জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলায় কাব্য-নির্ভর গান রচনার ক্ষেত্রে যাকে অগ্রপথিক ধরা হয় তিনি ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান বা অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক পরিচয় ছাপিয়ে যিনি দেশসেরা চিরস্মরণীয় এক গীতিকার হিসেবেই বাংলা গানের ভান্ডারে ঠাঁই করে নিয়েছেন আপন মহিমায়।
মনিরুজ্জামান ১৯৩৬ সালের ১৫ আগস্ট যশোর জেলার শহরের খড়কী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ শাহাদত আলী এবং মায়ের নাম রাহেলা খাতুন। ৮ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৫৩ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৫ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ১৯৫৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে, ব্রিটিশ কাউন্সিল বার্সারী বৃত্তি নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম ফেলো হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ লাভ করেন ও ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি মূলত কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। এ পর্যন্ত তার বারোটি কাব্য ও তিনটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থসহ মোট ৬০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দুর্লভ দিন, শঙ্কিত আলোক, বিপন্ন বিষাদ, প্রতনু- প্রত্যাশা, ভালবাসার হাতে, ভূমিহীন কৃষিজীবী, ইচ্ছে তার, তৃতীয় তরঙ্গে, কোলাহলের পর, ধীর প্রবাহে, ভাষাময় প্রজাপতি উল্লেখযোগ্য। অনুবাদ কবিতা এমিলি ডিকিনসনের কবিতা, অশান্ত অশোক ও সঙ্গী বিহঙ্গী। কিশোর কবিতা ইচ্ছেমতি ও অযুত কলি। গীতি কবিতা অনির্বাণ ও নির্বাচিত গান। এছাড়া তিনি গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ও নাট্যানুবাদ করেছেন একাধিক গ্রন্থ। ১৯৬০ সালে তার কিশোর সাহিত্য 'কবি আলাওল' প্রকাশ হলে ব্যাপক সাড়া পড়ে।
বহু গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে আধুনিক বাংলা সাহিত্য, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক, আধুনিক কাহিনী কাব্যে মুসলিম জীবন ও চিত্র, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা কবিতার ছন্দ, বাংলা সাহিত্যে বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা, শিক্ষায় ভাষা পরিকল্পনা, মধুসূদন, রবীন্দ্রচেতনা, নজরুল চেতনা অন্যতম। সম্পাদনা করেছেন এমন গ্রন্থের মধ্যে নজরুল সমীক্ষণ, মধুসূদন কাব্য গ্রন্থাবলী, মধুসূদন নাট্যগ্রন্থাবলী, প্যারীচাঁদ রচনাবলী, ঢাকার লোক কাহিনী, যশোরের লোক কাহিনী, সৈয়দ আলী আহসান সংবর্ধনা গ্রন্থ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচনাবলী, মুহাম্মদ এনামুল হক স্মারক গ্রন্থসহ একাধিক গ্রন্থ।
এতকিছুর পরেও তিনি আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানে। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি গান লিখতে শুরু করেছিলেন। ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের গান রচনার ক্ষেত্রে অনেকটা একক কৃতিত্ব ছিল তাঁর। তাঁর লেখা প্রথম গান 'ভালোবেসে তবু যেন সবটুকু ভালো লাগে না'-এর সুরকার ছিলেন শিল্পী আনোয়ারউদ্দীন খান।
তাঁর লেখা 'আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে ভরে আছে সারা মন, শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া, নেই কিছু প্রয়োজন' .. যা দেশাত্মবোধক গানের মধ্য অন্যতম সেরা গান হয়ে আছে। এই গানটির সুরকার প্রয়াত আব্দুল আহাদ। সুরকার নিজেই ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা এই গানটির ভূয়ষী প্রশংসা করে বলেছিলেন, 'এই গানটি এতোটাই বাণী সমৃদ্ধ যে গানটির কোনোদিন মৃত্যু হবে না, গানটি নিশ্চিত অমরত্ব লাভ করবে।' এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো যে বিটিভিতে প্রচারিত বহুল জনপ্রিয় শাইখ সিরাজের কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান 'মাটি ও মানুষ'-এর টাইটেল মিউজিক ছিলো গানটির সুর। সে সময় মাটি ও মানুষের টাইটেলে শুনতে শুনতে গানটির প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিলো।
তার লেখা আরও বেশ কয়েকটি দেশাত্ববোধক গান ভীষণরকম জনপ্রিয়। যার মধ্য প্রয়াত গুণী সুরকার দেবু ভট্টাচার্যের সুরে রুনা লায়লার গাওয়া 'প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে', 'ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ, ভুলিনি তোমাদের আমরা', 'স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন', খন্দকার নুরুল আলমের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা লক্ষ প্রাণের দাম' উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৬ সালে মোস্তাফিজ পরিচালিত 'ডাকবাবু' চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম গান লিখেন। সেই চলচ্চিত্র মুক্তি পাবার পর 'হলুদ বাটো মেন্দি বাটো' এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যা গ্রামে-গঞ্জে তা সবার মুখে মুখে গীত হতে থাকে। এরপর একে একে লিখতে থাকেন নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত চাওয়া পাওয়া, এতটুকু আশা, ছন্দ হারিয়ে গেল, দ্বীপ নিভে নাই, নীল আকাশের নিচে, মমতাজ আলী পরিচালিত নতুন নামে ডাকো, কামাল আহমেদ পরিচালিত অশ্রু দিয়ে লেখা, জহির চৌধুরী পরিচালিত 'পরশ মনি'-এর চলচ্চিত্রে, সবগুলোতেই তার লেখা গানগুলো হয়েছে কালজয়ী গান।
৬০-৮০ দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের গানে গীতিকার হিসেবে প্রথম কাতারের ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এ সময় তার বাসাতে সংশ্লিষ্টরা তাদের চলচ্চিত্রের গানের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। তাঁর লেখা গান গেয়ে যেমন এ দেশের শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলমের চলচ্চিত্রযাত্রা হয় তেমনি ঢাকার চলচ্চিত্রে গেয়েছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত মেহেদী হাসান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নাহিদ নিয়াজীর মতো শিল্পীরাও। সুরকার আলী হোসেনের সঙ্গে চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন বেশি। তাদের জুটি ছিলো দারুণ, অনবদ্য। আর ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের আপন ছোট ভাই হলেন প্রখ্যাত গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।
শিল্প ও সাহিত্য অবদানের জন্য ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ১৯৮৭ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ আরও একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা উল্লেখযোগ্য কিছু গানের লিংক—
আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে –
প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে –
ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ –
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লক্ষ প্রাণের দাম –
হলুদ বাটো মেন্দি বাটো –
তুমি কি দেখেছো কভু – Tumi Ki Dekhecho | তুমি কি দেখেছো কভু | HD | Altaf & A.T.M. Shamsuzzaman | Etotuku Asha | Anupam
হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়- Heshe Khele Jibonta | হেসে খেলে জীবনটা | Razzak & Ismail | Mohammad Ali Siddiki | Nil Akasher Niche
প্রেমের নাম বেদনা – Premer Nam Bedona | প্রেমের নাম বেদনা | Razzak & Kobori | Mahamudunnabi | Nil Akasher Niche
ঐ দূর দূর দূরান্তে – Oi Dur Dur Durantee -Md.Ali Siddiqui | Ft.Razzak,Kabori,Sultana,Altaf,Hasmat
অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান- Shabina Yasmin-Osru Diye Lekha Ei Gaan
কত যে ধীরে বহে মেঘনা- কত যে ধীরে বহে মেঘলা.... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে নিজেরে যে ভুলে যায় – O duti noyone swapane choyone (ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে) - MD KHURSHID ALAM
ঢাকো যতনা নয়নে দুহাতে – Dhako Jotona Noyon Du Haate, Mehdi Hasan, Film - Raja Saheb (রাজা সাহেব) 1981 Better Sound