ঊনপঞ্চাশ বাতাস
চিত্রনাট্য, সংলাপ, সংগীত ও পরিচালনা: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল
ক্যামেরায়: হৃদয় সরকার
অভিনয়ে: শার্লিন ফারজানা, ইমতিয়াজ বর্ষণ, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলোরা গহর, ড. ইনামুল হক, নেভিল ফেরদৌস, খাইরুল বাশার, লামিয়া, সেঁওতি প্রমুখ
নির্বাহী প্রযোজক: সৈয়দা শাওন
ব্যানার: রেড অক্টোবর
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট
মুক্তি: ২৩ অক্টোবর
রেটিং: ৪/৫
হলফ করে বলতে পারি, বিগত এক যুগে এমন প্রেমের ছবি আমি দেখিনি। একটি সিনেমাই তো! অথচ নীরবে-নিভৃতে কলিজা গুঁড়ো করে কত শত অনুভূতির অনুরণনে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না! সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে প্রিয়জনকে ক্ষণে ক্ষণে জড়িয়ে ধরছি, মনের গভীর থেকে আরও ভালোবাসার শপথ করছি, পরের জন্য জীবন ব্রত করার পবিত্র খেলায় মেতে ওঠার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি- মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের প্রথম সিনেমা ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এমনটাই ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিয়েছে মস্তিষ্ক আর মননে।
৮ মাস পর অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের ভেতর আমরা ঠকিনি, বরং উজ্জ্বল আলোর দেখা পেয়েছি। সরাসরিই বলছি, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিলনা। সহজ কথাকেও জটিল করে দেখার বদভ্যাস রয়েছে পরিচালকের- এমন ধারণা ছিল। তবে আমার ধারণা যে ভুল, সিনেমা দেখতে এসে চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। মানব জীবনের জটিল কিছু সম্পর্ক কী অবলীলায় সহজ করে দেখালেন টিভি নাটকের প্রশংসিত এই নির্মাতা। আমার মতো আমজনতা থেকে কট্টর বোদ্ধা-সমালোচকও এই গল্পে মন হারাতে বাধ্য হবেন। ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের দীর্ঘ এই সিনেমাটি আমি বার বার দেখতে চাইবো। বিশ্বের তাবৎ চলচ্চিত্রমোদীর কাছে, বাঙালিদের কাছে সগর্বে দেখাতে চাইবো।
‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ একটি বাগধারা। যার অর্থ ‘পাগলামি’। যে প্রেমে কোনও পাগলামি নেই, সে প্রেম নাকি গ্যাস ছাড়া বেলুনের মত। ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’-এর নীরা অন্তত এমন নিরুত্তাপ প্রেমে বিশ্বাস করে না। উচ্ছল, উজ্জ্বল, বাস্তববাদী অথচ আবেগী নীরা জীবন নিয়ে জুয়া খেলে, পাগলামি করে। আর সে পাগলামিতে আমরা দর্শকরা মনের অজান্তেই সায় দেই। এক সাক্ষাতকারে পরিচালককে বলতে শুনেছিলাম, আমার সিনেমায় যদি দর্শককে নতুন কিছু উপহার না দেই, দর্শক কেন গাঁটের টাকা খরচ করে সিনেমা হলে আসবেন? ভেবেছিলাম এমন মুখ ভরা বুলি তো সব পরিচালকই তোতা পাখির মতো বলে থাকেন। তবে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দেখার পর নির্দ্বিধায় বলছি, এমন প্রেমের গল্প আমাদের দেশে এর আগে কখনও কেউ দেখেননি। যে গল্পে প্রেমের সমীকরণের উদ্যোক্তা তথাকথিত ‘নায়ক’ নন; নায়িকা। যে গল্পে হৃদয় ছেঁড়া প্রেম প্রসূত হয় বিজ্ঞানের আবহে। যে গল্পে রোমান্স, কমেডি, সেন্টিমেন্ট, ট্র্যাজেডি, ফ্যান্টাসি, হরর-সব ক’টি দরজা মিলেমিশে অলক্ষ্যেই একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়ে যায়।
এ ছবির প্রথম ভাগে এক ধরনের স্বাদ, বিরতির পর আরেক ধরনের। বিশেষ করে গোরস্থান থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আমার চোখের পলক পড়েনি; পড়েছে জল। শেষ ভাগে অয়ন চরিত্রের ঘোর লাগানো আসা-যাওয়ার মাধ্যমে দুর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন উজ্জ্বল। নন-লিনিয়ার গল্পে নান্দনিক মেটাফোর (রূপক) তৈরির মাধ্যমে প্রথম দৃশ্য থেকেই অন্য এক দুনিয়ায় ঘুরিয়ে এনেছেন দর্শককে। যাদু বাস্তবতা দিয়ে শুরু হওয়া গল্পটি কখন যে অয়ন-নীরার লোমহর্ষক (!) প্রেমের গল্পে রূপান্তর হয়, বুঝতেই পারিনি। লোমহর্ষক বলছি, কারণ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বের করা টোস্ট বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খাওয়া কতটা রোমান্টিক হতে পারে, ভাবা যায়? বৃষ্টিস্নাত অলস দুপুরে সম্ভাব্য প্রেমিকার দু’হাত ভর্তি খাবার নিয়ে আসা, খাবারের ঘ্রাণ আর বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে মুখোমুখি বসে খাওয়া, ভালো লাগার মানুষের কাপড় কেচে বারান্দায় সে কাপড় নাড়িয়ে দেয়া, ইচ্ছাকৃত দূরত্ব মেপে মনের সবটুকু ভালোবাসার কথা উজাড় করে দেয়া, নিঃশ্বাস বোতল ভর্তি করে পরস্পরের কাছে রেখে দেয়া- প্রেমানুভূতির জীবন্ত এক সংকলন বলা যেতে পারে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’কে। ময়ূরের পালক থেকে পায়রা, নানান ঋতু, ভোর থেকে মধ্য রাত-সময়কেও সযত্নে ফ্রেম বন্দী করা হয়েছে। পরিচালককে ধন্যবাদ, তিনি গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে সরল ভাষায় নিজের চিহ্ন রেখে বাংলা সিনেমার জন্য এক জীবন্ত কবিতা উপহার দিয়েছেন। যে কবিতার প্রতিটি চরণে অদ্ভুত মায়াবাস্তবতা আর নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে।
একটি দৃশ্যে বর্ষণ ও শার্লিননীরা-অয়ন ছাড়াও ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘ভিড়’। ভিড়ের মাঝেই পাখির নীড়ের মতো চোখ দিয়ে নীরার ভালো লাগে অয়নকে, অতঃপর ভালোবাসা, প্রেম। যে প্রেম কোলাহলকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নির্জনতায়। এই নির্জনতার মাঝে ভালোবাসার পরিণতি শুধু দুজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অন্যদের জীবনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। আদি ও অকৃত্রিম সত্যটি সবাই নতুন করে বুঝতে পারে- সত্যিকারের ভালোবাসার মৃত্যু নেই।
পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল এক হাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব দায়িত্ব (কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, শিল্প নির্দেশনা, ফটোগ্রাফি, সংগীত, পোস্টার ও ক্যাম্পেইন ডিজাইন) সামলেছেন। কোন দায়িত্বে তিনি সবচাইতে সফল-তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। তবে পরিচালকের লেখা সংলাপগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেকদিন মনে থাকবে। (আমি অর্ধেকটা দম নেই, বাকিটা একসাথে নেবো বলে/ প্রেমের তাওয়া গরম থাকতে থাকতে রুটি সেঁকে ফেলতে হয়/ আমি হেঁটে যাই, শুধু পৌঁছুতে পারি না/ সব কিছু নিয়ে নিউজ করতে নেই)- বুকে এসে তীর বিঁধে যাবার মত শক্তিশালী কিছু সংলাপ ও গান লেখার জন্য পরিচালককে অশেষ ধন্যবাদ।
‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’-এর প্রতিটি গান কালোত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা রাখে। বেজবাবা সুমনের ‘প্রথম’ বা সৌরীনের ‘এ শহর’, সোমলতার ‘যেখানে’ বা পরিচালকের গাওয়া ‘মেঘমালা’-গল্পের খাতিরে প্রতিটি গান এসেছে। ‘চিবুক’ গানটিও অনলাইনে শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মূল সিনেমায় পাইনি। তবে হতাশও হইনি। ঘোরের মাঝে ছিলাম। ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরও ঘোর থেকে বের হতে চাইনি। তবে একটি কথা না বললেই নয়, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’-এর এত প্রশংসা, এত স্তুতি সব ম্লান হয়ে যেত, যদি এ ছবির অভিনয়শিল্পীরা ব্যর্থ হতেন।
অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ ছবির নায়ক দুজন: বর্ষণ ও শার্লিন। আলাদাভাবে দুজন যেমন উজ্জ্বল, তেমনি তাদের জুটির রসায়নও মনের কোণে সজোরে ধাক্কা দেয়। খুব ইচ্ছে করে অয়নের মতো ভালো মানুষ হয়ে প্রেম করতে। আর নীরা তো যে কোনও পুরুষের জন্যই আদর্শ প্রেমিকা। শার্লিন ফারজানাকে নিয়ে যতটুকু বলা হবে, ততটুকুই কম হবে। শার্লিনের আত্মায় জীবন্ত হওয়া নীরার সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের সফল নারী চরিত্রের মধ্যে একটি হয়ে থাকবে। এই চরিত্রে শার্লিনের অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, পোশাক ও সাজ- সর্বোপরি নান্দনিক সৌন্দর্যে দর্শক মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। শেষ দিকের দৃশ্যে যখন অয়নের কপালে নীরা চুমু খায়- শুধুমাত্র এই একটি মাত্র অভিব্যক্তির জন্য শার্লিন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেতেই পারেন।
ইমতিয়াজ বর্ষণ বাংলা চলচ্চিত্রে মধুর সংযোজন। শার্লিনের মতো বর্ষণও অধিকাংশ দৃশ্যে চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন। এই চরিত্রে নতুন একজন অভিনয়শিল্পীকে নির্বাচন করার জন্য পরিচালককে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। বর্ষণ সুদর্শন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অথচ স্বল্পভাষী। এমন ধরনের নায়ককে বাংলা চলচ্চিত্রে এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আমি নিশ্চিত, কলকাতার চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এই অভিনেতার মাঝে অপার সম্ভাবনা খুঁজে পাবেন।
পার্শ্ব চরিত্রগুলোর প্রায় প্রত্যেকেই গল্পে আলো ফেলেছেন। বিশেষ করে খাইরুল বাশার ও ইকবাল (অন্ধ কিশোরের বাবা) মুগ্ধ করেছেন। চিড়িয়াখানার দৃশ্যগুলোতে আমার চোখ ভিজে গিয়েছে। যেমন ভিজেছে বুক ভরা চাপা কান্না নিয়ে আয়নার সামনে নীরার সাজ দেখে। মা’কে জড়িয়ে ধরা দেখে। কাবিননামা দেখে। অসহায় এক মায়ের আর্তি দেখে। কিশোরের বুকে নীরার হৃদস্পন্দন শোনার আকুতি দেখে! চিত্রগ্রাহক হৃদয় সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ আমাদের চোখে আরাম দেবার জন্য। আবহ সংগীত এ ছবির অন্যতম অলংকার। শিল্প নির্দেশনা, রঙ বিন্যাস, মেকআপ, পোশাক পরিকল্পনা, আলোকসম্পাত-প্রশংসনীয়, হাত তালি পাবার মতো।
যদিও চাইলে ভালোর পিঠে মন্দ দিকগুলিও তুলে আনা যাবে। শার্লিন-বর্ষণের বেশ কিছু সংলাপ আমরা অনেকেই শুনতে পারিনি। সিনেমা হলের শব্দ কমিয়ে রাখা হয়েছিল নাকি তারা আসলেই এতটা মৃদু স্বরে কথা বলেছেন, বুঝতে পারিনি। জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মা-বাবার সাথে নীরার একটি দৃশ্য দেখতে পেলে ভালো লাগতো। অয়নের পরিবার বা তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতে পারলে ভালো লাগতো। চর্বি ফেলে ছবির দৈর্ঘ্য ১০-১৫ মিনিট কমিয়ে আনা হলে হয়তো আরও ভালো হতো। নীরার মায়ের চরিত্রে ইলোরা গহরের অভিনয় কিছুটা কৃত্রিম মনে হয়েছে।
শেষ কথা: যোগ-বিয়োগের সমীকরণে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ শুধু এ বছরেরই নয়, দীর্ঘদিন পর বাংলা চলচ্চিত্রের ঝুলিতে একটি সফল সংযোজন। হিট-ফ্লপের ব্র্যাকেটের ঊর্ধ্বে গর্ব করার মতো একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। এই গর্ব ছবি সংশ্লিষ্টদের, এই গর্ব দর্শকদের। নতুন নায়ক-নায়িকা, গল্প বলার নতুন তরিকা কিংবা নতুন স্বাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে পাগলামি করেছেন এরজন্য নির্মাতা-প্রযোজকদের মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। দেশীয় চলচ্চিত্রে এ মুহূর্তে এরকম আরও কয়েকটি ধারাবাহিক পাগলামির খুব প্রয়োজন।