তাহসান রহমান খান যাকে আমরা তাহসান বলে জানি। তাহসানকে নিয়ে লিখতে গেলে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত তার অতীত সাফল্যকে অস্বীকার করা যায় না দ্বিতীয়ত কিছু মানুষের তাকে ঘিরে তাচ্ছিল্যকেও খেয়াল করতে হয়। দ্বিতীয় বিষয়টা তার জীবনের একটা মোড়ের কারণে দর্শক/সমালোচকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। তাই তাহসানকে নিয়ে বর্তমানে লিখতে গেলে মানসিক প্রস্তুতির দরকার পড়ে। প্রস্তুতিটা হচ্ছে মার্ক জুকারবার্গ প্রদত্ত ফেসবুকীয় মুহুর্মুহু হা হা রিঅ্যাক্টের জোয়ার ও সস্তা তাচ্ছিল্যের কমেন্ট সহ্য করতে হবে।
তাহসানকে দেখলে অনেক গুণের একটা সমাহার চোখে পড়ে। একজন সফল তারকা হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করার মানসিকতা নিয়ে ভাবলে কি কি চোখে পড়ে শুধু নজর রাখতে হবে। কেউ যদি অস্বীকার করতে চায়ও তারপরেও চোখে পড়বে তার গুণগুলো। জোর করে এড়িয়ে গেলেও তাতে তার গুণগুলো মিথ্যে হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। একদিন পড়ন্ত বিকেলে জিমনেসিয়ামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাহসানের ‘বিন্দু আমি’ গানটা গাইছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে বড়ভাইয়ের আওয়াজ এলো। বললেন-‘তুই কি জানিস গানটা এখানেই স্যুট করা হয়েছিল?’ চোখ দুটো বড় বড় করে বললাম-‘রিয়েলি!’ বললেন-‘হ্যা, গানটার ভিডিও আজকে আরেকবার দেখবি। আমাদের ক্যাম্পাসের জিমনেসিয়ামের রাস্তাটা চোখে পড়বে।’ যেই কথা সেই কাজ। অসংখ্যবার দেখা সেই গানটি ইউটিউবে সেদিন যেন সম্পূর্ণ নতুন করে দেখতে বসলাম আর অবাক হলাম নিজের ক্যাম্পাসকে দেখে। তারপর অনেকদিন জিমনেসিয়ামের পথ ধরে হাঁটার সময় অবচেতনে এই গানটিই ঠোঁটে চলে আসত। তখনকার তাহসানপ্রীতির মাত্রাটা ছিল এমনই। এই তাহসানপ্রীতি আমাদের সময়ে দেশের উঠতি প্রজন্মের নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। তারপর যখন ‘আলো’ গানটা এলো এফএমরেডিওতে আল্লাহর তিরিশটা দিনই বাজানো হত। সে কি ক্রেজ গানের! ‘ব্ল্যাক’-এর তাহসানের আলাদা গুরুত্ব তো ছিলই। একটা প্রজন্মকে মৌলিক আধুনিক বাংলা গানের প্রতি মনোযোগী করতে তাহসানের অবদান কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে! তার গানের বাণী, সুর, গায়কী সবকিছুর মধ্যে একটা মার্জিত বিষয় আছে।
তাহসান কি শুধু নিজের জন্য গান করেছে! এই যে আজকে মিনার-কে দর্শকশ্রোতা এত পছন্দ করে, টলিউড থেকে তার গান করিয়ে নিচ্ছে সেই মিনারের ক্যারিয়ারেও তাহসানের অবদান আছে। ‘ডানপিটে’ অ্যালবামের অনবদ্য সেইসব গান কে ভুলতে পারে! ‘সাদা রঙের স্বপ্ন’ বলতে গেলে ছাত্রজীবনের অন্যতম সেরা গান, এ গানের সুর তাহসানের করা। মিথিলার কণ্ঠে ‘অগোচরে’ গানটাও তাহসানের সুর করা। মানুষটা কি শুধু নিজের জনপ্রিয়তার কথা ভেবেছে! বিজ্ঞাপন, রিয়েলিটি শো উপস্থাপনা, ট্যালেন্ট হান্টের বিচারক কত বৈচিত্রপূর্ণ কাজই তো করেছে তাহসান। কয়জন পেরেছে এতকিছু!
অভিনয় নিয়ে তাহসানের প্রতি কিছু দর্শকের ক্ষোভ, তাচ্ছিল্য। কিন্তু অভিনয়ে তার যে কমফোর্ট জোন সেদিক থেকে জনপ্রিয় অনেক কাজই তো উপহার দিয়েছে। তাহসান-মিথিলা, তাহসান-তিশা, তাহসান-মম জুটিগুলো দর্শক ভুলতে পারবে! ‘ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে প্রেম, ঠিকানা, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস, মনফড়িঙের গল্প, মনসুবা জংশন, নীলপরী নীলাণ্জনা, এপিক্লিস’ এ ধরনের জনপ্রিয়, প্রশংসিত নাটক কি তাহসান উপহার দেয়নি! অভিনয়ের সীমাবদ্ধতা অনেকেরই আছে। সমালোচনা আসতেই পারে কিন্তু তারও একটা সীমারেখা থাকা উচিত।
তাহসানের প্রতি আজকের দর্শকভেদে যে তাচ্ছিল্য বা হা হা প্রজন্মের আতিশয্য তার পেছনে মিথিলার সাথে বিচ্ছেদের বিষয়টাই সবচেয়ে বড় কারণ। মাথায় করে রাখত যখন তারা একসাথে ছিল। বিচ্ছেদের পর রাতারাতি মানুষ দুটি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেছে। কথা হচ্ছে, আপনার বিয়ের পর আপনার জীবনসঙ্গনীর সাথে আপনি সারাবছর এক ছাদের নিচে থাকতে পারবেন এই গ্যারান্টি আপনি দিতে পারবেন! সময়, বাস্তবতা কোনদিকে কিভাবে মোড় নেবে কে বলতে পারে! হ্যাঁ, বিচ্ছেদ হলে খারাপ লাগে, বিশ্বাসটা ভেঙে যায় বা দর্শক আস্থা হারায় কিন্তু তারও একটা এক্সট্রিম লেভেল থাকে। কতদিন আপনি বিদ্বেষ পুষে রেখে দুজনকে তাদের ইনবক্স বা কমেন্টবক্সে গালিগালাজ করে যাবেন যেটা সভ্যতার নিকৃষ্ট স্বভাব। তারা তো বলেছে তারা নিজেদের বাস্তবতা মেনে নিয়ে সন্তানের জন্য এখন সময় দেবে যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। অনেকে তো সন্তানের দায়িত্বটুকুও নিতে চায় না। তারা তো নিচ্ছে সেখানে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। কিংবা যখন দুজনই সম্পর্কের জটিলতায় বা সংকটে ছিল কতজন তাদের খোঁজ নিতে গেছে! কতজন পাশে থেকেছে! হুজুগ মেইনটেইন করে তাচ্ছিল্য ঠিকই করেছে বা করছে দল বেঁধে। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দেয়া উচিত এখন।
তাহসান এখন ‘যদি একদিন’ ছবির নায়ক। নায়ক বলতে প্রচলিত হিরোইজমের বাইরের নায়ক। তাকে আপনি ‘ডিসুমাইক’ জাতীয় ফ্লেভারে পাবেন না, তার কমফোর্ট জোনে পাবেন। তাকে বলা হয়েছিল-‘আপনি ছবি করুন তাহলে দর্শক বাড়বে।’ তাহসান কথাটা রেখেছে। তাকে তো ধন্যবাদ দেয়া উচিত। নিজের ফ্যানবেজকে কাজে লাগিয়ে আরো দর্শকের ভেতর আগ্রহ জাগিয়ে ছবি করলে লাভ তো ইন্ড্রাস্টিরই। যারা দিনরাত বলে পরিবার নিয়ে দেখার মতো ছবি হচ্ছে না। হাতের কাছে ‘যদি একদিন‘ ফ্যামিলি স্টোরি নিয়ে হাজির হয়েছে। এবার তো দেখা উচিত। ছবি না দেখে দিনরাত ‘পরিবার নিয়ে ছবি হচ্ছে না’ বলে বুলি আওড়ালে তো হবে না। দেখে ভালো লাগল না লাগল বলতে হবে।
তাহসানের পুরো ক্যারিয়ার এখন পর্যন্ত সমৃদ্ধ। তাকে ইগনোর করতে চাইলেও পারবে না লোকজন। বরং যারা ইগনোর করে ফ্যাশনেবল বা হুজুগে মানসিকতায় তাদের ফোনের প্লে-লিস্টেও ‘বিন্দু আমি, আলো, প্রত্যাবর্তন’ খুঁজে পাওয়া যাবে। সাফল্য-ব্যর্থতা সবার জীবনেই থাকে হোক উঁচুতলা বা নিচতলা। কাজকে কাজের জায়গা থেকে মূল্যায়ন করা উচিত ব্যক্তির চেয়ে।
‘তাহসান হতেও সাধনা লাগে’ এ কথাটা মনে রাখা দরকার।