What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected টেমস নদীর বাঁকে (1 Viewer)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
102
Messages
12,008
Credits
111,433
Calculator
Mosque
Calculator
LittleRed Car
LittleRed Car
LittleRed Car
প্রিয় লেখক ডাঃ আফতাব হোসেনের আরেকটি লেখা আপনাদের মাঝে নিয়ে আসলাম। এটা ভ্রমণ বিষয়ক একটি উপন্যাস। বরাবরের মতো এটাও আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।

আসুন তবে শুরু করি



টেমস নদীর বাঁকে

মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন



পর্ব-১ (লন্ডনের পথে)





ছাত্র জীবনে সেবা প্রকাশনীর বই পড়তাম খুব। বিশেষ করে মাসুদ রানা সিরিজের বই। বই কিনে পড়ার মতো সামর্থ্য হয়নি তখনও। পড়তাম ধার কর্জ করে। চেয়ে চিন্তে। কখনও সখনও চুরি চামারি করেও। কথায় বলে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার, ইন লাভ এন্ড ওয়ার। ভালোবাসার জন্য যদি সব করা জায়েজ হয়, তাহলে বইকে ভালোবেসে সেটা চুরি করলে দোষ হবে কেন ? তবে পড়তে পড়তে মাসুদ রানার চেয়ে গিলটি মিয়ার ভক্ত হয়ে গেলাম বেশি। এ জন্য নয়, যে সে খুব চালাক চতুর ছিল। এ জন্যও নয় যে, সে গুলি মেরে টিকটিকির ডিমও উড়িয়ে দিতে পারত। বরং এই জন্য যে, সেও আমার মতো ছোট খাটো আর শুকনা পটকা ছিল। কেন যে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলাম ? বসে বসে রুগী দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। লম্বায় বাড়ার তো কোনো চান্স ছিল না। তাই আড়ে দিকে বাড়তে থাকলাম। বাড়তে বাড়তে, ফুলতে ফুলতে, এক সময় গিলটি মিয়া থেকে গাবলু মিয়াঁ হয়ে গেলাম।

খাটো এবং মোটা, এই দুটোর কম্বিনেশন যে কতটা খারাপ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম প্লেন জার্নি করতে যেয়ে। ছোট ছোট সীট। ভালো মতো নড়াচড়াও করা যায় না। তার উপর খাটো বলে পা দুটো বিমানের মেঝে ছোঁয় না। খানিকটা উঁচুতে ঝুলে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে ফুলে যায়। ফুলতে ফুলতে নিজের জুতাকে ছেলের জুতা বলে মনে হয়। একবার বের হলে কোনমতেই আর ঢুকতে চায় না। শেষে গাও গেরামের মানুষের মতো, জুতো বগলে নিয়ে বিমান থেকে নামার অবস্থা ! এর আগে ইরান ও সৌদি আরবে গিয়েছি। চার পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট। কোনোমতে হাঁসফাঁস করে কাটিয়ে দিয়েছি। এবার ঢাকা টু লন্ডন, ডাইরেক্ট ফ্লাইট। বাংলাদেশ বিমান। ভাবলাম, গেট-লক সার্ভিসের মতো ফ্লাইট লক সার্ভিস। বিরতিহীন। কোথাও যাত্রী ওঠা নামার বালাই নাই। সোজা পৌঁছে যাবো ঢাকা থেকে লন্ডনে এক টানেই। তখন কে জানত, পুরা বারো ঘণ্টার জার্নি আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে ?

দেরী করে রওনা দেয়া, এবং দেরী করে পৌঁছানো, বাঙালি জাতির ঐতিহ্য। আর বাংলাদেশ বিমান তো জাতির পতাকা বহনকারী। জাতিয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যথারীতি তিন ঘণ্টা দেরী করে বিমান আকাশে উড়ল। এদিকে খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। আরও ঘণ্টা দেড়েক পর মধ্য বয়সী বিমান বালারা এসে গোমড়া মুখে রাতের খাবার পরিবেশন করা শুরু করল। যেন বিনা দাওয়াতে বিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছি। এখন অবশ্য বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো বেশ সুন্দরী, স্মার্ট, যুবতী মেয়েদের বিমান বালা হিসেবে নিয়োগ দেয়। আজ থেকে বিশ ত্রিশ বছর আগে, কোন যোগ্যতায় বাংলাদেশ বিমানে বিমান বালা নিয়োগ দেয়া হত, আমার জানা নেই। হয়ত যুবতী বয়সেই নিয়োগ পেত। কিন্তু লন্ডন গামী ফ্লাইটে সুযোগ পেতে পেতে তাঁদের যৌবনের সূর্য মধ্য গগণ পেরিয়ে যেত! তা না হয় গেল ! হাসতে তো আর বয়স লাগে না, পয়সাও লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশে যে সব মেয়েরা সেবার কাজে নিয়োজিত, হোক যে বিমান বালা, রিসেপশনিস্ট কিংবা নার্স, তাদের যেন হাসতে মানা। নাকি বাঙালি মেয়েদের ধারণা, মিষ্টি করে হাসলে যাত্রী, কাস্টোমার, রুগী, সবাই তাদের প্রেমে পড়ে যাবে?

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে অনেকেই সীটটাকে পিছনে হেলিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরার আয়োজন করল। বিনা নোটিশেই সামনের সীটটা ঝট করে আমার নাকের ডগার উপর চলে এলো। আর একটু হলেই গোবদা নাকটা আমার থ্যাবড়া হয়ে যেত ! বাধ্য হয়ে আমাকেও পিছনে সরতে হল। তা নাহয় সরলাম। কিন্তু পা দুটো নিয়ে কী করি ? ও দুটোকে তো আর টেনে লম্বা করা যাচ্ছে না। মেঝের নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। মোটা বলে পা গুটিয়ে বসব, তারও উপায় নেই। ইতিমধ্যে পা ভারি হতে শুরু করেছে। সাথে টনটনে ব্যথা। ইস, পা দুটো খুলে যদি কোলে নিয়ে বসতে পারতাম ! উঠে যে একটু হাঁটাহাঁটি করব, তাতেও ঝামেলা। উইন্ডো সীটে বসেছি। হাঁটতে গেলে দুজনকে টপকে যেতে হবে। কতবার এ ভাবে যাওয়া যায় ? জানি, বিমানের জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। তারপরও মানুষ উইন্ডো সীটেই বসতে চায়। আমিও তাঁর ব্যতিক্রম নই। যেন বিমানের খোলা জানালা দিয়ে মেঘেদের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে, তারাদের সাথে গল্প করতে করতে পথটা কাটিয়ে দেব! শুরু হল জীবনের দীর্ঘতম যাত্রা। অবশ্য এই অভিজ্ঞতার পর আর কোনোদিন আইল সীট ছাড়া বসিনি।

সব রাতই এক সময় ভোর হয়। এক সময় বাংলাদেশ বিমানও লন্ডনের আকাশে উদয় হল। কিন্তু বাঁধ সাধল অন্য খানে। পাইলট জানাল, অত্যধিক ট্রাফিকের কারণে ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের আরও কিছু সময় আকাশেই ভেসে থাকতে হবে। হা কপাল ! এতদিন ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম দেখেছি। এখন দেখছি লন্ডনের আকাশেও ট্রাফিক জ্যাম! হবেই বা না কেন? পরে জেনেছি, হিথরো এয়ারপোর্ট হল ইউরোপের ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৩ শো ফ্লাইট ল্যান্ড করে। ব্যস্ত সময়ে কখনও কখনও প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একটা করে বিমান নামে ! ভাগ্যিস, বিমানের পাইলটরা বাংলাদেশের ড্রাইভারদের মত না। নইলে এই ভিড়ের মধ্যে কে কার লেজে গুঁতা মেরে লেজে গোবরে পাকিয়ে ফেলত ! আর আমরাও বিলেতে নয়, সোজা স্বর্গে যেয়ে ল্যান্ড করতাম !

এতক্ষণে মনে হল, উইন্ডো সীটে বসার ফায়দাটা একটু নিই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, যেন এক গাঁদা ছাইয়ের মধ্যে প্লেনটা ডুবে আছে। ধূসর মেঘে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় আবার ঘোষণা হল, অত্যধিক তুষারপাতের কারণে জ্যাম আরও বেড়েছে। আজও মনে আছে, জানুয়ারির চার তারিখ ছিল সেদিন। ইংল্যান্ডে ভরা শীতের মৌসুম। মনে মনে শিহরিত হয়ে উঠলাম। এতদিন শুধু সিনেমাতেই লন্ডনের তুষারপাত দেখেছি। এবার স্বচক্ষে দেখব। সেই সাথে একটু শিউরেও উঠলাম। পাইলট ঠিকঠাক মতো ল্যান্ড করতে পারবে তো ?

চিলের মতো ঘণ্টা খানেক মেঘের রাজ্যে চক্কর কাটার পর শেষ পর্যন্ত আমরা সিরিয়াল পেলাম এবং নিরাপদে ল্যান্ডও করলাম। এই ফ্লাইটে প্রায় সবাই বাংলাদেশি। যদিও সবাই জানে, ল্যান্ড যখন একবার করেছে, তখন প্লেন থেকে সবাই বের হতে পারবে। তবু বাঙ্গালির যা স্বভাব, কে কার আগে নামবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ! খেয়াঘাটে কারোই দেরী সহ্য হয় না। আমারও না। কিন্তু উপায় নাই গোলাম হোসেন। আমি তখন আমার গদা মার্কা পা দু’খানা অতি সাধের কেনা টিম্বারল্যান্ডের হেভি ডিউটি জুতোর মধ্যে ঠেসেঠুসে ঢুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আরে, পা কি তুলোর বস্তা যে চাপ দিলেই নরম হয়ে ঢুকে যাবে ? যদিও বা শেষ পর্যন্ত ঢুকাতে পারলাম, দাঁড়াতে গেলেই পা দুটো বলে উঠল, এতক্ষণ গুঁতাগুঁতি যা করার করছ, কিছু কই নাই। ভর দেয়ার কথা চিন্তাও কইরো না। তোমার ঐ গদাই মোড়ল শরীরের ওজন আমি বইতে পারব না। বললাম, বাপ, আর একটু সহ্য কর। বিলাতে আইস্যা কি বয়াতী বংশের পোলার ইজ্জত খুয়াবি? বাসায় নিয়া তরে ভালো কইরা তেল মালিশ কইরা দিমুনে।

জোট সরকারের মতো পায়ের সাথে একটা দায়সারা গোছের সমঝোতা করে, কেবিন ট্রলিটা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্লেন থেকে বের হলাম। বের হয়েই তো চক্ষু চড়ক গাছ। যত দূর চোখ যায়, ততো দূর লম্বা করিডোর ! পিঁপড়ার মতো মানুষের সারি। পিলপিল করে যাচ্ছে একদিকে। শুনেছি, এই এয়ারপোর্টে গড়ে প্রতিদিন দুই লক্ষ লোক ওঠা নামা করে। খাইছে আমারে ! এক পা, দুই পা’ই হাঁটতে পারি না। এই লম্বা পুলসিরাত পাড়ি দিমু কেমনে ? অবাক কাণ্ড ! কিছু মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। আবার মানুষ দাঁড়িয়ে থেকেও যাচ্ছে। মানে কী ? এতক্ষণে খেয়াল করলাম, করিডোরের এক পাশে রেলিং দেয়া। তার ভেতর চলন্ত রাস্তা। অর্থাৎ একটা মুভিং বেল্ট। মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পরে শুনেছি, এর নাম, ট্রাভেলেটর। যাক বাঁচা গেল। কিছুক্ষণের জন্য পা দুটোর নখরামি সহ্য করতে হবে না। না হেঁটেও পৌঁছে যাব গন্তব্যে !

পথ যেন শেষই হতে চায় না। হা, খোদা! এ কোথায় নামাল আমাদের ? মতিঝিলের কথা বলে গাবতলি নামিয়ে দিল না তো ? নাকি বাংলাদেশ বিমান বলে এয়ারপোর্টের শেষ মাথায় নামাল? বাঙালির প্রতি এই অবহেলা দেখেছি প্রায় সব দেশেই। আর কত ? এক ধরণের রাগ আর জিদ চাপে মনের ভেতর। ব্যাটারা দুশো বছর আমাদের রক্ত চুষেছিস। যদি সুযোগ পাই, তোদেরও রক্ত চুষে ছাড়ব। খোদা বোধহয় সেদিন আমার কথা শুনেছিলেন। পরবর্তীতে অনেক ব্রিটিশের উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ হয়েছিল।

ইমিগ্রেশনে যেয়ে দেখি লাইন আরও লম্বা। ইউরোপিয়ানদের একদিকে, নন ইউরোপিয়ানদের আর একদিকে। ইউরোপিয়ানরা খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নন- ইউরোপিয়ানদের লাইন কচ্ছপের মতো এগুচ্ছে। একেক জনকে যে কত রকম প্রশ্ন করে। আরে বাবা, ভিসা দেয়ার সময় সওয়াল জওয়াব তো কম করো নাই। দাওয়াত দিয়া বাড়িতে আইনা এ ক্যামন ব্যবহার ? এক সময় আমার ডাক এলো। গাবদা গোবদা গোঁফ ওয়ালা এক মধ্য বয়সী ব্রিটিশ। বুঝলাম, আমার মতো বসে থেকে থেকে ওরও আমার মতো অবস্থা। সে একবার আমাকে দেখে, একবার পাসপোর্ট দেখে। আমি দু’চোখে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ সে গোঁফে তা দিয়ে বলল,

- আর ইউ আ ডক্টর ?

- ইয়েস।

- ওয়েলকাম টু দা ইউকে।

বলেই ঠকাস করে এন্ট্রি সিল মেরে দিল। ব্যাস, হয়ে গেল? তেলেসমাতি কাণ্ড ! ডাক্তার হলেই সাত খুন মাফ ? পরে জেনেছি, ব্যাটাদের দেশে ডাক্তারের খুব অভাব। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যেমন বুদ্ধি হবার পর থেকেই ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখে, ওরা তা দেখে না। ডাক্তারি পড়ার প্রতি ওদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই তো বিদেশী ডাক্তারের উপর নির্ভর করতে হয়। ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের এক তৃতীয়াংশ ডাক্তারই অন্য দেশ থেকে আসা।

লাগেজ বে’তে সারি সারি লাগেজ বেল্ট। ডিসপ্লে স্ক্রিনে দেখাচ্ছে কোন ফ্লাইটের লাগেজ কোন বেল্টে পাওয়া যাবে। সহজেই নির্দিষ্ট বেল্টটা খুঁজেও পেলাম। কিন্তু বেল্টে কোনো লাগেজ নেই ! বাংলাদেশে বেল্টে লাগেজ আসতে ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা লেগে যায়। তাই বলে বিশ্বের সর্বাধুনিক এয়ারপোর্টেও লাগেজ আসতে এত দেরী হবে ? হঠাৎ খটকা লাগল মনে। বেল্টের চারিদিকে তেমন কোনো বাংলাদেশীকে দেখতে পেলাম না। যারা আছে, তারা প্রায় সবাই সাদা চামড়া। ঠিক বেল্টে এসেছি তো ? প্রতিটা বেল্টের খাম্বার সাথে একটা ডিসপ্লে স্ক্রিন। তাকিয়ে দেখলাম, না, ঠিকই আছে। বিজি জিরো জিরো ওয়ান। তবে সাথে আরও একটা ফ্লাইট নম্বর। ধক করে ওঠে বুকের ভেতর। এমনিতেই ফ্লাইট থেকে দেরি করে নেমেছি। ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করতে করতে আরও ঘণ্টা খানেক লেগে গেছে। তাহলে কি কেউ আমার লাগেজ নিয়ে গেল ? ব্যাগ ভর্তি শীতের কাপড় চোপড়। বঙ্গ বাজার থেকে কেনা। শুনেছি, লন্ডনের তাপমাত্রা এখন শূন্যের কাছাকাছি। গরম কাপড় ছাড়া এই শীতে জমে সোজা বরফ হয়ে যাব। আর লন্ডনে কাপড় চোপড়ের যা দাম !

কাপড়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু বই ? মেডিকেলে ভর্তি হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত, যেখানেই গিয়েছি, বউ সাথে যাক বা না যাক, বই সাথে ঠিকই গিয়েছে। সে আমি পড়ি বা না পড়ি। সেই সব মোটা আর ভারি বই বইতে বইতে যাও আর একটু লম্বা হওয়ার কথা ছিল, তাও হওয়া হল না। এবারও সাথে করে মন দেড়েক উপর বই নিয়ে এসেছি। ভাগ্যিস, এয়ারপোর্টে একজন পরিচিত লোক ছিল। ওজন না করেই ট্যাগ লাগিয়ে বেল্টে তুলে দিল ! সে বই হারিয়ে গেলে তো আমার সারে সর্বনাশ ! সামনে কতগুলো পরীক্ষা। বই না পড়ে পরীক্ষা দেব কেমন করে ? ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। দেখে শুনে একজন এয়ারপোর্ট এটেন্ড্যান্টকে জিজ্ঞেস করলাম,

- ইজ ইট দা রাইট বেল্ট ফর বিজি জিরো জিরো ওয়ান ?

- ইয়াপ।

- বেল্টে লাগেজ আসা শুরু হয়নি এখনও ?

- হয়েছে এবং সবাই নিয়েও গেছে।

ব্যাটা কয় কী? নিয়ে গেছে মানে কী ? তাইলে আমারগুলা কই ? কাঁদো কাঁদো গলায় জিগাইলাম,

- ছার, আমার লাগেজ তো এখনও নিই নাই !

আমার গলায় বাংলা ‘ছার’ শুনেই হোক, কিংবা আমার রক্তশূন্য চেহারা দেখেই হোক, লোকটার মনে দয়া হল। আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

- ডোন্ট ওরি। কাম উইথ মি।

বলে ছ’ ফুটের উপর লম্বা মানুষটা আমাকে অনেকটা বগলদাবা করে নিয়ে গেল বেল্টের গোঁড়ার দিকে। দেখলাম, বেশ কিছু লাগেজ স্তূপাকারে পড়ে আছে অবহেলায়। চোখ নাচিয়ে বলল,

- হেয়ার ইউ গো। অল লেফট লাগেজেজ আর ডাম্পড হিয়ার।

একটু অবাক হলাম। লোকটা কষ্ট করে আমার সাথে না এলেও পারত ! আমাদের দেশের মতো দূর থেকেই “ওই হোথা” বলে দেখিয়ে দিলেও পারত ! দেখলাম, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চারা যেমন গলাগলি ধরে বসে থাকে, আমার লাগেজগুলোও তেমনই একই জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। বুঝলাম, যে এয়ারপোর্টে প্রতি মিনিটে একটা করে ফ্লাইট ল্যান্ড করে, সেখানে বেল্টের নাগরদোলায় বাক্স পেটরার ঘণ্টা খানেক ধরে দোল খাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। মালিক সময় মতো নামিয়ে না নিলে ওরাই কান ধরে নামিয়ে রেখে দেয় এক কোনায়!

আমার কোনো কিছু ডিক্লেয়ার করার নাই। তাই, গ্রিন চ্যানেল দিয়েই বের হলাম। দেখলাম, পথের এক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাস্টমস অফিসাররা। শ্যেন দৃষ্টিতে মাপছে সবাইকে। একটু সন্দেহ হলেই ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অন্য পাশে তাকাতেই গলা শুকিয়ে তক্তা হয়ে গেল ! সাদা কালো পোশাক পরে, ঘাড়ে ভারি অস্ত্র নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু পুলিশ। না, আমি ক্রিমিনাল নই। পুলিশকে ভয়ও পাই না। ভয় পেলাম অন্য কিছু দেখে। প্রত্যেক পুলিশের হাতেই শিকল দিয়ে বাঁধা ভাল্লুকের মতো সাইজের এক একটা কুকুর। এত্তো বড় কুত্তা বাপের জন্মেও দেখি নাই। কী বীভৎস তাদের চেহারা। মুখটা এবড়ো থেবড়ো। যেন জন্মের পর হাতুড়ী মেরে কেউ থেঁতলে দিয়েছে। দশ আঙ্গুল জিভ বের করে জুলু জুলু চোখে দেখছে আমাকে। যেন ছেড়ে দিলেই এক লাফে এসে আমার কল্লাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। আমি কি শিয়াল প্রজাতির কেউ যে অমন লোভী দৃষ্টিতে দেখতে হবে ? ছেলেবেলায় কুত্তার কামড়ের কথা ভুলিনি আজও। সেই থেকে জমের মতো ভয় পাই ওদের। আমার হাত পা ভারি হয়ে গেল। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ডাঙ্গায় তোলা টাকি মাছের মতো লাফাতে শুরু করল। অতি ভদ্র ব্রিটিশ জাতির এ কেমন অভদ্র অভ্যর্থনা ? পরে শুনেছি, ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। কারও লাগেজে ড্রাগ আছে কিনা তা দূর থেকেই শুঁকে বুঝতে পারে। আমি ওদের চোখের দিকে আর না তাকিয়ে গুঁটি গুঁটি পায়ে এগুতে থাকলাম।

পঞ্চাশ গজের মতো পথ। মনে হল, ওইটুকু পথ পেরুতেই আমার পঞ্চাশ বছর লেগে গেল। বাইরে বেরুতেই শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেল ! আমি চোখ বন্ধ করে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলাম।
 
টেমস নদীর বাঁকে


পর্ব-২ ((টিউব - লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড)




বাক্স পেঁটরা নিয়ে এরাইভাল লাউঞ্জে এসে দেখি, লোকে লোকারণ্য। আমাদের দেশে যেমন একজনকে বরণ করতে দশ জন এয়ারপোর্টে হাজির হয়, ব্রিটিশরাও বুঝি তার ব্যতিক্রম নয়। এত মানুষের ভিড়ে রফিক ভাইয়ের মুখ আমি কী ভাবে খুঁজে পাব ? সাথে ফোনও নাই যে জানান দেব। একমাত্র উপায়, যদি সে আমাকে খুঁজে পায় ! আর কাউকে চিনিও না। তার ঠিকানাও জানি না। মেইল করে জানিয়েছিলাম, আমার আসার কথা। উত্তরে ছোট্ট জবাব এসেছিল, চিন্তা করবেন না, আমি হাজির থাকব এয়ারপোর্টে। এত কথা বলা লোকটা ব্রিটেনে এসে এত স্বল্পভাষী হয়ে গেল ?

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পরিচয় সৌদি আরবে বসে। আমি ততদিনে ইরানের পাট চুকিয়ে বছর সৌদি আরবে এসেছি। জেদ্দার একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরী করি। একদিন ছেলের স্কুলে যেয়ে শুনলাম, একজন নতুন টিচার এসেছেন। খুলনায় বাড়ি। আমার জন্ম বরিশালে হলেও শ্বশুর বাড়ি খুলনায়। সেই সুবাদে খুলনার মানুষের প্রতি একটু বিশেষ টান আমার। তার উপর ছেলের স্কুলের টিচার। দেখা করলাম। প্রথম দেখাতেই মানুষটাকে ভালো লেগে গেল। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। হরলাল রায়ের ব্যাকরণের ভাষায় কথা বলেন।

বউয়ের দেশের মানুষ বলে পারিবারিক সম্পর্ক হতেও দেরি লাগল না। মানুষটার মন কাশবনের মতোই সাদা। অসম্ভব মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ অনার্সে ফার্স্ট হয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন, বাংলার অক্সফোর্ড, ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার হবেন। তাই মাস্টার্সে সাবজেক্ট হিসেবে এডুকেশন নিয়েছিলেন এবং আবারও ফার্স্ট হলেন। যোগ্যতায় স্বপ্ন পূরণের দুয়ারে পৌঁছে গেলেও বাঁধ সাধল অন্য খানে। ইন্টার্ভিউ বোর্ডের এক প্রফেসর তাঁকে আগে থেকেই রাজত্বের সাথে রাজকন্যা প্রাপ্তির একটা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। সহজ সরল মানুষটা সে ইঙ্গিত বুঝেও না বোঝার ভান করে বোকামি করে ফেললেন। ফলে বাংলাদেশে যা হবার তাই হল। আর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জামাইয়ের আদরে চাকরি করা হল না। তাঁকে অবশ্য দোষও দেয়া যায়না। তাঁর ভয়ঙ্কর রূপবতী স্ত্রীকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না, ভার্সিটির চাকরী তো দূরের কথা, রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের মতো সিংহাসনও ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করতেন না !

ভদ্রলোকের জেদ চেপে গিয়েছিল। বাংলার অক্সফোর্ডে যখন হল না, খোদ অক্সফোর্ডেরই শিক্ষক হবেন। তিনি দেশ ত্যাগ করলেন। জেদ্দায় বাংলাদেশ স্কুল এন্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক হয়ে এলেন। কারণ, সৌদি আরব থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়া সহজ। মানুষ যদি স্বপ্ন দেখতে জানে, আর সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে যদি হাল ছেড়ে না দেয়, তাহলে একদিন ঠিকই পৌঁছে যাওয়া যায় সেই স্বপ্নের ঠিকানায়।

স্বপ্ন দেখা আর হাল ছেড়ে না দেয়ার শিক্ষা আমিও আব্বার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। সপ্তায় আটচল্লিশ টাকা বেতনে চাকরি করা জুটমিলের একজন শ্রমিক স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে একদিন ডাক্তার হবে। শুধু ডাক্তার নয়, রীতিমত বিলেত ফেরত ডাক্তার হবে। আমাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন তিনি ঠিকই পূরণ করেছিলেন। কিন্তু বিলেত ফেরত বানাবার আগেই নিজে ফেরত চলে গেলেন! যাবার আগে সদ্য পাশ করা একজন ইন্টার্র্নি ডাক্তারের কাঁধে দিয়ে গেলেন পুরা সংসারের ভার। আর হাতে দিয়ে গেলেন স্বপ্নে ভরা এক সিন্দুকের চাবি। তারপর এক যুগ চলে গেছে। সংসারের হাল ফেরাতে আমিও দেশ ছেড়ে ইরান। ইরান ছেড়ে সৌদি আরব এসেছি। কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা হারাইনি। মাঝে মাঝে খুলে স্বপ্নগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখি। ঝেড়ে মুছে রাখি। দেখতে দেখতে সৌদি বসেই এমআরসিপি পার্ট ওয়ান পাশ করে ফেললাম। বাকি থাকল বিলেতে গিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে বিলেত ফেরত হওয়া।

দুজন স্বপ্ন বিলাসী মানুষ পরিচিত হবার পর খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। দুজনেই একই সাথে ইংল্যান্ডের ভিসার জন্য আবেদন করলাম। এক চান্সে পেয়েও গেলাম। রফিক ভাই চলে এলেও আমার আর সেবার আসা হল না। ইংল্যান্ডে পরিচিত ডাক্তার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে জানলাম, এমআরসিপি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় পাশ করতে হলে সেখানকার হাসপাতালে ট্রেনিং থাকাটা খুব জরুরী। ইংল্যান্ডের হাসপাতালে ট্রেনিং নিতে হলে সেখানে ডাক্তার হিসেবে চাকরি পেতে হবে। নইলে রুগী ছোঁয়া যাবে না। তার জন্য দরকার ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা (IELTS) এবং সে দেশের লাইসেন্সিং পরীক্ষায় (PLAB) পাশ করা। ইংরেজিতে অনার্স করা রফিক ভাইয়ের সে সব বালাই ছিল না। তিনি চলে গেলেন। আমি বউ বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরে গেলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক বছর ট্রেনিং করলাম। সেই সাথে IELTS এ প্রয়োজনীয় স্কোর করে PLAB পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সেই পরীক্ষা দিতেই বিলেতে আসা। বিলেত ফেরত হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করা।

কিন্তু কোথায় রফিক ভাই ? তাঁকে না পেলে তো মালপত্র নিয়ে এয়ারপোর্টেই রাত কাটাতে হবে। আমি অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকাই। যে’ই এরাইভাল লাউঞ্জে বের হচ্ছে, পুরুষ কিংবা নারী, অমনি তার প্রিয়জন এসে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তূলে ফেলছে। হাজার লোকের সামনেই চকাস চকাস চুমু খাচ্ছে। বিনে টিকেটে সিনেমার এমন মিলন দৃশ্য আগে দেখিনি কোনোদিন। এমন সময় শুনলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। নিজের নাম শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি রফিক ভাই। ক্লোজআপ মার্কা ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসি মুখে হাত নাড়ছেন। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে কেন যে শুধু মেয়েদেরই নেয়া হয় কে জানে ? সুন্দরী মেয়েদের ভুবন মোহিনী হাঁসি দেখে ছেলেরা সেই টুথপেস্ট কিনবে বলে ? কিন্তু টুথপেস্ট কি শুধু ছেলেরাই ব্যাবহার করে ? মেয়েরা করে না ? বিজ্ঞাপনে এই লোকের রমণী মোহন হাসি দেখলে তো মেয়েরা একটা নয়, এক ডজন করে কিনবে !

কুশলাদি বিনিময়ের পর রফিক ভাই বললেন,

- চলেন টিউবে যাই।

- টিউব ?

- লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন। এরা বলে টিউব।

টিউব শব্দটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে দ্রুত চলাচলের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড র্যা পিড ট্রানজিট রেলওয়ে সিস্টেম আছে। বিভিন্ন নামে ডাকা হয় তাদের। অধিকাংশের নামই মেট্রো কিংবা সাবওয়ে। এই প্রথম টিউব নাম শুনলাম। কেন বলে কে জানে ? সম্ভবত টিউব বা চোঙের মতো সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে চলে বলে।

এর আগে একবার কোলকাতা আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন বা মেট্রোতে চরেছিলাম। ব্যস্ত শহরে, ট্রাফিক জ্যাম এড়িয়ে, মুহূর্তে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার এর চেয়ে ভালো মাধ্যম বুঝি আর নেই। প্রচুর ভিড় দেখেছিলাম মেট্রোতে। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে খাঁচায় পোড়া মুরগীর মতো একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এখানে ভিড় কেমন হবে কে জানে ? এত পোটলা পাটলী নিয়ে কিভাবে যাব ভেবে কপালে একটু চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তবে বললাম না কিছুই। কারণ খোঁজ খবর নিয়েই এসেছি। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে গন্তব্যে যেতে ট্যাক্সিতে যেখানে কমপক্ষে পঞ্চাশ পাউন্ড লাগে, টিউবে সেখানে লাগে মাত্র পাঁচ পাউন্ড। এক পাউন্ড মানেই একশো টাকা। সৌদি আরবের গরমে রক্ত শুকিয়ে উপার্জন করা টাকা। আমাকে হিসেব করে চলতে হবে।

এরাইভাল লাউঞ্জ থেকেই টিউব স্টেশনে যাওয়া যায়। লিফটে করে পাতালে নামলাম। সে কী যেমন তেমন পাতাল ? যেন প্রশান্ত মহাসাগরের তল ! সেখানে থেকে স্টেশন বেশ খানিকটা দূরে। ভাগ্যিস লাগেজ ট্রলি সাথে আনতে দিয়েছিল। নইলে বিপদ হত। রফিক ভাই আমার জন্য অটোমেটিক মেশিন থেকে টিকেট কিনে আনলেন। তার সাপ্তাহিক টিকেট কাটা আছে। যারা খুব বেশি ট্রাভেল করে, তারা সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক টিকেট কিনে রাখে। তাতে বেশ সাশ্রয় হয়। এখন অবশ্য ওয়েস্টার কার্ড বেরিয়েছে। সে কার্ডে আগে ভাগে টাকা ভরে রাখতে হয়। সে কার্ড ছুঁইয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করা যায়। পয়সাও কম খরচ হয়।

লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে মোট এগারোটি রুটে ট্রেন চলাচল করে। যে রুটটি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসে, তার নাম পিকাডেলি লাইন। হিথরো এয়ারপোর্টই ফার্স্ট কিংবা লাস্ট স্টেশন। তাই ভিড় কম। আমরা দরজার কাছেই বাক্স পেটরা নিয়ে বসে পড়লাম। মাঝে একবার আমাদের ট্রেন চেঞ্জ করতে হবে। কোচগুলো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। ঝকঝকে, তকতকে। যেন কালই নামিয়েছে। পিকাডেলি উল্কার গতিতে পাতাল ফুঁড়ে ছুটে চলল। সম্ভবত সত্তর আশি কিলোমিটার বেগে। কিছুক্ষণ পর পরই স্টেশন। এক মিনিটও দাঁড়ায় না। তার মধ্যেই হুড়মুড় করে উঠতে ও নামতে হয়। কয়েক মিনিট পরপরই ট্রেন। মিস হলেও অসুবিধা নাই।

লম্বা প্লেন জার্নি করে এমনিতেই বেশ টায়ার্ড ছিলাম। এবার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের হালকা দুলুনিতে তন্দ্রা মতো লেগে এসেছিল। হঠাৎ চোখের উপর উজ্জ্বল আলো পড়ায় তন্দ্রা কেটে গেল। দেখি, সামনের জানালা থেকে আসছে ঝলমলে আলো। অবাক কাণ্ড ! এই পাতালপুরীতে সূর্য মামা কোত্থেকে উদয় হলেন ? ভালো করে তাকাতেই দেখলাম, পিকাডেলি পাতাল ফুঁড়ে জমিনের উপর উঠে এসেছে ! কিছুক্ষণ আগেই তুষারপাত থেমে গেছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, রাস্তাঘাট সব তুষারে ঢাকা। ধবধবে সাদা। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্য। তারই তির্যক রশ্মি তুষারে পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। চোখ ধাঁধানো আলো ! এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখিনি জীবনে ! যে দেশ থেকে এসেছি, সেখানে দেখেছি, বর্ষায় জল থৈথৈ চারিদিক। আজ এখানে দেখছি তুষার ধবল চারিদিক। কী অপূর্ব লীলা প্রকৃতির। রফিক ভাই ফিসফিস করে বললেন, বেশ কদিন ধরেই তুষারপাত হচ্ছে। আরও বললেন, নাম আন্ডারগ্রাউন্ড হলেও ট্রেন ট্রাকের মাত্র পঁয়তাল্লিশ ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড আর বাকিটা ওভার-গ্রাউন্ড। কোথাও কোথাও আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন মাটি থেকে প্রায় ষাট মিটার নীচে, অর্থাৎ প্রায় ষোলো তলা বিল্ডিং সমান নীচ। আবার কোথাও কোথাও ভূমি থেকে পঞ্চাশ ষাট ফুট উপরে। মাটির উপরে থাকতেই ব্যারন কোর্ট স্টেশন এসে গেল। রফিক ভাই আগের স্টেশনে থাকতেই সতর্ক করে রেখেছিলেন, পরের স্টেশনে নামতে হবে, ট্রেন চেঞ্জ করার জন্য। অল্প সময় দাঁড়ায়। নতুন মানুষ আমি। যাতে বাক্স পেঁটরা নিয়ে ট্রেনেই থেকে না যাই, তাই আগাম সতর্কতা। ট্রেন থামতেই আমরা পোটলা পুটলি নিয়ে নেমে পড়লাম। এই স্টেশনটি ছোট। চারটা ট্রাক। দুটি আপ, দুটি ডাউন। পিকাডেলি ও ডিসট্রিক্ট লাইনের জন্য। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন যে যার ট্রাকে চলে। ক্রসিং এর জন্য কাউকে কারও জন্য দাঁড়াতে হয় না। লাইন ভেদে প্রতি দুই থেকে পাঁচ মিনিট অন্তর ট্রেন।

আমরা প্লাটফর্মের অন্য পাশে যেতেই ডিসট্রিক্ট লাইন চলে এলো। বাইরের চেহারা পিকাডেলির মতো চৌকশ নয়। কিছুটা ম্যাড়ম্যাড়ে। ডিসট্রিক্ট লাইন পূর্ব লন্ডনের দিকে যায়। যেখানে প্রধানত এশিয়ান ও আফ্রিকানদের বসবাস। সেই জন্যই কি চেহারা এমন ? ট্রেনে উঠতেই ধারণাটা সত্যি হল। ভেতরের সব কিছুতেই কেমন একটা গরিবি হাল। যেহেতু আমরা তখনও মূল লন্ডন শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, তাই সীট পেয়ে গেলাম।

ডিসট্রিক্ট লাইন একটু পরেই আবার পাতালে ডুব দিল। এবং যথানিয়মে নির্দিষ্ট বিরতিতে স্টেশনে স্টেশনে থামতে লাগল। যাত্রী নামার চেয়ে উঠছেই বেশি। স্টেশনও ঘন ঘন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোচ মানুষে টইটুম্বুর হয়ে গেল। কোলকাতায় দেখেছি, মেট্রোতে মেয়েদের জন্য বসার আলাদা জায়গা। এখানে সে সবের বালাই নেই। সমান অধিকারের দেশ। কেউ কারও কাছে বাড়তি সুযোগ চায় না। কেউ কাউকে দেয়ও না। যে যেখানে পারছে, বসে পড়ছে গায়ে গা ঘেঁষে। বসতে না পারলে দাঁড়িয়ে থাকে উপরে রেলিং ধরে। তবে গেটের কাছে বৃদ্ধ ও সন্তান সহ মায়েদের বসার জন্য নির্ধারিত। রফিক ভাই আবার ফিসফিস করে বললেন, লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের সংখ্যা দুশো সত্তর। প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ লক্ষ লোক টিউবে যাতায়াত করে। গরীব, ধনী, হোমড়া চোমড়া, এমপি, মিনিস্টার, সবাই টিউব ব্যবহার করে। কারো কোনো প্রটোকল কিংবা প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর দরকার হয় না। কেউ কাউকে খেয়ালও করে না। একবার তো প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনকেও টিউবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। অথচ পাশেই আম জনতা যে যার মতো বসেছিল। কেউ তাঁকে সীট ছেড়ে দেয়নি। মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় যার বেতন হয়, তাঁকে বিশেষ সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন মনে করে নি কেউ। আমাদের দেশে হলে ভাবা যায় ? প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, আতি পাতি মন্ত্রী হলেও দেখা যেত, পুরা ট্রেনটাই বুক করে ফেলেছে !

রফিক ভাইকে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে একটু অবাক হলাম। আমরা তো বাংলায় কথা বলছি। যাত্রীদের প্রায় সবাই ভিনভাষী। বোঝার কথা নয়। তখনই খেয়াল হল, এই যে কোচ ভর্তি এত মানুষ, অথচ কোনো চেঁচামেচি নেই, হৈ হুল্লোড় নেই। যারা বসতে পেরেছে, তারা অনেকেই একটা বই খুলে বসেছে। মহা ব্যস্ত জীবন এদের। বই পড়ার অবসর কোথায় ? তাই যাত্রা পথেই পড়ার তৃষ্ণাটুকু মিটিয়ে নেয়। যুবক যুবতীরা কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে। তখনও ফেসবুক চালু হয়নি। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। পরচর্চা করছে না। রাজা উজির মারছে না। কাজের মানুষ সব, আমাদের মতো অকাজের কথা বলে সময় নষ্ট করার বিলাসিতা নেই এদের। তাছাড়া অকারণে উচ্চস্বরে কথা বলা যে অভদ্রতা, ভদ্র ব্রিটিশ জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।

হঠাৎ একটা কারবার দেখে তো আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা ! দেখলাম, এই ভিড়ের মধ্যেই একটা ছেলে একটা মেয়েকে জাপটে ধরে কষে চুমু খাচ্ছে। গালে, কপালে, টুকটাক ঠোঁট ছোঁয়ানো, তাও মেনে নেয়া যায়। এ তো রীতিমত ঠোঁটে ! দীর্ঘ গভীর চুম্বন। সাথে একটা হাতও বেজায়গায় ! এতদিন ইংরেজি সিনেমায় এগুলা দেখেছি। বাস্তবেও যে কাজটা ওরা যেখানে সেখানে করে, জানতাম না। ভাবতাম, দর্শকদের সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য সিনেমায় এটা দেখায়। যেমন দেখায় হিন্দি, বাংলা সিনেমায়, নায়ক নায়িকার ক্ষণে ক্ষণে নাচ, গান। যদিও বাস্তবে ভারতে কিংবা বাংলাদেশে, রাস্তা ঘাটে কোনো প্রেমিক প্রেমিকাকে নেচে কুঁদে প্রেম করতে দেখা যায় না। কৈশোর কিংবা যৌবনে, সিনেমা হলের অন্ধকারে বসে ঐ সব অন্তরঙ্গ দৃশ্য হা করে গিলতাম। এই মধ্য বয়সে এসেও বাস্তবে সে সব দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। রফিক ভাই তার কনুই দিয়ে একটা হালকা গুঁতা মেরে আস্তে আস্তে বললেন, স্টেয়ার (এক ভাবে চেয়ে থাকা) করবেন না। স্টেয়ার করা ওরা পছন্দ করে না। মনে মনে বললাম, মর জ্বালা ! দিনে দুপুরে, জনারণ্যে তোমরা আকামডা করতে পারবা, আর আম জনতা চাইয়া থাকলেই দোষ ? ক্যান ? ঘরে খাইয়া প্যাট ভরে না, যে রাস্তা ঘাটেও খাইতে হইব ? তবে মুখে কিছু না বলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আরও কত কী দেখতে হবে কে জানে ?

রফিক ভাই ইস্ট লন্ডনে থাকেন। এশিয়ান অধ্যুষিত এলাকা। যতই আমরা আমাদের গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিলাম, ততোই কোচ বাদামী চামড়ায় ভরে যেতে লাগল। এক সময় ডিসট্রিক্ট লাইন একটু নিরিবিলি একটা স্টেশনে দাঁড়াল। অন্য স্টেশনগুলির মতো অতো আলো ঝলমলে নয়। কেমন একটু আলো আঁধারির খেলা। রফিক ভাই আবার ফিসফিস করে বললেন, এই জায়গার নাম অলগেট। সতেরো শতাব্দীতে প্লেগে কয়েক মাসেই লন্ডনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। এত মানুষের আলাদা আলাদা সৎকার করা সম্ভব ছিল না। তাই কুপ খনন করে হাজার হাজার মৃতদেহ একসাথে ফেলে মাটি চাঁপা দেয়া হত। এরা বলে প্লেগ পিট। এই স্টেশনের এক্সটেনশন করার সময় তারই একটা প্লেগ পিটের দেখা মিলেছিল। এগারো শোর উপরে কংকাল পাওয়া গিয়েছিল। শুনে আমার গা ছমছম করে উঠল। এই অন্ধকার কুপে কিংবা এই জালের মতো বিছানো সুড়ঙ্গ পথে এখনও কি সেই সব হতভাগ্য মানুষের আত্মারা ঘুরে বেড়ায় ?

বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এই আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন চালু হয় ১৮৬৩ সালে। ভাবা যায় ? পৃথিবীর অনেক দেশ তখনও মাটির উপরেই রেল গাড়ি দেখেনি। অথচ ব্রিটিশরা মাটির নীচে ট্রেন চালু করেছিল। এই ব্রিটিশরাই যখন পাক ভারত উপমহাদেশে বোম্বে শহরে প্রথম বারের মত মাটির উপরে রেল ট্রাক বসাতে শুরু করেছিল (১৮৫৩), প্রায় একই সময়ে লন্ডনে মাটি খুঁড়ে ট্রাক বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। আর বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো রেলগাড়ি চলে ১৮৬৮ সালে দর্শণায়। লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে প্রথম দিকে ট্রেনের বগী ছিল কাঠের আর ইঞ্জিন স্টিম চালিত। ইঞ্জিনের গরম ও ভেন্টিলেশনের অভাবে প্রায়ই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ত। মাঝে মাঝে আগুন লেগে মারাও যেত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই সব আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন বিদ্যুৎ চালিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক টিউব স্টেশনকে মানুষের শেল্টার হিসেবে ব্যাবহার করা হত। একবার তো বেথনাল গ্রিন নামে এক স্টেশনে তাড়াহুড়া করে আশ্রয় নিতে যেয়ে স্টাম্পিডেই প্রায় দুশোর মতো মানুষ মারা গিয়েছিল। যাদের অনেকেই শিশু। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটাই ছিল সব চেয়ে বেশি বেসামরিক মৃত্যু। অনেক মানুষ তো সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ও মারা গিয়েছিল। এখনও বছরে গড়ে একশো থেকে দেড়শ লোক টিউব স্টেশনে চলন্ত ট্রেনের সামনে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। রাতের অন্ধকারে, সুড়ঙ্গের ভেতরে নাকি সেই সব মানুষের আর্ত চিৎকার শোনা যায়। রফিক ভাইয়ের কথায় আমি আবার শিউরে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

- আপনি কখনও শুনেছেন ?

- আরে নাহ। যারা অনেক রাতে জার্নি করে, যখন স্টেশন ফাঁকা থাকে, তখন নাকি শোনা যায়। এমনটাই অনেকে বলে। আমি কখনও শুনি নাই।

ছেলেবেলা থেকে দাদী নানীর মুখে কালি ভূত, মেছো ভুত, গেছো ভূতের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। এখনও গ্রামের রাস্তায় অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে যাই। এই ভিন দেশে এসে সাদা ভূত দেখার কোনো শখ আমার নাই।

রফিক ভাইকে বোধহয় কথায় পেয়েছিল। মাষ্টার মানুষ। পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে এরা ছাত্র মনে করে। তাছাড়া এমন নীরব শ্রোতাই বা ক’জন পাবে ? তিনি বলতে থাকেন, বাকিংহাম প্যালেসের কাছে ডাউন স্ট্রিটে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ছিল, যেখানে যুদ্ধের সময় উইনিস্টন চার্চিল তাঁর ওয়ার কেবিনেট নিয়ে মিটিং করতেন। এখন অবশ্য স্টেশনটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল লাইনের দুই মাইল লম্বা একটা টানেলে গোপনে যুদ্ধ বিমানও বানানো হত। উনিশশো আশি সাল পর্যন্ত সেটা অফিসিয়ালি সিক্রেট রাখা হয়েছিল।

কথা বলতে বলতে আমাদের স্টেশন এসে গেল। মাইলেন্ড। পাতাল ফুঁড়ে বাইরে বের হতেই দেখি সূর্যদেব অনেক আগেই মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছেন। শীতের দেশে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামে। জ্বলে উঠেছে ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন বাতি। ইতোমধ্যে ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হয়েছে। মিহিদানার মতো তুষার কণা লাগছে আমার গায়ে। যেন কয়েক হাজার সূচ ফুটিয়ে দিচ্ছে আমার চোখে মুখে। স্টেশন থেকে রফিক ভাইয়ের বাসা হাঁটা দূরত্বে। তবু ট্যাক্সি নিলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাসায়।
 
টেমস নদীর বাঁকে

পর্ব - ৩ (লন্ডন ব্রিজ)











ছোটবেলা থেকেই লন্ডন বলতে যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে হল, সাপের মতো একে বেঁকে বয়ে চলা টেমস নদী, নদীর উপর অপরূপ ভাস্কর্যে মণ্ডিত ঝুলন্ত দোতলা লন্ডন ব্রিজ, নদীর তীরে সুদৃশ্য ওয়েস্ট মিনিস্টার প্যালেস বা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন আর তার সামনেই সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার বা বিগ বেন। লন্ডনে এসেছি, আর টেমসের তীরে যাব না, এ সব দেখব না, তা কি হয় ?

ঘুম ভাঙ্গল সকাল আটটায়। অথচ শীতের সূর্যের ঘুম ভাঙ্গেনি তখনও। বাইরে জ্বলছে নিয়ন বাতি। সকাল আটটায়ও কেমন রাতের আমেজ। চোখে যতই ঘুম থাক, একবার ভাঙ্গলে আর ঘুমাতে পারি না। উঠে ফ্রেস হতে যেয়ে দেখি, রফিক ভাইয়ের বেডরুমের দরজা হাট করে খোলা। স্বামী স্ত্রী কেউ নেই বাসায়। কোথায় গেলেন এই সাত সকালে ? দেখলাম, কিচেনের দরজায় একটা ছোট্ট হলুদ চিরকুট আঁটা।

“ কাজে গেলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার রেডি করা আছে। সময় মতো খেয়ে নেবেন”

দুই বেডরুমের কাউন্সিল ফ্লাট। এখানকার বাড়ি ঘরগুলো সাধারণত দোতলা। আমাদের গ্রামে টিনের চালের মতো দোচালা টালির ছাদ। শীতপ্রধান দেশগুলোতে বাড়ির ছাদগুলো সাধারণত ঢালু হয়। যাতে তুষার জমে থাকতে না পারে। তবে কাউন্সিল ফ্লাটগুলো আমাদের দেশের মতোই বহুতল বিশিষ্ট। যাদের কামাই রোজগার নাই কিংবা রোজগার করতে অক্ষম, তাদেরকে সোশ্যাল সার্ভিস এই সব ফ্লাটে থাকতে দেয়। বিনে পয়সায়। এই বেনেফিট পেতে হলে ব্রিটিশ নাগরিক হতে হয়। রফিক ভাই মাত্র এক বছর হয় এসেছেন স্টুডেন্ট ভিসায়। ব্রিটিশ সিটিজেন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কাউন্সিল ফ্লাটে থাকেন ? একটু অবাক হয়েছিলাম। পরে শুনলাম, ফ্রি নয়। ভাড়া দিয়ে থাকেন। যার নামে এই কাউন্সিল ফ্লাট বরাদ্দ, সে গোপনে রফিক ভাইকে ভাড়া দিয়ে অন্য কোথাও থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে বাসস্থান একটি। বাসস্থান প্রত্যেক সাবালক ব্রিটিশ নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সে অধিকার আদায় করে নিয়ে কেউ কেউ ভোগ না করে গোপনে ভাড়া দিয়ে দু পয়সা কামিয়ে নেয়। এই অনৈতিক কাজটা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান থেকে আসা অভিবাসী ব্রিটিশরাই বেশি করে। এমনও দেখা গেছে, তিন পুরুষ এক বাসায় থাকে। বাকি দুই পুরুষের নামে বরাদ্দকৃত বাসাগুলো ভাড়া দিয়ে দেয়। কেউ কেউ তো নিজেরা থেকেও এক রুম ছাত্র ছাত্রীদের সাবলেট দেয়। শুনে খুব একটা খারাপ লাগে না আমার। দুশো বছরের গোলামীতে যাদের পূর্বপুরুষেরা এই ব্রিটিশদের অনেক ‘বেনেফিট’ দিয়েছে, তাদের উত্তরসূরিরা যদি কুট কৌশলে হলেও কিছুটা উসুল করে নেয়, অসুবিধা কী ?

তবে যেটা খারাপ লেগেছিল, সেটা হল, অভিবাসী ব্রিটিশ নাগরিকদের হীনমন্যতার কথা শুনে। তুখড় ইংরেজি জানেন বলে রফিক ভাই ইতোমধ্যেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছ থেকে দোভাষীর কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। উনি অনেক মজার মজার কাহিনী জানেন। কিছু মানুষ এমন আছে, যারা যে কোনো মূল্যে এ দেশে আসে শুধুমাত্র সোশ্যাল সার্ভিসের বেনেফিট ভোগ করতে। ফ্রি থাকা, ফ্রি চিকিৎসা, ফ্রি শিক্ষা, এমনকি খাওয়ার পয়সাও (বেকার ভাতা) যদি বসে বসে পাওয়া যায়, তাহলে আর কাজ কাম করবে কোন দুঃখে ? অনেকে তো পয়সার বিনিময়ে একটা ছেলে কিংবা মেয়েকে দেশে থেকে চুক্তি ভিত্তিক বিয়ে করে নিয়ে আসে। ব্রিটিশ পাসপোর্ট হয়ে গেলে ডিভোর্স দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা কাউন্সিল ফ্লাট পায়। আলাদা বেনেফিট পায়। সে নাহয় গেল চুক্তি ভিত্তিক স্বামী স্ত্রীদের কথা। সত্যিকার অর্থেই এমন স্বামী স্ত্রীও আছে, যারা শুধু আলাদা বেনেফিট খাওয়ার জন্য কাগজে কলমে আলাদা হয়ে যায়। ফলে তাদের আলাদা ফ্লাটে থাকতে হয়। একজন ব্রিটিশ নাগরিক যে পরিমাণ সোশ্যাল বেনেফিট পায়, তাতে তার নিশ্চিন্তে চলে যাবার কথা। তবুও আরও পয়সার জন্য ফ্লাটের এক রুম এ দেশে পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের সাবলেট দিয়ে দেয়। আর প্রকাশ্যে এক সাথে না থাকতে পারলেও চুরি চামারি করে শারীরিক সম্পর্কটা ঠিক বজায় রাখে। প্রয়োজনের সময় স্বামী এসে ভাড়াটিয়া ছেলে বা মেয়েটিকে বলে, ভাতিজা/ভাতিজি, ঘণ্টা দুইয়ের লাগি একটু বাইরে যাও, তোমার চাচীর লগে বিশেষ মাত (কথা) আছে ! মাঝে মাঝে ধরাও পড়ে। তখন তাদের বেনেফিট তো যায়ই, জেল জরিমানাও হয়ে যায়। শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। তবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। অথচ নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া এই সব মানুষগুলোই আবার সুযোগ পেলে নিজের দেশ নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। নাক সিটকে বলে, এহ, ওদেশে মানুষ থাকে ? উন্নত দেশে এসে থাকলেই যে চরিত্র উন্নত হয় না, ওটা রক্তের মধ্য থাকতে হয়, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে ?

রফিক ভাই, ভাবি, দুজনেই ব্রিটিশ ডিগ্রী নেয়ার জন্য পড়াশুনা করছেন। আবার দুজনেই কাজও করছেন। টিকে থাকতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। এই টুকু ঘরের ভাড়াই বাংলাদেশী টাকায় সত্তর হাজার টাকা। আছে টিউশন ফি, খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত। তাই বোধহয় রাত থাকতে উঠে, ঘর গেরস্থালীর কাজ কর্ম সেরে, এই হাড় কাঁপানো শীতের সকালে বেরিয়ে পড়েছেন জীবিকার সন্ধানে। কী অদ্ভুত জীবন !

আমি ধীরে সুস্থে টেবিলে ঢেকে রাখা সকালের নাস্তা সারলাম। আগের রাতেই জেনে রেখেছিলাম, কী ভাবে কোথায় যেতে হবে। ঘুম থেকে সূর্য মামা না উঠলেও মানুষজন উঠে পড়েছে। গাড়ি ঘোড়া চলছে। ছুটছে সবাই কাজে। ভাগ্য ভালো, আজ আকাশ পরিষ্কার। তার মানে তুষারপাত হবে না। তবে শীতের প্রকোপ বাড়বে। বঙ্গ বাজার থেকে কেনা সব গরম কাপড় একে একে গায়ে চড়ালাম। চড়াতে চড়াতে শরীরের উপরের অংশটা তুলার বস্তার মতো হয়ে গেল। নীচে চিকন দুটো ঠ্যাং। আমি যেন রাশিয়ান সার্কাসের এক বেটে খাটো ক্লাউন ! উপায় নাই গোলাম হোসেন। বাইরে শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা। গা সওয়া হতে সময় লাগবে। ততদিন এই ক্লাউনের সাজেই ব্রিটিশদের মনোরঞ্জন করতে হবে !

রফিক ভাইয়ের বাসার কাছেই একটা গ্রোসারি শপ। সেখানে ডে ট্রাভেল টিকেট কিনতে পাওয়া যায়। এক টিকেটেই সারাদিন যত খুশি ট্রেনে, টিউবে, বাসে চড়। যত খুশি ঘুরে বেড়াও। যতদূর ইচ্ছে যাও। হারিয়ে যাবার ভয় নেই। সারা লন্ডন শহর জুড়ে রয়েছে শত শত টিউব ষ্টেশন। সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। আর একবার ইন্দুরের গর্তে ঢুকতে পারলেই হল, ঠিক পৌঁছে যাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। তাছাড়া দোকানে, স্টেশনে, রাস্তার মোড়ে ফ্রি ট্রাভেল ম্যাপ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় টিউব, ট্রেন, বাসের টাইম টেবিল। আর যাবেই বা না কেন ? শুধু পর্যটন খাত থেকেই ব্রিটেনের আয় এক হাজার কোটি পাউন্ডের উপরে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার মতো। বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে গড়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষ আসে শুধু লন্ডন শহর দেখতে। এই টুকু খাতির যত্ন তো করতেই হবে।

বাইরে বের হতে হতে সকাল দশটা পেরিয়ে যায়। ততোক্ষণে সূর্যকুমার মাথা তুলেছেন পুবাকাশে। সোনা ঝরা রোদে চকচক করছে তুষার ঢাকা বাড়ি ঘরের ছাঁদ। মানুষ জন যে যার মতো অফিসে, আদালতে, স্কুলে, কলেজে ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন কম। আমি ট্রাভেল গাইড দেখে একটা ডাবল ডেকার বাসে উঠে পড়লাম। নীচে কিছু যাত্রী থাকলেও উপরটা প্রায় ফাঁকা। আমার মতোই দু চারজন টুরিস্ট বসে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাসে কোনো কন্ডাকটর নেই। হয় আগে থেকেই টিকেট কেটে উঠতে হয়, নয়ত ওঠার সময় সম পরিমাণ পয়সা ড্রাইভারকে দিতে হয়। আমার গন্তব্য লন্ডন ব্রিজ। রাস্তা ঘাট, স্টপেজ, কিছুই চিনি না। কন্ডাকটরও নেই যে স্টপেজ এলে “লন্ডন বিরিজ, লন্ডন বিরিজ” বলে আগে থেকেই হাঁক ছাড়বে। কিংবা ওস্তাদ, নামার আছে, বলে ড্রাইভারকে জানান দেবে। আমি ট্রাভেল গাইড খুলে কত স্টপেজ পরে নামতে হবে হিসেব করে নিলাম। প্রত্যেক সীটের কাছেই স্ট্যান্ডে লাগানো আছে লাল বোতাম। চাপ দিলে ড্রাইভার বুঝতে পারে, যাত্রী নামার আছে। বাহ, আধুনিক বিশ্বে আধুনিক ব্যবস্থা !

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই প্রায় সব নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীর ঘেঁষে। লন্ডন শহরও এর ব্যতিক্রম নয়। এর গোড়াপত্তন হয় মূলত রোমানদের হাতে। দুই হাজার বছর আগে, খৃষ্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা ইংল্যান্ড দখল করে নেয়। তৎকালীন রোমান আর্মি জেনারেল, অলুস প্লটিয়াস, ৪৩ সালে টেমস নদীর তীরে এক ছোট্ট গ্যারিসন শহর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় চারশো বছরের রোমান আমলে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ইউরোপের অন্যতম পুরনো এই শহর। তখন ডাকা হত লন্ডনিয়াম। পরবর্তীতে যা লন্ডন নামে পরিচিতি পায়। আমাদের বাস টেমসকে বায়ে রেখে এগিয়ে চলে। পুরনো ঢাকার মতোই পুরনো লন্ডনের এই এলাকার রাস্তাগুলো সরু, বাড়ি ঘরদোর পুরনো। আমি জানালা দিয়ে সেই সব পুরনো বাড়ি ঘর দেখি আর ইতিহাসের আল ধরে এগিয়ে চলি।

ছোট্ট এই দ্বীপটির ইতিহাস বড় বেশি রক্তে রঞ্জিত। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক সময় সূর্য অস্ত যেত না, তারাই অতীতে বিভিন্ন দেশ ও জাতি দ্বারা হয়েছে শাসিত, নির্যাতিত, লুণ্ঠিত ! পাঁচ শতাব্দীর প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপের জার্মান উপজাতি, স্যাক্সোনরা রোমান লন্ডনিয়াম আক্রমণ শুরু করে এবং পাঁচ শতকের মাঝামাঝি রোমানদের বিতাড়িত করে। তারও একশ বছর পরে স্থানীয় ব্রিটনদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে এংলো- স্যাক্সন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এংলো-স্যাক্সন আমলও শান্তিপূর্ণ ছিল না। আঞ্চলিক রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। দ্বীপটির জান মালের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল দুর্ধর্ষ ভাইকিং জলদস্যুদের দ্বারা। তারা আসত সমুদ্র পথে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন থেকে। নয় থেকে এগারো শতক পর্যন্ত চলতে থাকে ভাইকিংদের বীভৎস আক্রমণ, লুটতরাজ, হত্যাযজ্ঞ। এংলো-স্যাক্সন সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।

এই সুযোগে ১০৬৬ সালে ফ্রান্সের নরমা্নডি থেকে উইলিয়াম নরমানডি এসে ইংল্যান্ড দখল করে নেয়। পতন হয় এংলো-স্যাক্সন যুগের। শুরু হয় এংলো-নরমান যুগের। উইলিয়াম শক্ত হাতে দ্বীপটির ছোট ছোট রাজাদের দমন করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তার হাত ধরেই আধুনিক ইংল্যান্ডের সূচনা। শুরু হয় ইংলিশ ডাইনাস্টি বা ইংরেজ রাজতন্ত্রের যা অদ্যাবধি জারী আছে। আঠেরো শতকের গোঁড়ার দিকেই ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ড মিলে গঠিত হয় গ্রেট ব্রিটেন। আর ১৮০১ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ড যোগ দিলে গঠিত হয় আজকের ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য।

এ সব ভাবতে ভাবতেই আমার স্টপেজ এসে গেল। বোতাম টিপে বাস থামিয়ে তড়িঘড়ি নেমে পড়লাম। নেমেই তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এ কোথায় এসে পড়লাম ? ভেবেছিলাম, টেমসের পাড়ে ঝকঝকে ওয়েস্টমিনিস্টার প্যালেসের সামনে বিগ বেনের গোঁড়ায় নামিয়ে দেবে, যার কাছেই সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ। অথচ সে সব কিছুই ধারে কাছে নেই। তবে কি ভাবতে ভাবতে ভুল জায়গায় নেমে পড়লাম ? খুঁজে পেতে এক বাদামী চামড়ার এশিয়ানকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলাম,

- লন্ডন ব্রিজটা কোথায় ?

মুখে জবাব না দিয়ে কাছেই টেমসের উপর একটা রংচটা ব্রিজ দেখিয়ে দিল। ব্যাটা কয় কী ? আহাম্মক নাকি ? কোথায় আগরতলা আর কোথায় ছাদনাতলা ? কোথায় সুরম্য অট্টালিকার মতো দোতলা ব্রিজ, আর কোথায় এই ম্যাড়ম্যাড়ে ন্যাংটো ব্রিজ ? লন্ডনে থাইকাও লন্ডন ব্রিজ চিনে না ? বিরক্তি চেপে রেখে বুঝিয়ে বললাম,

- না না, এটা নয়, আমি সেই ঝুলন্ত ব্রিজটা খুঁজছি, যেটা জাহাজ আসলে দু’ভাগ হয়ে যায়।

- তুমি যেটার কথা বলছ, সেটা লন্ডন ব্রিজ নয়, টাওয়ার ব্রিজ। আধা মাইল পিছে ফেলে এসেছ।

আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে চলে গেল লোকটা। ভাবখানা এমন, যেন ডেভিড ক্যামেরুন ! কত তাড়া তার। তিনি না গেলে পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হবে না ! ব্যাটা খাইস তো বেনেফিট। ব্রিটিশ ভদ্রতা শিখবি কেমনে ? বিশেষ করে কাল রাতে এশিয়ান ব্রিটিশদের যে কাহিনী শুনেছি, তাতে ওদের উপর আমার ভরসা মোটামুটি শূন্যের কোঠায়। ব্যাটা আমারে ভিলা দিল না তো ? আসছি যখন, কাছে যাইয়াই দেখা যাক !

পায়ে পায়ে ব্রিজটার কাছে এগিয়ে গেলাম। নাহ, কংক্রিটের স্তম্ভে পরিষ্কার অক্ষরে লেখা, লন্ডন ব্রিজ। এবার নিজেকেই মহা আহাম্মক বলে মনে হল। বোকার মতো ধরেই নিয়েছিলাম, লন্ডনের আইকোনিক ব্রিজ যখন, নাম নিশ্চয়ই লন্ডনের নামেই হবে। অথচ নাম তার টাওয়ার ব্রিজ ! এর পর কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে আসার আগে পড়াশুনা করে আসতে হবে।

কাছে যেয়ে দেখলাম, ব্রিজের গোঁড়ায় মানুষের লম্বা লাইন। এই দেশে আসা অবধি দেখেছি, সব কিছুতেই লাইন। বাসে উঠতে লাইন, ট্রেনে উঠতে লাইন, টিউবে উঠতে লাইন, এমনকি মুদি দোকানেও লাইন। আমাদের দেশের মতো তাড়াহুড়া, চিল্লাচিল্লি, ধাক্কাধাক্কি নেই। সবাই চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। তবে এই লাইনে সবাই সাদা চামড়া। আমার মতো বাদামী চামড়ার কেউ নাই। একজন ইউনিফর্ম পরা গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম,

- কিসের লাইন এটা ?

- ব্রিজের তলায় যাওয়ার।

মর জ্বালা, মাইনে কী ? এতদিন দেখছি, মানুষ ব্রিজের উপরে ওঠার জন্য লাইন দেয়। এইখানে দেখতাছি, ব্রিজের তলায় যাওয়ার জন্য লাইন দিছে ! ব্রিজ থুইয়া সাঁতরাইয়া টেমস পার হইব নাকি ? জানতে চাইলাম,

- কী আছে তলায় ?

- লন্ডন ব্রিজ এক্সপেরিয়েন্স !

- মানে ?

- মানে প্রদর্শনী। লন্ডন ব্রিজ তৈরির ইতিহাস। প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত। কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কী ভাবে এই ব্রিজ বারবার শত্রু দ্বারা, দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, কী ভাবে মানুষ মরেছে, এই সব ইতিহাস তুমি দেখতে পাবে। দেখতে পাবে সেই সব মৃত মানুষের মাথার খুলি, শরীরের কংকাল, তাদের জীবন্ত লাশ, তাদের অতৃপ্ত আত্মা। দেখতে পাবে জীবন্ত বদ্ধ ভূমি, রক্তাক্ত মস্তকের স্তূপ, জীবন্ত সমাধি। এটা শুধু ইংল্যান্ডের নয়, পৃথিবীর অন্যতম ভীতিকর প্রদর্শনী ! ঐ পাশে টিকেট কাউন্টার আছে। বিশ পাউন্ড। টিকেট কেটে এসে লাইনে দাঁড়াও।

শুনেই ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। টিকেটের দাম শুইনা তো গায়ের লোম পুরাই খাড়াইয়া গেল ! বিশ পাউন্ড মানে বাংলা টাকায় দুই হাজার টাকা ! ডাক্তারির প্রথম চাকরিতে তো মাসে এত টাকা বেতনও পাই নাই। তাছাড়া মানুষ টাকা দিয়া ফুর্তি কেনে। আর আমি এতগুলা টাকা দিয়া পাতালে যাইয়া ভয় কিনমু ? আমারে কি পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে ? আস্তে করে লোকটার সামনে থেকে কেটে পড়লাম। তবে একেবারে চলে গেলাম না। দুই হাজার বছরের পুরনো এই ব্রিজ সম্পর্কে মনের ভেতর নানা কৌতূহল। ইনফরমেশন সেন্টার থেকে লন্ডন ব্রিজের উপর বেশ কিছু লিফলেট সংগ্রহ করলাম। বাঙালি যেখানে মাগনা পাইলে আলকাতরাও খায়, সেখানে মাগনা পাওয়া লিফলেট পইড়া জ্ঞান নিতে তো কোনো দোষ নাই।

ব্রিজের তলায় ঢুকতে পয়সা লাগলেও উপরে উঠতে পয়সা লাগল না। লাইনও দিতে হল না। আমি লিফলেটগুলো নিয়ে ব্রিজের উপরে চলে গেলাম। নদীর দেশের মানুষ আমি। নদী মানেই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, যমুনা। যার এক কুল ভাঙ্গে তো ও কুল গড়ে। আবার সেই ভাঙ্গা কুলে জেগে ওঠে চর। সেই চরে থাকে সবুজ ধান ক্ষেত। থাকে ধবল কাশফুল। থাকে গাছ গাছালি। টেমসকে দেখে আমার মোটেই নদী বলে মনে হল না। যেন একটা বড় সান বাঁধানো ড্রেন। এই ব্রিজের কাছে নদী মাত্র ২৬৫ মিটার চওড়া। লন্ডন শহরে টেমসের দুই পাড়ই সান বাঁধানো। তীরে কোনো গাছপালা নেই। আছে কংক্রিটের পায়ে চলা পথ। সে পথের দু ধারে নানা রকম খাবারের দোকান। সুভেনিয়ারের দোকান। কোথাও কোথাও নদীর কুল ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে সুরম্য অট্টালিকা, দামী দামী ম্যানশন, অফিস বিল্ডিং। আধা মাইল ভাটিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই টাওয়ার ব্রিজ স্ব-মহিমায়।

ব্যবহারিক অর্থেও টেমসকে একটা ড্রেনই বলা যায়। লন্ডন, অক্সফোর্ডের মতো বড় শহর ছাড়াও আরও অন্তত দেড় ডজন ছোট শহরের বর্জ্য এই নদী দিয়েই প্রবাহিত হয়ে উত্তর সাগরে পড়ে। এক সময় এই নদীর পানি এতটাই দুষিত ও নোংরা হয়ে পড়েছিল যে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে একে “বায়োলোজিকালী ডেড” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই নদীই আবার ২০১০ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার নদী হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পায়। এটা সম্ভব হয়েছিল বৈজ্ঞানিক উপায়ে সকল বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, এখন টেমস ষাট ভাগ লন্ডন-বাসীর তৃষ্ণাও মেটায়।

এই খানে টেমস উপর প্রথম ব্রিজ তৈরি হয়েছিল ৫৩ সালের দিকে। নৌকার উপর কাঠের নির্মিত পন্টুন ব্রিজ। রোমান আর্মিদের চলাচলের জন্য। সেই থেকে বারো শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিজটি কাঠেরই ছিল। বারবার আক্রান্ত হয়েছে, আগুন লেগেছে কিংবা ঝড়ে ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু কখনোই পুরা ধ্বংস হয়নি। আবার মাথা তূলে দাঁড়িয়েছে। বারো শতকের শেষের দিকে কাঠের পরিবর্তে লন্ডন ব্রিজ পাথর দিয়ে নির্মিত হয়। অবাক হলাম জেনে, এই ব্রিজের উপর নাকি এক সময় প্রায় দুইশয়ের মতো ঘর বাড়ি, দোকান পাট ছিল। তাও ছোট বাড়ি নয়, রীতিমত চার পাঁচ তলা। এমনকি ব্রিজের উপর একটা চার্চও ছিল। ব্রিজের এক পাশে ছিল একটা টাওয়ার, যা এখনও আছে। সেই টাওয়ারে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহীদের বিচারের পর, তাদের খণ্ডিত মস্তক ঝুলিয়ে রাখা হত।

বিখ্যাত স্কটিশ বীর, উইলিয়াম ওয়ালেস, যে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের সাথে যুদ্ধ করেছিল। প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী হলেও পরের বছর পরাজিত হয়। তবে পালিয়ে যাতে সক্ষম হয়েছিল। তারও কয়েক বছর পরে এক স্কটিশ নাইটের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। দেশদ্রোহিতার একমাত্র শাস্তি তখন মৃত্যুদণ্ড। এই লন্ডনে শহরেই কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু এক স্বাধীনতাকামী বীরের এ কেমন মৃত্যু ? তাঁকে প্রথমে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ঘোড়ার সাথে বেঁধে সারা শহর ঘুরানো হয়েছিল। তারপর তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় কিন্তু মৃত্যু হওয়ার আগেই নামিয়ে ফেলে। জীবন্ত ওয়ালেসের পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ শরীর থেকে আলাদা করে নপুংসক বানিয়ে তার পৌরুষের চরম অবমাননা করা হয়। পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে তার সামনেই আগুনে পোড়ানো হয়। তারপর শিরোচ্ছেদ। শুধু শিরোচ্ছেদই নয়, শরীরকে চার খণ্ডে খণ্ডিত করে শহরের চার প্রান্তে ঝুলিয়ে রেখেছিল। আর উইলিয়াম ওয়ালেসের খণ্ডিত মস্তক আলকাতরায় ডুবিয়ে এই লন্ডন ব্রিজেই ঝুলিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন। একজন বীরের এমন বীভৎস মৃত্যুদণ্ডের কাহিনী পড়ে আমার বমি চলে আসে। ঘৃণায় গা রিরি করে ওঠে। নৃশংসতায় চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের কাহিনী আমরা সবাই জানি। কিন্তু আজকের এই তথাকথিত ভদ্র ইংরেজ জাতির নৃশংসতার ইতিহাস আমরা ক’জনে জানি ? একবার এক জার্মান পর্যটক নাকি এই লন্ডন ব্রিজেই ত্রিশটা খণ্ডিত মাথা ঝুলতে দেখেছিল।

অবশ্য ১৯৬৫ সালেই ব্রিটেনে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়ে যায়। যদিও কাগজে কলমে দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বহাল ছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।

জনশ্রুতি আছে, মধ্যযুগে কিংবা তারও আগে, লন্ডন ব্রিজ রক্ষার্থে মানুষের জীবনও উৎসর্গ করা হত। শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীকে এই ব্রিজের গোঁড়ায় একটা বদ্ধ কুঠুরিতে আঁটকে রাখা হত, যতক্ষণ না ক্ষুৎপিপাসায় মারা না যায়। এমনকি জীবন্ত শিশু মেয়েদেরকেও ব্রিজের তলায় উৎসর্গ করা হত। যাতে তাদের আত্মা এই ব্রিজকে রক্ষা করতে পারে ! কুসংস্কার তাহলে শুধু আমাদের দেশেই নয়, এ দেশেও ছিল ? অবশ্য এ সব কেবলই জনশ্রুতি, সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

দিনে দিনে লন্ডন শহরের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে লন্ডন ব্রিজের উপর মানুষ ও গাড়ির চাপ। বাড়ি ঘরদোর, দোকানপাটের জন্য ব্রিজে মানুষ ও গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে থাকে। তাছাড়া সেই সব বাড়িঘরে প্রায়ই আগুনও লাগত। অনেক মানুষের মৃত্যু হল। আঠারো শতকের শেষের দিকে লন্ডন সিটি কাউন্সিল সাড়ে পাঁচশ বছরের পুরনো সব ঘর বাড়ি কিনে নিয়ে ধ্বংস করে ফেলে এবং পুরা ব্রিজ মানুষ ও গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।

আমাদের গ্রামের শিশুরা যেমন “ওপেন্টি বায়স্কোপ, নাইন, টেন, টেইস্কোপ, সুলতানা বিবিয়ানা, সাহেব বিবির বৈঠকখানা”, গান গেয়ে এক ধরণের খেলা খেলে, ব্রিটিশ শিশুরাও তেমনই সুর করে “লন্ডন ব্রিজ ইজ ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন, লন্ডন ব্রিজ ইজ ফলিং ডাউন, মাই ফেয়ার লেডি” গেয়ে সেই রকম খেলা খেলে। কারও কারও মতে এই ছড়ার মাধ্যমে একাদশ শতাব্দীতে ভাইকিং দস্যুদের দ্বারা এই ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলাকে বুঝায়। আর ফেয়ার লেডি বলতে কুমারী মেরীকে বোঝানো হয়। যেদিন ভাইকিঙরা ব্রিজ আক্রমণ করেছিল সেই দিনই কুমারী মেরীর জন্মদিন ছিল। তাদের বিশ্বাস, কুমারী মেরীই লন্ডন ব্রিজকে পুরা ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছিল। আবার কারও কারও মতে এই ছড়ার মাধ্যমে ব্রিজ রক্ষার্থে ইংরেজদের আত্মত্যাগকে বুঝায়। যাই বোঝাক না কেন, দেখতে যতই জৌলুশ-হীন হোক না কেন, লন্ডন ব্রিজ ইংরেজদের ঐতিহ্য, অহংকার ও নৃশংসতার প্রতীক হয়ে দুই হাজার বছর ধরে একই স্থানে দাড়িয় আছে।

লন্ডন ব্রিজের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, কোনো কংক্রিটের ব্রিজ নয়, আমি যেন ইতিহাসের সেতু ধরে হাঁটছি, যা দীর্ঘ দুই হাজার বছরের অনেক যুদ্ধ, অনেক মৃত্যু, অনেক আত্মত্যাগ, অনেক নির্মম ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ! আমি যেন টেমসের বাতাসে সেই সব অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার শুনতে শুনতে পেলাম। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি তাড়াতাড়ি ব্রিজ থেকে নেমে এলাম।
 
টেমস নদীর বাঁকে
পর্ব - ৪ (ব্রিটিশ “নন্দিনী”)






লন্ডন ব্রিজ থেকে নেমে টেমসের তীর ধরে ভাটির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাসেও যাওয়া যায়। তবে বেড়াতে এসে আমার হাঁটতেই ভালো লাগে। নতুন জায়গার সাথে এক ধরণের গা ছোঁয়া অনুভূতি পাই। তাছাড়া মাত্র তো আধা মাইল। এখানে পায়ে হাঁটা পথ কংক্রিটের কিংবা পিচ ঢালা হয় না। সিরামিক ইট কিংবা পাথর বিছানো। শীতের দিনে বরফ জমলে যাতে মানুষ স্লিপ না করে। পথের পাশেই নির্দিষ্ট দূরত্বে বসার বেঞ্চ। মাঝে মাঝে ফোর হুইলের উপর স্যান্ডউইচ, কফি, আইসক্রিমের দোকান। মাথার উপর মিঠেকড়া রোদ। টেমসের বুক থেকে আসা হিমহিম হাওয়া। ফ্রেস কফির চনমনে ঘ্রাণ। অসময়েই খিধেয় পেট চোঁচোঁ করে উঠল। সকালে যা নাস্তা করেছিলাম, এই শীতে শরীর গরম রাখতে যেয়ে তা এতক্ষণে বোধহয় হজম হয়ে গেছে। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, অনেক কিছু দেখতে হবে। ভাবলাম, কফি স্যান্ডউইচ খেয়ে নিই। মুসলমান মানুষ। এই প্রথম পশ্চিমের খৃষ্টান দেশে এসেছি। হারাম, হালাল জিনিষটা রক্তে মিশে আছে। তার উপর শুনেছি, এদের হ্যাম (শুকরের মাংস) খুব প্রিয়। কী খেতে কী খেয়ে শেষে কী বাপ দাদার আমলের ধর্মটা খোয়াব ? জ্যান্ত মুরগীর আণ্ডা তো আর হারাম হবে না ! একটা প্লেইন এগ স্যান্ডউইচ আর কফি অর্ডার করলাম। কিন্তু দাম দিতে যেয়ে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। পাঁচ পাউন্ড ! স্যান্ডউইচ দুই পাউন্ড আর কফি তিন পাউন্ড ! কয় কী ? আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। তখন বাংলাদেশে ডিম তিন টাকা আর দুই স্লাইস পাউরুটি বড়জোর দুই টাকা। পাঁচ টাকার স্যান্ডউইচ নিলো দুইশ টাকা ! তখন দেশে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কন্ডেন্সড মিল্কের চা খেতাম দুই টাকায়। কফি কিনে খাইনি কখনও। কত আর হবে ? নাহয় দশ টাকা। তাই বলে গরীব দেশের এই গরীব মানুষটার কাছ থেকে তিনশ টাকা নিবি ? তগো কি পরকালের ভয় ডরও নাই ? যদিও সৌদি আরবে রক্ত শুকিয়ে কামাই করা দশ হাজার ডলার পকেটে। তবুও পাঁচশ টাকা খসে যাওয়াতে খিধেটাই মরে গেল !

এক হাতে এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া স্যান্ডউইচ, অন্য হাতে কাগজের গ্লাসে কফি। কোথাও না বসতে পারলে খাই কেমন করে ? কিন্তু বসব কোথায় ? সব বেঞ্চেই কইতর কইতরিরা বইসা আছে। হয় বাকবাকুম করতাছে, নাহয় ঠোকাঠুকি করে একে অন্যের ওম নিতাছে। বেশ কিছু দূর গিয়ে একটা বেঞ্চের আধেকটা ফাঁকা পেলাম। অসম্ভব রকমের স্মার্ট এক সাদা চামড়ার নারী নাকের ডগায় চশমা তূলে বই পড়ছেন, আর থেকে থেকে কফির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। এই শীতেও পরনে তার একটা হালকা কার্ডিগান। বুঝলাম, বয়স তার শরীর কিংবা রক্ত, কোনোটাই স্পর্শ করতে পারেনি। বাংলাদেশ হলে কোনো সুন্দরী মহিলার পাশে বসতে চাইলে ভাবত আলু ভাজতে এসেছি। এরা নিশ্চয়ই আলু ভেজে নয়, ডিপ ফ্রাই করে খায় ! তাই কাছে যেয়ে সাহস করে বললাম,

- মে আই সীট হিয়ার ?

- ওহ, শিওর, শিওর।

বলে নিজের কাপ সরিয়ে আমাকে বসার জায়গা করে দিল মোহনীয় ব্রিটিশ রমণী। আমিও আমার কফির কাপ মাঝখানে রেখে এক পাশে জড়সড় হয়ে বসলাম। বসতেই এক মহুয়া মাতাল সুরভি এলো নাকে। কী সুগন্ধি মেখেছে এই নারী ? এমন বিবশ করা গন্ধও কোনো পারফিউমে হয় ? শুনেছি, এই সব দেশে নামী দামী পারফিউমের দাম দশ পনেরো হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। দুশো টাকার বডি স্প্রে পর্যন্ত দৌড় আমার। দশ পনেরো তো দূরের কথা, হাজার টাকা দিয়েও পারফিউম কেনার বিলাসিতা করিনি কখনও। আমি লম্বা একটা শ্বাস টেনে যতটুকু পারি, নাম না জানা সেই ফরাসি সৌরভ টেনে নিলাম বুকে।

ফয়েল খুলে স্যান্ডউইচে কামড় দিতে দিতে টেমসকে দেখি। এখানে নদী আছে। অথচ তার বুকে পাল তোলা নৌকা নেই। মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালী নেই। তীরে ঢেউ খেলে যাওয়া কাশফুল নেই। কুল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ নেই। দূরে সবুজ গ্রাম নেই। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথে কবিতা, “সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী, তীরে তমালের ঘন ছায়া, আঙ্গিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে তার, পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর…”

- হোয়াট আ নাইস ওয়েদার !

অন্যমনস্ক ছিলাম বলে শুনতে পেলাম না। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম,

- পারডন ! কিছু বললে ?

- বললাম, কী সুন্দর ওয়েদার, তাই না ?

আর কিছু কওনের পাইল না ? হাড় কাপাইনা শীতরে কয়, কী সুন্দর ওয়েদার ? পরে শুনেছি, আমরা যেমন দেখা হলে ধান চালের দাম কিংবা মন্ত্রী এমপিদের আকাম নিয়ে কথা বলি, ওরাও তেমনই ওয়েদার নিয়ে কথা বলে। আমাগো মন্ত্রী মিনিষ্টারগো যেমন বিশ্বাস নাই, অগোও ওয়েদাররে কোনো বিশ্বাস নাই। ইউ কান্ট ট্রাস্ট ব্রিটিশ ওয়েদার অ্যান্ড ব্রিটিশ উইমেন। সেই ব্রিটিশ উম্যান প্রশংসা করতাছে ব্রিটিশ ওয়েদারের ? মনে মনে বললাম, তগো ওয়েদারের আমি ঠ্যাঙা কিলাই। শীতে অঙ্গ আমার জারা জারা হইয়া যাইতাছে, এই নাইস ওয়েদার ধুইয়া কি আমি পানি খামু ? কোনো মতে বিরক্তি চেপে হে হে করে বললাম,

- তা যা বলেছ। নাইস ওয়েদার।

- তুমি কি এ দেশে নতুন এসেছ ?

কয় কী ? গুপ্তচর নাকি ? আমি যে নতুন আসছি বুঝল কেমনে ? আমার কপালে কি ইমিগ্রেশনের সিল মারা আছে ? দু’চোখ সরু করে মহিলাকে ভালো করে দেখি। মহিলা না বলে বোধহয় নারী বলাই ভালো। মহিলা শব্দটিতে কেমন খালা চাচী মার্কা একটা আটপৌরে গন্ধ আছে। বরং রমণী শব্দটায় একটা আভিজাত্য আছে, এক ধরণের নমনীয়তা আছে। মেয়েদের বয়স আমি এমনিতেও বুঝতে পারি না। এঁরটা তো আরও পারছি না। সোনালী চুলগুলো টানটান করে পিছনে বাঁধা। পুরু কাঁচের চশমা। বোধহয় প্রচুর পড়াশুনা করেন। চশমার পিছনে নীল দুই চোখ। ধূসর মণি। যেন প্রশান্ত মহাসাগরের নীলে পাল তোলা নৌকা। মুখের ত্বকে পিচ্ছিল কমনীয়তা। একটু আগের বিরক্তি ভাবটা এক ধরণের ভালো লাগায় বদলে গেল। হেসে জানতে চাইলাম,

- কী ভাবে বুঝলে নতুন এসেছি ?

- তোমার কাপড় দেখে।

আচানক কথা ! সিনেমায় ভাঁড়দের দেখেছি, প্রাইস ট্যাগ না খুলেই নতুন কাপড় পরতে। যাতে সবাই বুঝতে পারে নতুন কাপড়। আমার কাপড় তো বঙ্গ বাজার থেকে কেনা। প্রাইস ট্যাগ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। নাকি আমার বুক পকেট থেকে বোর্ডিং পাশটা উঁকি দিচ্ছে, যা দেখে সে বুঝতে পারল, আমি মাত্র ল্যান্ড করেছি ? অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকাতেই বললেন,

- এতে অবাক হবার কিছু নেই। যারা গরমের দেশ থেকে নতুন আসে, তাদের এই ঠাণ্ডা ওয়েদারে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে। তারা ভারি শীতের কাপড় পরে বাইরে বের হয়।

বলে মিষ্টি করে হাসলেন ইংলিশ অনামিকা। একজন অপরিচিত ভিনদেশী পুরুষের সাথে এমন সাবলীল ভাবে কথা বলছেন, যেন বহুদিনের চেনা। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে অবাক করে দেয়। অস্ফুটে বললাম,

- গ্রেট অবজারবেশন।

- আরও বলতে পারি। নিশ্চয় লন্ডন ব্রিজ দেখে আসছ ?

- এ আর কঠিন কী ? উজান থেকে যখন আসছি, যে কেউ বুঝবে, লন্ডন ব্রিজ দেখে আসছি।

- কিন্তু যেটা সবাই বুঝবে না, সেটা হল, তুমি টাওয়ার ব্রিজকে লন্ডন ব্রিজ ভেবে ভুল করেছ।

এবার আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে গেল ! সে কি আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে ? নাকি আমি যে কত বড় আহাম্মক, সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাইছে ? দেখি চশমার পিছনে ঝিকমিক করছে নীল সমুদ্র। প্রথম দিনেই এক ব্রিটিশ রমণীর কাছে আমার বেকুবি এ ভাবে ধরা খেয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম।

- তোমার লজ্জা পেতে হবে না। শুধু তুমি নও। তোমার মতো প্রায় সবাই এই ভুলটা করে। এমনকি এ দেশে বহুদিন বাস করেও অনেকে টাওয়ার ব্রিজকে লন্ডন ব্রিজ বলে জানে। তুমি শুনলে অবাক হবে, আমেরিকার এক তুখোড় ব্যবসায়ীও এই ভুল করে মস্ত বড় এক ধোঁকা খেয়েছিলেন।

- ধোঁকা ?

হাতের বইটা পাশে নামিয়ে রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলেন রহস্যময়ী। নিঃসঙ্কোচে পা দুটি ভাঁজ করে বেঞ্চের উপর তূলে দিয়ে বললেন,

- শোনো তাহলে। যে ব্রিজটি তুমি দেখে এলে, সেটি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬৭ সালে এবং চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ১৯৭৩ সালে। এর আগে যে ব্রিজটি এখানে ছিল, সেটা তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের প্রথম দিকে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ব্রিজটি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে প্রতি ঘণ্টায় আট হাজার মানুষ ও নয়শো গাড়ী পার হত। বেচারা ব্রিজ এত গাড়ি ও মানুষের ভার সইতে না পেরে এক প্রান্তে আস্তে আস্তে দেবে যেতে থাকল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে ব্রিজটি আবার পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। তখন লন্ডন সিটি কাউন্সিল ব্রিজটি বিক্রির ঘোষণা দিল। মিসৌরির এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ম্যাককুলক অয়েল কোম্পানির মালিক, রবার্ট ম্যাককুলক ১৯৬৮ সালে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার দিয়ে ব্রিজটি কিনেও নিলেন। কিনেই তো তিনি বোকা বনে গেলেন। তিনিও দৃষ্টি নন্দন টাওয়ার ব্রিজকেই লন্ডন ব্রিজ ভেবে ভুল করেছিলেন। কিন্তু বিক্রিত মাল তো আর ফেরত হয় না। কী আর করা ? বেচারা লন্ডন ব্রিজের প্রতিটি ইট, পাথর, লোহা লক্কড় খুলে, গুনে গুনে আমেরিকা নিয়ে গেলেন। সব চেয়ে অবাক ব্যাপার কি জানো ? আড়াই মিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনা লন্ডন ব্রিজ খুলে আমেরিকা নিয়ে যেতে ম্যাককুলকের খরচ হয়েছিল আরও সাত মিলিয়ন ডলার। আর সময় লেগেছিল পুরা তিন বছর। বেচারা সেই সব ইট, পাথর, রড দিয়ে লন্ডন ব্রিজের আদলে একটি ব্রিজ তৈরি করলেন এরিজোনা রাজ্যের লেক হাভাসু সিটির একটা চ্যানেলের উপর। যা আজও সেখানে লন্ডন ব্রিজ নামেই পরিচিতি।

রূপকথার গল্প শোনার মতো করে তন্ময় হয়ে শুনছিলাম লন্ডন ব্রিজ বিক্রির কাহিনী। ম্যাককুলক সাহেবের বেকুবির কাছে আমি তো নস্যি ! পৃথিবীতে কত কিসিমের পাগল যে আছে। দেশে বসে শুনতাম, বড়লোকের পয়সা হলে কুত্তার ছাও কেনে। আর এই ব্যাটা একটা ব্রিজের রাবিশ কিনল দশ মিলিয়ন ডলার দিয়া ! যার বর্তমান মূল্যমান কমপক্ষে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার বা চারশো কোটি টাকা ! চৌকশ এই ব্রিটিশ রমণীর জ্ঞান দেখে আমার সম্ভ্রম আরও বেড়ে গেল। অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলাম,

- তুমি এত কিছু জানো কেমন করে ?

- আমাকে জানতে হয়। বাই দা ওয়ে, আমি নাতাশা ওয়াটকিনসন। কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির হিস্ট্রির প্রফেসর।

বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। যে দেশে রাস্তা ঘাটে নারী পুরুষ জড়াজড়ি করে, চুমু খায়, সে দেশে নারী পুরুষের হ্যান্ডশেক করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবু আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। ব্রিটেনের অন্যতম বড় ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু এত অল্প বয়সে ? আমাদের দেশে প্রফেসর হতে হতে তো বয়স তিন কালে যেয়ে ঠেকে ! অনেকে তো আবার কলেজের লেকচারার হয়েও নিজেকে প্রফেসর বলে পরিচয় দেয়। এ নিশ্চয়ই তেমন নয়। আমাকে ছাত্র মনে করে একটা বড়সড় লেকচারও দিয়ে ফেলেছেন ! তবে ছাত্র হিসেবে আমিও কম যাই না। বরাবরই একটু পোংটা কিসিমের। রূপবতী এই মাস্টারনীর সাথে একটু পোংটামি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা আলতো করে ধরে বললাম,

- আমি আফতাব হোসেন। বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছি। গ্লাড টু মিট ইউ।

- আমারও তাই মনে হয়েছিল। তা কোন কলেজে ভর্তি হয়েছ ?

যা ভেবেছিলাম। আমার মাকুন্দ মার্কা চেহারা দেখে প্রফেসর ধোঁকা খেয়ে গেছেন। কলেজের ছাত্র ভেবে ভুল করে বসেছেন। আরও একটু ধোঁয়াশা তৈরি করতে একটা মিচকেল হাসি হেসে বললাম,

- ভর্তি নয়। পরীক্ষা দিতে এসেছি।

- কীসের পরীক্ষা ?

- লাইসেন্সিং এক্সাম।

- কীসের লাইসেন্স ?

- তোমাদের দেশে ডাক্তারি করার।

- ওয়াও! তুমি ডাক্তার ? দেখে একদম মনে হয় না।

- কেন ? আমি কি বন্দুক দিয়ে ডাক্তারি করব যে আর্মিদের মতো লম্বা চওড়া হতে হবে ?

- না না, তা নয়। ইউ লুকস সো ইয়াং !

- সে তো তোমাকে দেখেও প্রফেসর বলে মনে হয় না।

- কী মনে হয় আমাকে দেখে ?

চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে বাচ্চা মেয়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। চশমা ছাড়া চোখ দুটি আরও মায়াবী, আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। একগুচ্ছ অবাধ্য চুল ওড়া উড়ি করছে বাতাসে। বয়স যাই হোক, দেখতে যেমনই হোক, স্তুতিতে তুষ্ট হয় না, প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে না কিংবা, পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে রক্তিম হয় না, এমন নারী বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেন জানি না, ঐ তুষার শুভ্র মুখে খানিকটা আলতা ঢেলে দিতে ইচ্ছে হল। বললাম,

- নন্দিনী।

- নন্দিনী ? কে ? তোমার প্রেমিকা ?

- না। শুভঙ্করের।

- শুভঙ্করের ? সে আবার কে ?

- পঁয়তাল্লিশ বছরের এক সদ্যজাত যুবক।

- আর নন্দিনী ?

- এক বিদ্যুৎ শিখা।

- বাহ, তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলো !

- কথাগুলো আমার নয়। পূর্ণেন্দু পত্রী নামে এক কবির। যে ছিল নন্দিনী আর শুভঙ্করের নিত্য দিনের সঙ্গী। ওদের প্রেমের কথাবার্তাগুলো টুকে রাখত ডায়রির পাতায়। সেই সব আবীর মাখানো কথোপকথন নিয়ে লিখেছিল একশো একটি কবিতা।

- বল কী ? একশো একটা কবিতা ? দারুণ তো ! শোনাতে পারো দু একটা ?

- পুরা কবিতা তো ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারব না। তবে একটু ভাবার্থ শোনাতে পারি।

- আচ্ছা, শোনাও।

- একদিন শুভঙ্কর নন্দিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল, গরমের মধ্যে লোডশেডিং হলে কী কর ? নন্দিনী বলেছিল, “গায়ে জামা কাপড় রাখতে পারি না। সব খুলে দিই। চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল, লাজ লজ্জা সব”। শুনে শুভঙ্কর বলেছিল। “এমন তোমার উথাল-পাতাল দয়া। তুমি অন্ধকারকে সর্বস্ব, সব অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খুলে দিতে পার কত সহজে”। অথচ শুভঙ্কর কিছু চাইলেই, “কী, হচ্ছে কী ? পরের জন্মে দশ-দিগন্তের অন্ধকার হব আমি”।

অবাক হয়ে দেখি, দ্রুত চোখে চশমা পড়ে নিলেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। অজান্তেই বুকের কাপড় ঠিক করছেন। আমি মনে মনে ভাবি, যে দেশেই জন্মাও না কেন, যে ধর্মেই বিশ্বাস কর না কেন, যত সংক্ষিপ্ত কাপড়ই পড় না কেন, লজ্জা মিশে আছে তোমাদের সত্ত্বায়। লজ্জাই যে নারীর ভূষণ। আমি কোনো কথা না বলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই শাশ্বত নারীকে দেখতে থাকি। এই প্রথম তাঁর ভেতর এক ধরণের সংকোচের ভাব লক্ষ্য করলাম। আমি মুচকি হেসে জানতে চাইলাম,

- কেমন লাগল প্রফেসর ?

- এক্সিলেন্ট ! অপূর্ব ! নিশ্চয়ই ওদের মিলন হয়নি ?

- তুমি কী করে বুঝলে ?

- মিলনের প্রেম নিয়ে এত সুন্দর কবিতা লেখা যায় না !

- হ্যাঁ, প্রেম বিরহেই অমর হয়, মিলনে মলিন।

আমার কথার জবাব দিলেন না প্রফেসর। অবাক হয়ে দেখি, তাকিয়ে আছেন আমার দিকেই, অথচ দেখছেন না আমাকে। যেন হারিয়ে গেছেন কোনো দূর অজানায়। চশমার আড়ালে বড় বড় চোখ দুটোয় যেন একটু বিষাদের মেঘ। আমি কি তাঁর গোপন কোনো ক্ষত তাজা করে দিলাম ? এমন আগুনের মতো যার রূপ, সে আগুনে ভস্ম হতে প্রেমিকের অভাব হবার তো কথা নয়। তবে কেন এই বিষণ্ণতা ? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইলাম,

- আর ইউ ওকে প্রফেসর ?

- তুমিও কি কবিতা লেখো ডাক্তার ?

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন প্রফেসর। তবে কণ্ঠের বিষণ্ণতা লুকাতে পারলেন না। এত কাছে বসা, অথচ যেন অনেক দূর থেকে কথা বললেন। আমার চিকিৎসক মন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল, এই রূপবতী ব্রিটিশ রমণীর জীবনে গভীর কোনো দুঃখ আছে। কী সেটা, প্রথম পরিচয়েই জানতে চাওয়াটা শোভন দেখাবে না। তবে তাঁর মন ভালো করে দিতে তো কোনো বাঁধা নেই। আমি আমার কথার ঝুলি থেকে কিছু যাদুর কথা দেখে নিলাম। প্রফেসরের চোখে চোখ রেখে হেঁয়ালি করে বললাম,

- না। আমি কবিতা দেখি।

- কবিতা দেখো ? সে কেমন ?

- আমার চোখে যা কিছু সুন্দর, হোক সে ফুল, পাখি, প্রকৃতি কিংবা নারী, সে সবই আমার কাছে কবিতা। আমি বসে বসে সেই সব কবিতা দেখি। আমি সেই কবিতার পূজা করি।

- তুমি কি আমার সাথে ফ্লার্ট করছ ডাক্তার ?

- সে দায়ও কি আমার প্রফেসর ?

আমার ইঙ্গিতটা বুঝতে প্রখর বুদ্ধিমতী প্রফেসরের অসুবিধা হয় না। এতক্ষণে তাঁর দুধ সাদা গালে আবীর ছড়িয়ে পড়ে। ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি। তবে কিশোরী লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেন না। বরং ভ্রুকুটি হেনে বললেন,

- সাবধান, আমার সাথে বলেছ ঠিক আছে। এ দেশে কোনো মেয়ে রুগীর সাথে আবার এভাবে কথা বলতে যেও না।

- কেন ? চিকিৎসা কি শুধু ওষুধেই হতে হবে ? কথা দিয়েও তো চিকিৎসা করা যায়।

- তা যায়। তবে ওষুধে প্রভাব পড়ে শরীরে আর কথার প্রভাব পড়ে মনে। রুগীরা তোমার প্রেমে পড়ে যেতে পারে। তাতে প্রফেশনাল এডভান্টেজ নেয়ার দায়ে তুমি অভিযুক্ত হতে পারো। এমনকি তোমার ডাক্তারি লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যেতে পারে।

- জানি প্রফেসর। তবে আমিও অভিজ্ঞ ডাক্তার। ওষুধ যেমন বুঝে শুনে দেই, কথাও তেমন বুঝে শুনেই বলি।

বলে আমি শব্দ করেই হেসে উঠলাম। সে হাসির শব্দে চমকে তাকায় আশেপাশে বসা মানুষ। চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায় পথচারী। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে লাগাম টানলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম, এ দেশে কেউ প্রকাশ্যে উচ্চ শব্দে হাসে না, চিৎকার করে কথা বলে না। দেখি প্রফেসরের মুখটাও গম্ভীর। কবজি উল্টে একবার হাতের ছোট্ট ঘড়িটা দেখলেন। আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। আমার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরেই বললেন প্রফেসর,

- সে আমি এতক্ষণে বুঝে গেছি। তোমার মতো বাচাল ডাক্তার আমি জীবনে দেখিনি।

শুনে আমার চোখের আলো ধপ করে নিভে গেল ! মুখের উপর বাচাল বলল ? প্রথম পরিচয়েই একজন ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের সাথে এতটা প্রগলভ হওয়া উচিৎ হয়নি। লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললাম,

- আয়াম এক্সট্রিমলি স্যরি প্রফেসর। আমি বোধহয় খুব বেশি কথা বলি।

- বোধহয় না। তুমি আসলেই খুব বেশি কথা বল। আর শুধু বলই না, রীতিমতো কথার যাদুতে মানুষ বশ করে ফেলো। দেখোই না, তোমার কথা শুনে এই মধ্য বয়সেও আমার নন্দিনী হতে ইচ্ছে করছে। একটু পর যে আমার ক্লাস আছে, তাও ভুলে বসে আছি।

আমাকে অবাক করে দিয়ে এবার নিজেও শব্দ করে হেসে উঠলেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। যেন এক ঝাঁক ধান শালিক ডানা ঝাপটে উঠল টেমস নদীর বাঁকে। বুঝলাম, রসিকতা করছিলেন। আমারও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। হেসে বললাম,

- আমার কী দোষ বলো ? অগ্নিশিখা দেখলে কীট পতঙ্গ তো আত্মাহুতি দিতে চাইবেই !

কপট ধমকের সুরে বলে উঠলেন প্রফেসর,

- আবার ? এবার কিন্তু সত্যি সত্যি বকা খাবে ডাক্তার। আসলেই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস আছে। এখনই যেতে হবে। আমি প্রায়ই এখানে এসে বসি। আবার কোনো একদিন দেখা হলে তোমার কাছ থেকে নন্দিনীর গল্প শুনব।

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। যাবার আগে তাঁর খালি কফির গ্লাসটা তূলে নিতে ভুললেন না। একটু হেঁটে রাস্তার অন্য পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। এই এক গুণ ব্রিটিশদের। দরকার হলে আধা মাইল হাঁটবে, তবু ময়লা আবর্জনা এখানে সেখানে ফেলবে না। আমাদের দেশে হলে গ্লাসটা বেঞ্চিতে ফেলে রেখেই চলে যেত।

খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। যাবার আগে ব্রিটিশদের স্বভাবসুলভ বিদায় সম্ভাষণটুকুও জানালেন না। একবার পিছন ফিরেও তাকালেন না। সে কি ক্লাস নেয়ার তাড়া আছে বলে নাকি স্মৃতির হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি বসে বসে তাঁর চলে যাওয়া দেখি। চলার ছন্দে মাথার পিছনে উঁচু করে বাঁধা চুলগুলো ঘোড়ার লেজের মতো দুলতে থাকে। যেন এক আরবি ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে দুলকি চালে। ব্রিটিশরা বোধহয় আস্তে চলতে যানে না। কী নারী, কী পুরুষ, কী জোয়ান, কী বুড়ো, সবাই ছুটছে। যেন ছুটে চলার নামই জীবন। ক্ষণিক দাঁড়াবার, একটু তাকাবার, নেই কোনো অবসর। আমার ডব্লিউ এইচ ডেভিসের “লেইজার” কবিতার দুটি লাইন মনে পরে যায়,

হোয়াট ইজ দিস লাইফ ইফ, ফুল অব কেয়ার,

উই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড এন্ড স্টেয়ার।
 
টেমস নদীর বাঁকে
পর্ব - ৫ (টাওয়ার ব্রিজ)






বেশ কিছুক্ষণ হয় চলে গেছেন প্রফেসর ওয়াটকিনসন। অথচ তাঁর শরীরের মৌ মৌ সৌরভ যেন এখনও রয়ে গেছে বাতাসে। নাকি তাঁর প্রবল সম্মোহনী ব্যক্তিত্বে এখনও বিবশ হয়ে আছি? অতি সাধারণ লন্ডন ব্রিজ দেখে যেমন বোঝা যায়নি এর পিছনের মর্মান্তিক ইতিহাস! মোহনীয় এই রমণীকে দেখেও তেমন বুঝতে পারিনি, অবশ করা ঐ রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন করুণ ইতিহাস? এই জীবনে যত মানুষের কাছাকাছি এসেছি, মুখের চাইতে তাদের মনের রূপটাই দেখেছি বেশি। হবে কী আবার দেখা ? ফোন নম্বর, ঠিকানা, কিছুই তো জানি না। যদিও ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে খুঁজে বের করা যায়, কিন্তু সেটা শোভন দেখাবে না। কে জানে, হয়ত এই টেমস নদীর বাঁকেই একদিন আবার দেখা হয়ে যাবে।

হঠাৎ চারিদিকে মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য, কোলাহল, ছোটাছুটি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আশেপাশে বেঞ্চে বসে থাকা মানুষজন ছুটে যাচ্ছে নদীর কুলে। সেদিকে তাকাতেই দেখি ধীরে ধীরে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল টাওয়ার ব্রিজ। যেন খুলে যাচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহ দুয়ার। প্রায় তিনশ ফুট দীর্ঘ এক একটা পাল্লা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে উপরে। আমিও ছুটে গেলাম টেমসের কিনারে। নদীর কুল লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। যাতে কেউ অসাবধানতা বশত পড়ে না যায় । আমি সে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অন্যতম সভ্য এ জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আকাশ ছুঁতে দেখি। মাত্র মিনিট খানেক লাগল ব্রিজের পাল্লা দুটি প্রায় নব্বই ডিগ্রী উঠে যেতে। খোলা সে দুয়ার দিয়ে মাথা উঁচু করে ধীর গতিতে এগিয়ে এলো বিশাল এক ক্রুজ শিপ।

আমি যেখানটায় বসে আছি, তাঁর একটু পর থেকেই শুরু হয়েছে লন্ডনের প্রধান বন্দর। প্রায় এগারো মাইল ভাটির দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথম শতাব্দীতে রোমানদের হাতে ধরেই এই বন্দরের যাত্রা শুরু। সেই থেকে দুই হাজার বছর ধরে, ধীরে ধীরে বেড়েছে পৃথিবীর অন্যতম পুরনো এই বন্দরের ব্যাপ্তি। এক সময় এই বন্দর এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, যে বলা হয়, জাহাজের ভিড়ে পানি দেখা যেত না। মানুষ জাহাজের উপর দিয়ে হেঁটেই নদী পার হতে পারত।

উনিশের শতক। অর্ধেক পৃথিবী তখন ব্রিটিশদের পদানত। ইংরেজদের শাসন, শোষণ আর এক তরফা বাণিজ্য নীতির ফলে টাকা পয়সা, ধন সম্পদ এসে লন্ডনে জমা হতে থাকে জোয়ারের পানির মতো। লন্ডন হয়ে ওঠে পৃথিবীর বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র। উনিশ শতকের শেষের দিকে রাজধানী লন্ডন ঐশ্বর্যে, মানুষে এতটাই ফুলে ফেঁপে উঠল যে, ভাটিতে আরও একটি ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। লন্ডন ব্রিজের মতো অল্প উচ্চতার ব্রিজ বানালে তো জাহাজ ঢুকতে পারবে না। আবার বন্দরও ভাটির দিকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব না। প্রায় দেড়শ বছর আগে ব্রিটিশরা তৈরি করতে শুরু করল পৃথিবীর প্রথম জীবন্ত ব্রিজ। শুনেছি, চার শতাধিক মানুষ দিন রাত কাজ করে আট বছর বসে বানিয়েছিল এই ব্রিজ।

- ওয়াও। লুক হানি, মাইটি গর্জিয়াস! ইজিন্ট ইট?

- দ্যাটস রাইট। ইটস আওয়ার প্রাইড।

আড় চোখে তাকিয়ে দেখি, পাশেই দাঁড়ানো পড়ন্ত বয়সের এক সাদা দম্পতি। কত হবে বয়স? সত্তর থেকে আশি? বোঝা মুশকিল। দেখি, বৃদ্ধ শক্ত করে ধরে আছেন প্রেয়সীর হাত। যেভাবে বাবা ধরে রাখেন শিশু কন্যার হাত যাতে হঠাৎ করে দৌড় না দিতে পারে কিংবা পড়ে না যায় নদীর জলে। শিশুর মতোই অবাক উচ্ছল হয়ে দেখছেন মহিলা তাদের গৌরব।

ইংরেজদের এই সম্বোধনটা আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। হানি! আহা, এই একটা শব্দেই যেন এক পৃথিবী ভালোবাসা। এরা যতদিন একসাথে থাকে, একে অন্যকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে। প্রেমে কখনও ভাটা পড়ে না। হোক সে বিয়ে করে কিংবা না করে। কিন্তু আমাদের বেলায় ? কেমন শোনাবে ? যদি বউকে যদি ডেকে বলি, “মউ, একটু কাছে আসো”। নিঃসন্দেহে বউ কপাল কুঁচকে দু’চোখ সরু করে তাকাবে আমার দিকে। চোখে জমবে সন্দেহের কালো মেঘ। তারপর সে চোখে বিজলী চমকাবে। হবে বজ্রপাত! ঝংকার তুলবে গলায়, “বুইড়ার কি ভীমরতি ধরছে? একটা বউ পালার মুরদ নাই, আবার কোন মউয়ের পাল্লায় পড়ছ”? কিংবা হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে যাবে, “ও বাবাগো, এই ছিল আমার কপালে? বুড়া বয়সে সতীনের ঘর করতে হবে!” আর আমার অবস্থা হবে তখন “ভিক্ষা চাইনা মা, কুত্তা ঠেকা”।

প্রেম করার সময় কিংবা বিয়ের পরপর যদিও সোনা, ময়না, পাখি, জান, এই সব ডাক কপালে জোটে। বিয়ের কিছু দিন পর দেখা যায়, সব সোনা উঠে গেছে বউয়ের গলায় কিংবা হাতে। অথবা তালাবন্ধ সিন্দুকে। ময়না, পাখি, কবেই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে। আর ‘জান’ ? সেটা ঝালাপালা হয় অমুকের বাপ, তমুকের বাপ, ডাক শুনে শুনে! আমি নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের কথা শুনতে থাকি।

- দিনে ক’বার ব্রিজ ওপেন হয় ?

- ইট ডিপেন্ডস অন দ্যা ওয়াটার ট্রাফিক হানি। আগে তো অনেকবার খুলতে হত। অনেক রকম জাহাজ ঢুকত। এখন শুধু ক্রুজ লাইনারের শিপ গুলোই আসে প্যাসেঞ্জার জেটিতে। তাও দিনে দুই থেকে চার বার খোলে।

- জাহাজ আসতে দেখলেই কি ব্রিজ খুলে দেয় ?

- নাহ। কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা আগে ব্রিজের ক্যাপ্টেনকে নোটিশ দিতে হয়।

বুইড়া কয় কী? সেতুতেও ক্যাপ্টেন? এতদিন তো শুনে এসেছি, জাহাজের ডেকে ক্যাপ্টেন থাকে। ব্রিজের ডেকেও থাকে? মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,

- ব্রিজে ক্যাপ্টেন থাকে?

- কেন থাকবে না? যে ব্যক্তি জলযান নেভিগেট করে, তাকেই ক্যাপ্টেন বলে। টাওয়ার ব্রিজ তো এক রকম চলন্ত জলযানই। ঐ ক্রুজ শিপের মতোই প্রচণ্ড শক্তিশালী হাইড্রোলিক মটর আছে ব্রিজের নীচে পানির ভেতর, যা বারোশো টন ওজনের এক একটা পাল্লাকে উপরে উপরে ঠেলে তোলে।

- স্যরি! তোমাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। আমি ডাঃ হোসেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

- গ্লাড টু মিট ইউ ডক্টর। আমি জেমস হিথ আর ও মার্গারেট হিথ।

“গ্লাড টু মিট ইউ” বলে আমি মিঃ হিথের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। সে আমার হাত হতে এমন জোরে চাপ দিলে যে আমার পিলে চমকে গেল। বুড়ো হাড্ডিতে এত জোর? কোন দোকানে চাউল খায় জানতে পারলে ভালো হত! দেখি, মিসেস হিথও হাত বাড়িয়ে আছেন। তাঁর হাত ধরে বললাম,

- গ্লাড টু মিট ইউ মিসেস হিথ।

- ইউ ক্যান কিস মাই হ্যান্ড ইয়াং ম্যান, ইফ ইউ লাইক।

আমার হাতটা ধরে রেখেই বললেন মার্গারেট হিথ। কয় কী? ভাটায় শুকিয়ে গেলেও নদীতে যে এক সময় যৌবনের উন্মাতাল ঢেউ ছিল, বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই বইলা স্বামীর সামনেই তাঁর হাতে চুমা খামু? তখনই মনে পড়ল, হাতের পিঠে চুমো খেয়ে নারীর প্রতি সম্মান দেখানো একটা পশ্চিমা রীতি। রাণী এলিজাবেথের হাতেও অনেককে চুমু খেতে দেখেছি। আমি বো হয়ে তাঁর হাতের পিঠে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম,

- আইয়াম অনারড, ইওর হাইনেস।

শুনে কিশোরীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠল লাস্যময়ী ব্রিটিশ রমণী। সময়ের ভাটায় শরীর শুকিয়ে গেলেও কণ্ঠের কমনীয়তা শুকায়নি এখনও। যেন এক পশলা ঢেউ ভেঙ্গে পড়ল টেমসের বাঁধানো তীরে। হাসতে হাসতেই বললেন,

- মাই প্লেজার লিটিল উইটি (রসিক) ম্যান।

“লিটিল ম্যান” বলতে আমারে কি খাটো মানুষ বুঝাইল নাকি ছোট মানুষ বুঝাইল? খাটো বইলা টিপ্পনী এর আগেও কম শুনি নাই। তাই বইলা এই সাদা শাঁকচুন্নি বুড়িও আমারে খাটো কইয়া খোঁচা দিবো? আমিও হেসে উল্টা খোঁচা দিলাম,

- আমার মতো ছোট মানুষেরাই কিন্তু একদিন এই পৃথিবী শাসন করবে।

চায়না, জাপান, কোরিয়া যে ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক ভাবে পৃথিবী শাসন করতে শুরু করেছে, এই ব্রিটিশ দম্পতির তা না জানার কথা নয়। সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন শক্তিতেও পৃথিবী শাসন করতে শুরু করবে। আমি যে একটু আহত হয়েছি, বুঝতে পারলেন মিসেস হিথ। মিষ্টি হেসে বললেন,

- দুঃখ পেলে? আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং। মানুষ ছোট হয় তার আচরণে, আকারে নয়।

- কোন হাসপাতালে পোস্টিং তোমার ?

এবার জানতে চাইলেন মিঃ হিথ। বুঝলাম, বিচক্ষণ মানুষ, কথার মোড় ঘুরাতে চাইছেন।

- মাত্র কাল এসেছি তোমাদের দেশে। টাওয়ার ব্রিজ দেখতে এসেছি।

- দেখেছ?

- না। লন্ডন ব্রিজ দেখে এলাম। এখন যাব।

- গ্রেট। এসো, টাওয়ার ব্রিজ নিয়ে তোমাকে মজার কিছু গল্প বলি।

আমি উৎসাহী হয়ে উঠলাম। এই তো চাইছিলাম। কোনো ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ব্যাপারে পেশাদার গাইড যা বলে কিংবা গাইড বইতে যা লেখা থাকে, তা অধিকাংশেই অতিরঞ্জিত কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট। তাই আমি স্থানীয় মানুষের কাছ থেকেই ইতিহাসটা জানার চেষ্টা করি। হিস্ট্রির প্রফেসর, আমার ব্রিটিশ নন্দিনী তো ঘোড়া দাবড়ে চলে গেলেন। হয়ত এই বৃদ্ধ টাওয়ার ব্রিজ নিয়েও কোনো আজব কাহিনী শোনাতে পারবেন। আমি রেলিঙে হেলান দিয়ে হিথ দম্পতির দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। মিঃ হিথ প্রথমেই জানতে চাইলেন,

- এর নাম টাওয়ার ব্রিজ কেন জানো?

এই ব্যাটাও কি ইতিহাসের মাষ্টার নাকি? প্রথমেই প্রশ্ন করা শুরু করলেন! মনে মনে বললাম, হু হু, এইবার আর আমারে ধুর বানাইতে পারবা না। এইটা একটা প্রশ্ন হইল? পাগলেও জানে। বেশ কনফিডেন্সের সাথে জবাব দিলাম,

- কেন? দুটো বড় বড় টাওয়ারে ব্রিজটা ঝুলছে বলে।

- ভুল।

ভুল ? যাহ বাবা, আবার ধরা খাইলাম? আসলেই এখন নিজেকে ইতিহাসে পাতিহাঁস বলে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঝাঁপ দিই টেমসের জলে। যেই টাওয়ার ব্রিজকে লন্ডন ব্রিজ ভাইবা ভুল করলাম, সেই টাওয়ার ব্রিজের নামও টাওয়ারের নামে না? জিজ্ঞেস করলাম,

- তাহলে ?

- ব্রিজের কাছে গেলেই দেখতে পাবে। নদীর এ পাড়ে আছে এক হাজার বছরের পুরনো এক দুর্গ। একাদশ শতাব্দীতে রাজা উইলিয়াম নরমানডি ইংল্যান্ড দখল করার পর নিজের জন্য বানিয়েছিলেন। অনেক উঁচু বলে নাম দিয়েছিলেন টাওয়ার অফ লন্ডন। সেই থেকে প্রায় পাঁচশ বছর ওটাই রাজা রাণীদের প্রধান প্রাসাদ ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে টিউডাররা ক্ষমতায় আসার পর এর গুরুত্ব কমতে থাকে। তবে টাওয়ার অফ লন্ডন আগের মতোই আছে। সেই টাওয়ার অফ লন্ডনের প্রবেশ মুখের কাছে ব্রিজটা বলেই নাম টাওয়ার ব্রিজ। শুধু তাই নয়, ব্রিজের টাওয়ারের যে ডিজাইন দেখছ, তাও টাওয়ার অফ লন্ডনের মতো গথিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি।

- ওয়াও। অনেক ধন্যবাদ মিঃ হিথ। তুমি না বললে হয়ত আমার ধারণাটা ভুলই থেকেই যেত।

- শুধু তুমি নও। বর্তমান প্রজন্মের অনেক ব্রিটিশরাও এই ভুল ধারণা পোষণ করে।

মনে মনে ভাবলাম, যাক, তাহলে ধুর আমি একা না। আরও অনেকে আছে! জিজ্ঞেস করলাম,

- এই যে দিনের মধ্যে এতবার ব্রিজটা দুই ভাগ হয়ে যায়, কখনও কোনো এক্সিডেন্ট হয় না?

- একেবারে যে হয়না, তা নয়। তবে ব্রিটিশরা নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব সতর্ক। ব্রিজের গোঁড়ায় লোহার গেট আছে। সিগনাল আছে। সিগনাল ম্যান আছে। অনেকটা রেল ক্রসিঙের মতো। তারপরও একবার কী হয়েছিল শোনো। ১৯৫২ সালের ঘটনা। জাহাজ কাছে এসে গেছে। ব্রিজ তখন ফাঁকা। গেট-ম্যান ভুল করে আগে ব্রিজ খোলার সিগনাল দিয়ে তার পর রাস্তার গেট বন্ধ করতে গেল। এর মধ্যে একটা ডাবল ডেকার বাস রেড সিগনাল খেয়াল না করেই ব্রিজে উঠে পড়েছে। ওদিকে ব্রিজের পাল্লা উপরে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। বাস তখন তার নিয়মিত স্পিডে। ব্রেক কষে ব্যাক গিয়ার দিতে গেলে বড়সড় এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। ড্রাইভার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাসের গতি বাড়িয়ে দিল এবং সিনেমার স্টান্টের মতো তিন ফুট গ্যাপ লাফ দিয়ে ছয় ফুট নীচে অন্য পাশের পাল্লায় যেয়ে পড়ল। যেটা তখনও উঠতে শুরু করেনি। বাসের যাত্রীদের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও কন্ডাকটরের একটা ঠ্যাং ভেঙ্গে গিয়েছিল।

- মাই গড! পরে সেই ড্রাইভারের কোনো শাস্তি হয়েছিল ?

- আরে নাহ। উল্টো ড্রাইভারকে তার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্য দশ পাউন্ড, মানে এক দিনের বেতন পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল। তবে এক পাইলটের শাস্তি হয়েছিল।

- সেও কি প্লেন নিয়ে ব্রিজে উঠে পড়েছিল?

- অনেকটা সেই রকমই। যদিও ১৯১২ সালে একজন পাইলট ছোট ফ্লোট প্লেন (Float Plane) নিয়ে টাওয়ার ব্রিজের ভেতর দিয়ে উড়ান দিয়েছিল এবং এই স্টান্টবাজীর জন্য রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে গিয়েছিল। কিন্তু তার ছাপ্পান্ন বছর পর ১৯৬৮ সালে যা ঘটল, সেটাকে স্টান্টবাজী না বলে সুইসাইড এটেম্পট বলাই ভালো। রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলট, এলান পোলোক, একটা হকার হান্টার ফাইটার জেট নিয়ে কোনো রকম পূর্ব অনুমতি ছাড়াই তিনশো মাইল বেগে ব্রিজ আর ওয়াক ওয়ের ভেতর দিয়ে উড়ে গেল। ভাবতে পারো? অত স্পিড নিয়ে যদি ব্রিজে আঘাত করত, টুইন টাওয়ারের মতো প্লেন, পাইলট, ব্রিজ, সব ধ্বংস হয়ে যেত। সে হয়ত ভেবেছিল, রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে তার এই হিরোইক এটেম্পটের জন্য কমিশন দেয়া হবে। উলটো বেচারার কোর্ট মার্শাল হয়ে গেল। কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল!

- আহারে, বেচারা!

- বেচারা শুধু সে একাই না ডক্টর। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকেও একবার বেচারা হতে হয়েছিল।

- বল কী ? আমেরিকার প্রেসিডেন্টও কি আমেরিকান ব্যবসায়ী ম্যাককুলকের মতো টাওয়ার ব্রিজ কিনতে চেয়েছিল?

- আরে নাহ। তবে টাওয়ার ব্রিজের ইতিহাসে এটাই হয়ত সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ইংল্যান্ড এসেছিলেন স্টেট ভিজিটে। তো, প্রথা অনুযায়ী একদিন প্রাইমিনিস্টার টনি ব্লেয়ারের সাথে “টেমস সাইড লাঞ্চ” করতে গেলেন নদীর ওপারে। তুমি হয়ত জানো না, ব্রিটিশরা সময়ের ব্যাপারে খুব টনটনা। লাঞ্চ শেষ করে টনি ব্লেয়ার তাঁর গাড়ির বহর নিয়ে ঠিক সময় মতোই বের হলেন। কিন্তু একটু অলস কিসিমের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট দেরি করে ফেললেন। এদিকে ক্রুজ শিপ গ্লাডিসও তার জন্য নির্ধারিত সময়ে ব্রিজের কাছে এসে হাজির। টাওয়ার ব্রিজের কাছে ওয়াটার ট্রাফিক সব সময়েই রোড ট্রাফিকের উপর প্রাধান্য পায়, তা রোডে আমেরিকার প্রেসিডেন্টই থাক বা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীই থাক। মিঃ ব্লেয়ার ব্রিজ পার হতে পারলেও দেরি করে আসা প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন পারলেন না। তাকে গাড়ি নিয়ে পাক্কা বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ভাবতে পারো ? পৃথিবীর সব চেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিরাপত্তা নিয়ে ব্রিটিশ সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের কতটা উৎকণ্ঠায় কেটেছিল ঐ বিশ মিনিট !

আসলেই ভাবতে পারছিলাম না। আমাদের দেশে যেখানে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, পাতি-মন্ত্রী উপ-মন্ত্রীদের জন্যও রাস্তা ব্লক করে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে অপেক্ষা করানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন করলাম,

- পরে এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি? যত যাই বলো, “বিশ্ব-মোড়ল” বলে কথা!

- ঝামেলা হবে কেন? আইন সবার জন্য সমান। সে আমেরিকার প্রেসিডেন্টই হোক আর খেয়া নৌকার মাঝিই হোক। তাছাড়া বেচারা ব্রিজ মাস্টার কেমন করে জানবে, তোমার ঐ “বিশ্ব-মোড়ল” সময়ের ব্যাপারে এত ক্যালাস?

সময় নিয়ে কথা হচ্ছিল বলেই কিনা জানি না, আমিও হাত উল্টে ঘড়িতে সময় দেখলাম। মিঃ হিথও জানেন না, ব্রিটিশদের মতো আমিও পয়সা আর সময়, দুটোই খুব হিসেব করে খরচ করি। আমার কেবলই মনে হয়, আঙ্গুলের ফাঁক গলে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে সময়। একমাত্র গোসল করা ছাড়া কখনও হাতের ঘড়ি খুলি না। মিনিটে মিনিটে সময় দেখি। এমনকি ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শোয়ার সময়ও ঘড়ি দেখি। আর ভাবি, কতটা সময় গেল আর কতটা সময় বাকি ? আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে মিঃ হিথ বলে উঠলেন,

- তোমার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাও, আমাদের ঐতিহ্যকে দেখে নাও।

আসলেই টাওয়ার ব্রিজ তখন বাসর ঘরে বসে থাকা নববধূর মতো ডাকছে আমাকে। ডাকছে দুহাত মেলে তার ঐশ্বর্য আর সৌন্দর্যের রহস্য নিয়ে। তবে বললাম,

- না না, ঠিক আছে। ঘড়ি দেখা আমার একটা মুদ্রা দোষ। হাতে আমার অফুরন্ত সময়। আচ্ছা, বলো তো, ব্রিজের দোতলায় ঐ যে হাঁটার রাস্তা, ওখানে ওঠা যাবে ?

- কেন যাবে না ? নিশ্চয়ই যাবে। জাহাজ পার হওয়ার সময় পথচারীদের যাতে অপেক্ষা করতে না হয়, সেই জন্যই তো বানানো হয়েছিল ঐ ফুট ব্রিজ। তবে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত, বাহাত্তর বছর ঐ ফুট ব্রিজ বন্ধ ছিল।

- কেন?

- দূর থেকে দেখে হয়ত টাওয়ার ব্রিজকে তত উঁচু মনে হচ্ছে না। আসলে ফুট ব্রিজ পানির পৃষ্ঠ থেকে একশো তেতাল্লিশ ফুট উঁচুতে। মানে দশ তলা বিল্ডিঙের সমান। তখত তো আর লিফট ছিল না। দুশোর উপরে সিঁড়ির ধাপ ভেঙ্গে উঠতে হত। অত কষ্ট করে উপরে উঠে পার হওয়ার চাইতে পথচারীরা বিশ ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতেই বেশি পছন্দ করত।

- তাই বলে বন্ধ করে দেবে ?

- বন্ধ অবশ্য সে জন্য করেনি। মানুষ তো পারাপারের জন্য ফুট ব্রিজ তেমন একটা ব্যবহার করত না। তবে নির্জন সেই ফুট ব্রিজ বারবনিতাদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছিল। মানুষ উপরে উঠে দিনে দুপুরে সেক্স করত। শুধু তাই নয়, চোর বদমাশ, পকেটমারদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গিয়েছিল। একসময় টাওয়ার ব্রিজ লন্ডনের সাব চেয়ে খারাপ জায়গা বলে খ্যাতি লাভ করেছিল। নিরাপত্তার খাতিরেই বন্ধ করে দেয়া হয়।

- তাহলে আবার খুলে দিল কেন? নাহয় বুঝলাম, ব্রিটেনে চোর বদমাশ কমে গেছে। তাই বলে কি তোমরা কি সেক্স করাও কমিয়ে দিয়েছ?

বলে আমি হেসে উঠলাম। এতক্ষণের আলাপচারীতায় বুঝে গেছি, ভীষণ খোলা মানুষ এই হিথ দম্পতি। বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন বৃদ্ধ হিথও। দেখি মুখ লুকিয়ে হাসছেন বৃদ্ধাও। কে জানে, হয়ত যৌবনের উদ্দাম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে মার্গারেট হিথের। হাসতে হাসতেই বললেন মিঃ হিথ,

- আরে নাহ। ওটা কি আর ছাড়া যায়? ও আমাদের রক্তে মাংসে মিশে আছে। আমাদের সময় যাও একটু লজ্জা শরম ছিল, সেক্সের জন্য একটু আড়াল, একটু ফাঁক ফোঁকর খুঁজতাম। এখনকার ছেলে মেয়েরা অনেক সাহসী। হাঁস মুরগীর মতো যেখানে সেখানে হামলে পড়ে। আসলে, চাইলেও এখন আর ফুট ব্রিজে ওটা করতে পারে না। ব্রিজের অনেকখানি ফ্লোর এখন পরিষ্কার কাঁচের। নীচ থেকে সব দেখা যায়। তার উপরে পুরাটা পথ সিসি ক্যামেরার অধীনে। কেউ নিশ্চয়ই পর্ণ ছবির মডেল হওয়া পছন্দ করবে না?

- আহ, জিম। কী বলছ তুমি এসব ছেলেটাকে ?

মিঃ হিথকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললেন মিসেস হিথ। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে বৃদ্ধ বেশ উৎসাহ বোধ করছেন। এই বয়সে আলোচনা ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন? এ যেন দুধের সাধ ঘোলে মিটানো নয়, অনেকটা পানিতে মেটানোর মতো! আমি কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে থাকি আর এই দুই বুড়া বুড়ির অম্ল মধুর সম্পর্ক উপভোগ করতে থাকি। বুড়ির খোঁচা খেয়েই কিনা জানি না, বুড়ো রমণ কাহিনীতে লাগাম টানলেন। বললেন,

- যাও। তোমাকে আর আটকে রাখব না ডক্টর। এখন ফুট ব্রিজে ওঠার জন্য লিফট লাগানো হয়েছে। উঠতে কষ্ট হবে না। পুরো ওয়াক ওয়েকে এক্সিবিশন সেন্টারের মতো করা হয়েছে। অনেক টুরিস্ট আসে দেখতে। একটা টোকেন মানি দিয়ে টিকেট কেটে উপরে উঠে লন্ডনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে।

এখানেও পয়সা? শালার বাইন্যার জাত। সারা পৃথিবীর রক্ত চুইষাও তগো মন ভরে নাই? আমাগো দ্যাশ থেইক্যা সব সম্পদ লুট কইরা আইনা আমাগো দেখাইয়াই আবার পয়সা লুটবার চাইস? তবে কেন জানি না, টিকেট কাটার নাম শুনেও টাওয়ার ব্রিজকে দেখার উৎসাহে তেমন ভাটা পড়ল না আমার। এ যেন বাসর ঘরে নববধূর মুখ দেখার আগে মোহরানা আদায় করার মতো। শুধু জানি না, সেই মোহরানার পরিমাণ কত হবে। অজান্তেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,

- টিকেটের দাম কত?

- বেশি না। মাত্র দশ পাউন্ড।

এহ! বেশি না, মাত্র দশ পাউন্ড! ব্যাটা জানোস, দশ পাউন্ডে কত টাকা হয়? পুরা এক হাজার টাকা! আমাগো দ্যাশে একটা গরীব পরিবারের পুরা এক মাসের কাঁচা বাজার হয়ে যায়। কী আর করা? পড়েছি মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে এক সাথে! যে দেশে দুই পিস রুটি আর এক কাপ কফির দাম পাঁচ পাউন্ড, সেখানে টাওয়ার ব্রিজের মতো নান্দনিক স্থাপত্য দেখতে দশ পাউন্ড তো লাগবেই। বিশেষ করে সে স্থাপত্য যদি হয় এত রহস্যময়, এত রোমাঞ্চকর। ঠিক করলাম, লাগে লাগুক মোহরানা এক হাজার টাকা, বঁধুয়ার ঘোমটা আমি তুলবই। বললাম,

- হ্যাঁ, যাব। যাবার আগে একটা কথা বলো তো, স্থলের, অন্তরিক্ষের কাহিনী তো বললে, জলে কিছু ঘটেনি? মানে কোনো জাহাজ ধাক্কাটাক্কা দেয়নি?

- দিয়েছিল না? তবে এখানেও কালপ্রিট একজনই। এক স্প্যানিশ কার্গো জাহাজ লন্ডনে সবজি নিয়ে আসত। বেটি দশ বছরে তিন তিন বার টাওয়ার ব্রিজকে গুঁতা মেরেছিল। যদিও ব্রিজের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে লন্ডন পুলিশ তাদের রিপোর্টে লিখেছিল, “গুঁতা মারাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে!”

শুনে আমি হেসে ফেললাম। বললাম,

- ভালো বলেছে। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, কয়লা যায় না ধুইলে, স্বভাব যায় না মরলে।

- ইউ মিন, এ লেপার্ড কান্ট চেঞ্জ ইটস স্পট?

- এক্সাক্টলি।
 
টেমস নদীর বাঁকে

পর্ব – ৬ (ট্র্যাজিক কুইন এ্যান বোলিন)



১৫২৫ সাল। হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস। জৌলুস, প্রাচুর্য আর চাকচিক্যে সব প্রাসাদের সেরা। রাজা অষ্টম হেনরি অনেক যত্নে তৈরি করেছেন নিজের বিলাসী জীবনের আয়েসি সময় কাটানোর জন্য। এখানে প্রায়ই জলসা বসে। গানের সুরে সুরে, নাচের তালে তালে শরাবের ফোয়ারা ছোটে।
তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন রাজা অষ্টম হেনরি। বরাবরের মতোই তাঁর হাতে লাল মদিরার পেয়ালা। দু’চোখে রঙ্গিন নেশা। গানের সুরে সুরে মাথা দোলাচ্ছেন। গান ভীষণ পছন্দ তাঁর। যেমন পছন্দ নারী ও শরাব। আসলে তাঁর তো রাজা হবারই কথা ছিল না। রাজা হবার কথা বড় ভাই আর্থারের। তাই পিতা রাজা সপ্তম হেনরি ছোটবেলা থেকেই দিয়ে রেখেছিলেন তাঁকে অবাধ স্বাধীনতা। নিতে হয়নি ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার কঠোর প্রশিক্ষণ। কিশোর হেনরি মেতে থাকতেন খেলাধুলায়, অশ্ব চালনায়, শিকার আর গান বাজনায়। তিনি নিজেও গান লিখতেন ও গাইতেন।
রাজা হবার আগেই হঠাৎ করে মারা গেল আর্থার। ১৫০৯ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে, রাজনীতি, কূটনীতি ও যুদ্ধবিদ্যায় অনেকটাই অপরিপক্ব হেনরি, রাজা অষ্টম হেনরি হিসেবে বসলেন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে। তখনকার দিনে ফ্রান্স, স্পেন ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ত্রিমুখী শত্রুতা লেগেই থাকত। রাজা সপ্তম হেনরি স্পেনের সাথে মিত্রতা করতে বড় ছেলে আর্থারকে বিয়ে দিয়েছিলেন স্পেনের রাজকুমারী ক্যাথরিন অব আরাগোনের সাথে। সেই মিত্রতা বজায় রাখতে রাজা অষ্টম হেনরিও বিয়ে করতে চাইলেন রাজকুমারী ক্যাথরিনকে। কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করা বৈধ নয়। তখন খৃস্টান ধর্মীয় বিধানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রোমের পোপ। রাজা পোপের কাছে এই বিয়ের বৈধতার জন্য ডিক্রির আবেদন করলেন। রোম তখন স্পেনের অধীনে। যুগে যুগে রাজা বাদশাহদের ইচ্ছায় ধর্মের বিধানে এসেছে পরিবর্তন। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। দুই রাজাকে সন্তুষ্ট করতে পোপ ডিক্রী জারী করলেন, যেহেতু আর্থার ও ক্যাথরিনের বিয়ে নাবালক বয়েসে হয়েছিল এবং তাদের কোনো দৈহিক সম্পর্ক হয়নি, সেই বিয়ে কার্যত বাতিল বলে গণ্য করা হল। হেনরির ক্যাথরিনকে বিয়ে করতে আর কোনো বাঁধা থাকল না।
ষোলো বছরের বিবাহিত জীবনে রাণী ক্যাথরিন রাজাকে তিনটি পুত্র ও তিনটি কন্যা সন্তান উপহার দিলেন। কিন্তু একমাত্র কন্যা মেরি ব্যতীত সবাই হয় মৃত জন্ম নেয় কিংবা জন্মের পরপরই মারা যায়। ছয় ফুট দীর্ঘ, সুঠাম দেহ, রোমান্টিক মন আর অনেকটা কামুক স্বভাবের অধিকারী রাজা অষ্টম হেনরি। রাজনৈতিক কারণে বিয়ে করা তার চাইতে ছয় বছরের বড়, রাণী ক্যাথরিনের প্রতি রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার জন্ম দেয়া ছাড়া তেমন কোনো আকর্ষণ ছিল না। “এক পুরুষ, এক নারী” নীতিতে বিশ্বাসী খৃষ্টান ধর্মে এক স্ত্রী থাকতে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করার কোনো উপায় নেই। কট্টর ক্যাথোলিক রাজা হেনরি নিজেও এই নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু রাজা বাদশাহদের জন্য হেরেমে কিংবা হেরেমের বাইরে অন্য নারীর সাথে প্রেম ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে কোনো বাঁধা নেই। বিয়ের পরের বছর থেকেই রাজা একাধিক নারীতে আসক্ত হয়ে পড়লেন।
হেরেমে অনেক সুন্দরী নারীদের রাণীর পরিচারিকা বা “মেইড অব অনার” হিসেবে চাকরি দেয়া হত। রাণীর পরিচারিকা হলেও তারা মূলত রাজারই মনোরঞ্জন করত। মজার ব্যাপার হল, এই সব মেইড অব অনাররা মোঘল হেরেমের মতো দাসী বাঁদির মতো না। তারা ছিল উচ্চ শিক্ষিতা এবং বড় বড় রাজ কর্মচারী কিংবা আর্ল, ডিউক, লর্ডদের কন্যা। শুধু তাই নয়, মেইড অব অনার হয়ে তারা নিজেদের সম্মানিত ও ধন্য মনে করত।
কী রাজকুমারী, কী ঘুঁটেকুড়ানি, জন্মের পর থেকেই যুগ যুগ ধরে মেয়েদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দেয়া হত যে, নারীর জন্মই হয়েছে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। স্বামীর দাসত্ব করার জন্য। স্বামীরা ছিল স্ত্রীদের শরীর ও সকল সম্পদের একচ্ছত্র অধিকারী। বিয়ের পর স্ত্রী পরকীয়া প্রেম কিংবা অন্য পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে এবং তা প্রমাণিত হলে শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। অথচ একই অপরাধে স্বামীদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান ছিল না। আর রাজা বাদশাহ হলে তো কথাই নেই। রানী ক্যাথরিনও জানতেন রাজার এই বহু নারীর প্রতি আসক্তির কথা। কিন্তু বাঁধা দিতেন না কিংবা বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা ছিল না।
সব রাজার মতোই রাজা হেনরি খুব করে চাইতেন, তাঁরও একজন সুস্থ সবল পুত্র উত্তরাধিকার হোক। কিন্তু রানী ক্যাথরিন বারবার রাজার এই ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। অথচ ইতোমধ্যেই রাজা হেনরি বেসি ব্লাউন্ট নামে এক রক্ষিতার গর্ভে এক জারজ পুত্রের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন। তিনি বুঝে গেলেন, পুত্র জন্ম দেয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। এ শুধুই রানী ক্যাথরিনের অক্ষমতা, যে তাঁকে জীবিত পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারছে না। এই জন্য প্রায়ই তাঁর খুব মন খারাপ থাকে। সারাক্ষণ শরাবে আর নারীতেই ডুবে থাকেন। আজও ডুবে আছেন। পাশে বসা তাঁর বর্তমান রক্ষিতা, মেরি বোলিন। থেকে থেকে পূর্ণ করে দিচ্ছে মদের পেয়ালা।
হঠাৎ তাঁর নেশায় বোজা চোখ আটকে গেল এক যুবতীর শরীরে। ছিপছিপে লম্বা, লতানো শরীর, উন্নত বুক, ক্ষীণ কটি, ভারি নিতম্ব। শরীরে লতার মতোই ঢেউ তুলে নাচছে সে ডান্স ফ্লোরে। রাজার নেশা টুটে গেল। বহুদিন এমন আকর্ষণীয় রমণী দেখেননি তিনি। চনমন করে উঠল রক্ত। বুকে ডাকল কামনার বান। তিনি মেরির কানে কানে জানালেন তাঁর বাসনার কথা। শুনে চমকে উঠল মেরি। মেয়েটি আর কেউ নয়, তারই আপন ছোট বোন, এ্যান বোলিন! কী করে বলবে সে ছোট বোনের কাছে তারই প্রেমিকের বাসনার কথা? কিন্তু রাজার আদেশ অমান্য করার প্রশ্নই ওঠে না। যথা সময় পৌঁছে গেল রাজার পয়গাম এ্যানের কাছে।
মেরি ও এ্যানের পিতা, স্যার থমাস বোলিনও একজন উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারী এবং কূটনীতিবিদ। ছোট মেয়ে এ্যানকে ফ্রান্সে রেখে করেছেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতা। তখন ইউরোপে প্রটেস্টান্ট রেনেসাঁর হাওয়া বইছে। সে হাওয়া লেগেছে এ্যান বোলিনের গায়েও। হয়ে উঠেছে স্বাধীনচেতা, আত্ম-সচেতন, ব্যক্তিত্বশালিনী। ক্যাথোলিক মেয়েদের মতো মেরুদণ্ডহীন নয় সে মোটেই। শিক্ষা জীবন শেষ করে যোগ দিয়েছে রাজ প্রাসাদে মেইড অব অনার হিসেবে। এ্যান ছিল নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে ভীষণ রকমের সচেতন। ছিল নাচ, গান, বাজনায় পারদর্শী। আড়ম্বরপূর্ণ পোশাক, মার্জিত স্বভাব আর বুদ্ধিমত্তার জন্য খুব দ্রুত সে হয়ে হয়ে উঠল অনেক নামী দামী পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কবি, গায়ক, আর্ল, ডিউক, মন্ত্রী, আমলা, সবাই তাকে পাবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত সম্রাট নিজেও এই দলে যোগ দিলেন।
এ্যানকে আনা হল সম্রাটের খাস কামরায়। এ্যান জানত বোন মেরির সাথে রাজা হেনরির অবৈধ সম্পর্কের কথা। অথচ মেরি বিবাহিতা এবং দুই সন্তানের মা। সেই দুই সন্তান রাজা হেনরির কিনা, তা নিয়েও কানাঘুষা শুনেছে হেরেম। বিবাহিতা হয়েও অন্য পুরুষের সাথে ব্যভিচারের জন্য নিশ্চিত তার মৃত্যুদণ্ড হবার কথা। কিন্তু সম্রাটের ব্যভিচার করলে সাত খুন মাফ। তাছাড়া কার এত সাহস যে সম্রাটের দিকে আঙ্গুল তুলে অভিযোগ করবে? এ্যানের বুঝতে অসুবিধা হল না, কেন তাকে ডেকেছেন সম্রাট। কিন্তু এ্যান ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। বাগানে ফোটা সব চাইতে সুন্দর আর আকর্ষণীয় ফুল হওয়া সত্ত্বেও অতি যত্নে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে মাধুকরী সব ভ্রমরের হুল থেকে। সে জানে, ফুলের প্রতি মধু লোভী ভ্রমরদের আকর্ষণ হুল ফোটানো পর্যন্তই। একবার মধু খাওয়া হয়ে গেলে বাসি ফুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেরি করবে না। এ্যান বোলিন তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিলো।
ইংল্যান্ডের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট, রাজা অষ্টম হেনরি যখন হাঁটু গেঁড়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রেম নিবেদন করলেন, এ্যান তখন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শান্ত কণ্ঠে বলল,
- মাই লর্ড, ঈশ্বর আপনাকে আমাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এই পৃথিবীতে আপনার ইচ্ছাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি অতি নগণ্য এক নারী। আমি যে আপনার নজরে এসেছি, এতেই নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, একজন রাজার অবৈধ রক্ষিতা হওয়ার চাইতে একজন প্রজার বৈধ স্ত্রী হতে আমি বেশি পছন্দ করব।
একজন সামান্য পরিচারিকা হয়ে রাজার প্রত্যাশার এমন প্রত্যাখ্যান? না শুনতে অভ্যস্ত নন রাজা অষ্টম হেনরি। অথচ কেন জানি অবাধ্য এই মেয়েটির অহংকার দেখে ক্রুদ্ধ হতে পারলেন না। বরং মেয়েটির এই বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে চমৎকৃত হলেন। তাঁর আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। পাকা শিকারি রাজা হেনরি। যে হরিণী সহজে ধরা দেয় না, তাকে বধ করতেই তো বেশি মজা, বেশি উত্তেজনা। গোঁফের নীচে মুচকি হেসে বললেন,
- বেশ, রাজার রক্ষিতা না হও, রাজার উপঢৌকন গ্রহণ করতে তো কোনো বাঁধা নেই?
প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়ে এ্যান বোলিন। পুরুষের দৃষ্টি সে চেনে। সম্রাটের চোখের ভাষা পড়তে তার অসুবিধা হল না। সেও চালাক শিকার। বুঝতে পারল, সঠিক পথে এগুতে পারলে একদিন সে পৌঁছে যাবে সম্রাটের পাশের ঐ সুউচ্চ আসনে। রাজার উপহার প্রত্যাখ্যান করার মতো বোকামি সে করল না।
পঁয়ত্রিশ বছরের হেনরি কম নারীর সংস্পর্শে আসেননি। এমন আত্ম-সচেতন আর আত্মাভিমানী নারীর দেখা পাননি এখনও। প্রেমিক পুরুষ হেনরি এ্যান বোলিনের প্রেমে পড়ে গেলেন। তিনি নিয়মিত ব্যবধানে প্রেমপত্র ও দামী দামী উপহার পাঠাতে শুরু করলেন। বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। কিন্তু এ্যানের অনড় মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না। তার শরীর শুধু তার বৈধ স্বামীই পাবে, অন্য কেউ নয়। সম্রাটের জেদ চেপে গেল। যে কোনো মূল্যে এ্যানকে তাঁর চাইই চাই। কিন্তু কী ভাবে? ঘরে তাঁর স্ত্রী রয়েছেন। তাঁকে তালাক না দিয়ে এ্যানকে বিয়ে করা যাবে না। কিন্তু রানী ক্যাথরিনকে তালাক দেবেন কোন অজুহাতে? রানীর চরিত্রে কোনো কলুষতা ছিল না। তাছাড়া যে সে মেয়ে নয় ক্যাথরিন। স্পেনের রাজকন্যা। তাঁর চাচাত ভাই, রাজা পঞ্চম চার্লস তখন স্পেনের সিংহাসনে। ক্যাথরিনের প্রতি কোনো অন্যায় সে বরদাশত করবে না।
একমাত্র উপায় ধর্মীয় বিধান দিয়ে এই বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করা। আর তখনই তাঁর মনে হল, ঈশ্বর তাঁর উপর রুষ্ট হয়েছেন। আপন ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করে তিনি ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘন করেছেন। নিশ্চয়ই ক্যাথরিনের সাথে তাঁর প্রথম স্বামী আর্থারের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। নইলে ঈশ্বর তাঁকে পুত্র সন্তান থেকে বারবার বঞ্চিত কেন করছেন? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, এতগুলো বছর তিনি এক অবৈধ বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে আছেন। এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে তিনি ইংল্যান্ডের আর্চবিশপকে পাঠালেন পোপের কাছে এই আবেদন নিয়ে যে, তাদের বিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের বিধান অনুযায়ী হয়নি। এই বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করা হোক।
রোমের পোপ, সপ্তম ক্লেমেন্ট, একবার স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লসকে রুষ্ট করে কিছুদিন কারাগারে কাটিয়েছেন। স্পেনের রাজকুমারীর প্রতি অন্যায় করে আবার কারাগারে যাবার ইচ্ছা তাঁর মোটেও নেই। পোপ রাজা হেনরির এই অন্যায় আবদারকে সরাসরি নাকচ করে দিলেন।
এদিকে প্রটেস্টান্ট আন্দোলনের ছোঁয়া তখন ইংল্যান্ডের মাটিতেও লেগেছে। এক সময় ঘোর প্রটেস্টান্ট বিরোধী ছিলেন রাজা হেনরি। পোপ, দ্বিতীয় জুলিয়াস, কঠোর ক্যাথোলিক অনুসারী হিসেবে রাজা হেনরিকে “ডিফেন্ডার অব ফেইথ” বা বিশ্বাসের রক্ষাকর্তা উপাধিতে ভূষিতও করেছিলেন। সেই বিশ্বাসের রক্ষাকর্তা, শুধু মাত্র একজন নারীকে পাবার জন্য ক্যাথলিক চার্চের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। তাঁর ভাষায়, চার্চের ধর্মযাজকের কোনো অধিকার নেই মাটির শাসনকর্তার ইচ্ছার (Kings Great Matter) বিরুদ্ধে যাবার। তিনি ভ্যাটিকানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ঘোষণা দিলেন, ইংলিশ চার্চকে আর রোমের অধীনে থাকার দরকার নেই। শুরু হল এ্যাঙ্গলিকান চার্চের সূচনা। যা প্রটেস্টান্ট ক্রিশ্চিয়ানটিরই একটি ধারা। আর রাজা হেনরি হলেন সেই চার্চের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
এদিকে এ্যানও বুঝতে পারল, তাঁকে পাবার জন্যই রাজা এত বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার মন গলে গেল। সেও রাজাকে ভালোবেসে ফেলল। রাজা প্রতিশ্রুতি দিলেন, রানী ক্যাথরিনকে পরিত্যাগ করে এ্যানকেই রানী বানাবেন। এই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতেই তারা ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা শুরু করল। এ্যান রাজার সাথে শিকারে যায়, ভ্রমণে যায়, শুধু বিছানায় যায় না। সমনে সুস্বাদু খাবার রেখে অভুক্ত থাকা রমণ বিলাসী রাজার জন্য প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তিনি ক্যাথরিনকে প্রাসাদে রেখেই গোপনে এ্যানকে বিয়ে করে ফেললেন। কথা ছিল, রাজার প্রথম বিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে অবৈধ ঘোষিত হবার পরই এই বিয়ে আনুষ্ঠানিকতা পাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এ্যান প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ল। বিয়ে গোপন রাখার আর উপায় থাকল না।
ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করল। রাজার তল্পিবাহক ইংলিশ চার্চের আর্চবিশপ, থমাস ক্র্যানমার, হেনরি ও ক্যাথরিনের তেইশ বছরের পুরনো বিয়েকে অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করলেন। আর তার মাত্র পাঁচদিন পরই হেনরি ও এ্যানের গোপন বিয়েকে ধর্মীয় বৈধতা দিলেন। ধুমধাম করে রাজা হেনরির এ্যানকে আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে করলেন।
হেনরি ও এ্যান প্রেমের সাগরে ভাসতে লাগলেন। রাজা ভেবেছিলেন, এই বিয়ে যেহেতু ঈশ্বরের বিধান মেনে হয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি পুত্র লাভে ধন্য হবেন। কিন্তু রাজাকে হতাশ করে দিয়ে নতুন রানীও তাকে একটি কন্যা সন্তান উপহার দিলেন। যে পরবর্তীতে রানী প্রথম এলিযাবেথ হিসেবে ইতিহাসখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু পুত্র লাভের চাইতেও বড় ব্যাপার ছিল, যে পুরুষ একবার বহু নারীর স্বাদ পেয়ে যায়, তার পক্ষে এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকা কঠিন। যে এ্যান বোলিনকে পাবার জন্য রাজা অষ্টম হেনরি দীর্ঘ আট বছর তপস্যা করেছিলেন। সমাজের সাথে, ধর্মের সাথে, তেইশ বছরের স্ত্রী ক্যাথরিন ও কন্যা মেরির সাথে করেছিলেন বিশ্বাসঘাতকতা। মাত্র এক বছরের মধ্যে সেই এ্যান বোলিনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। রানী এ্যান বোলিনেরই দুজন মেইড অব অনারের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লেন। তাদের মধ্যে একজন আবার “লেডি ইন ওয়েটিং”, অর্থাৎ সম্মানের দিক দিয়ে রানীর পরেই যার অবস্থান। রাণী ভাবলেন, একমাত্র একটি পুত্র সন্তানই হয়ত রাজাকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে। পরপর দু’বছর প্রেগন্যান্টও হলেন। কিন্তু বিধি বাম। দু’বারই গর্ভপাত হয়ে গেল। এদিকে “লেডি ইন ওয়েটিং” জেন সিমোরের সাথে রাজার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকল। এ্যান ক্যাথরিনের মতো নির্বিবাদী, পুরুষের একান্ত অজ্ঞাবহ নারী ছিলেন না। তিনি রাজার এই ব্যভিচার নীরবে মেনে নিতে পারলেন না। রাজার সাথে সম্পর্কের খুব দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করল। ফলে যা হবার তাই হল। বিধাতা নয়, রাজাই রানীর ভাগ্য লেখার কাজ শুরু করে দিলেন।
পৃথিবীর বুকে ঈশ্বর সমান ক্ষমতা প্রাপ্ত রাজারা চাইলে সব কিছুই করতে পারেন। চক্রান্তের জাল বিছানো শুরু হল। এক সময় এ্যান বোলিনের প্রতি যারা প্রেমে পাগল হয়েছিল, খুঁজে খুঁজে সেই সব হতভাগ্য প্রেমিকদের বের করা হল। একজন বিখ্যাত কবি, একজন নামকরা গায়ক ও দুজন পদস্থ রাজ কর্মচারীকে রানী এ্যানের সাথে ব্যভিচার ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের দায়ে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হল। এখানেই থেমে থাকলেন না রাজা হেনরি। এ্যানের আপন ভাই জর্জ বোলিনকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করলেন। ভাবা যায়? মানুষ কতটা নীচে নামলে আপন ভাইয়ের সাথে যৌন সম্পর্কের অভিযোগ তুলতে পারে ? জর্জ বোলিনকে বন্দী করে নিয়ে আসা হল এই টাওয়ার অব লন্ডনে।
হিথ দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসছিলাম টাওয়ার ব্রিজ দেখতে। ব্রিজের এপ্রোচ রোডের ডান পার্শেই প্রায় আঠেরো একর এলাকা জুড়ে চওড়া প্রাচীর ঘেরা টাওয়ার অব লন্ডন। একেবারে টেমসের কুল ঘেঁষে। ইতিহাস সব সময়েই আমাকে পিছু ডাকে। বিশেষ করে, প্রাণহীন এই সব রাজপ্রাসাদের ইট পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যেন অনেক প্রাণের কান্না আমি শুনতে পাই। প্রাসাদের অলিতে, গলিতে যেন অনেক অতৃপ্ত আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ্য করলাম, প্রাসাদের প্রাচীর ঘেঁষে বেশ কিছু মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। চুপচাপ শুনছে কিছু। আমি টাওয়ার ব্রিজের ঐশ্বর্যের কথা ভুলে গিয়ে পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি, একজন অতি উৎসাহী ইতিহাসবিদ কিংবা প্রত্নতত্ত্ববিদ, পর্দায় ছবি ফেলে বর্ণনা করছেন টাওয়ার অব লন্ডনের কলঙ্কিত ইতিহাস। আজকের বিষয়বস্তু রাজা অষ্টম হেনরি ও তার ছয় রানী। এতক্ষণ তন্ময় হয়ে তার কথাই শুনছিলাম।
প্রথম দিকে টাওয়ার অব লন্ডন ইংল্যান্ডের রাজার প্রধান বাসস্থান হিসেবে তৈরি হলেও ধীরে ধীরে আরও অনেক রাজপ্রাসাদ গড়ে ওঠে লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে। টাওয়ার অব লন্ডন পরবর্তীতে মূলত প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবেই ব্যবহৃত হত। এই দুর্গের ভেতরেই আছে মোট একুশটি টাওয়ার বা ভবন। এখানেই গচ্ছিত থাকত সব অস্ত্রশস্ত্র, গোলা বারুদ, টাকা পয়সা, ধন সম্পদ, রাজকীয় অলঙ্কার। আবার এখানেই সব রাজবন্দীদের আটক রাখা হত বিচারের আগ পর্যন্ত। প্রায় সবার কপালেই জুটত মৃত্যুদণ্ড। যা কার্যকর করা হত দুর্গের বাইরে টাওয়ার হিল নামে এক উন্মুক্ত স্থানে, জনসম্মুখে। সেই সব হতভাগ্য মানুষের খণ্ডিত মস্তক ঝুলিয়ে রাখা হত লন্ডন ব্রিজে। বিশেষ বিশেষ কারও মৃত্যুদণ্ড এই দুর্গের ভেতরেও কার্যকর হত।
তবে তখনও দুর্গের কেন্দ্রে অবস্থিত মূল প্রাসাদ, যাকে হোয়াইট টাওয়ার বলা হয়, রাজা রানীদের সরকারী বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত হত। বিশেষ করে রাজ্যাভিষেকের আগে রাজা কিংবা রানীকে এই হোয়াইট টাওয়ারে এসে থাকতে হত। স্থলপথ দিয়ে দুর্গে প্রবেশের জন্য পশ্চিম পার্শ্বে আছে এক সিংহ দুয়ার। তেরো শতাব্দীর শেষের দিকে রাজা প্রথম এডওয়ার্ড নদীপথে দুর্গে প্রবেশের জন্য তৈরি করেছিলেম আর একটা প্রবেশপথ। পরবর্তীতে যা ট্রেইটরস গেট বা বিশ্বাসঘাতকের দরজা নামে পরিচিতি পায়। কারণ সব বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী রাজবন্দীদের নৌকায় করে এই দরজা দিয়ে এনে টাওয়ার অব লন্ডনে বন্দী করে রাখা হত। একবার যারা এই দরজা দিয়ে ঢুকত, তারা বুঝে যেত, আর কোনোদিন তাদের এই দরজা দিয়ে বের হওয়া হবে না।
রানী এ্যান রাজার এই সব ষড়যন্ত্রের কথা কিছুই জানতেন না। তাকেও যখন এক সকালে ওয়েস্টমিনিস্টার প্যালেস থেকে রাজকীয় বজরায় করে ট্রেইটরস গেট দিয়ে টাওয়ার অব লন্ডনে নিয়ে আসা হল, তিনি ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দুর্গের প্রধান রক্ষক, উইলিয়াম কিংস্টনের কাছে জানতে চাইলেন, তাকে কেন এই দরজা দিয়ে ঢোকানো হয়েছে? জবাবে দুর্গ রক্ষক জানালেন, রাণীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার, একাধিক পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক ও রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। রাণী যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। যে রাজার জন্য এই শরীর শত পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, অন্য পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক তো দূরের কথা, রাজা ছাড়া কোনো পুরুষকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দেননি, সেই রাজাই তাঁর শরীরের করলেন এমন অপমান? আর রাজাকে হত্যার কথা তো সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। লজ্জায়, ঘৃণায় তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু ততদিনে রাণী জেনে গেছেন, রাজাদের কাছে প্রেম, ভালোবাসা, সততার কোনো মূল্য নেই। বুঝতে পারলেন, রাজা তাঁর জীবনের ফয়সালা করে ফেলেছেন।
অশ্রু সজল চোখে শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন রাণী,
- আমাকে কি অন্য বন্দিদের মতো গ্রিন টাওয়ারে (বন্দীদের কোয়ার্টার, যা পরে “ব্লাডি টাওয়ার” নামে পরিচিতি পেয়েছিল) থাকতে হবে?
- নো, ইয়োর হাইনেস। আপনি রাজকীয় ভবন “হোয়াইট টাওয়ারে”ই থাকবেন। যেখানে আপনি অভিষেকের আগে ছিলেন।
নিজের দুর্ভাগ্য দেখে নিজেরই হাসি পেল এ্যান বোলিনের। মাত্র তিন বছর আগে যে টাওয়ারে বসে রাণী হবার সুখ স্বপ্নে ঘুম আসত না তাঁর, সেই টাওয়ারে বসেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দুশ্চিন্তায় ঘুম আসবে না আর। সব আগের মতোই আছে। শুধু তাঁর গন্তব্যটাই বদলে গেছে। তবে মনে মনে রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন এই ভেবে যে, জীবনের শেষ ক’টা দিন রাজকীয় ভবনে থাকার সম্মানটুকু অন্তত তাকে দিয়েছেন!
তারপর আর মাত্র সতেরো দিন বেঁচে ছিলেন রাণী এ্যান বোলিন। বলা হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিলেন তাঁর নিয়তি। শান্ত আচরণ করতেন। কবিতা লিখতেন। গান গাইতেন। রাজার কাছে নিজে নির্দোষ বলে চিঠিও লিখেছিলেন। কোনো জবাব আসেনি। অবশ্য মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতায় চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসত।
ওয়েস্টমিনিস্টার প্যালেসে অভিযুক্ত সব পুরুষদের বিচারের প্রহসন মঞ্চস্থ হল। কোনো রকম বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই সবাই দোষী সাব্যস্ত হল। রাজার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। আর রাস্ট্রদ্রোহীতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। তাও যে সে মৃত্যু নয়। পুরুষ হলে, Hanging, Drawing and Quartering. অর্থাৎ দণ্ডপ্রাপ্তকে কাঠের গুড়ির সাথে বেঁধে ঘোড়া দিয়ে টেনে হেঁচড়ে বধ্যভূমিতে আনা হত। সেখানে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝোলানো হত কিন্তু মৃত্যুর আগেই নামিয়ে ফেলা হত। তারপর সেই মৃতপ্রায় মানুষটির যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হত। পেট চিরে সব নাড়িভুঁড়ি বের করা হত। তারপর শিরোচ্ছেদ। এখানেই শেষ নয়, মুণ্ড-বিহীন ধরটাকে চার ভাগে ভাগ করা হত। আর দণ্ডপ্রাপ্ত মানুষটি নারী হলে তাকে জনসম্মুখে পুড়িয়ে মারা হত।
শুনে আমার বমি চলে আসে। নিষ্ঠুরতারও একটা সীমা আছে। এই যে তথাকথিত ভদ্র ব্রিটিশ জাতি, যারা মানবতা আর মানবিকতার শ্লোগান তুলে গলায় রক্ত উঠিয়ে ফেলে, সারা পৃথিবীতে ন্যায় বিচারেরে ঝাণ্ডা উড়াতে চায়, তাদেরই পূর্বসূরিদের অন্যায়, অবিচার, মানবতার অপমান আর নৃশংসতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তারপরও, রাণী এ্যান বোলিনের মৃত্যু কী ভাবে হয়েছিল, জানার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম।
১৫ মে, ১৫৩৬। এই টাওয়ার অব লন্ডনেই রাণী এ্যান বোলিনের বিচারের নাটক মঞ্চস্থ হল। একই ভাবে তাকেও দোষী সাব্যস্ত করা হল। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই বিচারে, জুরিদের মধ্যে একজন তাঁর এক সময়ের গুণমুগ্ধ প্রেমিক হেনরি পার্সিও ছিলেন। জুরিদের সর্বস্মমতিক্রমে যখন রাণীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হল, হেনরি পার্সি তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর আর মাত্র আট মাস বেঁচে ছিলেন হেনরি পার্সি। রাণী এখানেও খুব শান্ত ভাবে সকল দোষ অস্বীকার করলেন কিন্তু রায় মেনে নিলেন। এ্যানের প্রতি রাজা হেনরির ভালোবাসা হয়ত তখনও কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। রাণীকে পুড়িয়ে মারার মৃত্যুদণ্ড লঘু করে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করার অনুমতি দিলেন। তাকে হোয়াইট টাওয়ার থেকে গ্রিন টাওয়ার বা ব্লাডি টাওয়ারে নিয়ে আসা হল।
আমি দম বন্ধ করে শুনছিলাম মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের এক নারীর জীবনের মর্মান্তিক ইতিহাস। তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল, তিনি রাণী তো হয়েছিলেন কিন্তু রাজাকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারেননি। রাজার সব অনাচার, ব্যভিচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে পারেননি।
১৯ মে, ১৫৩৬। সকাল। দুর্গ রক্ষক উইলিয়াম কিংস্টন রাণীর সাথে দেখা করতে এলেন। রাণী ম্লান হেসে বললেন,
- মি. কিংস্টন, শুনলাম, দুপুরের আগে আমার দণ্ড কার্যকর হবে না। আমার খুব খারাপ লাগছে। ভেবেছিলাম, এতক্ষণে আমি বোধহয় সব কষ্টের ঊর্ধ্বে চলে যাব।
- খুব বেশি কষ্ট হবে না, ইয়োর হাইনেস।
- আমি অনেক শিরোচ্ছেদ দেখেছি। কুঠার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। জল্লাদ যদি অভিজ্ঞ না হয়, আর কুঠার যদি ধারাল না হয়, তাহলে দশ এগার বার আঘাত করতে হয়। আমার যে খুব খাটো গলা মি. কিংস্টন! কী ভাবে পারবে?
- চিন্তা করবেন না ইয়োর হাইনেস। ফ্রান্স থেকে একজন অভিজ্ঞ তলোয়ার-বাজ (Swordsman) আনা হয়েছে। খুব তীক্ষ্ণ তার তরবারি। সামান্যই ব্যথা পাবেন।
- তাই যেন হয় মি. কিংস্টন, তাই যেন হয়!
পরে মি। কিংস্টন বলেছিলেন, আমি অনেক মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী দেখেছি। রাণীর মতো এমন অধীর হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে কাউকে দেখিনি।
কিছুক্ষণ পরে রাণীকে হোয়াইট টাওয়ারের সামনে বিশেষ ভাবে নির্মিত মৃত্যু মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হল। রাজকীয় পোষাকে, রাণীর মতোই মাথা উঁচু করে দু’জন পরিচারিকার হাত ধরে তিনি মঞ্চে উঠলেন। বেশ কিছু লোক জড় হয়েছে মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য। রাণী সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
- আমার প্রিয় ভালো মানুষেরা, তোমরা সবাই জান, কেন আজ এখানে এসেছি। আইন আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আমি ইংল্যান্ডের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। আমি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও জানাব না। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন সম্রাটকে রক্ষা করেন। যাতে সম্রাট দীর্ঘ সময় ধরে তোমাদের রক্ষা করতে পারেন। তিনি আমার দেখা একজন অন্যতম অমায়িক দয়ালু সম্রাট। তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। অনেক দয়া করেছেন। তিনি ছিলেন আমার কাছে এক সার্বভৌম ঈশ্বরের মতো। ব্যাস, এইটুকুই আমার বলার ছিল। আমি পৃথিবীর কাছে থেকে বিদায় চাইছি। আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় চাইছি। তোমরা আমার জন্য প্রার্থনা করো। হে আমার মানুষেরা, আমাকে বিদায় দাও। হে আমার ঈশ্বর, আমার উপর দয়া কর। হে আমার ঈশ্বর, আমাকে গ্রহণ কর। আমার আত্মাকে শুদ্ধ করে দাও।
রাণী হাঁটু মুড়ে মাথা উঁচু করে বসলেন। পরিচারিকারা তাঁর মাথার আবরণ খুলে দিল। তাঁর চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে দিল। রাণী বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, হে আমার ঈশ্বর, আমাকে গ্রহণ করো। হে আমার ঈশ্বর, আমার উপর দয়া করো। ফরাসি জল্লাদের এক আঘাতেই রাণীর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল। ভুল বলেছিলেন উইলিয়াম কিংস্টন, সামান্য ব্যথা নয়, কোনো ব্যথা অনুভব করার আগেই হয়ত রাণী স্বর্গে পৌঁছে গেলেন। তার সামান্য ফাঁক করা ঠোঁট দুটি তখনও কাঁপছে। হয়ত বলছেন, হে আমার ঈশ্বর, আমাকে গ্রহণ করো। হে আমার ঈশ্বর, আমার উপর দয়া করো।
আমি আর শুনতে পারলাম না। মাথাটা ঘুরে উঠল। এলোমেলো পায়ে আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে এলাম। বক্তা তখনও বলে চলেছেন। রাজা হেনরির আরও চার স্ত্রী ছিল...।
বাকি চার রাণীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা শোনার মতো ধৈর্য কিংবা রুচি, কোনোটাই আমার অবশিষ্ট ছিল না। আমি যেন তখনও শুনতে পাচ্ছিলাম, টেমসের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত রাণীর শেষ কথাগুলো, হে আমার ঈশ্বর, আমাকে গ্রহণ করো। হে আমার ঈশ্বর, আমার উপর দয়া করো...
 
টেমস নদীর বাঁকে

পর্ব-৭ (হৃদয়ে বাংলাদেশ)





এক সময় অনেকের মত আমিও ভাবতাম, কোনো মতে একবার ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় গিয়ে পড়তে পারলে হয়, বেহেশতের কাছাকাছি পৌঁছে যাব। সেখানে আকাশে বাতাসে পাউন্ড ডলার উড়ে বেড়ায়। ধরে ধরে শুধু পকেটে পুরব। যত খুশি তত। সুখ আর শান্তি কিনব ইচ্ছে মত। কিন্তু টাকা দিয়ে সব কেনা গেলেও সুখ যে কেনা যায় না, সেটা বুঝতে বেশী দেরি লাগল না।
যে দেশটিকে শুধু ইংরেজি সিনেমায় দেখেছি। যে দেশে আসার জন্য জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখেছি। সে দেশে প্রথম এসে, খানাখন্দ বিহীন রাস্তা, সেই রাস্তায় নিঃশব্দে চলা চকচকে গাড়ি, দুপাশে ছবির মত সাজানো গোছানো ঝকঝকে বাড়ি, মাটির নীচ দিয়ে উল্কার বেগে ছুটে চলা ট্রেনের সারি দেখে, কিছু দিন একটা ঘোরের মধ্যে কাটল আমার। আস্তে আস্তে সে ঘোর কাটতে থাকে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, যত বড়লোকই হোক, যত দামী গাড়িই থাকুক, এ দেশে যার গাড়ি সেই চালায়। বিশাল ম্যানশনে থেকেও যার রান্না সেই করে। যার কাপড় সেই ধোয়। প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই স্বামী স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয়। বাচ্চা বড় হয় চাইল্ড মাইন্ডারের কোলে কিংবা নার্সারিতে। এক এক জনকে এক এক শিফটে কাজ করে। দেখা সাক্ষাৎ হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে। এমনকি মিলনও হয় ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে। সেই জন্যই বুঝি এদের বাচ্চা কাচ্চাও এত কম।
রফিক ভাইয়ের বাসা হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায়। এখানে মূলত: বাংলাদেশীদের বাস। বাইরে বেরুলেই বোঝা যায়। রাস্তায় শুধু বাদামী চামড়া, সাদা চামড়া কদাচিৎ চোখে পড়ে। ফুটপাথে, দোকানের সামনে, মানুষগুলো দল বেঁধে আড্ডা মারে, পান খায়, সুযোগ বুঝে ছিঁড়িত করে এখানে সেখানে পিক ফেলে, চিৎকার করে কথা বলে। রোববার ছাড়া প্রতিদিন হোয়াইট চ্যাপেল টিউব স্টেশনের সামনের ফুটপাতে পশরা সাজিয়ে দোকান বসায়। মাছ, তরকারি, কাপড় চোপড়, এমন কি হাড়ি পাতিল পর্যন্ত পাওয়া যায়। দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায়। রাস্তাঘাট অন্য এলাকার মত ঝকঝকে তকতকে নয়। ঝরা পাতা, ছেঁড়া কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট, পড়ে থাকে অবহেলায়। দেখে মনে হয় যেন ব্রিটেনের ভেতর এক টুকরা বাংলাদেশ। হোম সিকনেস কাটাতে প্রায়ই আমি সেই এলাকায় এলোমেলো হাঁটি।এই হোয়াইট চ্যাপেলেই আছে লন্ডনের সবচে বড় মসজিদ, ইষ্ট লন্ডন মস্ক।
শুক্রবার। বাঙালি মুসলমান আমি। বারো মাসে তেরো পার্বণ দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাই, ব্যক্তিগত ইবাদত করি বা না করি, আনুষ্ঠানিক ইবাদতে উৎসাহ প্রচুর। ঈদের নামাজ, জুমার নামাজ, মুসলমানদের আনুষ্ঠানিক ভাবে দল বেঁধে আদায় করতে হয়। সেই জুমার নামাজ পড়তে গেলাম ইস্ট লন্ডন মসজিদে। নামাজ শেষে বাইরে বের হতেই দেখি, ফুটপাতে পড়ে আছে রাশি রাশি বাংলায় প্রকাশিত স্থানীয় পত্রিকা। যত খুশি নাও। বিনে পয়সায়। বিদেশের মাটিতে বাংলা পত্রিকা দেখে মনের জমিন এক পশলা সুখের বৃষ্টিতে ভিজে গেল। তাও ফ্রি। মসজিদের পাশেই একটা পার্ক। আমি গোটা দুই পত্রিকা নিয়ে পার্কের একটা বেঞ্চে বসলাম। ডুবে গেলাম বাংলায় লেখা বাংলাদেশের খবরে।
- আফনে কিতা এ দেশো নয়া আইছো নি?
চমকে তাকিয়ে দেখি, পাশে এসে বসেছেন বৃদ্ধমত এক ভদ্রলোক। ছোটখাটো মানুষটার দাড়ি চুল সব পাকা। থতমত খেয়ে বললাম,
- জি।
- আফনে কিতা বাঙ্গালী না সিলোটি?
প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেলাম। চাচা মিয়া কয় কী? সিলেটীরা কি বাঙালি না? নাকি সিলেট বাংলাদেশের বাইরে? পরে শুনেছি, বাংলাদেশী হয়েও সিলেটীরা নিজেদের আলাদা গোষ্ঠী মনে করে। শুধু সিলেটীরাই না, ব্রিটিশ সরকারও বাংলা ভাষার পাশাপাশি সিলেটী ভাষাকে আলাদা ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। ইষ্ট লন্ডনের সব সরকারী প্রতিষ্ঠানে নোটিশ বোর্ড, লিফলেট কিংবা কাগজপত্রে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা অক্ষরে সিলেটী ভাষায় লেখা থাকে। তখন তো অত কিছু জানি না। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
- বাঙ্গালী।
- ডাকাইয়া নি?
মর জ্বালা! সিলেটকে নাহয় বাংলাদেশের বাইরেই ভাবল, তাই বলে বাংলাদেশে ঢাকা ছাড়া আর কোনো জেলাও নাই নাকি? এবার আর বিরক্তি চেপে রাখতে পারলাম না। কাটা কাটা শব্দে বললাম,
- জি না চাচা, আমি খুলনার ছেলে।
আমার বিরক্তি সিলেটী চাচাকে স্পর্শ করল বলে মনে হল না। পানের পিকটা পেটে চালান করে দিয়ে, এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে বললেন,
- ও, তাইলে তো আফনে লিগাল নায়।
এ কোন জ্বালায় পড়লাম রে বাবা? সিলেটীরা বাঙালি না, ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশে কোনো জেলা নাই, সিলেটী ছাড়া এ দেশে আর কেউ লিগাল না, আমি কই যাই? রেগে মেগে জিজ্ঞেস করলাম,
- এ কেমন কথা? লিগ্যাল হব না কেন?
আমার বিরক্তি চরমে উঠিয়ে পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে অমায়িক হাসি হাসলেন চাচা মিয়া। আর একটু কাছে এগিয়ে এসে বসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
- বাতিজা, গোসসা খরো কেনে? তোমার লগে ফরিচয় খররাম বা। তুমি কিতা এ দেশো বিয়া খরইয়া আইছো নি কিতা?
বৃদ্ধের অমায়িক হাসি দেখে আমার রাগ পড়ে গেল। আহা, হয়ত দেশের ছেলে ভেবে একটু খোঁজ খবর নিচ্ছেন। মনে পড়ল, গ্রামে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেলে মুরুব্বীদের এমন কত প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। মনু ভাত খাইছো কী দিয়া? পড় কোন কেলাসে? তোমরা কয় ভাই বোন? তোমার মায়ে কেমন আছে ? ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রশ্নগুলো অমূলক হলেও থাকত মমতা আর আন্তরিকতায় ভরা। বুঝতে পারলাম, চাচা বিলেতে থাকলেও মনটা এখনও বাঙ্গালিই রয়ে গেছে। হেসে বললাম,
- জি চাচা, বিয়ে করে এসেছি।
- খার ফুড়ি (মেয়ে) বিয়া খরলাইন ? আমি তো হগগোল সিলোডিরে ছিনি।
- সিলেটে না চাচা। আমি খুলনায় বিয়ে করেছি।
- ও।
মনে হল, আমার উত্তর শুনে বৃদ্ধের উৎসাহে কিছুটা ভাঁটা পড়ে গেল। উনি ধরে নিয়েছিলেন, আমি কোনো সিলেটী ব্রিটিশকে বিয়ে করে ফ্যামিলি ভিসায় এসেছি!
অবশ্য চাচা মিয়াকে আমি দোষ দিতে পারিনা। বিলেতে বাংলাদেশী কমিউনিটি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা হয়েছে আমার। পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশী ব্রিটেনে বাস করে। তার নব্বই ভাগের উপর সিলেট অঞ্চল থেকে আসা। সম্ভবত উনিশ শতকের মাঝামাঝি, তখন সিলেট অঞ্চলের কিছু লোক ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে খালাসীর কাজ করত। তাদের দু একজন তখন লন্ডনে বসতি স্থাপন শুরু করে। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সিলেটীরা এদেশে আসতে শুরু করে। বিশ্ব যুদ্ধের সময় অনেক সিলেটী যুদ্ধ জাহাজে খালাসী (লস্কর) ও কুকের চাকরী নেয় এবং পরবর্তীতে লন্ডন ও অন্যান্য পোর্ট সিটিতে এসে থাকা শুরু করে। তাদের কেউ কেউ ব্রিটিশ বিয়ে করে শঙ্কর জাতির জন্ম দেয়, তবে অধিকাংশই পরে দেশ থেকে নিজ পরিবার পরিজন কিংবা বিয়ে করে বউ নিয়ে আসে।
১৯৭০ এ ব্রিটেনে ইমিগ্রেশন এ্যাক্ট চালু হলে তার সুযোগ নিয়ে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী কালে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে মাইগ্রেশন শুরু হয়। এদের প্রায় সবাই ছিল সিলেট অঞ্চলের। কারণ, নতুন আইনে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে আবাসন গ্রহণকারী বিদেশীরা দেশ থেকে স্ত্রী, ষোল বছর বয়সের নীচে সন্তান ও নির্ভরশীল মা বাবাকে আনতে পারত। শুধু তাই নয়, ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি সিলেটী পরিবার ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করিয়ে আনতে শুরু করে। সেই সুযোগে আবার অনেকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বা পয়সার বিনিময়ে চুক্তিতে বিয়ে করে এ দেশে আসে। বৃদ্ধ ভেবেছেন, আমিও হয়ত তেমনই কোনো সিলেটী মেয়েকে চুক্তিতে বিয়ে করে এ দেশে এসেছি।
যে ভাবে হোক, ব্রিটেনে সিলেটী জনসংখ্যা পুনঃপৌনিক ভাবে বাড়তে থাকল। তারা প্রথম দিকে কলে কারখানায় অল্প বেতনে মজদুর কিংবা রেস্টুরেন্টে কুকের চাকরী করত। এমন সময় দুটি ঘটনা ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের ভবিষ্যৎ বদলে দিল। আশির দশকে ব্রিটেনে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে কল কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশী মজদুরেরা দলে দলে চাকরী হারাতে থাকে। একই সাথে ব্রিটিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির ছেলেরা বাংলাদেশীদের উপর জাতিগত সন্ত্রাস শুরু করে দিল। তখন কিছু দূরদর্শী বর্ষীয়ান সিলেটী পুরুষ আত্ম রক্ষার্থে বাংলাদেশীদের সংগঠিত করে। ততদিনে ব্রিটিশদের জিভে ইন্ডিয়ান কারির (মূলত: বাংলাদেশী রান্নার) স্বাদ লেগে গেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিলেটীরা ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটা শহরে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নাম দিয়ে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করতে থাকে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে সিলেটীকে কুক ও রেস্টুরেন্ট কর্মী হিসেবে চাকরী দিয়ে ব্রিটেনে আনতে থাকে। ব্রিটেনের ৩৫ হাজার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কিংবা টেক এওয়ের প্রায় নব্বই ভাগই সিলেটীদের দখলে, যা ব্রিটিশ অর্থনীতিতে এক বিশাল ভূমিকা রাখছে।
এর মধ্যে, ১৯৭৮ সালে ৪ঠা মে ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদীদের সন্ত্রাসী হামলায় আলতাব আলী নামে ২৫ বছরের এক সিলেটী যুবক নিহত হল। যা প্রচণ্ড ভাবে বাংলাদেশীদের টনক নাড়িয়ে দিল। তারা নিজেদেরকে শুধু রেস্টুরেন্টে রন্ধনশালায় বন্দি না রেখে ব্রিটিশ মূল ধারায় যুক্ত হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। সিলেটী বংশোদ্ভূত ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হতে শুরু করে এবং ব্রিটিশ পুলিশ, আর্মি, অফিস আদালতে চাকুরী নিতে থাকে। ফলশ্রুতিতে রোশন আলীর মত সিলেটী মহিলাকে আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে দেখতে পাই। যে পার্কে আমি বসে আছি, তার নাম আলতাব আলী পার্ক। সেই পার্কে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ মিনার। যেখানে ভাষা দিবসে প্রবাসী বাঙ্গালীরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতদের। ব্রিটিশ অর্থনীতি ও ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাংলাদেশীরা আজ এক অনিবার্য অংশ। এ শুধু সম্ভব হয়েছে আমার পাশে বসে থাকা এই অশীতিপর বৃদ্ধের মত কিছু মানুষের অনমনীয় মনোবল ও দূরদর্শিতার কারণে। এই যে আমি এত বড় মসজিদে নামাজ পড়ছি, পার্কে বসে বাংলা পত্রিকা পড়ছি, বাংলায় কথা কইছি, এ তো শুধু এই মানুষগুলো শত কষ্টের মাঝেও এ দেশে টিকে থাকার ফসল। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এলো। মৃদু হেসে বললাম,
- চাচা, আমি একজন ডাক্তার। স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছি।
অনেক ভাগ্যে ডাক্তার হয়েছিলাম। আবার ডাক্তার হয়েও ভাগ্যান্বেষণে অনেক দেশ ঘুরেছি। ইরান, সৌদি আরব, দুবাই হয়ে ইংল্যান্ডে এসেছি। যে দেশেই গিয়েছি, ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আলাদা সম্মান, বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেয়েছি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। আমি ডাক্তার শুনে চাচা মিয়ার চেহারায় পরিষ্কার সম্ভ্রম ফুটে উঠল। তবে ঢেঁকি যেখানেই যাক, ধানই ভাঙ্গে। চাচা মিয়া আমার সিলেটী ভাষা জ্ঞানের তোয়াক্কা না করেই বলল,
- তুমি যে ডাখতোর অইছো হুনিয়া বরো খুশি অইলাম। এ দেশোর ডাখতোরে কুনু ডাখতোরী বুজে না।
চিকিৎসা শাস্ত্রের সূতিকাগার, ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা ডাক্তারি বোঝে না? শুনে হাসব না কাঁদবো বুঝতে পারিনা। তবে কেন জানি না, সহজ সরল এই বৃদ্ধের উপর কোনো রাগ হল না। আমার কানের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে বললেন,
- আমার ফায়খানা কিলিয়ার অয় না। এ দেশোত ডাখতোর তো বহুত দেখাইলাম, কুনু লাব তো অইলো না, তুমি খও ছাইন, খিতা খররাম?
পৃথিবীর বহু দেশে ডাক্তারি করার সুযোগ হয়েছে। বাঙ্গালিদের মতো এমন পায়খানা ক্লিয়ার না হওয়ার ব্যারাম আর কোনো জাতির মধ্যে তেমন দেখিনি। ব্রিটিশ ডাক্তারদের কী দোষ ? এই রোগের কথা তো ডেভিডসন, হেরিসনে লেখা নেই, ওরা জানবে কেমন করে ? আরে বাবা, প্রতিদিন যে পরিমাণে খাও, তা যদি ক্লিয়ার না হয়ে সব জমা থাকে, তাহলে তো সেফটি ট্যাংকি ওভার ফ্লো হয়ে যাবার কথা। সাকসন কিংবা ড্রেজিং ছাড়া সে পথ ক্লিয়ার হবার কথা নয়। শুধু পায়খানা নয়, মেয়েদের পিরিয়ড নিয়েও একই কমপ্লেইন। প্রখ্যাত গাইনোকোলোজিষ্ট প্রফেসর টি চৌধুরীর কথা মনে পড়ে গেল। একদিন ক্লাসে বলছিলেন,
- বাংলাদেশের মেয়েদের এই এক আজব রোগ। পিরিয়ড একটু বেশী হলেও জ্বালা, কম হলেও জ্বালা। বেশী হলে নাহয় বুঝলাম, এনিমিয়া হতে পারে। কম হলে তোমার অসুবিধা কি? না, এসে বলবে, স্যার, পিরিয়ড ক্লিয়ার হয় না। আরে মা, তুমি ক্লিয়ারের বোঝটা কি?
মনে পড়তেই অজান্তে হেসে উঠলাম। বললাম,
- চাচা, যন্ত্রপাতি ছাড়া, পরীক্ষা না করে, পার্কে বসে ডাক্তারি কেমনে করি? তবে ক্লিয়ারের ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। ওসব তো পেটের মধ্যে চিরকাল জমা থাকার জিনিষ না। সময়মত ঠিক বের হয়ে যাবে। আপনি শুধু প্রচুর পানি আর সবজি খাবেন।
দুষ্টুমি ধরা পড়া শিশুর মত নির্মল হাসি হাসলেন বৃদ্ধ। একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন,
- তুমার লগো এট্টু মশখরা খররাম আর কি। তুমি কুনতা মনো খরিও নারে বা।
- জি না চাচা, আমি কিছু মনে করিনি।
বৃদ্ধকে আমার খুব ভাল লেগে গেল। অনেকক্ষণ ধরে তার গল্প শুনলাম। অনর্গল সিলেটী ভাষায় কত কিছু বলে চললেন। সব না বুঝলেও তাকে থামাই না। আহা, বলুক না। হয়ত বহুদিন পর এমন একজন নির্বাক শ্রোতা পেয়েছেন। ব্রিটেনে মানুষ সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত দৌড়ের উপর থাকে। দু'দণ্ড বসে এক বৃদ্ধের বকবকানি শোনার তাদের সময় কোথায়?
লন্ডনে চার পুরুষের বাস তাদের, ভাই বোন, ছেলে মেয়ে, ভাতিজা ভাতিজী, নাতি নাতনী মিলে প্রায় শ'খানেক মানুষের বিশাল পরিবার তার। প্রায় সবাই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত, প্রতিষ্ঠিত। কাছাকাছি থাকেন সবাই। বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়। বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিনে ঈর্ষা হয় আমার। প্রিয় মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে কত সুখেই না আছেন ভদ্রলোক। অস্ফুটে বললাম,
- বাহ, আপনি তো একেবারে চাঁদের হাট বসিয়েছেন। বেশ সুখে আছেন।
- অয়, ইতা খইতায় ফারো।
- দেশে তো যান না বোধহয়?
- খ্যানে? যাইতাম নায় খ্যানে? ফরতেক বছরও তো যাই।
অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম,
- বলেন কী? প্রতি বছর? আপনার তো সবাই এখানে? দেশে কে আছে আপনার?
- তুমি তো বা লেখাফড়া জানা মানুষ। তুমি ইতা কিতা খইলায়? কে আছে আবার কিতা? আমার দ্যাশ আছে না নি? আমার দেশোর মানুষ আছে না নি? আমার কুসুমপুর গাঁও আছে না নি? আমার সূরমা নদী, আমার ঠাঙ্গুয়া হাওড়, সবেই তো আমারে ডাখোউন। ইতা তো আমার দেশ নায় রে বা। আমার দেশ তো সিলেট, মাইনে বাংলাদেশ।
আমি অবাক বিস্ময়ে এই প্রায় অশিক্ষিত বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। লন্ডনে সুপ্রতিষ্ঠিত এই মানুষটার দেশের প্রতি প্রেম দেখে নিজেকে নিজের কাছেই খুব ছোট মনে হল। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম,
- স্যরি চাচা, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। মানে অনেকেই তো বিদেশে এসে দেশের কথা ভুলে যায়। মা, বাবা, ভাই, বোন দেশে থাকলেও সহজে যেতে চায় না। আর আপনার তো সবাই এখানে।
- তোমার ছরি অওয়া লাগতো নায়। আমি বুজি। তয় যারা দেশরে বুলিয়া থাকতা ফারোইন, তারা মারেও বুলিয়া থাকতা ফারে। আমি ফারছি নায়। এল্লাগিওই বাফোর বিটাত তিন তালা বিল্ডিং তুলচি। কুসুমপুরে আমার বাড়ি হক্কোলো চিনোইন। ফোয়া ফুড়িরেও দেশো যাওয়া হিকাইছি। দেশোই বিয়া শাদী খরাইছি। তারারাও দেশরে খুব বালা ফাইন।
আমার বিস্ময় আকাশ ছুঁতে থাকে। দেশে কেউ নেই, তবু নিজ গ্রামে বাপের ভিটিতে তিনতলা বাড়ি করেছেন, শুধু দেশকে ভালোবাসেন বলে? আমার খুব ইচ্ছে করছিল, এই বৃদ্ধের পায়ের ধূলা মাথায় নিই। সেদিন একটা দারুণ শিক্ষা পেয়েছিলাম। সত্যিই তো, দেশকে যে ভুলে যেতে পারে, সে তো নিজের মাকেও ভুলে যেতে পারে। আমি তো এমন কত জনকে জানি, যারা বাংলাদেশের মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে ইউরোপ আমেরিকায় এসে আর ফিরে যায়নি। ফিরে না যাক, দেশের পয়সায় শিক্ষিত হয়ে বিদেশে এসে যদি দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে, তাহলেও তো দেশের ঋণ কিছুটা শোধ হয়। তা তো করেই না, উল্টো দেশের সম্পদ সব বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে আসে। দেশ যেখানে মেধা রপ্তানি করে উপকৃত হতে পারত, সেখানে দেশ থেকে মেধা ও সম্পদ, দুটোই পাচার হয়ে যাচ্ছে। আজ এই যে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, তা মূলত মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপে কাজ করা মজুর কর্মচারীদের পাঠানো পয়সায়, আমার মত তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতদের নয়।
এই তো গতকালই রফিক ভাইয়ের সাথে এক দাওয়াতে গিয়েছিলাম। এক নন-সিলেটী বাংলাদেশীর বাসায়। বাঙ্গালী এক জায়গায় হলে যা হয়, শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক আলোচনা আর দেশের সমালোচনা। দেশের সরকার খারাপ, রাজনীতিবিদরা খারাপ, আইনের শাসন নেই, পুলিশ ঘুষ খায়, জজ সাহেবরা ভুল রায় দেয়, স্কুল কলেজে পড়াশুনা নেই, দেশ একেবারে রসাতলে যাচ্ছে। মাত্র দেশ থেকে এসেছি, এ সব শুনে খারাপ লাগলেও মনে মনে ভাবি, কথা তো মিথ্যা নয়। এবার ইয়াংমত একজন শুরু করল, দেশে রাস্তা ঘাট খারাপ, মানুষের ভিড়ে চলা যায় না, নর্দমার গন্ধে হাঁটা যায় না, মশার কামড়ে টেকা যায় না, কারেন্ট থাকে না, গরমে ঘুমানো যায় না, ও দেশে কি মানুষ থাকে? আমি আর নিতে পারলাম না। আর কত? হোক আমার মা বোকা কিংবা কালো, মোটা কিংবা খাটো, তবুও তো আমার মা, কতক্ষণ আর তার বদনাম সহ্য করা যায়? কিছুটা অভদ্রের মতই জিজ্ঞেস করলাম,
- ভাই ক'বছর হয় এদেশে এসেছেন?
- তিন বছর।
- দেশে কে কে আছেন?
- সবাই, আমি একা এসেছি পিএইচডি করতে। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার।
একটু বিরক্তির সাথে বললেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক। আমি বিনয়ের সাথে বললাম,
- স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনি যা বললেন সবই সত্যি। তবে যে দেশে ত্রিশটা বছর কাটালেন, যে দেশ প্রায় বিনা পয়সায় আমাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা প্রফেসর বানাল, যে দেশে আমাদের মা বাবা ভাই বোন সহ ষোল কোটি লোক বাস করছে, সে দেশের এত বদনাম করা কি খুব দরকার?
- আপনি ক'বছর হয় এসেছেন?
প্রফেসর সাহেবের গলা শুনে বুঝতে পারলাম, বেশ রেগে গেছেন। একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এভাবে বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। আমি গলা আরও নরম করে বললাম,
- এক সপ্তাহ স্যার।
শুনে এবার অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন,
- ও। তাই বলেন। প্রথম প্রথম আমারও আপনার মত লাগত। কিছু দিন যাক, তখন আপনারও আমার মত লাগবে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কী লাভ কথা বাড়িয়ে? যার নয় এ হয় না, তার নব্বইতেও হয় না। বিলেতে না হলেও জীবিকার কারণে গত পনেরো বছর ধরে প্রবাসে আছি। দেশের প্রতি শেকড়ের টান তো কমেইনি, বরং আরও মজবুত হয়েছে। দেশ প্রেমের জন্য শিক্ষা নয়, মন থাকা চাই।
নিজের দেশপ্রেম নিয়ে এক ধরনের গর্ব অনুভব করতাম। এই বৃদ্ধের দেশপ্রেম দেখে সে গর্ব ম্লান হয়ে গেল। বললাম,
- চাচা, আমার খুব ইচ্ছে করছে, আপনার পায়ে হাত দিয়ে একটু সালাম করি।
অবাক হয়ে আমাকে দেখেন বৃদ্ধ। একজন অপরিচিত লোক, যে কিনা আবার একজন ডাক্তার, পার্কের মাঝে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে চায়? বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। তাড়াতাড়ি বললেন,
- ইতা কিতা খও বা? ছালাম খরতা কিলা? ছালাম খরা লগতো নায়। আমি দোয়া খরি, তুমি বহুত বরো ডাখতোর অও। তয় বরো ডাখতোর অইয়া দেশরা বুলি যাইও না। দেশোর মানুষরে বুলি যাইও না।
বৃদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধায় আবারও অবনত হল মন। বললাম,
- দোয়া করবেন চাচা, দেশকে, দেশের মানুষকে যেন কোনদিন ভুলে না যাই।
- তুমার লগো মাতিয়া (কথা বলে) বরো শান্তি ফাইলাম রে বা। আমার আবার খাইবার টাইম অই গ্যাছে। সময় মত না খাইলে তোমার চাচীয়ে খালি দরবার খরউইন। তুমি আমার লগো ছলো, আমার লগো খাইবায়। তোমার চাচীয়ে সাতখরা দিয়া বোয়াল মাছ রানছোইন।
বৃদ্ধের কথার আন্তরিকতা আমাকে আবার ভিজিয়ে দিল। আমার দুচোখ জলে ভরতে চায়। যে মাটি হযরত শাহ জালালের মত আউলিয়ার পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়েছে, যে মাটি হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের মত মানবতাবাদী, মরমী সাধক কবির জন্ম দিয়েছে, সে মাটির সন্তান তো এমনটিই বলবেন। আমার দেশে হয়ত অনেক কিছুই নেই, কিন্তু মুহূর্তে আপন করে নেয়ার মত এমনই লক্ষ কোটি মানুষ আছে। আহা, কোথায় পাব আমি এমন দেশ,? এমন মাটির মানুষ? মানুষের এমন বুক ভরা মমতা? বড় ইচ্ছে করছিল, বুড়ো মানুষটার সাথে যাই, তার চাঁদের হাটে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি, তার স্ত্রীর সাতকড়া দিয়ে রান্না করা বোয়াল মাছ খাই। কিন্তু সম্ভব নয়। তার একটা হাত আমার দুহাতে নিয়ে বললাম,
- না চাচা, আজ না। নতুন এসেছি। মোবাইলও নাই। বাসায় চিন্তা করবে।
আমার অপারগতা বুঝতে পারলেন বৃদ্ধ। দুহাত দিয়ে আমার দুহাত চেপে ধরে বললেন,
- তাইলে আমারে খতা দেও, সামনের শুক্কুরবার খাইবায়।
হেসে বললাম,
- আচ্ছা বেশ।
- তোমারে কোনানো ফাইমু?
- এইখানে। এই বেঞ্চে। আগামী শুক্রবার।
- আচ্ছা তে আমি অখন যাই।সামনের শুক্কুরবার দেখা অইবোনে।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন বৃদ্ধ। আমি বসে বসে তার চলে যাওয়া দেখি। এই দূর প্রবাসে, একজন অপরিচিত মানুষের এমন মনকাড়া মমতা আমাকে কিছুক্ষণ বুঁদ করে রাখে।
হঠাৎ করে ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্টের জন্য লন্ডনের বাইরে চলে যাওয়াতে পরের শুক্রবার আর ইস্ট লন্ডন মসজিদে নামাজ পড়েতে যাওয়া হল না।
এরপর বহুবার সেই মসজিদে নামাজ পড়েছি। বহুদিন আলতাব আলী পার্কের সেই বেঞ্চে বসে থেকেছি। কিন্তু তাঁর সাথে আর দেখা হয়নি। তাঁর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছুই রাখিনি। কোথায় হারিয়ে গেলেন হৃদয়ে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখা সেই বৃদ্ধ, জানতে পারিনি।
আঠেরো বছর কেটে গেছে। এখনো মাঝে মাঝে সেই সিলেটী বৃদ্ধকে মনে পড়ে। মনে পড়ে তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করা শিশুর হাসি। এখনো লন্ডনে গেলে হোয়াইট চ্যাপেল মসজিদে জুমার নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে সেই বেঞ্চটাতে একটু বসি। জানি এত বছরে হয়ত বেঁচে নেই। তবু বসে থাকি। বসে থাকতে দেখে যদি কোনো এক সিলেটী বৃদ্ধ এসে জিজ্ঞেস করেন,
- আফনে কিতা ও দেশো নয়া আইছোইননি?
আমি তখন তাকে আমার হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধের গল্প শোনাব।
 
টেমস নদীর বাঁকে পর্ব – ৮ (চিঠি)



"যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন"।
স্কুলে পড়েছিলাম। নিতান্ত নগণ্য জিনিষের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে অপার কোনো সম্ভাবনা। কথাটা খুব মনে ধরেছিল আমার। স্কুলে থাকতেই পুরনো সব বই খাতা কাগজপত্র জমা করে রাখতাম। না, পুরনো বই নতুন করে পড়ার জন্য নয়। সেই সব পুরনো কাগজ বিক্রি করে জোগাড় হত সিনেমা দেখার পয়সা। সেটা অবশ্য আমার কাছে অমূল্য রতনের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। কারণ, প্রতি সপ্তায় একটা সিনেমা দেখা চাই। কখনও কখনও দুটা। নেশাটা ছিল রীতিমত পাগলামির পর্যায়ের। পুরনো কাগজ বিক্রি ছাড়াও বাপের পকেট থেকে টাকা চুরি করা, মায়ের মাটির ব্যাংক থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পয়সা বের করা, পচা মাছ কিনে বাজারের টাকা থেকে পয়সা বাঁচানো, গম ভাঙ্গাতে গিয়ে এক কেজি আটা বিক্রি দেয়া, সিনেমা দেখার জন্য করিনি, হেন কোনো অপকর্ম ছিল না।

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর, সিনেমা দেখার সেই পাগলামিটা চলে গেল! তবে পাগল হলাম অন্য কারণে। পাগল হলাম এক দারুচিনি দ্বিপের রাজকন্যার প্রেমে। সেকি উথাল পাথাল প্রেম! স্বপ্নের সেই দ্বিপ থেকে প্রতি শনিবার চিঠি আসত নীল খামে। সেই দিনটিতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমি আগেভাগেই চলে আসতাম রুমে। অপেক্ষায় থাকতাম ডাক পিওনের। কখন তার পায়ের শব্দ শোনা যায়। কখন কড়া নড়ে ওঠে দরজায়।

সেই সব চিঠিতে লেগে থাকত আমার রাজকুমারীর ছোঁয়া। শরীরের ঘ্রাণ। দরজার ছিটকানি আটকিয়ে শুয়ে পড়তাম বিছানায়। একলা ঘরে চিঠির অক্ষরগুলো তখন জীবন্ত হয়ে উঠত। যেন দুপাশে বেণী দোলানো ডাগর চোখের মেয়েটি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা কইত। কখনও হাসত। কখনও কাঁদত। এক অসহ্য শিহরনে কেঁপে কেপ উঠত আমার শরীর। এক স্বর্গীয় ভালোলাগায় ভরে উঠত বুক। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতাম চিঠিগুলো। সেই থেকে চিঠিপত্র আগলে রাখার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেল।

তখন সৌদি আরবে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি করি। বছর দুইয়ের মধ্যেই মালিকের খুব বিশ্বস্ত ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলাম। একদিন মালিক ডেকে বলল, সে তার নতুন ক্লিনিকের জন্য বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু ডাক্তার ও নার্স আনতে চায়। আমি যদি রিক্রুটিং এর দায়িত্বটা নিই। নেক ওউর পুঁছ পুঁছ ? মালিকের পয়সায় যাওয়া, আসা, থাকা, খাওয়া। উপরি পাওনা হিসেবে প্রিয় দেশটার বুকে কিছুদিন কাটিয়ে আসা। সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম।

যথাসময়ে সব ডাক্তার নার্স রিক্রুট হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে এক ডাক্তার এসে বলল, সে যাবে না। আচানক কাণ্ড ! সৌদি আরবের চাকরি তখন ডাক্তারদের কাছে সোনার হরিণের চেয়েও প্রিয়। আর এই বেটায় কয়, যাইব না! চোখ সরু করে দিকে তাকালাম। ছাব্বিশ সাতাশ বছরের এক টগবগে যুবক। ড্যাম স্মার্ট। বলতে দ্বিধা নেই, আমার নির্বাচিত ডাক্তারদের মধ্যে সেই সবচেয়ে চৌকশ ও মেধাবী। এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবে? জানতে চাইলাম,
- কেন যাবে না? কোনো অসুবিধা?
- না। কোনো অসুবিধা না স্যার। আসলে ইংল্যান্ড থেকে আমার জন্য একটা ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্টের অফার এসেছে। আমাকে ইংল্যান্ড যেতে হবে।

ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্ট কী জিনিষ, তখনও জানি না আমি। বোকার মতো প্রশ্ন করলাম,
- সেটা কী জিনিষ? চাকরি না স্কলারশিপ ?
- চাকরিও না, স্কলারশিপও না। এটা এক ধরণের ট্রেনিং। বিনা বেতনে। আসলে, আমি এম আর সি পি পরীক্ষা দেব। এই ট্রেনিং আমার খুব উপকারে আসবে। সুযোগটা হারাতে চাই না।
আমার বুকের ভেতর তখনও এম আর সি পি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা ঘুমিয়ে ছিল। ওর কথা শুনে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠল। ইতস্তত করে বললাম,
- অফারটা দেখতে পারি?
- শিওর।
বলে একটা চিঠির ফটোকপি ধরিয়ে দিল। রদারহাম জেনারেল হাসপাতালের প্যাডে লেখা। ডা মণ্ডল নামে একজন কনসালট্যান্ট তাকে তিন মাসের ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্ট অফার করেছেন। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকও একজন বাংলাদেশি ডাক্তার। ছেলেটার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। খুশি গর্বের মাখামাখি তার চোখে মুখে। বুকের ভেতর এক ধরণের ঈর্ষা অনুভব করলাম। আহা! কী সৌভাগ্য ছেলেটার! পাশ করেই উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে। আর আমি এখনও এক দেশে থেকে অন্য দেশে কলুর বলদের মতো সংসারের ঘানী টেনে চলেছি! বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ছেলেটা তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল।

তখনও চিঠিটা আমার হাতে ধরা। সম্বিৎ ফিরে পেতেই ছুটে বাইরে এলাম। ততক্ষণে ছেলেটা বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছে। চিৎকার করে বললাম,
- তোমার চিঠিটা নিয়ে গেলে না?
- লাগবে না। আমার কাছে অরিজিনাল কপি আছে।
বলে দূর থেকেই হাত নেড়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। জানি, অন্যের নামে লেখা চিঠি আমার কোনো কাজে আসবে না। তবু অভ্যাসবশে যত্ন করে রেখে দিলাম চিঠিটা নোটবুকের ফাঁকে। তখন কে জানত, এই চিঠিই একদিন খুলে দেবে আমার জন্য এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার ?

তারপর কেটে গেছে আরও তিনটা বছর। দিনে, রাতে, রুগী দেখি আর ফাঁকে ফাঁকে এম আর সি পি এর বই পড়ি। ততদিনে সৌদি টাকায় সংসারের অবস্থা ফিরেছে অনেক। ভাবলাম, এখন ঝুঁকি নেওয়া যায়। একদিন আল্লাহর নাম নিয়ে বসে পড়লাম এম আর সি পি পার্ট ওয়ান পরীক্ষায়। তখন জেদ্দায় পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সেন্টার ছিল। চার সপ্তাহ পর রেজাল্ট পেয়ে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্বপ্নাতীত স্কোর নিয়ে এক চান্সেই পার্ট ওয়ান পাশ করে গেছি!

পার্ট টু আর প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে হলে ইংল্যান্ড যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? ভিসা পাব কেমন করে? কোথায় থাকব? কী খাব? বয়স তো চল্লিশ পেরিয়ে গেছে! শুনেছি, মেডিকেলের বন্ধুদের কেউ কেউ ইংল্যান্ড গেছে। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, কারও সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তখন ইন্টারনেট, ইমেইল, মোবাইল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তবে ঐ সব বায়বীয় জিনিষগুলো আমার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে ছিল। তাই চাইলেও নতুন করে পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না।

আর তখনই মনে পড়লে সেই ছেলেটির কথা। যার জন্য ইংল্যান্ড থেকে ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্টের অফার এসেছিল। ভাগ্যিস, পুরনো বই, খাতা, চিঠিপত্র জমা করে রাখার অভ্যাস ছিল। খুঁজে পেতে ঠিক পেয়ে গেলাম তিন বছর আগের ধূলি ধূসর নোটবইটা। পেলাম, তার ফাঁকে যত্নে রাখা সেই চিঠিটা। পেয়ে গেলাম, ডা মণ্ডলের ফোন নম্বর। অচেনা, অদেখা এই মানুষটা আমাকে সাহায্য করবেন, এমন দুরাশা যদিও আমার ছিল না। তবু ভাবলাম, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন" !

পরদিনই সেই নম্বরে ফোন করলাম। ততক্ষণে বোধহয় ইংল্যান্ডে দুপুর পেরিয়ে গেছে। ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি মেয়ে কণ্ঠ ব্রিটিশ একসেন্টে বলল,
- রদারহাম জেনারেল হসপিটাল। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
- মে আই টক টু ডক্টর মণ্ডল প্লিজ?
- স্যরি, ডক্টর মণ্ডল হ্যাজ লেফট ফর টুডে। কল টুমোরো।
যাহ বাবা। এত টাকা খরচ কইরা যার জন্য ফোন করলাম, সেই নাই! আমি নাছোড়বান্দার মতো বললাম,
- মে আই গেট হিজ পারসোনাল নাম্বর প্লিজ?
- নো। আয়াম নট এলাউড টু গিভ হিজ পারসোনাল নাম্বার। স্যরি!
এর পর আর কথা চলে না। তয় আমিও বরিশাইল্যা পোলা। সহজে হাল ছাড়ার পাত্র না। মরিয়া কণ্ঠে বললাম,
- লুক। মাই নেম ইজ ডক্টর হোসেন। হিজ কান্ট্রি ফেলো। কলিং ফ্রম সৌদি এরাবিয়া। ইটস ভেরি আর্জেন্ট টু টক টু হিম।
কী ছিল আমার গলায়? জবরদস্তি? জেদ? মিনতি? ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে মেয়েটা একটু ইতস্তত করে বলল,
- হোল্ড অন। লেট মি চেক উইথ হিম।

আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ওপাশে সুনসান নীরবতা। ঘড়ির টিকটিক শব্দের সাথে বাড়ছে টেলিফোনের বিল। আমি পরোয়া করি না। এর শেষ দেখতে চাই। আমাকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠল টেলিফোন।
- ওয়েল। ডক্টর মণ্ডল হ্যাজ এগ্রিড টু টক টু ইউ। হেয়ার ইউ গো।
একটু পরেই ওপাশে গমগম করে উঠল একটা ভরাট কণ্ঠস্বর,
- হ্যালো।
- হ্যালো স্যার। মাই নেম ইজ আফতাব হোসেন। এ ডক্টর ফ্রম বাংলাদেশ।
- বলো আফতাব। তোমার জন্য কী করতে পারি।
আমাকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন। শুধু তাই নয়, এমন ভাবে বললেন, যেন আমি তার কতদিনের চেনা। আমিও বাংলায় বললাম,
- স্যার, আমি এম আর সি পি পার্ট ওয়ান পাশ করেছি। পার্ট টু দিতে ইংল্যান্ড আসব। আপনি যদি আমাকে একটা ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্টের ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে ভিসা পেতে খুব সহজ হত।
- নিশ্চয়ই। তোমার কি রদারহামে থাকার জায়গা আছে?
রদারহাম তো দূরের কথা, ইংল্যান্ডেও আমার থাকার কোনো জায়গা নাই। রদারহাম যে কোথায় তাও, জানি না। বললাম,
- না স্যার।
- ডোন্ট ওরি। আমি হাসপাতাল একোমোডেশনে তোমার ফ্রি থাকার ব্যবস্থা করে দেবো। তুমি এক কাজ করো, এটাচমেন্ট ও একোমোডেশন চেয়ে আমার বরাবর একটা এপ্লিকেশন করে দাও। আর আমার বাসার নম্বরটা লিখে নাও। প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন দিও।

বলে ওনার বাসার ফোন নম্বর দিলেন। আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে? কোনো দিন আমাকে দেখেননি। কোনো দিন কথাও হয় নি। এমনকি জানতেও চাইলেন না, কী করে তার খোঁজ পেলাম? অথচ এক কথায় শুধু এটাচমেন্ট নয়, আমার ফ্রি থাকার ব্যবস্থাও করে দেবেন বললেন! এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। আবার যেচে নিজের বসার ফোন নম্বরটাও দিয়ে দিলেন!

কথা রেখেছিলেন ডা মণ্ডল। যথা সময়ে পাঠিয়েছিলেন অফার লেটার। তিন মাসের ক্লিনিক্যাল এটাচমেন্ট উইথ ফ্রি একোমোডেশন। একবার নয়, দুই দুইবার। প্রথম বার ভিসা লাগিয়েও যাওয়া হয়নি। একবছর পর আবার পাঠিয়েছিলেন। সেই সুবাদেই এবার ব্রিটেনে আসা।

শুনেছি, ব্রিটিশরা খুব স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়। আর পাক ভারত উপমহাদেশ হতে যারা এ দেশে আসে, তারা ব্রিটিশদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অতি বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রম আমাদের দেশের সিলেটি সম্প্রদায়। তারা একবার এ দেশে আসতে পারলে সাত পুরুষের যত আত্মীয়স্বজন আছে, সবাইকে আনার চেষ্টা করে। এমনি না পারলে ছেলে কিংবা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্যদের নিয়ে আসে। এই মণ্ডল ডাক্তার সাহেব সিলেটি নয়ত ? তার কোনো মেয়ের জন্য আমাকে না দেখেই নির্বাচন করে বসেননি তো? হায় হায়! মাঝারি সাইজের ভুঁড়ি আর পাকা জুলফির চল্লিশোর্ধ এই আমাকে দেখে তার চেহারার হাল যে কী হবে? ভাবতেই হেসে ফেললাম।

সিলেটি চাচা চলে যাবার পর আলতাব আলী পার্কের সেই বেঞ্চে বসে এই সব সাত পাঁচ ভাবছিলাম। ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই আমার। ঘর নামের দুই কামরার সেই কাউন্সিল হাউজে কেউ অপেক্ষা করে নেই আমার জন্য। সকাল হলেই রফিক ভাই ও ভাবি বের হয়ে যান জীবিকার সন্ধানে। ফেরেন সন্ধ্যা পার করে। হঠাৎ করেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। এই এক জ্বালা এই দেশের। কথা নাই, বার্তা নাই, যখন তখন ছিঁচকাঁদুনে বউয়ের মতো নাকি কান্না শুরু করে দেয়। আমি উঠে বাসার পথ ধরলাম।

দরজা খুলতেই নীচে একগাদা চিঠি পড়ে থাকতে দেখলাম। প্রতিদিনই আসে। ব্যাংকের চিঠি। ক্রেডিট কার্ডের চিঠি। ইউটিলিটি বিলের চিঠি। কাউন্সিলের চিঠি। নানা জিনিষের বিজ্ঞাপন দিয়ে চিঠি। কত রকম চিঠি যে এ দেশে আসে! আর আমার যা অভ্যাস, এত চিঠি আগলে রাখতে গেলে তো রীতিমত একটা গোডাউন ভাড়া করতে হবে! চিঠিগুলো তুলে টেবিলে রাখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। একটায় আমার নাম লেখা !
 

Users who are viewing this thread

Back
Top