প্রায় তিরিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল। বড়সাহেবের বাংলোর সামনে তিনজন বন্দুকধারী পুলিশ। দু'জন চৌকিদার যারা ডাক্তারবাবুকে চেনে, তাদের একজন ভেতরে গিয়ে খবরটা দিয়েছিল।
তিরিশ মিনিট পরে ডাক এল।
আরামকেদারায় বসে আছেন বড়সাহেব। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বন্দুকধারী। ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, "এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? ওখানে কি অসুবিধে হয়েছে?"
"অসুবিধে হয়নি কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেড়ে যাওয়ায় থাকাটা নিরাপদ নয়," বললেন ওখানকার প্রশাসক।
"যাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তাদের দেখা পেয়েছ?"
"হ্যাঁ স্যার। আমার সঙ্গে যারা গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ওদের কোনও মিল নেই। ভাষাও বদলে গিয়েছে।"
"তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওখান থেকে দু'জনকে এখানে নিয়ে আসতে। তার বদলে যাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে, তাদের একজনকে শুনলাম ফেরত আনোনি। এর কী ব্যাখ্যা দেবে?"
"সে নিজে থেকেই সেখানে থাকতে চেয়েছে, আমি নিষেধ করিনি," ডাক্তারবাবু বললেন।
"তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওদের ওখানে নিয়ে গিয়ে বিশেষ একটা কাজ করিয়ে আনা। তুমি দায়িত্ব পালন করোনি। তোমার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আছে। তোমাকে সেই কারণে আপাতত সাসপেন্ড করলাম। তোমার সম্পর্কে এনকোয়ারি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তুমি বাগানে ঢুকবে না। তুমি এই জেলার বাইরেও যাবে না," বড়সাহেব এমনভাবে হাত নাড়লেন যেন তিনি শার্টে লাগা ময়লা সরাচ্ছেন।
বাইরে এসে নদীর পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভাবলেন ডাক্তারবাবু। কিছুদিন ধরে তাঁর স্ত্রী বলছিলেন চাকরি থাকতে থাকতে চা-বাগানের বাইরে একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে। অবসরের পর সেখানে থাকা যাবে। বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিনি অলস হয়ে ছিলেন। বাড়ি করে রাখলে এখন সেখানে যাওয়া যেত! আপাতত তাঁর মনে হল স্ত্রীর সন্ধানে যাওয়াই প্রথম কাজ। তিনি হাঁটা শুরু করলেন।
একপাশে কুলিলাইন, অন্যপাশে ছোট্ট নদী, ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে চিৎকারটা শুনতে পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হলেন। পুষি দৌড়োতে দৌড়োতে এগিয়ে আসছে। সামনে পৌঁছে পুষি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। ছেলেটার পেটে গুলি লেগেছে।"
"কোন ছেলে? কে গুলি করেছে?"
"আর কে!" খুব বিরক্ত হল পুষি, "তাড়াতাড়ি চলুন। এখন তো যারা স্বাধীনতা দেবে না, তারা গুলি করে মারে আর যাহা স্বাধীনতা চায়, তারা গুলি খেয়ে মরে। তাড়াতাড়ি চলুন," ব্যস্ত হয়ে হাত নাড়ল পুষি।
ডাক্তারবাবু অনুসরণ করলেন। পুষির দ্রুত চলার সঙ্গে তাল রাখতে হচ্ছিল তাঁকে। হঠাৎ মনে হল, ওদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান দেখাতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এখন পুষি তাঁকে পথ চেনাচ্ছে।
হঠাৎ বহু দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকার কানে এল। আরও একটু এগোলে শব্দগুলো স্পষ্ট হল, 'ভারতমাতা কি জয়!' অনেকগুলো কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে।
একটা ভাঙা খড়ের ঘরের মধ্যে ঢুকে পুষি থমকে দাঁড়াল। ঘরে একটি লোক শুয়ে আছে। একটি কিশোর তার পাশে বসে। ডাক্তারবাবু লোকটির পাশে বসে নাড়ি দেখলেন। শরীর প্রাণহীন।
ওপাশের চিৎকার করা লোকগুলো কাছাকাছি এসে গেছে। আচমকা গলার শিরা ফুলিয়ে পুষি চিৎকার করে উঠল, 'ভারতমাতা কি জয়!' কিশোর সশব্দে কেঁদে উঠল।
ডাক্তারবাবু অতীত এবং আগামীকালকে দু'হাতে ধরে রাখলেন। শক্ত করে।
***
তিরিশ মিনিট পরে ডাক এল।
আরামকেদারায় বসে আছেন বড়সাহেব। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বন্দুকধারী। ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, "এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? ওখানে কি অসুবিধে হয়েছে?"
"অসুবিধে হয়নি কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেড়ে যাওয়ায় থাকাটা নিরাপদ নয়," বললেন ওখানকার প্রশাসক।
"যাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তাদের দেখা পেয়েছ?"
"হ্যাঁ স্যার। আমার সঙ্গে যারা গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ওদের কোনও মিল নেই। ভাষাও বদলে গিয়েছে।"
"তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওখান থেকে দু'জনকে এখানে নিয়ে আসতে। তার বদলে যাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে, তাদের একজনকে শুনলাম ফেরত আনোনি। এর কী ব্যাখ্যা দেবে?"
"সে নিজে থেকেই সেখানে থাকতে চেয়েছে, আমি নিষেধ করিনি," ডাক্তারবাবু বললেন।
"তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওদের ওখানে নিয়ে গিয়ে বিশেষ একটা কাজ করিয়ে আনা। তুমি দায়িত্ব পালন করোনি। তোমার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আছে। তোমাকে সেই কারণে আপাতত সাসপেন্ড করলাম। তোমার সম্পর্কে এনকোয়ারি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তুমি বাগানে ঢুকবে না। তুমি এই জেলার বাইরেও যাবে না," বড়সাহেব এমনভাবে হাত নাড়লেন যেন তিনি শার্টে লাগা ময়লা সরাচ্ছেন।
বাইরে এসে নদীর পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভাবলেন ডাক্তারবাবু। কিছুদিন ধরে তাঁর স্ত্রী বলছিলেন চাকরি থাকতে থাকতে চা-বাগানের বাইরে একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে। অবসরের পর সেখানে থাকা যাবে। বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিনি অলস হয়ে ছিলেন। বাড়ি করে রাখলে এখন সেখানে যাওয়া যেত! আপাতত তাঁর মনে হল স্ত্রীর সন্ধানে যাওয়াই প্রথম কাজ। তিনি হাঁটা শুরু করলেন।
একপাশে কুলিলাইন, অন্যপাশে ছোট্ট নদী, ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে চিৎকারটা শুনতে পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হলেন। পুষি দৌড়োতে দৌড়োতে এগিয়ে আসছে। সামনে পৌঁছে পুষি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। ছেলেটার পেটে গুলি লেগেছে।"
"কোন ছেলে? কে গুলি করেছে?"
"আর কে!" খুব বিরক্ত হল পুষি, "তাড়াতাড়ি চলুন। এখন তো যারা স্বাধীনতা দেবে না, তারা গুলি করে মারে আর যাহা স্বাধীনতা চায়, তারা গুলি খেয়ে মরে। তাড়াতাড়ি চলুন," ব্যস্ত হয়ে হাত নাড়ল পুষি।
ডাক্তারবাবু অনুসরণ করলেন। পুষির দ্রুত চলার সঙ্গে তাল রাখতে হচ্ছিল তাঁকে। হঠাৎ মনে হল, ওদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান দেখাতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এখন পুষি তাঁকে পথ চেনাচ্ছে।
হঠাৎ বহু দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকার কানে এল। আরও একটু এগোলে শব্দগুলো স্পষ্ট হল, 'ভারতমাতা কি জয়!' অনেকগুলো কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে।
একটা ভাঙা খড়ের ঘরের মধ্যে ঢুকে পুষি থমকে দাঁড়াল। ঘরে একটি লোক শুয়ে আছে। একটি কিশোর তার পাশে বসে। ডাক্তারবাবু লোকটির পাশে বসে নাড়ি দেখলেন। শরীর প্রাণহীন।
ওপাশের চিৎকার করা লোকগুলো কাছাকাছি এসে গেছে। আচমকা গলার শিরা ফুলিয়ে পুষি চিৎকার করে উঠল, 'ভারতমাতা কি জয়!' কিশোর সশব্দে কেঁদে উঠল।
ডাক্তারবাবু অতীত এবং আগামীকালকে দু'হাতে ধরে রাখলেন। শক্ত করে।
***