০৩.
প্রেজো ফিসো বোর্ডিং হাউজ অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্ট।
ভোরের আলো মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। প্রেজো ফিসোর মালিক, ভিটেল রেমারিক, চোরের মত পা টিপে টিপে বারান্দা ধরে নিজের অফিস ঘরের দিকে এগোল। ত্রিশ বছর বয়স, সুঠাম স্বাস্থ্য, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, চোখে বুদ্ধি ঝিলিক। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভুরু কুঁচকে আছে, দৃষ্টিতে বিস্ময় মেশান উদ্বেগ দূর থেকেই দেখা গেল, দরজা হাঁ-হাঁ করছে।
দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে, সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর তাকাল। ভেতরের অস্পষ্ট আলোয় পরিষ্কার কিছুই দেখা গেল না। চারকোনা একটা কালো। কাঠামো, ওটা নিশ্চয়ই ডেস্ক। লম্বা আরও একটা আকৃতি, ওটা আলমিরা। ডেস্কের সামনে কালো আরও একটা কি যেন রয়েছে চেয়ার। ঘরের ভেতর থেকে ভারি নিঃশ্বাস পতনের আওয়াজ আসছে।
কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থাকার পর ভিটেলা রেমারিক বুঝল, চেয়ারটা সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে কেউ একজন বসে আছে ওতে। আলো আরও একটু না ফুটতে লোকটাকে পরিষ্কার দেখা যাবে না। তারমানে এখানেই তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
পজিটানোয় অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছিল ভিটেলা রেমারিক। রা, বারোটায় এখান থেকে তাকে ফোন করে ফুরেলা জানায়, একজন এসেছেন, নাম বলছেন ইমরুল হাসান, তার অনুমতি না নিয়েই মালিকের অফিস ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার দখল করে বসে আছেন।
ইমরুল হাসান! স্মৃতির পাতা উল্টে এই নামের কাউকে চিনতে পারেনি। ভিটেলা রেমারিক। খানিক চিন্তাভাবনা করার পর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল তার মনে। আমি একটা বোকা, নিজেকে তিরস্কার করল সে। লোকটা অনুমতির ধার না ধেরে সোজা তার ঘরে ঢুকে পড়েছে, এ থেকেই কি তার পরিচয় বেরিয়ে আসে না?
এরপর অসুস্থ মাকে চুমো খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
দিনের আলো একটু একটু করে বাড়ছে, সেই সাথে পরিষ্কার হচ্ছে লোকটার। চেহারা। উঁহু, এ লোক মাসুদ রানা, নয়। মুখ ভরা আধ ইঞ্চি লম্বা কালো দাড়ি, বা। চোখের নিচে আর কপালের ডান দিক ঘেঁষে দুটো কাটা দাগ, মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, মুখটা ভরাট, চোখের নিচে পোটলা। ঘর থেকে ভুর ভুর করে হুইস্কির গন্ধ বেরিয়ে আসছে।
আজ পাঁচ বছর। পাঁচ বছরে কি একটা মানুষ এত বদলাতে পারে? নাহ, কোথায় সেই একহারা গড়ন, মেদহীন পেটা শরীর? চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে ওটা. একটা পাড় মাতাল, কিন্তু ও জানে, মাসুদ রানা মদ স্পর্শ করে না। তাছাড়া, রানার চেয়ে এই লোকের বয়স অনেক বেশি–পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশও হতে পারে।
দিনের আলো পরিষ্কার হল। চেয়ারের পাশে হুইস্কির একটা খালি বোতলও এখন দেখতে পাচ্ছে ভিটেলা রেমারিক। একটা ভুল ভাঙলো তার, লোকটা ঘুমাচ্ছে না। চোখ জোড়া বড় বড়, ভারি পাতা, জানালা দিয়ে সাগর আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।
এই চোখ জোড়াই ভুল ভেঙে দিল তার। মায়াভরা এই চোখ কি ভোলা যায়। বয়স আর চেহারা মেলে না, তার কারণটাও পরিষ্কার হল। রানা ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।
বন্ধুকে চিনতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেল ভিটেলা রেমারিক। এক নিমেষে বহু। কিছু বুঝে নিল সে। হতভম্ব ভাবটা দূর হল, তার জায়গায় দেখা দিল সতর্কতা। ঘরে ঢুকল না সে, শুধু দোরগোড়ায় দাঁড়াল।
দিগন্তরেখায় তখন উঁকি দিচ্ছে নতুন সূর্য। সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আগেই টের পেয়েছে রানা, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। এবার সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে চেয়ারের ওপর সিধে হয়ে বসল ও, বলল, আমি হাসান। কেমন আছ, দোস্ত?
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রেমারিক। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল সে। বন্ধুর সামনে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, সে তাহলে লুকিয়ে পড়েছে?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। হ্যাঁ।
দুই বন্ধু সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পরস্পরকে দেখছে। প্রথমে ক্ষীণ একটু হাসি। দেখা গেল রানার ঠোঁটে। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেই হাসি। বন্ধু বিপদে পড়েছে, এটুকু বুঝতে পেরেছে রেমাক্সিক, সেজন্যে শরীরের সমস্ত পেশী টান টান। হয়ে আছে তার। মুখে হাসি ফুটতে তাই একটু দেরি হল। পরস্পরকে আলিঙ্গন করল ওরা। বুকে বুক ঠেকিয়ে দুজন্য দুজনকে যেন পিষছে। কোন কারণ নেই, আবার আরেক অর্থে কারণের কোন অভাব নেই, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। রেমারিকের। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ উচ্চারণ করল সে, কফি।
মাথা ঝাঁকাল রানা। কিন্তু ছেড়ে দেয়ার আগে লম্বা করা হাত দুটো বন্ধুর কাঁধে রেখে খুটিয়ে তাকে দেখল, আরেকবার। তারপর হাত নামিয়ে নিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে।
বোর্ডিং, রেস্তোরাঁ আর অফিস, বিল্ডিংটা এই তিন ভাগে ভাগ করা। অফিসের পাশে রেমারিকের জন্যে একটা শোবার ঘর আর খুদে একটা কিচেনও আছে। সেই কিচেনে এসে ঢুকল রেমারিক, ভারি উদ্বিগ্ন। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই রানার, এ. থেকে বোঝা যায় ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে। তার বন্ধু নিজেকে সুস্থ আর সবল রাখার জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু করত, অথচ আজ সে মদ খায়, শরীরে মেদ জমেছে। রেমারিক জানে, ইচ্ছে বা দরকার না হলে নিজের বিপদের কথা প্রকাশ করবে না। রানা। ওদের বন্ধুত্বটা এমনই, রানা না বললে সে-ও কিছু জানতে চাইবে না। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অতীত রোমন্থন করল রেমারিক। রানার অনেক কিছুই জানে না সে, তার কাছে ও এক রহস্যময় চরিত্র। কিন্তু না জানা ব্যাপারগুলো তাকে কখনও বিরক্ত বা কৌতূহলী করে তোলে না। রানাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া সাতজন্মের ভাগ্য, সেটা পেয়েই কৃতজ্ঞ সে। মনে পড়ল, শেষবার দুজনের দেখা হয়েছিল জেসমিনের মৃত্যুর পর।
তারপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কি ঘটেছে এই পাঁচ বছরে?
সেবার দুহপ্তা এখানে ছিল রানা, বরাবরের মত শান্ত আর চুপচাপ। কিন্তু রানার নিরুপদ্রব উপস্থিতি প্রয়োজনের সময় বরাবরের মতই শক্তি যুগিয়েছে। তাকে, গিঁট দিয়েছে ছিঁড়ে যাওয়া সুতোয়।
পাহাড়ের পাশে, চূড়োর কাছাকাছি উঠে এসেছে সূর্য। অফিস ঘরে ফিরে এল রেমারিক। বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালা দিয়ে দেখা গেল, নেপলস জেগে উঠছে। বে-তে নোঙর ফেলেছে একটা যুদ্ধ জাহাজ, আরও সামনে। বিশাল একটা লাইনারের পিছন দিকটা দেখা গেল। টেবিলে ট্রে রেখে অপেক্ষা করছে রেমারিক। ২ বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে ডেস্কের পিছনের চেয়ারটায় বসল রানা। পট থেকে কফি ঢেলে দুধ চিনি মেশাল রেমারিক। চুপচাপ বসে কফির কাপে চুমুক দিল দুজন। দুজনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল রানাই, অসুবিধে করলাম?
স্নান একটু হাসল রেমারিক। মা। তার সেই রহস্যময় অসুস্থতা।
দুএকমাস পর পর হাঁটুতে আর কোমরে ব্যথা, হেঁটে চার্চে যেতে পারে না বলে কান্নাকাটি। হাসছে রানা।
হ্যাঁ।
বাত, বলল রানা। নতুন একটা ওষুধ বেরিয়েছে, জেনেভা থেকে নিয়ে এসেছি আমি। ফেলে চলে এলে কেন?
আজ সকালে মিলান থেকে রিসো আসছে, বলল রেমারিক। বলছু বটে। বাত, কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। যখনই মনে হয় তার প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে, তখনই এই অসুস্থতা দেখা দেয়। আমার জন্যে তেমন সমস্যা নয়, মাত্র চল্লিশ মিনিটের পথ। কিন্তু রিসোর বারোটা বেজে যায়।
কেমন আছে রিসো?
ভাল। গত বছর ওর কোম্পানি ওকে পার্টনার করে নিয়েছে। আরেকটা বাচ্চা হয়েছে ওর ছেলে।
আবার কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকল ওরা। প্রশান্ত নিস্তব্ধতা, শুধুমাত্র দীর্ঘদিনের প্রিয় দুই বন্ধুর উপস্থিতিতেই সম্ভব, যোগাযোগ, অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে মুখ না খুললেও ওদের চলে। লাইনারটা যখন প্রায় দিগন্ত রেখায় পৌঁছে গেছে, আবার কথা বলল রেমারিক। তুমি ক্লান্ত। এস, বিছানাটা দেখিয়ে দিই।
উঠে দাঁড়াল রানা। আর তুমি? তুমিও তো সারারাত ঘুমাওনি।
লাঞ্চের পর ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে নিলেই আমার চলবে। কিছুদিন থাকতে পারবে তো, নাকি?
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আমার কোন প্ল্যান নেই, রেমারিক। হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ল, চলে এলাম।
মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। তাহলে তো ভালই। অনেকদিন পর এলে। কোন কাজের মধ্যে আছ?
ছমাস ধরে নেই। কর্সিকা থেকে সরাসরি আসছি আমি।
দরজার দিকে হাঁটছিল ওরা, কথাটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রেমারিক। ঢাকা থেকে নয়? সরাসরি দেশ থেকে আসছ না?
আবার কাঁধ ঝাঁকাল রানা। না। কোন প্রশ্ন কোরো না। শুধু জেন, বন্ধু-বান্ধব কারও সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। মার্সেলেসে এসে তোমার কথা মনে পড়ল, ঝোঁকের মাথায় চলে এলাম।
রেমারিকের চোখে ঝিক করে উঠল কৌতুক। ঝোঁকের মাথায়? তুমি? হাসতে লাগল সে।
রানার মুখেও ক্লান্ত হাসি দেখা গেল। রাতে কথা হবে। তোমার সেই বিছানাটা কোথায়?
.
কিচেন টেবিলে বসে আছে রেমারিক, বাজার থেকে ফিরে আসবে ফুরেলা, তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বোর্ডিং সেকশনে ছয়টা কামরা, সারা বছর একটাও খালি থাকে না। রেস্তোরাঁ এই এলাকায় বেশ নাম করেছে, লাঞ্চ আর ডিনারের জন্যে প্রচুর লোক আসে। চালু করেছিল জেসমিন। সাধারণ খাবার, কিন্তু চমৎকার রান্নার জন্যে তখনই সুনাম হয়ে যায়। রান্নার মানটা আজও বজায় আছে, তার একটা। কারণ সম্ভবত এই যে রান্নার সময় রেমারিক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করে। একবার যদি কেউ প্রেজো ফিসোতে খায়, দ্বিতীয়বার তার ফিরে না এসে উপায়। নেই।
একা বসে বন্ধুর কথা ভাবছে রেমারিক। কিছু একটা ঘটেছে ওর। রহস্যময় একটা চরিত্র, ওকে বুঝতে পারা কোনদিনই সহজ ছিল না, কিন্তু তবু অন্যের চেয়ে। সে ওকে ভালভাবে চেনে। যাই ঘটুক, এর সাথে মেয়েমানুষ জড়িত বলে তার মনে। হল না। রানাকে কোনদিন মেয়েদের পিছনে ছুটতে দেখেনি সে, বরং মেয়েরাই, ওর। পিছনে ছোটে। মেয়েদের ব্যাপারে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়াও ওর স্বভাব নয়। এমন অনেক মেয়ে দেখেছে রেমারিক, যারা রানা বলতে অজ্ঞান ছিল, কিন্তু সময়। থাকতে তারা বুঝতে পারে, এ লোককে বাধনে জড়ানো সম্ভব নয়।
একটা মেয়ের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে রেমারিকের। এক লেডি ডাক্তার। ব্যাপারটা অনেকটা যেন ভুল চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা, মেয়েটা একদিন। বলেছিল রেমারিককে। তালায় ঢোকে, কিন্তু ঘোরে না। কথাটা শোনার পর জবাবে রানা শুধু বলেছিল, দোষটা তালার, সন্দেহ নেই।
রেমারিকের নিজের কামরায় এখন ঘুমাচ্ছে রানা। খানিক আগে ওকে দেখে এসেছে রেমারিক। পাশ ফিরে শুয়েছিল রানা, গায়ের চাদরটা কোমরের কাছে জড় করা। চুপি চুপি অনেকক্ষণ ধরে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থেকেছে সে। রানার গায়ে সত্যি বেশ মেদ জমেছে, শরীরে অনেকগুলো কাটা-কুটির দাগ। বেশিরভাগই পুরানো, রেমারিকের পরিচিত, দুচারটে নতুন। তিন মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। রেমারিক, তার মধ্যে বেশ কয়েকবার পাশ ফিরেছে রানা। ওর মনে শান্তি নেই, বুঝতে পেরেছে রেমারিক, ঘুমের মধ্যেও অস্থিরতায় ভুগছে।
বন্ধু বিপদে পড়েছে, সেটাই রেমারিকের উদ্বেগের কারণ। কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে নিষেধ করে দিয়েছে ও। তারমানে কোন সাহায্য চায় না। না চাইলেও, কিভাবে সাহায্য করা যায় তাই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে সে। বাধা পড়ল ফুরেলা ফিরে আসায়, তার দুই বগলের নিচে দুটো বাস্কেট। মালিককে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। এই সময় মেইন কিচেন রূমে থাকার কথা রেমারিকের।
আপনি এখানে? টেবিলের ওপর বাস্কেট দুটো নামিয়ে রেখে জানতে চাইল। ফুরেলা।
অনেক দিনের পুরানো বন্ধু, বলল রেমারিক। প্রথম দিন ওকে আমি নিজে রান্না করে খাওয়াব। উঠে দাঁড়িয়ে বাস্কেটের ভেতর উঁকি দিল সে।
মালিককে দেখাবার জন্যে বাস্কেট থেকে ফল-পাকড়, তরিতরকারি, মাছ মাংস ইত্যাদি নামাতে শুরু করল ফুরেলা। অসুস্থ মাকে ফেলে চলে এলেন। কি রকম বন্ধু?
সে তুমি বুঝবে না, মুচকি হাসল রেমারিক। ও এখন আমার ঘরে ঘুমাচ্ছে।
.
ফুরেলাকে কৌতূহলে পেয়ে বসল।
আজ চার বছর রেমারিকের কাছে আছে ছেলেটা। রেমারিকের গাড়ি থেকে ভিউ মিরর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সে। রেমারিক তাকে প্রথমে বেদম মারধর করে, তারপর একশো একটা প্রশ্নের জবাব চেয়ে বসে। সে নিরাশ্রয় আর এতিম জানার পর রাস্তা থেকে তাকে তুলে নিয়ে এসে বোর্ভিঙে জায়গা দেয়, খেতে দেয় পেট ভরে। বিনিময়ে তাকে কোন কাজ করতে দেয়নি সে। কিন্তু দুদিন পর ফুরেলা নিজেই ছোটখাট কাজে রেমারিককে সাহায্য করার আগ্রহ দেখায়। সেই থেকে রয়ে গেছে ছেলেটা।
তখনও ফুরেলা জানত না, আজও জানে না, সেই প্রথম দিন ফুরেলার মধ্যে নিজের ছেলেবেলা দেখতে পেয়েছিল রেমারিক।
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ফুরেলার সাথে একই আচরণ করে আসছে রেমারিক রূঢ়, কর্কশ, কোন রকম স্নেহ-ভালবাসা প্রকাশ পায় না। আর ফুরেলাও তার স্বভাব বজায় রেখেছে–উদ্ধত, ঘাড়ত্যাড়া, মালিকের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখাবার সুযোগ। পেলে ছাড়ে না। দুজনেই জানে স্নেহ আর শ্রদ্ধার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু কখনোই সে-সবের প্রকাশ ঘটে না। আশ্চর্য একটা সম্পর্ক, ইটালিয়ানদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় না। সময়ের সাথে সাথে রেমারিকের ডান হাত হয়ে উঠেছে ছেলেটা, সততা আর বিশ্বস্ততার অনেক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উতরে গেছে।
রেমারিকের কাছে এতদিন থেকেও তার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফুরেলা। বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে রেমারিকের মা প্রেজো ফিসোতে আসে বটে, কিন্তু বুড়ি নিজের ছোট ছেলে রিসো, বড় ছেলের নিহত বউ জেসমিনের গল্প করেই থেমে যায়। বড় ছেলে রেমারিকের অতীত সম্পর্কে ভুলেও একটা শব্দ উচ্চারণ করে না। ফুরেলা জানে, রেমারিক অনর্গল আরবী বলতে পারে, আফ্রিকান দুএকটা ভাষাও তার জানা আছে, আর ফ্রেঞ্চ তো জানেই। বোঝা যায়, অনেক ঘাটের পানি খাওয়া লোক। প্রশ্ন করে জেনে নেবে, সে সাহস তার হয়নি কখনও। সম্পর্কটা সেরকম নয়।
সেজন্যেই নতুন লোকের আগমন তাকে বিস্মিত করে তুলেছে। মাঝরাতের। ঠিক আগের মুহূর্তে যখন কলিংবেল বাজল, সে ধরে নিয়েছিল রেমারিক তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। দরজা খোলার পর অচেনা লোকটাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।
রেমারিক আছে? লোকটা জানতে চায়। কথায় নিয়াপলিটান টান পরিষ্কার।
কথা না বলে ফুরেলা শুধু মাথা নাড়ে।
কখন ফিরবে সে?
কাঁধ ঝাঁকাল ফুরেলা। লক্ষ্য করল, তার সহযোগিতা না পেয়ে লোকটা অবাক হয়নি।
আমি অপেক্ষা করব, বলে ফুরেলাকে এক রকম, ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে আগন্তুক, রিসেপশনে ঢুকে বোর্ড থেকে চাবি নিয়ে সোজা উঠে যায়। দোতলায়। পিছু পিছু ওপরে উঠে এসে ফুরেলা দেখে অফিস কামরার দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকে পড়েছে লোকটা, চেয়ারে বসে পা দুটো লম্বা করে দিয়েছে। রাগ হয়। ফুরেলার, ব্যাখ্যা দাবি করার ইচ্ছে জাগে, কিন্তু লোকটাকে তখন আর তার ভয় করছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শহরের আলো দেখছিল লোকটা, এই জগতেই যেন নেই। কেন যেন ফুরেলার রাগ পানি হয়ে গেল। মৃদু সুরে সে জানতে চাইল, তার কিছু লাগবে কিনা।
যদি থাকে, বলল লোকটা। এক বোতল স্কচ।
একটা বোতল আর গ্লাস নিয়ে এল ফুরেলা। আরও খানিক চিন্তা-ভাবনা করে আগন্তুকের নাম জানতে চাইল সে।
ইমরুল হাসান, বলল লোকটা। তুমি?
ফুরেলা কালমাট। মালিকের আমি ডান হাত।
বোতল থেকে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে চুমুক দিল লোকটা। তারপর কটমট করে। তাকাল ফুরেলার দিকে। যাও, শুয়ে পড়। আমি কিছু চুরি করব না।
.
লাঞ্চ তৈরি করছিল ওরা, এই সময় ছেলেটাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ কথাটা। বলল রেমারিক, ও বাংলাদেশী।
কে?
একটা হাত তুলে সিলিঙের দিকে আঙুল তাক করল রেমারিক। আমার বন্ধু। হাসান।
কিন্তু উনি তো খাঁটি ইটালিয়ান বলেন।
মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। আমি শিখিয়েছি।
ফুরেলার বিস্ময় বাড়তেই লাগল। মালিকের এই নরম সুর তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। যে লোক ধমক আর হুমকি ছাড়া কথা বলে না, আজ সে তাকে গল্প। শোনাতে বসেছে। কৌতূহলে মরে যাচ্ছিল ফুরেলা, কিন্তু নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করেনি সে।
আমরা দুজন যুদ্ধে ছিলাম, আবার বলল রেমারিক। বিয়ে করার পর যুদ্ধ ছেড়ে দিলাম আমি। সে আজ আট বছর আগের কথা।
যুদ্ধে ছিলেন? বড় বড় হয়ে উঠল ফুরেলার চোখ। কোথায়?
হাসছে রেমারিক। লেবাননে যুদ্ধ করেছি আমরা, মুসলিম ফিলিস্তিনীদের কাঁধে কাধ মিলিয়ে। যুদ্ধ করেছি জিম্বাবুই-য়ে।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকল ফুরেলা। কি বলছেন? ফিলিস্তিনীদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন? আপনি? একজন শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান? তারপর আবার স্মিথ। সরকারের বিরুদ্ধে রোডেশিয়ায়? কালোদের পক্ষে?
কালো কি, গোরা, মুসলিম কি খ্রিস্টান সে সব আমি বিচার করিনি, বলল রেমারিক। আমি বিচার করেছিলাম ন্যায় কি অন্যায়। ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে নাম। লেখাই আমি। ভাড়াটে যোদ্ধারা ন্যায়-অন্যায় বিচার করে না, যারা টাকা দেয়। তাদের পক্ষেই যুদ্ধ করে। কিন্তু আমার বন্ধু আমার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধটা জাগিয়ে দেয়। তারপর থেকে আমি আর অন্যায়ের পথে যেতে পারিনি। একটু থামল রেমারিক। তারপর চুপ হয়ে গেল।
অনেক কথা ভিড় করছে আজ তার মনে।
.
মারা গেছে বাবা। পনেরো বছরের সুন্দরী বোন, লম্পট সমাজপতিরা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। ছয় বছরের ছোট ভাই, খিদের জ্বালায় সারা দিন ঘ্যান ঘ্যান। করে বেড়ায়। কঙ্কালসার মা, অদৃষ্টে বিশ্বাসী, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় চার্চে, যেন প্রার্থনা করলেই আকাশ থেকে রুটি পড়বে।
বোনটা একদিন পালিয়ে গেল। আর কোনদিন ফেরেনি সে। বহু বছর পর একদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল রেমারিকের। কিন্তু দেখা না হলেই ভাল হত।
বোন পালাবার দুদিন পর পেটে তিন দিনের খিদে নিয়ে এগারো বছরের রেমারিকও বাড়ি ছাড়ল। পঞ্চাশ কিলোমিটার হেঁটে নেপলসে চলে এল সে। জানে, নেপলস শহরে ধনী লোকজন আছে, আর তাদের টাকা পয়সা কেড়ে নেয়ার জন্যে আছে গুণ্ডা-বদমাশ, তারও একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
বুদ্ধি ছিল রেমারিকের। হাত পাতার সময় চোখে মরিচের গুঁড়ো ঘষে সাগর বইয়ে দিত, দুঃখ-দুর্দশায় ভরা এমন সব গল্প ফাঁদতো মহাকাব্যকেও ছাড়িয়ে যেতে চায়। তবু ভিক্ষা পাওয়া যেত না, আর ভিক্ষা না পেলে চুরি করত রেমারিক।
দেখা গেল চুরি বিদ্যায় হাত আর মাথা আরও বেশি খোলে রেমারিকের। তার মত কয়েক শো ছেলের মধ্যে থেকে ছয়জনকে শিষ্য বানিয়ে একটা পোড়োবাড়িতে আস্তানা গাড়ল সে। নিজে থেকে সে যা শিখেছে, শিষ্যদের। সেগুলো যত্নের সাথে শেখাল। মদের বোতল খালি হলে ধনীর দুলালরা উদার হয়ে পড়ে, ভিক্ষা চাওয়ার সেটাই উপযুক্ত সময়। আর ওরা যখন মেয়েমানুষের কাছে যায়, বিছানা যখন কাঁচ ক্যাচ করতে থাকে, সেটাই চুরি করার আদর্শ সময়। শহরের প্রতিটি গলি উপগলি, বাক আর চৌরাস্তা মুখস্থ করে নিল রেমারিক। এভাবে সে টিকে গেল। সাগর ঘেষা রাস্তা ধরে প্রতি হপ্তায় পজিটানোয় যায় সে, পকেটে থাকে টাকা, হাতে চকলেট আর মাংসের টিন। রিসো আর খিদের জ্বালায় ঘ্যান ঘ্যান করে না। মা অবশ্য আরও ঘন ঘন চার্চে যাওয়া শুরু করেছে, তার ধারণা তার প্রার্থনার জবাবে ওপরওয়ালা মুখ তুলে চেয়েছেন।
যেখানে ক্ষুধা আর অভাব সর্বগ্রাসী, নৈতিকতা সেখানে পরাজিত সৈনিক। যে সমাজ জীবনের মৌল চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না তার আইনকে মানুষ বুড়ো আঙুল দেখাবেই। পজিটানোয় বসবাস করার জন্যে আর কখনও ফিরে। যায়নি রেমারিক। নেপলস তার তীর্থস্থান হয়ে উঠল, এখানেই রয়েছে তার গুপ্তধন আর ভবিষ্যৎ। প্রথমে সে শুধু টিকে থাকার ধান্ধা করে বেড়াল। তারপর তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলল বুদ্ধি। পনেরো বছর বয়সে পৌঁছে রেমারিক। দেখল, সমবয়েসী বারোজন শিষ্য রয়েছে তার, সবাই এক একটা পাকা চোর।
দিন বেশ ভালই কাটছিল, কিন্তু তবু মনে শান্তি ছিল না। তার একটা প্রতিজ্ঞা, পালিয়ে যাওয়া বোনকে সে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু কোথায় সে? মিলানে সে নেই, তাকে খুঁজে বের করতে শহরের প্রতিটি ইট শুধু খুলতে বাকি রেখেছে সে।
.
পচন মাথা থেকেই ধরে। তখনকার সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে দুর্নীতি, অন্যায় আর জুলুমের আশ্রয় নিল। ভাল মানুষদের ধরে ধরে জেলে ভরা হল, আর বের করে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হল চোর-গুণ্ডা-বদমাশদের। সুসংগঠিত অপরাধী চক্র থাকা দরকার, তারা সাহায্য করবে সরকারকে। প্রায় রাতারাতি গোটা সমাজ চলে গেল অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে।
পেটে খিদে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত বেশ্যারা, তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে জমজমাট ব্যবসা শুরু হল। অনেক বছর পর আবার পুরোদমে মাঠে নামল সংঘবদ্ধ মাফিয়া। ছোট বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব পেল, চুটিয়ে ব্যবসা করে যাও, আমরা প্রোটেকশন দেব, বিনিময়ে হপ্তায় হপ্তায় লাভের বখরা, দিতে হবে। যারা। রাজি হল। তালিকায় নাম উঠল তাদের, আর যারা রাজি হল না তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল না।
এই নতুন ছকের সাথে খাপে খাপে মিলে গেল রেমারিক। সে আর তার কিশোর দল গোটা কাঠামোর একটা অংশ হয়ে উঠল। আঞ্চলিক নেতারা তাকে চিনতে পারল, সম্ভাবনাময় একজন তরুণ হিসেবে গুরুত্ব পেল সে। ডকের পিছনে লাগিয়ে দেয়া হল তাকে, খুদে দোকানদার আর ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে। প্রোটেকশন না পেলে কেউ, তারা বাঁচবে না। ডকের পিছনে ভাল কাজ দেখাল সে, পুরস্কার হিসেবে এবার গোটা ডকের দায়িত্ব দেয়া হল তাকে। সে আর তার দল শুধু চুরি নয়, আক্ষরিক অর্থেই লুটপাট শুরু করে দিল। বিদেশ থেকে যত, কার্গো আসে, বাক্স খুলে অর্ধেক বের করে নেয় তারা। নিজের লাভের অংশ জমিয়ে একটা। বাড়ি কিনল রেমারিক, সেটাই আজ প্রেজো ফিসো।
বাড়িটা মায়ের নামে কিনল রেমারিক, কারণ তখনও সে নাবালক।
এভাবে কেটে গেল আরও দুটো বছর। সতেরোয় পা দিল রেমারিক। ওপরমহল তার ওপর ভারি খুশি, নতুন আরও একটা সুযোগ এল তার হাতে। এবার মেয়েদের নিয়ে কারবার করতে হবে রেমারিককে। ডক এলাকায় মেয়েদের। চাহিদা আছে, কিন্তু মেয়েদের জন্যে ভাল কোন আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেই। ডকের। কাছাকাছি গোটা একটা পাড়া খালি করতে হবে, বাইরে থেকে মেয়ে আমদানী, করে ভরতে হবে ওই পাড়া। মনে মনে হিসেব করে খুশি হল রেমারিক, তিনগুণ বেড়ে যাবে তার রোজগার।
শুরু হল কাজ। শখানেক বাড়ি নিয়ে একটা পাড়া, খালি করা কম ঝামেলার কাজ নয়। কাজটা করতে গিয়ে উভয়পক্ষের কিছু লোক মারা গেল। তবে কাজটা দুমাসের মধ্যেই শেষ করতে পারল রেমারিক। এবার মেয়ে জোগাড়ের পালা। দালালদের ডেকে সে জানিয়ে দিল, সুন্দরী মেয়ে চাই তার। ভক এলাকার লোকেরা মালদার মক্কেল, ভাল জিনিস দিয়ে ভাল পয়সা খসাতে চায় সে। দালালরা। ব্যাপারটা বুঝল। মেয়ে না এনে তাদের ফটো তুলে নিয়ে এল তারা। রেমারিক নিজে বাছাই করুক, পরে যেন তাদের ঘাড়ে দোষ না চাপে।
মেয়েদের কয়েকশো ফটো দেখল, সে, পছন্দও হল অনেককে। কিন্তু হঠাৎ একটা ফটো দেখে মাথা ঘুরে গেল তার।
ফটোটা হাতে নিয়ে আধ ঘন্টা বসে থাকল রেমারিক, এক চুল নড়ার শক্তি পেল না। ফটোর পিছনে মেয়েটার নাম লেখা রয়েছে, এমিলিয়া। ঠিকানাও আছে। তারমানে, ভাবল রেমারিক, বেলালোনা নাম বদলেছে। তার মন ঠিকই গিয়েছিল, বরাবর কাছেপিঠেই ছিল সে। কিন্তু আশ্চর্য, তার চোখে একদিনও পড়ল না!
মনে মনে হিসেব করল রেমারিক। বেলাডোনার বয়স এখন একুশ বছর। কিন্তু ফটোতে দেখে মনে হয় ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। সেই ভরাট মুখে হাড় গজিয়েছে। গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট এখন বিবর্ণ। পটলচেরা চোখ এখন। আধবোজা, ঢুলুঢুলু। ফটোটা ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে টেবিলে মাথা ঠুকতে লাগল রেমারিক। চোখ-মুখ বিকৃত করে অনেকক্ষণ ধরে ফোঁপাল।
পজিটানোয়, মার কাছে যাচ্ছে রেমারিক। অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে এল সে, এ-কথা কি করে বলবে মাকে? নিজের আস্তানায় নয়, ফটোর পিছনে লেখা ঠিকানা। ধরে নেপলসের সবচেয়ে বড় বেশ্যাপাড়ায় চলে এল সে। নম্বর মিলিয়ে ছোট্ট একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। চোখ দুটো টকটকে লাল, উসকোখুসকো চুল, হাত পা কাঁপছে।
মাত্র সন্ধে, এরই মধ্যে খদ্দেরদের ভিড় জমে উঠেছে গলির ভেতর। দুবার হাত উঠিয়েও নামিয়ে নিল রেমারিক, নক করতে পারল না। এই এলাকায় কেউ তাকে চেনে না, এভাবে আরও কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে উপদ্রব ভেবে। দালালরা ঘাড় ধরে পাড়া থেকে বের করে দিতে চাইবে। তৃতীয়বারের চেষ্টায় নক করতে পারল রেমারিক। আওয়াজ হল, কিন্তু এত আস্তে যে ভেতরে কেউ থাকলে শুনতে পেয়েছে কিনা সন্দেহ।
খানিক পর দরজা খুলে গেল। টলতে টলতে বেরিয়ে এল প্রৌঢ় এক লোক। রেমারিককে ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটাল সে, সস্তা মদের গন্ধ ঢুকল তার নাকে।
কে গো, নতুন মনে হচ্ছে? ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজটা এল। সেই অতি। পরিচিত কণ্ঠস্বর, কিন্তু আগের চেয়ে ভোতা আর সুরটা অশ্লীল।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দর দর করে ঘামতে লাগল রেমারিক।
টলতে টলতে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল মেয়েটা। আলুথালু বেশ, এলোমেলো। চুল, ঠোঁট জোড়া ফুলে আছে, চোখে নগ্ন আহ্বান। এ কে? একে তো রেমারিক। চেনে না। ইচ্ছে হল দৌড়ে পালায়। কিন্তু নড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।
বেলাডোনা! বিড়বিড় করে বলল রেমারিক।
সাপ দেখার মত আঁতকে উঠল বেলাডোনা। কে? দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে * দরজার কবাট আকড়ে ধরল সে। চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে, দৃষ্টিতে রাজ্যের অবিশ্বাস।
ছায়া থেকে আলোয় সরে এল রেমারিক। আরেকবার শিউরে উঠল। বেলাডোনা।– ভাই-বোন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাইয়ের চোখে কান্না, বোনের। চোখে আতঙ্ক।– চল বাড়ি যাবে, অনেকক্ষণ পর কথা বলতে পারল রেমারিক।
বেলাডোনার চোখে পলক নেই, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিঃশব্দে শুধু মাথা নাড়ল সে।
ইতিমধ্যে ওদের দিকে চোখ পড়েছে লোকের। পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়াচ্ছে কেউ কেউ।
ভেতরে আয়, অস্ফুটে বলল বেলাডোনা।
মাথা নাড়ল রেমারিক, ভেতরে যাবে না সে। কিন্তু তারপরই কি মনে করে এগোল। ঘরের মাঝখানে থেমে ঘুরল সে। দরজা বন্ধ করে রেমারিকের দিকে ফিরল বেলাডোনা।
বসবি না? কেমন আছিস তোরা? মা..মা কেমন আছে? রিসো??
গেলেই দেখতে পাবে, বিড়বিড় করে বলল রেমারিক। বোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না সে, দেয়ালের দিকে তাকাল। নগ্ন, অর্ধনগ্ন মেয়েলোকের। ছবি সাঁটা দেয়াল। চোখ নামিয়ে নিল সে।
তা হয় না, ছোট্ট করে বলল বেলাডোনা।
চমকে উঠে মুখ তুলল রেমারিক। মানে?
আমার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। বিস্ময় আর আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছে। বেলাডোনা। তার চেহারায় একটা পাথুরে ভাব লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেল রেমারিক।
কেন?
সে তুই বুঝবি না, বলল বেলাডোনা। ওরা কেমন আছে বললি, না?
আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি, জেদের সুরে বলল রেমারিক। লক্ষ্য করল, দরজার পাশের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে বেলাডোনা, দেয়াল থেকে হাতটা একবারও নামায়নি
পাগলামি করিসনে, শান্ত ভাবে বলল বেলাডোনা। এগিয়ে এল সে, একটু খোঁড়াচ্ছে। চেয়ারের পিঠ, খাটের স্ট্যাণ্ড ধরে কয়েক পা হাঁটল, তারপর বসল বিছানায়। তার পা দুটোর দিকে চোখ পড়ল রেমারিকের। জুতো পরে আছে বেলাডোনা।
পাগলামি বলছ কেন? ফিরে যেতে অসুবিধে কি?
রেমারিকের দিকে তাকিয়ে থাকল বেলাডোনা। কোন জবাব দিল না। হঠাৎ একটা হাত ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। আয়, কাছে বস।
নড়ল না রেমারিক। তোমাকে এখুনি আমার সাথে যেতে হবে।
আয় না, বস, আবার কাছে ডাকল বেলাডোনা।
তুমি যাবে কিনা বল।
মা কেমন আছে রে?
ভাল। তুমি না গেলে আমি এখান থেকে যাব না।
রিসো?
পড়াশোনা করছে, বলল রেমারিক। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজেছি তোমাকে…
জানি। বেলাডোনার ঠোঁটে স্লান হাসি।
জানো? হতভম্ব হয়ে গেল রেমারিক।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম, তোকে দেখতে পেলেই গা ঢাকা দিতাম। মেয়েদের কাছে শুনতাম, বেলাডোনা নামে একটা মেয়েকে খুঁজছিস তুই।
কেন? গলা বুজে এল রেমারিকের। কেন?
কেন সে তোকে বোঝানো যাবে না, বলল বেলাডোনা। আমাকে পালিয়েই বেড়াতে হবে, রেমারিক। যদি না বসিস, চলে যা, ভাই। আর কখনও এদিকে আসবি না।
না।
হাসতে লাগল বেলাডোনা। তুই সেই আগের মতই জেদি আছিস, নারে?
তুমি না গেলে আমি জোর করে তোমাকে নিয়ে যাব।
রেমারিকের দিকে আবার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল বেলাডোনা। তোরা আমাকে ভুলতে পারিসনি, নারে?
কি বলবে রেমারিক! তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়তে লাগল। নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত সুরে বলল সে, তোমার মালিক কে? তাকে ডাক। ক্ষতিপূরণ দিয়ে তোমাকে আমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাব।
আমি যেতে চাই না, রেমারিক।
কেন? চিৎকার করে জানতে চাইল রেমারিক।
কেন? পায়ের জুতো খুলে ফেলল বেলাডোনা। দেখ।
ঘা। বেলাডোনার দুই পায়ের তিনটে করে ছটা আঙুল নেই। ডান পায়ের। পাতাও ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। কুষ্ঠ, চিনতে পারল রেমারিক। এই রোগ আগেও দেখেছে সে।
চোয়াল দুটো উঁচু হয়ে উঠল রেমারিকের। আমরা তোমার চিকিৎসা করাব।
এ যেন সারে, বলে আবার জুতো পরল বেলাডোনা। এবার তুই যা, রেমারিক।
নড়ল না রেমারিক। কবে থেকে?
তিন বছর পেরিয়ে গেছে।
ওষুধ?
কি লাভ! ঠোঁট উল্টাল বেলাডোনা। সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে, কোথায় ওষুধ দেব?
অনেকক্ষণ আর কেউ কথা বলল না। ঠিক আছে, আমি আবার কাল আসব, নিস্তব্ধতা ভেঙে এক সময় বলল রেমারিক। তুমি আমার কাছে থাকবে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব, তুমি আর আমি থাকব সেখানে। কারও সাথে তোমার দেখা হবে না, কেউ কিছু জানবে না। এতে তোমার আপত্তি নেই তো?
এ হয় না, রেমারিক।
কেন হয় না? এই রোগ হয়েছে জানলে লোকে তোমাকে ঘৃণা করবে, এই তো তোমার ভয়? কেউ জানবে না। কারও সাথে তোমার দেখাই হবে না।
চুপ করে থাকল বেলাডোনা।
দরজার দিকে এগোল রেমারিক। দরজার কাছে এসে কি মনে করে ঘাড়। ফেরাল সে। দেখল একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বেলাডোনা, যেন তাকে ছুঁতে। চেয়েছিল। সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে শুরু করতেই হাতটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিয়েছে।
ধীরে ধীরে ঘুরল রেমারিক। ভাইয়ের চোখে ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে নিয়েছে বেলাডোনা, ছুটে গিয়ে বোনের গায়ের ওপর আছড়ে পড়ল রেমারিক। বেলাডোনার হাঁটুর ওপর মুখ রেখে ডুকরে উঠল। তার মাথায় একটা হাত রাখল। বেলাডোনা, হাতের উল্টো পিঠে ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের পানি পড়ছে।
পরদিন বেলাডোনাকে নয়, তার লাশ নিয়ে এসে কবর দিল রেমারিক। রাতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে সে।
তিন দিন কাজে বেরুলো না রেমারিক। মা আর ভাইকে বেলাডোনার কথা। কিছুই জানায়নি সে, ঠিক করল কোনদিন জানাবেও না। আরও দুটো সিদ্ধান্ত নিল রেমারিক। এক, নারী-ব্যবসার সাথে নিজেকে সে জড়াবে না, ডক এলাকায় কোন বেশ্যাপাড়াও তৈরি হতে দেবে না। দুই, কুষ্ঠ রোগীদের জন্যে একটা আশ্রম তৈরি করতে হবে তার।
ঘর-বাড়ি থেকে যাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে ফিরে আসতে বলল রেমারিক। খবর পেয়ে মাফিয়া নেতা ব্যাখ্যা দাবি করে প্রতিনিধি পাঠাল। তার সাথে দেখাই করল না রেমারিক, লোক মারফত জানিয়ে দিল, ডক এলাকায় বেশ্যাপাড়া হবে না। হৈ চৈ পড়ে গেল আণ্ডারওয়ার্ল্ডে। কার এত সাহস নেতার। আদেশ অমান্য করে? কে এই রেমারিক?
ঠিক এই সময় মাফিয়া নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রেমারিকের ওপরওয়ালাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে, ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছে কেউ কেউ, দেমাকে অনেকেরই মাটিতে পা পড়ে না। কে কত শক্তিশালী এটা প্রমাণ করার জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। গোটা দেশ জুড়ে মাফিয়াদের একটা কাঠামো থাকলেও দুই যুগ আগের মত শক্ত আর নিরেট হয়নি তখনও। দক্ষিণের প্রবীণ নেতারা তখনও সবখানে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। শিল্পসমৃদ্ধ উত্তরে আর রোমে তারা সফল হলেও, নেপলসে তারা সুবিধে করতে পারছিল না। ইটালীর অবাধ্য শহর বলা হয় নেপলসকে, এখানের ক্রিমিন্যালরাও আর সবার চেয়ে এক কাঠি বাড়া। প্রবীণ মাতব্বররা সবশেষে নজর দিল নেপলসের দিকে।
ক্ষমতার ভাগ নিয়ে দুটো দলের লড়াই শুরু হল নেপলসে। যে-কোন একটা পক্ষ নিতে হবে রেমারিককে, এই পক্ষ নিতে গিয়েই জীবনের প্রথম ভুলটা করে বসল সে। গিড়ি নোচি নামে এক লোকের পক্ষ নিল সে। ডন নোচি নারী-ব্যবসা, পছন্দ করে না, বেশ্যাদের প্রতি চিরকাল সহানুভূতি দেখিয়ে এসেছে সে, তার এই গুণের জন্যেই রেমারিক তার সাথে হাত মেলাল। কিন্তু নোচি বুড়ো, প্রায় অথর্ব, বহু বছর জেল খেটে আত্মবিশ্বাস, কমে গেছে তার। ফলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারলেও রেমারিক আর তার দলের অপূরণীয় ক্ষতি হতে লাগল। নিচুস্তরের কর্মী। বলে রেমারিকের দলকেই সামনে থেকে লড়তে হল। মাস কাটল না, দলের অর্ধেক সদস্য হয় খুন হল নাহয় দল ছেড়ে পালিয়ে গেল। শটগানের গুলি খেয়ে আহত হল রেমারিক, হাসপাতালে শুয়ে কাতরাতে লাগল ব্যথায়।
ওদিকে, তার আশা-ভরসা আর উদ্ধারকর্তা গিডি নাচি, ক্লান্ত এবং অসতর্ক, ফ্রিটো মিসটো খেতে বসে, এক রেস্তোরাঁয় খুন হয়ে গেল। শোনা কথা, পুলিস। নাকি তার মুখ থেকে ভাজা মাছ বের করে। আততায়ীকে দেখতেই পায়নি নোচি, শটগানের গুলিতে তার গোটা বুক গুড়ো হয়ে যায়।
এই পর্যায়ে ঘুম ভাঙে পুলিসের। দাপট দেখাবার জন্যে রাস্তায় নেমে আসে তারা। খবরের কাগজগুলো আর রাজনীতিকরা এসবের বিহিত দাবি করে বসে। শেষ পর্যন্ত বিজয়ীদের মধ্যে একটা শান্তি আলোচনার ব্যবস্থা হল। মাফিয়াদের তরফ থেকে উদ্যোগী হল ডন আতুনি বেরলিংগার, সরকারের পক্ষে আলোচনায়, বসল পাবলিক প্রসিকিউটর। প্রমাণ আর সাক্ষী জোগাড় হল, নিচুস্তরের কিছু। লোকজনকে ধরে হাজতে ভরল পুলিস। ভিটেলা রেমারিকও থাকল তাদের মধ্যে। বিচারে দুবছরের জেল হয়ে গেল তার।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর দুমাস গা ঢাকা দিয়ে থাকল রেমারিক। আর আমি জেলে যাব না, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল সে। ঠিক করল, মাস্তানি ছেড়ে। দিয়ে দেখবে সত্তাবে বেঁচে থাকা যায় কিনা। মার নামে কেনা বাড়িটা খালি পড়ে ছিল, ঠিক করল ওটাকে বোর্ডিং হাউস বানাবে।
গত দুবছরে শহরে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে আতুনি বেরলিংগার। তার দলে কুখ্যাত সব মস্তানরা ভিড়েছে, পুলিস আর স্থানীয় সরকারের প্রভাবশালী অফিসাররাও এখন তার পকেটে। রেমারিক বুঝল, তাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হলে বেরলিংগারের অনুমতি লাগবে। নেপলসে আত্মপ্রকাশ করল সে, বেরলিংগারের সাথে দেখা করার চেষ্টায় থাকল।
বেরলিংগার তখনও যুবক, মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। আধুনিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে অল্প যে-কজন নেতা উঠে এসেছিল, সে তাদেরই একজন। রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষমতায় এল বটে, কিন্তু চারদিক একটু গুছিয়ে নিয়েই বাস্তববাদী ব্যবসায়ীর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করল সে। বুঝল, তার ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে গোটা দেশের সব মাফিয়া নেতাদের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে হবে তাকে। সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে, সব বড় শহরে প্রতিনিধি পাঠাল সে। পালার্মো থেকে দূত এল তার কাছে, প্রভাব-বলয় আর ক্ষমতার আওতা নির্ধারণের জন্যে মীটিঙে বসার আমন্ত্রণ জানানো হল তাকে।
পোপ নির্বাচনে যে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, সে-সব মীটিঙের আলোচনাও তেমনি গোপন রাখা হল। কার কতটুকু ক্ষমতা, প্রভাব-বলয়ের বিস্তৃতি, ইত্যাদি নিয়ে মতবিরোধ আর দ্বন্দ্ব দেখা দিল, কিন্তু নতুন করে কোন রক্তপাত ঘটল না। কালাব্রিয়ার পুরানো ঐতিহ্যের অনুসারীরা গোঁ ধরে বসল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মিলান আর তুরিনের বস-রা যেন কোনভাবেই অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারী না হয়। সবেচেয়ে বেশি শোরগোল তুলল নেপলস আর রোমের নেতারা, কারণ গত কয়েক যুগ ধরে তাদেরকে অবহেলা করা হয়েছে। তবে সবাই একমত হল যে গোটা দেশ জুড়ে শক্তিশালী একটা কাঠামো থাকা দরকার, নেতাদের নেতাও একজন থাকতে হবে, যার ক্ষমতা হবে সবার চেয়ে বেশি।
উত্তরের নেতারা কালাব্রিয়ানদের মধ্যে থেকে কাউকে চায় না, কালাব্রিয়ানরা উত্তরের কাউকে মেনে নেবে না। রোমের ডন পেসকাকে নরম বলে রায় দেয়া হল, আর রেলিংগারের বয়স কম।
এ-ধরনের পরিস্থিতিতে যা হয়, একটা আপোসরফায় আসতে হল সবাইকে। মীটিং আহ্বান করা হয়েছিল পালার্মো থেকে। পালার্মোর নেতা ডন বাকালাকে সাময়িকভাবে নেতাদের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হল। লোকটা মাঝারি আকৃতির, ঝানু একজন কূটনীতিক। কেউ জানত না, তার একটা প্রতিজ্ঞা। ছিল, পালার্মোকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। লক্ষণগুলো দেখে ঠিক কি ঘটতে যাচ্ছে পরিষ্কার আঁচ করতে পারে সে। উপস্থিত কেউই তার কূটনৈতিক চাল পছন্দ করত না। রাজনীতিকদের সাথে তার অতিরিক্ত মাখামাখিও সন্দেহের। চোখে দেখা হত। কিন্তু কেউই ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, ডন বাকালা তার কুটনৈতিক চাল চেলেই আগামী আটটা বছর সরার মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাবে। সবাই এ-কথা ভেবেই খুশি হল যে বেশ লম্বা একটা সময়ের জন্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সবার জন্যেই সেটা বিরাট লাভ হয়ে দেখা দেবে।
আতুনি বেরলিংগারের সাদর অভ্যর্থনা পেয়ে মুগ্ধ হল রেমারিক। তার অফিস দেখেও প্রভাবিত হল সে। সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে লোকটা। দুবছর আগের নিষ্ঠুরতা সত্যি অতীতের একটা কলঙ্ক মাত্র। যা ঘটবার ঘটে গেছে, ভুলে যাওয়াই ভাল, আশ্বাস দিয়ে বলল বেরলিংগার। পরিস্থিতি এখন। বদলে গেছে। আরে না, রেমারিক নতুন করে ব্যবসা শুরু করলে কেউ তাকে বাধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে রেমারিক যদি বোর্ডিং হাউসে মারিজুয়ানাও বিক্রি করে; নেতার অনুরোধ ফেলা হয়নি দেখে যারপর নাই খুশি হবে বেরলিংগার। মারিজুয়ানা কেনাবেচার জন্যে পুঁজি লাগলে তাও পেয়ে যাবে রেমারিক।
শর্তটা জুড়ে দেয়ায় একটু মনক্ষুণ্ণ হলেও, আত্মবিশ্বাস নিয়েই ফিরে এল রেমারিক। ভাবল, ভাগ্যিস তাকে বেশ্যাপাড়া চালাতে বলেনি।
আসলে ডন বেরলিংগারকে চিনতে পারেনি রেমারিক। বেরলিংগার তাকে ক্ষমা করেনি। বিরোধী পক্ষে রেমারিক আর তার দল ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক, বেশিরভাগ ক্ষয়-ক্ষতি ওদের দ্বারাই ঘটেছিল। সেই রেমারিককে ব্যবসা করে খেয়ে। পরে বাচতে দেবে, বেরলিংগার সে লোকই নয়।
পালার্মো থেকে নির্দেশ ছিল, আঞ্চলিক গোলযোগ একেবারে কমিয়ে ফেলতে হবে। অতীত ঘটনার জের ধরে কোনরকম খুন-খারাবি চলবে না। বেরলিংগারের তখনও এতটা ক্ষমতা বা সাহস হয়নি যে ডন বাকালার নির্দেশ অমান্য করে। সহজ একটা উপায় আবিষ্কার করে সে। শুরু করুক রেমারিক। সময় আর। সুযোগমত প্রোটেকশন প্রত্যাহার করে নেবে সে। যা করার, তার কাছ থেকে। প্ররোচিত হয়ে পুলিসই সব করতে পারবে। বিচার বিভাগের সাথে তার দহরম মহরম আছে, রেমারিককে লম্বা সময়ের জন্যে জেলের ঘানি টানানো কোন সমস্যাই হবে না।
.
একদিন রাত দুপুরে এল একটা টেলিফোন কল। কে ফোন করেছিল, আজও জানা হয়নি রেমারিকের।
গিডি নোচি আর আতুনি বেরলিংগার, দুজনকেই বাকিতে অস্ত্র আর গোলা বারুদ সরবরাহ করেছিল ভিনসেন্ট গগল নামে এক লোক। নোচি নিহত হওয়ায়। পাওনা টাকা মার গেল গগলের। কিন্তু বিজয়ী বেরলিংগারের কাছ থেকেও টাকা পেল না সে। গগলকে সাধারণ একজন স্মাগলার মনে করে টাকাটা না দেয়ার। সিদ্ধান্ত নিল বেরলিংগার। কেউ ঠকালে বা শত্রুতা করলে সরাসরি আঘাত করা গগলের স্বভাব নয়। কারও সাথে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়াও তার অপছন্দ। বেরলিংগার টাকা দিতে অস্বীকার করায় কোন প্রতিবাদই করল না সে। শুধু ঘটনার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখল আর অপেক্ষায় থাকল সুযোগের।
অবৈধ অস্ত্রের যোগানদার হিসেবে নোচি আর বেরলিংগার, দুপক্ষের। লোকজনদেরই চিনত গগল। এদের মধ্যে নোচির দলের রেমারিক তার দৃষ্টি কাড়ে। রেমারিক কোত্থেকে কোথায় উঠেছে, তারপর কোথায় নেমে গেল, সব খবরই জানা ছিল তার।
নানা দেশে ব্যবসা আছে গগলের, সবখানে ঘুরে বেড়াতে হয়, তবু হাতে সময় পেলেই ইতালীতে ছুটি কাটাতে আসে সে। আর এলেই সংশ্লিষ্ট সবার খোঁজ খবর নেয়। রেমারিক সম্পর্কে আরও কিছু খবর পেল সে। বেরলিংগারের সাথে। দেখা করেছে রেমারিক, আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে ছেলেটা।
নিজের ব্যবসা বা ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে বন্ধু মাসুদ রানার সাথে, কখনও আলোচনা করেনি গগল, তবে রানা কি ধরনের কাহিনী শুনতে পছন্দ করে সেটা তার খুব ভাল জানা আছে। বেরলিংগার টাকা দিতে অস্বীকার করার পর রানার সাথে দেশে-বিদেশে অনেকবারই দেখা হয়েছে গগলের। গল্পচ্ছলে রানাকে সে রেমারিকের কথাও বলেছে।
যাকে নিয়ে এত আলোচনা, সেই রেমারিক কিছুই জানল না, কিন্তু বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট এবং রানা ইনভেস্টিগেশনের চীফ মাসুদ রানা তার সম্পর্কে যা কিছু জানার প্রায় সবই জেনে ফেলল। বিমুখ পরিস্থিতির সাথে একা লড়ে রেমারিক অনেক ওপরে উঠেছে, এটা রানার ভাল লাগে। মাফিয়া নেতার কাছ থেকে নারী-ব্যবসা করার নির্দেশ পেয়েও সেটা অমান্য করার সাহস দেখিয়েছিল রেমারিক, এই ঘটনা রানার মনে একটা ছাপ ফেলে। কেন যেন রানার। মনে হয়, ওখানে একজন সৎ যুবক সুযোগের অভাবে সৎ পথে আসতে পারছে না। গগলের সাথে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে দুএকবার জানতে চেয়েছে ও, তোমার সেই রেমারিকের খবর কি?
গগল একবার জানাল, বেরলিংগার তাকে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। তবে আমার ধারণা, সুযোগমত ঠিকই ছোবল মারবে সে।
একটু চিন্তা করে রানা বলেছিল, ওর কোন সাহায্য লাগলে আমাকে জানিও। ছেলেটাকে আমার ভাল লেগেছে।
ব্যস, এই পর্যন্তই। এরপর অনেকদিন গগলের সাথে দেখা হয়নি রানার, রেমারিকের কথাও ভুলে গেছে ও।
ব্যবসার কাজে আবার একবার মিলানে এল গগল। বেরলিংগারের দলের ভেতর নিজের লোক আছে তার, তাকে ডেকে ভেতরের সব খবর সংগ্রহ করার সময়ই সে জানতে পারল, রেমারিককে শায়েস্তা করার জন্যে প্রোটেকশন প্রত্যাহার। করে নিচ্ছে বেরলিংগার। আজ রাতেই তার বোর্ডিং হাউসে হানা দেবে পুলিস।
ইনফরমারকে বিদায় করে দিয়ে চিন্তা করতে বসল গগল। রেমারিকের প্রতি সহানুভূতি জাগল তার মনে। ভাবল, রেমারিককে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে দিতে পারলে বেরলিংগার একটা চোট খাবে। কিন্তু রেমারিককে কোথায় সরাবে সে?
এই সময় রানার কথা মনে পড়ে গেল গগলের। মিলানে রানা ইনভেস্টিগেশনের শাখা আছে, কিন্তু ফোন করে সেখানে রানাকে পাওয়া গেল না। কোথায় পাওয়া যাবে ওকে, তাও বলতে পারল না শাখাপ্রধান। রিসিভার নামিয়ে রাখবে গগল, এই সময় অপরপ্রান্ত থেকে জানতে চাওয়া হল, মি. রানাকে কি দরকার?
না, মানে রেমারিক নামে এক যুবককে…
আপনি কে বলছেন?
নিজের পরিচয় দিল গগল।
অপরপ্রান্ত থেকে জবাব এল, রেমারিককে আমাদের ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দিন। বস তার সম্পর্কে অনেক দিন আগেই আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। রেমারিক এখানে পৌঁছুতে পারলে তার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাদের।
এই প্রথম গগল উপলব্ধি করে, গোটা ইউরোপ জুড়ে রানা ইনভেস্টিগেশন কেন এত নাম করেছে। দায়িত্ব, তা সে যত নগণ্যই হোক, ছোট করে দেখে না ওরা। রানার আচরণও তার মনে শ্রদ্ধার একটা ভাব এনে দিল। রেমারিককে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়ে সেটা ভুলে যায়নি ও, নিজের লোকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়ে রেখেছে।
এরপর গগল ফোন করে রেমারিককে। নিজের পরিচয় না দিয়ে তাকে সে জানায়, বেরলিংগার প্রোটেকশন প্রত্যাহার করেছে। এক ঘন্টার মধ্যে রওনা হচ্ছে পুলিস।
রেমারিক জানতে চায়, আপনি কে বলছেন?
একটা ঠিকানা দিচ্ছি। নিজের ব্যবস্থা নিজে যদি না করতে পার, এই ঠিকানায় গেলে ওরা তোমাকে সাহায্য করবে, ঠিকানাটা জানিয়ে কানেকশন কেটে দিল গগল।
এই রকম একটা বিপদের জন্যে তৈরি ছিল না রেমারিক। কয়েক মিনিট পাথর হয়ে বসে থাকল সে। বেরলিংগারের শত্রুর অভাব নেই, সম্ভবত তাদেরই কেউ ফোন করেছিল। কিন্তু যেচে পড়ে সাহায্য করতে চাওয়ায় মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। ঠিকানাটার ওপর আরেকবার চোখ বুলাল সে। একটা। ইনভেস্টিগেটিং ফার্মের ঠিকানা, প্রতিষ্ঠানটার নাম অনেকের মুখে শুনেছে সে।
বেরলিংগার তাকে ক্ষমা করেনি এটা পরিষ্কার। তার কি করার আছে ভাবল। রেমারিক। গা ঢাকা দিতে পারে, কিন্তু বেশি দিনের জন্যে নয়। হয় বেরলিংগার, নয় পুলিস শেষ পর্যন্ত তাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে। লড়তে পারে সে, কিন্তু জেতা সম্ভব নয়। আরেক উপায় দেশ ত্যাগ করা। কিন্তু ডক এলাকায়। বেরলিংগারের লোকজন যারা কাজ করছে তারা সবাই চেনে তাকে। জাহাজে ওঠার আগেই ধরা পড়ে যাবে সে। পাসপোটও নেই।
আবার তাকে জেলে যেতে হবে?
না। তারচেয়ে এই ঠিকানায় গিয়ে দেখবে সে। যদি ফাঁদ হয়, মেনে নেবে কপালের লিখন।
মাকে চিঠি লিখল রেমারিক। সৎ একজন উকিলের ঠিকানা দিল চিঠিতে। লিখল, এই উকিলের মাধ্যমে বোর্ডিং হাউসটা ভাড়া দিতে হবে, ভাড়ার টাকা দিয়ে ভরণপোষণ আর রিসোর লেখাপড়ার খরচ চালাতে হবে। সবশেষে লিখল, আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হচ্ছে, কবে ফিরব ঠিক নেই।
পকেটে কিছু টাকা নিয়ে- একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়ল রেমারিক।
ওর মা পরদিন ছেলের চিঠি পেল। চিঠি পড়ে চার্চে গেল সে। সারাটা দিন প্রার্থনার মধ্যে কাটাল।
রানা ইনভেস্টিগেশনের মিলান শাখা তিন দিন লুকিয়ে রাখল রেমারিককে। এই তিনদিনে পাসপোর্ট এবং দরকারি আরও কিছু কাগজপত্র তৈরি হল তার জন্যে। তাকে প্রস্তাব দেয়া হল, পৃথিবীর যে-কোন দেশে যেতে পারে সে, বেছে নিতে পারে যে-কোন ধরনের পেশা। এই ফার্ম তাকে বিনা ফি-তে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে। প্রশ্নটা চেপে রাখতে পারেনি রেমারিক–কিন্তু কেন? আমি। তো তোমাদের কোন উপকার করিনি? আমার জন্যে এত কিছু…? শাখা প্রধান, মুচকি হেসে বলেছে, আমাদের চীফের নির্দেশ, তার বেশি আমি নিজেও কিছু জানি না।
এই উত্তরেই সন্তুষ্ট থাকতে হল রেমারিককে। অনেক ধরনের চাকরির কথা বলা হল তাকে–বডিগার্ড, সিকিউরিটি গার্ড, ইনফরমার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চেকার, সেলসম্যান, মেসেঞ্জার, ভাড়াটে সৈনিক। ভাড়াটে সৈনিক? যুদ্ধ? কোথায়?
রেমারিককে বলা হল, আগে ট্রেনিং নিতে হবে, ট্রেনিং শেষ হলে যেখানে খুশি ভাড়ায় গিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে সে। আগ্রহী হয়ে উঠল রেমারিক। সে দুর্বল, ভয় পেয়ে পালাচ্ছে–ট্রেনিং নিয়ে একজন যোদ্ধা হতে পারলে মন্দ হয় না। তাহলে আলজিয়ার্সে যেতে হবে তাকে। ওখানে একটা ট্রেনিং সেন্টার আছে, ট্রেনিং দিয়ে। সৈনিক বানানো হয়। কিন্তু সেই সাথে সাবধান করে দেয়া হল–এ বড় কঠিন। জীবন, প্রতিপদে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। গায়ে মাখল না রেমারিক।
মিলান থেকে নিরাপদেই প্লেনে চড়ে আলজিয়ার্সে চলে এল ও। মিলান এয়ারপোর্টে বেরলিংগারের একাধিক লোককে ঘুর ঘুর করতে দেখল সে, কিন্তু ছদ্মবেশ নিয়ে থাকায় ওকে দেখেও তারা কেউ চিনতে পারল না।
ট্রেনিং সেন্টারটা মরুভূমির মাঝখানে। দেড় মাসের মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিল রেমারিক। শুধু যে খাপ খাইয়ে নিল তাই নয়, সে আর তার ইন্সট্রাক্টর। দুজনেই আবিষ্কার করল, যুদ্ধ-কৌশল দ্রুত রপ্ত করার ব্যাপারে সে একটা প্রতিভা। একবার দেখিয়ে দিলেই যে-কোন ড্রিল বা রণ-কৌশল হুবহু অনুকরণ করতে পারে। সে। টার্গেট প্র্যাকটিসে সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। তার তৈরি অ্যামবুশে সম্ভাব্য সমস্ত ফ্যাক্টর বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়, কোথাও কোন খুঁত থাকে না। তার চিন্তা-ভাবনা অঙ্কের নিয়মে বাধা, ঝুঁকি নেয়া চলে কিনা অঙ্ক কষে বের করে ফেলে।
এই ট্রেনিং সেন্টারে দুজন লোকের সাথে দেখা হল রেমারিকের, দুজনেই তাকে ভালভাবে চেনে, কিন্তু রেমারিক তাদের একজনকেও চিনতে পারল না। একজন ভিনসেন্ট গগল, অপরজন মাসুদ রানা।
ট্রেনিং চলাকালে বেশ কয়েকবারই সেন্টারে এল গগল, প্রতিবার আধুনিক অস্ত্র পাতি আর গোলাবারুদ নিয়ে এল সে। আর রানা এল ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবার পর, ওদের বিদায় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে।
অনুষ্ঠানের মাত্র এক ঘন্টা আগে উপস্থিত হল রানা। রেমারিক লক্ষ করল, তাদের ব্যাচের আট দশ জন যুবক এই নতুন আগন্তুককে ঘিরে ধরে প্রবল উৎসাহে কুশলাদি জানতে চাইছে। প্রায় সমবয়েসী, সুদর্শন, চেহারায় এমন অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে যে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে পারা যায় না। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে। না, সুযোগ পেলেই একা থাকতে ভালবাসে, কারও দিকে মাত্র একবার তাকিয়েই যেন তার অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখতে পায়। আগন্তুক সম্পর্কে প্রচণ্ড কৌতূহল। জাগল রেমারিকের মনে। কিন্তু একে তাকে প্রশ্ন করে বিশেষ কিছু জানতে পারল না সে। শুধু জানল, আগন্তুক নয়জন যুবককে নিজের খরচে এখানে ট্রেনিং নিতে পাঠিয়েছিল, ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন তাদেরকে নিয়ে যেতে এসেছে।
অনাড়ম্বর বিদায় অনুষ্ঠান শেষ হল। তখনও রেমারিক ঠিক করতে পারেনি। কোথায় যুদ্ধ করতে যাবে-সে। হঠাৎ আগন্তুককে দেখে তার সামনে দাঁড়াল সে, বলল, বলতে পার, যুদ্ধ করতে কোথায় আমার যাওয়া উচিত?
রোডেশিয়ায়, সাথে সাথে জবাব দিল রানা। কিংবা লেবাননে। যদি ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে চাও। আমার বন্ধুরা এখানে যারা ট্রেনিং শেষ করেছে, দুভাগে। ভাগ হয়ে লেবানন আর রোডেশিয়ায় যাচ্ছে ওরা। তুমি যে-কোন একটা দলের সাথে ভিড়ে যেতে পার।
তোমার নামটা আমার জানা হয়নিঃ..
মাসুদ রানা।
আর কোন আলাপের সুযোগ হল না, রানাকে নিয়ে তার বন্ধুরা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল।
পরদিন আরও চারজনের সাথে রওনা হল রেমারিক। গন্তব্য রোডেশিয়া। উদ্দেশ্য মুক্তিপাগল কালোদের সাথে স্মিথ সরকারের শ্বেতাঙ্গ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
সে যুদ্ধের স্মৃতি চিরকাল স্মরণ থাকবে রেমারিকের। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে একমাত্র শ্বেতাঙ্গ ছিল সে, তাতে করে আশ্চর্য সব সুবিধে ভোগ করার সুযোগ এসে যায় তার। বার কয়েক শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের হাতে ধরা পড়েও তাদের ভুল বুঝিয়ে নিজেকে মুক্ত করে আনে সে।
তিনমাস পর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিল রানা। রেমারিকের কৃতিত্বের খবর শুনে তাকে নিজের ইউনিটে টেনে নিল ও। এখানেই পরস্পরকে চিনতে শুরু করল। ওরা, ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল বন্ধুত্ব।
রোডেশিয়ায় যুদ্ধ করার সময় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল রেমারিক। তার মহত্ত্ব, তার আত্মত্যাগ, তার বুদ্ধি আর সাহস তাকে একটানে তুলে নিয়ে এল রানার পাশে। কিংবদন্তীর নায়কে পরিণত হল সে। এমন কিছু ঘটনা ঘটল, ব্যক্তিগতভাবে রেমারিকের প্রতি চিরঋণী হয়ে থাকল রানা। আক্ষরিক অর্থেই অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রানাকে ছিনিয়ে আনল রেমারিক। সেই রকম রানাও রেমারিককে নতুন জীবন দান করল, নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে শত্রুঘাটি থেকে বন্দী রেমারিককে উদ্ধার করে নিয়ে এল।
পরস্পরকে সাহায্য করতে পেরেছে বলেই বন্ধুত্ব হল, ব্যাপারটা তা-ও ঠিক নয়। চরিত্রগত কিছু মিলও ছিল, মিল ছিল জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতে, রুচিতে অরুচিতে, আহারে-বিহারে। রানার কোন অহঙ্কার নেই, রেমারিকেরও নেই। শেখার আগ্রহ রেমারিকের জন্মগত, রানারও তাই। দুজনের কেউই অন্যায় সহ্য। করতে পারে না।
ইতিমধ্যে রেমারিকের সব কথা জানা হয়ে গেছে রানার। মা আর ভাই কেমন আছে জানে না রেমারিক, লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভেজায়। একদিন বেলাডোনার করুণ পরিণতির কথাও জানল রানা। জানল, আতুনি বেরলিংগার রেমারিকের সবচেয়ে বড় শত্রু। মুখে কিছু বলল না রানা, কিন্তু মনে মনে ঠিক করল, রেমারিককে আবার তার সমাজে ফিরে যেতে সাহায্য করবে ও। তাকে ও সুখী দেখতে চায়।
দেশের কাজে ঢাকায় ফিরে যেতে হল রানাকে। দেশ থেকে আবার বেরুল রানা, চলে এল ইটালীতে, কিন্তু রেমারিক সে খবর জানল না। ইটালীতে এসে মাফিয়া নেতারা কে কোথায় কি অবস্থায় আছে খোঁজ-খবর নিল রানা। আত্বনি বেরলিংগার সম্পর্কে জানল, হাতে আরও টাকা আর ক্ষমতা আসায় নিজের হেডকোয়ার্টার নেপলস থেকে রোমে সরিয়ে নিয়ে গেছে লোকটা। নেপলসের বিধাতা এখন অন্য একজন ডন, যদিও বেরলিংগারেরই লোক সে। উত্তর থেকে এসেছে লোকটা, এখানকার অতীত সম্পর্কে তার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই।
মাফিয়া মহলে প্রভাবশালী দুএকজন নেতার সাথে পরিচয় ছিল রানার। তাদের একজনের সাথে দেখা করল ও। দীর্ঘ আলাপের পর রানাকে কথা দেয়া হল, ভিটেলা রেমারিক আবার নেপলসে ফিরে এসে বসবাস শুরু করলে। বেরলিংগার বা আর কেউ তাকে কোন রকম বিরক্ত করবে না।
তখন লেবাননে যুদ্ধ করছে রেমারিক, তাকে নিয়ে আবার নেপলসে ফিরে এল রানা। মার নামে কেনা বাড়িটা অক্ষতই আছে, একটা চার্চকে ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেটা। কুমারী মাতারা থাকে সেখানে। পজিটানোয় মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল রেমারিক, সাথে রানা। ওরা ভাল আছে, সে-খবর রানার কাছ থেকে আগেই পেয়েছিল রেমারিক।
রিসো, তার ছোট ভাই, রোম ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র তখন, ইকনমিকস পড়ছে সে। মার বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনও খটখটে। ছেলের ফিরে আসা উপলক্ষে চার্চে গেল সে, বারোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এল।
ব্যস, এখানেই রেমারিকের সৈনিক জীবনের ইতি হল। এরপর মাল্টায় গেল ও রানার সাথে, বিয়ে করল। বউ নিয়ে এখানেই ফিরে এসেছিল ও।-মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমারিক। কী হতে পারত, আর কী হয়ে গেল! জীবনটা কী!
.