নতুন নিরীক্ষার নতুন ছবি ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস।’ নাট্যাঙ্গনে নিজস্বতা তৈরি করা সৃষ্টিশীল নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের প্রথম পরিচালিত ছবি। দুই ধরনের ছবি হয় – শুধুই বিনোদনধর্মী আর ভাবাতে পারা ছবি। ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দুটোর সংমিশ্রণে নির্মিত অন্যরকম ছবি।
‘আইডিয়া’ আর ‘মেথড’ দুটো হাত ধরাধরি করে চলে। নতুন কোনো আইডিয়া আনলে সেটাকে প্রয়োগ করার মতো দক্ষতাও প্রয়োজন। নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল নতুন আইডিয়াকে একদম সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরিবেশন করেছেন ছবিটিতে। দর্শককে ভাবাতে বা তাদের ভাবনাকে চারিয়ে দেবে এ ছবি। এক ছবিতে রোমান্স, সায়েন্স ফিকশন, হিউম্যানিটি, ফ্যান্টাসি, হরর এবং ক্লাইমেক্সে সম্পূর্ণ নতুন একটি এক্সপেরিমেন্ট দেখতে পাবে দর্শক। সবটা মিলিয়ে ছবি যখন শেষ হবে প্রেম বলতে আমরা সাধারণত যা মিন করি দুজন নর-নারীর প্রেম সেটাকে এ ছবি অন্য এক অর্থে নিয়ে যাবে। অদ্ভুত এক মানবিক বোধের জায়গায় দর্শককে দাঁড় করাবে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস।’
‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ শাব্দিক অর্থে ‘পাগলামি।’ ব্যাকরণগতভাবে এটা একটা বাগধারা কিন্তু সৃজনশীল অর্থে এটা গভীর। সৃজনশীল মানুষ বা সৃষ্টিশীল কোনোকিছুর মধ্যেই একটা পাগলামি থাকে। এ পাগলামির ধরন ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে বাধ্য আবার ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে ছড়িয়ে গেলে আরো বড় অর্থ পায়। ছবিতে সৃষ্টিশীল সত্তাটি ব্যক্তি থেকে সামষ্টিকে ছড়িয়ে গেছে তাই পাগলামিটা শেষ পর্যন্ত অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মন যেমন আনন্দিত হয় সৃষ্টিশীলতায় তেমনি বিষণ্ন হয় বেদনায় এ ছবিতে দুটোই মিলবে।
‘ভিড়ের মধ্যে চলে যাও অনেক গল্প পাবে সেখানে’
– শার্ল বোদলেয়ার
ভিড়ের মধ্যে দুজন ছেলেমেয়ে কথা বলছে, পরিচিত হচ্ছে, চা অফার করছে একে অন্যকে। কিছুটা ব্যতিক্রমী দৃশ্য ছবির শুরুতেই। ভিড়কে ধীরে ধীরে ছবির একটা চরিত্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সামাজিকতার বড় একটা সাইন এই ভিড় যেখানে মানুষ অনেকের দেখা পায়। ছবির প্রধান দুই চরিত্র অয়ন ও নীরার ভিড়ে পরিচয় এবং ঘটনাক্রমে প্রেম। প্রেমটা গতানুগতিক নয় একটু আলাদা। অয়ন ও নীরা দুজন দুইরকম, তাদের কাজও দুইরকম। রকমফের ছিল বলেই তাদের মধ্যে আকর্ষণটা তৈরি হয়েছে। তবে অয়নের কাজটা নীরাকে প্রথমত আকর্ষণ করেছে। ঐ আকর্ষণ থেকে প্রেমে গড়িয়ে তারপর নতুন মোড় নিয়েছে গল্প।
ছবির ফার্স্ট হাফ এবং সেকেন্ড হাফ টোটালি আলাদা। দুই ফ্লেভারের গল্প ছিল যার জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পেরেছে। একটা ভারসাম্য বজায় রেখে স্টোরি টেলিং করা হয়েছে। পরিচালক চরিত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান দুই চরিত্রকে দুইভাবে উপস্থাপন করেছেন। অয়ন চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণকে একদম সরল করে তুলে ধরেছেন আর নীরা চরিত্রে শার্লিন ফারজানাকে কিছুটা চঞ্চল দেখিয়েছেন, দুজনের মাঝে প্রেম থাকলেও চিন্তার কিছু তফাত রেখেছেন অথচ ঐ চিন্তাগুলো তাদের প্রেমে দূরত্ব না এনে বরং গভীর করে তুলেছে। এটা ছবির শেষ পর্যন্ত ছিল। মানবিক হয়ে উঠেছে এই প্রেম, যেন ছবির আরেকটি চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রেম এবং এর জন্যই বাকিসব এক্সপেরিমেন্ট এসেছে।
ইমতিয়াজ বর্ষণ (অয়ন) ও শার্লিন ফারজানা (নীরা) নিঃসন্দেহে ছবির সেরা দুই পারফর্মার। দুজনের বৈশিষ্ট্য দুইরকম। ইমতিয়াজ খুব আস্তে কথা বলে, সরলতা ও নম্রতা আছে। অন্যদিকে শার্লিন চঞ্চল এবং ঘটনাক্রমে চোখের ভাষায় কথা বলা চরিত্র। শার্লিনের ভয়েস পুরো ছবিতে একটা নির্দিষ্ট টোনে ছিল যেটা শুনতে খুব মিষ্টি, গম্ভীর লেগেছে। তার ভয়েসে ‘আমার রক্ত লাগবে সি নেগেটিভ’ শুনতে একদম অন্যরকম লাগে। ইমতিয়াজের বলিষ্ঠতা আছে ভয়েসে। বাকিসব চরিত্র প্রয়োজনমাফিক এসেছে। নেভিলের চরিত্রটি ইন্টারেস্টিং।
ছবির সংলাপ ছিল খুবই ভালো। কিছু ক্ষেত্রে ফানি, কিছু ইমোশনাল বা সিরিয়াস। ‘প্রেমের তাওয়া গরম থাকতে থাকতে রুটি সেঁকে ফেলতে হয়’ মজার এই সংলাপের বিপরীতে সিরিয়াস যেমন-‘লোকজন ভাঁড়ামি করেই হিরো হয়ে যাচ্ছে দু’একটা মিউজিক ভিডিও করেই হিরো হয়ে যাচ্ছে’ কিংবা ‘সবকিছু নিয়ে নিউজ করতে নেই।’ এটা সমসাময়িক সিরিয়াস টপিকে হয়েছে। মানবিক একটা চরিত্রকে দেখানো হচ্ছে এ সংলাপে-‘একজন অজানা অচেনা মানুষ যখন অসুস্থ থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে তার মুখের হাসিটা একটু দেইখেন। স্যাম্পল বিক্রির থেকে অনেক বেশি দামি সেটা।’ গানের মধ্যে বেজবাবা সুমনের ‘প্রথম ঝরে পড়া শিউলিটা’ অসাধারণ বলিষ্ঠ কণ্ঠের গান, ‘এই শহর’ দারুণ ঘোর লাগানো। সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পারফেক্ট।
ছবির ক্লাইমেক্স ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। সেটা অবশ্যই গল্পের শক্তি। যে সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট পুরো ছবিতে চলেছে তার একটা মানবিক রূপ ক্লাইমেক্সে ছিল। মন স্পর্শ করবে। প্রেম বা ভালোবাসার একপাক্ষিক কোনো রূপ যে নেই সেটাই ক্লাইমেক্সে ছিল। অয়ন ও নীরা দুজনের দুইরকমের প্রেম, ভালোবাসার নিদর্শন ছবিটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। সমাজের বাস্তব চরিত্রগুলোর মধ্যে যারা প্রেমকে লালন করে তারা যেন এক একজন অয়ন ও নীরা হতে চাইবে। এভাবে রাবীন্দ্রিক ভাষায় ‘হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনোখানে’ পৌঁছে গেছে তারা।
‘যে ভালোবাসেসে কত ভালোবাসা দেখাতে সে পারে!’ জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ আশ্চর্য প্রশ্নের মতোই ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ছবি বিস্ময় রেখে শেষ হয়ে যায়।
রেটিং – ৮.৫/১০