এক রাখাল ছেলে মাঠে গরু ছাড়িয়া দিয়া গাছতলায় বসিয়া আছে। এমন সময় এক ফকির আসিয়া তাহাকে বলিল, 'বাবা, আমাকে একটু পানি খাওয়াইবে? আমার বড়ই তেষ্টা পাইয়াছে।'
রাখালটি তাড়াতাড়ি নদীতে যাইয়া এক ঘটি পানি আনিয়া মুসাফিরকে দিল। পানি খাইয়া মুসাফির বড়ই খুশি হইল। যাইবার সময় মুসাফির রাখাল ছেলেটিকে একটি মন্ত্র শিখাইয়া দিয়া গেল—
'তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি,
তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি।'
আরও বলিয়া গেল, 'তুমি যখন তখন এই মন্ত্রটি জোরে জোরে আওড়াইবে। তোমার কপাল ফিরিয়া যাইবে।'
সেই হইতে রাখাল ছেলেটি যখন তখন এই মন্ত্রটি আওড়ায়। পাড়ার লোকে ভাবে সে পাগল হইয়াছে।
সে দেশের বাদশা বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে ভিখারির পোশাক পরিয়া প্রজাদের অবস্থা জানিতে বাহির হইতেন। সেদিন ঘুরিতে ঘুরিতে বাদশা দেখিতে পাইলেন, কয়েকজন চোর একটি বাড়িতে সিঁধ কাটিতেছিল। সেই পথ দিয়া যাইতে ছেলেটি জোরে জোরে মন্ত্র পড়িল—
'তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি,
তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি।'
অমনি চোরেরা সিঁধ-কাঠি লইয়া উধাও। বাদশা তখন ভাবিলেন, এই রাখাল বালক নিশ্চয় কোনো কেরামতি পাইয়াছে। তারই ফলে সে চোরদের সকল খবর জানিতে পারে।
রাখাল কেমন করিয়া কাহার নিকট হইতে এই মন্ত্রটি শিখিয়াছিল তাহা বাদশাকে জানাইল। তারপর বলিল, 'আমার আর কোনোই কেরামতি নাই। আমি শুধু জোরে জোরে এই মন্ত্রটি পড়িয়াছি—
'তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি,
তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি।'
বাদশা রাখাল ছেলেটিকে বহু পুরস্কার দিয়া তাহার নিকট হইতে এই মন্ত্রটি শিখিয়া আসিলেন। বাদশার উজির বড়ই খারাপ লোক। সে গোপনে গোপনে বাদশাকে খুন করিয়া নিজে বাদশা হইবার মতলবে ছিল। তাই সে বাদশার নাপিতকে বহু টাকা ঘুষ দিয়া বলিয়া দিল, 'তুমি যখন কাল বাদশার দাড়ি কামাইবে, তখন ক্ষুর দিয়া তাহার গলা কাটিয়া ফেলিবে।'
নাপিত বহু টাকা ঘুষ পাইয়া উজিরের কথায় রাজি হইল।
পরদিন বাদশার দাড়ি কামাইতে আসিয়া নাপিত দেখিল, তাহার ক্ষুরে তেমন ধার নাই। সে পাথরের উপর ঘষিয়া ক্ষুরে ধার দিতে লাগিল।
বাদশা ভাবিলেন, সেই রাখাল বালকের মন্ত্রটি জোরে জোরে আওড়াইয়া দেখি কী ফল হয়। বাদশা মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন—
'তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি,
তুমি কেন ঘষো, আমি তাহা জানি।'
তখন নাপিত আর যায় কোথায়? সে ভাবিল, বাদশা তাহাদের গোপন কথা সবই জানিতে পারিয়াছেন। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাদশার পায়ে পড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, 'বাদশা নামদার, আমার কসুর মাফ করেন। আপনার দুষ্ট উজির অনেক টাকাপয়সা দিয়া আমাকে আপনার গলা কাটিতে পরামর্শ দিয়াছে।'
বাদশা তখন সবই বুঝিতে পারিলেন। উজিরকে বন্দী করিয়া আনিয়া শাস্তি দিলেন, আর রাখাল বালকটিকে আনিয়া নিজের সভাসদ করিলেন।
সূত্র: বাঙ্গালীর হাসির গল্প (২য় খণ্ড)
জসীমউদ্দীন: প্রখ্যাত বাঙালি কবি। 'পল্লীকবি' হিসেবে সুপরিচিত। জন্ম ১৯০৩ সালে ফরিদপুরে, মারা গেছেন ১৯৭৬ সালে। নকসী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ রচনা।