বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ এখন বৃক্ষশোভিত
করোনাকাল বলে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক সময়ের শোরগোল নেই, নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণ। এক বছরের অধিক সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় গাছগুলো আরও সতেজ, আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। পথ চলতে চলতে মনে হচ্ছিল, এ যেন বৃক্ষশোভিত নান্দনিক এক ক্যাম্পাসে হাঁটছি।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক পেরোতেই চোখে পড়ে সারি সারি সবুজ বৃক্ষ। গাছের লতাপাতার ফাঁকফোকর দিয়ে ইটের দালানগুলো দেখা যায়। সুনসান ক্যাম্পাস। ফটক পেরিয়ে একটু এগোতেই চোখ পড়ল জারুল গাছ। সবুজের বুকে দৃষ্টিনন্দন ফুল ফুটে আছে। সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে আরও জারুল গাছের সমারোহ। ফটক থেকে যে সড়ক ভেতরে প্রবেশ করেছে, তার দুধারে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। সবুজ পাতার ভেতরে থেকে রক্তরঙা কৃষ্ণচূড়া যেন স্বাগত জানাল। কিছু দূর হেঁটে যেতেই দেখা মিলল গগনশিরীষ গাছের সারি। দুধারে গগনশিরীষ গাছের সারি থাকায় সড়কটির নামকরণ হয়েছে 'গগনশিরীষ সড়ক'। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন আর সাদা চেরি ফুলের গাছ। এর পাশে স্বাধীনতা স্মারক স্তম্ভের পশ্চিমে জারুল গাছের বাগান। বিকেলের মিষ্টি রোদ আর সবুজের বুকে যেন দোল খাচ্ছে বেগুনি জারুল। পাশেই দেবদারুশোভিত সড়কে গাছের পাতাগুলো আরও সুশোভিত করে তুলেছে ক্যাম্পাসের পরিবেশ।
একাডেমিক ভবনের সামনের সড়কের পাশে সবুজ আর সবুজ। যেন ছায়াঘেরা উদ্যান। চারদিকে সবুজময়। বিচিত্র গাছের সমাহার। শেখ রাসেল চত্বরে মাঝারি পাকুড় গাছ। গাছটির চারদিকে ইটের গাঁথুনি নিয়ে বাঁধানো। এরই মধ্যে দুই শিক্ষার্থী বসে জামরুল ফল খাচ্ছেন। কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। বললেন, গাছ থেকে জামরুল পেরে খাওয়ার নাকি আনন্দই আলাদা।
ক্যাম্পাসজুড়ে শাল, দেবদারু, পলাশ, কাউফল, আঁশফল, সফেদা, আলুবোখারা, আমলকী, বট, পাকুড়, হরীতকী, বহেরা, অর্জুন, কাইজেলিয়া, রাবার, সোনালু, বিলাতি গাব, জাত নিম, বুদ্ধ নারিকেল, কাঠবাদাম গাছ সতেজ শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ার পাশাপাশি সৌন্দর্য যেন শোভা পাচ্ছে।
কিছু ফুল গাছেরও সন্ধান মিলল। নীলমণিলতা, ঝুমকোলতা, লাল কাঞ্চন, শ্বেত কাঞ্চন, তিন রকম কাঠগোলাপ, তিন ধরনের চেরি, বাগানবিলাসসহ অনেক ফুল। মাধবীলতাও বেড়ে উঠছে।
একাডেমিক ভবনগুলোর সামনে অনেক দুর্লভ গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। গ্লিরিসিডিয়া, জয়তুন, পারুল, হৈমন্তী, জয়ত্রী, ঢাকি জাম, তেলসুর, পুত্রঞ্জীব, কানাইডিঙা, হলদু, দইবোটা, ডুমুর, মহুয়া, পানিয়াল, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, চিকরাশি, নাগেশ্বর গাছ বেড়ে উঠছে।
ছাত্রদের আবাসিক হলের দিকে যাওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উত্তর ও দক্ষিণ প্রাঙ্গণ সবুজে ঢেকে আছে। নারকেল গাছের সারি যে কারও নজর কাড়বে। গ্রন্থাগার পেরিয়ে ছাত্রদের হলের দৃষ্টিনন্দন সড়ক। একদিক খোলা, অন্যদিক জারুল গাছের দীর্ঘ সারি। কী মনোরম দৃশ্য! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে কয়েকটি গোলাপজামের গাছ। ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে ডালপালা ছড়িয়েছে। জানা গেল, এ বছর গোলাপজাম ধরেছিল। একটি নাগেশ্বর গাছ সেখানে বেড়ে উঠছে। গ্রন্থাগার আর ছাত্রহলের মধ্যবর্তী সড়কের পাশে কয়েকটি কাউফলের গাছে অনেক ফল এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে উপাচার্যের বাসার দিকে চলে গেছে একটি সড়ক। সড়কের দুদিকের সবুজ আরও বাড়িয়ে তুলেছে সৌন্দর্য। যে কেউ এই সড়কে হাঁটলে মনে দোল খেয়ে যাবে। কোথাও ফুটে আছে সোনালু, জারুল আর কৃষ্ণচূড়া।
একটি সড়ক চলে গেছে গাড়ি গ্যারেজের দিকে। এই সড়কের দুধারে বেড়ে উঠছে বেশ কিছু দুর্লভ গাছ। কনকচাঁপা, মণিমালা, কুসুম, ভুঁইকদম, জংলি বাদাম, লোহা কাঠ, গজারি, গর্জন, সুলতান চাপা, বাজনা, পাদাউক, সিন্দুরী, রক্তন, বনআশরা, জ্যাকারান্ডাসহ হরেক রকম গাছ। শিক্ষক-কর্মকর্তা ডরমিটরির সামনে এবং মসজিদের উত্তর-পশ্চিমে বিশাল দুটি আমবাগান।
ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখছিলাম। আর এসব গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ। যিনি এই ক্যাম্পাসকে সবুজায়নের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গাছগুলো লাগিয়েছেন।
ক্যাম্পাসকে সবুজ উদ্যানে পরিণত করার পেছনের কারণ প্রসঙ্গে তুহিন ওয়াদুদ বললেন অনেক কথা। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বলতে গেলে কোনো গাছই ছিল না। তিনি বলেন, 'একজন শিক্ষার্থী যে কোনো গাছের ছায়ায় একটু দাঁড়িয়ে শরীর জুড়াবে, তার কোনো উপায় ছিল না। এমন এক পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণ শুরু করি। কিছু শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন কর্মচারী এসব গাছের পরিচর্যায় অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহা ফরিদের গাছের প্রতি ভালোবাসা উল্লেখ করার মতো। সংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ''রণন''।'
যেসব গাছ রোপণ করা হয়েছে, তার প্রায় সবটাই কোনো না কোনো ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আনা হয়েছে। 'তরুপল্লব'–এর সাধারণ সম্পাদক পরিবেশবিষয়ক লেখক ও গবেষক মোকারম হোসেনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, 'এ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ২২৫ প্রজাতির ৩৫ হাজারের ওপর গাছ লাগানো হয়েছে। এই ক্যাম্পাসকে বৃক্ষের জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। পরিবেশের জন্য এ ক্যাম্পাস আশীর্বাদ হয়ে থাকবে এমনটাই আশা করি।'
* আরিফুল হক, রংপুর