বাংলাদেশে তখন শীত জেঁকে বসেছে। পরিযায়ী পাখিরা সাইবেরিয়াসহ দূরদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে বাংলাদেশে। গত পৌষের সে সময় আমি গিয়েছিলাম পৃথিবীর অন্যতম শীতল স্থান সাইবেরিয়ায়। উদ্দেশ্য, বৈকাল হ্রদ ভ্রমণ।
পেশাগত কাজের সূত্রেই রাশিয়ায় যাওয়া। রাশিয়ার নভোভরোনেজ থেকে সাইবেরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম। প্রথমে ট্যাক্সি আর ট্রেনে মস্কো, তারপর উড়োজাহাজে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাইবেরিয়ার ইরকুৎস্ক শহরে।
সাইবেরিয়ার অন্যতম বড় এবং জনবহুল ইরকুৎস্ক শহর। ইরকুৎস্ক বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে হোটেলে যাওয়ার পথে ঘুম ঘুমচোখে আশপাশ দেখছিলাম। চারদিক বরফের শুভ্র আবরণে ঢাকা। তুলার মতো তুষার পড়ে চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। পাহাড় সাদা, বরফ আচ্ছাদিত গাছপালা, ঘরবাড়ি। বরফ সাদা জগৎ দেখতে দেখতে স্বাগত জানাল বৈকাল হ্রদ। পৃথিবীর বৃহত্তম স্বাদুপানির এই হ্রদের আয়তন প্রায় ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটার। কমবেশি ৩৩০ নদী এ হ্রদে পতিত হয়েছে। আর এ হ্রদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে আঙ্গারা নদীর।
ওলখনে জমাটবাঁধা হ্রদে ছবি তুলছিলেন দুই চীনা তরুণী
হোটেলে এসে দেখি, জানালা খুলে চোখ মেললেই বৈকাল হ্রদ, বরফে আচ্ছাদিত কোদার পর্বতমালা দেখা যায়। পরের দুদিন কেব্ল কারে কোদারপর্বতের ওপর থেকে বৈকালের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।
বলে রাখা ভালো, ইরকুৎস্কে বৈকালের এন্ডেমিক সিলের খেলা দেখা, ডগ স্লেজিং কিংবা স্নোমোবিলে চড়ার ব্যবস্থা আছে। তবে আপনি প্রাণিপ্রেমী হলে এগুলো বাদ দিতে পারেন। ইরকুৎস্কে একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম, হ্রদের পানি তখনো পুরোপুরি বরফ হয়নি, কেবল ওপরে হালকা একটি আবরণ পড়েছে, এর ওপর পাথর ছুড়লে বেশ চমৎকার এক সুরধ্বনি তৈরি হয়।
শামান রকের পাশে রংবেরংয়ের খুঁটি। এগুলো ‘পবিত্র খুঁটি’ হিসেবে পরিচিত
ওলখন দ্বীপে যাত্রা
বরফে পাথর ছোড়ার সুর কানে বাজাতে বাজাতে আমরা যাত্রা শুরু করি ওলখন দ্বীপের উদ্দেশে। সকাল আটটা মানে এখানে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকারে পথ ধরেছিলাম, সারা দিনে ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম ওলখন। যাত্রাপথে দেখা মিলল একপাল ঘোড়ার, হুট করে তারা রাস্তা পার হচ্ছিল।
দ্বীপে পৌঁছানোর আগে ফেরির জন্য বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। তখন দেখলাম বৈকালের আরেকটি অপার্থিব রূপ। ফেরি পারাপারের জায়গাটা বরফ হয়ে আছে। চারপাশের পাহাড়সারি বরফের চাদরে আচ্ছাদিত। এর মধ্যে আবার একটু করে সূর্য দেখা যাচ্ছে।
ওলখনে আমাদের হোটেলের আতিথেয়তা মনে রাখার মতো। আর ওদের খাবারও বেশ ভালো। রাতের বেলা বৈকাল হ্রদের অমুল মাছের বারবিকিউ হলো। তাই দিয়ে রাতের খাবার সারলাম।
পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম জমাটবাঁধা হ্রদ দেখতে। ট্যুরিস্ট বাসগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বাসের আদলে তৈরি। আটজন বেশ আঁটসাঁট হয়ে বসতে হয়। এই বাসে পাহাড়ের একদম ওপরে উঠে দেখিলাম বৈকালের আরেক রূপ।
অন্য পর্যটকদের সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)
পাখির চোখে দেখা মিলল বরফসাদার সমারোহ। চারপাশ পর্বত বরফে সাদা। এখান থেকে বাস আমাদের হুট করেই নিচে নিয়ে এল। হঠাৎ করেই দেখি বাস চলছে কিন্তু বাসের নিচে কেবল বরফ আর বরফ। নেমে দেখি আমরা একদম বৈকালের মধ্যে। বরফ এতই শক্ত যে এর মধ্য দিয়ে বাস পর্যন্ত চলছে অনায়াসে। হ্রদের পানির ওপরের স্তরের হয়তো ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত বরফ হয়ে আছে। ওপর থেকে তাকালে নীল বরফের মাঝে জমাটবাঁধা বাতাসের বুদ্বুদ দেখা যায়। দেখা মেলে পাথুরে গুহার ভেতর সারি সারি নীল বরফ ফালির। এর মধ্যে আবার আমাদের গাড়ির চালক বাসের ভেতর দুপুরের খাবার রান্না করতে গেছেন। এই হিম ঠান্ডায় স্যুপ আর চা খেতে অমৃত লাগছিল। খাওয়ার পর যে ময়লা ছিল, সেটা আমাদের গাড়ির চালক এক জায়গায় জড়ো করে রাখছিলেন, যা পরবর্তী সময় ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। হ্রদের মধ্যে বরফের মধ্যে ছোট–বড় অনেক গর্ত। এগুলো আসলে হ্রদ থেকে মাছ ধরার জন্য, যা এত দিন কেবল তথ্যচিত্রে দেখেছি।
শামান রকে বিদায়বেলা
পরদিন সকালে উঠে চলে গেলাম শামান রক দেখতে। আমাদের হোটেল থেকে হেঁটে মিনিট পনেরো লাগল। পাহাড়ের ওপর থেকে যখন নামছিলাম, তখন এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছিল। শামান রক বৈকালের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, বুরখান ধর্মানুসারী আলতাই জাতিদের একটা বড় অংশ এই শামান রকের গুহায় বাস করত। এই পাথরের পাদদেশে নীলের ছড়াছড়ি। পাথরের বুকে যে বরফ জমে সাদা হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো আকাশের রং ধারণ করেছে।
এরপর বিদায়বেলা। উত্তর হাওয়া বিদায় জানিয়ে কর্মস্থলের পথ ধরলাম। আবার দূরদেশে সেই প্রতিদিনকার আটপৌরে জীবন শুরু হয়।
* লেখক: তানভীর হোসেন | প্রকৌশলী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঈশ্বরদী।