হাঙ্গেরির জাতীয় সংসদ ভবন, এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংসদ ভবন;
স্লোভেনিয়া ও হাঙ্গেরি প্রতিবেশী। তাই স্লোভেনিয়াতে আসার পর বেশ কয়েকবার আমি হাঙ্গেরিতে গিয়েছি। এমনকি শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচির আওতায় হাঙ্গেরির পঞ্চম বৃহত্তম শহর পেচেও কয়েক মাস থাকার সুযোগ হয়েছে। হাঙ্গেরির প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব পেচও এই শহরে। যদিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল লাইব্রেরি হিসেবে। প্রায় ৬৫০ বছরের পুরোনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিকসের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। তাই শিক্ষার্থী হিসেবেও কয়েক মাস হাঙ্গেরিতে থেকেছি।
অন্যদিকে স্লোভেনিয়ায় অবস্থিত একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট আয়তনের দিক থেকে তেমন একটা বড় নয়। পায়ে হেঁটে মালিবাগ মোড় থেকে মৌচাকের মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও কম সময়ে ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। ছোট এয়ারপোর্ট হওয়ায় সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটও তেমন একটা নেই। বিশেষ করে উইজ এয়ার কিংবা রায়ান এয়ারের মতো স্বল্প বাজেটের এয়ারলাইনস স্লোভেনিয়াতে ল্যান্ড করতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এ জন্য বেশির ভাগ সময় ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফ্লাইটে যাতায়াত করার জন্য আমাকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের লিৎজ ফ্যারেঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কিংবা ভেনিসের মার্কো পোলো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ও ত্রেভিসো এয়ারপোর্টের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে।
হাঙ্গেরির ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব পেচ; বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রায় ৬৫০ বছরের পুরনো
একাধিকবার বুদাপেস্ট গিয়েছি। অন্য শহরেও যাওয়া হয়েছে। কিন্তু হাঙ্গেরির অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি। এর একটা বড় কারণ হতে পারে পেচে থাকার সময় বেশ কয়েকবার বর্ণবাদের শিকার হওয়া। কারণ, অনেকেই হয়তো আমাকে স্থানীয় জিপসি জাতি রোমাদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলত গায়ের রঙের জন্য। তাই বাস, ট্রেন, এমনকি পাবলিক প্লেসেও অনেক হাঙ্গেরিয়ান আমাকে দেখে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
তা ছাড়া প্রথমবার বুদাপেস্টে গিয়েও এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। ট্রেনে বুদাপেস্ট থেকে পেচে যাওয়ার জন্য আমাকে কেলেতি পালয়ুদভারে আসতে হয়েছিল। ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘সিগারেট? মারিজুয়ানা?’ এরপর তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন, তাঁর গা থেকে ভীষণ বাজে গন্ধ আসছিল। তাঁর হাঙ্গেরিয়ান বলার স্টাইলও ছিল সাধারণ হাঙ্গেরিয়ানদের তুলনায় আলাদা। তাঁকে দেখে আমি আচমকা সেখান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, এ সময় হঠাৎ আমার সঙ্গে একজনের ধাক্কা লাগে। কিছুক্ষণ পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার মানিব্যাগ নেই। তবে দরকারি কাগজপত্র আগে থেকে ব্যাগে রাখায় অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে যাই। কারণ, মানিব্যাগে ছিল মাত্র ৫০০ হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট। হাঙ্গেরির জাতীয় মুদ্রা হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট। গোটা ইউরোপে হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট সবচেয়ে দুর্বল মুদ্রা। বাংলাদেশের এক টাকা সমান হাঙ্গেরির তিন থেকে সাড়ে তিন হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্ট।
বুদাপেস্টের কেলেতি পালয়ুদভার রেলওয়ে স্টেশন
হাঙ্গেরিতে থাকার সুবাদে বেশ কয়েকজন হাঙ্গেরিয়ানকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। তাঁদেরই একজন ক্যাতিসিয়া হোভার্ট। ক্যাতিসিয়ার সঙ্গে অবশ্য আমার প্রথম পরিচয় ফেসবুকে, বুদাপেস্টের একটি বিউটি পারলারে তখন তিনি কাজ করতেন। ক্যাতিসিয়ার আমন্ত্রণে শেষ পর্যন্ত বুদাপেস্টে ভ্রমণে আগ্রহী হই।
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে স্যামহেইন ডে উপলক্ষে চার দিনের ছুটিকে বুদাপেস্ট ঘোরার জন্য আদর্শ মনে হয়। ক্যাতিসিয়া আগেই আমাকে মেসেজ দিয়ে রেখেছে, আমার জন্য তিনি পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অপেক্ষা করবেন। আমি তাঁকে পার্লামেন্ট ভবনের পরিবর্তে আশপাশের কোনো কফিশপের সামনে দাঁড়াতে বলি।
পার্লামেন্ট এরিয়াতে বেশ কয়েকটি কফিশপ রয়েছে। এর মধ্যে ক্যাতিসিয়ার সবচেয়ে প্রিয় কফিশপ মাডাল ক্যাফে। তিনি আমাকে মেসেঞ্জারে তাঁর লাইভ লোকেশন পাঠান। সে অনুযায়ী তাঁকে আমি খুঁজে বের করি। মাডাল ক্যাফের প্রবেশমুখে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
বুদাপেস্ট ভ্রমণের সঙ্গী ক্যাতিসিয়া হোভার্টের সঙ্গে লেখক
মাডাল ক্যাফে থেকে আমরা দুজনই নাশতা সেরে নিই। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো হাঙ্গেরিতেও তখন একটু একটু করে শীত পড়তে শুরু করেছে। লাতের সঙ্গে বিস্কুট ও কেক, একটি সুন্দর দিন শুরু করার জন্য আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ ধরনের নাশতাকে যথাযথ বললে ভুল হবে না।
প্রায় তিন বছর হয়েছে আমি স্লোভেনিয়াতে এলেও সেভাবে কফির অভ্যাস গড়ে তুলতে পারিনি। আমি এখনো দুধ–চায়ের ভক্ত।
পূর্ব ইউরোপে বুদাপেস্ট ও প্রাগ—এ দুই শহরের মতো অন্য কোনো শহরে এত বেশি দর্শকসমাগম হয় না। হলিউড ও বলিউডের অনেক বিখ্যাত সিনেমার শুটিং হয়েছে বুদাপেস্টে। সুশান্ত সিং ও কীর্তি শ্যানন অভিনীত ‘রাবতা’ সিনেমার পুরাটা শুট হয়েছে বুদাপেস্টে।
হাঙ্গেরির ইতিহাসে কোসাথ লায়োস অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব; তাঁর নাম অনুসারে হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট প্যালেসের নাম রাখা হয়েছে কোসাথ লায়োস স্কয়ার
হিরোজ স্কয়ার ছাড়া বুদাপেস্টের বেশির ভাগ দর্শনীয় স্থানের অবস্থান কোসাথ লায়োস টারের আশপাশে। হাঙ্গেরির ইতিহাসে কোসাথ লায়োস অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য রাস্তাঘাট, এমনকি পাবলিক স্কয়ার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণ হয়েছে কোসাথ লায়োসের নামে। এমনকি হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট প্যালেসের নামও রাখা হয়েছে কোসাথ লায়োস স্কয়ার। পার্লামেন্ট ভবনের পূর্ব প্রান্তে তাঁর স্মরণে একটি মেমোরিয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। বিতার্কিক ও সুবক্তা হিসেবে কোসাথ লায়োস ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ১৮৪৮ সালে সংগঠিত হাঙ্গেরীয় বিপ্লবে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। এমনকি ১৮৪৯ সালে স্বল্প মেয়াদে তিনি হাঙ্গেরির গভর্নর-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে মূল নামের সঙ্গে ফ্যামিলি নেম সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু হাঙ্গেরিতে সম্পূর্ণ উল্টো, সেখানে ফ্যামিলি নেম লেখা হয় মূল নামের আগে। অবশ্য আমাদের দেশে সবাই যে ফ্যামিলি নেম ব্যবহার করেন, তেমনটিও নয়।
বুদাপেস্ট ভ্রমণের সূচনাটা হলো হাঙ্গেরির ন্যাশনাল পার্লামেন্ট ভবন দিয়ে। হাঙ্গেরিয়ানদের জাতীয় জীবনে পার্লামেন্ট ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্যাতিসিয়া আমাকে বলছিলেন, হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষের কাছে মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি জিনিস গৌরবের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, সেগুলোর অন্যতম এ পার্লামেন্ট ভবন।
সংসদ ভবনের সামনে সামরিক পোশাকে গার্ডরত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী
রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে অবস্থিত দেশটির জাতীয় সংসদ পার্লামেন্তুল রোমানিয়েই, এরপর হাঙ্গেরির ন্যাশনাল পার্লামেন্ট ভবনটি এ পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদ ভবন। ভৌগলিকভাবে হাঙ্গেরি ও রোমানিয়া একে অন্যের প্রতিবেশী হলেও দেশ দুটির সাধারণ মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক তেমন একটা উষ্ণ নয়। রোমানিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত ট্রান্সসিলভানিয়া অঞ্চলকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যকার দ্বৈরথ সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। হাঙ্গেরিয়ানরা রোমানিয়ানদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাই হাঙ্গেরিতে বেড়াতে এলে রোমানিয়া নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
ক্যাতিসিয়ার মুখ থেকে হাঙ্গেরিয়ান ন্যাশনাল পার্লামেন্টের ইতিহাস জানতে পারলাম। ১৮৮৫ সালে পার্লামেন্টের মূল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলেও পুরো পার্লামেন্টের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়। বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি ইমরে ফেরেঙ্ক স্টোইনডি হাঙ্গেরিয়ান ন্যাশনাল পার্লামেন্টের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। গোথিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দানিয়ুব নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা হাঙ্গেরির ন্যাশনাল পার্লামেন্ট ভবনটি সত্যি অসাধারণ। বিশেষত পার্লামেন্ট ভবনের উপরিভাগের লাল গম্বুজটি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, ইউরোপের অন্যান্য দেশে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবনের তুলনায় হাঙ্গেরিয়ান ন্যাশনাল পার্লামেন্টের অভিনবত্ব উপরিভাগের লাল গম্বুজে। পার্লামেন্ট প্যালেসে সব সময় একদল গার্ডকে কুচকাওয়াজ করতে দেখা যায়।
হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন্টের নোট
দর্শনার্থীরা চাইলে পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরটা ঘুরে দেখতে পারেন। এ জন্য অবশ্য একজন দর্শনার্থীকে ২ হাজার ৫২০ হাঙ্গেরিয়ান ফোরেন্ট খরচ করতে হয়। ক্যাতিসিয়া আগেই আমার জন্য অনলাইন রিজার্ভেশনের মাধ্যমে টিকিট কিনে রেখেছিলেন। সংসদ ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে আলাদাভাবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে, টিকিট থাকার পরও অনেকে সেখানে প্রবেশ করতে পারেন না। তবে সেদিন আমাদের ভাগ্য ছিল অত্যন্ত সুপ্রসন্ন, খুব বেশি দর্শনার্থীর চাপ না থাকায় আমরা সহজে পার্লামেন্টের ভেতর প্রবেশ করতে পারি। তবে পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি ছিল না। তাই চোখের দেখায় আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরের অংশ দুটি হলে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি হল পার্লামেন্টের অধিবেশনের কাজে ব্যবহার করা হয়, অন্য হলটি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত হয়। সংসদের অধিবেশনকক্ষের সব আসবাব কাঠের তৈরি। মূল অধিবেশনকক্ষ ছাড়াও সব কক্ষের খিলানে ঝোলানো রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের ছোট ছোট মূর্তি। আমাদের সঙ্গে থাকা ট্যুর গাইড জানালেন, আইনপ্রণেতারা যাতে সংসদে প্রবেশ করার পর সাধারণ মানুষের কথা ভুলে না যান, সে জন্য এ মূর্তিগুলো বানানো হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে, মূর্তিগুলো যেন বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী মানুষের জীবনকে প্রতিফলিত করে। পুরো সংসদ ভবনজুড়ে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি আইনপ্রণেতাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আমরা তোমাদের এখানে পাঠিয়েছি, আমাদের ভাগ্য নিয়ে তোমরা খেলো না।’
এ ছাড়া পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে একটি মিউজিয়াম আছে। হাঙ্গেরির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে মিউজিয়ামটি সাজানো হয়েছে। মিউজিয়ামে থাকা অন্যান্য নিদর্শনের চেয়ে হলি ক্রাউন অব হাঙ্গেরি নামে রাজমুকুটটি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। ক্যাতিসিয়া বললেন, হাঙ্গেরির ইতিহাসে প্রায় ৫০ জন রাজা এ রাজমুকুট পরিধান করেছেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য পতনের আগপর্যন্ত রাজা চতুর্থ চার্লসের অধীনে ছিল। সে সময়ের হাঙ্গেরি, আজকের মানচিত্রে আমরা যে হাঙ্গেরিকে দেখতে পাই, তার তুলনায় প্রায় তিন গুণ বড় ছিল।
[FA]pen[/FA] লেখক: রাকিব হাসান | দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।