তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। একদিন তাঁর এক সহকারী এসে বললেন, গৌরীদা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খুব করে ধরেছে। আপনি এখনি একটা গান লিখে দিন। এ ডাক ফেরানো যায়না। উনি কিছু সময়ের মধ্যেই লিখে ফেললেন গান, ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’। সে গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জোয়ার এনেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে।
মুক্তিযুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে। এপ্রিলের ৪ তারিখ। ভারতের গড়িয়ায় একটি চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। আলোচনার মূল বিষয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। এই আড্ডাতেই জন্ম কালজয়ী একটি গানের: ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যুদ্ধের সেই দিনগুলোয় যে কটি গান মুক্তিকামী মানুষদের কঠোর সংগ্রামের পথে সাহস জোগাত, প্রেরণা দিত—এই গান সেগুলোর একটি। খ্যাতিমান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন লোকসংগীতশিল্পী অংশুমান রায়।
শচীনদেব বর্মণ একদিন ডেকে বললেন এখনই লিখতে হবে গান। সে অনেক আগের কথা। সেই সময়ে তিনি শচীনদেব বর্মণকে লিখে দিয়েছিলেন, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর লেখা 'বঁধু গো এই মধুমাস' গানটিতে শচিন দেব বর্মন নিজে সুর দিয়ে প্রথম রেকর্ড করেন। পরে ধীরে গীতিকার হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। রেকর্ডে তার গান প্রকাশিত হওয়ার পর, তিনি ধীরে চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখা শুরু করেন। অগ্নিপরীক্ষা, পথে হল দেরী, হারানো সুর, সপ্তপদী, দেয়া নেয়া, মরুতীর্থ হিংলাজ এবং আরও বহু সিনেমায় তাঁর লেখা গান জনপ্রিয় হয়েছিল।
গৌরীপ্রসন্ন বাংলা গানের কবি, বাড়ি ছিল পাবনায়।
১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরীপ্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তিঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা।
সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরীপ্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজা করেই বলেন, "কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?" এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, "কী সব গদগদ প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।"
এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, "তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছ। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?" সুপর্ণ তখন বলেন, "কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পার।" এই তর্কের মাঝেই গৌরীপ্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।' সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তিঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরীপ্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন । সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরীপ্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু'দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরীপ্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক।
শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- 'সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।' কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিত্সা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
"সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই,
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।"
বাংলাভাষার কবি ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা সংগীত ভুবনে এক অসাধারণ স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর অসংখ্য অমর সৃষ্টি আমাদের সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর গান বিভিন্ন কণ্ঠে বার বার শুনেও যেন আশ মেটে না আমার মতোন বাঙালির।
ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তবে তিনি সংগীতেই মন উজাড় করে দিয়েছিলেন। গান লিখে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’
১৯৮৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অনেকটা অভিমান থেকেই বলেছিলেন- ‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। এ বড় ক্ষোভের কথা। অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারদের কবি প্রতিভা সম্বন্ধে কারোর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু কবি সম্মেলনে কোন গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কবিতা ছাড়াও অত গান লিখতেন না। তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তা একটি গানের বইয়ের জন্য।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রযোজিত ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে গান লেখার জন্য তাকেই ডেকেছিলেন। মহরতের দিনে তাঁর কাঁধেই রেখেছিলেন নির্ভরতার হাত। তিনি সেই ছবির জন্য লিখেছিলেন, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’,আর ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর ‘পরে ওই নীল আকাশ’। সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান।
অমল মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পেয়ে গেলেন একটি ছবিতে। গৌরীবাবুকে যেয়ে বললেন, গৌরীদা, এমন একটা গান লিখে দিন না, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে। উনি হেসে, বললেই কি ওমন লেখা যায়রে। কিন্তু লিখে দিয়েছিলেন সেই গান, ‘এই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’।‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে ওনার লেখা আর নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবনা’ গানটির জন্য গল্পেই পরিবর্তন এনেছিলেন পরিচালক! ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির প্রযোজক এসে ধরলেন। আমার সব ছবি ফ্লপ করছে। এবার আপনাকে আর হেমন্তদাকে নিয়েছি। এ ছবি হিট না করলে আমি পথে বসে যাব। সে ছবিতে তিনি লিখেছিলেন সেই গান, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো’। ছবি সুপার হিট।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই। মনে পড়ছে ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। এ গানগুলো তো ভোলার নয়।
আরও যে সব গান তিনি লিখে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, পথের ক্লান্তি ভুলে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু, মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো, এই রাত তোমার আমার, প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে, পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে, যদি কাগজে লেখো নাম…। এই সব অমর গানের বাণীর মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মনের মাঝে চিরকাল।
মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্ট ভোগ শেষে ৬১ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়।
মৃত্যুর আগে হাসপাতালে লিখেছিলেন শেষ গান, গেয়েছিলেন নিজের সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই।’
শুভ জন্মদিন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বাংলা গানের সুর যার কথার আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে।
(ফেসবুকের সৌজন্যে প্রাপ্ত, কোথা থেকে নিয়েছিলাম, তা মনে করতে পারছি না।)।
মুক্তিযুদ্ধ তখন সবে শুরু হয়েছে। এপ্রিলের ৪ তারিখ। ভারতের গড়িয়ায় একটি চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। আলোচনার মূল বিষয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। এই আড্ডাতেই জন্ম কালজয়ী একটি গানের: ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যুদ্ধের সেই দিনগুলোয় যে কটি গান মুক্তিকামী মানুষদের কঠোর সংগ্রামের পথে সাহস জোগাত, প্রেরণা দিত—এই গান সেগুলোর একটি। খ্যাতিমান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন লোকসংগীতশিল্পী অংশুমান রায়।
শচীনদেব বর্মণ একদিন ডেকে বললেন এখনই লিখতে হবে গান। সে অনেক আগের কথা। সেই সময়ে তিনি শচীনদেব বর্মণকে লিখে দিয়েছিলেন, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর লেখা 'বঁধু গো এই মধুমাস' গানটিতে শচিন দেব বর্মন নিজে সুর দিয়ে প্রথম রেকর্ড করেন। পরে ধীরে গীতিকার হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। রেকর্ডে তার গান প্রকাশিত হওয়ার পর, তিনি ধীরে চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখা শুরু করেন। অগ্নিপরীক্ষা, পথে হল দেরী, হারানো সুর, সপ্তপদী, দেয়া নেয়া, মরুতীর্থ হিংলাজ এবং আরও বহু সিনেমায় তাঁর লেখা গান জনপ্রিয় হয়েছিল।
গৌরীপ্রসন্ন বাংলা গানের কবি, বাড়ি ছিল পাবনায়।
১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরীপ্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তিঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা।
সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরীপ্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজা করেই বলেন, "কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?" এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, "কী সব গদগদ প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।"
এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, "তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছ। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?" সুপর্ণ তখন বলেন, "কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পার।" এই তর্কের মাঝেই গৌরীপ্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।' সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তিঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরীপ্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন । সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরীপ্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু'দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরীপ্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক।
শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- 'সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।' কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিত্সা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
"সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই,
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।"
বাংলাভাষার কবি ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা সংগীত ভুবনে এক অসাধারণ স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর অসংখ্য অমর সৃষ্টি আমাদের সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর গান বিভিন্ন কণ্ঠে বার বার শুনেও যেন আশ মেটে না আমার মতোন বাঙালির।
ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তবে তিনি সংগীতেই মন উজাড় করে দিয়েছিলেন। গান লিখে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’
১৯৮৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অনেকটা অভিমান থেকেই বলেছিলেন- ‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। এ বড় ক্ষোভের কথা। অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারদের কবি প্রতিভা সম্বন্ধে কারোর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু কবি সম্মেলনে কোন গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কবিতা ছাড়াও অত গান লিখতেন না। তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তা একটি গানের বইয়ের জন্য।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রযোজিত ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে গান লেখার জন্য তাকেই ডেকেছিলেন। মহরতের দিনে তাঁর কাঁধেই রেখেছিলেন নির্ভরতার হাত। তিনি সেই ছবির জন্য লিখেছিলেন, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’,আর ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর ‘পরে ওই নীল আকাশ’। সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান।
অমল মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পেয়ে গেলেন একটি ছবিতে। গৌরীবাবুকে যেয়ে বললেন, গৌরীদা, এমন একটা গান লিখে দিন না, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে। উনি হেসে, বললেই কি ওমন লেখা যায়রে। কিন্তু লিখে দিয়েছিলেন সেই গান, ‘এই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’।‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে ওনার লেখা আর নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবনা’ গানটির জন্য গল্পেই পরিবর্তন এনেছিলেন পরিচালক! ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির প্রযোজক এসে ধরলেন। আমার সব ছবি ফ্লপ করছে। এবার আপনাকে আর হেমন্তদাকে নিয়েছি। এ ছবি হিট না করলে আমি পথে বসে যাব। সে ছবিতে তিনি লিখেছিলেন সেই গান, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো’। ছবি সুপার হিট।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই। মনে পড়ছে ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। এ গানগুলো তো ভোলার নয়।
আরও যে সব গান তিনি লিখে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, পথের ক্লান্তি ভুলে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু, মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো, এই রাত তোমার আমার, প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে, পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে, যদি কাগজে লেখো নাম…। এই সব অমর গানের বাণীর মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মনের মাঝে চিরকাল।
মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্ট ভোগ শেষে ৬১ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়।
মৃত্যুর আগে হাসপাতালে লিখেছিলেন শেষ গান, গেয়েছিলেন নিজের সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই।’
শুভ জন্মদিন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বাংলা গানের সুর যার কথার আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে।
(ফেসবুকের সৌজন্যে প্রাপ্ত, কোথা থেকে নিয়েছিলাম, তা মনে করতে পারছি না।)।