টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার উপর দিয়ে প্রবহমান ঝিনাই নদীর নথখোলা ও কাশিল পয়েন্টে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলছে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনের মহা উৎসব। স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে অপরিকল্পিত এই মাটি উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পরেছে প্রধানমন্ত্রীর বুড়িগঙ্গা বাঁচাও পাইলট প্রকল্প।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাশিল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য স্থানীয় ইনছান আলী নামের এক ব্যক্তির উচ্চ আদালতে করা একটি রিটের আদেশের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলছে অপরিকল্পিতভাবে এই অবৈধ মাটি খনন। নানা ভাবে স্থানীয় প্রশাসন কে ম্যানেজ করে গত ৩ বছর ধরে বালুদস্যু এই চক্রটি প্রতিনিয়ত অবৈধ ভাবে মাটি খনন করে বিক্রি করে আসছে। এই বালুদস্যু বাহিনীর অপরিকল্পিত খননের ফলে ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে নথখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সহ স্কুল ভবনের একাংশ। গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যালয়ের পাকা ভবনটির শ্রেনিকক্ষ। নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে কাশিল উচ্চ বিদ্যালয়ের একাংশ। হুমকির মুখে রয়েছে টাঙ্গাইল সদরের সাথে বাসাইল ও সখিপুর উপজেলার সংযোগ রক্ষাকারি নথখোলা সেতু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। কাশিল পয়েন্ট থেকে মাটি খনন করে ট্রাকে পরিবহনের যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে শহীদ স্মৃতি স্থম্ভের ঠিক পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতের মধ্যদিয়ে। যার ফলে যেকোন মুহুর্তে নদী গর্ভে বিলিন হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত এই স্মৃতি স্তম্ভটি। প্রধানমন্ত্রীর বুড়িগঙ্গা বাঁচাও পাইলট প্রকল্পের কারনে বালু মহলের ইজারা গত ২ বৎসর যাবত বন্ধ থাকলেও বহাল তবিয়তে বেপোরোয়া ভাবে মাটি খনন করছে মাটি দস্যুরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নথখোলা ব্রীজের অদূরে ৩টি ও কাশিলের নদী তীরবর্তী অংশে ২টি মাটিকাটার এস্কিবিউটর (মাটি কাটার যন্ত্র) বসিয়ে দিন রাত ২৪ ঘন্টা উত্তোলন করা হচ্ছে মাটি। প্রতিদিন গড়ে ১০ চাকার বড় ড্রাম ট্রাক সহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৫০০ ট্রাক মাটি প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও দুটি ড্রেজার মেশিনের অস্তিত্ব দেখা যায় খনন করা অংশে। দিনের বেলায় এই মেশিন দুটি ঢাকা থাকলেও, রাতের আধাঁরে চালু করে চলে বালু উত্তোলনের মহাউৎসব। ইতিমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ড্রেজিং মেশিন। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই অদৃশ্য শক্তির বলে আবারও চালু হয়েছে ড্রেজিং।
এই দুই পয়েন্ট থেকে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা উজ্জল মোল্লার যার সার্বিক তত্বাবধায়নে চলছে মাটি খনন। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সাংসদের নাম ভাঙ্গিয়ে ও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি অবৈধ এই মাটি খনন চালাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যাক্তি জানান, উজ্জল মোল্লা স্থানীয় ভাবে সরকারদলীয় প্রভাব খাটিয়ে নদী থেকে মাটি খনন করছে। তার পেশীশক্তিকে ভয় পেয়ে স্থানীয় মানুষ বাড়ি ঘড় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না ।
মাটি খনন করা এলাকায় কর্মরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে জানা যায়, সাবেক ইউপি সদস্য ইনছান আলীর উচ্চ আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা দিয়ে মাটি খনন কারি হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শরিফুল ইসলাম মানিক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খান বাহাদুর, আরিফুল ইসলাম আরিফ, লিটু, পিন্টু জমাদার, করটিয়া সাদত কলেজের সাবেক জিএস ও সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী কামরুজ্জামান রিপন ও কাশিল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রাজিক খান এই মাটি উত্তোলনের সাথে সম্পৃক্ত । যদিও কাশিল ইউপি চেয়ারম্যান রাজিক খান মাটি খননের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করে এই প্রতিবেদককে বলেন, উচ্চ আদালতে রায়ের বলে মাটি খনন হচ্ছে, আর খননকারীরা আমার এলাকার ভোটার, তাই নিজেরা অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য চেয়ারম্যান হিসেবে আমার নাম বলে থাকতে পারে।
অপরদিকে এই মাটি উত্তোলনকে কেন্দ্র করে উত্তোলনকারীদের মধ্যে মাটি উত্তোলনের লভ্যাংশের ভাগবন্টন নিয়ে বিরোধ চরম আকারে পৌঁছেছে। অংশীদারদের মধ্যে ইনছান আলীর সমর্থক ও স্থানীয় উজ্জল মোল্লার সমর্থকদের করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় নথখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আসমা সুলতানা বলেন, অপরিকল্পিত খননের ফলে ইতিমধ্যে স্কুলের শহীদ মিনার ও একটি ভবনের মেঝে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে অবহিত করা হয়েছে।
অবৈধ মাটি খননের ব্যাপারে সাবেক ইউপি সদস্য ইনছান আলী বলেন, উচ্চ আদালতে নির্দিষ্ট দাগ নাম্বারের ওপর উচ্চ আদালতে রিটের বিপরিতে মাটি খননের আদেশের বলে মাটি খনন করা হচ্ছে। তবে উচ্চ আদালতে করা রিটের দাগ নম্বরের জায়গায় অবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাইলে, তিনি উক্ত দাগের জায়গার অবস্থান দেখাতে পারেন নি। এবং স্বীকার করেন উক্ত দাগের বাহিরেও খনন চলছে। এসময় তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু সুবিধা নিতে পারেন বলেও দাবি করেন।
মাটি খননের বিষয়ে বাসাইল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুন নাহার বলেন, নথখোলায় মাটি উত্তোলনের কারণে ইতিমধ্যেই স্কুল-ব্রীজের যে ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। এছাড়া হাইকোর্টের রিটে যে সকল দাগ নাম্বারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার বাইড়ে থেকেই মাটি উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। এর পরিপেক্ষিতে প্রশনাসনের পক্ষ থেকে যা যা করনীয় আমরা তা করার সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এই মাটি খনন চক্রের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে। মোবাইল কোর্টে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করাও হয়েছে।
এই ব্যাপারে বাসাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামসুন নাহার স্বপ্না জানান, ইতিপূর্বে নথখোলায় অবৈধ মাটি খননের ব্যাপারে জানতে পেরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তাদের নির্দিষ্ট দাগ নম্বরের জমির ওপর উচ্চ আদালদের একটি আদেশ রয়েছে। উক্ত দাগ নম্বরের বাহিরে আবারও যদি তারা খনন করে তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।