দেশে করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এরই মধ্যে অনেকে প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন। তবে টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করার পর বেশ কিছু ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। এ বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন অনেকে। তাহলে কি করোনার টিকা তাঁদের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি?
করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার অন্তত ১৪ দিনের মধ্যে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না, তাই টিকা নেওয়ার পরই নিজেকে যথেষ্ট সুরক্ষিত ও নিরাপদ মনে করার কোনো কারণ নেই। এই সময়ের পর অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হয়, ধাপে ধাপে বাড়ে আর দ্বিতীয় ডোজটি গ্রহণ করতে হয় ৪ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে দুটি ডোজ নেওয়ার পর এর কার্যকারিতা ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ। এতে ব্যক্তিভেদ আছে। মানে সবারই একই মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি হবে তা নয়। আর ৮০ বা ৯০ শতাংশ ধরে নেওয়া হলেও বাকি ১০ থেকে ২০ শতাংশ ঝুঁকি কিন্তু রয়েই যায়। তাই করোনার টিকা নিলে কখনোই আর করোনা হবে না, এই ভাবনা অমূলক।
টিকা নিয়ে লাভ কী
যদি করোনা হয়ই, তবে টিকা নিয়ে লাভ কী! এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে টিকা নেওয়ার পর করোনা হলেও তার তীব্রতা বা জটিলতার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টিকা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ার পর ভাইরাসের ট্রান্সমিসিবিলিটি বা চলাচল, একে অপরকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি কমতে শুরু করেছে। এটি হাসিল হয় হার্ড ইমিউনিটি সৃষ্টি করার মাধ্যমে। জনসাধারণের ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার পরই কেবল তা সম্ভব। তখন ভাইরাস প্রকৃতি থেকে বিনাশ হয়ে না গেলেও তা মানুষের মধ্যে তীব্র রোগ বা মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারবে না। বিশ্বজুড়ে টিকা কার্যক্রমের এটাই মূল উদ্দেশ্য।
এ ছাড়া আরেকটি কথা আছে। কেউ টিকা গ্রহণ করার অব্যবহিত আগে বা পরে ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন কি না, তা বোঝার উপায় সীমিত। সে ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার পরপরই কারও উপসর্গ দেখা দিতে পারে। টিকায় জীবিত ভাইরাস ব্যবহৃত হয়নি, ব্যবহৃত হয়েছে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের অংশবিশেষ, তাই টিকা নিজে সংক্রমণ করতে অক্ষম। সংক্রমণ বা রোগ সৃষ্টি করতে হলে মানবদেহে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করতে হবে, যা জীবিত ভাইরাসই কেবল করতে পারবে।
কী করবেন
করোনার টিকার প্রথম ডোজ দিয়েই অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানা ছেড়ে দিয়েছেন। মাস্ক ব্যবহারে, সামাজিক দূরত্ব পালনে বা হাত ধোয়ায় এসেছে শিথিলতা। গত কিছুদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ পর্যটন করছেন, সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব পালন করছেন, রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছেন কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি প্রায় না মেনেই। এমনটা করা চলবে না।
এমনকি দুটি ডোজ সম্পূর্ণ করার পরও বিশ্বে ঠিক কত দিন করোনা মহামারি থাকবে, সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্তত আগামী দুই বছর পৃথিবীর মানুষকে সব স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে।
এই সময়ের মধ্যে যত বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে, ততই মঙ্গল। তত দ্রুতই আমরা হার্ড ইমিউনিটির পথে অগ্রসর হতে পারব। তার আগপর্যন্ত আপনি টিকা নিলেও পুরোপুরি নিরাপদ নন।
তাই মাস্ক এখনই খুলে ফেলবেন না। ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে যদি আপনার বয়স বেশি হয় বা আপনার অন্যান্য আনুষঙ্গিক রোগ থাকে। সামাজিক অনুষ্ঠান–উৎসব সীমিত আকারে পালন করুন। বারবার হাত ধোয়া বা হাঁচি–কাশির আদবকেতা মেনে চলুন। কারও জ্বর বা উপসর্গ হলে আইসোলেশন বজায় রাখুন। টিকা দিতে যাওয়ার সময়ও এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। কারণ, টিকাকেন্দ্রেও জনসমাগম হতে পারে।
টিকা দেওয়ার পরও যেহেতু শতভাগ নিরাপদ নন, তাই টিকা নেওয়ার পর করোনার উপসর্গ দেখা দিলে করোনার পরীক্ষা করতে হবে ও দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* ডা. আবদুস শাকুর খান | বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, ট্রেজারার, বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন, ঢাকা