সালমান শাহ নামটি ৯০ দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক ধুমকেতুর নাম। যিনি হুট করে এসে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের মন জয় করে খুব তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমার এই লিখাটি আমার দেখা সালমানের কয়েকটি চলচ্চিত্রের ব্যাপারে ধারণা দেয়া’সহ সালমান সম্পর্কে সবাইকে একটা পরিপূর্ণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা মাত্র। সালমানকে নিয়ে এই লিখাটি ৯০ দশকে হলে দেখা একজন দর্শকের চোখ দিয়ে দেখার বর্ণনা বা স্মৃতিচারণ বলতে পারেন।
১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরের ছবিগুলোর মাঝে মুক্তি পায় সোহানুর রহমান সোহানের রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসাসফল ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ যা ছিল ভারতের আমির -জুহির ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির বাংলা সংস্করণ বা রিমেক। যা পরিচালক ও প্রযোজক ভারত থেকে মুল ছবির প্রযোজক ও পরিচাকের অনুমতি নিয়েই ছবিটি তৈরি করেন। সোহান তখন ইন্ডাস্ট্রির নবীন একজন পরিচালক যিনি বাংলাদেশের ৮০র দশক থেকে ৯০ দশকের সেরা পরিচালক এ জে মিন্টুর সহকারী পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন এবং মিন্টুকেই যিনি ‘গুরু’ মানেন। ৯১ সালে ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’ সিনেমার মধ্য দিয়ে সোহান পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
‘’কেয়ামত থেকে কেয়ামত’’ মুক্তি পাওয়ার পর সারাদেশের দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। পারিবারিক দর্শকদের সাথে নতুন প্রজন্মের কিশোর তরুনদের উপচে পড়া ভিড় ছিল প্রতিটি সিনেমা হলের প্রতিটি শোতে যার ফলে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’’ চলচ্চিত্রের পরের অবস্থানটি দখল করে নেয়। পরিচালক সোহান হিন্দি সিনেমা থেকে রিমেক করেছেন সেটা আগে থেকে কেউ না জানলে মনে করবে এটি বাংলাদেশেরই মৌলিক কোন গল্পের ছবি। পরিচালক সোহান কিছু কিছু জায়গায় মুল হিন্দি ছবিটিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গীত পরিচালক আলম খান আবহ সঙ্গীত পরিচালনায় দারুণ/দুর্দান্ত কাজ দেখিয়েছেন। ছবিতে দর্শকরা সালমান হাজির হলেন যথারীতি আমির খানের মতো জনপ্রিয় গানটির মাধ্যমে ।
প্রথম সাক্ষাতেই দর্শক নড়ে চড়ে বসলো নতুন সুদর্শন তরুন নায়ক সালমান কে দেখে। এরপর যতই ছবির গল্প এগোতে থাকে ততই যেন সালমানকে দর্শকদের ভালো লাগতে থাকে। সেই সাথে ভালো লাগতে থাকে সালমান – মৌসুমী জুটিকে। দুজনকে মানিয়েছিলে বেশ।
পুরো ছবিতে দুই তরুণ-তরুণীর প্রেম ও সর্বশেষ দুই অভিজাত পরিবারের দ্বন্দ্বের কারণে দুইজনের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয় ।যা দর্শকদের চোখ ভেজা অবস্থায় বাড়ী ফিরতে বাধ্য করে। অবাক কড়া ব্যপার হলো মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর দর্শকদের কাছে ছবিটির গল্প ও পরিণতি আগে থেকে জানা থাকলেও পুরোটা সময় জুড়ে একজন দর্শককেও দেখলাম না বিরক্ত হতে বরং মনে হয়েছে সবাই গল্পটি আজই প্রথম জেনেছে যার ফলে প্রতিটা দর্শক শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ছবিটি উপভোগ করেছেন, কেউ কেউ একাধিকবারও উপভোগ করেছেন। প্রযুক্তির অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বলিউডের একটি সুপারহিট ছায়াছবির বাংলা রিমেক অসাধারণভাবে সফল হয় যা বাংলা ছায়াছবির একটি মাস্টার পিস বলা যায়। বলিউডের বিগ বাজেটের তুলনায় বাংলাদেশের স্বল্প বাজেট ও পরিচিত লোকেশনেও ছবিটি দারুণ সফলতা পায় এবং সেই সঙ্গে প্রথম ছবিতেই দর্শকদের বিশাল ভাললাগা ও ভালবাসায় পরিনত হোন সালমান শাহ ও মৌসুমী। কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির প্রযোজনা সংস্থা আনন্দমেলা চলচ্চিত্র যার কর্ণধার ছিলেন প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ যিনি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। যিনি পরবর্তীতে একইভাবে ‘সাজন’ রুবেল, ইলিয়াস কাঞ্চন ও মৌসুমী এবং ‘আমার ঘর আমার বেহেস্ত’ শাকিল খান ও পপিকে নিয়ে ছবি তৈরি করেন যার পরিচালক এই সোহানুর রহমান সোহান। প্রথমবার যে সকল হলে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি মুক্তি পায় তার অধিকাংশ হলেই পুরো ৪ সপ্তাহ হাউসফুল ব্যবসা করে অর্থাৎ সিনেমা হল মালিকরা ছবিটি পুরো ১ মাস প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। ছবির গান সবগুলো ছিল সুপারহিট। এই ছবির পর সালমানকে আর কখনো সোহানের ছবিতে পাওয়া যায়নি কিন্তু মৌসুমীকে একাধিকবার সোহানের ছবিতে কাজ করতে দেখা গেছে।
কেয়ামত থেকে কেয়ামতের বিশাল সফলতার পর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সালমান শাহকে। এরপরেও গল্পটা শুধুই সালমানের তড়তড় করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।সালমান হয়ে গেলেন সেই সময়কার নতুন দর্শকসহ প্রবীণ দর্শকদেরও পছন্দের নায়ক। জাফর ইকবালের মৃত্যু যে শূন্যতা তৈরি করেছিল সালমান এসে যেন সেই শূন্যতা পূরণ করলেন এমন একটা ভাব ছিল প্রবীণ দর্শকদের মাঝে। সালমান হয়ে যান তরুণদের ফ্যাশন আইকন।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির সুপারহিট সালমান মৌসুমীর ২য় সুপারহিট ছবি শিবলী সাদিকের ‘অন্তরে অন্তরে’। এই ছবিটিও সালমান-মৌসুমীর প্রথম ছবিটির মতো হিন্দি ছবির রিমেক নয় কিন্তু হিন্দি ছবির গল্পকে অনুকরণ করা ছিল। ছবিটির পরিচালক শিবলী সাদিক মুলত সামাজিক অ্যাকশন ও পারিবারিক গল্পের ছবির এক নিপুণ কারিগর। সেই সময় শিবলী সাদিক এর নামটা বক্স অফিসে আলাদা সমীহ জাগানিয়া একটি নাম। যে ছবির পরিচালকের নাম শিবলী সাদিক থাকে সেই ছবি প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে যেতো। কারণ শিবলীর ছবির দর্শক তখনও ঘরে ঘরে ছিল। শিবলী সাদিক একবারে নতুন কিন্তু বক্স অফিসে তোলপাড় করা জুটি সালমান-মৌসুমীকে নিয়ে এমন দুর্দান্ত একটি গল্পের ছবি বানালেন আর সাথে শিবলীর বন্ধু সঙ্গীত পরিচালক আলম খানের মিষ্টি সুরের গান ছবিতে দিয়ে দিলেন যার ফলাফল সালমান-মৌসুমী জুটির টানা দ্বিতীয় সুপারহিট ছবি।
প্রথম ছবির পিতা-পুত্র অর্থাৎ রাজীব-সালমান এবার আলাদা রাজীব এই ছবিতে মৌসুমীর পিতা যিনি একজন জমিদারের বিশ্বস্ত প্রজা ও গরীব জেলে। আর সালমান জমিদার বাড়ীর বিদেশ ফেরত নাতী। ধনি গরীবের অসম প্রেম, বাধা বিপত্তি ও নাটকীয়তা শেষে অবশেষে দুই তরুণ-তরুণীর মিলন ছিল ছবিটির মুল উপজীব্য। এই ধরনের ছবি আরও বাংলা চলচ্চিত্রে হয়েছিল তবুও ছবিটি হয় সুপার ডুপার হিট। হয়তো প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামতের মধ্যে সালমান-মৌসুমীর বিয়োগান্তক সমাপ্তি দর্শক মেনে নিতে পারেনি যা তাদের মনে দাগ ফেলে। সেই ঘা শুকাতেই হয়তো দর্শক ‘অন্তরে অন্তরে’ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। রাজীব এই ছবিতে পজিটিভ চরিত্রের এক দুর্দান্ত অভিনেতা। শিবলী সাদিক কাহিনীকে এতো চমৎকার ভাবে গেথেছিলেন যে পুরো ছবিটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত দর্শক হল থেকে বের হয়নি। এই ছবির সবগুলো গান দারুন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যা ছবিটির সফলতায় সহায়তা করে। ‘অন্তরে অন্তরে’ ছবির আলম খানের সুর করা গানগুলো ছিল সেই সময়ের রেডিও ও টেলিভিশনের ছায়াছবির গানের মধ্য তুমুল জনপ্রিয় গান। ছবিটি পারিবারিক ও রোমান্টিক প্রেমের ছবি। পর পর দুটো রোমান্টিক চলচ্চিত্র হিন্দি গল্প থেকে নেয়া হলেও দর্শকদের মাঝে এ নিয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ছিলো না বরং দর্শক সালমান শাহ –মৌসুমীতেই বুদ হয়েছিল বুঝা যায়।
‘’অন্তরে অন্তরে’’ সিনেমার শুটিং চলাকালিন সময়েই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম যে সালমান মৌসুমী জুটি হাতে থাকা ছবিগুলোর কাজ শেষ করার পর আর একসাথে কাজ করবেন না। এই সংবাদটা ভক্ত , প্রযোজক , পরিচালকদের কাছে যতটা না নেতিবাচক ছিলো পরবর্তীতে তা হয়ে যায় ইতিবাচক। পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য সেই সময়ের মেধাবি পরিচালকরা বিষয়টাকে ইতিবাচক করে তুলেন সানি – মৌসুমী জুটি গড়ে। শুরু হয়ে যায় সালমান শাহ’র সাথে আরেক নতুন নায়ক ওমর সানীর প্রতিযোগিতা যা দর্শকরা লুফে নেয়। জহিরুল হক সর্বপ্রথম মৌসুমীকে বাদ দিয়ে সালমানের সাথে শাবনুরের জুটি গড়ে তুলেন যে শাবনুরের প্রথম চলচ্চিত্র ‘’চাঁদনী রাতে’’ ছিল সুপার ফ্লপ। অন্যদিকে দিলিপ সোম নির্মাণ করেন সানি মৌসুমী জুটির প্রথম সিনেমা ‘দোলা’। সালমান শাবনুরের প্রথম ছবি ‘তুমি আমার ‘ ও সানি – মৌসুমীর ‘দোলা’ দুটোই হয়ে যায় সুপারহিট যার ফলে প্রযোজক পরিচালকদের ২য় কোন কিছু ভাবতে হয়নি। হলে যাওয়া নতুন দর্শকদের জন্য দুটো নতুন জুটি সার্থকভাবেই গড়ে তুললেন আর শুরু করে দিলেন প্রতিযোগিতা যার ফলে মান্না, রুবেল, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চনদের দাপটের বাহিরে সালমান – সানী’র দাপট শুরু হয়ে যায়। দর্শকরা পেতে থাকে একে একে দুর্দান্ত সব সিনেমা যা ছিল বাংলাচলচ্চিত্রের স্মরণকালের সেরা একটি সময়। পারিবারিক দর্শকরা ছাড়াও সিনেমা হল মাতিয়ে রাখে সেই সময়কার স্কুল কলেজ পড়ুয়া কিশোর তরুন’রা।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ও ‘অন্তরে অন্তরে’ ছায়াছবি দুটি সুপারহিট হওয়ার সুবাদে সালমান- মৌসুমী জুটির চাহিদা আকাশতুঙ্গে। ঠিক এমন সময়ই কি এক অজানা কারনে সালমান – মৌসুমী আর জুটি বাঁধতে রাজী হননি। তাঁরা দুজনেই নিজেদের চেনাতে সিদ্ধান্ত নিলেন যে আর একসঙ্গে কোন ছবিতে অভিনয় করবেন না যা পরবর্তীতে মাত্র আরও ২ টি ছবি ছাড়া দুজনের দেখা একসঙ্গে দর্শকরা পায়নি। ফলে পরিচালকগন বেশ বিপাকে পড়ে যান ,কারন ঐ সময় মৌসুমী ছাড়া প্রতিষ্ঠিত সব অভিনেত্রীই ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে সালমানের সিনিয়র যারা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বিশেষ করে চম্পা ও দিতি। এদের সাথে জুটি করেও লাভ হবেনা। সালমান হয়ে পড়েন মৌসুমী বিহীন একা। ঠিক তখনই প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক জহিরুল হক সিদ্ধান্ত নেন যে ইন্ডাস্ট্রির আরেক নতুন মুখ ‘শাবনুর’কে নিয়ে সালমান এর সাথে ছবি বানাবেন। উল্লেখ্য শাবনুর এর প্রথম ছবি প্রয়াত এহতেশাম এর ‘চাঁদনী রাতে’ ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরে যার বিপরীতে ছিলেন আরেক নবাগত নায়ক ‘সাব্বির’। ‘চাঁদনী রাতে’ ছবিটি আমি ও আমার বন্ধুরা অর্ধেক দেখে হল থেকে বের হয়ে আসি ভালো না লাগার কারনে। তখন শাবনুর স্কুল পড়ুয়া একজন অভিনেত্রী যার মাঝে কিশোরীপনা স্পষ্ট লক্ষণীয় ছিল। যাই হোক, সালমান প্রথমেই রাজী হয়ে গেলেন কিন্তু আপত্তি ছিল প্রযোজকের যার দায়িত্ব নিলেন পরিচালক জহিরুল হক। তিনি প্রযোজককে আশস্থ করলেন যে ছবিটি ব্যবসা সফল হবেই। যদিও জহিরুল হক ছবিটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, অকালেই তাঁকে আমরা হারাই। জহিরুল হকের অসমাপ্ত কাজটি শেষ করেন একসময়ের তারই সহকারী তমিজ উদ্দিন রিজভি।
প্রবীণ পরিচালকের সাথে নবীন সালমান ও শাবনুর এর এটাই প্রথম কাজ। ছবিটি ছিল পুরোটাই রোমান্টিক ছবি যা হিন্দি একটি সিনেমার গল্পের অনুকরণে যেখানে সালমান বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা কাপর চোপড়, গাড়ী ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেকে একজন ধনির ছেলে হিসেবে শাবনুর এর সামনে তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে প্রকাশ পায় সম্পূর্ণ মিথ্যে ও অভিনয়। আসলে সালমান ধনী পরিবারের সন্তান নয় যা নিয়ে কাহিনীতে ব্যাপক গণ্ডগোল লাগিয়ে দেন বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ পরিচালক জহিরুল হক। জহিরুল হক হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ৮০র দশকে রংবাজ, কি যে করি, কেউ কারো নয়, প্রান সজনি, সারেন্ডার, বিজয়, জনি ওস্তাদ এর মতো ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়েছিলেন।
‘তুমি আমার’ ছবি ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া মাত্রই আমরা সব সালমান -সানী ভক্তরা হলে ভিড় করি। টিকেট নিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা কালোবাজারিদের উপর চড়াও হয়, যার ফলে সিনেমার মারামারি বাস্তবে শুরু হয়ে যায় হলের বাহিরেই। আবার এক স্কুলের ছেলেরা অন্য স্কুলের ছেলেদের উপর হামলা চালায় কাউনটার থেকে আগে টিকেট সংগ্রহ করা নিয়ে। কে কার আগে টিকেট কিনবে সেটা নিয়েই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ধস্তাধস্তি শুরু হলো। অবশ্য এইসব দৃশ্য তখন হলের নিত্যদিনের সকালের শোতে দেখা যেতো যা কারনে হলের দর্শকদের খুব বেশী আতংকিত হতে দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে বিকেলের শোতে ও এইরকম দু চারটা ঘটনা ঘটে ঘটতো।
ছবির সাথে সাথে প্রয়াত মেধাবী সঙ্গীত পরিচালক আবু তাহের এর সুরে ছবির গানগুলো বিশেষ করে কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ও ২য় বার রুনা লায়লার কণ্ঠের ‘ জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি, শেখ ইশতিয়াক ও কনক চাঁপার কণ্ঠে – তুমি আমার ভালোবাসার গান, আগুন ও সামিনা চৌধুরী’র কণ্ঠের – আমার জন্ম তোমার জন্য, , আগুন ও কনক চাঁপার কণ্ঠে – দেখা না হলে একদিন, গানগুলো ছিল সুপার ডূপারহিট। একটি গল্পের সাথে দারুন কিছু গান একটি চলচ্চিত্রের সফলতায় কিভাবে কাজ করে তুমি আমার তার প্রমাণ। গানগুলি ছিল সেই সময় চরম হিট যা বিটিভির ছায়াছন্দে ও রেডিওর ছায়াছবির গানের নিয়মিত প্রচারিত হতে থাকে। উল্লেখ্য এর আগে জহিরুল হক এর ছবিগুলোর গান থাকতো আলম খানের সুর করা কিন্তু এই প্রথম জহির তাঁর বন্ধু আলম খান এর ব্যস্ততার কারনে আবু তাহের কে নিয়ে গানের কাজ করেন আর আবু তাহেরও তাঁর সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ছবির সবগুলো গানকে চমৎকার সুর করে। সেই থেকে শুরু হলো বাংলা চলচ্চিত্রের একটি সুপারহিট জুটি সালমান – শাবনুর এর জন্ম এবং শুরু হয়ে গেলো একটি অঘোষিত লড়াই যার একদিকে সালমান -শাবনুর অন্যদিকে মৌসুমী – ? সেটার জন্য আগামী পোস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। যাদের কারনে সেই সময় ইন্ডাস্ট্রি ও দর্শক ২ দিকে ভাগ হয়ে যায় আর চলতে থাকে একজুদ্ধ……..।ফলাফল কিছু অসাধারন ছবি ।। তুমি আমার ছবির সাফল্যর পরপরেই পরিচালক শাহ আলম কিরণ সালমান -শাবনুর জুটিকে নিয়ে ৭০র দশকের সুপারহিট খান আতাউর রহমান এর ‘সুজন সখী’ (ফারুক কবরী) রিমেক বানানোর ঘোষণা দেন যা
‘তুমি আমার ‘ ছবিটি মুক্তির পর যথারীতি সুপারহিট। অর্থাৎ নবাগত সালমানের একটানা ৩ টি সুপারহিট ছবি দিয়ে প্রযোজক , পরিচালকদের আস্থা অর্জন করলেন এখানে মজার ব্যাপার হলো যে সালমানের তিনটি সিনেমাই ছিল হিন্দি গল্পের নকল তবুও ব্যবসা করেছে পরিচালকদের মুন্সিয়ানায় ও সালমানের ক্রেজের কারনে। আর অন্যদিকে শাবনুর পেলেন প্রথম সুপারহিট ছবির স্বাদ এবং বুঝে গেলেন যে নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে ও সাজাতে সালমান এর সাথে জুটি বাঁধা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।অর্থাৎ শাবনুর নিজের ক্যারিয়ার গড়তেই সালমান কে ব্যবহার করতে লাগলেন। কারন দর্শক সালমান এর জন্য ছবি দেখতে যায় শাবনুর জন্য নয় এটা স্পষ্ট। আমরা যারা সেই সময় হলে নিয়মিত যেতাম তাঁরা কেউ শাবনুর এর ছবি এসেছে এই জন্য যেতাম না, সবাই সালমানের নতুন ছবি সেইজন্যই যেতাম।
সালমান শুরু থেকেই রোমান্টিক গল্পের সিনেমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন যে প্রযোজক পরিচালক ও দর্শকরা ভিন্নভাবে কিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছিলো সেই দুঃখটা গুচিয়ে দিলেন পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান ‘বিক্ষোভ’ সিনেমা দিয়ে। এই প্রথম সালমানকে পাওয়া গেলো রোমান্টিক গল্পের বাহিরের ভিন্ন গল্পের ছবিতে। সালমানও নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন বিক্ষোভ ছবিতে। পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান তিন সুপারহিট রোমান্টিক ছবির নায়ক সালমান কে নিয়ে তৈরি করেন বাংলাদেশের অন্ধকার ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ‘বিক্ষোভ’ ছবিটি। যার মধ্য দিয়ে কিভাবে মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন সেই সত্যিকারের চিত্রটি পরিচালক সাহসের সাথে ফুটিয়ে তোলেন এ যেন আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মম সত্যিকারের চিত্র। একজন সাধারন দর্শক হিসেবে রোমান্টিক ছবির বাহিরে আমার দেখা সালমানের সেরা তিনটি ছবি হলো ‘বিক্ষোভ’ এরপর ‘ এই ঘর এই সংসার ‘ ও ‘’ সত্যর মৃত্যু নেই’’।
ছবির নায়িকা সেই আগের ‘তুমি আমার’ খ্যাত শাবনুরকেই বেছে নিলেন কারন মৌসুমী সালমান বিরোধ এবং মৌসুমীর সাথে ইতিমধ্যে দর্শকরা অন্য একজনকে গ্রহন করে নিয়েছে তাই পরিচালক হান্নান কোন ঝুঁকি না নিয়েই শাবনুরকে সালমান এর বিপরীতে নিয়েই শুরু করেন ‘বিক্ষোভ’ ছবিটি। ছবির প্রযোজনা সংস্থা বি.এম ফিল্মস এর এটি ছিল প্রথম ছবি যা নিবেদন করেছিলেন আলেয়া বেগম ও সালেহা রাব্বি। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর যথারীতি সালমান ঝড়ে হলগুলো ‘হাউসফুল’ হয়ে ছবি প্রদর্শন করতে থাকে। টিকেটের চড়া মূল্য এবং আবারো হল কাউনটারে দর্শকদের ধস্তাধস্তি ও মারামারি। তবুও ছবির ব্যবসায় কোন আচর পড়েনি। এই ছবিতে সালমান কলেজের একজন মেধাবী ছাত্র। যার পিতা রাজীবের ‘রাজনীতিতে একটা কথা আছে’ কথাটির প্যাঁচে পড়ে প্রান হারান। সালমান তখন শিশু। যখন বড় হন তখন রাজীব দেশের একজন রাজনৈতিক নেতা যিনি সালমানের কলেজের সন্ত্রাসী জহির উদ্দিন পিয়ার এর আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। যার সন্ত্রাসের কারনে কলেজের সাধারন শিক্ষার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ে। একসময় সবাই প্রতিবাদ করতে শুরু করে।
ছবির চিত্রনাট্য এতো শক্তিশালী ছিল যে দর্শকরা ছবি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একবারও অনুমান করতে পারেনি ছবির শেষ পর্যন্ত কি হবে? একদিকে ছবির নাটকীয়তা, অন্যদিকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয় ও একের পর এক দুর্দান্ত গানগুলো দিয়ে ছবিটি ছিল ঠাসা।অথচ আজকের এতো ঢাকঢোল পেটানো ও দাওয়াত দিয়ে প্রিমিয়াম শো দেখানো ছবি গুলোর মাঝে তাঁর ছিটেফোটা পাওয়া যায়না। ভালো গল্প ও গানের ছবি হলে ঢাকঢোল পেটানো লাগেনা এবং প্রিমিয়াম শো করে সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে ছবির প্রচার করা লাগেনা তাঁর প্রমান ‘বিক্ষোভ’। পরিচালক হান্নান প্রমান করেছিলেন যে শুধু সালমানের টানেই নয় ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য ছিল শক্তিশালি, গান ছিল চমৎকার যার কারনে দর্শকরা ছবিটিকে গ্রহন করেছিল। ছবিতে পরিচালক আমাদের খ্যাতনামা আরেক সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর হাতে ছবির গানগুলোর দায়িত্ব দেন। বুলবুল ১০০ তে ১০০ পেয়েই তার পুরো দায়িত্ব সফল্ভাবে সম্পন্ন করেন। এই ছবির ব্যবসায়িক সফলতার পরেও সালমান কে আর এই ধরনে সামাজিক অ্যাকশন ছবিতে খুব বেশী দেখা যায়নি। সালসালমান আবারো যথারীতি রোমান্টিক প্রেমের ছবিতে কাজ করতে শুরু করেন। আসলে মোহাম্মদ হান্নান এর ছবিটি ছিল এমন যে এখানে সালমান না হয়ে যদি তখনকার জনপ্রিয় নায়ক মান্না, ওমরসানী বা রুবেল কেও নেয়া হতো তাহলেও ছবিটি ব্যবসাসফল হতো। কারন এর গল্প ও গাঁথুনি ছিল খুব মজবুত যার কারনে ছবিটি দেখে দর্শকরা চরম মজা পেয়েছিল। আর তখন এই ধরনের রাজনৈতিক গল্পের ছবির বাজারও ছিল চরম। যার প্রমান এর ২ বছর আগের ছবি কাজী হায়াত ‘ত্রাস’, ‘চাঁদাবাজ’ ,নাদিম মাহমুদ এর ৯৩ তে নাদিম মাহমুদ এর ‘আখেরি হামলা’ ছবিগুলো। প্রথমদিন ‘বিক্ষোভ’ ছবিটির হাউস্ফুল দেখে সবাই সালমান এর জন্য ভিড় করেছে মনে হলেও পরবর্তীতে তা পাল্টে যায়। ছবির কাহিনীর কারনেই দর্শক ছবিটি লুফে নেয়। তবে সালমানের যে কোন অবদান নেই সেটা আমি বলছি না , এখানে দর্শকরা আগের শান্তশিষ্ট প্রেমিক সালমানের বদলে এক নতুন প্রতিবাদী কলেজ ছাত্র সালমানকে দেখতে পায়। যিনি রোমান্টিক ছবির মতোই এখানেও সফল। তবে সালমানের অনেক দর্শক মনে মনে সালমানকে অ্যাকশন নায়ক হিসেবে গ্রহন করেনি যা সালমান নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন । মোহাম্মদ হান্নান এর সাথে সালমানের সেটাই প্রথম এবং শেষ ছবি ছিল। জীবিত অবস্থায় মোহাম্মদ হান্নান সালমান শাবনুর জুটিকে নিয়ে আর কাজ করেননি। আজো স্মৃতির পটে ছবিটি হলে দেখার দিনটির কথা বারবার মনে পড়ে আর চোখে সেইসব আনন্দ ও উত্তেজনা নিয়ে বদ্ধ হল ঘরে একের পর এক সিগারেট টানার দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে, যেখানে আমরা সব বন্ধুরা ছিলাম চরম টেনশনে। ধন্যবাদ জানাই পরিচালক মোহাম্মদ হান্নান কে এমন একটি চমৎকার সুন্দর ছবি আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।