করোনার সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি, বন্ধ ছিল বাইরে হাঁটতে যাওয়া বা ব্যায়াম, মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি কম হয়নি। এরই মধ্যে এল আরেকটি নতুন বছর। নতুন বছরে এসব করণীয় কীভাবে মানবেন, এখানে থাকল তারই পরামর্শ।
নতুন বছর, নতুন স্বাভাবিক
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদিও আশা প্রকাশ করছে যে ২০২২ হবে করোনা সমাপ্তির বছর, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানোর সময় এখনো আসেনি। ব্যাপক টিকা কার্যক্রম, কমিউনিটি সংক্রমণের মাধ্যমে একধরনের ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠা আর দিন দিন ভাইরাসের মিউটেশন ঘটা—এই তিন ঘটনার সমন্বয়ে ধীরে ধীরে হয়তো করোনা খানিকটা দুর্বল হয়ে আসবে। কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল হবে, তা আশা করা যায় না। তাই স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে ছাড় দেবেন না। জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমরা ভ্রমণ করছি, সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করছি, পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছি, কিন্তু মুখে মাস্ক পরা, খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়ার অভ্যাস বাদ দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে যাঁরা বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁদের জন্য এ কথা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। কারণ, এসব স্বাস্থ্যবিধি পালনের মাধ্যমে তাঁরা আরও নানা রোগবালাই থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারেন।
নিয়মিত হাঁটলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতীকী ছবিতে উল্কা হোসেন
স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা এখনো নেননি, তাঁরা এ বছর অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে নেবেন। আর ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা নেবেন বুস্টার ডোজ। গবেষণায় প্রমাণিত যে বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজ আপনার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়াতে সক্ষম। শুধু নিজেরাই নন, চারপাশে যাঁরা আছেন, সবাইকেই টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করুন। বাড়ির গৃহকর্মী, গাড়িচালক, পাড়া-প্রতিবেশী, নিরাপত্তারক্ষী, অফিসের অন্য সবাই টিকা না নিলে সুফল মিলবে না।
নতুন বছরে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
করোনা ও অন্যান্য আতঙ্কের জন্য গত বছর দৈনন্দিন জীবনযাপনে উল্টাপাল্টা হয়েছে। ঠিকমতো হাঁটা হয়নি, ব্যায়াম হয়নি। বাড়িতে বসে খাওয়াদাওয়া বেশি হয়েছে। ফলে ওজন বেড়েছে। এ বছর সেই সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটু একটু করে পার্ক, রাস্তা, ছাদ বা জিমে ব্যায়াম করতে শুরু করুন। নিদেনপক্ষে বাসায় ব্যায়াম করুন। বাড়তি মেদ ঝরাতে সচেষ্ট হোন। সঠিক সময়ে ঘুম ও সকালে ওঠার রুটিন সবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বছর চেষ্টা করুন আগের নিয়মে ফিরতে। রাতে ৬-৭ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম দরকার।
চিকিৎসকের পরামর্শে এখন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সেরে ফেলতে পারেন, ছবি: সংগৃহীত
বিঞ্জ ইটিং বা যখন-তখন খাওয়া বন্ধ করে খাদ্যাভ্যাসকে একটি নিয়মের মধ্যে আনতে চেষ্টা করুন। সকালে নাশতা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকালের নাশতা যেন দুপুরে না গড়ায়। আর রাতের খাবারও সেরে ফেলতে হবে সন্ধ্যার একটু পর। নতুন বছরে নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করুন, পুরোনো স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো ফিরিয়ে আনবেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
বয়স্ক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদ্রোগ আছে, এমন ব্যক্তি যাঁরা আগে বছরে দুই-চারবার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন, তাঁদের অনেকেই গত দুই বছর সাহস করে উঠতে পারেননি। এ কারণে করোনার সময়ে অন্যান্য রোগে মৃত্যু, যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির হার বেড়েছে। এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধীরে ধীরে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সেরে ফেলতে পারেন। এর মধ্যে পড়ে রক্তে শর্করা, চর্বি, কিডনির ক্রিয়েটিনিন, প্রস্রাবে আমিষ, লিভার পরীক্ষা ইত্যাদি। নারীদের জন্য আরও কিছু পরীক্ষা আছে। চোখ পরীক্ষা করাও জরুরি। কারও ক্রনিক রোগ থেকে থাকলে, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে ফেলুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ওষুধপথ্যের পরিবর্তন বা অ্যাডজাস্ট করতে হবে কি না, জেনে নিন।
মনের সুস্থতার জন্য কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন
মনের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিন
করোনার সময়ে একা একা ও দূরবর্তী থাকতে থাকতে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিই মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকের মনমেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, অনেকে বিষণ্নতায় ভুগছেন। এবার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারেন ধীরে ধীরে। নাতি-নাতনিদের নিয়ে খেলতে পারেন। কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন, গ্রামের বাড়ি যেতে পারেন। এসব করলে মানসিক চাপ কমবে। যদি প্রয়োজন মনে করেন, মানসিক বিপর্যয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে পারেন। তবে এর অনেক কিছু নির্ভর করে চলমান সংক্রমণের হারের ওপর। যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তবে আবার হয়তো বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে হবে।
শিশুদের হারানো জীবন
করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা। তাদের জীবন থেকে দুটি বছর হারিয়ে গেছে। তারা স্কুলে যেতে পারেনি, বাইরে খেলতে পারেনি, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারেনি। এত সব না করা, শরীর ও মনের ওপর চাপ ফেলেছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তাই নতুন বছরে উচিত হবে শিশু-কিশোরদের টিকা দিয়ে ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে দ্রুত পুরোনো জীবনে ফিরিয়ে আনা। স্কুলগুলো খুলে দেওয়া। এ জন্য অভিভাবকদেরও করণীয় আছে। নতুন স্বাভাবিক জীবনাচরণে শিশু-কিশোরদের অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
সবকিছু আগের মতো নেই
অমিক্রন ধরন নিয়ে কোভিডের ফিরে আসা বলে দিচ্ছে যে চট করে স্বস্তি পাওয়ার মতো কিছু নেই। হয়তো আমাদের এই ভাইরাসের সঙ্গেই মানিয়ে জীবন যাপন করতে হবে আরও অনেক দিন। তাই সবকিছু আগের মতো হবে না, এটা মেনে নিতে হবে। হাহুতাশ করার কিছু নেই। আগের সবকিছু ভালো ছিল, তা তো নয়। নতুন স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করার সময় পুরোনো বদভ্যাসগুলো ঝেড়ে ফেলে এগোন। নতুন স্বাভাবিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। তাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সুস্থ জীবনাচরণে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলুন।
[FA]pen[/FA] লেখক: অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত | চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা