What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে কিছু কথা (1 Viewer)

BRICK

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Dec 12, 2019
Threads
355
Messages
10,073
Credits
81,757
T-Shirt
Glasses sunglasses
Calculator
Watermelon
Pistol
Pistol
এক সাহিত্যিকের এত ক্ষুরধার লেখা ইদানিং পড়িনি। আখতারুজ্জামান আজাদ।
কলকাতার লেখক শিল্পীরা - একটু পা চালিয়ে !
*********
সাহিত্য-যিশু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওষধি পদক ও অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিন।
লিখেছেন
আখতারুজ্জামান আজাদ।

পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যাকাশে গতকাল এক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। নিখিল ভারত দূরে থাক; এমন ঘটনা গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আগে কখনও ঘটেছে কি না, এ রীতিমতো গুরুতর গবেষণার বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা সামান্যই— একজন কবি 'বাংলা সাহিত্যচর্চায় নিরলস সাধনা ও সামগ্রিক কৃতিত্বের জন্যে' রাজ্যটির বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু পুরস্কারটি মোটেই সাধারণ না। বস্তুত অবিভক্ত সৌরজগতের ইতিহাসেই এমন পুরস্কার বিরল। কারণ সুনির্দিষ্টভাবে এই কবিকেই দেওয়ার জন্য পুরস্কারটি নতুন করে প্রবর্তন করা হয়েছে। পুরস্কারটির যে নাম রাখা হয়েছে, সেটিও বেশ লোমহর্ষক— বাংলা আকাদেমি রিট্রিভার শিপ পুরস্কার। রিট্রিভার শিপ মানে উদ্ধারকারী জাহাজ। অন্য কোনো জাহাজ ডুবে গেলে তা উদ্ধার করতে রিট্রিভার শিপ পাঠানো হয়। অন্য পেশায় জড়িত থেকেও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে যারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা পাবেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির এই রিট্রিভার শিপ পদক। তা হলে এর মানে দাঁড়াল— পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যজাহাজ এতদিন যাবৎ ডুবে ছিল, সদ্য 'রিট্রিভার শিপ পদক'প্রাপ্ত কবিটি উদ্ধারকারী জাহাজ হিশেবে ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে উদ্ধার করে ফেলেছেন বা ফেলতে যাচ্ছেন।
খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস— যিশুখ্রিষ্ট মারা গেছেন, তিনি আর ফিরবেন না। মুসলমানদের বিশ্বাস— যিশু মারা যাননি, খোদা তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, পুনর্বার আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীকে তিনি যাবতীয় অনাচারমুক্ত করবেন। সে-মতে বলা যায়— আলোচ্য কবিটি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-যিশু। বাংলাদেশের দুই সুপরিচিত উদ্ধারকারী জাহাজের নাম হামজা আর রুস্তম। সে হিশেবে এই কবি নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-হামজা ও সাহিত্য-রুস্তমও বটে। আলোচ্য কবি আর কেউ নন— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু সাহিত্য-যিশু না কিংবা হামজা-রুস্তমই না, ভদ্রমহিলা বাংলা সাহিত্যের শচীন টেন্ডুলকারও। শচীন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করেছিলেন। ২০২০ সালের এক বইমেলায়ই মমতার বই বেরিয়েছে তেরোটা। ২০২০ পর্যন্ত তার বইয়ের সংখ্যা ছিল একশো এক। এর পরের দুই বছরে সংখ্যাটা আরো বেড়েছে কি না, বাড়লে তা কই গিয়ে ঠেকেছে; জানি না। শুধু জানি যে, তার সুবৃহৎ 'কবিতা বিতান' বইটায় কবিতা আছে হাজারের কাছাকাছি— নয়শো ছেচল্লিশটা। এই বইয়ের জন্যই রাজ্যটির বাংলা আকাদেমি এই চাঞ্চল্যকর 'রিট্রিভার শিপ পদক' চালু করেছে। শুধু তাকেই পুরস্কৃত করার জন্য এত আয়োজন।

কোনো পুরস্কার প্রবর্তিত হলে তা প্রতিবছরই দেওয়া হবে— এটিই স্বাভাবিক ও প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু এই লোমহর্ষক 'রিট্রিভার শিপ পদক' প্রতিবছর দেওয়া হবে না। হ্যালির ধূমকেতু যেমন পৌনে একশো বছরে একবার করে উদিত হয়, জাতীয় নির্বাচন যেমন অর্ধদশকে একবার করে অনুষ্ঠিত হয়, অধিবর্ষ বা বিশ্বকাপ যেমন চারবছর অন্তর একবার করে আসে; এই পদকও তেমনি দেওয়া হবে তিনবছর অন্তর। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে পদক দেওয়া যেহেতু হয়েই গেছে, অতএব প্রতিবছর (কিংবা আদৌ আর কখনও) পদক না দিলে তাতে পদকের কিছুই যাবে-আসবে না, তিনবছর পার হতে-হতে এই পদকের কথা আমজনতা অতটা মনেও রাখবে না; কোনোমতে 'অনিবার্য কারণবশত' সেরেফ দু-একবার যদি এই পদক স্থগিত করে রাখা যায়, তা হলেই ইতিহাস থেকে 'রিট্রিভার শিপ পদক' নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ইতিহাসে বিরাজ করবেন এই পদকধারী একমাত্র কবি হিশেবে।

অন্য পেশায় থেকেও 'নিরলসভাবে' সাহিত্যসেবা করে যাচ্ছেন— ভূভারতে এ রকম লোকের অভাব নেই। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দকে স্বাগত জানিয়ে গুজরাটের কবি নরেন্দ্র মোদি টুইটারে 'আভি সুরুজ তো উগা হ্যায়' শিরোনামে কবিতা তো লিখেছিলেনই, সেই কবিতা স্বকণ্ঠে আবৃত্তিও করেছিলেন। কর্ণাটকের কবি দীপিকা পাড়ুকোন তো কবিতা লেখেন বারো বছর ধরে, সে হিশেবে তার কবিজীবনের বয়স দুই যুগ। বোমাহামলায় সহায়তা করায় অভিযোগে অভিযুক্ত মহারাষ্ট্রের কবি সঞ্জয় দত্ত অন্য দুই কয়েদির উৎসাহে কারাগারে বসেই লিখে ফেলেছিলেন অর্ধসহস্রাধিক কবিতা। কারাগার থেকে বেরিয়ে ঐসব কবিতা নিয়ে বই প্রকাশ করার পরিকল্পনাও সঞ্জয়ের ছিল। প্রকাশ করেছেন কি না, জানি না। ভারত-বন্ধের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন হিমাচলের কবি কঙ্গনা রনৌত— 'এসো তবে করি ভারত বন্ধ। নৌকা তো এমনিতেই ঝড়ের আঘাতে জর্জরিত। তবুও কুড়ালটা নিয়ে এসো, আরো কয়েকটা ফুটো করে দিই। দেশভক্তদেরকে বলো, এবার তোমরাও নিজেদের জন্য দেশের একটা টুকরা চেয়ে নাও। রাস্তায় নেমে তুমিও ধরনা দাও। চলো, এই গল্প আজ এখানেই শেষ করি।' তবে, উল্লিখিত বলিউড-কবিদের কেউই বাঙালিও না, পশ্চিমবঙ্গেরও না। তাই, বাংলা আকাদেমির এই রিট্রিভার শিপ পদক তাদেরকে দেওয়ার জো নেই।
অন্য পেশায় সম্পৃক্ত থেকেও নিরলসভাবে কবিতা লিখেছেন— পশ্চিমবঙ্গে এমন দুজনের কথা আপাতত মনে পড়ছে। একজন ঘাটালের কবি দীপক অধিকারী (লোকে যাকে চিত্রনায়ক দেব হিশেবে জানে)। বঙ্গীয় জনপদের এই দ্রুততম কবি প্রেমিকা রুক্মিণী মৈত্রকে উদ্দেশ করে, ২০২০ সালে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। বাংলার এই উসাইন বোল্ট সেই কবিতাটি আবার বাংলায় লেখেননি, লিখেছিলেন রীতিমতো ইংরেজিতে। সেই মহার্ঘ্য কবিতাখানিকে বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো— 'এক ছিল গাছ, আর এক ছিল চারা। গাছটি চারাকে জিজ্ঞেস করল কেমন আছো। চারা বলল, ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?' বিশ্বসাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতাটি সেখানেই শেষ। অন্য পেশার আরেক ব্যক্তি— বীরভূমের খ্যাতিমান খুচরা বাদামব্যবসায়ী ভুবন বাদ্যকর 'আমার কাছে নেইকো, বুবু, ভাজা বাদাম; আমার কাছে পাবে শুধু কাঁচা বাদাম' গীতিকবিতা লিখে ভূভারতে ভূকম্পন সৃষ্টি করেছেন। দীপক অধিকারীকে (দেব) ২০২৫ সালে, আর এই ভুবন বাদ্যকরকে ২০২৮ সালে সাহিত্যে 'রিট্রিভার শিপ পদক' দেওয়া যেতেই পারে। ২০৩১ সালে 'অন্য পেশা'র কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলে বীরভূমেরই আরেক বীরপুরুষ অনুব্রত মণ্ডলকে এই পদকের জন্য বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। অনুব্রত আনুষ্ঠানিকভাবে অদ্যাবধি কোনো কবিতা লেখেননি— সত্য। তবে তার 'শুটিয়ে লাল করে দেবো, নোংরামো বার করে দেবো' সহস্র পঙক্তিবিশিষ্ট যেকোনো কবিতার চেয়েও নিঃসন্দেহে শক্তিশালী কবিতা। এই দুই পঙক্তি তাকে দুই বঙ্গে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট।
যা হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মমতাজ আলী খানের 'হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো; সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো' গানের বাস্তব প্রতিমূর্তি। যে বাংলা আকাদেমি মমতাকে এই বিচিত্র পদক দিয়েছে, সেই আকাদেমির সভাপতি ব্রাত্য বসু মমতারই মন্ত্রিসভার সদস্য। অর্থাৎ নিজের লোক দিয়ে পদকটি নিজের জন্য সৃষ্টিও করেছেন মমতা, পদকের জন্য নিজেকে নির্বাচিতও করেছেন মমতা। মেডেল নিজের হাতে নিজে তুলে দেওয়া যায় না বিধায় পদকপ্রদান মমতা বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে উচ্চপদস্থ কেউ না থাকায় পদকটি তিনি কার হাত থেকে নেবেন, এও ছিল এক মহাসংকট। প্রধান শিক্ষক নিজেকেই স্কুলের সেরা ছাত্র ঘোষণা করলে যা ঘটে, মমতার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মমতাকে যখন পদক নেওয়ার জন্য মঞ্চে ডাকলেন, আরেক মন্ত্রী রুদ্রনীল সেন এসে মাইকে ঘোষণা দিলেন পদকটা যেন মমতার পক্ষে ব্রাত্যই নেন। উপস্থাপক পদক ঘোষণা করে উপস্থাপকই পদক নিয়েছেন— ঘটনা হিশেবে এও কম লোমহর্ষক না। যা হোক, মমতা পদকটা ভিন্নভাবে নিতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে তার হাতে তিনটে সুযোগ ছিল। মেডেলটাকে তিনি বাঁ হাত থেকে 'আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রিট্রিভার শিপ পুরস্কার প্রদান করলাম' বলে ডান হাতে হস্তান্তর করতে পারতেন, এই একই শ্লোক বলে মেডেল শূন্যে ছুড়ে দিয়ে জন্টি রোডসের মতো ক্ষিপ্রগতিতে ক্যাচ নিতে পারতেন কিংবা নিজের একটা আবক্ষ ভাস্কর্য বানিয়ে সেই ভাস্কর্যের গলায় মেডেল পরিয়ে দিতে পারতেন।

(আলোচ্য পুরস্কার ঘোষণাকালে মঞ্চে কবিসাহিত্যিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ; ব্রাত্য বসুর ভাষ্যমতে তাদের অনুমোদনক্রমেই মমতাকে ঐ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বিষণ্ণ হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার হলো শেষোক্ত কবি, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, দুটো পঙক্তির জন্য দুই বাংলায় জনপ্রিয়— 'মানুষ থেকেই মানুষ আসে, বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়; তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়।')

যা হোক, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে মাথায় রেখে নতুন পদক সৃষ্টির নজির ইতিহাসে এই প্রথম নয়। অপর বঙ্গেরই আরেক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেও উত্তর আমেরিকা মহাদেশে একটি পদকের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তাও বেশিদিন আগের কথা না। চলতি বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে শোনা গেল 'কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন' নামক একটি কথিত সংস্থা খালেদাকে আড়াই বছর আগে 'মাদার অব ডেমোক্রেসি' পদক দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা খালেদাকে এমনিতেই বেশ ক'বছর ধরে 'মাদার অব ডেমোক্রেসি' বলে সম্বোধন করে থাকেন। কর্মীরা যে নামে ডাকেন, পদকও সেই একই নামে— রেডিমেড পদক এমন হয় না, এ রীতিমতো দর্জির কাছে যথাযথ মাপ দিয়ে বানিয়ে আনা নিখুঁত অর্ডারি জামার মতো অর্ডারি পদক। এই পদককাণ্ডের আগে বাংলাদেশের কেউ ঐ সংস্থার নামও শোনেনি; সংস্থাটি অতীতেও অন্য কাউকে 'মাদার অব ডেমোক্রেসি' নামে পদক দেয়নি, পরেও দেয়নি, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতেও দেবে বলে ভাবলক্ষণ নেই। অর্থাৎ 'মাদার অব ডেমোক্রেসি' পদক পৃথিবীতে একজনের জন্য একপিসই তৈরি হয়েছে। একবার ফল দিয়ে যে গাছ মরে যায়, সেই গাছকে যদি 'ওষধি গাছ' বলে; তা হলে এই 'রিট্রিভার শিপ' এবং 'মাদার অব ডেমোক্রেসি' নিশ্চয়ই ওষধি পদক।

শুধু পদক না, নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য আলাদা পদ সৃষ্টির নজিরও বাংলাদেশে আছে। খালেদা জিয়ারই জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে দলের কোন পদে রাখা হবে, এ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধ। তারেকের জন্য কোনো পদই উপযুক্ত মনে না হওয়ায় অথবা 'চেয়ারম্যান' ছাড়া অন্য কোনো পদই তারেকের পছন্দ না হওয়ায় বিএনপিতে প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছিল 'সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব' পদ। কিছুকাল থাকার পর সেই পদও তারেকের ভালো লাগেনি। তার জন্য দলে এরপর সৃষ্টি করা হয় 'সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান' পদ। শের-এ-লন্ডন তারেক রহমান কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত এই পদে আছেন। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিশেষ পদ সৃষ্টির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাংলাদেশে আছে। জোটবদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামি লিগের অলিখিত চুক্তি ছিল জোট জয়ী হলে আওয়ামি লিগ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানাবে। ছেলেবেলার বোষ্টমী, মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি কিংবা বড়বেলার বরুনা— তেত্রিশ বছরেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেওয়া কথা কেউ যেমন রাখেনি; আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনাও এরশাদকে তেমনি কখনও রাষ্ট্রপতি বানাননি, বরং তার জন্য সৃষ্টি করেছিলেন সম্পূর্ণ আনকোরা এক পদ— প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। একই ব্যক্তি একাধারে বিরোধীদলেও আছেন, আবার সরকারপ্রধানেরও বিশেষ দূত— বিশ্বের বুকে এ এক 'অপার বিস্ময়' তো বটেই, 'আপার বিস্ময়'ও বৈকি।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে কাব্যপ্রতিভা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে— এমন নেতাদের তালিকায় ভারতীয় উপমহাদেশে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এতকাল অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন। মমতার বইয়ের সংখ্যা একশো এক হলেও এরশাদের বই ছিল মোটে সাতাশটা, এর মধ্যে এক ২০১৮ সালের বইমেলায়ই প্রকাশিত হয়েছিল তার আটটা বই। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি কবিদেরকে নিয়ে আসর বসাতেন, অনুগত কবিদেরকে বিভিন্ন রকম উপঢৌকন দিতেন, কবিদেরকে নিয়ে বিদেশ সফরে যেতেন। 'এশীয় কবিতা উৎসব' আয়োজন করে বিদেশী কবিদেরকেও বাংলাদেশে আনতেন। এত কবিতা-অন্তঃপ্রাণ রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান অন্তত এই উপমহাদেশ আর কখনও দেখেনি। অবশ্য বলা হয়ে থাকে— এরশাদের নামে ছাপা হওয়া অধিকাংশ কবিতাই এরশাদের নিজের লেখা না, ওসব লিখে দিতেন অন্যরা। যারা লিখে দিতেন বলে বাজারে গুজব ছিল; তারা হচ্ছেন সৈয়দ আলী আহসান, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবু জাফর ওবায়াদুল্লাহ্। এই অভিযোগ এই ত্রয়ী অবশ্য তাদের জীবদ্দশায় কখনোই স্বীকার করেননি।

ক্ষমতায় আরোহনের পর প্রথম দু'বছর তার কবিতা দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় বাধ্যতামূলকভাবে ছাপা হতো। জাহাঙ্গির হোসেন নামক একজন বাসস-সাংবাদিক এক সংবাদসম্মেলনে এরশাদকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন প্রথম পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির কবিতা ছাপার ব্যাপারে পত্রিকা সম্পাদকদের ওপর এরশাদের নির্দেশ আছে কি না। এই প্রশ্নের পর এরশাদের কবিতা প্রথম পাতা থেকে ভেতরের পাতায় চলে গিয়েছিল, বদলির আদেশ পেয়ে ঐ সাংবাদিককেও ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল চট্টগ্রামে। স্বৈরশাসকরা বিরোধীদলকে মোটেই ভয় পান না; ভয় পান স্বাধীনচেতা কবি-সাহিত্যিকদেরকে। বিরোধীদলের ইদের আগের বা পরের শত আন্দোলন সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না; স্পর্শ করে কবিদের স্বৈরাচারবিরোধী গান-কবিতা, কথাসাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস। এরশাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিলেন তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা। স্বৈরশাসকরা হয় কবিতা নিষিদ্ধ করেন অথবা কবিদের একাংশকে উপঢৌকন দিয়ে কবজা করার চেষ্টা করেন। এরশাদ কবিদের একাংশকে কেনার মাধ্যমে এবং নিজেও কবি সাজার মধ্য দিয়ে কবি-দমনের চেষ্টা করেছিলেন, অনেকটা সফলও হয়েছিলেন, অনেক কবিই তার ক্রীতদাস হয়েছিলেন। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ রফিক এরশাদের এই কবিতা-বাতিক নিয়ে 'খোলা কবিতা' নামে ষোলো পৃষ্ঠার একটা দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। সেটির উল্লেখযোগ্য দুটো পঙক্তি— 'সব শালা কবি হবে, পিপীলিকা গোঁ ধরেছে উড়বেই; বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই।'
যা হোক, স্বৈরতান্ত্রিক বুদ্ধির মাপকাঠিতে মমতা এরশাদের তুলনায় নেহায়েত দুগ্ধপোষ্য শিশু হলেও একটা দিক দিয়ে মমতা এগিয়ে গেছেন। প্রায় এক দশক ক্ষমতায় থাকলেও এরশাদ নিজেকে নিজে কখনও রাষ্ট্রীয় পদক দেননি। মমতা এরশাদের না-করা কাজটি করে ফেলেছেন। আমার আশঙ্কা— এখন ঢাকার চাটুকাররাও কোলকাতার চাটুকারদের তরিকা অবলম্বন করে বসে কি না। ঢাকার চাটুকাররা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে যদি একবার বলে বসে যে, ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে একটা 'রিট্রিভার শিপ পদক' তার প্রাপ্য, তিনি নিজেকে সংবরণ করতে পারবেন কি না— নিশ্চয়তা নেই। কেউ তোষামোদ করেছে বা করতে গিয়েছে, আর প্রধানমন্ত্রী সেটা উপভোগ করেননি— এমন নজির নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দলের আর সবাইকে কেনা গেলেও তাকে কেনা যায় না; কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে— স্বাভাবিকের একটু বেশি প্রশংসায়ই তিনি বিগলিত হয়ে যান। বিভিন্ন সময়ে বিবিধ সব অখ্যাত পুরস্কার আনতে তিনি সশরীর বিদেশে গেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রহণ করেছেন এমন এক 'আন্তর্জাতিক মাদার তেরেসা পদক'— যে পদক পেয়েছেন বিতর্কিত সাবেক সাংসদ এইচবিএম ইকবাল, বসুন্ধরা গ্রুপের আহমেদ আকবর সোবহান, এমনকি সায়েম সোবহান আনভিরও।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রায় চল্লিশটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার ইতোমধ্যেই পেয়ে ফেলেছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির ব্যাপারে যেকোনো সময়ে কল আসতে পারে বিধায় নোবেল কমিটি শেখ হাসিনাকে ফোনের আশেপাশে থাকতে বলেছে, চাটারফ্লাইয়ের দল এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার পর অর্ধদশক আগে লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া বইয়ের একটা কলামে সখেদে পরামর্শ দিয়েছিলাম— পুরস্কার পেতে-পেতে শেখ হাসিনা এখন পুরস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন, এখন বরং আলফ্রেড নোবেলকেই মরণোত্তর 'শেখ হাসিনা পদক' দেওয়া হোক। যা হোক, অন্য পেশায় নিয়োজিত থেকেও নিরলসভাবে সাহিত্যচর্চা করে যাওয়ায় ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমি বা কোলকাতার বাংলা আকাদেমি বাংলাদেশের সড়কপরিবহণ ও সেতু মন্ত্রীকে 'রিট্রিভার শিপ পদক' দিলে আমি অবশ্য আনন্দিতই হব। করোনা নিয়ে সেতুমন্ত্রী জাতিকে যে প্রলয়ঙ্কর কবিতা শুনিয়েছিলেন, করোনা তাতেই ভয় পেয়ে এই জনপদ ত্যাগ করেছে বলে জনশ্রুতি আছে। 'আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী, জাতি হিশেবেও শক্তিশালী'— এও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কোনো কবিতার চেয়ে কম আবেদনময় নয়।

আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা প্রস্তাব দিতাম— সাহিত্যপদক থেকে শুরু করে যত ধরনের জাতীয় ও স্থানীয় পদক বাংলাদেশ থেকে দেওয়া হয়, এর সবগুলোর এক কপি তাকে দেওয়া হবে; তার 'হরে কর কম্বা, গরু ডাকে হাম্বা, গর্জন করে অম্বা, মা ডাকেন বুম্বা; হরে কর কম্বা, ডব্বা ডব্বা রব্বা, হুড়হুড় করে হুম্বা, তোবা তোবা আব্বা'কে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে; সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়ে তাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী 'জাতীয় মহিলা কবি' হিশেবে ঘোষণা করা হবে (পাঠ্যপুস্তকে সেইসাথে ওঠানো হবে তার রচিত আরো একটি কবিতা— 'কেমন আছো? থ্যাঙ্ক ইউ। অভিনন্দন— থ্যাঙ্ক ইউ। মা কোথায়— ঘেউ ঘেউ। মানেটা কী? সাথে ফেউ। ভর্তি হয়েছ? কলেজে কিউ। ফর্ম তুলেছ? ফর্মটা ডিউ। ধন্যবাদ— সি ইউ। সাথে কে? বন্ধু পিউ। ভালো থেকো— বাই বাই। হরে কৃষ্ণ— হ্যালো হাই); বিনিময়ে তিনি আমাদেরকে আমাদের প্রাপ্য তিস্তার পানিটুকু যেন দিয়ে দেন।

পুনশ্চ :
এক দশক আগে নির্মিত 'দ্য ডিক্টেটর' চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বৈরশাসক আলাদিন। এই বিদ্রুপাত্মক চলচ্চিত্রে তাকে কখনও সম্বোধন করা হয় 'অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিন' বলে, কখনও 'দ্য সুপ্রিম লিডার অব ওয়াদিয়া' (ওয়াদিয়া একটি কল্পিত আরব রাষ্ট্র)। আলাদিন এমনই এক একনায়ক যে, সে দৌড়প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সব প্রতিযোগীকে গুলি করে নিজে বিজয়ী হয়, একাই ছিনিয়ে নেয় সব প্রতিযোগিতার সব মেডেল। অভিধানের তিনশো শব্দ পরিবর্তন করে প্রতিটির প্রতিশব্দ হিশেবে সে 'আলাদিন' ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। পরিবর্তিত অভিধান অনুযায়ী 'হ্যাঁ' মানেও আলাদিন, 'না' মানেও আলাদিন; 'পজিটিভ' মানেও আলাদিন, 'নেগেটিভ' মানেও আলাদিন। এমতাবস্থায় ওয়াদিয়ার এক চিকিৎসক রোগীকে জিজ্ঞেস করেন— 'তুমি কি আলাদিন খবর (সুসংবাদ) শুনতে চাও? নাকি আলাদিন খবর (দুঃসংবাদ) শুনতে চাও?' রোগীর উত্তর— 'আমি আলাদিন খবর শুনতে চাই।' জবাবে চিকিৎসক বললেন— 'তুমি এইচআইভি আলাদিন।'

১০ মে ২০২২
 

Users who are viewing this thread

Back
Top