ক্রীড়নক
- নীললোহিত
বি.দ্র.- এই কাহিনীর সমস্ত চরিত্র, ঘটনা এবং স্থান - সবই লেখকের কল্পনাপ্রসুত। এই কাহিনীর সাথে বাস্তবের কোনোও মিল নেই। যদি কোনোও জীবিত বা মৃত ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে এই কাহিনীর ন্যুনতম মিলও থাকে, তাহলে তা সম্পূর্ণরূপে কাকতালীয়। সেই ঘটনার দায় কোনোওভাবেই লেখকের উপর বর্তাবে না।– নীললোহিত
বিদেশী উপন্যাসের ছায়াবলম্বনে রচিত।
ধূমপান ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। এগুলি ক্যান্সারের কারণ।
প্রথম অধ্যায় - যন্ত্রণার প্রথম পাঠ
পর্ব ১
গ্লাস এলিভেটরের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটাকে এই নিয়ে প্রায় চারবার দেখল ঈশিতা। ও যে নার্ভাস হয়ে আছে, সেটা ওকে এই মুহুর্তে যে কেউ দেখে বলবে। কিন্তু এর আগে তো ঈশিতা কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছে। ভয় হয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু আজকের মতো তো কখনো এত নার্ভাস ফিল্ হয়নি? তাহলে আজ কি হল? তার মত স্মার্ট একটি মেয়ে সামান্য একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে এসে নার্ভাস ফিল করছে কেন? আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল ঈশিতা। মাথায় হালকা বাদামী চুল। শ্যাম্পু আর দামী কন্ডিশনারের দৌলতে সেগুলো পশমের মত নরম। হাল্কা আই-লাইনার ওর বড় বড় টানা টানা চোখদুটোকে করে তুলেছে আরোও মোহময়ী। চুলটা ইচ্ছা ছিল বাঁধার। খোঁপা নয় অবশ্য। আজকালকার দিনে আবার খোঁপা করে নাকি কেউ? চুলগুলোকে একটা স্কার্ফ দিয়ে বেঁধে কাঁধের উপরে ফেলে রেখেছে। ঠোঁটে প্রথমে কোন রঙের লিপস্টিকটা লাগাবে সেটা ভেবে পায়নি। তারপর লাইট পিঙ্কটাই বেছে নিয়েছে ও। সবশেষে ও যখন নিজেকে আয়নায় দেখছিল, তখনই ওর ঘরে প্রবেশ করল ওর মা। এক্কেবারে সেকেলে। আধুনিক ধ্যানধারণা আর ফ্যাশান সম্পর্কে একটুও যদি জ্ঞান থাকে মায়ের। ওকে দেখে মা যেন তাজ্জব হয়ে গেছে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল প্রায় সাড়ে তিন মিনিট। আর থাকতে পারেনি ঈশিতা। আয়না থেকে মুখটা ঘুরিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "কি দেখছো, অমন হাঁ করে?" মা বলেছিল, "তোমাকে।" মা একটু রেগে গেলে ওকে আবার 'তুমি' করে বলে। ও বলেছিল, "কেন, আমাকে কি এই প্রথম দেখছো নাকি?" মা বলেছিল, "তাই তো দেখছি মনে হচ্ছে। চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছো, নাকি বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।"
"কেন, এটা তো ক্যজুয়াল ড্রেস? এটা পরে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যাবেনা, সেটা তোমাকে কে বলল?"
"কে আর বলবে? চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছি সব। হ্যাঁরে, এইরকম বগলকাটা জামা পরে ইন্টারভিউ দিতে যাবি?"
"উফ্ মা, তুমি না বড্ড আনকালচারড্! এটাকে বলে স্লিভলেস। বগলকাটা আবার কি! এটাই এখন ট্রেন্ডি!"
"সে না হয় হল, আর এই ছেঁড়া প্যান্টটা ছাড়া কি আর কিছু নেই তোর? এটা পরেই যেতে হবে?"
"তোমাকে বোঝানো আমার কম্ম নয়। আমার দেরী হচ্ছে, আমি এবার বেরোবো।" হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলে ঈশিতা। মা এবার ওর আরো কাছে এসে বলে, "এতো টাইট প্যান্টটা পরার কি দরকার ছিল বাপু বুঝিনা।" ঈশিতা কোনো উত্তর দেয়না। এখন তার হাতে আর একটুও সময় নেই। মায়ের সাথে বৃথা তর্ক করা মানে, খামোকা সময় নষ্ট। তাই আর কিছু না বলে কাঁধে ব্যাগটা আর হাতে ওর ডকুমেন্টের ফাইলটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে।
সেই থেকে ওর মনে এই নার্ভাসনেসটা কাজ করছে। তাহলে কি সত্যি করেই সাজটা একটু বেশী হয়ে গেছে ইন্টারভিউয়ের পক্ষে? এর আগে ও যে তিনটে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল, তাতে তার সাজ এতটা ছিল না, এটা সত্যি। কিন্তু আজকে ও যেন কতকটা ইচ্ছা করেই সেজেছে। তবে মা যেরকম বলল, ততটাও বাড়াবাড়ি রকমের কিছু সাজেনি সে। মা যেন বুঝতেই পারেনা, ঈশিতা বড় হয়ে গেছে। এই তো কদিন আগেই ও তেইশ বছরে পা দিয়েছে। গ্রাজুয়েটেড, দেখতে সুন্দরী, আধুনিকা, স্মার্ট। এই মেয়ের কি একটা আধটা বয়ফ্রেন্ড থাকতে নেই? কিন্তু মায়ের জন্য সেটাও সম্ভব নয়। প্রতিদিন ওর ফোন ঘেঁটে কাকে কল্ করছে, কাকে মেসেজ করছে, ফেসবুকে কটা ছেলে ওর প্রোফাইল পিকচারে লাইক করেছে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কটা ছেলে আছে, সব মায়ের দেখা চাই। মা ওকে এখনও কচি খুকিটি বলেই মনে করে। মায়ের জ্বালায় ওর যে প্রাইভেট লাইফের ষষ্ঠীপূজো হয়ে যাচ্ছে, সেটা মা বুঝেও বোঝে না। এই তো কদিন আগে ওর এক বন্ধু ওকে বার্থডেতে লুকিয়ে একটা দামী বিলিতি গ্লাস-ডিলডো উপহার দিয়েছিল, সেটাকে পর্যন্ত মায়ের ভয়ে সবসময় ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরতে হয়। বাথরুমে বসে যে কিছুটা সময় সেটা নিয়ে খেলবে, তারও কোনো উপায় নেই। একটু দেরী হলেই এসে দরজা ধাক্কাবে, "কি রে, এত সময় লাগছে কেন?" আমার লাগছে তো তোমার কি? যত্তসব! বাসে বসে বসে এসব কথাই চিন্তা করছিল ও। হঠাৎ বাসটা থেমে যেতে ওর সম্বিত ফিরল। কন্ডাক্টর হেঁকে বলল, "দিদি, আপনার স্টপেজ এসে গেছে।" তাইতো, মায়ের কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে স্টপেজ এসে গেছে, সেটা ওর খেয়ালই নেই। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, হাতে ফাইলটা নিয়ে ও বাস থেকে নেমে পড়ল। সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে হোয়াটসঅ্যাপটা খুলল। ওখানেই অফিসের ঠিকানাটা আছে। ঠিকানাটা বার করে কয়েকবার পড়ে মুখস্থ করে নিল ঈশিতা। সল্টলেকের এই দিকটায় এর আগে কখনো আসেনি ও। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সামনের স্টেশনারী দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। দোকানে মাঝবয়সী একটি লোক বসে রয়েছে। ওকে দেখেই সে বলল, "আসুন দিদি, কি চাই বলুন।" কি জ্বালাতন! আজ সবাই তাকে দিদি বলেই ডাকছে কেন! একটু আগে কন্ডাক্টারটা বলল, এখন আবার এ বলছে। তার বাপের বয়সী লোক যদি তাকে দিদি বলে ডাকে তাহলে তো অসুবিধা হওয়ারই কথা। মরুক গে, এখন ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। এগারোটা বেজে গেছে। সাড়ে এগারোটায় ওর ইন্টারভিউ। ওকে বারবার বলে দেওয়া হয়েছে, এই অফিসের সবই নাকি ডিসিপ্লিনড আর পাংচুয়াল। সাড়ে এগারোটা মানে সাড়ে এগারোটাতেই তার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। না একমিনিট আগে, না এক মিনিট পরে। যদি ও লেট করে, তাহলে ওর ইন্টারভিউ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। যেটা ও একেবারেই চায় না। ঈশিতা চুপ করে আছে দেখে লোকটা আবার বলল, "কি হল দিদি, কি লাগবে ভুলে গেছেন?" ঈশিতা আর দেরী না করে ওর মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "এই ঠিকানাটা কোথায় একটু বলে দেবেন।" লোকটার এতক্ষণে বোধগম্য হল যে, ঈশিতা ওর দোকানে কিছু কিনতে আসেনি। আর সেটা বুঝতে পেরেই তার মুখটা বাংলার সাড়ে পাঁচের মত হয়ে গেল। তারপর যেন অনেক কষ্টে ঈশিতার মোবাইলে ঠিকানাটা পড়ে নিয়ে নিমের পাঁচন খাওয়া গলায় বলল, "কাছেই। এখান থেকে দ্বিতীয় গলিটা। বাঁ দিকে চলে যান। বড়ো অফিস। রাস্তা থেকেই দেখা যায়।" ঈশিতা আর দাঁড়াল না, লোকটার বলা রাস্তার দিকে পা বাড়াল।
লোকটার বলা মতই ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে গেল ঈশিতা। লোকটা ঠিকই বলেছিল। বড়ো অফিস। দশতলা তো হবেই। বাইরে থেকে কোম্পানীর নামটা পড়া যাচ্ছে। Blue Oranges Advertising Group. অফিসের গোটা বিল্ডিংটাই নীল রঙের কাচ দিয়ে ঘেরা। বিল্ডিংয়ের ঠিক নিচেই দুজন সিকিউরিটি গার্ড বসে রয়েছে। তাদের উর্দির বুক পকেটের উপর কোম্পানীর নাম আর লোগো সেলাই করা আছে। সামনে রেজিস্টার খাতা খোলা। ঈশিতা ওদের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর বলল, "আজ আমার ইন্টারভিউ আছে। আমাকে কল্ করা হয়েছিল।" একজন গার্ড বলল, "রেজিস্টার মে আপনা নাম ঔর পতা লিখ দিজিয়ে। আনে কা ওয়াক্ত ভি লিখ দিজিয়ে।" ইশিতা খাতায় নিজের নামটা লিখল। ঈশিতা বসু। তারপর ওর বাড়ির ঠিকানা আর সময়টাও লিখে দিল। এগারোটা দশ। ওর লেখা শেষ হলে গার্ডটা বলল, "আপ আটবে মঞ্জিল মে চলে যাইয়ে। ওঁহা কিসিকো পুছ লেনা।" ঈশিতা আবার পা চালিয়ে বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ল।
বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরটা গোটাটাই কার-পার্কিং। ঈশিতা একবার উঁকি মেরে দেখল সেই পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু বিলিতি মডেলের গাড়ি। যেগুলোকে ও এর আগে কেবল ম্যাগাজিনের পাতাতেই দেখেছে। ঈশিতা এবার এগিয়ে গিয়ে এলিভেটরের বোতামটা টিপে দিল। "স্লিং!" মৃদু শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এলিভেটরের। ভিতরে ঢোকার আগেই ঈশিতা চোখ প্রায় কপালে উঠেছে। এলিভেটরের ভিতরের তিনটি দেওয়াল আয়নায় মোড়া। ও ভিতরে ঢুকে সাত নম্বর বোতামটা টিপে দিল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়ে এলিভেটর উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। কাচের উপর নিজের প্রতিবিম্বটিকে দেখল ঈশিতা। সে যে সুন্দরী এটা যেকোনো পুরুষই ওকে দেখে স্বীকার করবে। তবে আজ ওকে দেখে সুন্দরীর থেকেও যে শব্দটা ব্যবহার করা উপযুক্ত, সেটা হল সেক্সী। স্লিভলেট ওফ-হোয়াইট টপ আর ডেনিমের জিন্সে ওকে বেশ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। তার কারণ আজকের ইন্টারভিউয়ে ও নিজেকে সেক্সী দেখাতে চাইছিল। গতকালই ওকে ফোনে জানানো হয়েছিল যে আজ ওর ইন্টারভিউ নেবে কোম্পানীর এম.ডি. কিঙ্কর রায়। ও ব্লু-ওরেঞ্জ অ্যাডভার্টাইসিং গ্রুপের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে কিঙ্করের কিছু ছবি দেখেছে আর দেখেই যাকে বলে প্রেমে পড়ে গেছে ওর। এই রকম হ্যান্ডসাম পুরুষ এর আগে খুব কমই দেখেছে ও। এর আগে সবই দেখেছে রূপালী পর্দায়, এই প্রথম বাস্তবে। আর সেই কারণেই তার এই পোষাক নির্বাচন আর প্রসাধনী। এলিভেটরের আয়নায় ঈশিতা নিজের চুল আর পোষাক ঠিকঠাক করে নিল শেষবারের মত। কারণ এলিভেটর ততক্ষণে ওকে বিল্ডিংয়ের অষ্টম তলায় পৌঁছে দিয়েছে।
আগের মতই স্লিং শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ঈশিতা এলিভেটরের বাইরে এসে দাঁড়াল। আর দাঁড়াতেই বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেল। কারণ গোটা আটতলাটাই একটা পুরো অফিস। ইটালিয়ান মার্বেল ফ্লোরিং-র উপর নিজের নতুন হাইহিলটা দিয়ে শব্দ তুলে ঈশিতা পৌঁছে গেল রিসেপশন লেখা ডেস্কটার কাছে। সেখানে কেউ নেই। কেবল টেবিলে একটা আধখাওয়া স্যান্ডউইচ পড়ে রয়েছে প্লেটের উপর। দেখে মনে হচ্ছে, সেটা কেউ খেতে খেতে এইমাত্র কোথাও গেছে, এক্ষুণি ফিরবে। ঈশিতা কাঁধের ব্যাগ আর হাতের ফাইলটাকে সামলে এদিক-ওদিক তাকালো। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। গোটা জায়গাটায় এই মুহুর্তে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। অথচ রিসেপশন ডেস্কের ঠিক পিছনের দেওয়ালে টাঙানো দেওয়াল ঘড়িটায় এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট দেখাচ্ছে। ঈশিতা আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এখানে কি ধরনের কাজ করা হয়, কিন্তু তেমন কিছুই বুঝতে পারল না। গোটা চারেক সোফা আর কাচের সেন্টার টেবিল রাখা আছে একদিকে। এই গোটা ফ্লোরের দেওয়ালগুলো ওর টপটার মতোই অফ-হোয়াইট রঙ করা। দেওয়ালে ব্লু-ওরেঞ্জ কোম্পানীর তৈরী করা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের তৈলচিত্র টাঙানো আছে। রিসেপশন ডেস্কটা যেদিকে আছে, ঠিক তার উল্টো দিকে দুটি কেবিন দেখা যাচ্ছে। যার একটার উপর লেখা রয়েছে কিঙ্কর রয়, এম.ডি. এবং অন্যটার উপরে লেখা রয়েছে জয়ন্ত ঘোষ, ক্রিয়েটিভ হেড। Excuse me! Can I help you?" ঠিক তার পিঠের কাছেই কেউ বলে উঠল। এত অকস্মাৎ কথাটা তার কানে গেল, যে ঈশিতা প্রায় লাফিয়ে উঠল। তারপর পিছন ফিরে দেখল ওর পিছনে একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোক না বলে বরং ষুবক বললেই বোধহয় ভালো হত। কারণ দেখে তার বয়স পঁচিশ বছরের বেশী বলে মনে হচ্ছে না। দেখতে শুনতে ভালোই। মুখে এখনো কাঠিন্যভাবটা পুরোপুরি আসেনি। মাথার চুলগুলো একটু ঘাঁটা। একটা ডার্ক-ব্লু কালারের জামা ইন্ করে পরে রয়েছে। তবে সবার প্রথমেই ছেলেটার চোখের উপরে নজর গেল ঈশিতার। কারণ এর আগে কোনোও বাঙ্গালী ছেলের এরকম কটা চোখ দেখেনি। বেশীক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না ঈশিতা। ও চোখটা সরিয়ে নিল। ছেলেটা ওকে পাশ কাটিয়ে রিসেপশন ডেস্কটার পিছনে গিয়ে, ওর দিকে তাকিয়ে একটু আগে করা প্রশ্নটাই বড্ড বেশী কেজো গলায় জিজ্ঞাসা করল, Can I help you?" ঈশিতা বলল, "আমার আজ সাড়ে এগারোটায় ইন্টারভিউ আছে, গতকাল আমাকে ফোন করা হয়েছিল।" ছেলেটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, "ওটা আমিই করেছিলাম। আপনার নাম?"
"ঈশিতা বসু।"
"আপনি একটু আগেই চলে এসেছেন। ভালো। আমাদের বস কিন্তু খুব পাংচুয়াল। ঠিক সাড়ে এগারোটাতেই আপনার ইন্টারভিউটা হবে।"
"ঠিক আছে, আমি ততক্ষণ ওয়েট করছি।" বলল ঈশিতা। উত্তরে ছেলেটি কিছু বলল না। টেবিলের উপরে রাখা স্যান্ডউইচটা তুলে নিয়ে কামড় বসাল তাতে। ঈশিতা কোণের একটি সোফায় গিয়ে বসল। ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফার উপরে রাখল। তার পাশে রাখল ফাইলটাকে। ওর সামনের কাচের সেন্টার টেবিলটায় কতকগুলো ফিল্ম আর ফ্যাশান ম্যাগাজিন পড়েছিল। তার থেকেই একটা তুলে পাতা উল্টে দেখতে লাগল ঈশিতা। কয়েকটা পাতা ওল্টানোর পর একবার মুখ তুলে দেখল ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঈশিতা দেখতেই সে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। ওর কি কোনো কাজ নেই নাকি? মনে মনে বলল ঈশিতা। "কফি খাবেন? আপনার ইন্টারভিউ শুরু হতে বেশ কিছুক্ষণ দেরী আছে।" প্রথমবারের মতই ওকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছেলেটি। অভদ্রতা এড়াতে ঈশিতা ঘাড় নেড়ে বলল, "হলে মন্দ হত না। তা কফি কি ক্যান্টিন থেকে আনতে হবে?"
"তার প্রয়োজন হবেনা। এই ফ্লোরেই কফি মেশিন আছে।" বলে ছেলেটি ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এসে এককোণে চলে গেল। এতক্ষণ ঈশিতার নজর পড়েনি। সত্যি করেই সেদিকে একটা টেবিলের উপর কফি মেশিন বসানো আছে। ঈশিতা এবার নজর ঘুরিয়ে দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। বিজ্ঞাপনের তৈলচিত্র, নিউজপেপার কাটিংয়ের পাশে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ওর নজর কেড়ে নিল। ঈশিতা সোফা থেকে উঠে ছবিটার কাছে গেল, সেটাকে ভালো করে দেখবে বলে। ছবিটা একটা গ্রুপ ফটো। বোঝাই যাচ্ছে এই অফিসেরই এমপ্লয়ীদের ছবি। ছবিতে বেশ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম সারির তিনজনকে সে চিনতে পারল। কিঙ্কর রায় আর জয়ন্ত ঘোষকে চিনতে পারল তার কারণ গতকালই ও ওয়েবসাইটে ওদের দুজনের ছবি দেখেছে। কিঙ্করকে দেখলে খুবই মুডি, পার্সোনালিটিওয়ালা কড়া মেজাজের মানুষ বলে মনে হয়। অন্তত ঈশিতার তাইই মনে হয়েছে।। পারফেক্ট বিজনেসম্যান। তবে দেখতে যে সে সুপুরুষ সেটা তো পরিষ্কার। ঈশিতার মত একজন মেয়ে কেবল ছবি দেখেই যার প্রেমে পড়ে যায়, সে সুপুরুষ হতে বাধ্য। একটি ম্যাগাজিনে কিঙ্করের ইন্টারভিউ খুঁটিয়ে পড়েছে ও। তার ছবি দেখার পরেই কিঙ্করকে ভালো লেগে যায় ওর। হবু বসের প্রেমে পড়াটা খুবই বালখিল্যতা ও অন্যায়, সেটা বুঝতে পেরেও ঈশিতা কিঙ্করের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। তার পছন্দ-অপছন্দ। ভালো-খারাপ। সবকিছুই। তবে তেমন কিছুই জানতে পারেনি ঈশিতা। কেবল কিঙ্কর একটা সময় ক্রিকেট খেলত আর লং-ড্রাইভে যেতে ওর খুবই পছন্দের, এটুকু তথ্য ছাড়া। বাকী গোটা ইন্টারভিউটা সে নিজের কাজ সম্বন্ধেই কথা বলেছে। অন্যদিকে জয়ন্তকে দেখলে মনে হয়, এখানে কাজ করার থেকে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করাটাই তার পক্ষে বেটার হত। অমন পেশীবহুল চেহারা, কালো ব্যাকব্রাশ করা চুল, নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফদাড়িতে তাকে হিরো বলেই মনে হয়। এরা ছাড়াও তৃতীয় যাকে ঈশিতা চিনতে পারল, সে হল রিসেপশনের এই ছেলেটি।
"দেখুন, মিষ্টিটা ঠিক আছে কিনা।" ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছেলেটি ওর দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। ও মৃদু হেসে, "থ্যাঙ্কস!" বলে ওর হাত থেকে কাপটা নিল। ছেলেটি "ওয়েলকাম!" বলে একহাত পিছিয়ে গেল। "ছবিটা দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে?" ছেলেটি হঠাৎ প্রশ্ন করল। হঠাৎ করা এই প্রশ্নটায় ঈশিতা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। কারণ উত্তরটা এই মুহুর্তে ঠিক গুছিয়ে ওর মাথায় আসছে না। "ছবিটা দেখে...মনে হচ্ছে..." থেমে থেমে বলল ও। তারপর আড়চোখ তাকিয়ে দেখল ছেলেটি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পেল না ঈশিতা। বলল, "...মনে হচ্ছে এই অফিসে যারা কাজ করে, তারা সবাই খুবই আর্টিস্টিক।" কোনোরকমে উত্তর দিল ঈশিতা। কিন্তু উত্তরটা যথাযথ হল কিনা, সে নিজেই বুঝতে পারল না। কিন্তু ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল, "ঠিকই বলেছেন, আমরা খুবই আর্টিস্টিক। আমরা সব কাজকেই আর্টের পর্যায়ে নিয়ে যাই। তা সে যে ধরনের কাজই হোক না কেন।" কথাটার মানে বোধগম্য হল না ঈশিতার। ছেলেটা ততক্ষণে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে।
ঈশিতা এতক্ষণে নিজের কফির কাপে চুমুক দিল। আর দিয়েই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। এর আগে জীবনে এত কড়া আর তেতো কফি ও এর আগে কখনও খায়নি। কোনোরকমে কফিটাকে গলাদ্ধকরণ করার পর ও রিসেপশনের দিকে তাকালো। ছেলেটা এখনও তার দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে। ঈশিতা বাধ্য হয়ে আরেকটা চুমুক দিল কফিতে। ঠোঁট থেকে জিভ আর সেই সাথে গলাটাও তেতো হয়ে গেল ওর। ঠিক তখনই রিসেপশনে রাখা ফোনটা বেজে উঠল দুবার। ঈশিতার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা ধরল ছেলেটা। তারপর কয়েকবার "হুঁ," "হ্যাঁ," ইত্যাদি করার পর ফোনটা নামিয়ে রাখল। তারপর ঈশিতার দিকে আবার তাকিয়ে বলল, "কিঙ্কর স্যার এবার আপনার সাথে কথা বলবেন। আপনার কি আর কিছু লাগবে?"
"না, তার আর দরকার হবেনা। যা কফি খাওয়ালে, তাতেই জীবন ধন্য হয়ে গেছে। আর কিছু লাগবে না।" মুখে হাসি এনে মনে মনে কথাগুলো বলল ঈশিতা। তারপর বলল, "একগ্লাস জল হলে ভালো হত। যদি না আপনি কিছু মনে করেন।"
"না, না। এতে মনে করার কিছু নেই। আপনি দাঁড়ান, আমি এনে দিচ্ছি।" বলে ছেলেটা তার জায়গা থেকে চলে গেল। সে চলে যেতেই ঈশিতা এদিক-ওদিক দেখল। কোথায় এই বিদখুটে কফিটা ফেলা যায়। তারপর সবচেয়ে কোণের টবের মাণিপ্ল্যান্টটাই ওর পছন্দ হল। ওর টবটার কাছে গিয়ে কফির কাপটা উল্টে দিল।
"মিস বসু!" ঈশিতা আবার চমকে উঠে সোজা হল। গলা শুনেই ও বুঝতে পেরেছিল ও গলা সেই ছেলেটির হতেই পারেনা। এত গম্ভীর আর ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরের মালিক এই অফিসে একজনই আছে। ঈশিতা পিছন ফিরে কিঙ্কর রায়কেই দেখতে পেল। ও হাতের কাপটা লোকাতে গিয়েও পারল না। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে কিঙ্কর রায়ের ঠোঁটদুটো একটু বাঁকল। হাসল বোধহয়। অন্তত ঈশিতার তাই মনে হল। "ঐ গাছগুলো প্লাস্টিকের।" কিঙ্কর রায় ওর থেকে একহাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। খেলোয়ারসুলভ পেটানো শরীরটা থেকে দামী পারফিউমের মৃদু গন্ধ এসে পৌঁচ্ছাছিল ঈশিতার নাকে। আর গলা? এর আগে ও কিঙ্করের গলা শোনেনি। এই প্রথম। আর শুনেই নতুন করে তার প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করছে ঈশিতার। ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "সরি স্যার।"
"ইটস্ ওকে। আপনি আপনার ডকুমেন্ট নিয়ে আমার কেবিনে আসুন। ওখানেই কথা হবে।"
এক মুহুর্ত আর সেখানে দাঁড়াবার প্রয়োজন মনে করল না ঈশিতা। কিঙ্করের পিছন পিছন তার কেবিনের দিকে যেতে লাগল সে। তবে তার আগে সোফা থেকে নিজের ব্যাগ আর ফাইলটা নিতে ভুলল না সে। কিঙ্করের পিছন পিছন যেতে যেতে ঈশিতা বলল, "থ্যাঙ্কস, ফর দিস অপারচুনিটি, স্যার।" ও তাকিয়ে দেখল ছেলেটি এরই মধ্যে কখন জানি নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। আর তার হাতে কোনো জলের গ্লাস নেই। কিঙ্কর কোনো কথা না বলে নিজের কেবিনে ঢুকে গেল। ঈশিতা ঢোকার আগে শুনতে পেল তাকে শুনিয়ে ছেলেটা বিড়বিড় করে বলছে, "এত তাড়া কিসের, সুন্দরী? থ্যাঙ্কস বলার অনেক সুযোগ পাবে। এই তো সবে খেলা শুরু হয়েছে।" ঈশিতা একবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। এর মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। এই অফিসে কিছু না কিছু গন্ডগোল অবশ্যই আছে। আর সেই গন্ডগোলের মাঝে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ছে না তো? চিন্তার মাঝেই ঈশিতা কিঙ্করের কেবিনে প্রবেশ করল।
ক্রমশ...