দেখা বাসে উঠতে গিয়ে। বাড়িয়ে দেওয়া হাতের সেই হ্যাঁচকা টানটাই বদলে যায় অমলিন বন্ধুতার হ্যান্ডশেকে। যেচে শুরু আলাপের, গড়ায় অন্তরঙ্গতায়। জীবন রসে টইটম্বুর, জীবনকে উদ্যাপন করতে জানা মেয়েটিই একদিন ভোজবাজির মতোই উড়ে যায়। ফিরে যায় তার দেশে; অন্য বেশে। চারপাশে ছড়িয়ে অসংখ্য স্মৃতি আর সম্পর্কের পালক।
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
আগের পর্বের পর...
৪
দেখতে দেখতে বন্ধু হওয়ার বদলে ভক্ত বনে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়ার বড় স্ক্রিনে ক্যাম্পাসের খবর ফলাও করে ঘুরপাক খায়। তাতে জিসেলের ছবি ভাসে নিত্যদিন। কখনো কনফারেন্সে প্রাইজ নিচ্ছে, কখনোবা স্টুডেন্ট ইলেকশনে জিতে হাত নাড়ছে। ক্যাম্পাসের তুমুল হ্যাপেনিং লেডি। একনামে সবাই চেনে। এমন মেয়ের ভক্ত না হয়ে উপায় নেই।
তবে মাঝেমধ্যে স্ক্রিন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে জিসেল। মাঝশরতের শেষ বিকেল। ক্যাম্পাসে বারবিকিউ পার্টি। পুরোটা গ্রীষ্ম গেল, কোনো খবর নেই। অথচ এই আসি আসি শীতে কি না বারবিকিউ। তা–ও আবার হলিউডি সিনেমায় বিদেশি ছেলেমেয়েদের যেমন হইহুল্লোড় দেখা যায়, অমনটা নয়। কাগজের প্লেটে গ্রিল করা সসেজ আর প্লাস্টিক কাপে বিয়ার নিয়ে যে যার মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসে নিচু স্বরে গল্প করছে। আমিও একটা পোড়ানো ভুট্টার ওপর মাখন ছেড়ে দিয়ে এ্যায়সা কামড় বসিয়েছি। মুখে পুরে মনটাই বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে হালুম করে কে যেন ঘাড়ে এসে পড়ল। ‘হেই! কোনায় দাঁড়িয়ে কি খাচ্ছ ওটা? হাপুস–হুপুস খেয়ে গেলেই হবে? বাতচিত করতে হবে না?’ মুখ তুলে দেখি জিসেল। লম্বা ঝুলের কমলা ফ্রকে তাকে পড়ন্ত রোদের আলোর মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। প্রাণখোলা হাসিতে হ্যাঁচকা টানে আমাকে উঠিয়ে ছাড়ল ঘাসের আসন থেকে।
‘সামনের নভেম্বরে সায়েন্স স্ল্যাম হবে। নাম দিয়েছি। আসবে কিন্তু।’ কথা আদায়ের ভঙ্গিতে তাকাল জিসেল। সায়েন্স স্ল্যামটা কী বস্তু, সেটা না বুঝেই একটা হ্যাঁ বলে দিলাম। ‘জিসেল, একসঙ্গে এত কিছু করো কী করে, বলো তো? আমার তো সকাল-সন্ধ্যা এক ল্যাবের কাজ করেই জান বেরিয়ে যায়, ফিউউউহহ্!’
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
এক হাতে তুড়ি মেরে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল মেয়েটা, ‘তোমার কি মনে হয়ে দেশ ছেড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এত দূর এসেছি কেবল পড়াশোনা আর ডিগ্রি-ফিগ্রি করতে? ছোহ্! আমি এসেছি সব জিতে নিতে। যত কম্পিটিশন-কনফারেন্স আছে, সবটায় নাম লেখাব। হারি-জিতি ব্যাপার না। কিন্তু লড়তে দারুণ লাগে।’ শুনে আমারও দারুণ লাগল। জিসেলের কথাগুলোতে যে পরিমাণ স্পিরিট আছে, টেবিলের ওপর রাখা বিয়ারের জগেও অত স্পিরিট নেই।
৫
ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে চারটায় হাজির হলাম। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় সেমিনার হল। আসনগুলো কলোসিয়ামের আদলে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। সায়েন্স স্ল্যামের আসর শুরু হবে এক্ষুনি। লাল-নীল ডিস্কো বাতি লাগানো হয়েছে। বেশ সাজ সাজ রব। প্রথম প্রতিযোগী এল। কাজটা কঠিন। ১০ মিনিটের ভেতর যার যার গবেষণার খটোমটো জটিল বিষয় পানির মতো সরল ভাষায় বলে যেতে হবে। শুধু সরল হলে হবে না, সরসও হতে হবে।
রসের অবশ্য অভাব হলো না। তুখোড় সব উপস্থাপনায় তাক লেগে যাচ্ছে একের পর এক। অবশেষে তিনজনের পর জিসেল এল। টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল ছবির থিম মিউজিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেড়ে আপ ফ্রন্টে সে কি সব আউড়ে গেল, আর লোকেরা এর ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে হাসতে লাগল। সুদূর হন্ডুরাসের মেয়ের মিশন ‘সায়েন্স স্ল্যাম’ এক্কেবারে পসিবল হয়ে ছাড়ল। তুমুল হাততালির ভেতর সেরা তিনের ট্রফিটা হাতে উঁচিয়ে চওড়া হাসিতে মঞ্চ মাতিয়ে হাসছে জিসেল। সামনের সারিতে বসে আমিও পাঁড় ভক্তের মতো হাত নাড়ছি। এই মেয়েটা আসলেই অন্য ধাতুতে গড়া।
৬
সকাল সকাল কাজ শুরু করেছি আজ। ‘শুনেছ খবরটা?’ কারিনের কথায় হাতের খাতাটা টেবিলে নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কারিন আর আমি একই ল্যাবের। ‘জিসেল নামের মেয়েটাকে চেনো তো?’ মনে মনে বলি, ‘তা আর বলতে!’ মুখে বললাম, ‘সে আবার নতুন কোনো প্রাইজ জিতেছে, তাই তো?’ কারিন সামান্য ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বলে গেল, ‘না মানে জিসেল আর নেই। কালকে রাতের ঘটনা। লাং এম্বলিজম কেস। বাঁচানো যায়নি।’
স্তব্ধ, হতভম্ব হয়ে গেলাম। লাং এম্বলিজমের মানে কী, তা জীববিজ্ঞানের ছাত্র আমাকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। রক্ত জমাট বেঁধে ফুসফুসের ধমনি আটকে নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে জিসেলের। খবরটা শুনে আমারও নিশ্বাস আটকে আসার জোগাড়। এমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত মেয়েটা অমন ঠুস করে মরে গেল? মানতেই পারছি না। আরও কিছু জানতে চাইব বলে মুখ খুললাম। তার আগেই কারিন হাত নাড়াল, ‘আর কিছু জানি না বাপু। কাজ আছে। যাই গে।’
জীবিত লোক দিয়ে কাজ হয়, গবেষণা চলে, সব হয়। কিন্তু মরে গেলে সে লোক বড়ই অপ্রয়োজনীয় জড়বস্তুতে পাল্টে যায়। তাকে নিয়ে কথা বলাও বাতুলতা। তাই বাজে বকা এড়াতে দায়সারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে পড়ল কারিন। শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হাতের খাতাটা কখন যে ছিটকে পড়ে টেবিলের নিচে পালিয়েছে, খেয়ালও হলো না। বজ্রাহত হলেও বুঝি লোকে জমে এমন কাঠ হয়ে যায় না।
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
কিন্তু না। জিসেল চলে গিয়েও গেল না। বাক্সবন্দী হয়ে হাসপাতালের মর্গে শুয়ে থাকল দিব্যি হাত ভাঁজ করে। তার যাওয়া আটকে গেছে। জার্মানি থেকে কফিন তার দেশ হন্ডুরাসে নিতে ম্যালা খরচ। প্রায় হাজার দশেক ইউরো। বাংলা টাকায় লাখ দশেক। পড়তে আসা বিদেশি ছাত্রের ব্যাংকে এত পয়সা থাকে না। শুনলাম জিসেলের পরিবারও তেমন সচ্ছল না। মেয়েকে বাড়ি আনার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাকি রইল এই হেমহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার। তাদের মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হয়ে ধরা দিল না।
দায়টা হাত ঘুরে শেষমেশ জিসেলের ল্যাবের কলিগদের ঘাড়েই বর্তাল। তারা রোজ রোজ ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় টেবিল পেতে বসে থাকে। আমরা যে যা পারলাম দিয়ে দিলাম পকেট উজাড় করে। কারিনকেও দেখলাম অবলীলায় অনেকগুলো নোট ঢুকিয়ে দিল ওদের টিনের কৌটায়।
সপ্তাহখানেক পর। সময়ের সঙ্গে শোক শুকিয়ে যায় অনেকটাই। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ল্যাবে ঢুকেছি। কারিন থামাল হঠাৎ। ‘আজকে জিসেলের ফ্লাইট’। বলেই সে স্বভাবসুলভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ কানে এল। এক দৌড়ে জানালার কাছে চলে এলাম। বিচিত্র অস্থিরতা কাজ করছে। নাহ্, তাজা বাতাস দরকার।
ক্যাম্পাসের বড় মাঠের একধারে বসেছি। তাজা হাওয়ার কানাকানি। তবু যেন বুকভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। আরও একটা–দুটো প্লেন উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। কে জানে তার কোনটায় চেপে জিসেল দেশে ফিরছে। আহা, বাক্সে করে হলেও মেয়েটা বাড়ি ফিরুক।
আকাশের নীল থেকে চোখ নামিয়ে ঘাসের সবুজে দৃষ্টি ছুঁড়লাম। নিমেষেই যেন ঘাসগুলো ঢেকে গেল নরম তুষারে। অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠল। তুষার মাড়িয়ে লাল শাল উড়িয়ে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে জিসেল। আর তার প্রাণখোলা হাসিটা যেন তরঙ্গ তুলে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে তেপান্তরের আনাচকানাচে। (শেষ)
* লেখক: রিম সাবরিনা জাহান সরকার | পোস্টডক্টরাল গবেষক; ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
আগের পর্বের পর...
৪
দেখতে দেখতে বন্ধু হওয়ার বদলে ভক্ত বনে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়ার বড় স্ক্রিনে ক্যাম্পাসের খবর ফলাও করে ঘুরপাক খায়। তাতে জিসেলের ছবি ভাসে নিত্যদিন। কখনো কনফারেন্সে প্রাইজ নিচ্ছে, কখনোবা স্টুডেন্ট ইলেকশনে জিতে হাত নাড়ছে। ক্যাম্পাসের তুমুল হ্যাপেনিং লেডি। একনামে সবাই চেনে। এমন মেয়ের ভক্ত না হয়ে উপায় নেই।
তবে মাঝেমধ্যে স্ক্রিন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে জিসেল। মাঝশরতের শেষ বিকেল। ক্যাম্পাসে বারবিকিউ পার্টি। পুরোটা গ্রীষ্ম গেল, কোনো খবর নেই। অথচ এই আসি আসি শীতে কি না বারবিকিউ। তা–ও আবার হলিউডি সিনেমায় বিদেশি ছেলেমেয়েদের যেমন হইহুল্লোড় দেখা যায়, অমনটা নয়। কাগজের প্লেটে গ্রিল করা সসেজ আর প্লাস্টিক কাপে বিয়ার নিয়ে যে যার মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসে নিচু স্বরে গল্প করছে। আমিও একটা পোড়ানো ভুট্টার ওপর মাখন ছেড়ে দিয়ে এ্যায়সা কামড় বসিয়েছি। মুখে পুরে মনটাই বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে হালুম করে কে যেন ঘাড়ে এসে পড়ল। ‘হেই! কোনায় দাঁড়িয়ে কি খাচ্ছ ওটা? হাপুস–হুপুস খেয়ে গেলেই হবে? বাতচিত করতে হবে না?’ মুখ তুলে দেখি জিসেল। লম্বা ঝুলের কমলা ফ্রকে তাকে পড়ন্ত রোদের আলোর মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। প্রাণখোলা হাসিতে হ্যাঁচকা টানে আমাকে উঠিয়ে ছাড়ল ঘাসের আসন থেকে।
‘সামনের নভেম্বরে সায়েন্স স্ল্যাম হবে। নাম দিয়েছি। আসবে কিন্তু।’ কথা আদায়ের ভঙ্গিতে তাকাল জিসেল। সায়েন্স স্ল্যামটা কী বস্তু, সেটা না বুঝেই একটা হ্যাঁ বলে দিলাম। ‘জিসেল, একসঙ্গে এত কিছু করো কী করে, বলো তো? আমার তো সকাল-সন্ধ্যা এক ল্যাবের কাজ করেই জান বেরিয়ে যায়, ফিউউউহহ্!’
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
এক হাতে তুড়ি মেরে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল মেয়েটা, ‘তোমার কি মনে হয়ে দেশ ছেড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এত দূর এসেছি কেবল পড়াশোনা আর ডিগ্রি-ফিগ্রি করতে? ছোহ্! আমি এসেছি সব জিতে নিতে। যত কম্পিটিশন-কনফারেন্স আছে, সবটায় নাম লেখাব। হারি-জিতি ব্যাপার না। কিন্তু লড়তে দারুণ লাগে।’ শুনে আমারও দারুণ লাগল। জিসেলের কথাগুলোতে যে পরিমাণ স্পিরিট আছে, টেবিলের ওপর রাখা বিয়ারের জগেও অত স্পিরিট নেই।
৫
ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে চারটায় হাজির হলাম। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় সেমিনার হল। আসনগুলো কলোসিয়ামের আদলে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। সায়েন্স স্ল্যামের আসর শুরু হবে এক্ষুনি। লাল-নীল ডিস্কো বাতি লাগানো হয়েছে। বেশ সাজ সাজ রব। প্রথম প্রতিযোগী এল। কাজটা কঠিন। ১০ মিনিটের ভেতর যার যার গবেষণার খটোমটো জটিল বিষয় পানির মতো সরল ভাষায় বলে যেতে হবে। শুধু সরল হলে হবে না, সরসও হতে হবে।
রসের অবশ্য অভাব হলো না। তুখোড় সব উপস্থাপনায় তাক লেগে যাচ্ছে একের পর এক। অবশেষে তিনজনের পর জিসেল এল। টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল ছবির থিম মিউজিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেড়ে আপ ফ্রন্টে সে কি সব আউড়ে গেল, আর লোকেরা এর ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে হাসতে লাগল। সুদূর হন্ডুরাসের মেয়ের মিশন ‘সায়েন্স স্ল্যাম’ এক্কেবারে পসিবল হয়ে ছাড়ল। তুমুল হাততালির ভেতর সেরা তিনের ট্রফিটা হাতে উঁচিয়ে চওড়া হাসিতে মঞ্চ মাতিয়ে হাসছে জিসেল। সামনের সারিতে বসে আমিও পাঁড় ভক্তের মতো হাত নাড়ছি। এই মেয়েটা আসলেই অন্য ধাতুতে গড়া।
৬
সকাল সকাল কাজ শুরু করেছি আজ। ‘শুনেছ খবরটা?’ কারিনের কথায় হাতের খাতাটা টেবিলে নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কারিন আর আমি একই ল্যাবের। ‘জিসেল নামের মেয়েটাকে চেনো তো?’ মনে মনে বলি, ‘তা আর বলতে!’ মুখে বললাম, ‘সে আবার নতুন কোনো প্রাইজ জিতেছে, তাই তো?’ কারিন সামান্য ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বলে গেল, ‘না মানে জিসেল আর নেই। কালকে রাতের ঘটনা। লাং এম্বলিজম কেস। বাঁচানো যায়নি।’
স্তব্ধ, হতভম্ব হয়ে গেলাম। লাং এম্বলিজমের মানে কী, তা জীববিজ্ঞানের ছাত্র আমাকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। রক্ত জমাট বেঁধে ফুসফুসের ধমনি আটকে নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে জিসেলের। খবরটা শুনে আমারও নিশ্বাস আটকে আসার জোগাড়। এমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত মেয়েটা অমন ঠুস করে মরে গেল? মানতেই পারছি না। আরও কিছু জানতে চাইব বলে মুখ খুললাম। তার আগেই কারিন হাত নাড়াল, ‘আর কিছু জানি না বাপু। কাজ আছে। যাই গে।’
জীবিত লোক দিয়ে কাজ হয়, গবেষণা চলে, সব হয়। কিন্তু মরে গেলে সে লোক বড়ই অপ্রয়োজনীয় জড়বস্তুতে পাল্টে যায়। তাকে নিয়ে কথা বলাও বাতুলতা। তাই বাজে বকা এড়াতে দায়সারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে পড়ল কারিন। শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হাতের খাতাটা কখন যে ছিটকে পড়ে টেবিলের নিচে পালিয়েছে, খেয়ালও হলো না। বজ্রাহত হলেও বুঝি লোকে জমে এমন কাঠ হয়ে যায় না।
ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ
কিন্তু না। জিসেল চলে গিয়েও গেল না। বাক্সবন্দী হয়ে হাসপাতালের মর্গে শুয়ে থাকল দিব্যি হাত ভাঁজ করে। তার যাওয়া আটকে গেছে। জার্মানি থেকে কফিন তার দেশ হন্ডুরাসে নিতে ম্যালা খরচ। প্রায় হাজার দশেক ইউরো। বাংলা টাকায় লাখ দশেক। পড়তে আসা বিদেশি ছাত্রের ব্যাংকে এত পয়সা থাকে না। শুনলাম জিসেলের পরিবারও তেমন সচ্ছল না। মেয়েকে বাড়ি আনার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাকি রইল এই হেমহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার। তাদের মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হয়ে ধরা দিল না।
দায়টা হাত ঘুরে শেষমেশ জিসেলের ল্যাবের কলিগদের ঘাড়েই বর্তাল। তারা রোজ রোজ ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় টেবিল পেতে বসে থাকে। আমরা যে যা পারলাম দিয়ে দিলাম পকেট উজাড় করে। কারিনকেও দেখলাম অবলীলায় অনেকগুলো নোট ঢুকিয়ে দিল ওদের টিনের কৌটায়।
সপ্তাহখানেক পর। সময়ের সঙ্গে শোক শুকিয়ে যায় অনেকটাই। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ল্যাবে ঢুকেছি। কারিন থামাল হঠাৎ। ‘আজকে জিসেলের ফ্লাইট’। বলেই সে স্বভাবসুলভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ কানে এল। এক দৌড়ে জানালার কাছে চলে এলাম। বিচিত্র অস্থিরতা কাজ করছে। নাহ্, তাজা বাতাস দরকার।
ক্যাম্পাসের বড় মাঠের একধারে বসেছি। তাজা হাওয়ার কানাকানি। তবু যেন বুকভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। আরও একটা–দুটো প্লেন উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। কে জানে তার কোনটায় চেপে জিসেল দেশে ফিরছে। আহা, বাক্সে করে হলেও মেয়েটা বাড়ি ফিরুক।
আকাশের নীল থেকে চোখ নামিয়ে ঘাসের সবুজে দৃষ্টি ছুঁড়লাম। নিমেষেই যেন ঘাসগুলো ঢেকে গেল নরম তুষারে। অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠল। তুষার মাড়িয়ে লাল শাল উড়িয়ে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে জিসেল। আর তার প্রাণখোলা হাসিটা যেন তরঙ্গ তুলে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে তেপান্তরের আনাচকানাচে। (শেষ)
* লেখক: রিম সাবরিনা জাহান সরকার | পোস্টডক্টরাল গবেষক; ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি