সুন্দর শহরের ঝাপসা আলো - by Jupiter10
সুন্দর শহর কলকাতা. কত উঁচু উঁচু অট্টালিকা, উঁচু উঁচু ইমারত. সুন্দর আলো বাতি. ঝাঁ-চকচকে রাস্তাঘাট. কত ব্যস্ত মানুষ জন. সারাদিন রাত ছুটোছুটি. জীবন জীবিকার স্বার্থে এদিকে ওদিকে দৌড়ঝাঁপ. শুধুমাত্র একটা স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য.
তিলোত্তমা শহর কলকাতা. রকমারি আলোর রাত্রি. বাস- ট্রাম ও হলুদ ট্যাক্সির পেঁচ পেঁচানী.
বহু মানুষ ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ধর্ম, তারা এই শহরে আসে চোখে এক উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে. স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন ও জীবিকার আশায়. তাদের মধ্যে অনেকের হয়তো এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়. আবার অনেকেই আছে যাদের কাছে দিনে দুবেলা-দুমুঠো খাবারের যোগান ও স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়ায়.
জোটে না তাদের ভাগ্যে উঁচু উঁচু অট্টালিকা গাড়ি বাড়ি এবং স্বাচ্ছন্দ.
থাকতে হয় তাদের শহর বা শহরতলীর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার বস্তির মধ্যে. ছোট ছোট কাঁচা মাটির বাড়ি আর ভাঙ্গা টালির ছাদ. পানীয় জল এবং বিজলি বাতির নিত্য সমস্যা. ঝুঁকিপূর্ণ জীবন আর নিরাপত্তাহীনতা.
হ্যাঁ এই তিলোত্তমা শহর কলকাতার যেমন একটা সুন্দর দিক আছে ঠিক তেমনি একটা অসুন্দর দিকও আছে.
খেটে খাওয়া মানুষের মায়ানগরি কলকাতার বস্তি.
এই বস্তির অন্ধকার কুঠুরিতে জন্মানো আর তার অলিগলিতে বেড়ে ওটা বছর বারোর ছেলে সঞ্জয়.
বাবা পরেশনাথ পেশায় রিক্সা চালক আর মা সুমিত্রা বাড়ি বাড়ি পরিচারীকার কাজ করে.
সঞ্জয় ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে প্রতিদিন সকাল বেলা তার মা বাবা ঘুম থেকে উঠে তাদের প্রাতরাশ সেরে যে যার কাজে চলে যায়.
মা আসে দুপুর বেলা আর বাবা আসে সেই সন্ধ্যা বেলা তার রিক্সা টা নিয়ে.
মদ্যপায়ী বাবা সন্ধ্যা বেলায় মদ খেয়ে এসে সঞ্জয়ের মায়ের সাথে ঝগড়া ঝামেলা করে. অকথ্য গালিগালাজ দেয়.মাঝেমধ্যে নিজের স্ত্রীর গায়েও হাত তুলে দেয় পরেশনাথ.
সঞ্জয় ছোটবেলা থেকেই ভীতু, তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়.
তাই যখন ওর মাকে ওর বাবার কাছে মার খেতে দেখে, ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, মনের মধ্যে প্রতিবাদী ঝড় ওঠে কিন্তু কিছু বলতে পারেনা.
মাতাল বাবার ওই রূপ দেখলেই থরথর করে কাপে.
ক্রন্দনরত মাকে দেখলে মনে খুব কষ্ট হয়.
ঘরের বাইরে বেরিয়ে অনেক দূরে চলে যায়. রেল লাইনের ধারে যেখানে বস্তি গুলো শেষ হয়েছে. ওখানে চলে যায়.
কিছু দূরে রেল সোঁ সোঁ শব্দ করে তাদের বস্তির পাশ দিয়ে পেরিয়ে চলে যায়. সেটাকে দেখে ঘরের অশান্তি সাময়িক ভাবে ভোলার চেষ্টা করে.
বাবার ওপর খুব রাগ হয়, ক্ষোভে ফেটে পড়ে.
পরক্ষনেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়. মায়ের জন্য খুব চিন্তা হয় .মাকে খুব ভালোবাসে.
সুমিত্রাও ছেলে সঞ্জয়কে খুব ভালোবাসে. সে চায়না তার ছেলে কোনো রকম কষ্ট ও অবহেলায় মানুষ হোক.
সে জানে বস্তির পরিবেশ খুব খারাপ. সেখানে অনেক খারাপ মানুষের আনাগোনা. সে চায়না তার ছেলে ঐসব লোকের সাথে মিলে মিশে একটা খারাপ মানুষ তৈরী হোক .
বিশেষ করে সুমিত্রা একদমই চায়না যে ওর ছেলে ওর স্বামীর মতো মাতাল ও দুশ্চরিত্রের মানুষ তৈরী হোক.
সে নিজে একজন নিরক্ষর মহিলা হলেও লেখাপড়ার গুরুত্ব জানে. তাই ছেলে সঞ্জয়কে বহু কষ্টের মধ্যেও সরকারি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার করে হাই স্কুলে ভর্তি করেছে. ছেলের যাতে লেখাপড়া ঠিক মতো হয় তার জন্য নিজের কষ্ট করে উপার্জনের টাকা করি দিয়ে একটা টিউশন এর ব্যবস্থা করেছে.
বিকেলবেলা সে যখন পরিচারীকার কাজে যায় সঙ্গে করে ছেলে সঞ্জয়কে নিয়ে গিয়ে ওই প্রাইভেট টিউশনএ দিয়ে আসে আবার ফেরার পথে ছেলেকে সাথে করে নিয়ে আসে.
সুমিত্রার স্বামী খুবই খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষ. সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যতটুকু আয় উপার্জন হয় তার প্রায় সর্বাংশ মদ ও জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয় .
সুমিত্রা যদি কখনো ওর স্বামীর কাছে টাকা পয়সা চেয়ে বসে তাহলে তাকে ওর স্বামীর কাছে অকথ্য গালিগালাজ শুনতে হয়.
একপ্রকার সংসারের সমস্ত দায়ভার তার উপর চলে এসেছে.
একদিকে তার পরিচারীকার কাজের স্বল্প আয় অন্য দিকে ছেলের লেখা পড়ার খরচ. তার উপর মাতাল স্বামীর অত্যাচার, জীবনকে এক কঠোর সংঘর্ষে পরিণত করে তুলেছে.
মাঝে মধ্যেই তার মনে হয় সব ছেড়ে বেড়ে দিয়ে কোথাও চলে যায়. আবার এক দুবার এটাও মনে হয় যে আত্মহত্যা করি. কিন্তু তা করতে পারেনা সে.
ছেলের মুখে চেয়ে, সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে আছে. ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ হতে দেখতে চায়, তার বিশ্বাস ছেলে একদিন বড়ো মানুষ হয়ে দাঁড়াবে .
তাই শত কষ্টেও হাঁসি মুখে সব কিছু সহ্য করে আসছে.
সারাদিনে চার ঘরে পরিচারীকার কাজ করে যত টুকু উপার্জন করে তাতে তার সংসার চলে না.
তাই পাড়া প্রতিবেশীর আরও সব মহিলাদের বলে রেখেছে যে, কোনো রকম কাজের সন্ধান পেলে তাকে জানাতে.
যতদিন না সঞ্জয় বড় হচ্ছে, গায়ে গতরে তাকে খেটে টাকা পয়সার জোগাড় জানতি করে রাখতে হবে. স্বামীর উপর আর ভরসা নেই তার.
দিনদিন পরেশনাথ আরও মাতাল আর জুয়াড়ি হয়ে উঠছে. বৌকে একদম ভালোবাসে না সে.
আর ছেলে টাকেও কোনো রকম তোয়াক্কা করেনা. ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেয় তার . শুধু মদ আর মদ.
মাঝে মধ্যে যখন পরেশনাথ সাদা চোখে থাকে, সঞ্জয়ের মা তাকে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ গো... তুমি প্রতিদিন এমন করে এতো মদ খাও কেন??
পরেশনাথ তখন তার খসখসে কর্কশ গলায় বলে, “ধুর.... শালা সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করি.... এক জায়গার মানুষকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দি... শেষে শালারা ঠিক মতো ভাড়া দেয়না... চাইলে অপমান করে গালাগালি করে... যতসব বাবুর দল... আমাদের মতো গরিব মানুষদের তু তুকারি করে.... সম্মান দেয়না..... কি করবো আমরা গরিব বলে মানুষ না.... আরে আমরা খেটে খাই... তোদের মতো ঘুষখোর নই... শালা বড়োলোক বাবুর দল”.
সুমিত্রা চুপ করে তার স্বামীর কথা শোনে.... আর মনে মনে ভাবে, “হয়তো তার স্বামীর এই মদ খাওয়া সারাদিন তার সাথে ঘটে যাওয়া নানা রকম অমানুষিক কৃত্যের ফল, স্বামী হয়তো মদ খেয়ে সব কিছু ভুলতে চায়.... সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসন্নতাকে মদের মাধ্যমে দূর করতে চায়”.
সঞ্জয়ের বাড়িটা মাটির তৈরী টালির চাল, দুটো রুম, সামনের ঘরটায় এখন ও থাকে আর ভেতরের ঘরে বাবা মা .
সারাদিন স্কুল আর বন্ধুদের সাথে দৌড়া দৌড়ি করে কেটে যায় দিনকাল.
বাবার রিক্সার পুরোনো টায়ার চালিয়ে চালিয়ে বস্তির এ মাথা থেকে ও মাথা ঘোরা ফেরা করা তার কাজ.
তবে বস্তির অন্য পাড়ায় সে যায়না কখনো, সেখানকার দুস্টু ছেলেরা তার টায়ার গাড়ি কেড়ে নিয়ে তাকে মারধর করতে পারে. ঐসব দুস্টু ছেলেদের ভয় পায় সে.
তার মা তাকে নিষেধ করেছে ওই পাড়ায় যেতে আর মা এটাও বলেছে যে টাউনের দিকে ভুল করে কখনো যেন না যায়, রাস্তাঘাটের দুস্টু ছেলেধরা তাকে ধরে নিয়ে চলে যেতে পারে.
মায়ের কথা খুব মানে সঞ্জয়, কারণ সে জানে মায়ের কথা অবমাননা করলে তার মা তাকে বকাঝকা করতে পারে এবং মারও দিতে পারে.
মা তাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি তাকে খুব শাসন ও করে. তার মা খুব রাগী.
পাড়ার আরও ছেলেরা যেমন তুষার, রফিক, আসলাম এরা সব সঞ্জয়ের বন্ধু. তাদের মধ্যে রফিক খুব ধূর্ত ছেলে, মুখে সবসময় নোংরা খিস্তি লেগে থাকে.....তাছাড়া রফিক ছেলেটাও সঞ্জয়, তুষার আর আসলামের থেকে বয়সে বড়, ওর বয়স এখন পনেরো বছর.
রফিকের বাবা আনসার রঙের কাজ করে আর মা আমিনা পাড়ার একটা হোটেলে রাঁধুনির কাজ করে .
সঞ্জয়ের এখনো মনে পড়ে... ওর মা একবার ওকে খুব বকে ছিল রফিকের সাথে মেলা মেসা করে বলে.
একবার রফিক, সঞ্জয় ও বাকি ছেলেদের নিয়ে কোনো এক বাবুদের বাড়ি গিয়েছিলো চুরি করবে বলে. সঞ্জয় না বুঝেই তাদের সাথে চলে গিয়েছিলো, খেলার ছলে.
পরে সে জানতে পারে রফিক পাঁচিল টপকে ওই বড়ো বাড়িটাতে কি যেন চুরি করতে চলেছে.
সঞ্জয় খুব ভয় পেয়েছিলো সে সময়.
কিছু না বুঝেই সজোরে দৌড় দিয়েছিলো তার নিজের ঝুপড়ির দিকে.
ঘরে মাকে ব্যাপারটা জানাতে, মা তার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে ছিল.
সেদিন থেকে সঞ্জয় প্রন নেয় যে রফিকের সাথে সে আর মেলামেশা করবে না.
আসলাম, সঞ্জয়ের খুব ভালো বন্ধু ওরা দুজনেই একই সাথে একই স্কুলে পড়ে. আসলামের বাবা সালাউদ্দিন ট্যাক্সি চালায় আর মা শামীমা, সঞ্জয়ের মায়ের মতো পরিচারীকার কাজ করে.
আসলামরা গরিব হলেও ওদের অবস্থা কিছুটা ভালো সঞ্জয় দের থেকে কারণ আসলামের বাবা মদ ভাঙ্গ খায় না.
তাছাড়া আসলামের বাবার আয় উন্নতি পোরেশনাথের থেকে যথেষ্ট ভালো.
তাই সঞ্জয় অনেক সময় আসলামের কাছে থেকে ছোটোখাটো জিনিস যেমন খেলনা, সামগ্রী, বইপত্র ইদ্যাদির সাহায্য পেয়ে থাকে.
সঞ্জয় ও এই বয়স থেকে বেশ খুদ্দার ছেলে, ওর মা ওকে শিখিয়ে রেখেছে যে, কারো কাছে কোনো জিনিস যেন সে এমনি এমনি না নেয়, বিনিময়ে কিছু দিয়ে দেয়....
তাই সঞ্জয় ও.....যখন ওর মা ওকে টাকা পয়সা দেয় তখন কেক বিস্কুট কিনে নিজেও খায় আর আসলাম কেও খাওয়ায়.
সঞ্জয় পড়াশোনা তেও বেশ মনোযোগী... সন্ধ্যা বেলা যখন ওর মা রান্না করে তখন ও ওদের ছোটো উঠোনের মধ্যে বসে জোরে জোরে বই পাঠ করে .
এইরকম শহরতলীর মধ্যে গড়ে ওটা ছোটো ছোটো অগুন্তি বস্তির মধ্যে কতই না সঞ্জয় আছে আর কতই না সুমিত্রার মতো মায়েরা আছে.
যারা দিন আনে দিন খায়... আর চোখে বড় হবার স্বপ্ন দেখে.
একদিন সন্ধ্যা বেলা সঞ্জয় খেলাধুলা করে... বাড়ি ফিরে এসে দেখে... ঘরের দরজার সামনে ওর মা বসে আছে.
একটু উদাসীন... কি যেন চিন্তা করছিলো.. একটা হাত গালের মধ্যে দিয়ে আর মুখটা মাটির দিকে নামিয়ে.
সঞ্জয় তার চিন্তিত মায়ের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলো. মাকে এইরকম দেখতে তার ভালো লাগেনা,
অনেক সময় যখন বাবা মায়ের ঝগড়া হয়, বাবা মাকে মারে তখন মা এই ভাবে বসে থাকে মন দুঃখী করে কিন্তু, এই কয়দিনে তো তাদের মধ্যে ঝগড়া ঝামেলা হয়নি,
তাহলে মা এমন করে কেন বসে আছে.
একটু ভাবতে লাগলো সে.
অবশ্য...মা একটু হাঁসি খুশিতে কম থাকে...বাবার ঐরকম অবস্থার জন্য...তবুও এভাবে মাকে স্থির হয়ে চিন্তা ভাবনা করতে খুব কমই দেখেছে সঞ্জয়.
একটু স্তম্ভিত থাকার পর সঞ্জয়.
সামনের কুয়ো থেকে জল তুলে... তা দিয়ে নিজের হাত পা মুখ ধুয়ে নিয়ে.. আবার তার মায়ের মুখের একবার দিকে চেয়ে দেখলো .
তারের মধ্যে রাখা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মাকে প্রশ্ন করলো...”কি হয়েছে মা...তুমি এমন করে বসে আছো কেন.....?
“কিছু না রে এমনি...” সুমিত্রা তার ছেলেকে বলে উঠল.
ছেলে এখন শিশু...তাকে এভাবে নিজের মনের অশান্তির কথা জানানো ঠিক হবে না.
মনে মনে বলতে লাগলো সঞ্জয়ের মা.
কি ভাবে বলবে যে আজ সে তার একবাড়ি কাজ হারিয়েছে... কারণ সে বাড়ির লোকজন কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে.
একটা বাড়ির কাজ হারানো মানে...মাসিক আয়ের প্রায় চারআনা ভাগ কমে যাওয়া.তার সাথে একটা বাড়তি চাপ আর দুশ্চিন্তা.
বেশ কয়েকটা মাস হয়ে গেলো...সঞ্জয়ের টিউশন মাস্টারকে তার বেতন দেওয়া হয়নি.
সঞ্জয়কে দিয়ে বেশ কয়েকবার ওর টিউশন মাস্টার সুমিত্রাকে খবর পাঠিয়েছে বেতনের ব্যাপারে.
সুমিত্রা তাকে বেশ কয়েকবার আশ্বাস দিয়ে এসেছে যে...তার বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেবে খুব শীঘ্রই .কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি.
আরও দেরি করতে থাকলে হয়তো সঞ্জয়ের টিউশন পড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে.
এইতো দুমাস আগে সঞ্জয়ের বাবা পরেশনাথের অসুখ হয়েছিল তখন বাবু দের বাড়ি থেকে টাকা ধার করে সুমিত্রাকে তার চিকিৎসা করাতে হয়েছিলো.
এভাবে চলতে থাকলে...বিয়ের সময় বাপ্ মায়ের দেওয়া সামান্য গয়না গাটি আছে সেগুলোকেও বেচতে হবে...
দুয়ারের মধ্যে বসে, ভাবতে ভাবতে গালের মধ্য থেকে হাতটা সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্জয়ের মা....তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে.....পড়তে বস সঞ্জু...আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি.
সঞ্জয় মায়ের আদেশ গ্রাহ্য করে....বলে “হ্যাঁ মা...বসছি..”
ঘরের মধ্যে চাটায় বিছিয়ে...বই পত্র নিয়ে পড়তে বসে যায় সে.
বিড়বিড় করে পড়া আরম্ভ করে দেয়...মাঝে মাঝে পড়া থেমে যায়.
শুধু বার বার মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে....কিছু যেন লুকাচ্ছে মা...টাকা পয়সার ব্যাপারে কি...
সঞ্জয় ছোট হলেও বোঝে মায়ের কষ্ট গুলো....তাই মনে মনে বলে...মায়ের কাছে কখনো আর অযথা বায়না করবে না.
আজ সন্ধ্যাবেলা হয়ে গেলো....বাবা এখনো অবধি ফিরলো...নির্ঘাত আজ হয়তো বাবা মদ খেয়ে আসবে.
মায়ের সাথে অশান্তি করবে.
বুকটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠল অশান্তির কথা ভেবে.
হঠাৎ দেখে ওর মা আসছে...ওর জন্য খাবার নিয়ে.তাড়াতাড়ি আবার জোরে জোরে পড়া শুরু করে দেয় সঞ্জয় .
মা যদি দেখে যে, সে বই খুলে আকাশ কুসুম চিন্তা করছে, তাহলে বেজায় রেগে যাবে.
তাই সে মনোযোগ দিয়ে পড়ার ভান করতে লাগলো.
“এই নে সঞ্জু....মুড়ি টা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, দিয়ে আবার পড়তে বসবি...”.বলে সুমিত্রা ওর ছেলেকে খাবার দিয়ে, রান্না ঘরে চলে গেলো.
সঞ্জয় হাতে করে মুড়ি খাওয়া সবে শুরু করেছে, তখনি ওর বাবা কেঁচোর কেঁচোর শব্দ করে রিক্সাটা নিয়ে বাড়ি ফিরলো.
সঞ্জয় মাথা তুলে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাবা কি আজ সত্যিই মদ খেয়ে এসেছে..না...আজ বোধহয় বাবা মদ খাইনি..
পরেশনাথ কে দেখে সঞ্জয় আবার পড়াশোনায় মন দেয়.
ওদিকে সুমিত্রা দেখে ওর স্বামী আজ সাদা চোখে বাড়ি ফিরেছে...মনে মনে ভাবলো, তাহলে ছেলের টিউশোনের টাকাটা চাওয়া যাবে.
সুমিত্রা একটা গ্লাসে করে জল নিয়ে গিয়ে পরেশনাথকে দেয়, আর একটু আড়ষ্ট ভাব নিয়ে বর কে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যা...গো আজ তোমার ভাড়া কেমন হয়েছে...? “
ঢক ঢক করে জল খাওয়ার পর .
পরেশনাথ গম্ভীর গলায় বলে, “কেন....কি হয়েছে....আজ তুমি আমার ভাড়ার কথা...জিজ্ঞাসা করছো....”.
“না ওই হাতে এখন আমার টাকা কড়ি নেইতো আর কাজের ঘরে মাইনে হয়নি এখনো ....তাই বলছিলাম....” বলে সুমিত্রা একটু চুপ করে রইলো. তারপর আবার বলল, “আসলে ছেলের টিউশন এর টাকা অনেক দিন ধরে বাকি পড়ে আছে...দেওয়া হয়নি...সেদিন মাস্টারমশাই টাকাটা চাইছিলো...তাই বলছিলাম...তোমার কাছে থাকলে দিয়ে দিতাম....”.
পরেশনাথ, ওর বউয়ের কথা শুনে একটু বিরক্ত হলো, বলল “না আজ ঠিক মতো ভাড়া হয়নি....আর আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই”.
সুমিত্রা আবার একটু বিনতীর স্বরে বলল, “দেখো না...যা হয়...তাই দাও...টাকার অভাবে ছেলের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে এটা ঠিক হবে না “.
পরেশনাথ উঠে পড়ে....সুমিত্রাকে ধমক দিয়ে বলল, “বললাম তো...আমার কাছে একটা কানাকড়ি ও নেই....তা ছাড়া...তুমি ওকে পড়াচ্ছ কেন...বার বার বলেছি যে লেখাপড়া গরিবদের জন্য নয়...ও রিকশাওয়ালার ছেলে বড়ো হয়ে রিক্সাওয়ালায় হবে”.
মায়ের উপর বাবার ধমক, পড়তে পড়তে সঞ্জয়ের কানে আসে.
মনে মনে বলে হে ঠাকুর আজ যেন বাবা মাকে না মারে...
ওদিকে সঞ্জয়ের মা ও ভেবে নিলো যে....ওর স্বামীর কাছে কোনো রকম টাকা পয়সার সাহায্য পাওয়া যাবে না.
তাই সে আবার রান্নাঘরে গিয়ে নিজের কাজে মন দেয়.
পরেশনাথ ও নিজের পোশাক বদলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে.
পরদিন সকাল বেলা, পরেশনাথ নিজের রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে.সে সময় সুমিত্রা ঘরের রান্নাবান্না তৈরী করে ছেলেকে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়. আর নিজে পরিচারীকার কাজে বেরিয়ে পড়ে.
রাস্তায় যেতে যেতে সে ভাবে যে আজ দেখি বাবুদের ঘরে, কিছু অগ্রিম টাকা পাওয়া যায় কি না... এইতো কয়েকমাস আগে সঞ্জয়ের বাবার অসুখের সময় একটা বাড়ি থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে ছিলো কিন্তু তা এখনো শোধ করা হয়নি...তাই এবারে আর টাকা পাওয়া যাবে কি?
না পেলে ঘোর সংকটে পড়বে সঞ্জয়ের মা..
ভয় হয় তার...আরও জোরে জোরে হেঁটে কাজের বাড়ির দিকে যেতে থাকে.
ওদিকে সঞ্জয় স্কুলের ড্রেস পরে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে আসলামের বাড়ির দিকে এগোয়. আসলাম আর সঞ্জয় দুজন মিলে একসাথে স্কুল যায় .
যাওয়ার সময় আসলাম সঞ্জয় কে জিজ্ঞাসা করে, “কিরে তুই কয়েকদিন ধরে টিউশন পড়তে যাচ্ছিস না?”
সঞ্জয়, আসলামের কথায় উত্তর দেয়, “যাচ্ছি না তার কারণ...আমার টিউশন এর বেতন অনেক দিন ধরে স্যার কে দিতে পারিনি... তাই সেদিন মাকে স্যার বলেছিলেন এভাবে টাকা না দিলে উনি আর আমাকে পড়াবেন না”.
আসলাম, সঞ্জয়ের কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিলো...তারপর আবার বলল..”হুম...কেন তোর বাবা টিউশন এর টাকা দেয়না??”
“না রে...আমার বাবা তো ঘরে কোনো টাকা পয়সায় দেয়না...বাবা শুধু মদ খায়, তুইতো জানিস” সঞ্জয় উত্তর দেয়.
আসলাম আবার বলে, “ঠিক আছে...শোননা...আমি না আমার আব্বা কে বলবো তোর টিউশন এর টাকাটা দেবার জন্য”
সঞ্জয়, আসলামের কথা শুনে খুশি হয়...”বলে..তোর বাবা খুব ভালো...উনি যদি আমার টিউশন এর টাকাটা দিয়ে তাহলে খুব ভালো হয়...আমি আবার টিউশন পড়তে যেতে পারবো”
দুপুর বেলা...সঞ্জয়ের মা...উদাস মনে কাজ করে বাড়ি ফেরে,
এবার কাজের বাড়ি থেকে অগ্রিম টাকা পায়নি...তাই একটু চিন্তিত ছিলো সে.
একবার ভাবলো যে.. সন্ধ্যাবেলা টিউশন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে বিনতি করে আসবে, ছেলেকে পড়ানোর জন্য...
কিছক্ষন পর সঞ্জয়ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসে.
মাকে আবার উদাসীন দেখে মন খারাপ হয়ে যায় তার.
বলে, “মা আজ আমি...আসলামকে বলেছি...ওর বাবা...আমার টিউশনের টাকা দিয়ে দেবে বলেছে...তুমি মাইনে পেলে...শোধ করে দিও..”
ছেলের কথা শুনে মনে মনে ভেঙে পড়ে সুমিত্রা...শেষ পর্যন্ত...ছেলের লেখাপড়ার জন্য পাড়া প্রতিবেশীর কাছে থেকে টাকা ধার চাইতে হবে...
সঞ্জয়ের মায়ের ধারণা এই বস্তির লোকজন খুবই স্বার্থপর হয়...এদের কাছে টাকা ধার নেওয়া একদম উচিত না.
ধমক দিয়ে সঞ্জয় কে বলে, “থাক তোকে আর লেখাপড়া করতে হবে না...ওতো লোকের কাছে আমি টাকা ধার নিয়ে পড়াতে পারবো না...তোর বাবা ঠিকই বলে...গরিবের আবার লেখাপড়া কিসের...ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে...”
মায়ের কথা শুনে সঞ্জয় ঘাবড়ে উঠে....মনে মনে বলে...আজ মা হয়তো কাজের ঘর টাকা পয়সা পায়নি...তাই...হতাশ হয়ে...রেগে যাচ্ছে.
মায়ের খুবই কষ্ট...বাবাও কষ্ট দেয় আর আমিও কষ্ট দিচ্ছি...
সে মনে মনে আবার বলে বড়ো হয়ে আমি মায়ের সব কষ্ট দূর করবো...
“ঠিক আছে মা...আমি টিউশন পড়তে যাবনা...ঘরেই নিজে নিজে পড়ে সব মুখস্ত করে নেবো... তুমি চিন্তা করোনা..” বলে সঞ্জয় স্কুলের জামাকাপড় বদলে...খেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে.
ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়...বেশি দেরি করলে আবার হয়তো মায়ের কাছে বকা খেতে হবে...
বাড়ি ফেরার কিছক্ষনের মধ্যেই বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শুনতে পায় সঞ্জয়.
খাটের মধ্যে ওর মা বসে ছিলো...মা ছেলে একে ওপরের মুখের দিকে তাকায়.
সঞ্জয় বাইরে বেরিয়ে যায় দেখে...আসলাম আর সাথে একটা লম্বা ফর্সা আর রোগা লোক, থুতনির নিচে লম্বা দাড়ি...এটা নিশ্চয় আসলামের বাবা.
আসলাম হাঁসি মুখে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “সঞ্জয় এটা আমার আব্বুজান...তোর কথা আমি আব্বুকে বলে ছিলাম তাই তিনি এসেছে...”
সঞ্জয়, আসলামের বাবার দিকে তাকিয়ে হাঁসে...লোকটার মুখটা দেখে খুব ভালো মানুষ বলে মনে হলো সঞ্জয়ের.
ঘরের মধ্যে গিয়ে মাকে ডেকে আনে সে, “মা দেখো আসলাম আর ওর বাবা এসেছে...কি বলতে চায় তোমাকে...”
সুমিত্রা নিজের কাজ ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসে.
আসলামের বাবা সঞ্জয়ের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে...একবার পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলিয়ে নেয়... তারপর ঢোক গেলে...
সুমিত্রা লোকটার ঐরকম চাহুনি দেখে নিজেকে অস্বস্তি বোধ করে...শাড়িটা ঠিক করে নেয় আর আঁচল দিয়ে নিজের উন্মুক্ত পেট ও নাভি ছিদ্রকে ঢেকে নেয়.
সড়গড় ভাবেই বলে উঠে, “হ্যাঁ বলুন কি বলছেন...?? “
সালাউদ্দিন এর মুখে হাঁসি ফোটে বলে “বেহেনজি...আমি...আসলামের বাবা....” “আসলাম বলছিলো ওর দোস্তের...টাকার দরকার আছে...টিউশনের জন্য...তাই এসেছিলাম”.
সঞ্জয়ের মা সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকায় তারপর উত্তর দেয়...”না না...টাকা পয়সার...দরকার ছিলো কিন্তু...এখন আর নেই...”.
সালাউদ্দিন আবার মুচকি হাঁসে...বলে, “ঠিক আছে...বেহেনজি...কোনো অসুবিধা...নেয়...আসলে আমরা গরিব আদমি...ঝুপড়িতে থাকি..আর মানুষ...মানুষকে মদত করবে নাতো কে করবে বলো...”
সুমিত্রা কোনো উত্তর দেয়না...
আসলামের বাবা আবার বলে..”আচ্ছা আমি চলি...তুমি আমার বহিনের মাফিক আছো..কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও...সাথে থাকবো...”
সুমিত্রা বলে...”হ্যাঁ দাদা নিশ্চই..বলবো...আপনাকে...আসবেন...আবার...”
আসলামরা চলে যাবার পর, সঞ্জয়ের মা ওকে আবার বলে...”শোন..সঞ্জয় এভাবে...ঘরের সমস্যা বাইরের কাউকে কখনো বলবিনা...কেমন...ওতে ওরা আমাকে আর তোর বাবাকে খারাপ মনে করবে...ঠিক আছে সোনা..কাউকে কোনো দিন বলবিনা”.
সঞ্জয় ও মাথা নেড়ে উত্তর দেয় “ঠিক আছে মা এবার থেকে আর বলবো না...’.
বলে সঞ্জয় নিজের বইপত্র নিয়ে পড়তে বসে যায়.
মা নিশ্চয় টাকা পয়সা জোগাড় করে নিয়েছে অথবা আসলামের বাবার কাছে থেকে সাহায্য নিতে চাইছে না...মনে মনে বলে সঞ্জয়.
পরদিন সকালবেলা সুমিত্রা সঞ্জয়কে বলে চল তোর মাস্টারমশাই এর সাথে কথা বলে আসি...
“কি বলবে মা” প্রশ্ন করে সঞ্জয়.
“বলবো আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন সব টাকা মিটিয়ে দেবো..”. বলল সুমিত্রা.
ঘর থেকে বেরোবার সময়ই পাড়ার এক মহিলা তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো...
সুমিত্রা বাইরে বেরিয়ে দেখে....অলকা মাসি...আর সাথে আরেকজন অপরিচিত মহিলা...দেখে মনে হলো...শহুরে.
“এই সুমি...তুই কাজ খুজঁছিলি না...” একটু ক্যাটক্যাটে গলায় বলে ওঠে অলকা.
সুমিত্রা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে...তারপর বলে, “হ্যাঁ মাসি....এই কদিন আগে একটা কাজ হারিয়ে...খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছি”.
“কাজের সন্ধান থাকলে বলো না...”.
“তার জন্যই তো এসেছি....”বলে অলকা ওই অপরিচিতা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখছেন...এই মেয়ে হলো সুমিত্রা....আমাদের বস্তির বৌ....স্বামী হলো একটা আস্ত
মাতাল...ঘর সংসার দেখে না...তারপর ছেলেও বড়ো হচ্ছে...সংসারের চাপ...পুরোপুরি এই মেয়ের উপর...কতই বা বয়স হবে সুমির ওই তিরিশ বত্রিশ”
তারপর ওই মহিলাটি সঞ্জয়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে...”তাইতো দেখছি....মেয়ে ভারী মিষ্টি দেখতে...”
কথাটি শোনার পর অলকা আবার ওর কেটকেটে গলায় বলে, “হ্যাঁ দেখুন না...কেউ বলবে সুমি...বস্তির বউ....বলুন তো....এতো সুন্দরী মেয়ে....গোটা বস্তিতে নেই...সুমি যেমনি মিষ্টি দেখতে তেমনি মিষ্টি স্বভাবের, শুধু ওর কপালটাই খারাপ....তানাহলে পরেশনাথের মতো ঐরকম মাতাল জুয়াড়ি..মরদ জোটে ওর ভাগ্যে...”
‘রাজরানীর মতো থাকা মেয়েকে কিনা পরের বাড়িতে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে বলুন তো...”.
অলকার কথাগুলোতে সুমিত্রা বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলো....
বলল, “থাক না...মাসি..এসব কথা, আমার জন্য কোনো কাজ আছে বলোনা”.
অলকা বলে, “তাইতো দিদিমনি এসেছেন...তোকে কাজে নেবার জন্নি”.
তারপর ওই মহিলাটি কথা বলা শুরু করলেন..”মা তুমি আমার বাড়িতে কাজ করো...কোনো অসুবিধা হবে না...টাকা পয়সার...ঘরে মাত্র দুইটি লোক...আমি আর আমার বৃদ্ধ স্বামী...এমনিতে আমার বাড়িতে তেমন বেশি কাজ নেয়...শুধু বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার আর কিছু না...তুমি করলে খুব ভালো হয়..করবে তো মা?? ‘
সুমিত্রা বলে, “কেন করবো না কাকিমা...এমনি তেই কয়েকদিন আগে একটা বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে ওই সময়টা ফাঁকাই চলে যাচ্ছে”
কথার মাঝে ওই বৃদ্ধ মহিলাটির নজর সঞ্জয়ের দিকে যায়.আর বলে, “মা সুমিত্রা এটা কি তোমার ছেলে...”
সুমিত্রা হেঁসে উত্তর দেয়...”হ্যাঁ ও আমার ছেলে...সঞ্জয়...”
মহিলাটি বলে, “বাহ্, ছেলে তো বেশ বড়ো হয়ে গেছে...পড়াশোনা করে তো...?? ”
সুমিত্রা বলে...হ্যাঁ ওকে হাই স্কুলে ভর্তি করেছি...
মহিলাটি বলে...”হ্যাঁ মা তোমার ছেলেকে পড়াচ্ছ খুব ভালো কথা...তা নাহলে...বস্তির ছেলেরা এই বয়সে সব...না না রকম অপরাধ মূলক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে...”
মহিলাটির কথা শুনে সুমিত্রার একটু রাগ হলো...তাতে সে কিছু আর প্রতিক্রিয়া দেখালো না..
ও জানে বস্তির মানুষের প্রতি লোকের চিন্তা ভাবনা কেমন...
শুধু হুম বলে চুপ করে রইলো...
তারপর মহিলাটা সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কি এখন আমার সাথে যেতে চাও...আমার বাড়ি দেখে আসবে চলো”
সুমিত্রা রাজি হয়ে যায়...তার আগে ছেলেকে মাস্টারের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে...
দেখলো সঞ্জয়ের টিউশন মাস্টারের বাড়ির ওই দিকেই মহিলাটির বাড়ি...
সুতরাং তাদের একসাথে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না..
সঞ্জয় আর সঞ্জয়ের মা প্রথমে টিউশন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে কথা বলে...সুমিত্রা অনেক কাকতিবিনতি করে ছেলেকে পড়ানোর জন্য বলে “এই মাসের বেতন পেলেই তাকে দিয়ে দেবেন”...মাস্টারমশাই ছমাসের টাকা বাকি...সেটার কথায় শুধু বলে চলেছিলেন ...অবশেষে রাজি হয়ে যান...এই শর্তে যে অর্ধেক টাকা আগামী পনেরো দিনের মধ্যেই দিয়ে দিতে হবে...সুমিত্রা সে মুহূর্তে কোনোকিছু না ভেবেই..মাস্টারমশাইকে টাকা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়.
টিউশন মাস্টার সঞ্জয় কে বলে দেয় যে পরের দিন যথা সময়ে টিউশন পড়তে চলে আসতে.
তারপর সঞ্জয় ও তার মা সেই মহিলা টার সাথে ওনার বাড়ির দিকে চলে যায়.
সেখানে সুমিত্রা ওই মহিলাটার সাথে ওনারদের বাড়িতে প্রবেশ করে যায়...আর সঞ্জয় সেই বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখেই, নিজের বস্তির দিকে চলে যায়.কারণ তার স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছিলো.
সঞ্জয়ের মা সুমিত্রা ও ভেবে নিয়ে ছিলো যে..এ মাসে তার বেতনের কিছু অংশ টিউশন মাস্টারকে দিয়ে দেবে...যাতে ওর ছেলের পড়াশোনা না বন্ধ হয়ে যায়..
তাতে এ মাসে ঘরে অনটন চলে আসলেও সে কোনোরকম সামলে নেবে...
আসতে আসতে দিন পেরিয়ে যায়...সঞ্জয় ও তার লেখাপড়া আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে.শিশুমন কি জানে দিন দুনিয়া আর সংসারের নির্মম খেলা.
ঐদিকে সুমিত্রা একটা একটা করে দিন গুনতে থাকে...নিজের মাস মাইনে হবার...দুশ্চিন্তা ও হয় কারণ মাস্টারমশাই কে দেওয়া প্রতিশ্রুতির দিন ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে.
সঞ্জয়ের যেদিন টিউশন পড়া থাকে...সেদিন টিউশন শেষে মায়ের ওই কাজের বাড়িটাতে চলে যায়..ও বৈঠকখানায় বসে থাকে আর মা কাজ করে...
শেষে মা ও ছেলে দুজন মিলে একসাথে বাড়ি ফেরে...
মায়ের ওই কাজের বাড়িটা সঞ্জয়ের খুব ভালো লেগে গিয়েছে...কারণ ওই বাড়ির মহিলা ওকে ভালো ভালো খাবার, কেক ও লজেন্স দেয়...যখনি যায় তখনি দেয়.
শুধু ওই বাড়ির বুড়ো লোকটাকে সঞ্জয়ের ভালো লাগেনা....উনি খুব উগ্র...সঞ্জয় কে দেখলে খেঁকিয়ে ওঠে...বস্তির গরিব ছেলে দের পছন্দ করে না সে.
সেদিন ছেলে সঞ্জয়, মাকে জিজ্ঞাসা করে “মা...আর কয়েকদিন বাদে পনেরো দিন হয়ে যাচ্ছে...মাস্টারমশাই কে টাকাটা দিতে হবে...”
ছেলের কথা শুনে সুমিত্রা বলে “হ্যাঁ রে...আমার মনে আছে..এই মাসের বেতন পেলেই তোর মাস্টারমশাই কে টাকা দিয়ে দেবো...”
সময় পেরোতে থাকে...সঞ্জয়ের মায়ের হাতে পয়সা আসে...সারা মাস লোকের ঘরে ঝিয়ের কাজ করে অবশেষে স্বল্প খানেক টাকা সে পায়...ওই দিয়েই সে খুশি...কারণ ছেলের বাকি থাকা টিউশনের পয়সা সে এই মাসে কিছুটা হলেও মেটাতে পারবে..
কিন্তু হতভাগা সুমিত্রার জীবনে সুখ লেখা নেয়.
সেদিন সন্ধ্যা বেলা পরেশনাথ আবার মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে...সুমিত্রার সাথে ঝামেলা করে...ওর কাছে টাকা চায়...কারণ সে আজ জুয়াতে অনেক টাকা হেরে গেছে...তার রাগ সুমিত্রার ওপর ঝাড়ে...
সুমিত্রা প্রানপন চেষ্টা করে টাকা না দেবার....সেসময় পরেশনাথ ওর গায়ে হাত তোলে...গালাগালি দেয়...বলে, “খানকিমাগী....তুই রেন্ডি গিরি করে অনেক টাকা কামাস...আজ দে তোর সব টাকা...আমি জুয়া খেলবো মদ খাবো...দে টাকা দে রেন্ডিমাগী....বড়ো বড়ো বাবুরা তোর এই গতর দেখেই তোকে কাজে রাখে...ওরা তোর এই রসালো শরীরের রস খায়...”
সঞ্জয় বাইরের ঘর থেকে সবকিছু শোনে....বাবার গালাগালি...মায়ের কান্না...বাবার অশ্রাব্য ভাষা তার বোধগম্যের বাইরে...কিন্তু মায়ের কান্না....মায়ের কান্না তার কাছে অনেক খানি গুরুত্ব রাখে...
সে নিজেও মনে মনে কেঁদে ফেটে পড়ে...সে অসহায়...মায়ের জন্য কিছু করতে পারে না..
পরেশনাথ...সুমিত্রার কাছে থেকে হাত মুচড়ে টাকা নিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়...
সঞ্জয় সে মুহূর্তে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়...ক্রন্দনরত মায়ের মাথায় হাত বোলায় চোখের জল মুছে দেয় আর বলে “কেঁদো না মা...কেঁদো না...আমি বড়ো হয়ে যাই তোমাকে অনেক সুখ দেবো...”
সুমিত্রা ও চোখের জল নিয়ে ছেলের দিকে তাকায় আর ভাবে...ছেলের কথা যেন সত্যি হয় ঠাকুর...ছেলে মরদ হয়ে তাকে প্রতিদিন অনেক সুখ দেয়..
এর পরে কয়েকদিন সুমিত্রাকে আবার চিন্তা গ্রস্ত লাগছিলো...সঞ্জয় সেটা দেখছিলো.
সে জানে ঘরে অশান্তি হলে মা বেশ কয়েকদিন এভাবেই মন খারাপ করে থাকে.
সেদিন মাস্টারমশাই ও টাকাটা চেয়েছিলো....সঞ্জয় কিছু বলেনি মাকে...ভাবছিলো এবার টিউশন ছেড়ে দেবে...
কিন্তু মা একদিন নিজেই টিউশন মাস্টারের সাথে কথা বলে আগামী দুদিনের মধ্যে টাকা দিয়ে দেবে বলে কথা দিয়ে এসেছে...
সেহেতু সঞ্জয়ের টিউশন বন্ধ হয়নি....একদিন রোববার ছিলো...স্কুল ছুটি...কিন্তু টিউশন পড়া ছিলো...এবারও সঞ্জয় পড়া শেষে মায়ের ওই কাজের বাড়িতে যায়...ওই বাড়ির মহিলা সঞ্জয়কে ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়...
সঞ্জয় ওই বাড়িতে ঢুকে দেখে মা...ঘর মুচছে...
তাই সে ওখানকার বারান্দায় চুপ করে বসে রইলো...সুমিত্রা ওর ছেলেকে একবার বাড়ি চলে যেতে বলল কারণ আজ ওর দেরি হতে পারে..
সঞ্জয় ও ওর মাকে বলল যে আজ স্কুল নেয় তাই দেরি হলে অসুবিধা হবে না...
ছেলের কথা শুনে সুমিত্রা একটু অস্বস্তি বোধ করল কিন্তু আর কিছু বলল না...
তক্ষুনি ঘরের ওই মহিলা কিছু খাবার নিয়ে এসে সঞ্জয়কে দিলো...আর বলল..”তুমি এগুলো খাও আর মায়ের কাজ হয়ে গেলে মায়ের সাথে চলে যেও...”.
তারপর ওই মহিলা আবার সুমিত্রা কে একটা তেলের সিসি দিয়ে বলল “এটা নিয়ে তোর কাকুর হাত পায়ে একটু মালিশ করে দিস তো...আমি একটু বাজার থেকে আসছি...”
সুমিত্রা একবার ছেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালো....সঞ্জয় বারান্দায় বসে আপন মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে....
তখনি ঘরের মালিক ওই বুড়ো লোকটা উপর থেকে ভারী গলায় বলে উঠল “তুই বেটা আজকেও এসেছিস.....!!!”
“মাকে পাহারা দিতে....”
সঞ্জয় থতমত খেয়ে উপরে তাকালো...লোকটাকে দেখলে সঞ্জয়ের যত না ভয় হয় তার থেকে আরও বেশি রাগ হয়...
লোকটা তারপর সঞ্জয়ের মায়ের দিকে তাকায় আর বলে...”সুমিত্রা...তেলের শিশি টা নিয়ে এসো...তোমার কাকিমা বলল না যে আমার হাত পায়ে একটু মালিশ করে দিতে...”
সুমিত্রা আর কিছু না বলে উপরে বাবুর রুমে চলে যায়...
এদিকে সঞ্জয় খাবার খেয়ে কিছু ক্ষণ বসে থাকার পর মাকে ডাকার জন্য উপরে চলে যায়...
ঘরের মধ্যে সটান ঢুকে যায় আর দেখে...ওই লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে খালি গায়ে আর পরনে লুঙ্গি, ওর মা ওই লোকটার বুকে তেল মাখাচ্ছে...মা তেরছা করে বসে আছে বিছানার মধ্যে...
সঞ্জয় তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে যায়...সুমিত্রাও ছেলেকে পিছন ফিরে দেখে স্থির হয়ে যায়...তারপর লোকটা বলে “ওই দেখো তোমার গুণধর “
সঞ্জয় কিছু না ভেবে পেয়ে বলে, “মা...তুমি কখন যাবে...?? “
সুমিত্রা ছেলেকে আশ্বাস দেয়...বলে, “তুই যা নিচে গিয়ে বস...আমি এখুনি আসছি...”
সঞ্জয় একটু ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে আসে...আবার বারান্দায় বসে...ওর নজর তখন বাইরের গাছ পালা..ফুল ফল ইত্যাদির উপর...মা উপরে কি করছে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলো সে.
তারপর হঠাৎ মনে হলো ওর, যে অনেক খানি সময় পেরিয়ে গেছে, মা এখনো এলো না.
মা কি করছে এতক্ষন ধরে...ওই দাদুটাকে তেল মালিশ করছিল...এখন তো অনেক সময় হয়ে গেলো...মা এখুনি আসবে বলেছিলো...যায় একবার দেখে আসি...আর কতক্ষন সময় লাগবে...মাকে জিজ্ঞাসা করে আসি...
বলে সঞ্জয় একপা দুপা করে এগোতে এগোতে...সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো.
উপরে উঠেই সঞ্জয় একপ্রকার চমকে উঠল....উপরে ঘরের ভেতর থেকে কিসের যেন শব্দ ওর কানে আসছিলো.মায়ের হালকা হালকা কোঁঠানোর শব্দ.আর চুড়ি তে চুড়ি ঘষার ঠকঠক শব্দ.
যেন মা হালকা ফিনফিনে গলা করে “মমমম” “মমমম”মমমম” আওয়াজ করছে আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে আবার চুড়ি দিয়ে আওয়াজ করছে....
সুন্দর শহর কলকাতা. কত উঁচু উঁচু অট্টালিকা, উঁচু উঁচু ইমারত. সুন্দর আলো বাতি. ঝাঁ-চকচকে রাস্তাঘাট. কত ব্যস্ত মানুষ জন. সারাদিন রাত ছুটোছুটি. জীবন জীবিকার স্বার্থে এদিকে ওদিকে দৌড়ঝাঁপ. শুধুমাত্র একটা স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য.
তিলোত্তমা শহর কলকাতা. রকমারি আলোর রাত্রি. বাস- ট্রাম ও হলুদ ট্যাক্সির পেঁচ পেঁচানী.
বহু মানুষ ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ধর্ম, তারা এই শহরে আসে চোখে এক উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে. স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন ও জীবিকার আশায়. তাদের মধ্যে অনেকের হয়তো এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়. আবার অনেকেই আছে যাদের কাছে দিনে দুবেলা-দুমুঠো খাবারের যোগান ও স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়ায়.
জোটে না তাদের ভাগ্যে উঁচু উঁচু অট্টালিকা গাড়ি বাড়ি এবং স্বাচ্ছন্দ.
থাকতে হয় তাদের শহর বা শহরতলীর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার বস্তির মধ্যে. ছোট ছোট কাঁচা মাটির বাড়ি আর ভাঙ্গা টালির ছাদ. পানীয় জল এবং বিজলি বাতির নিত্য সমস্যা. ঝুঁকিপূর্ণ জীবন আর নিরাপত্তাহীনতা.
হ্যাঁ এই তিলোত্তমা শহর কলকাতার যেমন একটা সুন্দর দিক আছে ঠিক তেমনি একটা অসুন্দর দিকও আছে.
খেটে খাওয়া মানুষের মায়ানগরি কলকাতার বস্তি.
এই বস্তির অন্ধকার কুঠুরিতে জন্মানো আর তার অলিগলিতে বেড়ে ওটা বছর বারোর ছেলে সঞ্জয়.
বাবা পরেশনাথ পেশায় রিক্সা চালক আর মা সুমিত্রা বাড়ি বাড়ি পরিচারীকার কাজ করে.
সঞ্জয় ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে প্রতিদিন সকাল বেলা তার মা বাবা ঘুম থেকে উঠে তাদের প্রাতরাশ সেরে যে যার কাজে চলে যায়.
মা আসে দুপুর বেলা আর বাবা আসে সেই সন্ধ্যা বেলা তার রিক্সা টা নিয়ে.
মদ্যপায়ী বাবা সন্ধ্যা বেলায় মদ খেয়ে এসে সঞ্জয়ের মায়ের সাথে ঝগড়া ঝামেলা করে. অকথ্য গালিগালাজ দেয়.মাঝেমধ্যে নিজের স্ত্রীর গায়েও হাত তুলে দেয় পরেশনাথ.
সঞ্জয় ছোটবেলা থেকেই ভীতু, তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়.
তাই যখন ওর মাকে ওর বাবার কাছে মার খেতে দেখে, ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, মনের মধ্যে প্রতিবাদী ঝড় ওঠে কিন্তু কিছু বলতে পারেনা.
মাতাল বাবার ওই রূপ দেখলেই থরথর করে কাপে.
ক্রন্দনরত মাকে দেখলে মনে খুব কষ্ট হয়.
ঘরের বাইরে বেরিয়ে অনেক দূরে চলে যায়. রেল লাইনের ধারে যেখানে বস্তি গুলো শেষ হয়েছে. ওখানে চলে যায়.
কিছু দূরে রেল সোঁ সোঁ শব্দ করে তাদের বস্তির পাশ দিয়ে পেরিয়ে চলে যায়. সেটাকে দেখে ঘরের অশান্তি সাময়িক ভাবে ভোলার চেষ্টা করে.
বাবার ওপর খুব রাগ হয়, ক্ষোভে ফেটে পড়ে.
পরক্ষনেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়. মায়ের জন্য খুব চিন্তা হয় .মাকে খুব ভালোবাসে.
সুমিত্রাও ছেলে সঞ্জয়কে খুব ভালোবাসে. সে চায়না তার ছেলে কোনো রকম কষ্ট ও অবহেলায় মানুষ হোক.
সে জানে বস্তির পরিবেশ খুব খারাপ. সেখানে অনেক খারাপ মানুষের আনাগোনা. সে চায়না তার ছেলে ঐসব লোকের সাথে মিলে মিশে একটা খারাপ মানুষ তৈরী হোক .
বিশেষ করে সুমিত্রা একদমই চায়না যে ওর ছেলে ওর স্বামীর মতো মাতাল ও দুশ্চরিত্রের মানুষ তৈরী হোক.
সে নিজে একজন নিরক্ষর মহিলা হলেও লেখাপড়ার গুরুত্ব জানে. তাই ছেলে সঞ্জয়কে বহু কষ্টের মধ্যেও সরকারি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার করে হাই স্কুলে ভর্তি করেছে. ছেলের যাতে লেখাপড়া ঠিক মতো হয় তার জন্য নিজের কষ্ট করে উপার্জনের টাকা করি দিয়ে একটা টিউশন এর ব্যবস্থা করেছে.
বিকেলবেলা সে যখন পরিচারীকার কাজে যায় সঙ্গে করে ছেলে সঞ্জয়কে নিয়ে গিয়ে ওই প্রাইভেট টিউশনএ দিয়ে আসে আবার ফেরার পথে ছেলেকে সাথে করে নিয়ে আসে.
সুমিত্রার স্বামী খুবই খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষ. সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যতটুকু আয় উপার্জন হয় তার প্রায় সর্বাংশ মদ ও জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয় .
সুমিত্রা যদি কখনো ওর স্বামীর কাছে টাকা পয়সা চেয়ে বসে তাহলে তাকে ওর স্বামীর কাছে অকথ্য গালিগালাজ শুনতে হয়.
একপ্রকার সংসারের সমস্ত দায়ভার তার উপর চলে এসেছে.
একদিকে তার পরিচারীকার কাজের স্বল্প আয় অন্য দিকে ছেলের লেখা পড়ার খরচ. তার উপর মাতাল স্বামীর অত্যাচার, জীবনকে এক কঠোর সংঘর্ষে পরিণত করে তুলেছে.
মাঝে মধ্যেই তার মনে হয় সব ছেড়ে বেড়ে দিয়ে কোথাও চলে যায়. আবার এক দুবার এটাও মনে হয় যে আত্মহত্যা করি. কিন্তু তা করতে পারেনা সে.
ছেলের মুখে চেয়ে, সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে আছে. ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ হতে দেখতে চায়, তার বিশ্বাস ছেলে একদিন বড়ো মানুষ হয়ে দাঁড়াবে .
তাই শত কষ্টেও হাঁসি মুখে সব কিছু সহ্য করে আসছে.
সারাদিনে চার ঘরে পরিচারীকার কাজ করে যত টুকু উপার্জন করে তাতে তার সংসার চলে না.
তাই পাড়া প্রতিবেশীর আরও সব মহিলাদের বলে রেখেছে যে, কোনো রকম কাজের সন্ধান পেলে তাকে জানাতে.
যতদিন না সঞ্জয় বড় হচ্ছে, গায়ে গতরে তাকে খেটে টাকা পয়সার জোগাড় জানতি করে রাখতে হবে. স্বামীর উপর আর ভরসা নেই তার.
দিনদিন পরেশনাথ আরও মাতাল আর জুয়াড়ি হয়ে উঠছে. বৌকে একদম ভালোবাসে না সে.
আর ছেলে টাকেও কোনো রকম তোয়াক্কা করেনা. ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেয় তার . শুধু মদ আর মদ.
মাঝে মধ্যে যখন পরেশনাথ সাদা চোখে থাকে, সঞ্জয়ের মা তাকে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁ গো... তুমি প্রতিদিন এমন করে এতো মদ খাও কেন??
পরেশনাথ তখন তার খসখসে কর্কশ গলায় বলে, “ধুর.... শালা সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করি.... এক জায়গার মানুষকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দি... শেষে শালারা ঠিক মতো ভাড়া দেয়না... চাইলে অপমান করে গালাগালি করে... যতসব বাবুর দল... আমাদের মতো গরিব মানুষদের তু তুকারি করে.... সম্মান দেয়না..... কি করবো আমরা গরিব বলে মানুষ না.... আরে আমরা খেটে খাই... তোদের মতো ঘুষখোর নই... শালা বড়োলোক বাবুর দল”.
সুমিত্রা চুপ করে তার স্বামীর কথা শোনে.... আর মনে মনে ভাবে, “হয়তো তার স্বামীর এই মদ খাওয়া সারাদিন তার সাথে ঘটে যাওয়া নানা রকম অমানুষিক কৃত্যের ফল, স্বামী হয়তো মদ খেয়ে সব কিছু ভুলতে চায়.... সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসন্নতাকে মদের মাধ্যমে দূর করতে চায়”.
সঞ্জয়ের বাড়িটা মাটির তৈরী টালির চাল, দুটো রুম, সামনের ঘরটায় এখন ও থাকে আর ভেতরের ঘরে বাবা মা .
সারাদিন স্কুল আর বন্ধুদের সাথে দৌড়া দৌড়ি করে কেটে যায় দিনকাল.
বাবার রিক্সার পুরোনো টায়ার চালিয়ে চালিয়ে বস্তির এ মাথা থেকে ও মাথা ঘোরা ফেরা করা তার কাজ.
তবে বস্তির অন্য পাড়ায় সে যায়না কখনো, সেখানকার দুস্টু ছেলেরা তার টায়ার গাড়ি কেড়ে নিয়ে তাকে মারধর করতে পারে. ঐসব দুস্টু ছেলেদের ভয় পায় সে.
তার মা তাকে নিষেধ করেছে ওই পাড়ায় যেতে আর মা এটাও বলেছে যে টাউনের দিকে ভুল করে কখনো যেন না যায়, রাস্তাঘাটের দুস্টু ছেলেধরা তাকে ধরে নিয়ে চলে যেতে পারে.
মায়ের কথা খুব মানে সঞ্জয়, কারণ সে জানে মায়ের কথা অবমাননা করলে তার মা তাকে বকাঝকা করতে পারে এবং মারও দিতে পারে.
মা তাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি তাকে খুব শাসন ও করে. তার মা খুব রাগী.
পাড়ার আরও ছেলেরা যেমন তুষার, রফিক, আসলাম এরা সব সঞ্জয়ের বন্ধু. তাদের মধ্যে রফিক খুব ধূর্ত ছেলে, মুখে সবসময় নোংরা খিস্তি লেগে থাকে.....তাছাড়া রফিক ছেলেটাও সঞ্জয়, তুষার আর আসলামের থেকে বয়সে বড়, ওর বয়স এখন পনেরো বছর.
রফিকের বাবা আনসার রঙের কাজ করে আর মা আমিনা পাড়ার একটা হোটেলে রাঁধুনির কাজ করে .
সঞ্জয়ের এখনো মনে পড়ে... ওর মা একবার ওকে খুব বকে ছিল রফিকের সাথে মেলা মেসা করে বলে.
একবার রফিক, সঞ্জয় ও বাকি ছেলেদের নিয়ে কোনো এক বাবুদের বাড়ি গিয়েছিলো চুরি করবে বলে. সঞ্জয় না বুঝেই তাদের সাথে চলে গিয়েছিলো, খেলার ছলে.
পরে সে জানতে পারে রফিক পাঁচিল টপকে ওই বড়ো বাড়িটাতে কি যেন চুরি করতে চলেছে.
সঞ্জয় খুব ভয় পেয়েছিলো সে সময়.
কিছু না বুঝেই সজোরে দৌড় দিয়েছিলো তার নিজের ঝুপড়ির দিকে.
ঘরে মাকে ব্যাপারটা জানাতে, মা তার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে ছিল.
সেদিন থেকে সঞ্জয় প্রন নেয় যে রফিকের সাথে সে আর মেলামেশা করবে না.
আসলাম, সঞ্জয়ের খুব ভালো বন্ধু ওরা দুজনেই একই সাথে একই স্কুলে পড়ে. আসলামের বাবা সালাউদ্দিন ট্যাক্সি চালায় আর মা শামীমা, সঞ্জয়ের মায়ের মতো পরিচারীকার কাজ করে.
আসলামরা গরিব হলেও ওদের অবস্থা কিছুটা ভালো সঞ্জয় দের থেকে কারণ আসলামের বাবা মদ ভাঙ্গ খায় না.
তাছাড়া আসলামের বাবার আয় উন্নতি পোরেশনাথের থেকে যথেষ্ট ভালো.
তাই সঞ্জয় অনেক সময় আসলামের কাছে থেকে ছোটোখাটো জিনিস যেমন খেলনা, সামগ্রী, বইপত্র ইদ্যাদির সাহায্য পেয়ে থাকে.
সঞ্জয় ও এই বয়স থেকে বেশ খুদ্দার ছেলে, ওর মা ওকে শিখিয়ে রেখেছে যে, কারো কাছে কোনো জিনিস যেন সে এমনি এমনি না নেয়, বিনিময়ে কিছু দিয়ে দেয়....
তাই সঞ্জয় ও.....যখন ওর মা ওকে টাকা পয়সা দেয় তখন কেক বিস্কুট কিনে নিজেও খায় আর আসলাম কেও খাওয়ায়.
সঞ্জয় পড়াশোনা তেও বেশ মনোযোগী... সন্ধ্যা বেলা যখন ওর মা রান্না করে তখন ও ওদের ছোটো উঠোনের মধ্যে বসে জোরে জোরে বই পাঠ করে .
এইরকম শহরতলীর মধ্যে গড়ে ওটা ছোটো ছোটো অগুন্তি বস্তির মধ্যে কতই না সঞ্জয় আছে আর কতই না সুমিত্রার মতো মায়েরা আছে.
যারা দিন আনে দিন খায়... আর চোখে বড় হবার স্বপ্ন দেখে.
একদিন সন্ধ্যা বেলা সঞ্জয় খেলাধুলা করে... বাড়ি ফিরে এসে দেখে... ঘরের দরজার সামনে ওর মা বসে আছে.
একটু উদাসীন... কি যেন চিন্তা করছিলো.. একটা হাত গালের মধ্যে দিয়ে আর মুখটা মাটির দিকে নামিয়ে.
সঞ্জয় তার চিন্তিত মায়ের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলো. মাকে এইরকম দেখতে তার ভালো লাগেনা,
অনেক সময় যখন বাবা মায়ের ঝগড়া হয়, বাবা মাকে মারে তখন মা এই ভাবে বসে থাকে মন দুঃখী করে কিন্তু, এই কয়দিনে তো তাদের মধ্যে ঝগড়া ঝামেলা হয়নি,
তাহলে মা এমন করে কেন বসে আছে.
একটু ভাবতে লাগলো সে.
অবশ্য...মা একটু হাঁসি খুশিতে কম থাকে...বাবার ঐরকম অবস্থার জন্য...তবুও এভাবে মাকে স্থির হয়ে চিন্তা ভাবনা করতে খুব কমই দেখেছে সঞ্জয়.
একটু স্তম্ভিত থাকার পর সঞ্জয়.
সামনের কুয়ো থেকে জল তুলে... তা দিয়ে নিজের হাত পা মুখ ধুয়ে নিয়ে.. আবার তার মায়ের মুখের একবার দিকে চেয়ে দেখলো .
তারের মধ্যে রাখা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মাকে প্রশ্ন করলো...”কি হয়েছে মা...তুমি এমন করে বসে আছো কেন.....?
“কিছু না রে এমনি...” সুমিত্রা তার ছেলেকে বলে উঠল.
ছেলে এখন শিশু...তাকে এভাবে নিজের মনের অশান্তির কথা জানানো ঠিক হবে না.
মনে মনে বলতে লাগলো সঞ্জয়ের মা.
কি ভাবে বলবে যে আজ সে তার একবাড়ি কাজ হারিয়েছে... কারণ সে বাড়ির লোকজন কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে.
একটা বাড়ির কাজ হারানো মানে...মাসিক আয়ের প্রায় চারআনা ভাগ কমে যাওয়া.তার সাথে একটা বাড়তি চাপ আর দুশ্চিন্তা.
বেশ কয়েকটা মাস হয়ে গেলো...সঞ্জয়ের টিউশন মাস্টারকে তার বেতন দেওয়া হয়নি.
সঞ্জয়কে দিয়ে বেশ কয়েকবার ওর টিউশন মাস্টার সুমিত্রাকে খবর পাঠিয়েছে বেতনের ব্যাপারে.
সুমিত্রা তাকে বেশ কয়েকবার আশ্বাস দিয়ে এসেছে যে...তার বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেবে খুব শীঘ্রই .কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি.
আরও দেরি করতে থাকলে হয়তো সঞ্জয়ের টিউশন পড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে.
এইতো দুমাস আগে সঞ্জয়ের বাবা পরেশনাথের অসুখ হয়েছিল তখন বাবু দের বাড়ি থেকে টাকা ধার করে সুমিত্রাকে তার চিকিৎসা করাতে হয়েছিলো.
এভাবে চলতে থাকলে...বিয়ের সময় বাপ্ মায়ের দেওয়া সামান্য গয়না গাটি আছে সেগুলোকেও বেচতে হবে...
দুয়ারের মধ্যে বসে, ভাবতে ভাবতে গালের মধ্য থেকে হাতটা সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্জয়ের মা....তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে.....পড়তে বস সঞ্জু...আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি.
সঞ্জয় মায়ের আদেশ গ্রাহ্য করে....বলে “হ্যাঁ মা...বসছি..”
ঘরের মধ্যে চাটায় বিছিয়ে...বই পত্র নিয়ে পড়তে বসে যায় সে.
বিড়বিড় করে পড়া আরম্ভ করে দেয়...মাঝে মাঝে পড়া থেমে যায়.
শুধু বার বার মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে....কিছু যেন লুকাচ্ছে মা...টাকা পয়সার ব্যাপারে কি...
সঞ্জয় ছোট হলেও বোঝে মায়ের কষ্ট গুলো....তাই মনে মনে বলে...মায়ের কাছে কখনো আর অযথা বায়না করবে না.
আজ সন্ধ্যাবেলা হয়ে গেলো....বাবা এখনো অবধি ফিরলো...নির্ঘাত আজ হয়তো বাবা মদ খেয়ে আসবে.
মায়ের সাথে অশান্তি করবে.
বুকটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠল অশান্তির কথা ভেবে.
হঠাৎ দেখে ওর মা আসছে...ওর জন্য খাবার নিয়ে.তাড়াতাড়ি আবার জোরে জোরে পড়া শুরু করে দেয় সঞ্জয় .
মা যদি দেখে যে, সে বই খুলে আকাশ কুসুম চিন্তা করছে, তাহলে বেজায় রেগে যাবে.
তাই সে মনোযোগ দিয়ে পড়ার ভান করতে লাগলো.
“এই নে সঞ্জু....মুড়ি টা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, দিয়ে আবার পড়তে বসবি...”.বলে সুমিত্রা ওর ছেলেকে খাবার দিয়ে, রান্না ঘরে চলে গেলো.
সঞ্জয় হাতে করে মুড়ি খাওয়া সবে শুরু করেছে, তখনি ওর বাবা কেঁচোর কেঁচোর শব্দ করে রিক্সাটা নিয়ে বাড়ি ফিরলো.
সঞ্জয় মাথা তুলে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাবা কি আজ সত্যিই মদ খেয়ে এসেছে..না...আজ বোধহয় বাবা মদ খাইনি..
পরেশনাথ কে দেখে সঞ্জয় আবার পড়াশোনায় মন দেয়.
ওদিকে সুমিত্রা দেখে ওর স্বামী আজ সাদা চোখে বাড়ি ফিরেছে...মনে মনে ভাবলো, তাহলে ছেলের টিউশোনের টাকাটা চাওয়া যাবে.
সুমিত্রা একটা গ্লাসে করে জল নিয়ে গিয়ে পরেশনাথকে দেয়, আর একটু আড়ষ্ট ভাব নিয়ে বর কে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যা...গো আজ তোমার ভাড়া কেমন হয়েছে...? “
ঢক ঢক করে জল খাওয়ার পর .
পরেশনাথ গম্ভীর গলায় বলে, “কেন....কি হয়েছে....আজ তুমি আমার ভাড়ার কথা...জিজ্ঞাসা করছো....”.
“না ওই হাতে এখন আমার টাকা কড়ি নেইতো আর কাজের ঘরে মাইনে হয়নি এখনো ....তাই বলছিলাম....” বলে সুমিত্রা একটু চুপ করে রইলো. তারপর আবার বলল, “আসলে ছেলের টিউশন এর টাকা অনেক দিন ধরে বাকি পড়ে আছে...দেওয়া হয়নি...সেদিন মাস্টারমশাই টাকাটা চাইছিলো...তাই বলছিলাম...তোমার কাছে থাকলে দিয়ে দিতাম....”.
পরেশনাথ, ওর বউয়ের কথা শুনে একটু বিরক্ত হলো, বলল “না আজ ঠিক মতো ভাড়া হয়নি....আর আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই”.
সুমিত্রা আবার একটু বিনতীর স্বরে বলল, “দেখো না...যা হয়...তাই দাও...টাকার অভাবে ছেলের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে এটা ঠিক হবে না “.
পরেশনাথ উঠে পড়ে....সুমিত্রাকে ধমক দিয়ে বলল, “বললাম তো...আমার কাছে একটা কানাকড়ি ও নেই....তা ছাড়া...তুমি ওকে পড়াচ্ছ কেন...বার বার বলেছি যে লেখাপড়া গরিবদের জন্য নয়...ও রিকশাওয়ালার ছেলে বড়ো হয়ে রিক্সাওয়ালায় হবে”.
মায়ের উপর বাবার ধমক, পড়তে পড়তে সঞ্জয়ের কানে আসে.
মনে মনে বলে হে ঠাকুর আজ যেন বাবা মাকে না মারে...
ওদিকে সঞ্জয়ের মা ও ভেবে নিলো যে....ওর স্বামীর কাছে কোনো রকম টাকা পয়সার সাহায্য পাওয়া যাবে না.
তাই সে আবার রান্নাঘরে গিয়ে নিজের কাজে মন দেয়.
পরেশনাথ ও নিজের পোশাক বদলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে.
পরদিন সকাল বেলা, পরেশনাথ নিজের রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে.সে সময় সুমিত্রা ঘরের রান্নাবান্না তৈরী করে ছেলেকে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়. আর নিজে পরিচারীকার কাজে বেরিয়ে পড়ে.
রাস্তায় যেতে যেতে সে ভাবে যে আজ দেখি বাবুদের ঘরে, কিছু অগ্রিম টাকা পাওয়া যায় কি না... এইতো কয়েকমাস আগে সঞ্জয়ের বাবার অসুখের সময় একটা বাড়ি থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে ছিলো কিন্তু তা এখনো শোধ করা হয়নি...তাই এবারে আর টাকা পাওয়া যাবে কি?
না পেলে ঘোর সংকটে পড়বে সঞ্জয়ের মা..
ভয় হয় তার...আরও জোরে জোরে হেঁটে কাজের বাড়ির দিকে যেতে থাকে.
ওদিকে সঞ্জয় স্কুলের ড্রেস পরে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে আসলামের বাড়ির দিকে এগোয়. আসলাম আর সঞ্জয় দুজন মিলে একসাথে স্কুল যায় .
যাওয়ার সময় আসলাম সঞ্জয় কে জিজ্ঞাসা করে, “কিরে তুই কয়েকদিন ধরে টিউশন পড়তে যাচ্ছিস না?”
সঞ্জয়, আসলামের কথায় উত্তর দেয়, “যাচ্ছি না তার কারণ...আমার টিউশন এর বেতন অনেক দিন ধরে স্যার কে দিতে পারিনি... তাই সেদিন মাকে স্যার বলেছিলেন এভাবে টাকা না দিলে উনি আর আমাকে পড়াবেন না”.
আসলাম, সঞ্জয়ের কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিলো...তারপর আবার বলল..”হুম...কেন তোর বাবা টিউশন এর টাকা দেয়না??”
“না রে...আমার বাবা তো ঘরে কোনো টাকা পয়সায় দেয়না...বাবা শুধু মদ খায়, তুইতো জানিস” সঞ্জয় উত্তর দেয়.
আসলাম আবার বলে, “ঠিক আছে...শোননা...আমি না আমার আব্বা কে বলবো তোর টিউশন এর টাকাটা দেবার জন্য”
সঞ্জয়, আসলামের কথা শুনে খুশি হয়...”বলে..তোর বাবা খুব ভালো...উনি যদি আমার টিউশন এর টাকাটা দিয়ে তাহলে খুব ভালো হয়...আমি আবার টিউশন পড়তে যেতে পারবো”
দুপুর বেলা...সঞ্জয়ের মা...উদাস মনে কাজ করে বাড়ি ফেরে,
এবার কাজের বাড়ি থেকে অগ্রিম টাকা পায়নি...তাই একটু চিন্তিত ছিলো সে.
একবার ভাবলো যে.. সন্ধ্যাবেলা টিউশন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে বিনতি করে আসবে, ছেলেকে পড়ানোর জন্য...
কিছক্ষন পর সঞ্জয়ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসে.
মাকে আবার উদাসীন দেখে মন খারাপ হয়ে যায় তার.
বলে, “মা আজ আমি...আসলামকে বলেছি...ওর বাবা...আমার টিউশনের টাকা দিয়ে দেবে বলেছে...তুমি মাইনে পেলে...শোধ করে দিও..”
ছেলের কথা শুনে মনে মনে ভেঙে পড়ে সুমিত্রা...শেষ পর্যন্ত...ছেলের লেখাপড়ার জন্য পাড়া প্রতিবেশীর কাছে থেকে টাকা ধার চাইতে হবে...
সঞ্জয়ের মায়ের ধারণা এই বস্তির লোকজন খুবই স্বার্থপর হয়...এদের কাছে টাকা ধার নেওয়া একদম উচিত না.
ধমক দিয়ে সঞ্জয় কে বলে, “থাক তোকে আর লেখাপড়া করতে হবে না...ওতো লোকের কাছে আমি টাকা ধার নিয়ে পড়াতে পারবো না...তোর বাবা ঠিকই বলে...গরিবের আবার লেখাপড়া কিসের...ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে...”
মায়ের কথা শুনে সঞ্জয় ঘাবড়ে উঠে....মনে মনে বলে...আজ মা হয়তো কাজের ঘর টাকা পয়সা পায়নি...তাই...হতাশ হয়ে...রেগে যাচ্ছে.
মায়ের খুবই কষ্ট...বাবাও কষ্ট দেয় আর আমিও কষ্ট দিচ্ছি...
সে মনে মনে আবার বলে বড়ো হয়ে আমি মায়ের সব কষ্ট দূর করবো...
“ঠিক আছে মা...আমি টিউশন পড়তে যাবনা...ঘরেই নিজে নিজে পড়ে সব মুখস্ত করে নেবো... তুমি চিন্তা করোনা..” বলে সঞ্জয় স্কুলের জামাকাপড় বদলে...খেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে.
ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়...বেশি দেরি করলে আবার হয়তো মায়ের কাছে বকা খেতে হবে...
বাড়ি ফেরার কিছক্ষনের মধ্যেই বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শুনতে পায় সঞ্জয়.
খাটের মধ্যে ওর মা বসে ছিলো...মা ছেলে একে ওপরের মুখের দিকে তাকায়.
সঞ্জয় বাইরে বেরিয়ে যায় দেখে...আসলাম আর সাথে একটা লম্বা ফর্সা আর রোগা লোক, থুতনির নিচে লম্বা দাড়ি...এটা নিশ্চয় আসলামের বাবা.
আসলাম হাঁসি মুখে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “সঞ্জয় এটা আমার আব্বুজান...তোর কথা আমি আব্বুকে বলে ছিলাম তাই তিনি এসেছে...”
সঞ্জয়, আসলামের বাবার দিকে তাকিয়ে হাঁসে...লোকটার মুখটা দেখে খুব ভালো মানুষ বলে মনে হলো সঞ্জয়ের.
ঘরের মধ্যে গিয়ে মাকে ডেকে আনে সে, “মা দেখো আসলাম আর ওর বাবা এসেছে...কি বলতে চায় তোমাকে...”
সুমিত্রা নিজের কাজ ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসে.
আসলামের বাবা সঞ্জয়ের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে...একবার পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলিয়ে নেয়... তারপর ঢোক গেলে...
সুমিত্রা লোকটার ঐরকম চাহুনি দেখে নিজেকে অস্বস্তি বোধ করে...শাড়িটা ঠিক করে নেয় আর আঁচল দিয়ে নিজের উন্মুক্ত পেট ও নাভি ছিদ্রকে ঢেকে নেয়.
সড়গড় ভাবেই বলে উঠে, “হ্যাঁ বলুন কি বলছেন...?? “
সালাউদ্দিন এর মুখে হাঁসি ফোটে বলে “বেহেনজি...আমি...আসলামের বাবা....” “আসলাম বলছিলো ওর দোস্তের...টাকার দরকার আছে...টিউশনের জন্য...তাই এসেছিলাম”.
সঞ্জয়ের মা সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকায় তারপর উত্তর দেয়...”না না...টাকা পয়সার...দরকার ছিলো কিন্তু...এখন আর নেই...”.
সালাউদ্দিন আবার মুচকি হাঁসে...বলে, “ঠিক আছে...বেহেনজি...কোনো অসুবিধা...নেয়...আসলে আমরা গরিব আদমি...ঝুপড়িতে থাকি..আর মানুষ...মানুষকে মদত করবে নাতো কে করবে বলো...”
সুমিত্রা কোনো উত্তর দেয়না...
আসলামের বাবা আবার বলে..”আচ্ছা আমি চলি...তুমি আমার বহিনের মাফিক আছো..কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও...সাথে থাকবো...”
সুমিত্রা বলে...”হ্যাঁ দাদা নিশ্চই..বলবো...আপনাকে...আসবেন...আবার...”
আসলামরা চলে যাবার পর, সঞ্জয়ের মা ওকে আবার বলে...”শোন..সঞ্জয় এভাবে...ঘরের সমস্যা বাইরের কাউকে কখনো বলবিনা...কেমন...ওতে ওরা আমাকে আর তোর বাবাকে খারাপ মনে করবে...ঠিক আছে সোনা..কাউকে কোনো দিন বলবিনা”.
সঞ্জয় ও মাথা নেড়ে উত্তর দেয় “ঠিক আছে মা এবার থেকে আর বলবো না...’.
বলে সঞ্জয় নিজের বইপত্র নিয়ে পড়তে বসে যায়.
মা নিশ্চয় টাকা পয়সা জোগাড় করে নিয়েছে অথবা আসলামের বাবার কাছে থেকে সাহায্য নিতে চাইছে না...মনে মনে বলে সঞ্জয়.
পরদিন সকালবেলা সুমিত্রা সঞ্জয়কে বলে চল তোর মাস্টারমশাই এর সাথে কথা বলে আসি...
“কি বলবে মা” প্রশ্ন করে সঞ্জয়.
“বলবো আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন সব টাকা মিটিয়ে দেবো..”. বলল সুমিত্রা.
ঘর থেকে বেরোবার সময়ই পাড়ার এক মহিলা তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো...
সুমিত্রা বাইরে বেরিয়ে দেখে....অলকা মাসি...আর সাথে আরেকজন অপরিচিত মহিলা...দেখে মনে হলো...শহুরে.
“এই সুমি...তুই কাজ খুজঁছিলি না...” একটু ক্যাটক্যাটে গলায় বলে ওঠে অলকা.
সুমিত্রা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে...তারপর বলে, “হ্যাঁ মাসি....এই কদিন আগে একটা কাজ হারিয়ে...খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছি”.
“কাজের সন্ধান থাকলে বলো না...”.
“তার জন্যই তো এসেছি....”বলে অলকা ওই অপরিচিতা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখছেন...এই মেয়ে হলো সুমিত্রা....আমাদের বস্তির বৌ....স্বামী হলো একটা আস্ত
মাতাল...ঘর সংসার দেখে না...তারপর ছেলেও বড়ো হচ্ছে...সংসারের চাপ...পুরোপুরি এই মেয়ের উপর...কতই বা বয়স হবে সুমির ওই তিরিশ বত্রিশ”
তারপর ওই মহিলাটি সঞ্জয়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে...”তাইতো দেখছি....মেয়ে ভারী মিষ্টি দেখতে...”
কথাটি শোনার পর অলকা আবার ওর কেটকেটে গলায় বলে, “হ্যাঁ দেখুন না...কেউ বলবে সুমি...বস্তির বউ....বলুন তো....এতো সুন্দরী মেয়ে....গোটা বস্তিতে নেই...সুমি যেমনি মিষ্টি দেখতে তেমনি মিষ্টি স্বভাবের, শুধু ওর কপালটাই খারাপ....তানাহলে পরেশনাথের মতো ঐরকম মাতাল জুয়াড়ি..মরদ জোটে ওর ভাগ্যে...”
‘রাজরানীর মতো থাকা মেয়েকে কিনা পরের বাড়িতে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে বলুন তো...”.
অলকার কথাগুলোতে সুমিত্রা বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলো....
বলল, “থাক না...মাসি..এসব কথা, আমার জন্য কোনো কাজ আছে বলোনা”.
অলকা বলে, “তাইতো দিদিমনি এসেছেন...তোকে কাজে নেবার জন্নি”.
তারপর ওই মহিলাটি কথা বলা শুরু করলেন..”মা তুমি আমার বাড়িতে কাজ করো...কোনো অসুবিধা হবে না...টাকা পয়সার...ঘরে মাত্র দুইটি লোক...আমি আর আমার বৃদ্ধ স্বামী...এমনিতে আমার বাড়িতে তেমন বেশি কাজ নেয়...শুধু বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার আর কিছু না...তুমি করলে খুব ভালো হয়..করবে তো মা?? ‘
সুমিত্রা বলে, “কেন করবো না কাকিমা...এমনি তেই কয়েকদিন আগে একটা বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে ওই সময়টা ফাঁকাই চলে যাচ্ছে”
কথার মাঝে ওই বৃদ্ধ মহিলাটির নজর সঞ্জয়ের দিকে যায়.আর বলে, “মা সুমিত্রা এটা কি তোমার ছেলে...”
সুমিত্রা হেঁসে উত্তর দেয়...”হ্যাঁ ও আমার ছেলে...সঞ্জয়...”
মহিলাটি বলে, “বাহ্, ছেলে তো বেশ বড়ো হয়ে গেছে...পড়াশোনা করে তো...?? ”
সুমিত্রা বলে...হ্যাঁ ওকে হাই স্কুলে ভর্তি করেছি...
মহিলাটি বলে...”হ্যাঁ মা তোমার ছেলেকে পড়াচ্ছ খুব ভালো কথা...তা নাহলে...বস্তির ছেলেরা এই বয়সে সব...না না রকম অপরাধ মূলক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে...”
মহিলাটির কথা শুনে সুমিত্রার একটু রাগ হলো...তাতে সে কিছু আর প্রতিক্রিয়া দেখালো না..
ও জানে বস্তির মানুষের প্রতি লোকের চিন্তা ভাবনা কেমন...
শুধু হুম বলে চুপ করে রইলো...
তারপর মহিলাটা সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কি এখন আমার সাথে যেতে চাও...আমার বাড়ি দেখে আসবে চলো”
সুমিত্রা রাজি হয়ে যায়...তার আগে ছেলেকে মাস্টারের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে...
দেখলো সঞ্জয়ের টিউশন মাস্টারের বাড়ির ওই দিকেই মহিলাটির বাড়ি...
সুতরাং তাদের একসাথে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না..
সঞ্জয় আর সঞ্জয়ের মা প্রথমে টিউশন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে কথা বলে...সুমিত্রা অনেক কাকতিবিনতি করে ছেলেকে পড়ানোর জন্য বলে “এই মাসের বেতন পেলেই তাকে দিয়ে দেবেন”...মাস্টারমশাই ছমাসের টাকা বাকি...সেটার কথায় শুধু বলে চলেছিলেন ...অবশেষে রাজি হয়ে যান...এই শর্তে যে অর্ধেক টাকা আগামী পনেরো দিনের মধ্যেই দিয়ে দিতে হবে...সুমিত্রা সে মুহূর্তে কোনোকিছু না ভেবেই..মাস্টারমশাইকে টাকা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়.
টিউশন মাস্টার সঞ্জয় কে বলে দেয় যে পরের দিন যথা সময়ে টিউশন পড়তে চলে আসতে.
তারপর সঞ্জয় ও তার মা সেই মহিলা টার সাথে ওনার বাড়ির দিকে চলে যায়.
সেখানে সুমিত্রা ওই মহিলাটার সাথে ওনারদের বাড়িতে প্রবেশ করে যায়...আর সঞ্জয় সেই বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখেই, নিজের বস্তির দিকে চলে যায়.কারণ তার স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছিলো.
সঞ্জয়ের মা সুমিত্রা ও ভেবে নিয়ে ছিলো যে..এ মাসে তার বেতনের কিছু অংশ টিউশন মাস্টারকে দিয়ে দেবে...যাতে ওর ছেলের পড়াশোনা না বন্ধ হয়ে যায়..
তাতে এ মাসে ঘরে অনটন চলে আসলেও সে কোনোরকম সামলে নেবে...
আসতে আসতে দিন পেরিয়ে যায়...সঞ্জয় ও তার লেখাপড়া আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে.শিশুমন কি জানে দিন দুনিয়া আর সংসারের নির্মম খেলা.
ঐদিকে সুমিত্রা একটা একটা করে দিন গুনতে থাকে...নিজের মাস মাইনে হবার...দুশ্চিন্তা ও হয় কারণ মাস্টারমশাই কে দেওয়া প্রতিশ্রুতির দিন ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে.
সঞ্জয়ের যেদিন টিউশন পড়া থাকে...সেদিন টিউশন শেষে মায়ের ওই কাজের বাড়িটাতে চলে যায়..ও বৈঠকখানায় বসে থাকে আর মা কাজ করে...
শেষে মা ও ছেলে দুজন মিলে একসাথে বাড়ি ফেরে...
মায়ের ওই কাজের বাড়িটা সঞ্জয়ের খুব ভালো লেগে গিয়েছে...কারণ ওই বাড়ির মহিলা ওকে ভালো ভালো খাবার, কেক ও লজেন্স দেয়...যখনি যায় তখনি দেয়.
শুধু ওই বাড়ির বুড়ো লোকটাকে সঞ্জয়ের ভালো লাগেনা....উনি খুব উগ্র...সঞ্জয় কে দেখলে খেঁকিয়ে ওঠে...বস্তির গরিব ছেলে দের পছন্দ করে না সে.
সেদিন ছেলে সঞ্জয়, মাকে জিজ্ঞাসা করে “মা...আর কয়েকদিন বাদে পনেরো দিন হয়ে যাচ্ছে...মাস্টারমশাই কে টাকাটা দিতে হবে...”
ছেলের কথা শুনে সুমিত্রা বলে “হ্যাঁ রে...আমার মনে আছে..এই মাসের বেতন পেলেই তোর মাস্টারমশাই কে টাকা দিয়ে দেবো...”
সময় পেরোতে থাকে...সঞ্জয়ের মায়ের হাতে পয়সা আসে...সারা মাস লোকের ঘরে ঝিয়ের কাজ করে অবশেষে স্বল্প খানেক টাকা সে পায়...ওই দিয়েই সে খুশি...কারণ ছেলের বাকি থাকা টিউশনের পয়সা সে এই মাসে কিছুটা হলেও মেটাতে পারবে..
কিন্তু হতভাগা সুমিত্রার জীবনে সুখ লেখা নেয়.
সেদিন সন্ধ্যা বেলা পরেশনাথ আবার মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে...সুমিত্রার সাথে ঝামেলা করে...ওর কাছে টাকা চায়...কারণ সে আজ জুয়াতে অনেক টাকা হেরে গেছে...তার রাগ সুমিত্রার ওপর ঝাড়ে...
সুমিত্রা প্রানপন চেষ্টা করে টাকা না দেবার....সেসময় পরেশনাথ ওর গায়ে হাত তোলে...গালাগালি দেয়...বলে, “খানকিমাগী....তুই রেন্ডি গিরি করে অনেক টাকা কামাস...আজ দে তোর সব টাকা...আমি জুয়া খেলবো মদ খাবো...দে টাকা দে রেন্ডিমাগী....বড়ো বড়ো বাবুরা তোর এই গতর দেখেই তোকে কাজে রাখে...ওরা তোর এই রসালো শরীরের রস খায়...”
সঞ্জয় বাইরের ঘর থেকে সবকিছু শোনে....বাবার গালাগালি...মায়ের কান্না...বাবার অশ্রাব্য ভাষা তার বোধগম্যের বাইরে...কিন্তু মায়ের কান্না....মায়ের কান্না তার কাছে অনেক খানি গুরুত্ব রাখে...
সে নিজেও মনে মনে কেঁদে ফেটে পড়ে...সে অসহায়...মায়ের জন্য কিছু করতে পারে না..
পরেশনাথ...সুমিত্রার কাছে থেকে হাত মুচড়ে টাকা নিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়...
সঞ্জয় সে মুহূর্তে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়...ক্রন্দনরত মায়ের মাথায় হাত বোলায় চোখের জল মুছে দেয় আর বলে “কেঁদো না মা...কেঁদো না...আমি বড়ো হয়ে যাই তোমাকে অনেক সুখ দেবো...”
সুমিত্রা ও চোখের জল নিয়ে ছেলের দিকে তাকায় আর ভাবে...ছেলের কথা যেন সত্যি হয় ঠাকুর...ছেলে মরদ হয়ে তাকে প্রতিদিন অনেক সুখ দেয়..
এর পরে কয়েকদিন সুমিত্রাকে আবার চিন্তা গ্রস্ত লাগছিলো...সঞ্জয় সেটা দেখছিলো.
সে জানে ঘরে অশান্তি হলে মা বেশ কয়েকদিন এভাবেই মন খারাপ করে থাকে.
সেদিন মাস্টারমশাই ও টাকাটা চেয়েছিলো....সঞ্জয় কিছু বলেনি মাকে...ভাবছিলো এবার টিউশন ছেড়ে দেবে...
কিন্তু মা একদিন নিজেই টিউশন মাস্টারের সাথে কথা বলে আগামী দুদিনের মধ্যে টাকা দিয়ে দেবে বলে কথা দিয়ে এসেছে...
সেহেতু সঞ্জয়ের টিউশন বন্ধ হয়নি....একদিন রোববার ছিলো...স্কুল ছুটি...কিন্তু টিউশন পড়া ছিলো...এবারও সঞ্জয় পড়া শেষে মায়ের ওই কাজের বাড়িতে যায়...ওই বাড়ির মহিলা সঞ্জয়কে ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়...
সঞ্জয় ওই বাড়িতে ঢুকে দেখে মা...ঘর মুচছে...
তাই সে ওখানকার বারান্দায় চুপ করে বসে রইলো...সুমিত্রা ওর ছেলেকে একবার বাড়ি চলে যেতে বলল কারণ আজ ওর দেরি হতে পারে..
সঞ্জয় ও ওর মাকে বলল যে আজ স্কুল নেয় তাই দেরি হলে অসুবিধা হবে না...
ছেলের কথা শুনে সুমিত্রা একটু অস্বস্তি বোধ করল কিন্তু আর কিছু বলল না...
তক্ষুনি ঘরের ওই মহিলা কিছু খাবার নিয়ে এসে সঞ্জয়কে দিলো...আর বলল..”তুমি এগুলো খাও আর মায়ের কাজ হয়ে গেলে মায়ের সাথে চলে যেও...”.
তারপর ওই মহিলা আবার সুমিত্রা কে একটা তেলের সিসি দিয়ে বলল “এটা নিয়ে তোর কাকুর হাত পায়ে একটু মালিশ করে দিস তো...আমি একটু বাজার থেকে আসছি...”
সুমিত্রা একবার ছেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালো....সঞ্জয় বারান্দায় বসে আপন মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে....
তখনি ঘরের মালিক ওই বুড়ো লোকটা উপর থেকে ভারী গলায় বলে উঠল “তুই বেটা আজকেও এসেছিস.....!!!”
“মাকে পাহারা দিতে....”
সঞ্জয় থতমত খেয়ে উপরে তাকালো...লোকটাকে দেখলে সঞ্জয়ের যত না ভয় হয় তার থেকে আরও বেশি রাগ হয়...
লোকটা তারপর সঞ্জয়ের মায়ের দিকে তাকায় আর বলে...”সুমিত্রা...তেলের শিশি টা নিয়ে এসো...তোমার কাকিমা বলল না যে আমার হাত পায়ে একটু মালিশ করে দিতে...”
সুমিত্রা আর কিছু না বলে উপরে বাবুর রুমে চলে যায়...
এদিকে সঞ্জয় খাবার খেয়ে কিছু ক্ষণ বসে থাকার পর মাকে ডাকার জন্য উপরে চলে যায়...
ঘরের মধ্যে সটান ঢুকে যায় আর দেখে...ওই লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে খালি গায়ে আর পরনে লুঙ্গি, ওর মা ওই লোকটার বুকে তেল মাখাচ্ছে...মা তেরছা করে বসে আছে বিছানার মধ্যে...
সঞ্জয় তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে যায়...সুমিত্রাও ছেলেকে পিছন ফিরে দেখে স্থির হয়ে যায়...তারপর লোকটা বলে “ওই দেখো তোমার গুণধর “
সঞ্জয় কিছু না ভেবে পেয়ে বলে, “মা...তুমি কখন যাবে...?? “
সুমিত্রা ছেলেকে আশ্বাস দেয়...বলে, “তুই যা নিচে গিয়ে বস...আমি এখুনি আসছি...”
সঞ্জয় একটু ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে আসে...আবার বারান্দায় বসে...ওর নজর তখন বাইরের গাছ পালা..ফুল ফল ইত্যাদির উপর...মা উপরে কি করছে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলো সে.
তারপর হঠাৎ মনে হলো ওর, যে অনেক খানি সময় পেরিয়ে গেছে, মা এখনো এলো না.
মা কি করছে এতক্ষন ধরে...ওই দাদুটাকে তেল মালিশ করছিল...এখন তো অনেক সময় হয়ে গেলো...মা এখুনি আসবে বলেছিলো...যায় একবার দেখে আসি...আর কতক্ষন সময় লাগবে...মাকে জিজ্ঞাসা করে আসি...
বলে সঞ্জয় একপা দুপা করে এগোতে এগোতে...সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো.
উপরে উঠেই সঞ্জয় একপ্রকার চমকে উঠল....উপরে ঘরের ভেতর থেকে কিসের যেন শব্দ ওর কানে আসছিলো.মায়ের হালকা হালকা কোঁঠানোর শব্দ.আর চুড়ি তে চুড়ি ঘষার ঠকঠক শব্দ.
যেন মা হালকা ফিনফিনে গলা করে “মমমম” “মমমম”মমমম” আওয়াজ করছে আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে আবার চুড়ি দিয়ে আওয়াজ করছে....