০২.
লোকটা মোটাসোটা, লম্বা, আঁটসাট ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরে আছে। কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ট্রানসিভার আর গ্রেনেড, হাতে স্টার্লিং সাবমেশিনগান। পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে, খোলা উঠনের ওপর দিয়ে ছুটে এসে হাঁপিয়ে, গেছে।
দোতলা একটা বাড়ি, ওপর তলায় উঠতে হবে তাকে। করিডর ধরে একটু একটু করে বাঁকের দিকে এগোল সে। জানে, বাকের পর আবার লম্বা একটা করিডর, শেষ মাথায় সিঁড়ি। কোণে এসে দাঁড়াল সে, তারপর নিচু হয়ে লাফ দিল। সামনে, স্টার্লিঙের ট্রিগার টেনে ধরেছে আঙুল।
গুলির একনাগাড় আওয়াজে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে লোকটাকে আসতে দেখল রানা, তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিনাটি সবকিছু লক্ষ করছে। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার দেয়ালে হেলান দিল লোকটা। খালি একটা ম্যাগাজিন পড়ল মেঝেতে, ক্লিক করে জায়গামত বসল। নতুন আরেকটা। মুখের কাছেট্র্যানসিভার তুলে বলল সে, ওপরে যাচ্ছে। রানার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল। রানা। বাড়ির চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ারের আরও আওয়াজ আসছে, মাঝে মধ্যে গ্রেনেড় ফাটছে দুএকটা।
.
এক এক করে পনেরোজনই বাগানে বেরিয়ে এল ওরা, পরনে এখনও সবার ক্যামোফ্লেজ গিয়ার, কথা বলছে উত্তেজিতভাবে। সবার পিছু পিছু এল পিওতর মেনিনো। নিচু একটা পাঁচিল দেখিয়ে সবাইকে বসতে বলল সে।
পাঁচ মিনিটের এক্সারসাইজ, কিন্তু ভিব্রিফিঙে সময় লাগল এক ঘন্টা। হামলার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে কথা বলল মেনিনো, কারও সমালোচনা করল, কারও প্রশংসা। পনেরোজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, পাশে রানা। স্কোয়াডের সবাই উৎসাহে ভরপুর, এটাই তাদের প্রথম ফুল-স্কেল এক্সারসাইজ, বিস্ফোরণের আওয়াজ আর ছুটোছুটি ওদেরকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। কথা শেষ করে রানার দিকে ফিরল। মেনিনো। এনি কমেন্ট?
সামনে এগোল রানা, স্কোয়াডের সবাই কিছু শুনতে পাবার আশায় স্থির হয়ে গেল।
সব মিলিয়ে ভাল, বলল রানা। খুশি হয়ে হেসে উঠল সবাই।
কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে, আট থেকে দশ জন মারা যেতে তোমরা, না হয় আহত হতে। মুছে গেল মুখের হাসি।
লম্বা মোটাসোটা যুবকের দিকে হাত তুলল রানা। মারাঞ্জানো, করিডর ধরে। আসার সময় দেয়াল ঘেষে ছিলে তুমি–ভুলে গিয়েছিলে ওটা একটা পাথরের। দেয়াল। শক্ত দেয়ালে বুলেট ঢোকে না, পিছলে যায়–সেজন্যেই বারবার, করিডরের মাঝখানে থাকতে বলা হয়েছে সবাইকে। মাঝখানে থাকলে তোমার মনে হবে শত্রু তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তবু মাঝখানে থাকাই। নিরাপদ। বাকটা ঘোরার সময় নিচু হয়ে ছিলে তুমি, কিন্তু তারপরই সিধে হয়ে গেলে। আরেকটা কথা, কোমর-সমান উঁচুতে লক্ষ্যস্থির করছিলে তুমি। শত্রু মেঝেতে শুয়ে থাকতে পারে, বাতাসে ওড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই সব সময় নিচের দিকে গুলি করতে হবে।
মাথা ঝাঁকাল মারাঞ্জানো, হতভম্ব দেখাল তাকে। কিন্তু রানা তাকে এখনও রেহাই দেয়নি।
আমি টেরোরিস্ট হলে, এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতে। ম্যাগাজিন বদলাতে অনেক বেশি সময় নিয়েছ। ওটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়, তোমার সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। সবাইকে বলছি, আরও প্র্যাকটিস কর। বাঁচতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই।
মাঝারি আকৃতির এক যুবকের দিকে ফিরল রানা। ডেগা, জোনাথনের পিছু পিছু দুনাম্বার কামরায় ঢুকলে তুমি। অথচ উচিত ছিল করিডর থেকে তিন আর চার নাম্বার কামরার দরজা কাভার দেয়া। কি আশা করেছিলে, দুনাম্বার কামরায় তোমার জন্যে কোন মেয়ে অপেক্ষা করছে?
হাসির হররা বয়ে গেল। সবাই জানে, ডেগা একজন রোমিও, মেয়ে দেখলে। পিছু ছাড়ে না।
স্কোয়াডের প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলল রানা। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকল মেনিনো, দোষ-ক্রটি আবিষ্কার আর সম্ভাবনার নতুন নতুন দিক উন্মোচনে রানার কৃতিত্ব দেখে বিস্মিত। তার লোকেরা সবাই ওর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কারণ একজন অভিজ্ঞ লোক কর্তৃত্বের সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় গলদ। ওরা সবাই রানাকে স্টার্লিঙের ম্যাগাজিন পাল্টাতে দেখল বিদ্যুৎ খেলে গেল হাতে, একটানা গুলিবর্ষণে বিরতি পড়ল কি পড়ল না। রানাকে হ্যাণ্ডগান, এস-এম জি আর কারবাইন চালাতেও দেখল ওরা–দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, দ্রুত। এর আগে তারা আন-আর্মড কমব্যাট প্র্যাকটিস করতে দেখেছে ওকে, ওর গতি আর রিফ্লেক্স দেখে মুগ্ধ হয়েছে। পনেরো জনের কারও বয়সই পঁচিশের বেশি। নয়, সবাই শক্ত-সমর্থ, কিন্তু জানে রানার সঙ্গে কেউ ওরা পারবে না। কাজেই ওর কথা মন দিয়ে শুনল সবাই।
সবশেষে মেনিনো, ধন্যবাদ জানাল রানাকে। বলল, বিল্ডিংটা আরও এক মাস আমাদের দখলে থাকবে, আমি চাই আরও দুটো এক্সারসাইজে আপনি থাকুন। এয়ার মাল্টার সাথে কথা হয়ে গেছে, দুঘন্টার জন্যে ওরা আমাদের একটা বোয়িং ধার দেবে। হাইজ্যাক অ্যাসল্টের মহড়া আপনি পরিচালনা করবেন।
রাজি হল রানা।
ওর আগের স্বাস্থ্য আর শক্তি ফিরে এসেছে, ফিরে পেয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতাও। নিয়মিত প্র্যাকটিস করে এখন শুধু ওগুলো ধরে রাখা।
.
একটা রুটিন করে নিয়েছে ভায়োলা।
ভোর অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তার, দোতলায় উঠে রানার দরজায় টোকা। দেয়। রানার সাড়া পেলে নিচে নেমে কফি তৈরি করে সে। আবার দোতলায় উঠে।
আসে, দেখে, ব্যায়াম শুরু করেছে রানা। বিছানায় বসে রানাকে ঘেমেনেয়ে উঠতে দেখে সে। তারপর চেয়ারে বসে কফি খায় রানা। তখনও. সূর্য ওঠে না, গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। চুপচাপ থাকে ওরা, দুএকটা কথা হয় কি হয় না। কফি শেষ করে, দৌড়াতে যায় রানা–এখন একটানা দশ মাইল দৌড়ায় ও। দৌড় শেষ করে খুদে ইনলেটে চলে আসে, এসে দেখে ভায়োলা সেখানে আগেই হাজির হয়েছে, ওর জন্যে কিছু একটা ঠাণ্ডা পানীয় আর তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছে। ডাইভ দিয়ে। পানিতে নামে রানা, তিন বার কোমিনো হয়ে ফিরে আসে। তারপর সমতল পাথরে আধ ঘন্টা শুয়ে থাকে, ওর পাশে বসে বা শুয়ে থাকে ভায়োলা।
ব্রেকফাস্ট সেরে পাহাড়ে চলে যায় রানা, তাজা আর নিডোর সঙ্গে মাটি কাটার কাজ করে।
সন্ধের সময় আবার রানার সঙ্গে দেখা হয় ভায়োলার, খুদে ইনলেটে সাঁতার। কাটে দুজন। তখন ওদের মধ্যে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ কেউ তোলে না, অতীত আর ভবিষ্যতের কথা দুজনেই সচেতনভাবে এড়িয়ে। যায়। আভাসে জানিয়ে দিয়েছে ভায়োলা, তার কোন প্রত্যাশা নেই, কিন্তু ভাল লাগা আছে, আছে সমর্থন আর সহানুভূতি। সেবা, শুশ্রূষা আর সঙ্গ দিয়ে নিজেই তৃপ্তি পেতে চায় সে; অনুরোধ–নারীসুলভ তার এই আচরণকে যেন অন্য চোখে দেখা না হয়।
মাঝে মধ্যে রানাকে হাসতে দেখে ভায়োলা, অদ্ভুত একটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। তার অন্তর। রেমারিকের কাছে শুনেছে সে, অসহনীয় একটা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে। আছে এই লোকের মন। রেমারিকের সাথে আরও কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তার, রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে এক-আধটু আভাস পেয়েছে সে।
প্রথম দিকে একটু ধাঁধা লাগলেও, এখন রানা ভায়োলাকে বুঝতে পারে। অসাধারণ, বুদ্ধিমতী সে, মনটা ফুলের মত কোমল। কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, সত্যিকার পৌরুষ আছে এই রকম পুরুষ মানুষের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে, সে। হতে পারে স্বামীর সঙ্গে যে-কারণে ঘর করতে পারেনি, এ তারই প্রতিক্রিয়া।
সময় বয়ে চলল, কিন্তু ওদের সম্পর্ক আগের মতই থাকল। ভায়োলা সব সময় রানার কাছাকাছি আছে, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ হবার কোন চেষ্টা নেই তার। নাগালের মধ্যে রয়েছে ভায়োলা, কিন্তু কখনও হাত বাড়াবার কোন প্রবণতা রানার মধ্যে দেখা যায় না।
রানা একদিন মৃদু কণ্ঠে বলল, আর দিন দশেক পর রওনা হব আমি। মার্সেলেসে যেতে হবে আমাকে। দেখি আজ যদি পারি জাহাজের শিডিউল চেক করে আসব।
সে তো আমিই পারি, বলল ভায়োলা। ভ্যালেটায় একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে, আমার এক বান্ধবী কাজ করে। যতদূর মনে পড়ছে, হপ্তায় একটা করে জাহাজ যায়–বন পুয়ারো।
পরদিন রেমারিকের চিঠি পৌঁছুল।
স্পষ্ট, খুদে হস্তাক্ষরে চার পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রেমারিক। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা টিকেটের অর্ধেক পিন দিয়ে আটকানো। মার্সেলেন্স রেলওয়ে স্টেশনের। ব্যাগেজরূমের টিকেট ওটা।
সে-রাতে দুটো চিঠি লিখল রানা। প্রথমটা ঢাকায়, মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের কাছে। চিঠিতে সি. আই. এ-র মতিগতি কি রকম জানতে চাইল সে। লিখল, শুধু ভাল কোন খবর থাকলে বি. সি. আই রেমারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর, একটা ইকুইপমেন্টের জন্যে অনুরোধ করল রানা, মার্সেলেসে, পোস্ট রেসতাত-এ পাঠাতে হবে।
দ্বিতীয় চিঠিটা লিখল ফেঞ্চ আর্মির একজন জেনারেলকে। এই ফ্রেঞ্চ জেনারেল কিছু ব্যাপারে রানার প্রতি দুর্বল। লেবাননে পাঠানো জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীতে ছিলেন তিনি, খ্রিস্টান ফ্যালাঞ্জিস্টদের গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। রানা তাকে কাঁধে তুলে নেয়, তিন ঘন্টা হেঁটে, পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। এই জেনারেলকেও একটা পার্সেলের জন্যে লিখল রানা।
.
কাল সকালে গোজো ছেড়ে চলে যাবে রানা।
স্কোয়াডের শেষ মহড়াটাও পরিচালনা করল ও। সবারই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, মেনিনো আর রানার সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াল ব্রা, নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই বেশি জুটল কপালে।
রানার এটা শেষ সেশন, তাই ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্কের জন্যে জেদ ধরল ওরা। ফেরি ধরতে পারবে না বলেও এড়াতে পারল না রানা, ওর জন্যে আগেই মাল্টা। নেভির একটা পেট্রল বোট তৈরি রাখা হয়েছে, গোজোয় পৌঁছে দেবে ওকে। মেনিনো বলল, নিডোকে ফোন করেছিলাম, তাকে না পেয়ে ভায়োলার সাথে কথা। হয়েছে আমার। আপনাকে ফেয়ারওয়েল জানাবার জন্যে রুচিতাস-এ অপেক্ষা করবে সবাই।
স্কোয়াডের অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল। এক সময় রানাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে মেনিনো বলল, মাল্টায়, বিশেষ করে গোজোতে আপনার অনেক বন্ধু রয়েছে, মি. হাসান। আপনি যে কাজে যাচ্ছেন, তার ফলাফল যাই হোক, কথাটা কিন্তু ভুলবেন না।
ভুলব না,বলল রানা। অসংখ্য ধন্যবাদ।
গোজোয় পৌঁছে রানা দেখল আলফানসো আর মিলানো ওর জন্যে জেটিতে অপেক্ষা করছে, ওকে রুচিতাস-এ নিয়ে যাবে। বারের কাছাকাছি পৌঁছে হতবাক হয়ে গেল রানা। বারের ভেতর একশো জনের ওপর লোক ধরে, অথচ জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই উমো এসেছে, উমো এসেছে বলে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল ভিড়ের ভেতর থেকে।
উমো এসেছে মানে? জিজ্ঞেস করল রানা।
তোমার ডাক নাম, বলল আলফানসো।
মানেটা জিজ্ঞেস করতে হল না, জানে রানা ইটালিয়ান ভাষায় উমো মানে, পুরুষ। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, বহিরাগত কাউকে ডাকনাম দেয়া হয় না।
রানার সাথে যাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তারা তো আছেই, গোজোর কৃষক আর জেলেরাও দলবেধে ফেয়ারওয়েলু জানাতে এসেছে রানাকে। কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে, কিছুই কাউকে বলেনি রানা, অথচ সবাই যেন সব কিছু জানে। প্রসঙ্গটা কেউ তুলল না বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বোঝা গেল, রানার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনও আছে।
দরজার কাছে একটা টেবিলে বসেছে নিডোভায়োলা, অনোরিয়া আর তাজা। বারটেণ্ডার সাকো মগভর্তি বিয়ার ধরিয়ে দিল রানার হাতে, বলল, আমার তরফ থেকে।
রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?
ক্ষতি কি!
হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। চেয়ার ছেড়ে উঠল ভায়োলা, তার কাঁধে একটা। ব্যাগ। রানার হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল সে। প্যারিস থেকে জেনারেল। পাঠিয়েছেন। রানার অনুরোধ রক্ষা করেছেন তিনি।
খানিক পর বিদ্রোহী এসে ওর কাঁধে হাত রাখল, বলল, একটু বাইরে। আসবে? তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।
বার থেকে বেরিয়ে নির্জন একটা জায়গার খোঁজে বেশ কয়েক পা হেঁটে আসতে হল ওদেরকে। কি ব্যাপার, কালো?জানতে চাইল রানা।
রানার সামনে ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত লাগল বিদ্রোহীকে। উমো, ভারি গলায় বলল সে, কখনও যদি তোমার সাহায্য দরকার হয়, আর প্রথমে যদি। আমাকে না ডাক, আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব, হ্যাঁ।
রানা হাসল। তোমাকেই প্রথমে ডাকব, কথা দিলাম।
মাথা ঝাঁকাল বিদ্রোহী। স্রেফ রুচিতা’স-এ একটা তার পাঠিয়ে দেবে, সাকো জানে কোথায় আমাকে পাওয়া যাবে।
আবার বারে ফিরে এল ওরা। এরপর একে একে কিন্তু, ক্ষতি কি, গুঁফো, অক্লান্ত আর হাজির একইভাবে আড়ালে ডেকে নিয়ে একই কথা বলল রানাকে। সবাই ওরা সাহায্য করতে চায় রানাকে।
শেষবার বারে ফিরে এসে পাজেরো তাজাকে একপাশে ডেকে নিল রানা, বলল, তুমি আমার কাছে টাকা পাও, তাজা।
প্রৌঢ় অবাক হয়ে তাকাল, কিসের টাকা?
তোমার বাড়িতে এতদিন থাকলাম, খেলাম–এ-সবে টাকা লাগে।
একগাল হাসল তাজা। তা ঠিক। বেশ, হপ্তায় পনেরো পাউণ্ড চার্জ করলাম। আমি–এদিকে ফার্ম লেবাররা ওই পনেরো পাউণ্ডই মজুরি পায়, তারমানে কাটাকাটি হয়ে গেল। কথা শেষ করে বার কাউন্টারের দিকে চলে গেল সে। অসহায়ভাবে কাধ ঝাঁকাল রানা।
রাত বারোটার আগেই নিডো আর অনোরিয়াকে নিয়ে চলে গেল তাজা। ল্যাণ্ড রোভারটা ভায়োলা আর রানার জন্যে থাকল। বিদায় সম্বর্ধনা শেষ হতে দুটো বাজল। সবার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিল রানা, আবার একবার করে সবাইকে কথা দিতে হল, সাহায্য দরকার হলে প্রথমে গোজোর বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণ করবে ও। সবশেষে ভায়োলা ওর হাত ধরল, টেনে বের করে আনল বার। থেকে। পিছন দিক থেকে কে যেন বলল, জোড়া কিন্তু দারুণ মানিয়েছে, তাই না?
পাহাড়ী পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার, ভায়োলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রানা। প্রচুর বিয়ার খেয়েছে ও, কিন্তু নেশা হয়নি। ভায়োলা খুব বেশি খায়নি, কিন্তু বারে থাকতেই তার চোখে ঢুলু ঢুলু একটা ভাব লক্ষ করেছে ও। গভীর রাত, চারদিকে নির্জন বন-জঙ্গল, আর নিস্তব্ধ পাহাড়। শুধু কৌতূহল নয়, সেই সাথে পুলক অনুভব করল রানা। ভাবল, কি ব্যাপার, এভাবে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ভায়োলা?
আর ভায়োলা ভাবছে, দিন তো বেশ কটা কাটল, এখনও আমার মন বুঝতে পারেনি ও? অনেক বছর পর একজন পুরুষ আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সে কি সত্যি নির্লোভ দেবতা? নাকি ভালবাসতে জানে না, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে? এত কাছাকাছি থাকি, কিন্তু স্পর্শটুকুও পাই না–একি ওর ভদ্রতা, নাকি অনীহা? কিন্তু আমি তো অসুন্দরী নই! আমাকে পাবার জন্যে কত লোকই তো পাগল। তবে কি অহঙ্কারী ও? আশা করছে, প্রথম নিবেদন আমার তরফ থেকে আসুক?
পাহাড়ের মাথায় উঠে এল ল্যাণ্ড রোভার। ভায়োলার দৃষ্টি এখনও অনুভব করছে রানা। ভাবছে, ও কিছু বলে না কেন? কি করে বুঝব আমি ওকে কাছে টানলে ফোঁস করে উঠে ফণা তুলবে না? ওদের পরিবারের সবাই খুব সরল, আমার সাথে ওর এই ঘনিষ্ঠতা হয়ত সেই সরলতারই প্রকাশ, এর মধ্যে হয়ত আর কিছু নেই। হাত বাড়াতে দেখলে যদি চরিত্রহীন বলে গাল দিয়ে বসে?
পাহাড়ের মাথা থেকে নিচে নেমে এল ল্যাণ্ড রোভার। ডান পাশে সাগর, খানিকটা দূরে, পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। দুজনই ওরা আড়ষ্ট, ঘামছে একটু একটু, ঢোক গিলছে।
এভাবেই হয়ত বাড়ি ফিরত ওরা, বুকভরা বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে। কিন্তু ওদেরকে সাহায্য করল একটা জানোয়ার।
রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেল একটা শিয়াল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল রানা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শিয়ালটা, তারপর ঘুরে যেদিক। থেকে এসেছিল সেদিকেই ছুটে পালাল। ঝাঁকি খেয়ে রানার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ভায়োলা। গিয়ার পাল্টে আবার গাড়ি ছাড়তে গিয়ে অনুভব করল ও, ভায়োলার দুই হাত ওকে ছেড়ে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইল থেকে নামিয়ে নিল রানা।
এঞ্জিন বন্ধ হল। খুলে গেল মনের দুয়ার।
রানার কাঁধের ওপর মাথা রাখল ভায়োলা, ভায়োলার পিঠের ওপর ভাঁজ করা কনুই আর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা। কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না। তারপর কাঁধে। রানার হাতের চাপ অনুভব করল ভায়োলা। রানার কাঁধ থেকে মুখ তুলল সে, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে আছে। তাকে বুকে টেনে নিল রানা, দুই জোড়া ব্যাকুল ঠোঁট এক হল।
প্রথমে দীর্ঘ একটা চুমো–প্রচণ্ড তৃষ্ণায় এক ফোঁটা বৃষ্টির মত। তারপর মুষলধারে শুরু হল, উন্মত্ত আবেগে দুজনেই দিশেহারা।
তারপর এক সময় থামল ওরা। একবার যখন জ্বলেছে, এ আগুন নেভাতেও হবে।
শুনতে পাচ্ছ? ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল ভায়োলা।
কিসের কথা বলছে ভায়োলা বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করতে পারল রানা, অস্ফুটে বলল, হ্যাঁ। সাগর আমাদের ডাকছে। কিন্তু সাথে যে সুইমস্যুট নেই?
দরকার কি। বলেই রানার বুকে মুখ লুকাল ভায়োলা।
কেউ দেখলে চোখ কপালে উঠত তার, জড়াজড়ি করে গাড়ি থেকে নামার সময় কিম্ভূত আকৃতির দুমুখো একটা প্রাণী মনে হল ওদেরকে, যেন প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল একটা।
খুদে ইনলেটে চলে এল ওরা। পানির ওপর ঝুলে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে থাকল, দুটো শরীর পরস্পরের সাথে সেঁটে আছে। ডাইভ দিল না, ঢালু পাথরের ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে দুজন একসাথে ঝুপ করে পড়ল সাগরে।
পাহাড়ের এক কোণ থেকে সবই দেখল চাঁদ মামা। কানের পাশে ফিস ফিস করে সায় দিল ফুরফুরে বাতাস। গম্ভীর, ভরাট আওয়াজ তুলে একের পর এক ছুটে এল ঢেউগুলো, পিঠে তুলে নিল প্রকৃতির দুই নগ্ন সন্তানকে।
সাগর থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে। পেতে একটু সময় নিল দুজনেই। সাগর থেকে উঠে সমতল পাথরের ওপর শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে পেয়ে প্রথমে কথা বলল ভায়োলা।
অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু কিভাবে বলতে হয় জানি না।
আমি তোমাকে ভালবাসি, এভাবে শুরু করতে পার, মুচকি হেসে উৎসাহ দিল রানা।
কিন্তু হাসল না ভায়োলা, তবে সিরিয়াস দেখাল। একবার ঠকেছি, আর নয়–নিজেকে কারও সাথে বাধব না, কাউকে বিয়ে করব না, এভাবে যদি শুরু করি?
তাহলে জিজ্ঞেস করব, কাছে এলে কেন, কেন টানলে?
ভাল লেগেছে, তাই, ভায়োলার সরল জবাব। যতদিন তোমাকে ভাল লাগবে, আমি তোমার। কাছে গেলে যদি বুকে টেনে নাও, খুশি হব, কৃতজ্ঞবোধ করব। যদি ফিরিয়ে দাও, আহত হব, কিন্তু অভিশাপ দেব না ভালবাসার দাবি নিয়ে তোমাকে দখল করতে চাই না।
কিন্তু জীবন? ভবিষ্যৎ?
সে তো তোমাকে দেখার আগেই একটা ছকে ফেলে সাজিয়ে রেখেছি, বলল ভায়োলা। বিয়ে নয়, বাঁধন নয়, মুক্ত-স্বাধীন জীবন। আর ভবিষ্যৎ? হ্যাঁ, ভবিষ্যৎও ঠিক করা আছে, তবে তোমাকে দেখার পর একটু বদলাবে। আগের প্যানে কারও জন্যে অপেক্ষা ছিল না, এখন থাকবে। জানি, চলে যাবে তুমি। আর হয়ত কোন দিন দেখা হবে না। কিন্তু তবু আমি অপেক্ষা করব। যদি কখনও ফের, নিজেকে নিবেদন করে ধন্য হব। আর যদি না ফের, চলতে থাকবে অপেক্ষার পালা, শেষ হবে. সেই যেদিন মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যাবে আমাকে।
কাছের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে উঠতে দুজনেই ওরা চমকে উঠে তাকাল। সেই। ধাড়ী শিয়ালটা ঝোঁপের আড়াল থেকে মুখ বের করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখছ, কি রকম বিরক্ত হয়েছে ব্যাটা?
কেন, বিরক্ত হবে কেন? চোখ বড় বড় করল ভায়োলা।
ওদের মধ্যে বোধহয় এত দেরি করার রীতি নেই, হাসি চেপে বলল রানা। আমরা শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করছি, আসল কাজের নামও নিচ্ছি না, বিরক্ত হবে না তো কি!
হাত মুঠো করে কিল তুলল ভায়োলা, ঝট করে ভায়োলারই বুকের ভেতর মুখ লুকাল রানা। কিলটা পড়ল রানার চওড়া, ভিজে পিঠে। ভায়োলার বুকের ভেতর আরও একটু সেঁধিয়ে গেল রানার নাক-মুখ।
হুক্কা-হুয়া করে একটা ডাক ছাড়ল শিয়ালটা, তারপর ঝোপ টপকে ছুটল। বোধহয় সঙ্গিনীর খোঁজে।
রানা আর ভায়োলা তখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।
.
কি যেন জিজ্ঞেস করল ভায়োলা, অন্যমনস্ক ছিল বলে শুনতে পায়নি রানা। চাঁদের আলোয় ওদের নগ্ন শরীর ঘামে চকচক করছে। রানার পাশেই ভাঁজ করা হাঁটুর উপর চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা। শান্ত, মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল রানা।
বলল কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে। নেপলসে যখন এল তখন ওর মানসিক আর শারীরিক অবস্থা কি ছিল। রেমারিক আর রিসো কিভাবে ওকে যোগাড় করে দিল কাজটা। প্রথম দিকে লুবনার সঙ্গে কি রকম কঠোর ব্যবহার করেছিল ও, কিন্তু। ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে ধীরে ধীরে তার মন জয় করে নেয়।
এসব কথা ভায়োলাকে কেন বলছে রানা, ও নিজেও বোধহয় ভাল করে জানে না। কারণ হয়ত ভায়োলার নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন, কিংবা হয়ত রাতের নির্জন। পরিবেশটাই এমন যে বিদায় লগ্নে মনের সমস্ত ভার লাঘব করার একটা অবকাশ তৈরি করে দিয়েছে।
লুবনাকে নিয়ে পিকনিকে যাবার ঘটনাটাও বলল রানা। সেদিন লুবনা ওকে ছোট্ট একটা কোরান শরিফ উপহার দিয়েছিল। ওর নির্বাচিত শব্দগুলো জ্যান্ত করে, তুলল লুবনাকে, চোখের সামনে মেয়েটাকে পরিষ্কার যেন দেখতে পেল ভায়োলা। চঞ্চল, কৌতূহলী, কথায় কথায় ঠোঁট ফোলায়, আবার অকারণ আনন্দে খিল খিল করে হেসে ওঠে।
তারপর, শেষ দিনটা। কিডন্যাপাররা লুবনার পথরোধ করে দাঁড়াল। গুলি খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে রানা, চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল লুবনা সেই হাহাকার ধ্বনি আজও পরিষ্কার শুনতে পায় রানা। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে, জানে না বাচবে কিনা, কিন্তু বাঁচার প্রচণ্ড একটা আকুতি রয়েছে। এরপর রেমারিক এসে জানাল, লুবনা নেই। জানাল, কিভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
আর বলল সেই গানের কথা; যে গান ওকে ঘুমাতে দেয় না।
ভাঁজ করা হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা, তার লম্বা কালো চুলে। ঢাকা পড়ে আছে মুখ। অনেকক্ষণ হল চুপ করে গেছে রানা। পাথরের গায়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ, মনে হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। মুখ তুলল ভায়োলা, চাঁদের ম্লান আলোয় তার চোখে পানি চিকচিক করতে দেখল রানা। দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাবার। চেষ্টা করল ভায়োলা, রুদ্ধস্বরে বলল, মার, রানা! ওদের তুমি খুন কর! এমন, প্রতিশোধ নাও, মানুষ যেন শিউরে ওঠে!
ভাঁজ করা হাঁটুতে আবার মুখ ঢাকল ভায়োলা, তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠল। লুবনার জন্যে কাঁদছে সে। উঠে বসেছে রানা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, নির্বাক।
এক সময় শান্ত হল ভায়োলা। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল, যে-কাজে তুমি যাচ্ছ, ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু?
জানি না, অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল রানা। খুব কম, নেই বললেই চলে।
কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে…।
ভায়োলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল রানা। দেখল, ভায়োলার ঠোঁটের কোণে একটু ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে।
ফিরে আসতে হবে, তোমার কাছে?
হ্যাঁ, হাসিটা আরও একটু বড় হল ভায়োলার মুখে। আমার কাছে। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।
হেসে ফেলল রানা। চেষ্টার কোন ক্রটি করব না, কথা দিলাম।
যতদিন তুমি না ফের, রোজ সকালে চার্চে যাব আমি, অস্ফুটে বলল ভায়োলা। তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।
লোকটা মোটাসোটা, লম্বা, আঁটসাট ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরে আছে। কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ট্রানসিভার আর গ্রেনেড, হাতে স্টার্লিং সাবমেশিনগান। পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে, খোলা উঠনের ওপর দিয়ে ছুটে এসে হাঁপিয়ে, গেছে।
দোতলা একটা বাড়ি, ওপর তলায় উঠতে হবে তাকে। করিডর ধরে একটু একটু করে বাঁকের দিকে এগোল সে। জানে, বাকের পর আবার লম্বা একটা করিডর, শেষ মাথায় সিঁড়ি। কোণে এসে দাঁড়াল সে, তারপর নিচু হয়ে লাফ দিল। সামনে, স্টার্লিঙের ট্রিগার টেনে ধরেছে আঙুল।
গুলির একনাগাড় আওয়াজে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে লোকটাকে আসতে দেখল রানা, তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিনাটি সবকিছু লক্ষ করছে। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার দেয়ালে হেলান দিল লোকটা। খালি একটা ম্যাগাজিন পড়ল মেঝেতে, ক্লিক করে জায়গামত বসল। নতুন আরেকটা। মুখের কাছেট্র্যানসিভার তুলে বলল সে, ওপরে যাচ্ছে। রানার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল। রানা। বাড়ির চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ারের আরও আওয়াজ আসছে, মাঝে মধ্যে গ্রেনেড় ফাটছে দুএকটা।
.
এক এক করে পনেরোজনই বাগানে বেরিয়ে এল ওরা, পরনে এখনও সবার ক্যামোফ্লেজ গিয়ার, কথা বলছে উত্তেজিতভাবে। সবার পিছু পিছু এল পিওতর মেনিনো। নিচু একটা পাঁচিল দেখিয়ে সবাইকে বসতে বলল সে।
পাঁচ মিনিটের এক্সারসাইজ, কিন্তু ভিব্রিফিঙে সময় লাগল এক ঘন্টা। হামলার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে কথা বলল মেনিনো, কারও সমালোচনা করল, কারও প্রশংসা। পনেরোজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, পাশে রানা। স্কোয়াডের সবাই উৎসাহে ভরপুর, এটাই তাদের প্রথম ফুল-স্কেল এক্সারসাইজ, বিস্ফোরণের আওয়াজ আর ছুটোছুটি ওদেরকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। কথা শেষ করে রানার দিকে ফিরল। মেনিনো। এনি কমেন্ট?
সামনে এগোল রানা, স্কোয়াডের সবাই কিছু শুনতে পাবার আশায় স্থির হয়ে গেল।
সব মিলিয়ে ভাল, বলল রানা। খুশি হয়ে হেসে উঠল সবাই।
কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে, আট থেকে দশ জন মারা যেতে তোমরা, না হয় আহত হতে। মুছে গেল মুখের হাসি।
লম্বা মোটাসোটা যুবকের দিকে হাত তুলল রানা। মারাঞ্জানো, করিডর ধরে। আসার সময় দেয়াল ঘেষে ছিলে তুমি–ভুলে গিয়েছিলে ওটা একটা পাথরের। দেয়াল। শক্ত দেয়ালে বুলেট ঢোকে না, পিছলে যায়–সেজন্যেই বারবার, করিডরের মাঝখানে থাকতে বলা হয়েছে সবাইকে। মাঝখানে থাকলে তোমার মনে হবে শত্রু তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তবু মাঝখানে থাকাই। নিরাপদ। বাকটা ঘোরার সময় নিচু হয়ে ছিলে তুমি, কিন্তু তারপরই সিধে হয়ে গেলে। আরেকটা কথা, কোমর-সমান উঁচুতে লক্ষ্যস্থির করছিলে তুমি। শত্রু মেঝেতে শুয়ে থাকতে পারে, বাতাসে ওড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই সব সময় নিচের দিকে গুলি করতে হবে।
মাথা ঝাঁকাল মারাঞ্জানো, হতভম্ব দেখাল তাকে। কিন্তু রানা তাকে এখনও রেহাই দেয়নি।
আমি টেরোরিস্ট হলে, এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতে। ম্যাগাজিন বদলাতে অনেক বেশি সময় নিয়েছ। ওটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়, তোমার সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। সবাইকে বলছি, আরও প্র্যাকটিস কর। বাঁচতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই।
মাঝারি আকৃতির এক যুবকের দিকে ফিরল রানা। ডেগা, জোনাথনের পিছু পিছু দুনাম্বার কামরায় ঢুকলে তুমি। অথচ উচিত ছিল করিডর থেকে তিন আর চার নাম্বার কামরার দরজা কাভার দেয়া। কি আশা করেছিলে, দুনাম্বার কামরায় তোমার জন্যে কোন মেয়ে অপেক্ষা করছে?
হাসির হররা বয়ে গেল। সবাই জানে, ডেগা একজন রোমিও, মেয়ে দেখলে। পিছু ছাড়ে না।
স্কোয়াডের প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলল রানা। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকল মেনিনো, দোষ-ক্রটি আবিষ্কার আর সম্ভাবনার নতুন নতুন দিক উন্মোচনে রানার কৃতিত্ব দেখে বিস্মিত। তার লোকেরা সবাই ওর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কারণ একজন অভিজ্ঞ লোক কর্তৃত্বের সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় গলদ। ওরা সবাই রানাকে স্টার্লিঙের ম্যাগাজিন পাল্টাতে দেখল বিদ্যুৎ খেলে গেল হাতে, একটানা গুলিবর্ষণে বিরতি পড়ল কি পড়ল না। রানাকে হ্যাণ্ডগান, এস-এম জি আর কারবাইন চালাতেও দেখল ওরা–দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, দ্রুত। এর আগে তারা আন-আর্মড কমব্যাট প্র্যাকটিস করতে দেখেছে ওকে, ওর গতি আর রিফ্লেক্স দেখে মুগ্ধ হয়েছে। পনেরো জনের কারও বয়সই পঁচিশের বেশি। নয়, সবাই শক্ত-সমর্থ, কিন্তু জানে রানার সঙ্গে কেউ ওরা পারবে না। কাজেই ওর কথা মন দিয়ে শুনল সবাই।
সবশেষে মেনিনো, ধন্যবাদ জানাল রানাকে। বলল, বিল্ডিংটা আরও এক মাস আমাদের দখলে থাকবে, আমি চাই আরও দুটো এক্সারসাইজে আপনি থাকুন। এয়ার মাল্টার সাথে কথা হয়ে গেছে, দুঘন্টার জন্যে ওরা আমাদের একটা বোয়িং ধার দেবে। হাইজ্যাক অ্যাসল্টের মহড়া আপনি পরিচালনা করবেন।
রাজি হল রানা।
ওর আগের স্বাস্থ্য আর শক্তি ফিরে এসেছে, ফিরে পেয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতাও। নিয়মিত প্র্যাকটিস করে এখন শুধু ওগুলো ধরে রাখা।
.
একটা রুটিন করে নিয়েছে ভায়োলা।
ভোর অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তার, দোতলায় উঠে রানার দরজায় টোকা। দেয়। রানার সাড়া পেলে নিচে নেমে কফি তৈরি করে সে। আবার দোতলায় উঠে।
আসে, দেখে, ব্যায়াম শুরু করেছে রানা। বিছানায় বসে রানাকে ঘেমেনেয়ে উঠতে দেখে সে। তারপর চেয়ারে বসে কফি খায় রানা। তখনও. সূর্য ওঠে না, গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। চুপচাপ থাকে ওরা, দুএকটা কথা হয় কি হয় না। কফি শেষ করে, দৌড়াতে যায় রানা–এখন একটানা দশ মাইল দৌড়ায় ও। দৌড় শেষ করে খুদে ইনলেটে চলে আসে, এসে দেখে ভায়োলা সেখানে আগেই হাজির হয়েছে, ওর জন্যে কিছু একটা ঠাণ্ডা পানীয় আর তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছে। ডাইভ দিয়ে। পানিতে নামে রানা, তিন বার কোমিনো হয়ে ফিরে আসে। তারপর সমতল পাথরে আধ ঘন্টা শুয়ে থাকে, ওর পাশে বসে বা শুয়ে থাকে ভায়োলা।
ব্রেকফাস্ট সেরে পাহাড়ে চলে যায় রানা, তাজা আর নিডোর সঙ্গে মাটি কাটার কাজ করে।
সন্ধের সময় আবার রানার সঙ্গে দেখা হয় ভায়োলার, খুদে ইনলেটে সাঁতার। কাটে দুজন। তখন ওদের মধ্যে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ কেউ তোলে না, অতীত আর ভবিষ্যতের কথা দুজনেই সচেতনভাবে এড়িয়ে। যায়। আভাসে জানিয়ে দিয়েছে ভায়োলা, তার কোন প্রত্যাশা নেই, কিন্তু ভাল লাগা আছে, আছে সমর্থন আর সহানুভূতি। সেবা, শুশ্রূষা আর সঙ্গ দিয়ে নিজেই তৃপ্তি পেতে চায় সে; অনুরোধ–নারীসুলভ তার এই আচরণকে যেন অন্য চোখে দেখা না হয়।
মাঝে মধ্যে রানাকে হাসতে দেখে ভায়োলা, অদ্ভুত একটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। তার অন্তর। রেমারিকের কাছে শুনেছে সে, অসহনীয় একটা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে। আছে এই লোকের মন। রেমারিকের সাথে আরও কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তার, রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে এক-আধটু আভাস পেয়েছে সে।
প্রথম দিকে একটু ধাঁধা লাগলেও, এখন রানা ভায়োলাকে বুঝতে পারে। অসাধারণ, বুদ্ধিমতী সে, মনটা ফুলের মত কোমল। কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, সত্যিকার পৌরুষ আছে এই রকম পুরুষ মানুষের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে, সে। হতে পারে স্বামীর সঙ্গে যে-কারণে ঘর করতে পারেনি, এ তারই প্রতিক্রিয়া।
সময় বয়ে চলল, কিন্তু ওদের সম্পর্ক আগের মতই থাকল। ভায়োলা সব সময় রানার কাছাকাছি আছে, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ হবার কোন চেষ্টা নেই তার। নাগালের মধ্যে রয়েছে ভায়োলা, কিন্তু কখনও হাত বাড়াবার কোন প্রবণতা রানার মধ্যে দেখা যায় না।
রানা একদিন মৃদু কণ্ঠে বলল, আর দিন দশেক পর রওনা হব আমি। মার্সেলেসে যেতে হবে আমাকে। দেখি আজ যদি পারি জাহাজের শিডিউল চেক করে আসব।
সে তো আমিই পারি, বলল ভায়োলা। ভ্যালেটায় একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে, আমার এক বান্ধবী কাজ করে। যতদূর মনে পড়ছে, হপ্তায় একটা করে জাহাজ যায়–বন পুয়ারো।
পরদিন রেমারিকের চিঠি পৌঁছুল।
স্পষ্ট, খুদে হস্তাক্ষরে চার পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রেমারিক। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা টিকেটের অর্ধেক পিন দিয়ে আটকানো। মার্সেলেন্স রেলওয়ে স্টেশনের। ব্যাগেজরূমের টিকেট ওটা।
সে-রাতে দুটো চিঠি লিখল রানা। প্রথমটা ঢাকায়, মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের কাছে। চিঠিতে সি. আই. এ-র মতিগতি কি রকম জানতে চাইল সে। লিখল, শুধু ভাল কোন খবর থাকলে বি. সি. আই রেমারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর, একটা ইকুইপমেন্টের জন্যে অনুরোধ করল রানা, মার্সেলেসে, পোস্ট রেসতাত-এ পাঠাতে হবে।
দ্বিতীয় চিঠিটা লিখল ফেঞ্চ আর্মির একজন জেনারেলকে। এই ফ্রেঞ্চ জেনারেল কিছু ব্যাপারে রানার প্রতি দুর্বল। লেবাননে পাঠানো জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীতে ছিলেন তিনি, খ্রিস্টান ফ্যালাঞ্জিস্টদের গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। রানা তাকে কাঁধে তুলে নেয়, তিন ঘন্টা হেঁটে, পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। এই জেনারেলকেও একটা পার্সেলের জন্যে লিখল রানা।
.
কাল সকালে গোজো ছেড়ে চলে যাবে রানা।
স্কোয়াডের শেষ মহড়াটাও পরিচালনা করল ও। সবারই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, মেনিনো আর রানার সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াল ব্রা, নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই বেশি জুটল কপালে।
রানার এটা শেষ সেশন, তাই ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্কের জন্যে জেদ ধরল ওরা। ফেরি ধরতে পারবে না বলেও এড়াতে পারল না রানা, ওর জন্যে আগেই মাল্টা। নেভির একটা পেট্রল বোট তৈরি রাখা হয়েছে, গোজোয় পৌঁছে দেবে ওকে। মেনিনো বলল, নিডোকে ফোন করেছিলাম, তাকে না পেয়ে ভায়োলার সাথে কথা। হয়েছে আমার। আপনাকে ফেয়ারওয়েল জানাবার জন্যে রুচিতাস-এ অপেক্ষা করবে সবাই।
স্কোয়াডের অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল। এক সময় রানাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে মেনিনো বলল, মাল্টায়, বিশেষ করে গোজোতে আপনার অনেক বন্ধু রয়েছে, মি. হাসান। আপনি যে কাজে যাচ্ছেন, তার ফলাফল যাই হোক, কথাটা কিন্তু ভুলবেন না।
ভুলব না,বলল রানা। অসংখ্য ধন্যবাদ।
গোজোয় পৌঁছে রানা দেখল আলফানসো আর মিলানো ওর জন্যে জেটিতে অপেক্ষা করছে, ওকে রুচিতাস-এ নিয়ে যাবে। বারের কাছাকাছি পৌঁছে হতবাক হয়ে গেল রানা। বারের ভেতর একশো জনের ওপর লোক ধরে, অথচ জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই উমো এসেছে, উমো এসেছে বলে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল ভিড়ের ভেতর থেকে।
উমো এসেছে মানে? জিজ্ঞেস করল রানা।
তোমার ডাক নাম, বলল আলফানসো।
মানেটা জিজ্ঞেস করতে হল না, জানে রানা ইটালিয়ান ভাষায় উমো মানে, পুরুষ। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, বহিরাগত কাউকে ডাকনাম দেয়া হয় না।
রানার সাথে যাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তারা তো আছেই, গোজোর কৃষক আর জেলেরাও দলবেধে ফেয়ারওয়েলু জানাতে এসেছে রানাকে। কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে, কিছুই কাউকে বলেনি রানা, অথচ সবাই যেন সব কিছু জানে। প্রসঙ্গটা কেউ তুলল না বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বোঝা গেল, রানার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনও আছে।
দরজার কাছে একটা টেবিলে বসেছে নিডোভায়োলা, অনোরিয়া আর তাজা। বারটেণ্ডার সাকো মগভর্তি বিয়ার ধরিয়ে দিল রানার হাতে, বলল, আমার তরফ থেকে।
রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?
ক্ষতি কি!
হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। চেয়ার ছেড়ে উঠল ভায়োলা, তার কাঁধে একটা। ব্যাগ। রানার হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল সে। প্যারিস থেকে জেনারেল। পাঠিয়েছেন। রানার অনুরোধ রক্ষা করেছেন তিনি।
খানিক পর বিদ্রোহী এসে ওর কাঁধে হাত রাখল, বলল, একটু বাইরে। আসবে? তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।
বার থেকে বেরিয়ে নির্জন একটা জায়গার খোঁজে বেশ কয়েক পা হেঁটে আসতে হল ওদেরকে। কি ব্যাপার, কালো?জানতে চাইল রানা।
রানার সামনে ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত লাগল বিদ্রোহীকে। উমো, ভারি গলায় বলল সে, কখনও যদি তোমার সাহায্য দরকার হয়, আর প্রথমে যদি। আমাকে না ডাক, আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব, হ্যাঁ।
রানা হাসল। তোমাকেই প্রথমে ডাকব, কথা দিলাম।
মাথা ঝাঁকাল বিদ্রোহী। স্রেফ রুচিতা’স-এ একটা তার পাঠিয়ে দেবে, সাকো জানে কোথায় আমাকে পাওয়া যাবে।
আবার বারে ফিরে এল ওরা। এরপর একে একে কিন্তু, ক্ষতি কি, গুঁফো, অক্লান্ত আর হাজির একইভাবে আড়ালে ডেকে নিয়ে একই কথা বলল রানাকে। সবাই ওরা সাহায্য করতে চায় রানাকে।
শেষবার বারে ফিরে এসে পাজেরো তাজাকে একপাশে ডেকে নিল রানা, বলল, তুমি আমার কাছে টাকা পাও, তাজা।
প্রৌঢ় অবাক হয়ে তাকাল, কিসের টাকা?
তোমার বাড়িতে এতদিন থাকলাম, খেলাম–এ-সবে টাকা লাগে।
একগাল হাসল তাজা। তা ঠিক। বেশ, হপ্তায় পনেরো পাউণ্ড চার্জ করলাম। আমি–এদিকে ফার্ম লেবাররা ওই পনেরো পাউণ্ডই মজুরি পায়, তারমানে কাটাকাটি হয়ে গেল। কথা শেষ করে বার কাউন্টারের দিকে চলে গেল সে। অসহায়ভাবে কাধ ঝাঁকাল রানা।
রাত বারোটার আগেই নিডো আর অনোরিয়াকে নিয়ে চলে গেল তাজা। ল্যাণ্ড রোভারটা ভায়োলা আর রানার জন্যে থাকল। বিদায় সম্বর্ধনা শেষ হতে দুটো বাজল। সবার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিল রানা, আবার একবার করে সবাইকে কথা দিতে হল, সাহায্য দরকার হলে প্রথমে গোজোর বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণ করবে ও। সবশেষে ভায়োলা ওর হাত ধরল, টেনে বের করে আনল বার। থেকে। পিছন দিক থেকে কে যেন বলল, জোড়া কিন্তু দারুণ মানিয়েছে, তাই না?
পাহাড়ী পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার, ভায়োলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রানা। প্রচুর বিয়ার খেয়েছে ও, কিন্তু নেশা হয়নি। ভায়োলা খুব বেশি খায়নি, কিন্তু বারে থাকতেই তার চোখে ঢুলু ঢুলু একটা ভাব লক্ষ করেছে ও। গভীর রাত, চারদিকে নির্জন বন-জঙ্গল, আর নিস্তব্ধ পাহাড়। শুধু কৌতূহল নয়, সেই সাথে পুলক অনুভব করল রানা। ভাবল, কি ব্যাপার, এভাবে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ভায়োলা?
আর ভায়োলা ভাবছে, দিন তো বেশ কটা কাটল, এখনও আমার মন বুঝতে পারেনি ও? অনেক বছর পর একজন পুরুষ আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সে কি সত্যি নির্লোভ দেবতা? নাকি ভালবাসতে জানে না, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে? এত কাছাকাছি থাকি, কিন্তু স্পর্শটুকুও পাই না–একি ওর ভদ্রতা, নাকি অনীহা? কিন্তু আমি তো অসুন্দরী নই! আমাকে পাবার জন্যে কত লোকই তো পাগল। তবে কি অহঙ্কারী ও? আশা করছে, প্রথম নিবেদন আমার তরফ থেকে আসুক?
পাহাড়ের মাথায় উঠে এল ল্যাণ্ড রোভার। ভায়োলার দৃষ্টি এখনও অনুভব করছে রানা। ভাবছে, ও কিছু বলে না কেন? কি করে বুঝব আমি ওকে কাছে টানলে ফোঁস করে উঠে ফণা তুলবে না? ওদের পরিবারের সবাই খুব সরল, আমার সাথে ওর এই ঘনিষ্ঠতা হয়ত সেই সরলতারই প্রকাশ, এর মধ্যে হয়ত আর কিছু নেই। হাত বাড়াতে দেখলে যদি চরিত্রহীন বলে গাল দিয়ে বসে?
পাহাড়ের মাথা থেকে নিচে নেমে এল ল্যাণ্ড রোভার। ডান পাশে সাগর, খানিকটা দূরে, পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। দুজনই ওরা আড়ষ্ট, ঘামছে একটু একটু, ঢোক গিলছে।
এভাবেই হয়ত বাড়ি ফিরত ওরা, বুকভরা বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে। কিন্তু ওদেরকে সাহায্য করল একটা জানোয়ার।
রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেল একটা শিয়াল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল রানা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শিয়ালটা, তারপর ঘুরে যেদিক। থেকে এসেছিল সেদিকেই ছুটে পালাল। ঝাঁকি খেয়ে রানার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ভায়োলা। গিয়ার পাল্টে আবার গাড়ি ছাড়তে গিয়ে অনুভব করল ও, ভায়োলার দুই হাত ওকে ছেড়ে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইল থেকে নামিয়ে নিল রানা।
এঞ্জিন বন্ধ হল। খুলে গেল মনের দুয়ার।
রানার কাঁধের ওপর মাথা রাখল ভায়োলা, ভায়োলার পিঠের ওপর ভাঁজ করা কনুই আর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা। কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না। তারপর কাঁধে। রানার হাতের চাপ অনুভব করল ভায়োলা। রানার কাঁধ থেকে মুখ তুলল সে, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে আছে। তাকে বুকে টেনে নিল রানা, দুই জোড়া ব্যাকুল ঠোঁট এক হল।
প্রথমে দীর্ঘ একটা চুমো–প্রচণ্ড তৃষ্ণায় এক ফোঁটা বৃষ্টির মত। তারপর মুষলধারে শুরু হল, উন্মত্ত আবেগে দুজনেই দিশেহারা।
তারপর এক সময় থামল ওরা। একবার যখন জ্বলেছে, এ আগুন নেভাতেও হবে।
শুনতে পাচ্ছ? ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল ভায়োলা।
কিসের কথা বলছে ভায়োলা বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করতে পারল রানা, অস্ফুটে বলল, হ্যাঁ। সাগর আমাদের ডাকছে। কিন্তু সাথে যে সুইমস্যুট নেই?
দরকার কি। বলেই রানার বুকে মুখ লুকাল ভায়োলা।
কেউ দেখলে চোখ কপালে উঠত তার, জড়াজড়ি করে গাড়ি থেকে নামার সময় কিম্ভূত আকৃতির দুমুখো একটা প্রাণী মনে হল ওদেরকে, যেন প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল একটা।
খুদে ইনলেটে চলে এল ওরা। পানির ওপর ঝুলে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে থাকল, দুটো শরীর পরস্পরের সাথে সেঁটে আছে। ডাইভ দিল না, ঢালু পাথরের ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে দুজন একসাথে ঝুপ করে পড়ল সাগরে।
পাহাড়ের এক কোণ থেকে সবই দেখল চাঁদ মামা। কানের পাশে ফিস ফিস করে সায় দিল ফুরফুরে বাতাস। গম্ভীর, ভরাট আওয়াজ তুলে একের পর এক ছুটে এল ঢেউগুলো, পিঠে তুলে নিল প্রকৃতির দুই নগ্ন সন্তানকে।
সাগর থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে। পেতে একটু সময় নিল দুজনেই। সাগর থেকে উঠে সমতল পাথরের ওপর শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে পেয়ে প্রথমে কথা বলল ভায়োলা।
অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু কিভাবে বলতে হয় জানি না।
আমি তোমাকে ভালবাসি, এভাবে শুরু করতে পার, মুচকি হেসে উৎসাহ দিল রানা।
কিন্তু হাসল না ভায়োলা, তবে সিরিয়াস দেখাল। একবার ঠকেছি, আর নয়–নিজেকে কারও সাথে বাধব না, কাউকে বিয়ে করব না, এভাবে যদি শুরু করি?
তাহলে জিজ্ঞেস করব, কাছে এলে কেন, কেন টানলে?
ভাল লেগেছে, তাই, ভায়োলার সরল জবাব। যতদিন তোমাকে ভাল লাগবে, আমি তোমার। কাছে গেলে যদি বুকে টেনে নাও, খুশি হব, কৃতজ্ঞবোধ করব। যদি ফিরিয়ে দাও, আহত হব, কিন্তু অভিশাপ দেব না ভালবাসার দাবি নিয়ে তোমাকে দখল করতে চাই না।
কিন্তু জীবন? ভবিষ্যৎ?
সে তো তোমাকে দেখার আগেই একটা ছকে ফেলে সাজিয়ে রেখেছি, বলল ভায়োলা। বিয়ে নয়, বাঁধন নয়, মুক্ত-স্বাধীন জীবন। আর ভবিষ্যৎ? হ্যাঁ, ভবিষ্যৎও ঠিক করা আছে, তবে তোমাকে দেখার পর একটু বদলাবে। আগের প্যানে কারও জন্যে অপেক্ষা ছিল না, এখন থাকবে। জানি, চলে যাবে তুমি। আর হয়ত কোন দিন দেখা হবে না। কিন্তু তবু আমি অপেক্ষা করব। যদি কখনও ফের, নিজেকে নিবেদন করে ধন্য হব। আর যদি না ফের, চলতে থাকবে অপেক্ষার পালা, শেষ হবে. সেই যেদিন মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যাবে আমাকে।
কাছের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে উঠতে দুজনেই ওরা চমকে উঠে তাকাল। সেই। ধাড়ী শিয়ালটা ঝোঁপের আড়াল থেকে মুখ বের করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখছ, কি রকম বিরক্ত হয়েছে ব্যাটা?
কেন, বিরক্ত হবে কেন? চোখ বড় বড় করল ভায়োলা।
ওদের মধ্যে বোধহয় এত দেরি করার রীতি নেই, হাসি চেপে বলল রানা। আমরা শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করছি, আসল কাজের নামও নিচ্ছি না, বিরক্ত হবে না তো কি!
হাত মুঠো করে কিল তুলল ভায়োলা, ঝট করে ভায়োলারই বুকের ভেতর মুখ লুকাল রানা। কিলটা পড়ল রানার চওড়া, ভিজে পিঠে। ভায়োলার বুকের ভেতর আরও একটু সেঁধিয়ে গেল রানার নাক-মুখ।
হুক্কা-হুয়া করে একটা ডাক ছাড়ল শিয়ালটা, তারপর ঝোপ টপকে ছুটল। বোধহয় সঙ্গিনীর খোঁজে।
রানা আর ভায়োলা তখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।
.
কি যেন জিজ্ঞেস করল ভায়োলা, অন্যমনস্ক ছিল বলে শুনতে পায়নি রানা। চাঁদের আলোয় ওদের নগ্ন শরীর ঘামে চকচক করছে। রানার পাশেই ভাঁজ করা হাঁটুর উপর চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা। শান্ত, মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল রানা।
বলল কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে। নেপলসে যখন এল তখন ওর মানসিক আর শারীরিক অবস্থা কি ছিল। রেমারিক আর রিসো কিভাবে ওকে যোগাড় করে দিল কাজটা। প্রথম দিকে লুবনার সঙ্গে কি রকম কঠোর ব্যবহার করেছিল ও, কিন্তু। ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে ধীরে ধীরে তার মন জয় করে নেয়।
এসব কথা ভায়োলাকে কেন বলছে রানা, ও নিজেও বোধহয় ভাল করে জানে না। কারণ হয়ত ভায়োলার নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন, কিংবা হয়ত রাতের নির্জন। পরিবেশটাই এমন যে বিদায় লগ্নে মনের সমস্ত ভার লাঘব করার একটা অবকাশ তৈরি করে দিয়েছে।
লুবনাকে নিয়ে পিকনিকে যাবার ঘটনাটাও বলল রানা। সেদিন লুবনা ওকে ছোট্ট একটা কোরান শরিফ উপহার দিয়েছিল। ওর নির্বাচিত শব্দগুলো জ্যান্ত করে, তুলল লুবনাকে, চোখের সামনে মেয়েটাকে পরিষ্কার যেন দেখতে পেল ভায়োলা। চঞ্চল, কৌতূহলী, কথায় কথায় ঠোঁট ফোলায়, আবার অকারণ আনন্দে খিল খিল করে হেসে ওঠে।
তারপর, শেষ দিনটা। কিডন্যাপাররা লুবনার পথরোধ করে দাঁড়াল। গুলি খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে রানা, চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল লুবনা সেই হাহাকার ধ্বনি আজও পরিষ্কার শুনতে পায় রানা। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে, জানে না বাচবে কিনা, কিন্তু বাঁচার প্রচণ্ড একটা আকুতি রয়েছে। এরপর রেমারিক এসে জানাল, লুবনা নেই। জানাল, কিভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
আর বলল সেই গানের কথা; যে গান ওকে ঘুমাতে দেয় না।
ভাঁজ করা হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা, তার লম্বা কালো চুলে। ঢাকা পড়ে আছে মুখ। অনেকক্ষণ হল চুপ করে গেছে রানা। পাথরের গায়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ, মনে হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। মুখ তুলল ভায়োলা, চাঁদের ম্লান আলোয় তার চোখে পানি চিকচিক করতে দেখল রানা। দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাবার। চেষ্টা করল ভায়োলা, রুদ্ধস্বরে বলল, মার, রানা! ওদের তুমি খুন কর! এমন, প্রতিশোধ নাও, মানুষ যেন শিউরে ওঠে!
ভাঁজ করা হাঁটুতে আবার মুখ ঢাকল ভায়োলা, তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠল। লুবনার জন্যে কাঁদছে সে। উঠে বসেছে রানা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, নির্বাক।
এক সময় শান্ত হল ভায়োলা। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল, যে-কাজে তুমি যাচ্ছ, ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু?
জানি না, অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল রানা। খুব কম, নেই বললেই চলে।
কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে…।
ভায়োলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল রানা। দেখল, ভায়োলার ঠোঁটের কোণে একটু ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে।
ফিরে আসতে হবে, তোমার কাছে?
হ্যাঁ, হাসিটা আরও একটু বড় হল ভায়োলার মুখে। আমার কাছে। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।
হেসে ফেলল রানা। চেষ্টার কোন ক্রটি করব না, কথা দিলাম।
যতদিন তুমি না ফের, রোজ সকালে চার্চে যাব আমি, অস্ফুটে বলল ভায়োলা। তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।