস ঘাতক রাত্রিতে
আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে
তোমার গুলিবদ্ধি রক্তাক্ত লাশ আমি দেখিনি
তোমার মৃত্যুর খবর শুনে
বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল মন
তবু সেই রাত্রেই আড়াই-শত মাইল দূর থেকে
সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিয়েছিলাম
তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে
তোমার খুনিদের রক্তে হাত রাঙ্গাতে।

বসু, আমরা বহুবার তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেবার শপথ গ্রহণ করেছি
অপরাজয়ে বাংলার পাদদেশে, শহীদ মিনার, বটতলায়, বায়তুল মোকারমে,
সারাদেশ তোমার হত্যার বদলা চায়
কিন্ত্তু এখনো তোমার খুনিরা প্রকাশ্যে সর্গবে ঘুরে বেড়ায়
এখনো তোমার ঘাতকেরা ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে
রাইফেল তাক করে আছে আমাদের প্রতি।

বসু, আমাদের শিক্ষানীতি এখনো বদলায়নি
সামরিক খাতে ব্যয় শিক্ষাখাতের চেয়ে আরও বেড়েছে
নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা হলেও
সংস্কারের অভাবে জগন্নাথ হলরে র্জীণ ছাদ ধ্বসে
তোমার অনেক বন্ধু মারা গেছে
এখনো হলে হলে মেধা-ভিত্তিক সিট বণ্টন চালু হয়নি।

বসু, তুমি এসবের পরিবর্তন চেয়ে জীবন দিয়েছ
কিন্তু আমরা এখন তোমার একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারিনি
বসু, আমরা তোমার কাঙ্খিত লড়াই চূড়ান্ত করতে পারিনি
আমরা তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি
আমরা এখনো অজস্র বসু হতে পারিনি বলেই ...

মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
খুব মনে পড়ে।
 
-অবাক সূর্যোদয়
হাসান হাফিজুর রহমান

"কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকুল সূর্যোদয়
রক্তভীষণ মুখমণ্ডলে চমকায় বরাভয় ।
বুকের অধীর ফিনকির ক্ষুরধার
শহীদের খুন লেগে
কিশোর তোমার দুই হাতে দুই
সূর্য উঠেছে জেগে ।
মানুষের হাতে অবাক সূর্যোদয়,
যায় পুড়ে যায় মর্ত্যের অমানিশা
শঙ্কার সংশয় ।
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
প্রবল অহংকারে সূর্যের সাথে
অভিন্ন দেখ অমিত অযুত লাখ ।
সারা শহরের মুখ
তোমার হাতের দিকে
ভয়হারা কোটি অপলক চোখ একাকার হল
সূর্যের অনিমিখে ।
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
লোলিত পাপের আমূল রসনা ক্রুর অগ্নিতে ঢাক ।
রক্তের খরতানে
জাগাও পাবক প্রাণ
কণ্ঠে কাটাও নিষ্ঠুরতম গান
যাক পুড়ে যাক আপামর পশু
মনুষ্যত্বের ধিক্ অপমান
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
কুহেলী পোড়ানো মিছিলের হুতাশনে
লাখ অযুতকে ডাক ।
কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকূল সূর্যোদয়
রক্তশোধিত মুখমণ্ডলে চমকাক্ বরাভয়। "
 
সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

রাইফেল তাক কোরে আছো মানুষের দিকে।

সঙ্গিন উচিয়ে আছো ধূর্ত নেকড়ের মতো।

পায়ে বুট, সুরক্ষিত হেলমেটে ঢেকে আছো মাথা।

সশস্ত্র তোমার হাত, সংগঠিত, কে তোমাকে ছোঁয়!

তোমার বুলেট মানুষের বুক লক্ষ্য কোরে ছুটে যাচ্ছে

তোমার বুলেট মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে নিচ্ছে

তোমার বুলেট মানুষের হৃৎপিন্ড স্তব্ধ কোরে দিচ্ছে

তুমি গুলি ছুঁড়ছো, তুমি গুলি ছুঁড়ছো মানুষের দিকে।

যে মানুষের মধ্যে কেউ একজন তোমার ভাই

যে মানুষের মধ্যে কেউ একজন তোমার পিতা

যে মানুষের মধ্যে কেউ একজন তোমার বোন

যে মানুষের মধ্যে কেউ একজন তোমার ছেলে

সেই মানুষের দিকে তোমারা টার্গেট প্র্যাক্টিস করছো...

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

প্রকৃতির ভেতরে তাকাও, দ্যাখো আলো এবং অন্ধকার দুটি পক্ষ

নিসর্গের ভেতরে তাকাও, দ্যাখো পানি এবং মাটি দুটি পক্ষ

পৃথিবীর ভেতরে তাকাও, দ্যাখো শোষিত এবং শোষক দুটি পক্ষ

মানুষের ভেতরে তাকাও, দ্যাখো গরীব এবং বুর্জুয়া দুটি পক্ষ

এদেশের ভেতরে তাকাও, দ্যাখো পঁচাশি এবং পনেরো দুটি পক্ষ

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

এদেশের আশি যোগ পাঁচজন এখনো ক্ষুধার্ত প্রাণী

অর্থাৎ এখনো মানুষ নয় তারা এখনো মানবেতর,

তারা এমন কি দরিদ্রও নয়, দরিদ্র-সীমার নিচে।

ক্ষুধার আঘাতে পঙ্গু, বস্ত্রহীন, উদ্বাস্ত-উন্মুল এই

আশি যোগ পাঁচজন স্বপ্নাহত, নিঃস্ব, মুমূর্ষু মানুষ-

এই মানুষের দিকে তোমরা টার্গেট প্র্যাক্টিস করছো।

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

তুমি সেই আশি যোগ পাঁচজন মানুষের ছেলে-

তোমার পিতা একজন চাষা, ক্ষেতে লাঙ্গল চালায়

তোমার পিতা একজন শ্রমিক, মিলে গতর খাটায়

তোমার পিতা একজন মজুর, একজন কর্মচারী

তোমার পিতা একজন পিয়ন, রেলশ্রমিক, কেরানি

তোমার পিতা একজন বাসশ্রমিক, বেশ্যার দালাল

তোমার পিতা একজন স্কুল শিক্ষক, রিক্সাওয়ালা-

তোমার পিতার পাঁজরে তোমরা টার্গেট প্র্যাক্টিস করছো...

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

সীমান্ত রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে,

সার্বভৌমত্বের নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে।

শৃংখলা রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে,

আইন রক্ষার নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে।

সীমান্ত রক্ষাও নয়, সার্বভৌমত্বও নয়, শুধুমাত্র পুঁজি,

শুধুমাত্র পুঁজিবাদ রক্ষাই তোমাদের মৌল কাজ।

তোমরা এখন বিত্তের পাহারাদার, বিত্তবানের প্রহরী,

বিত্তবান তোমাকে ব্যবহার করছে তার বিত্তের স্বপক্ষে।

বিত্তের বিরদ্ধে তাই যখন শ্লোগান ওঠে শহরে ও গ্রামে,

যখন মিছিল নামে রাজপথে মানুষের দাবির মিছিল,

যখন মিছিল নামে রাজপথে মানুষের ক্ষুধার মিছিল-

তখন তোমার হাতে গর্জে ওঠে তীক্ষ্ম রাইফেল,

তুমি ব্যবহৃত হও, নিরুপায় ব্যবহৃত হও।

তোমার হাতের ভেতর তখন শোষকের হাত।

তোমার আঙুল, সে তখন খুনী জান্তার আঙুল।

তোমার সুশিক্ষিত পা, সে তখন স্বৈরাচারের পা।

তোমার চোখ তখন এক ঘাতকের খল চোখ।

তোমার জিভ তখন এক ঘৃণ্য দুর্বৃত্তের জিভ।

দাঁড়াও‌, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?

একদিকে বিত্তবান,

অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ।

একদিকে পূঁজিবাদ,

অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ।

ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ লড়াই-

কোন পক্ষে যাবে?
 
-দেশলাই কাঠি
সুকান্ত ভট্টাচার্য

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন –
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাত্
আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন-
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে–আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।
আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছো বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে, গ্রামে– দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়-
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব-
সবাই– শেষবারের মতো!
 
উলঙ্গ রাজা
__________-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি_____________________

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
_------------_------_---------------------------------------------------
 
একটি_মৃত্যু

........গৌতম চক্রবর্তী

ট্রলিতে শুয়ে চুল্লিতে প্রবেশ করতেই দ্বপকরে
জ্বলে উঠল গায়ের কাপড়টি,নিমেষে ঘটাংকরে
চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

যতক্ষণ চুল্লিতে দেয়নি ততক্ষণ কেমন ছেলেমানুষ হয়েছিলাম,মানতেই পারছিলাম না যে "মৃত্যু হয়েছে"
বারবার মনে হচ্ছিল কিচ্ছু হয়নি সব ঠিক হয়ে যাবে,যেমনটা সবসময় হয়।

ঐ চুল্লির ঘটাংকরে দরজা বন্ধ হওয়াটা আর সহ্য করতে পারলাম না,
যেন ঐ আওয়াজ টাই আমার সব আশা শেষ করে দিল..
যেন ঐ আওয়াজ টাই আমার স্ত্রীর মৃত্যু বয়ে আনলো..
যেন ঐ আওয়াজ টাই আমায় এক মহাকাশ
শূন্যতা দিয়ে দিল।
যেন বিদ্যুৎ বেগে আমার হৃৎপিণ্ডটার উপর দিয়ে একটি ট্রেন চলে গেল।

দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু বুঝতে পারছি...
সুন্দর কেশরাশি নিমেষে ছাই হয়েগেছে,
ধীরে ধীরে পেশী,মজ্জা,অস্থি ছাই হচ্ছে শুধু একটু
অপেক্ষা।

সবাই দেখছে চিতা জ্বলছে শুধু আমি দেখতে
পাচ্ছি না...
আমি দেখছি আমার ভালোবাসা জ্বলছে..
আমার আদর জ্বলছে..
আমার আবদার জ্বলছে..
আমার ছেলেমানুষী জ্বলছে..
আমার অভিমান জ্বলছে..
আমার অধিকার জ্বলছে..
আমার অস্তিত্ব জ্বলছে..
জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

ছাই হয়ে যাচ্ছে আমারই চোখের সামনে
আমার রাঙতায় মোড়া বসন্ত,
ভোরের আদরে ভেজা চা এর পেয়ালা,
হিমেল রাতের গরম চাদর,
লুকিয়ে রাখা বিড়ির প্যাকেট আর আঁচল ভরা শাসন।

কাঁদছে তারা যারা হারিয়েছে
আমি কাঁদছি না
আমার শরীরটা বেঁচে আছে মনটার মৃত্যু হয়েছে
যার চিতা এখনও জ্বলছে
মরে গেলে কেউ কাঁদতে পারে ?

একটি মৃত্যু আসলে একটি মৃত্যু নয় একটি মৃত্যুই অনেক মৃত্যু,

পুরুষেরও বৈধব্য আসে পোশাকে নয় মননে।

""""""""""""""""""""""""""""*****"""""""""""""""''''''''"""""""""""""
 
শুধু তোমার জন্য

- নির্মলেন্দু গুণ
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
 
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে

- কাজী নজরুল ইসলাম
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top